লিফট আতঙ্ক

লিফট আতঙ্ক

“লিফটটা একটু আটকান না, প্লিজ।” একটু দূর থেকে দৌড়ে আসতে আসতে মেয়েটি বলে উঠলো।
.
রাজীব হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দেয়ার বোতামটি চেপে ধরলো। হাঁফাতে হাঁফাতে মেয়েটি লিফটে উঠে বললো, থ্যাংকস।
.
রাজীব মনে মনে প্রমাদ গুণলো। লিফটে এখন সর্বসাকুল্যে ছয়জন। ধারণক্ষমতা অবশ্য লেখা আছে ৮ জন। তবে এই বিল্ডিং এ যাতায়াতের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে রাজীব এটা জানে যে, এই লিফটটায় কত সমস্যা। এর আগে একবার পাঁচজন নিয়েই লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলো।
.
“এত স্লো!” পাশ থেকে বিড়বিড় একজন বলে উঠলো। রাজীব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। বয়স্কমতন একজন ভদ্রলোক। তার পাশেই শাড়ি পরা কম বয়েসী একটা মেয়ে। স্যুটেড বুটেড বছর ত্রিশেক বয়সের একজন সুদর্শন যুবা। গেটের কাছটায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে কুঁচকানো কাপড় পরা ছোটখাটো একজন মানুষ।
.
লিফটা ৩ অতিক্রম করছে। ৪, ৬ আর ৭ এ কল দেয়া আছে, রাজীব নামবে ৮ এ, সর্বশেষ ফ্লোর। কল দিয়ে রাখতে মনে নেই। লিফটে সবশেষে ওঠা মেয়েটার গা বাঁচিয়ে ৮ এ চাপ দিতে গেলো রাজীব। ঠিক সে সময়েই ঘটলো ঘটনাটা।
.
কোন আগাম নোটিস ছাড়াই মেয়েটা হঠাৎ লিফটের মেঝেতে পড়ে গেলো। কেউ ধরার চেষ্টা তো করলোই না, বরং একজন আরেকজনের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে এমনভাবে সরে দাঁড়ালো, যেন মেয়েটা অচ্ছুৎ।
.
“এই, এই, আপনি কিছু করেছেন।” বয়স্কমতন লোকটা সবার আগে বলে উঠলেন।
.
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি উনার শরীরে হাত দিয়েছেন।’ স্যুটেড বুটেড সুদর্শন তার সাথে গলা মেলালো।
.
– ওই লোকটাও কিছু করে থাকতে পারে। একমাত্র কম বয়েসী সেই মেয়েটাই রাজীবের ওপর কিছুটা রহম খেলো।
.
“দেখুন, আন্দাজের উপর কাউকে দোষারোপ করবেন না। বাঙ্গালীর অভ্যাসই হলো, না জেনে কথা বলা। আমি কিছু করিনি।”
.
কথা বলতে বলতে কারোই নজর পড়লো না, লিফটটা আর উপরে উঠছে না, থেমে আছে।
.
‘এই ছেলে, এই … এখন সাধু সাজা হচ্ছে, না? লিফটে উঠে কল দাওনি কেন, হু? মেয়েদের বুকে হাত দেয়ার খুব শখ, না?’
.
– এত কথা না বলে একটু দেখুন না, কি হলো উনার। এই যে আপনি, আপনি একটু দেখুন না। কম বয়েসী মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো রাজীব।
.
“আমি?” থতমত খেয়ে মেয়েটি বলে ওঠে।
.
– প্লিজ…
.
‘আরে, আরে, লিফট তো চলছে না। থেমে আছে। কেউ ইমার্জেন্সি কল বাটনটা চাপুন।’ স্যুটেড বুটেড সুদর্শন যুবা প্রায় চিৎকার দিয়ে ওঠে।
.
ইমার্জেন্সি বাটনে চাপ দিয়ে গেটের দারোয়ানের সাথে কথা বলা হলো।
.
‘সমেস্যা নাই। লিফট মাজে মইদ্যে ইট্টু আটকাইয়া যায়। সুইস বন্দ কইরা চালু দিলেই ঠিক হয়া যাইবো। আপনেরা ভয় পাইয়েন না। দুই সেকেন্ড ধৈয্য ধরেন।’
.
দারোয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই লিফটের ভেতর আলো নিভে অন্ধকার হয়ে গেলো।
.
.
আলো জ্বলে ওঠার পর প্রথম যে ব্যাপারটা রাজীবের চোখে পড়লো সেটা হচ্ছে, মেয়েটা লিফটের ফ্লোরে পড়ে নেই। রাজীব সবার মুখের দিকে একবার করে তাকালো। না, যে যার মত দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা তাদের মধ্যে নেই।
.
‘মেয়েটা কোথায় গেলো?’ কেউ উত্তর দিচ্ছে না। এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
.
নতুন করে সবাই আবার কল দিয়েছে। ৪ এ আসতেই বয়স্ক লোক আর কম বয়েসী মেয়েটা নেমে গেলো। ৬ এ স্যুটেড বুটেড সুদর্শন যুবা। ৭ এ কুঁচকানো কাপড় পরা ছোটখাটো মানুষটা।
.
একটা জলজ্যান্ত মেয়ে এতগুলো মানুষের চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গেলো, কারও কোন মাথা ব্যথা নেই! সত্যিই মানুষ দিন দিন রোবটে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। আবার এরাই গায়ে হাত দেয়ার অভিযোগ নিয়ে তেড়ে এসেছিলো।
.
.
৮ এ এসে লিফটের দরজা খুলতেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন লোক তাড়া দিয়ে উঠলো, “তাড়াতাড়ি নামেন, তাড়াতাড়ি নামেন। লিফটে ডেডবডি নিচে যাবে।”
.
রাজীব দ্রুত নেমে একপাশে সরে দাঁড়াতেই স্ট্রেচার শোয়ানো একটা মেয়ের শরীর নিয়ে দু’জন এগিয়ে আসলো। স্ট্রেচারটা লিফটে ঢোকানোর সময় মেয়েটার মুখ দেখতে পেলো রাজীব। সেই মেয়েটা, যে কিছুক্ষণ আগেই লিফটের ভেতর উধাও হয়ে গিয়েছিলো।
.
৮ এ রাজীব একজন ছাত্র পড়াতো, ভালো বেতনে। সেদিনের পর থেকে সে ছাত্রকে আর কখনও পড়াতে যায়নি রাজীব। এমনকি বকেয়া বেতনের টাকাটা নিতেও না!

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত