পথচলতি গল্প

প্রতিদিনের মতো আজকেও রীতিমতো যুদ্ধ করে অফিসের পথে রওনা হই। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের সামনে থেকে লেগুনায় উঠি। সেখান থেকে যাবো বনানীর অফিসে। গাড়িতে উঠেই দেখি, আমার ঠিক পাশের জনের সঙ্গে অপর পাশে বসা ভদ্রলোকের কী বিষয় নিয়ে যেন তুমুল ঝগড়া চলছে। বেশ উত্তেজিত দুজনই। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। বেশভুষা দেখে পাশের জনকে দেখে মনে হলো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

আর অপর পাশের জনকে অফিসযাত্রী। অফিসগামী ভদ্রলোকটি উত্তেজনার একপর্যায়ে বাংলা বলা রেখে ইংরেজি বলতে শুরু করেন। এই শুনে শিক্ষার্থীটি চুপ মেরে যায়। সম্ভবত শিক্ষার্থীটি ইংরেজিতে দুর্বল কিংবা ইংরেজিতে তর্ক করার ইচ্ছে তার নেই। সে যাই হোক, গাড়ি চলতে থাকে। চলার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনাও প্রশমিত হতে থাকে। একসময় সব চুপচাপ। কেবল গাড়ি চলার শব্দ ভাসে। এসময়ে কেউ আরামে ঝিমোয়, কেউ কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে গান শোনে, কেউ-বা সেই গতানুগতিক রাজা-উজির মারেন, দেশ উদ্ধার করেন। আমি চুপচাপ কথা শুনে যাই, দৃশ্যপট দেখে যাই। কিছু বলি না। কারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠে অপরিচিত কারো সঙ্গেই আমি কোনো বিষয়েই কোনো কথা বলি না। এটা আমার স্বভাবে নেই। তবে পরিচিত কেউ পাশে থাকলে কথা বলতে বলতেই পুরোটা রাস্তা পার করি।

প্রসঙ্গে আসি, ফিরে আসি আবার আজকের ঘটনায়। লেগুনা চলতে থাকে। শিশুবয়সী হেল্পার ভাড়া চাইতে থাকে একেকজনের কাছে। মহাখালী পর্যন্ত ভাড়া ১৭ টাকা, গুলশান গেলে ২২টাকা। সবাই ভাড়া পরিশোধ করে। আমি মহাখালীর ভাড়া দিই। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী কিছুতেই ভাড়া শোধ করতে পারছে না। কারণ, তার কাছে একটি মাত্রই ৫শ টাকার নোট আছে। সেই টাকার ভাংতি দিতে পারে না হেল্পার ছেলেটি। গাড়িতে বসা কারো কাছেই ৫শ টাকার খুচরো নেই। এদিকে ভাড়া না দিয়েও গাড়ি থেকে নামতে পারছে না সে। একসময় যথারীতি গাড়িটি বিজয় সরণিতে এসে যানজটে আটকায়। শিক্ষার্থী গাড়ি থেকে নেমে ঠিক পেছনেই দাঁড়ানো একটি সিএনজিওয়ালাকে টাকার ভাংতি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে, আশেপাশে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শিক্ষার্থীর মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ।

কিছুটা দিক্‌ভ্রান্তও মনে হলো। তার গন্তব্যও মনে হলো কাছাকাছি কোথাও। হেল্পার আবার তাগাদা দিলে হঠাৎ টাকা বাড়িয়ে দিলেন সেই অফিসযাত্রী। শিক্ষার্থীকে দেখিয়ে বললেন, উনার ভাড়াটি রাখো। এই দেখে শিক্ষার্থী রীতিমতো বিস্মিত, খানিকটা লজ্জিতও মনে হলো। অফিসগামী ভদ্রলোকের কাজটি দেখে কেন যেন আমার ভেতরে খুব ভালো লাগলো। মনে হলো, এটাই বুঝি প্রকৃত বাঙালি চরিত্র। এত গালাগালির পরেও শেষে অনায়াসে গলাগলি করতে পারে। আমি দুজনকেই আঁড় চোখে দেখে যাই। শিক্ষার্থীর ভাড়া পরিশোধ করে অফিসযাত্রী ভদ্রলোক আগের মতো করে ঝিমুতে থাকে। শিক্ষার্থী উশখুশ করতে থাকে নামার জন্য। একসময় মহাখালী ব্রিজের সামনে এলে আমি, শিক্ষার্থী ও অফিসযাত্রী নেমে পড়ি। গাড়ি চলে যায় গুলশানের দিকে। তারা দুজন আমাকে ছেড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। অফিসযাত্রী হাসিমুখে কিছু জিজ্ঞাসা করেন শিক্ষার্থীকে। শুরুর দুটি কথা শুনতে পাই, ‘আপনি কি স্টুডেন্ট?’ শিক্ষার্থীর উত্তর- ‘হা, প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।’ তারপরের কথাগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে যেতে থাকে।

ব্রিজের মাথার আইল্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি টঙ্গি-গাজীপুরগামী বাসের অপেক্ষায়। একটি করে দ্রুতগামী বাস আসে, আর ২০/২৫জন তাতে ওঠার জন্য ধস্তাধস্তি চালায়। একটি গাড়ি যায়, উঠতে পারি না। পরের গাড়ি আসে, সেটাতেও ব্যর্থ হই। এর পরেটায় ভিড় ঠেলে কোনোভাবে উঠে দাঁড়াই। দেখি, আমার ঠিক পাশে ঠেলাঠেলি করে উঠেছেন সেই অফিসযাত্রী ও শিক্ষার্থী। আমি নামবো কাকলী ওভারব্রিজের নিচে, সেখান থেকে হেঁটে বনানী অফিসে। ভাড়া ৫ টাকা। শিক্ষার্থী ও অফিসযাত্রীর আলাপে বুঝতে পারলাম, তারাও একই জায়গায় নামবে। এবার শিক্ষার্থীর কণ্ঠ, “এই হেল্পার, দুজনের ভাড়া রাখো, ৫শ টাকা ভাংতি দিতে হবে কিন্তু।” হেল্পারের উত্তর, “কী যে কন মামা! ১০ টাকার ভাড়ায় ৫শ টাকা ভাংতি? হইব না।” ভাড়া পরিশোধ করার জন্য উদ্‌গ্রীব শিক্ষার্থী। হয়তো ঋণশোধের জন্যই এমনটা করা তার।

কিন্তু নিরুপায়। ব্যর্থ হয় সে। আবারও ভাড়া পরিশোধ করেন সেই অফিসযাত্রী। একসময় বাস এসে দাঁড়ায় কাকলী ব্রিজের নিচে। আমি নেমে যাই আরো অনেকের সঙ্গে। একই সঙ্গে নামে সেই শিক্ষার্থী ও অফিসযাত্রী। পাশাপাশি হাঁটতে থাকে তারা। তার পেছন পেছন আমি হাঁটি। অফিসযাত্রী হাসতে হাসতে কথা বলতে থাকেন। আর মাথা নিচু করে তা শুনতে থাকে অনুশোচনাগ্রস্থ শিক্ষার্থী। ঋণ পরিশোধ করার খানিকটা সুযোগ পেয়েও, হাতছাড়া হলো তার। অফিসযাত্রী হয়তো কিছু জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু গাড়ির তীব্র হর্নে সেটা আর শোনা গেল না। ফুটপাতে মানুষের স্রোতে হাঁটতে থাকি। একসময় খেয়াল করি চোখের পলকে মিশে গেছে নাম না-জানা মানুষ দুটি। তবে সেই ভিড় থেকে টুপ করে যেন একটি গল্প এসে পড়লো আমার হাতে। হাতে ধরা গল্পের আপেলটি নিয়ে গোপনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভাবলাম, সব কিছুর পরেও হয়তো মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়।

গল্পের বিষয়:
অনুপ্রেরণা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত