ভালোবাসার মৃত্যু

ভালোবাসার মৃত্যু

–নাহিদ, এখন থেকে আর আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনা
–কেন সাদিয়া ? আমি কি করেছি ?
— তুমি বেকার। কোনো চাকরি করো না।
–তুমি তো আমার সবকিছু জেনেই আমার সাথে সম্পর্ক করেছিলে ?
–তখন আবেগ ছিল কিন্তু এখন নেই। আর আমি এসব বাদ দিয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ দিতে চাই। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।
–তুমি এতে খুশি হবে ?
–হ্যাঁ হবো। আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনা।
–ধন্যবাদ সাদিয়া । ভালো থেকো।
–তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা না করলেই খুব খুশি হব।
নাহিদ আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সেখানে। হঠাৎ করে সাদিয়ার এমন কথায় সে স্তব্ধ। আসলে সাদিয়ার কথাগুলোই সত্যি। নাহিদের পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো না। তার আব্বু এক সময় অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে স্ট্রোক করায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে অনেক কষ্টে পরিবার চলছে।

পাবনার আমিনপুর নামক একটি গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। দুই ভাই, মা ও অসুস্থ বাবাকে নিয়ে পরিবার। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। তাই তার উপর আলাদা একটা চাপ রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী আর সাহসী। একমাত্র স্বপ্ন দেশের জন্য কিছু করা। সাহসী হলেও লাজুক স্বভাবের। আর মেয়েদের সামনে গেলেই তো হয়ে গেল। তাই মেয়েদের থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতো। ভুলেও সামনে যেতো না।

উচ্চ মাধ্যমিকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিত কলেজ যেতো। ঝড়-বৃষ্টি কিছুই আটকাতো না। পড়াশোনার প্রতি খুবই মনোযোগী ছিলো। তাই কোনো ক্লাসই বাদ যেত না। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আর প্রাইভেট ও পড়ার সুযোগও নাই। তাই ক্লাসই একমাত্র সম্বল।
একদিন সকাল থেকেই খুব ঝড় হচ্ছিল। কিন্তু ঝড়ের মধ্যেও সে কলেজে উপস্থিত। এসে দেখে কয়েকজন ছাত্রী ছাড়া কেউই আসেনি। কিভাবে একা একা এদের সাথে ক্লাস করবে ? পরে গেলো মহা বিড়ম্বনায়। কিন্তু ক্লাস তো ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তাই মনটা খারাপ করে বসে রইলো।
হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বললো –
— এই নাহিদ, কেমন আছো ?
— আপনি আমাকে তুমি করে কেন বলছেন ? এর অধিকার কি আপনাকে দিয়েছি ?
— একই সাথে পড়ি তুমি করে বললে সমস্যা কি ?
— আমি কি আপনাকে চিনি যে তুমি করে বলবেন ?
— আচ্ছা, আমরা বন্ধু হয়ে যাই। তাহলে তো তুমি করে বলতে পারবো ?
— একটা মেয়ে আর একটা ছেলে কখনও বন্ধু হতে পারে না ?
— কে বলেছে ? কেন পারেনা ?
— বন্ধু হলে কেউ না কেউ প্রেমে পড়বে। আর আমি তা চাইনা।
— এরকম কিছুই হবেনা।
— আচ্ছা যাই। ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে।
এভাবেই প্রথম দেখা হয়েছিল । কিন্তু প্রথম আলাপে কেউ কারো সাথে তেমন পরিচিতই হতে পারলো না।

তারপর প্রতিদিন অল্প অল্প কথা হতো । একসময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভালো বন্ধু হয়ে যান। বন্ধু বললে কম হবে। তার চেয়েও বেশী কিছু। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেই পারতো না। ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা, পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা নিয়মিত হতো। একজন কলেজে না আসলে অন্যজন চিন্তায় অস্তির হয়ে যেতো। এতো কিছুর পরও নিয়ম করে প্রতিদিন একবার ঝগড়া হতো। কিন্তু তার স্থায়িত্ব কয়েক মিনিট। দিন অনেক ভালোই চলছিলো।

একই উপজেলার কাশিনাথপুর গ্রামের এক উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে মেয়ে সাদিয়া। দেখতে পূর্নিমার চাদেঁর মতো। কিন্তু একটু রাগী। যে ভয়টার জন্য বন্ধুত্ব করতে চাইছিল না সেটাই হয়েছে। সাদিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিছু একই বয়সে তো ভালোবাসার শুভ সমাপ্তি সম্ভব না। যখন মেয়েটার বিয়ের কথাবার্তা চলবে তখন তো সে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকবে। আবার যদি ভালোবাসার কথা বলেন বন্ধুত্ত্ব নষ্ট হতে পারে। তাই ভালোবেসেও কখনও প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিলো।
দূর থেকে কি ভালবাসা যায়না ?

প্রতিদিনের মতো ক্লাসের ফাঁকে সাদিয়ার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। হঠাৎ সাদিয়া বললো-
— নাহিদ, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে
— কি কথা?
— আগে বলো রাগ করবে না ?
— রাগ করার মতো হলে করব। তুমি বলো ?
— না বলো রাগ করবে না ?
— আচ্ছা, করবো না!
— আমি তোমাকে ভালোবাসি।
— কি? মাথা খারাপ হয়েছে ?
— হ্যাঁ খারাপ। শুধুমাত্র তোমার জন্য।
— বন্ধু আছো বন্ধুই থাকো। এর চেয়ে বেশি আশা করো না। এখন যাই।
যা ঘটেছিল প্রত্যাশিত ছিলো না। সাদিয়া তাকে ভালোবাসে এটা তার কল্পনার বাইরে। ভালোবেসেও ফিরিয়ে দিয়েছিলো। প্রথমত উচ্চবিত্তের একমাত্র মেয়ে। মধ্যবিত্ত ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না। আবার সমবয়সী। সম্পর্কের শুভ সমাপ্তি সম্ভব নয়।

কিন্তু সাদিয়া কিছুতেই মেনে নিচ্ছিলো না। সারাজীবন অপেক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। দুই পরিবারকে রাজি করার দায়িত্ব নেয়। রাজি না হলে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ।
কিন্তু কয়েকদিনের জোরাজুরিতে রাজি না হয়ে পারলো না। শুরু হয় ভালোবাসার নতুন এক অধ্যায়। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেওয়া। পার্কে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, ফুসকা আর আইসক্রিম খাওয়া, সারারাত জেগে কথা বলা নিয়মিত রুটিনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এভাবে চলে যায় দুইটা বছর। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হয়ে যায়।

কিন্তু সময় পাল্টায় সাথে সাদিয়াও। আগের মতো কথা বলেনা। দেখা করতে চাইলে নানা অজুহাত দেখায়। কল দিলে ধরে না। রিং হতে হতে কেটে আসে। ভুলেও নিজে কল দেয়না। যদি কোনো সময় কল ধরে একটু কথা বলেই রেখে দেয়। নিজ থেকে কোনো সময় যোগাযোগ করে না। কিন্তু এই সাদিয়া একসময় সারারাত ঘুমাতে দিতো না। কিছুক্ষণ পর পর কল দিতো। অনেক খেয়াল রাখতো। কিন্তু এখন সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। গভীর রাতেও কল দিলে ব্যস্ত দেখাও। অনেক দিন দেখা হয়নি। অনেক করে অনুরোধ করায় পার্কে দেখা করতে এসেছিলো। আর এসেই এতোদিনের সম্পর্ক ভেঙে দিলো।

কয়েক বছর পর…
সেদিনের বেকার নাহিদ আজ মেজর জেনারেল নাহিদুল ইসলাম। সেনাবাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাড়ি-গাড়ি, অর্থ,সম্মান কোনো কিছুর কমতি নেই। তবে শান্তি অনুপস্থিত। জানে সাদিয়া ফিরবে না। তবুও অপেক্ষায় আছে। প্রতি বছর দুই ঈদে সাদিয়ার জন্য শাড়ি সহ অনেক কিছু কিনে। যখন মন চায় তখনই উপহার কিনেন। কিন্তু তা আর দেওয়া হয় না। জমিয়ে রাখে।

তবে সাদিয়া জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। সফলও হয়েছে। আজ ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। এখনও বিয়ে করেনি। হয়তো তাদের পছন্দমত ভালো বর খুঁজে পাচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষিত, সুশ্রী চাকরিজীবী কন্যার জন্য উপযুক্ত বড় পাওয়া খুবই মুশকিল।

একদিন রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ অপরিচিত এক নাম্বার থেকে নাহিদের ফোনে কল আসলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে-
–হ্যালো নাহিদ?
–জ্বী, আপনি কে বলছেন?
— সাদিয়া
— সাদিয়া, এতদিন পর কিভাবে মনে হলো?
— কেমন আছো?
— বেচেঁ আছি
— ভালো নেই ?
— ইচ্ছা বা কারণ কোনটাই নেই
— কাল দেখা করতে পারবে?
— কেন?
— খুব দেখতে ইচ্ছে করছে?
— কেন?
— দেখা করবে না?
— কোথায় ?
— সেই পার্কে, বিকাল ৫ টায় অপেক্ষা করব
— হুম
— এখন রাখি
— হুম
সাদিয়ার কলটা প্রত্যাশিত ছিলো না। কিন্তু অজানা কারনে এতদিন পর কথা বলার সুযোগ পেয়েও কথা বলতে পারেনি।

এতদিন দিন পর সাদিয়া দেখা করতে চায়। কিন্তু কেন ? এমন প্রশ্ন মনে আসে। পরের দিন সময়মতো দেখা করতে যায়।
তখন সাদিয়া বলে-
— আমাকে ক্ষমা করে দাও
— তুমি কি অপরাধ করেছো যে ক্ষমা চাইছো? আর আমি ক্ষমা করার কে?
— তোমাকে অপমান করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সত্যিই অনেক ভালোবাসি। প্রতিটা মূহুর্ত তোমার জন্য কেঁদেছি।
— এতদিন কোথায় ছিলে ? আজ আমি বেকার নই, আগের মতো দরিদ্র নই তাই তোমার ভালবাসা ফিরে এসেছে ?
— না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভুল বুঝতেছ
— যদি বেকার থাকতাম? তখন কি ফিরে আসতে?
— এরকম কেন বলছো? ভালোবাসি তাই ফিরে এসেছি
— তোমার উপযুক্ত বর পাওয়া যাচ্ছে না তাই ফিরে এসেছো। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কখনও বিয়ে করব না। চলে যাও।
— প্লিজ ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না
— কাজ আছে যেতে হবে। ভালো থেকো।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে চলে আসলো। আর সাদিয়া চিৎকার করে কাদতে শুরু করল। নাহিদের চোখেও জল। সামনাসামনি কথা বলতে পারবে না তাই কাজের অজুহাতে চলে এসেছে।
সে মেয়েকে খুব বেশি ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটি ফিরে আসায় তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে। যখন বেকার ছিলো, টাকা-পয়সা ছিলো না তখন চলে গেছে। আজ ভালো চাকরি করে অনেক টাকা- পয়সার মালিক হয়েছে। তাই মেয়েটাও ফিরে এসেছে। মেয়েটা তার জন্য ফিরে আসেনি, এসেছে তার চাকরি আর টাকার জন্য। তাই ভালোবেসেও লোভী মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে সারাজীবন একা থাকার প্রতিজ্ঞা করেন।

অতঃপর .. মেয়েটার লোভের কারণে ঘটে এতোদিনের লালিত ভালোবাসার মৃত্যু ..!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত