চকলেটি প্রমিস

চকলেটি প্রমিস

আজ অনেকদিন,অনেকমাস আর অনেক অনেক বছর পর একটা পুরোনো অথচ অতিচেনা মুখ দেখা গেলো লেকের সেই বেঞ্চটাতে।যদিও চেহারার গঠনটা অনেকটাই বদলে গেছে,বয়সের ছাঁপ এখন স্পষ্টই বোঝা যায়।চেহারার সাথে একদম বেমানান একটা চশমাও আছে দেখছি।কি অদ্ভূদ দেখাচ্ছে।যে মেয়েটা একসময় স্পষ্ট আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন বলে নিজেকে নিয়ে বাহাদুরি করতো সেই মেয়েটাই কিনা আজ চশমা ছাড়া অচলপ্রায়।সত্যিই,প্র­­ক­ৃতি ভীষণ অদ্ভূদ।কার সাথে যে কী করা উচিত তা তার চাইতে ভালো আর কেই বা জানে।তবে লেকটা কিন্তু আর আগের মতো নেই। কিছুটা দূরে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে দৃষ্টি যেতেই চোখে জল চলে এলো।কত স্মৃতিই না ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।

নাহ্,এখন উঠতে হবে।বেশ অনেকক্ষণ ধরেই একা বসে আছি।এসব ভাবতে ভাবতে নিশা উঠে
হাঁটতে লাগলো।

বাহ্,একটা বাদামওয়ালাও পাওয়া গেলো।১০টাকার বাদাম কিনে নিয়ে হাঁটছে আর বাদামগুলোর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ভাবছে,সত্যিই বাদামের খোসা ছাড়ানোর ব্যাপারটা অত্যন্ত বিরক্তিকর।যদি কেউ এই বিরক্তিকর কাজটা করে দিতো,তাহলে বেশ ভালো হতো।
একহাতে বাদামের ঠোঙাটা আর অন্যহাতে একটা ব্যাগ।ব্যাগটাতে বেশি কিছু নেই।শুধু কয়েকটা নোট,একটা মোবাইল আর একটা চকলেটের বক্স।

‘আজ যদি অন্তত ব্যাগটা খালি করতে পারতাম তাহলে খুব স্বস্তি পেতাম।কিন্তু আমার স্বস্তিতে কার কিই বা যায় আসে?’ এমনটাই ভাবছে নিশা।গত ১৫বছর ধরেই তো এমনটা ভাবছে ও।ঠিক আজ থেকে ১৫বছর আগেই যে এই দিনটাতে তাকে প্রমিস করেছিলো,যে পরেরবার যখনই দেখা হবে তখনই বার্থডে গিফট হিসেবে তার এই প্রিয় চকলেটটা দেবে।
ছেলেটাকে সত্যিই খুব ভালোবাসতো নিশা।কিন্তু হঠাৎ করে যে কী হলো,নিশান অযথাই এড়িয়ে চলতে লাগলো ওকে।তারপর না জানিয়েই কোথায় যেনো উঁধাও হয়ে গেলো,খোঁজখবর নিয়ে পরে জানা গেলো যে সে নাকি লন্ডন চলে গেছে।আর হয়তো কখনো ফিরে আসবে না।
যোগাযোগের সব রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছিলো।প্রথম প্রথম যেনো কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলো না নিশা।কিন্তু পরিস্থিতির চাপে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিতে থাকে।

তবে কেন জানি সেদিন নিশানকে দেয়া প্রমিসটার কথা নিশা ভুলতে পারে নি।তাইতো এখনও ওর হ্যান্ড ব্যাগে একটা চকলেটের বক্স থাকে।কিছুদিন পর পরই একেকটা চকলেটের বক্স কিনে রেখে দেয় ব্যাগে। সেই চকলেট যেটা খেতে নিশান খুব ভালোবাসতো,আর হয়তো এখনও ভালোবাসে।কে জানে কখনো যদি অদ্ভূদভাবে তার সাথে দেখা হয়ে যায় আর সে তার দেয়া কথাটা রাখতে না পারে সেই ভয়েই হয়তো।
.
মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো।মা ফোন করেছে,বাবা নাকি অপেক্ষা করছে আমার জন্য,এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে।সন্ধ্যেও ঘনিয়ে এসেছে।লেকের এদিকটাতে এখন মানুষও কম।পাখির কিচিরমিচির ডাক কানে আসছে।আবছা অন্ধকার আর শেষ গোধূলী লগ্নের লাল আভা মিশে পরিবেশটা ভীষণ মায়াবি লাগছে।চোখের চশমার কাঁচটা মুছে নিলো নিশা।এমন দৃশ্য যে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।

নিশা দেখলো কিছু দূরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।শুধু এটুকুই বোঝা যাচ্ছে যে লোকটার চোখেও চশমা আছে।নিশা এগিয়ে গেলো।লোকটা তার বয়সী বলেই মনে হচ্ছে,একটু কথা বললে ব্যাপারটা মন্দ হয় না।
.
‘আজ প্রথমবার এসেছেন বুঝি?’ আস্তে আস্তে লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো নিশা।ওর কন্ঠস্বর শুনে লোকটা তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়ালো ওর দিকে l
.
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।নিশান এখানে কী করে এলো? দুজন দুজনকে দেখছে,দীর্ঘ ১৫ বছর পর।কী ভীষণ অদ্ভূদ সে দৃষ্টি!যেনো হাজারটা প্রশ্ন খেলা করছে।দুজনেরই চোখে জল।কিন্তু চশমার গ্লাস সেটা লুকিয়ে রাখছে অপরের দৃষ্টি থেকে।নিশান তো ছোটবেলা থেকেই চশমা পড়তো।এজন্য কলেজের দিনগুলোতে নিশা কতোই না মজা করতো ওকে নিয়ে।মনে হচ্ছে যেন সেইতো গতকালের কথা।
.
এখনও সেই অদ্ভূদ ফ্রেমের চশমা পড়ো?
.
নিশার এমন প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো নিশান।নিশাও হাসছে।নিশা হাসলে যে এখনও আগের মতো অসম্ভব সুন্দর টোল পড়ে ওর গালে সেটা দেখে ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিশান।এতোটা বছর এই চেহারাটা একবার দেখার কথা ভেবে ভেবে কতো নির্ঘুম রাতই না কাটিয়েছে সে।হাজারো নিশব্দ হাহাকারে প্রতিক্ষণে শ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে,কারণ ও কাউকে বোঝাতে পারে নি যে যা হয়েছে সেটা কখনোই করতে চায় নি ও।ভালো তো সেও বেসেছিলো।
.
সব ভুলে গিয়ে আজ আবারো নিশানের ইচ্ছে হলো এই মেয়েটার প্রেমে পড়তে।আপন করে নিতে চিরদিনের জন্য।কিন্তু সেটাও তো আর সম্ভব নয়।বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে যে।১৫ বছর আগে যেমন মা বাবার কথা রাখতে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো আর আজও ওর জীবনে অনধিকার প্রবেশের ভয়ে চুপ করে রইলো।
.
আর উদাস স্বরে উত্তর দিলো,
‘চশমার ফ্রেম নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো আর কাউকে পাই নি তো তাই।’
নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি ব্যাগটা থেকে চকলেটটা বের করলো নিশা।ঘটনার আকস্মিকতায় সবটা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ লেগে গেলো নিশানের।আরে এটা তো ওর ফেভারিট চকলেট। আসলে ও তো ভুলেই গেছিলো যে আজ ওর বার্থডে।চকলেটের প্যাকেটটা দেখে পুরোনো একটা প্রমিসের কথা মনে পড়লো নিশানের।বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলে নিশার দিকে।
মুখে একটা স্ফিত হাসি ফুটিয়ে নিশা বললো,’হ্যাপি বার্থডে নিশান।’
দুজনের দৃষ্টি পুরোপুরি আটকে আছে ভালোবাসার মানুষটার দিকে।এতো কাছে থেকেও যেনো দূরত্বটা অনেক।
.
সূর্যের লাল আভা ওদের উপর পড়ায় মায়াবী মানব মানবীর মতো লাগছে ওদেরকে।এদিকে প্রকৃতি হাসছে।ওরা ভাবছে একে অপরকে হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই।কিন্তু আজও যে দুজনই মণের মণিকোঠার আসনটিতে অপরকে সাজিয়ে রেখেছে,যে জায়গাটা আর কেউ দখল করতে পারে নি বা পারবেও না সেটা দুজনেরই অজানা।আর কে জানে হয়তো এই সত্যিটা চিরকাল অজানাই থেকে যাবে এই মানব মানবীর কাছে,হয়তো এমনটাই প্রকৃতির ইচ্ছে l

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত