অতৃপ্ত আত্মা

অতৃপ্ত আত্মা

চারদিক অন্ধকার। হিজলতলী গাঁয়ের অধিকাংশ বাড়িই নিঃশব্দতায় ছেঁয়ে গেছে। গ্রামের মানুষের চিরাচরিত রুপ এটাই। সারাদিন কাজ কর্মের ব্যস্ততার পর রাতে একটু

আরাম করা। সকলের মতো গোলজার মিয়াও ক্লান্তি রেখে খাওয়ার পর্ব শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন। রাবেয়া বেগম তার পাশেই কুপির আলোয় কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত।
‘রাবেয়া, একখান কথা কইবার চাই।’ -গলাটা খাকড় দিয়ে বললেন গোলজার মিয়া।
‘কি কইবার চান, কইয়া ফালান। এতো অনুমতি লাগবো না।’ -সুঁচ থেকে সুতা কাটতে কাটতে গোলজার মিয়ার কথায় সম্মতি দিলো রাবেয়া বেগম।
পায়ের নিকট থেকে কম্বলটা একটু টেনে গায়ের উপরে আবৃত করে নেন-, ‘গত তিনদিন থাইকা আমি একটা স্বপন বারবার দেখতাছি।’
‘কি স্বপন!’ -অবাক হয়ে প্রশ্ন করে গোলজার মিয়ার দিকে তাকায় রাবেয়া।
‘আমি দেখতাছি আমারে কে যেন দৌঁড়ানি দিছে। আমি ভালো কইরা দেখি কালো কুচকুচে একখান মহিলা হিহিহি কইরা হাসতাছে আর আমার দিকে আগাইতাছে। তাই

দেইখা আমি দৌঁড়াচ্ছি তো দৌঁড়াচ্ছি। তারপর পাহাড়ের উপর থাইকা নিচে লাফাইয়া পড়ে মরছি।’ গোলজার মিয়ার কথা শেষ হতেই রাবেয়া তার মুখ চেপে ধরে।

ছলছল চোখে প্রিয় স্বামীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বলে, ‘অমন কথা মুখেও আইনেন না। আল্লাহ আমাগো মাফ করুক। আপনে আর বেশি রাইত কইরা বাড়ি ফিরেন না। তাড়াতাড়ি একটু ফিইরা আইসেন।’
বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে গোলজার মিয়া বলেন, ‘রাইত না কইরা উপায় নাই রাবেয়া বিবি। কাম শ্যাষ করতে করতে মাগরিবের আযান কানে ভাসি আইসে।’
‘তবুও আপনি বেশি রাইত কইরেন না। আর যদি বেশি রাইত হয় তাইলে শশ্মানঘাট দিয়া ফিরবেন না।’
‘ক্যান! শশ্মানঘাট দিয়া ফিরলে কী হইবো? সেই ছোডবেলা থাইকা হিজলতলীতেই বড় হইছি। অহনো কিচ্ছু হয় নাই, আর আল্লাহয় দিলে কিচ্ছু হইবো না।’

রাবেয়া বেগম স্বামীর কথায় কিছু বলতে পারে না। দুরুদুরু বুকে সেলাইয়ের কাজে মন দেয় সে। কয়েকদিন ধরে গ্রামে কী সব আত্মার কথার শোনা যাচ্ছে। প্রায়ই নাকি শশ্মানঘাট থেকে কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। আবার কখনো হাসির শব্দও মানুষের কানে প্রবিষ্ট হয়।
এইসব অদ্ভুত ঘটনা এর আগে হিজলতলীর গাঁয়ে কখনো শোনা যায় নি। হঠাৎ করেই এমন ঘটনায় চিন্তিত সবাই।
গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের কানাঘুষার ফাঁকেই তিন বৃহস্পতিবার তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে। প্রথমজন গোলজার মিয়া, দ্বিতীয়জন মন্টু মিয়া, তৃতীয়জন আবুল মিয়া।
গোলজার মিয়াকে হারিয়ে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বিলাপ করে কেঁদেছে। অদ্ভুতভাবে তিনজনই বৃহস্পতিবার কাজ থেকে ফেরার পথে দুষ্টু আত্মার ভোগের কারণ

হয়েছে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, তিনজনকেই শশ্মানঘাটের দক্ষিণের বটগাছে ফাঁসী দিয়ে রেখেছে। হাত দু’টোয় রশ্মি দিয়ে গাছের ডালে ঝুলে রেখে মাথার মুন্ডুটা

গাছের গোঁড়ায় রেখে দিয়েছে। তিনজনের চোখ খোলা ছিলো। পৃথক পৃথকভাবে এমন লাশ গ্রামের মানুষের অন্তরের ভীতির সঞ্চালন সৃষ্টি করেছে। সেজন্য হয়তো সন্ধ্যার পর কেউই এখন শশ্মানঘাট দিয়ে যাতায়াত করে না।
.
হিজলতলী গাঁয়ের সকলেই চিন্তিত অবস্থায় দিনাতিবাহিত করছে। এর পরে কার মরণ চিঠি আসবে কে জানে! রীতিমত বৃহস্পতিবার দিনটি চলে আসলো। সন্ধ্যার

আগেই ঘরে পদার্পণ করেছে মানুষজন। ঘর থেকে কুটকুট কথা ভেসে আসলেও বাইরে কেউই নেই। অনেকটা নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে এই রাতটিও অতিবাহিত করে

সাধারণ মানুষজন। ভোরবেলা নামায পড়ে ফেরার সময় কথাবার্তা বলতে বলতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন মুন্সী সোবহান ও আজিজ মিয়া।

হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে উঠেন আজিজ মিয়া। আজিজ মিয়াকে চিৎকার করতে দেখে মুন্সী বলে উঠেন-, ‘কী খবর মিয়া, এমন কইরা চিক্কুর দিলা ক্যান?’

মুখ দিয়ে কোন কথা বের করলো না আজিজ মিয়া। শুধু মধ্যমা আঙ্গুলি উঁচিয়ে শশ্মানঘাটের বটগাছটার দিকে ইশারা করলো। মুন্সীও গাছটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে ইন্না লিল্লাহ পাঠ করে আরো কয়েকজন মানুষকে ডেকে আনলো।
‘বেচারা করীম, বাপ-মা, বউ কেউই আছিলো না। শেষে তাকেই পেরানটা দিতে হইলো?’ -কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পানি মুছতে লাগলো মতিন মিয়া।
আস্তে আস্তে গ্রামের সবাই ছুটে আসলো। বটগাছটার আশেপাশে মানুষে গিজগিজ করতে লাগলে। কিন্তু মুন্ডুবিহীর শরীরটা কেউই নামাতে সাহস করলো না। আগের তিনটা লাশের মুন্ডুবিহীর শরীরগুলো এই করীমই নামিয়েছিলো। আজকে তাকে কে নামাবে?
অনেকেই শলাপরামর্শ করছে যে, হয়তো গাছটা থেকে লাশ নামানোর অপরাধে করীমকেও জমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই কেউ এগিয়ে আসলো না।

করীমের শরীরে অনেক আঁচড়ের দাগ। হয়তো ছেলেটা বাঁচার জন্য অনেক ছটফট করেছে, কিন্তু প্রেতাত্মার সাথে লড়তে পারেনি। কিছুক্ষণ বাদে মাতরব সাহেব ফিরে

আসলেন। মাতবর সাহেব তার চ্যালাদের আদেশ করে করীমকে বটগাছ থেকে নামালেন। বাপ-মা মরা ছেলে করীম, তার জন্য দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত কাজ সমাধা করছেন

মাতবর সাহেব। মাতরব সাহেব মানুষটা বেশ ভালো। গ্রামের মানুষদের কথা সবসময় ভাবেন। যাইহোক, করীমের মুন্ডটা কোনরকমে জুড়ে দিয়ে কবর দেয়া হলো।

 

মাতবর সাহেব রাগ হয়ে কাঠুরের মাধ্যমে বটগাছটা কেটে ফেললেন। এতদিনের বটগাছটার উপর মানুষের খুব মায়া জন্মেছিলো, কিন্তু তা নিমিষেই শেষ করে দিতে হলো।
মাতবর সাহেবের বিশ্বাস ছিলো বটগাছটা কাটার পর আত্মাটা ওখান থেকে চলে যাবে। কিন্তু মাতবর সাহেবের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে পরের বৃহস্পতিবার ঘটলো অন্য ঘটনা। আগের মতন এবার কাঠুরেকে মেরে শশ্মানঘাটের ভিতরের কাঁঠাল গাছে ঝুলিয়ে রাখা হলো।
মুন্ডুবিহীন শরীর! অনেকেই কাঠুরেকে দেখে কেঁদে উঠে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছে। অনেকেই চলেও যাচ্ছে। মাতবর সাহেব কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অবশেষে মাথায় একটা বুদ্ধি চলে আসলো। মনে পড়ে গেল তার ছোটবেলার বন্ধু সাইফের কথা।
ফোন করে সবকিছু খুলে বলে তিনি সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইফ তাকে আশ্বস্ত করে অতিশীঘ্রই এর সমাধাণ করবে বলে ভরসা রাখতে বললেন। শনিবার তিনি

হিজলতলীর গাঁয়ের আসবেন বলে আশায় রাখলেন। আপাতত কিছুটা হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন মাতবর সাহেব। সাইফ প্রতি তার বিশ্বাস আছে, অগাধ বিশ্বাস।
.
শনিবার সন্ধ্যার কিছু সময় পূর্বে সাইফ একজন তান্ত্রিককে নিয়ে মাতবর সাহেবের বাড়িতে হাজির হলো। হালকা দেহের গড়নের সাইফ চৌধুরী ছোটখাটো একজন

ব্যবসায়ী। অপরদিকে জটা চুলধারী জীর্ণ-শীর্ণ পোশাকে আবৃত একজন তান্ত্রিক। মাতবর সাহেবের বুঝতে বাকি রইলো না এই ব্যক্তিই তান্ত্রিক। তান্ত্রিকের হাতে সাপের মতন একটা লাঠি, ঘাড়ে একটা পোটলা।
‘আরে বন্ধু, আসো আসো।’ -সাইফ চৌধুরীকে পেয়ে বুকের মধ্যে টেনে বন্ধুত্বের মহামিলন আবেগঘন করে রাখলেন উভয়েই। তান্ত্রিককে শুধুমাত্র সালাম দিয়েই চুপ

করে তাদের বসতে বললেন। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সাইফ চৌধুরী একজন শহুরে, একজন ব্যবসায়ী। তিনি এখনো এসব বিশ্বাস করেন! মনে মনে হেসে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান তিনি।
‘কষ্ট করে যদি শশ্মানঘাটে একবার নিয়ে যেতেন তাহলে ভালো হতো।’ -তান্ত্রিকের কথায় পিছনে ফিরে তাকিয়ে ম্লান হেসে বললো-, ‘দূর থেকে এসেছেন, আগে একটু বিশ্রাম নিন। তারপর না হয় যাওয়া যাবে।’
মাতবর সাহেবের কথায় মেকি হেসে লাঠিটা নিয়ে নাড়ানাড়ি করতে লাগলো তান্ত্রিক। সোফাতে বসে থেকে সাইফ চৌধুরী ব্যবসায়ীক কাজকর্মে আদেশ করে চলেছেন। একেরপর এক ফোন আসছে।
গ্রামে তান্ত্রিক এসেছে! একথা মূহূর্তেই বাতাসের বেগে ছড়িয়ে গেল। সকলেই নিজ নিজ দায়িত্বে কানাঘুষা করতে লাগলো। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শশ্মানঘাটের দিকে অগ্রসর হলেন মাতবর সাহেব। তাকে অনুসরণ করতে লাগলো তান্ত্রিক ও সাইফ চৌধুরী।
মাতবর সাহেব আস্তে আস্তে সবকথা তুলে ধরলেন।
প্রথম তিনজন যে একই স্বপ্ন দেখেছিলো সেকথা বলতে ভুল করলেন না।
তান্ত্রিক চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। তান্ত্রিকের মুখে কোন কথা না দেখে সাইফ চৌধুরী বললেন-, ‘জনাব, এত চুপচাপ কেন? কি করতে চলেছেন আপনি?’
‘প্ল্যানচেট।’ -তান্ত্রিকের একথার জবাব।
মাতবর সাহেব ও সাইফ চৌধুরী কিছুই বুঝলেন না। একে অন্যের প্রতি চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। উভয়ের এত আগ্রহ দেখে তান্ত্রিক শান্তস্বরে বললেন, ‘আমি যা

করতে চলেছি তার জন্য কয়েকটা মোমবাতি লাগবে, একটা ফাঁকা ঘর লাগবে। তবে সেটা যেন এই বটগাছটার পাশাপাশি হয়। সাহসী তিনজন পুরুষ লাগবে, আমি সহ চারজন।’
তান্ত্রিকের কথামতো সাইফ চৌধুরী ও মাতবর সাহেব থাকতে রাজি হলেন। বাকি একজন খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কেউই আসতে চাচ্ছিলো না। শেষপর্যন্ত টাকার বিনিময়ে কালু নামের এক ব্যক্তি আসলো।
বটগাছটার কিছুদূরে করীমের বাড়ি। করীম তো এখন অবর্তমান, তাই তার বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে আছে। সেখানেই প্ল্যানচেট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।
ভয়ঙ্কর এই কারবারের কথাশুনে গ্রামের লোকজন আগে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো।
রাত ১২ বাজতে এখনো কিছুক্ষণ বাকি। তান্ত্রিক সবকিছু প্রস্তুত করে রেখেছে। তার সামনে একটা বোর্ডের উপর কয়েকটা মোমবাতি জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছিলো। সেই সাথে রয়েছে মানুষের মাথার একটা খুলি।
‘যখন আমি আপনাদের হাতের মুঠ বন্ধ করতে বলবো তখন চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠ বন্ধ করবেন। খবরদার আত্মার সাথে কথা বলার সময় হাতের মুঠ কিংবা চোখ

খুলবেন না। যদি খুলেন তাহলে প্ল্যানচেট হবে না, সেই সাথে মরতে হবে। তখনকার দায়ভার কিন্তু আমার না।’ – তান্ত্রিকের কথা শুনে মাতবর সাহেব কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললেন-, ‘কিন্তু কার আত্মা আসবে?’
‘প্ল্যানচেট করার উদ্দেশ্য হলো কারো আত্মাকে ডেকে তার সাথে কথা বলা। আমি এখন এই কাটা বটগাছের আত্মার সাথে কথা বলবো। আপনারা চোখ ও হাতের মুঠ বন্ধ করুন।’
তান্ত্রিকের কথায় সবাই বসে চোখ ও হাতের মুঠ বন্ধ করে স্থির হয়ে বসে রইলো। তান্ত্রিক মন্ত্র পড়েই যাচ্ছেন। ঘরটাতে শীতল হাওয়া বইতে লাগলো। ক্রমশ বাড়ছে, তবুও

চারজনই প্রচণ্ড ঘেমে গেছেন। মোমবাতির আলো নিভে গেল। মাথার খুলি থেকে ধোঁয়া বের হয়ে সম্পূর্ণ ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেল। হাহা করে বিদঘুটে হাসি হেসে এক মহিলা এসে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ হেসে জিজ্ঞেস করলো-, ‘কেন আমাকে ডেকেছিস?’
তান্ত্রিক চোখ বন্ধ রেখেই বললো-, ‘কে তুমি? আর এভাবে গ্রামের লোকদের মারছই বা কেন? তোমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ গ্রাম ছেড়ে ভয়ে চলে যাচ্ছে।’

হুংকার ছেড়ে আত্মা জবাব দিলো, ‘তাতে আমার কী? যখন কঠিন মুসিবতের সময় চিৎকার করে কেঁদেছিলাম তখন আমাকে এই গাঁয়ের মানুষেরা বাঁচায় নি, কেউ

এগিয়ে আসেনি। আমাকে বটগাছের নিচে পালাক্রমে ধর্ষণ করে মাথা কেটে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো, শেষরাতে মানুষজন টের পাবে বলে উত্তরদিকে শিমুলগাছের নিচে

আমাকে মাটি চাপা দিয়েছিলো, জানাজাও হয়নি। আমি ওদেরকেও মেরে ফেলেছি। আস্তে আস্তে এই গ্রাম শূণ্য করে দিবো। প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ।’
কথাগুলো বলে হাউমাউ করে পতিত আত্মা কাঁদতে লাগলো।
বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে মাতবর বললো-, ‘মাগো, আমরা তো জানতাম না। আমি নিরীহ মানুষ। সারাদিন খাটাখাটনির পর রাতে একটু ঘুমাই। গভীর ঘুমে তলিয়ে কিভাবে চিৎকার শুনবো মা?’
‘শোন, আমি শেষ তোকে মারতাম, কিন্তু তার আগেই তুই আমাকে এখানে আনলি।’
ভয়ার্ত কণ্ঠে মাতবর বলে উঠলো-, ‘আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুক মা। তোমার জন্য আমরা অনুতপ্ত। তোমার জন্য দান করবো, সদকা করবো। সবাই তোমার জন্য দোয়া করবো। তবুও আমাদের বাঁচতে দাও মাগো।’
‘কিন্তু তুই তো আমার আশ্রয় বটগাছটুকু কেড়ে নিয়েছিস। আমি কোথায় থাকবো? তোকে মরতেই হবে।’
কান্নার শব্দযোগে মাতবর বললো, ‘আল্লাহর দোহাই তোমার, আমাকে মেরো না। আমাদের ছেড়ে দাও। তুমি এখন যা করতে বলবে তাই হবে।’
‘শেষপর্যন্ত আল্লাহর দোহাই দিলি? আমাকে ডাকার আগে মনে ছিলো না , আত্মাদের ডাকা যায় না? এর নিয়মকানুন অনেক বড় গুনাহ।’
‘মাফ করো মা।’
‘মা বলে যখন ডেকেছিস তখন বলছি, মাফ চাইতে হলে আল্লাহর কাছে চা। আমি তো কেবল আমার প্রতিশোধ নেয়া শুরু করেছিলাম। কথা দিলাম আর কাউকে মারবো

না। আমার জন্য দান-সদকা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাস। আমি মৃত ব্যক্তি আমার তো সব পথ বন্ধ। আর হ্যাঁ, শিমুলগাছের পাশে ওরা আমাকে পুঁতে রেখেছে।

আমার কংকালটার জানাজা করাবি। বটগাছের স্থানে আরেকটা বটগাছের চারা রোপণ করবি। তোরা ভালো থাকিস, আমাকে আর ডাকিস না। আমি এখনো অতৃপ্ত। তবুও মানুষের জয় হোক।’
কথাগুলো শেষ করেই ধোঁয়ার সাথে সাথে আত্মাটা মিশে গেল। সকলের গা দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।
‘আত্মার কথাগুলো মেনে চলবেন বাবুজি।’ -তান্ত্রিকের উপদেশ।
হুঁ বলে উঠে দাঁড়ালেন মাতবর সাহেব।
পরদিন গ্রামবাসীকে ডেকে সকলের সামনে শিমুলগাছের পাশ থেকে একটা কংকাল বের করা হলো। মৃত মানুষের ন্যয় দাফন-কাফন করে তাকে কবরে শায়িত করা হলো।
গোপণে মাতবর আত্মা মেয়েটির জন্য সদকায়ে জারিয়া করে রাখলেন যাতে এর থেকে সওয়াব সে পায়।
পুরানো বটগাছের নিকট একটা বটগাছের চারা লাগালেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো বটগাছের চারাটা খুব দ্রুত বাড়তে থাকলো।
মাতবর সাহেবের পাগলামি দেখে ইমাম সাহেব বললেন, ‘মাতবর সাহেব, আমি জানি আপনি যা করেছেন তা মানুষের মঙ্গলের জন্য করেছেন। তবুও আপনাকে বলি

প্ল্যানচেট করা ইসলামে না-জায়েজ। কারণ এই কার্যসিদ্ধ করার জন্য অনেক শির্কের আশ্রয় নিতে হয়। আমি আপনাকে বলি আপনি আল্লাহর কাছে এর জন্য একান্তে অশ্রু ফেলে ক্ষমা চাইবেন।’
ইমাম সাহেবের কথাগুলো যাচাই করার জন্য মাতবর সাহেব আরো কয়েকজন আলেমের মতামত নিলেন, সবাই ইমাম সাহেবের মতই বলছেন।

তাদের কথানুযায়ী তাহাজ্জুদে চোখের পানি ফেলেন মাতরব সাহেব। মাঝে মাঝে বটগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মাতবর সাহেব।

সূর্যের আলোর সাথে একজন রমণী হাসছে। কিছুটা তৃপ্ত হাসি হাসার চেষ্টা করছে। তার চোখে-মুখে এখনো স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ। হয়তো সে তার জীবন বাঁচাতে চিৎকার

করে কেঁদেছিলো। কিন্তু সে চিৎকার ম্লান হয়ে গিয়েছিলো পথেই।

……………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত