“অথয়” বড় স্বার্থপর মেয়ে!

“অথয়” বড় স্বার্থপর মেয়ে!

পড়ন্ত বিকেলের এই গৌধুলী লগ্নে সূর্যের রক্তিম আলোয় পরিবেশটা অনেকটায় শিল্পীর আকা পটের মত। আমি কফির মগ হাতে বেলকনির ইজি চেয়ারে বসে। আমার কবুতরগুলোও কেন জানি আজ বাধন হারা হয়ে ওঠেছে। আপন মনে অনেক উচুতে উঠছে আবার দিগবাজি দিতে দিতে নিচে নেমে আসছে। মনের অজান্তেই যেন আমার ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি। বেশ উপভোগ করছিলাম আমি। হঠাৎ আম্মুর ডাকে আমার এ সৌন্দর্য দেখায় ছেদ পড়ল। আমাদের বাসায় রুপক আংকেল আর আন্টি এসেছেন। তাদের সাথে কৌশল বিনিময় করে আমি আমার রোমে ফিরে এলাম। তখন আমার আঁখিতে এই বাদল নামল বলে। অনেক দিন হল আমার ডায়রি লেখার বদ অভ্যাসটা নেই। কিন্তু আজ আমি ডায়রিটা হন্য হয়ে খোঁজছি। ঐ ডায়রির নীল কাভারের মাঝে আমার নীল কষ্টগুলো লুকায়িত। আজ স্বার্থপর মেয়েটাকে খুব বেশী মনে পড়ছে। রুপক আংকেলের মেয়ে অথয়। অথই আসলেই একটা স্বার্থপর মেয়ে ছিল। অনেক বেশী স্বার্থপর। না হলে কি এত সহজেই ভূলে যেতে পারে? আমাকে ছেড়ে দুরে থাকতে পারে?

অথয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ক্লাশ ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিন্তু অথয় সবকিছু জেনে নিয়েছিল আমার সম্পর্কে। আসলে মেয়েরা একটু বেশী আপডেটেট হয়ে থাকে। আম্মু আর অথয়ের মা বাল্য বান্ধবী। আব্বু আর অথয়ের বাবাও তাই। আর কাকতালীয় ব্যাপার হল আমার আর অথয়ের সিট পাশাপাশি পড়েছিল। প্রথম দিন আম্মু আর আন্টি বলে দিয়েছিল আমরা যেন একজন আরেক জনকে দেখায়। অথয় আমারটা দেখে কপি করেছিল আমার প্রয়োজন পড়েনি। পরীক্ষার শেষদিন, আমি খাতা জমা দিয়ে হল থেকে বের হয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলছি। আবার কতদিন পরে দেখা হবে বলা তো যায় না। হঠাৎ অনুভব করলাম কে যেন আমার হাত ধরে টানছে। পাশে তাকাতেই দেখি অথয়। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা হাত ধরে টেনে গেটের বাহিরে । আম্মু আর আন্টি অথয়ের কান্ড দেখে হাসছে। আজ আর এসবের কিছুই মনে নেয় অথয়ের। ও যে স্বার্থপর । না হলে স্মৃতিগুলো কিভাবে ভুলে থাকে?

অথয়ের কারনেই আমি শহুরে স্কুলে ভর্তি হয়। আমি সাধারন বৃত্তি পেলেও অথয় টেলেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছিল। যদিও অথয় আমার লিখাই হুবহু কপি করেছিল। বাড়ি থেকে স্কুল এক ঘন্টার পথ। সাইকেল হল আমার বাহন। স্কুল থেকে অথয়দের বাসার দুরত্ব সাইকেলে গেলে দশ মিনিটের পথ। প্রতিদিন স্বুলে গিয়ে ব্যাগ রেখে অথয়কে তাদের বাসা থেকে নিয়ে আসতাম আবার ছুটি হলে তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরতাম। এটা আমার প্রতিদিনের রুটিনে পরিনত হয়েছিল। আমি যদি একদিন না আনতে ও সেদিন স্কুলেই আসত না। তবে এমনটা মাত্র একবারই ঘটেছিল। তারপর কোনদিন আর এর পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। কিন্তু অথয় সব ভুলে গেছে। ভিষন স্বার্থপর যে। বড় বেশী স্বার্থপর!

বন্যার পানিতে চারদিক থৈ-থৈ। আমি তখন ক্লাশ টেনে পড়ি। কলাগাছের ভেলায় ভেসে পুরো গ্রাম চষে বেড়ায়। অথয় সেবার গ্রামে এসেছিল পানি দেখতে। বিকালে চার পাঁচজন ছোট্ট ছোট্ট এ্যাডভেঞ্চার পিপাসুদের ভেলায় তুলে আমি প্রস্তুত উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের পথে। হঠাৎ অথয়ের ডাক।

– অনয় ভাইয়া আমিও যাব তোমার সাথে।

– চলে আস ভেলায়।

– সবাইকে নামিয়ে দাও।

– কেন? চল সবাই একসাথে যায়।

– না! তাহলে আমি যাব না।

তাই বাধ্য হয়ে সবাইকে নামতে বললাম। ওরাও সবাই হাসিমুখে নেমে গেল। আমি আর অথয় ভেলায় ভেসে চলেছি। অথয় পানিতে পা দুলাতে দুলাতে এসএসসি পাশের পর কোথায় ভর্তি হবে তার আগাম ধারনা দিচ্ছে। প্রথমে আমি তার কথায় অসম্মতি জ্ঞাপনে, ও একদম রেগে আগুন। তাড়াতাড়ি তার কথায় সম্মতি দিলাম পরে না আবার পানিতে ঝাপ দেয়। তারপর আরও কত কথা মুখে আউড়িয়ে চলেছে আর আমি বাধ্য শ্রোতার মত শোনে যাচ্ছি। হঠাৎ-ই অথয় চিৎকার দিয়ে আমার বুকে এসে আছড়ে পড়েছে। দুজনে পানিতে পড়তে পড়তেও শেষ রক্ষা হয়েছিল। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই হাতের ইশারায় তার পা দেখতে বলে। একটা জোঁক তার পায়ে আটকে আছে। রক্ত পান করে বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে গেছে। জোঁকটাকে অথয়ের পা থেকে আলাদা করতেই ক্ষতস্থান হতে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। চারপাশেই পানি, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে গায়ের গেঞ্জী ছিড়ে অথয়ের ক্ষতস্থান বেধে দেয়। তারপর…..

– আচ্ছা অথই তুমি যে আমার বুকের উপর আছড়ে পড়লে এটা যদি আমি সবাইকে বলে দেয়?

– একদম খুন করে ফেলব!

– কেন এটা তো সত্য কথা বললে দোষ কি?

– তোমার কিছুই বলতে হবেনা সময় হলে আমি-ই বলব!

– কি বলবে?

– কিছু বলব না। দেখে নিও একদিন সবার সামনেই তোমার বুকে আছড়ে পড়ব। তখন বুঝবে। এখন বাড়ি ফিরে চল।

স্বার্থপর মেয়েটার আজ এসবের কিছুই মনে নেই। আমায় ছেড়ে অনেক দুরে চলে গেছে। হয়ত অনেক সুখেও আছে?

একবার আমি অথয়কে কিছু না জানিয়েই বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। অথয় তার মার সাথে ওর খালামনিদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। তাই জানাতে পারিনি। আর অথয় জানতে পারলে আমার যাওয়াটাই বন্ধ হয়ে যেত। বাসায় ফিরে যখন শুনেছে আমি কক্সবাজার গিয়েছি অথই তার মার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। আন্টি নাকি প্লান করে ওকে তার খালামনিদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। যাতে ও আমার সাথে যাওয়ার বায়না না ধরতে পারে।

আমি সাতদিন পর বাড়িতে আসি। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সায় বাড়িতে আসার পথে দুর্ভাগ্যক্রমে রিক্সাটা উল্টে যায়। হাতে আর পায়ে বেশ ব্যাথা পেলেও প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই বাড়ি চলে আসি। মা আমাকে এ অবস্থায় দেখেই সবাইকে ফোন দিতে শুরু করে। খবর পেয়েই আংকেল আর আন্টিকে সাথে নিয়ে অথয় আমাদের বাড়িতে চলে আসে। আমাকে দেখে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরেছে। ভেলায় বলা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন। এলোপাতাড়ি ভাবে ওর কোমল হাতগুলো আছড়ে পড়ছে আমার বুকে। দেখ অথয় অনয় তো ব্যাথা পাবে কি হচ্ছে এসব। আন্টির কথায় ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা আমার রোমে। দরজা আটকে দিয়ে ফলকাটার ছুরি হাতে আমাকে খুন করবে বলে উদ্ধত। তার চোখ হতে বাদলের ধারা বয়ে চলেছে অবিরত। অনর্গল বলে চলেছে আমার কিছু হয়ে গেলে ওর কি হত। আমি প্রায় বিছানায় শুয়ে পড়েছি। ও থামছেই না। আমি অভাগ দৃষ্টিতে অথয়ের দিকে তাকিয়ে। ভাবছি রাগলে মেয়েদের এত সুন্দর লাগে।

হঠাৎ কি যেন ভেবে আমাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে। হয়তো আমি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম এজন্যই। অথয়কে আম্মুর ডাক আমাকে সাথে নিয়ে খাবার টেবিলে যেতে। দরজা খোলে বের হতে যাবে এমন সময় হঠাৎ ফিরে এসে আমার ওষ্ঠে তার আলতো চুম্বন। তারপর ঠোটের কোনে মিষ্টি হাসি এনে এক দৌড়ে খাবারের টেববিলে। আমি তখন নির্বাক তাকিয়ে। আজ সবি-ই শুধু স্মৃতি। শুধুই স্মৃতি।

আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার দুই দিন পর কোচিং থেকে ফেরার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। আর আমার অথয় এ পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে অন্য পৃথিবীতে। না ফেরার পৃথিবীতে। যে পৃথিবীতে যাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা এক অদৃশ্য রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু ফিরে আসার জন্য কোন রাস্তা তৈরি করেন নি। আর যারা যায় তারাও হয়তো সেখানকার সুখের মোহে ভূলে সৃষ্টিকর্তার নিকট কোন আর্জি জানায় না এ পৃথিবীতে আসার। স্বার্থপর! তারা বড় বেশী স্বার্থপর হয়ে যায় তখন। বড় বেশী স্বার্থপর!

তখন একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, তবে কি আমিও একদিন স্বার্থপর হয়ে যাব? হয়তো আমিও? হঠাৎ দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দে আমি সংজ্ঞায় ফিরে আসি। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে উঠে দাড়ায়। মসজিদ হতে সু-মধুর আযান ভেসে আসছে কানে। দরজা খোলতেই দেখি আম্মু দাড়িয়ে। অনয় তুই কাঁদছিস কেন বাবা? অপ্রস্তুত হয়ে, না মা চোখে কি যেন পড়েছিল। আম্মু আর এ নিয়ে কোন কথা বাড়ায় নি। মা তো।

সন্তানদের সবকিছুর অন্তরজামি। তোর আংকেল আন্টি চলে গেল তুই এলিনা, মাগরিবের নামাযও পড়তে গেলিনা তাই ডাকতে এলাম। এশার নামায পড়বি না? হ্যা আম্মু পড়ব। তুমি যাও আমি রেড়ি হয়ে আসছি। মাকে যেতে বলে আবারও দাড়ায় বেলকনিতে গিয়ে। চাদের আলো এসে আছড়ে পড়ছে। আকাশে তারাগুলোও বেশ উজ্জ্বল। অথয়ও হয়তো আছে এ তারাদের মেলায়। হয়তো দেখছেও আমায়। আবার আম্মুর ডাক, অনয় নামাযের সময় হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি কর। চোখের লোনাজল মুছে দ্রুত ওযু করে নিয়ে মসজিদের পথে পা বাড়ায়।

 

গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত