রাক্ষস

রাক্ষস

বাড়ির পাশের খেলার মাঠটাতে ঝগড়া বেধে গেল সেদিন খুব। অনেক লোক জড় হয়ে গেল। পাড়ার দু’-একজন বুড়ো ভদ্রলোকও এসে হাজির হয়েছিলেন। কী যেন বলছিলেন হাত নেড়ে নেড়ে। জানালার কাছে বসে বসে পিকলু দেখছিল সব। কিন্তু মাথায় ঢুকছিল না কিছুই। কী নিয়ে ঝগড়া। কার সঙ্গে ঝগড়া? দিদি ঘরে ঢুকেছিল আলমারি খুলে একটা বই নিতে। ইস্কুলে পড়ে। আলমারি আছে নিজের একটা। কাউকে ধরতে দেয় না সেটা। ও জিজ্ঞেস করল তাকে, কী হয়েছে রে দিদি?” “কোথায়?” অবাক হয়ে গেল রানু। “মাঠে অত ভিড় কেন?” হৈ-চৈ কিসের?” “ও, ওই মাঠটার কথা বলছিস? ওটা তো বিক্রি হয়ে গেছে।” যেন দিদিমণির কাছে পড়া মুখস্থ বলছে মুখখানাকে এমনি করে গড়গড় করে বলে গেল রানু।

ভবানীপুরের এক ইঞ্জিনিয়ার কিনেছেন ওটা। মস্ত বাড়ি উঠবে ওখানে। তাই মাপজোক হচ্ছে। কোন দেশে নাকি একটা নদী আছে। সবাই বলে দুঃখের নদী। দিদিমণি যেমন একদিন বোঝাচ্ছিল দিদিকে, খাটের তলায় বল খুঁজতে গিয়ে ও শুনে ফেলেছিল কথাগুলো, তেমনি দু’এক কথায় সব পরিষ্কার করে দিয়ে রানু বেরিয়ে গেল ঘর থেকে তাড়াতাড়ি। মনে মনে কিন্তু পিকলু খুশিই হল একটু। মাঠটা আর থাকছে না তাহলে। তার বদলে মস্ত একটা বাড়ি উঠবে সেখানে। এতদিন মনের মধ্যে যে রাগটা পুষে রেখেছিল ও, এবার সেটা মিটল। পিকলুর ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে একবার দেখে আসে মাঠটাকে। কিন্তু ভয় করছিল খুব। বাবা যদি দেখে ফেলে অমনি নালিশ করবে ডাক্তারবাবুর কাছে।

খস্ খস্ করে সাদা কাগজে কী সব হিজিবিজি কাটবে ডাক্তারবাবু। বলবে, এক মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। নট নড়ন-চড়ন। অথচ ওর এই কষ্টের জন্যে মাঠটাই তো দায়ী। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল খুব দুপুরবেলা। কাদা জমে উঠেছিল মাঠে। বিকেলবেলা বল খেলতে নেমে গিয়েছিল ও সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে। গোলের মুখে বলটা পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি। যেই একটু জোরে ছুটে গিয়েছে, অমনি পিছলে গেল পা-টা। তারপর কী যে হল আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলতেই বাবার গলা কানে এল। কেমন, ভেঙেছ তো পা-টা? এখন চুপটি করে শুয়ে থাক বিছানায়। একটুও নড়বে না।

সত্যি সত্যি কতদিন হয়ে গেল বিছানা থেকে নামতে দেয়নি ওকে। দিদিটা এমন হিংসুটে যে বিছানায় একটু উঠে বসতে দেখলেই মা-কে ডেকে নিয়ে আসবে সঙ্গে সঙ্গে। বিকেলবেলা অফিস থেকে ফিরলে বাবার কাছে সব কথা লাগাবে। নিজে খুব মজাসে ঘুরে বেড়াতে পারছে কিনা তাই। একদিন কোলে করে মা বসিয়ে দিয়েছিল ওকে জানালার ধারে একটা টুলের ওপর। বন্ধুরা তখন বল খেলছিল। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল খুব। সব রাগ গিয়ে পড়েছিল মাঠটার ওপর। মাঠটা বোধহয় আর জন্মে শত্রু ছিল ওর। বেশ হয়েছে। মাঠটা খুব জব্দ এখন।

পরের ক্ষতি করে যারা, এমনি শাস্তি বুঝি তাদের পেতে হয়। সেদিন ভোরে টুলের ওপর বসিয়ে দিতেই আবার অবাক হয়ে গেল পিকলু। মাঠটার বুকে বিরাট বিরাট গর্ত করেছে কারা? একটা লরি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় থাক থাক করে ইট সাজানো। কী সুন্দর একটা পাহাড় তৈরি করেছে বালি দিয়ে। বন্ধুরা সবাই একবার করে চড়ছে সেই পাহাড়ে, আবার গড়িয়ে পড়ছে সঙ্গে সঙ্গে। বাঃ, ভারি মজার খেলা তো। না, একটুও দুঃখ হল না ওর মাঠটার জন্যে। পিকলু যেমন পা ভেঙে পড়ে আছে বিছানায়, মাঠটাও তেমনি যন্ত্রণায় ছটফট করুক এখন শুয়ে শুয়ে। একটু পরেই কালো রঙের একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল সেখানে। গাড়ি থেকে নামলেন ফর্সা, লম্বা এক ভদ্রলোক। ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখতে লাগলেন। দিদিকে কাছে পেয়ে পিকলু জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কে রে দিদি?” “উনিই তো ইনজিনিয়ারবাবু। বাড়ির কাজ দেখতে এসেছেন। না দেখলে যে ফাঁকি দেবে মিস্ত্রিরা।”

যেন পড়া মুখস্থ হয়েছে কিনা দেখবার জন্য বই বন্ধ করে নিজের মনেই বিড়বিড় করছে সে। পিকলু আবার বলল, “বাড়িটা কত উঁচু হবে রে?” “অনে-ক উঁচু। ওই নাকেল গাছটার মাথা ছাড়িয়ে যাবে দেখিস।” পিকলু ওদের নিজেদের বাড়িটার কথা একবার ভাবতে চেষ্টা করল। ওদের বাড়িতে ছাত আছে কিনা ও জানে না। সিঁড়িটা খুঁজে পায়নি কোনোদিন। উঁচু বাড়ির ছাতে উঠতে একেকদিন খুব ইচ্ছে করে ওর। হাত বাড়িয়ে আকাশটাকে ছোঁয়া যায় কেমন। পাখিগুলো উড়তে উড়তে যখন হাঁফিয়ে পড়বে তখন বসবে এসে ছাতের ওপর। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখবে ওকে। বেশ মজা হবে। মাঠটা থাকবে না তো বয়ে গেল। পা-টা একবার সারুক না। ও উঠবে একদিন নতুন বাড়ির ছাতে। দেখে আসবে সব কিছু নিজের চোখে। এরপর পিকলু জানালার পাশে বসতে পারেনি কয়েকদিন। বাবার ছুটি ছিল। এক মুহূর্ত নড়েনি বাড়ি থেকে। দুপুরে খেয়ে দেয়ে মোটা একটা ইংরেজি বই বুকের ওপর খুলে রেখে ঘুমিয়েছে ইজিচেয়ারে। কী জানি কেন পড়তে বসলে ওরও ঘুম পায় খুব। সেদিন সকালে দিদি ইস্কুলে চলে যাবার পরই এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পিকলু নিজেই গিয়ে বসল টুলটার ওপরে। জানালার বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। একটা বিরাট লোহার খাঁচা দাঁড়িয়ে আছে মাঠটার বুকে। ঠিক যেন স্বাস্থ্য বইয়ে দেখা একটা কঙ্কাল। মাঠটা মরে ভূত হয়ে গিয়েছে এবার।

এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ওই কঙ্কালটা। দিদি বলেছে বাড়িটা নাকি খুব তাড়াতাড়ি উঠে যাবে। রাত জেগে জেগে কাজ করছে মিস্ত্রিরা। পিকলু মনে মনে ঠিক করে ফেলল আজ রাতে ঘুমোবে না ও। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে আস্তে চুপি চুপি বিছানা থেকে নেমে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াবে। দেখবে, কী ভাবে কাজ করে তারা। হাড়গুলোতে একটু একটু করে মাংস লাগায়। অনেক রাত অবধি জেগেছিল পিকলু। অন্ধকার ঘরে চোখ খুলতে ভরসা পাচ্ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য। মজার ব্যাপারটা ঘটল তখনই। বাড়িটা নিজেই কখন এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে। ধবধবে সাদা শরীর নিয়ে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। পিকুলকে অবাক হয়ে যেতে দেখে সে বলল, “কী, হাঁ করে কী দেখছ আমার দিকে তাকিয়ে? কেমন সেজেছি বল তো?” পিকলু বলল, “বাঃ কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। খুব ভাল লাগছে আমার।” “লাগবেই তো। আমি যে তোমার বন্ধু।”

একথা শুনে একটু যেন অহংকারই হল পিকলুর। বন্ধু বলে ওকে যখন খাতিরই করছে এতটা, তখন আর ছাতে উঠতে ভয়টা কিসের! আর, একবার সেখানে উঠতে পারলে আকাশের শেষ সীমানা পর্যন্ত ও দেখে নেবে ভাল করে। কিন্তু কবে যে সারবে পা-টা! মাঠটার ওপর আবার রাগ হল খুব। কেন যে এমন ক্ষতি করল ওর। কী দোষ করেছিল ও? পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই যেই উঠে বসতে গেছে ও বিছানার ওপর, মা ছুটে এল তাড়াতাড়ি। “না না, উঠবে না তুমি লক্ষ্মী সোনা। আমি দুধ গরম করে নিয়ে আসছি।” বাবাও এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে। গম্ভীরমুখে বলল, “ঠান্ডা লাগিয়ে লাগিয়েই তো জ্বরটা বাধিয়েছ। একদম নড়বে না তুমি বিছানা থেকে।” ঠান্ডা লাগার ভয়ে জানালাটা বন্ধ করে বাবা। কী বিশ্রী দড়াম করে শব্দ হল একটা। যেন মাঠটাই মুখ ভেংচে হেসে উঠল বিকট শব্দ করে। পিকলুর মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। মাঠটাই এর জন্যে দায়ী। হয়তো জ্বরটাকে সে-ই পাঠিয়েছে। মরেও শান্তি দেবে না সে ওকে। কিন্তু বন্ধু কী ভাববে এখন ওর সম্বন্ধে? হয়তো বলবে “ভিতু কোথাকার!” আট-দশদিন জ্বরে ভুগল পিকলু। এই কদিন একবারও জানালাটা খোলা হয়নি। বাবাই খুলতে দেয়নি। ঘরে ঢুকে আগে দেখেছে ওটা ঠিকমতো বন্ধ আছে কিনা।

তবে নিশ্চিন্ত হয়ে জামার বোতাম খুলেছে। তবু একদিন কী করে যেন জানালা গলিয়ে বাড়িটা ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভিতর। ওর বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। “কী ঘুমোচ্ছ কেন? ওঠ, উঠে পড়। ছাতে চড়বে না?” “সত্যি?” আনন্দটা আর চেপে রাখতে পারেনি ও। “হঁ্যা,” অনেক উচুঁ ছাতে চড়াব তোমাকে। দেরি কোরো না। জলদি চল।” অনেক, অনেক উচুঁতে উঠে গিয়েছিল পিকলু। চাঁদিয়াল ঘুড়িটা সেদিন যেখানে উঠেছিল ঠিক সেখানে। খুব মজা লাগছিল ওর। ওদের বাড়িটাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। মা জানবে না বাবা টের পাবে না। সারা আকাশ ঘুরে বেড়িয়ে টুক করে কখন ঢুকে পড়বে ও বিছানার ভিতরে। মাঠটা দেখুক। দেখে দেখে হিংসেয় জ্বলে মরুক। কেমন জব্দ এবার। হঠাত্‌ কী হল। শুনতে পেল ও মা বাবাকে বলছে, “ঘাম হচ্ছে খুব খোকার। জ্বরটা বোধহয় ছেড়ে যাবে।” এদিক-ওদিক তাকিয়ে সারা ঘরে ও খুঁজছিল বাড়িটাকে।

কোন ফাঁকে সরে পড়েছে কে জানে। কতদিন বাদে পিকলু আজ উঠে বসেছে বিছানার ওপর। জানালাটা কে খুলে দিয়েছে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল উঠে গিয়ে একবার বসে জানালাটার পাশে। চাঁদিয়াল ঘুড়িটা সেদিন সেখানে উঠে গিয়ে লাট খাচ্ছিল, আকাশের সেই জায়গাটা খুঁজে দেখে। ঘরে কেউ ছিল না। একটা পেনসিল নিতে ঘরে ঢুকেছিল রানু। ও ডাকল তাকে, “এই দিদি শোন।” “কী?” কাছে এগিয়ে এল রানু। “বাড়িটা হয়ে গেছে?” “হঁ্যা।” “কত উচুঁ হয়েছে রে?” “খু-ব উচুঁ। সাদা রং করেছে।” “করবেই তো।” যেন পিকলুর সব জানা।

ওর সঙ্গে পরামর্শ করেই সব কিছু করা হচ্ছে। মনে মনে একবার কী ভাবল পিকলু। তারপর বলল, “রঙের বাক্সটা তুই নিবি দিদি? ওটা আমার আর চাই না।” রানু বুঝতে পারল ওর মনের কথাটা। কাছে সরে এসে বলল, “জানালার ধারে বসবি? বাবা বকবে না তোকে।” হাত ধরতে হল না। পিকলু নিজেই ভাঙা পা-টাকে টেনে টেনে হাজির হল জানালাটার সামনে। কিন্তু এ কী! আকাশটা গেল কোথায়? বাড়িটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে কটমট করে। বিরাট একটা রাক্ষসের মতো। তবে কি মাঠটাকেই শুধু মেরে ফেলেনি রাক্ষসটা, আকাশটাকেও গিলে খেয়েছে? আর কোনওদিন ও খুঁজে পাবে না তাকে। দু’চোখ ছাপিয়ে জল এসে গেল এবার পিকলুর।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত