পরশ

পরশ

মায়া আমাকে খুব মিনতি করে বললো আমাকে একটু ছুঁয়ে দাও, একবার শুধু আমি তোমার পরশ চাই দেখো এদিকে এভাবে মুখ নিচু করে রেখেছো কেন? প্লিজ নীল একটানা এতগুলো কথা বলে মায়া একটু থামলো, আমার ভিতর দিয়ে তখন হাজার মাইল বেগে এলোমেলো ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো।

প্রায় তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক আমাদের, ভালোবাসা বলছি না কারণ মাঝে মাঝে ওর কিছু ব্যবহারে মনে হতো এ ভালোবাসা নয় প্রেম! এ আঁকড়ে রাখা নয়, কোনমতে ভাসিয়ে দেয়া প্রেমের অধ্যায় চলছে আমাদের! মায়া আবারো বললো একটা চুমু দাও শেষবারের মতো! ঠোঁটে উথাল পাথাল ভাবছিলাম তখন “শেষবারের মতো ” শব্দগুলো শুনে কেমন যেনো হাহাকার করে উঠলো পুরনো হৃদয়! হ্যা তো! মায়ার সাথে “শেষবারের মতো” দেখা করতে এসেছি! ১৭ -১৮ বছর বয়সের এক তরুণের সামনে তার সমবয়সী তরুণী চুমুর আবদার করছে বার বার, শেষবারের জন্য! মায়া কে বললাম চলো হাঁটি, মায়া একরাশ প্রশ্ন নিয়ে আমার উঠে যাওয়া দেখে নিজেও উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে, আমরা একটা পার্কে এসেছি, বিদায় বলতে একে অপরকে!

কারণ সে থাকে শহরে আর আমি গ্রামে, মাধ্যমিকের পর তারা পুরো পরিবার শহরে চলে এসেছিলো! পাশাপাশি হাঁটছিলাম, মায়া আমার হাতটা ধরলো, ও কাঁদছে কিনা বুঝতে পারছি না, মেয়েরা বেশ আবেগী হয়! আমার অবশ্য কান্না পাচ্ছে না! পরশুর আগেরদিন রাতে পড়তে বসেছিলাম, দেখি ধীরে ধীরে আমার রুমে প্রবেশ করে বাবা যখন বললো জিসান আমাকে মাফ করে দিস বাপ তোর বোধহয় আর এইচ এস সি পরীক্ষা দেয়া হবে না। এতটুকু বলে বাবা থেমে ছিলেন সেদিনই পাঠ্যবইয়ে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিলাম মলাটে হাত বুলিয়ে! যাক ছেলেদের অতশত ভাবতে হয় না, যখন যা তখন তা!মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। স্বপ্ন ভেঙে গেলে ছেলেরা চিৎকার করে কাঁদতে পারে না, কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই সন্তপর্ণে মুছে নিতে হয় কেউ দেখার আগেই! নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি ভাইয়ার একার আয়ে সংসার চলেনা, চললেও কেমনে চলে তা একমাত্র “মা” ই জানে! বাবা অসুস্থ, মা ও অসুস্থ! ছোট ভাই টা পড়াশোনা করে।

মায়াকে সেদিন অনেক জড়তা আর একবুক খাঁটি ভালোবাসায় কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বিদেয় নিয়েছিলাম, তিন বছরে যাকে ছুঁয়েও দেখিনি আজ তার ত্বক স্পর্শ করে আমার কোনরকম অনুভূতি হয় নি, শুধু তার ইচ্ছা পূরণের জন্যই মায়া সেদিন কথা দিয়েছিলো, সুখ- দুঃখ দুটোই আমরা একসাথে সামলাবো! এরপর চার পাঁচদিনের ব্যবধানে সব ছেড়ে আমি সাত সাগর তেরো নদীর এপারে আর আমার মা,বাবা,বন্ধু প্রেম,ভালোবাসা,বোন, ছোট ভাই, আমার প্রিয় ঘর, আমার দেহটা ছাড়া সব, বাকী সবকিছুই শত আলোকবর্ষ দূরে মায়ার সাথে প্রতিদিন কথা হয়, মায়াকে বলি ঠিক কতোটা পাগলের মতো ঘুমানোর সময় মনে হয় এইতো ঘুমাবো আর ঘুম ভাঙলে দেখবো আমি বাড়ীতে, আমার খাঁটে, মা আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে চা খেতে ডাকছেন। এসব স্বপ্ন ছিলো, আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।

কিন্তু তা আর হয় না! দিনগুলো কী ভাবে কাটে সে গল্প করি না মায়ার সাথে, কত ভারী বোঝা পিঠে তুলতে হয় সেসব মাকে বলিনা, খেয়ে না খেয়ে এ বিদেশজীবন কিভাবে পার করি বাবাকে বলিনা কখনো, কত রাত নিশ্চুপ কেঁদে কেঁদে লালচে ফোলা চোখ নিয়ে সকালে কাজে গিয়েছি বোনকে বলি না, পিঠের ব্যথাটার জন্য সারারাত কাতরানো, জ্বরের ঘোরে মা মা প্রলাপ বকতে বকতে কপালে একটু স্নেহের পরশ ছাড়াই বিছানা আঁকড়ে পরে থাকার এক এক রাতের উপন্যাস গুলো সবার অজানাই থাকুক! তবে, মার সাথে কথা বলার সময় খুব সাবধানে থাকি, মা পাছে বুঝে যায়, সে ভয়ে থাকি! মা ভালো থাকুক! আর কিছু চাই না! হাসিমুখে সবার প্রয়োজনগুলো জেনে পূরণের চিন্তায় দিনরাত্রি গুলো কেটে যায় এভাবে অনাদরে।

একদিন মায়া কাঁদছিলো খুব, তার বাবা হঠাৎ করেই চাকুরিচ্যুত হয়ে যাওয়ায় ৫০ হাজার টাকা খুব প্রয়োজন, নয়তো তাকেও পড়াশোনা ছেড়ে কোথাও কাজ জুটাতে হবে, তার বড় ভাই নেই, নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি তাতে কী! কেউ যেন এমন স্বপ্ন ভঙ্গের সাক্ষী না হয়, আমি চাই না, এক ভাইয়ার কাছ থেকে ঋণ করে টাকা পাঠালাম আমার ভালোবাসাটার বাবার নতুন চাকুরির জন্য।

মায়া খুব খুশী হলো, সেদিন তার আনন্দের সীমা ছিলো না! সে বললো যতযাই হোক, আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না! ভালো লাগতো ওর কথা শুনে কিছুদিন পর ছোটভাই জানালো তার কিছু অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন, এদিকে আমি যা বেতন পাই সবটুকুই বাড়ী পাঠিয়ে দিই শুধু নিজের অত্যাবশ্যক খরচটুকু রেখে। সাতপাঁচ চিন্তা না করে বাকী মাসের নিজের খরচের টাকা সব পাঠিয়ে দিলাম, কী ভাবছেন? আমি কী করে ছিলাম বাকী সময়টুকু? এরপর সেটুকু বড় করুণ, না হয় নাই বলি! ওরা ভালো থাকুক! এভাবে দিন কাটতে থাকে, হুটহাট ওদের প্রয়োজনগুলোর তালিকা বাড়তে থাকে, কমতে থাকে আমার রাতের ঘুম, একটু বেশী কাজ না করলে বেশী টুকু কোথা থেকে জোগাড় করবো। ভাইয়া বিয়ে করবে, সঞ্চয় করছে। ঘর বাঁধতে ও তো হবে।

পরিবার? তাদের কী হবে? অমানুষিক পরিশ্রম বুঝেন? অমানুষিক পরিশ্রম করে উপার্জন গুলো একটা কাগজ সাক্ষী রেখে সবটুকু বাড়ী পাঠানোর নিয়মটার আজ তিনবছর চলছে! কদিন আগে বলেছিলাম বাড়ী আসব, ওরা না করে দিলো, বললো এখন না যেতে! আসলে মায়ের জন্য কেমন লাগে তা কেউ বুঝবে না! মাঝে মাঝে মনেহয় যদি পাখি হতাম! মায়া? সে উচ্চশিক্ষিতা হচ্ছে,  আমি তো এইচ এস সির দরজা ও পেরোতে পারিনি! আমাকে কী তার সাথে শোভা পায়? এমন আমি বলছিনা,ও এমনটা বুঝিয়েছে তার ব্যবহার দিয়ে, প্রতিনিয়ত আর আমি একটু একটু করে নীল হয়েছি,কষ্টে! বোনেরা? ও হ্যা, ওরা খবর নেয়। শেষে প্রয়োজন থাকলে কিছু বলে, বড় আপুর ছেলের জন্য কিছু টাকা লাগবে বলেছিলো। কোচিং ফি! ও একটু সমস্যায় আছে! পাঠিয়েছি! কী করে তা আর না বলি! পরিচিত অনেকেই টাকা পয়সা চায়, ওরা ভাবে বিদেশে থাকি বহু পয়সার মালিক, না বললে ভাবে মিথ্যা বলছি।

আমিও নিরাশ করি না, সব ছেড়ে যখন শ্রম দিতে এসেছি তখন অতিরিক্ত দিলেও কী? তারা ভালো থাকুক! এতক্ষণ চাঁদের সাথে গল্প করছিলাম! জীবনের গল্প শব্দটা বললে চাঁদ হাসে, জীবন যে আজো বাকী! মায়ের জন্য একগাছি স্বর্ণের চুড়ি নিয়ে বাড়ী যাবো বড় শখ আমার! চাঁদকে বলি চাঁদ শোনে! যদিও চাঁদ কোনদিন আমার হবে না, তাও মনেহয় কত কাছের, আমায় দেখে আমি ও দেখি, অভিমান হলে আড়াল হয় মেঘের পিছনে, কিন্তু আবার ফিরে আসে!

মায়ার মতো করে ছোট করে না আমায়, চাঁদ বলে “তুমি তোমার পরিবারের জন্য যা করেছো তা অনেক ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত হয়েও করতে পারে না, তুমি কখনোই কোন অংশে ছোট নও, নিজেকে কখনো ছোট বা দূর্বল ভেবো না, তুমি মহান নীল। আমি চাঁদের প্রেমে পরে যাই, তবে বলতে ভয় হয় চাঁদ যদি এমন শুনে আমাকে রেখে চলে যায়? চাঁদ তো কারো একার হতে পারে না! আমি চলি আমার পথে।

মা’র কথা ভাবলেই ভালো লাগে, থেমে যাওয়া যাবে না, মায়ের জন্য স্বর্ণের চুড়ি নিয়ে বাড়ী যাবো, মায়ের হাতের রান্নায় এক প্লেট গরম গরম ভাত কখন খাব মনে হলেই পিঠে ৩০ কেজির বোঝাও অনায়সে তুলতে পারি, তবে রাতে ব্যথায় জ্বর আসে, জ্বর আপনা আপনিই চলে যায় কপালে কেউ হাত দেয় না, কেউ জানেনা জ্বরের তীব্রতা কত ছিলো, শুধু আমি কুঁকড়ে যেতে থাকি! হাতের মধ্যে দলা পাকিয়ে ধরি বিছানার চাদর হয়তো আবোলতাবোল মা মা করে ক্ষীণ স্বরে ডাকতে থাকি!

সনাপ্ত

গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত