রেস

রেস

সেদিন শুনলাম কুহু আর কেকাতে আড়ি হয়ে গেছে। হামেশাই হয়ে থাকে। যেখানে যত ভাব, সেখানে তত আড়ি। ওরা তো ছেলেমানুষ। বড়রাও কম যান না। এই তো কদিন আগে মিসেস কাঞ্জিলাল বলছিলেন ওঁদের ‘গৃহলক্ষী ক্লাব’-এর মেম্বার ছিলেন পঞ্চান্ন, কমে কমে পঁয়ত্রিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণটা কী? না, এর সঙ্গে ওঁর মুখ দেখাদেখি বন্ধ, সি ব্লকের সঙ্গে ডি ব্লকের যাতায়াত নেই।

ছোটদের অবিশ্যি আড়ি থেকে ভাব হতে দেরি হয় না। কিন্তু কুহু আর কেকা এবার বেশ কিছুদিন ধরে যে যার বাড়িতে গঁ্যাট হয়ে– বসে আছে। ব্যাপার কী? একটা দিন মুখোমুখি বসে বকবক করতে না পারলে যাদের ভাত হজম হয় না, তারা হঠাত্‌ এরকম নন-কোঅপারেশন করে বসে আছে কেন? বেড়াতে বেড়াতে গেলাম কুহুদির বাড়ি। প্রথমে কিছুই বলতে চায় না। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে অনেক করে বোঝাতে চোখ ছলছল করে বলল, “কেকাটা আমার মন্টুদাকে অপমান করেছে।” “বল কী!”

“হঁ্যা, দেখুন না, সেদিন কাগজে ছবি বেরিয়েছে মন্টুদার। ওদের ক্লাবের স্পোর্টসে লঙ জাম্পে ফার্স্ট হয়েছে কিনা। কেকাকে দেখাতে নিয়ে গেলাম। তুই আমার বন্ধু, খুশী হবি তো? তা না। ঠোঁট উল্টে বলল এ যে তোর মন্টুদা, বুঝলি কী করে? কতগুলো লোক ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটা না হয় ভালো ওঠেনি। তাই বলে আমার মন্টুদাকে ভূত বলবে!” আমি বললাম, “তাই তো, ভারী অন্যায়।”

“আরো কী বলল শুনুন না। ‘খুব যে মন্টুদা মন্টুদা করিস, নিয়ে আয় না একবার, দেখি কত বড় স্পোর্টসম্যান। এই তো আসছে মাসে আমাদের মাঠে স্পোর্টস হচ্ছে। মেজকাকে বলে ওর নামটা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে।’ আচ্ছা বলুন তো, মন্টুদা আসবে এই অজ পাড়াগাঁয়ের পচা স্পোর্টসে নাম দিতে! আর উনি দয়া করে ওঁর মেজকাকে বলে তাকে ঢুকিয়ে দেবেন!”

বলেই কান্না চাপতে চাপতে ছুটে বেরিয়ে গেল।

আঘাতটা সত্যিই ওর খুব লেগেছে। লাগবারই কথা। কেকাই বা ওসব বলতে গেল কেন? কুহু যে মন্টুদা বলতে অজ্ঞান সেটা তো সে ভাল করেই জানে। এবার কেকাকে ধরলাম। সে স্বীকার করল, হঁ্যা অনেকটা ঐ ধরনের কথা সে বলেছে। কিন্তু খালি-খালি তো আর বলতে যায়নি। কুহু তার ঝন্টুদাকে নিয়ে অমন ঠেস দিয়ে বাজে কথা বলল কেন?

জানতে চাইলাম, “কী বলেছে কুহু?”

“বলে কিনা খুব তো মোহামেড়ানের প্লেয়ার বলে ঢাক পিটিয়েছিলি। তোর মেজকা যদি খেলা বন্ধ করে না দিতেন, দেখা যেত। এসব কথার মানে কী আপনিই বলুন।”

ঘটনাটা আমি জানি। তোমরা যখন আনন্দমেলা পড় তোমাদেরও নিশ্চয়ই মনে আছে। কুহুর মুখে হরদম ‘মন্টুদা এই করেছে, মন্টুদা ঐ করেছে’ শুনে শুনে কেকার কান ঝালাপালা। একদিন আর থাকতে না পেরে বলে বসল, তার ঝন্টুদাও একজন দুর্দান্ত ফুটবলার, মোহামেড়ানে খেলে। আসলে সে ফুটবল মাঠেও যায়নি কোনদিন। কিছুদিন পরেই ঝন্টু বেড়াতে এল ওদের বাড়ি। তখন ফুটবল মরশুম চলছে। ওদের গ্রামের উত্তরপাড়া এফ সির সঙ্গে দক্ষিণপাড়া ইলেভেন-এর সেমি-ফাইন্যাল। আর যায় কোথায়! সবাই মিলে ধরে বেঁধে তাকে নামিয়ে দিল। কেকাদের পাড়ার টীমের গোলকীপার। কেকা গিয়ে ধরল তার মেজকাকে কী করে মুখ বাঁচানো যায়। তিনি তাঁর ওকালতি বুদ্ধি খাটিয়ে গোলে বল যাবার আগেই এমন একটা গোল বাধিয়ে দিলেন যে খেলাই বন্ধ হয়ে গেল। মাঠের লোকেরা চালাকিটা ধরতে পারল না। কুহুর মনে কিছুটা সন্দেহ হয়ে থাকবে। কথায়-কথায় সেদিন বেরিয়ে পড়েছে। কেকাও পাল্টা ঘা দিয়ে বসেছে।

কুহুকে নিয়ে তার বাড়ির লোকেরা মহা ভাবনায় পড়লেন। কী হল মেয়েটার। মুখে হাসি নেই, কথা টথাও বড় একটা বলে না কারো সঙ্গে। স্কুলে একদিন গেল তো দুদিন গেল না। গানের মাস্টার এলে বলে, “আমার গলা ব্যথা।”

একদিন হঠাত্‌ দেখা গেল, সকাল থেকেই তার ঘরের দরজা বন্ধ। রবিবার বলে নটার সময় চান-খাওয়ার তাগিদ এল না। কিন্তু এগারোটা বাজবার পরেও বেরোচ্ছে না দেখে বৌদি এলেন ডাকতে। তিন চারবার ডাকাডাকির পর সাড়া এল ভারী গলায়, “তোমরা খেয়ে নাওগে। আমি আজ-খাবো না।” “কেন, খাবে না কেন?” “আমার খিদে নেই।” “দোর খুলবে তো?” “না।”

তারপর এলেন মা। প্রথমে সাধাসাধি, তারপর রাগারাগি, কুহু কোনটারই জবাব দিলনা, দরজাও খুলল না। কদিন ধরে সারা ব্যাপারটা নাড়াচাড়া করে কুহুর সব রাগ গিয়ে পড়েছিল মন্টুদার ওপর। ঠিকই বলেছে কেকা। সে-ই কেবল মন্টুদা-মন্টুদা করে মরে। তিনি কোন্ লাটসাহেব যে একটিবারও তাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে পারলেন না! হতে পারে তারা বড়লোক, খাস ঢাকার বনেদী গোষ্ঠী। কিন্তু কেকার ঝন্টুদারাও কম বড়লোক বা কম বনেদী নয়। মন্টু যেমন তালতলার তালুকদার বাড়ির মেজোছেলে, ঝন্টুও তেমনি বড়বাজারের বাঁড়ুজ্যে বাড়ির মেজোছেলে। দুদিকের সম্পর্কটাও একই রকম। মন্টু কুহুর পিসতুতো ভাই, ঝন্টু কেকার মাসতুতো ভাই। ঝন্টু সে-সম্বন্ধটা মনে রাখে। এরই মধ্যে দু-দুবার ঘুরে গেল মাসির বাড়ি। আর মন্টুবাবুর মামা-মামীর কথাও একবার মনে পড়ে না, বোন তো তার পরে।

বাবার কাছে খবর গিয়েছিল। তিনি এসে নরম সুরে ডাকলেন, “দরজাটা একটু খোল তো মা।” এবার আর না খুলে পারল না কুহু। বাবা ঘরে ঢুকতেই বলে উঠল, “আচ্ছা বাপি, মন্টুদা আমাদের বাড়ি একবারও আসে না কেন?” হঠাত্‌ একথা কেন, বুঝতে পারলেন না ভদ্রলোক। তিনি ভেবেছিলেন, জটিলরকম কোনো কিছু ঘটেছে নিশ্চয়ই। এই গোছের সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে মেয়ে ঘরে দোর দিয়ে না-খেয়ে বসে আছে কেমন করে জানবেন? বললেন, “শুনেছি খুব খেলাধুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই হয়তো আসতে পারে না।” “মোটেই তা নয়। আমরা তো ওদের মত বড়লোক নই, পাড়াগাঁয়ে থাকি। তাই আসে না।”

“কী যে বলিস? মন্টু মোটেই সেরকম ছেলে নয়। তা এ নিয়ে তুই মন খারাপ করছিস কেন?”

“কেকার ঝন্টুদা কত আসে ওদের বাড়ি, কেমন হৈ চৈ করে। আর-” বাকীটুকু আর বলতে পারল না। দু’চোখে আঁচল চেপে ধরল। বাবা এবার বুঝলেন, ব্যাপারটাকে মোটেই হালকা করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বন্ধুর কাছে মেয়ের একটা মান আছে না?

বললেন, “আচ্ছা, আমি তো আসছে সপ্তাহেই ঢাকা যাচ্ছি। দেখা হলে ওকে খুব বকে দিয়ে আসব। আর ওর মাকে বলে আসব শিগগিরই যেন একবার পাঠিয়ে দেয়। তুই কিছু ভাবিসনে।”

শিগগির আর হল না। মামা এত করে বলে গেছেন শুনেও ‘আজ যাই কাল যাই’ করে মাসখানেক পরে এল মন্টু। আর ঠিক সেই দিনই এখানকার স্পোর্টস। কুহু তো চটে লাল, “কে আসতে বলেছিল তোমাকে?” মন্টু হাসল।

“জানিস তো আমার কত কাজ! ডিসেম্বর মাস পড়ে গেছে। রোজই কোনো না কোনো ক্লাবে-”

“আর আমাদের ক্লাবটা বুঝি এতই ফ্যালনা?”

“ফ্যালনা কেন হবে? এই তো ঠিক দিন বুঝে এসে পড়েছি।” “হুঁ, দুটোয় স্পোর্টস আর বাবু এসে পৌঁছলেন বেলা এগারোটায়!” “তাতে কী হয়েছ? তুই চলে যা না। আমি মামার সঙ্গে ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হবো।” “শুধু হাজির হলেই হবে না মশাই, আপনাকে নামতে হবে।” মন্টু মনে-মনে হেসে খুন। মেয়েটা বলে কী!

এই গেঁয়ো স্পোর্টসে পার্ট নেবে মন্টু তালুকদার! তার ক্লাবের ছেলেরা শুনতে পেলে তাকে সঙ্গে-সঙ্গে বয়কট করে দেবে। তাছাড়া মাঠের যা ছিরি। আসবার সময় দেখে এসেছে। আগাগোড়া এবড়ো-থেবড়ো, মাঝে-মাঝে গর্ত। এর মধ্যে ছোটে কেমন করে? পাড়াগেঁয়ে ভূত তো। ওরা সব পারে।

কুহুকে বলল, “কী জানিস পর পর পনের দিন একটানা দৌড়-ঝাঁপ লাফালাফি করে শ্রীচরণ দুটির অবস্থা তেমন সুবিধের নয়। কটা দিন ছুটি চাইছে।” “তার চেয়ে বল না কেন, ইচ্ছে নেই। একে পাড়াগাঁ তায় ছোট ক্লাব-” ঠোঁট উলটে বলল কুহু।

মন্টুকে হার মানতে হল, “আচ্ছা বাবা নামবো। তবে কোনো বড় ইভেন্ট্ দিতে মানা করিস। ছোটোখাটো কিছু একটা-”

বলতে বলতেই ক্লাবের সেক্রেটারি দলবল নিয়ে এসে পড়লেন। বললেন, “বেশ তাই হবে। আমাদের মাঠে আপনার পায়ের ধুলো পড়বে। তাতেই আমরা ধন্য।” ঠিক হল, একশ গজ ফ্ল্যাট রেস্-এ দৌড়বে মন্টু।

এ গাঁয়ের ইতিহাসে এত বড় ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। তালতলা ইউথ ক্লাবের দুর্দান্ত স্পোর্টস ম্যান মন্টু তালুকদারকে চোখে দেখাই ভাগ্যের কথা। তার ওপরে তার দৌড়ও দেখা যাবে। কাতারে-কাতারে লোক এসে জড় হল মাঠে। মাইক তো নেই। একটা ছেলে- চেহারা সরু হলেও, গলাটা বেশ মোটা- মুখে মস্ত বড় এক চোঙা লাগিয়ে চেঁচাচ্ছে, ‘‘বন্ধুগণ, স্বনামধন্য ক্রীড়াবিদ্ মন্টু তালুকদার আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত। ১০০ গজ ফ্ল্যাট রেস্-এ আপনারা তাঁকে দেখতে পাবেন।”

ঐ ইভেন্টে রাখা হয়েছিল সকলের শেষে, লোকজন আটকে রাখার জন্যে। সারা মাঠ উত্‌সাহ, উত্তেজনায় ফেটে পড়েছে। চোঙাওয়ালা পরপর ছটা নাম বলে গেল। সকলের শেষে মন্টু তালুকদার। সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হাততালি।

মেয়েদের ভিড়টাও কম নয়। কুহু তো আগেই এসে বসে গেছে একেবারে সামনের সারিতে। কিন্তু ‘সে’ কোথায়? আসবে নিশ্চয়ই। তবু না দেখা পর্যন্ত মনটা ঠাণ্ডা হচ্ছিল না। না এলে সব মাটি। ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিল বারবার। ঐ তো এসে গেছে। বড় বড় চোখ করে মন্টুদাকে দেখছে। কুহু, মনে মনে বলল, আনতে পারব না বলেছিল তো? এবার দ্যাখো, ভাল করে দ্যাখো।

স্টার্টার পিস্তলের আওয়াজ করলেন। দৌড় শুরু। সকলের আগে মন্টু তালুকদার। সারা মাঠ গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। হঠাত্‌ সব চিত্‌কার যেন ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। অ্যাক্সিডেন্ট! মন্টু তালুকদার উপুর হয়ে পড়ে আছে ট্র্যাকের উপর। সব লোক ছুটে চলেছে সেই দিকে। তখন অত ভিড় ঠেলে কাছে যাওয়া আমার সাধ্য নয়।

সন্ধ্যার পর গেলাম কুহুদের বাড়ি। মাঠেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ‘মন্টুদার’ সঙ্গে। একবার খবর নেওয়া দরকার। বাইরের ঘরেই পাওয়া গেল। পায়ে চুন হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে কুহু। পাশে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে কেকা! আমাকে দেখে বলে উঠল, “আচ্ছা, আপনিই বলুন তো জ্যাঠামশাই, নেহাত হাসি তামাশা করে সেই কবে কী বলেছিলাম, আর সেই জন্যে কিনা ও’র মত একজন এতবড় স্পোর্টসম্যানকে টেনে এনে আমাদের এই পচা মাঠে দৌড় করিয়ে ছাড়ল! কী জেদী মেয়ে বাবা!”

কুহু মাথা নিচু করেই বলল, “সত্যি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, এরকম মাঠে দৌড়নো ওঁর অভ্যাস নেই। একটা গর্তের মধ্যে পা পড়ে-”

“আহা তাতে হয়েছেটা কী?” বাধা দিল মন্টু। আমার দিকে ফিরে বলল, “আপনি এসেছেন ভালোই হয়েছে। আমি এদের কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, এরকম হামেশাই ঘটে থাকে আমাদের।”

আমি বললাম, “আমারও একটা ধাঁধা কাটল।” “ধাঁধা!”

“হঁ্যা, তোমাদের লংজাম্প, হাই জাম্প, রিলে রেস্, অবস্ট্যাকল রেস, স্যাক রেস-এসবগুলোর মানে বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু ফ্ল্যাট রেস কথাটা ঠিক ধরতে পারিনি। আজ সব পরিষ্কার হয়ে গেল যখন দেখলাম-” “আমি ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছি,” বলে হো হো করে হেসে উঠল মন্টু। তাকে ছাপিয়ে গেল কুহু ও কেকার খিলখিল হাসি।

 

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত