অথচ

অথচ

তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা দিয়ে প্রবল জলীয় বাতাস এসে আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে কাঠের পাল্লার গায়ে। তার দাপটে পাল্লাদুটো দুমদাম করে ক্রমাগতই আছড়ে পড়ছে। বাইরে শুধু নীল ধোঁয়াশা। নীল কুয়াশা মাটি থেকে থরে থরে জমে উঠে যেন আকাশ ছুঁয়েছে! নীলাভ অন্ধকারের মধ্যে বুক চিতিয়ে মাঝেমধ্যেই তলোয়ার শানাচ্ছে বিদ্যুৎরেখা! মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বুকে থেকে থেকে যেন শয়তানের ঘোড়ার খুরের শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঝম্‌ঝম শব্দে পাগলের মত এদিক ওদিক সাপ্টে নিয়ে তীব্র গতিবেগে ঝরে পড়ছে জলধারা। হাওয়ার ধাক্কায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। কখনও ছাঁট এদিকে আসছে, কখনও ওদিকে। যেন গতিপথ ঠিক করে উঠতে পারছে না!

মাথার ওপরের আলোগুলো দপদপিয়ে উঠল। ইন্সপেক্টর সিন্‌হা আলগোছে ঠিক মাথার ওপরের বাল্বটার দিকে তাকালেন। হালকা হলুদ ম্যাটম্যাটে আলোটা যেন হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে দপ্‌ করে জ্বলে উঠল। তারপরই আবার নিষ্প্রভ! থানার ভেতরের খাঁ খাঁ শূন্যতা যেন খেয়ে নিচ্ছে আলোটার অর্ধেক জ্যোতি! যেটুকু অবশিষ্ট, সেটুকুও রেশ রেখেই মিলিয়ে যাচ্ছে অজানা কোনও কৃষ্ণগহ্বরে। ইন্সপেক্টর আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে নেন সেদিক থেকে। আচমকা তাঁর মনে হল, আলোটাকে বুঝি অন্যান্য দিনের চেয়েও আজ বেশি বিবর্ণ মনে হচ্ছে। বৃদ্ধ মানুষের চোখের ঘোলাটে জ্যোতির মত নিষ্প্রাণ! বাল্বটাকে পাল্টাতে হবে।

কড়কড় শব্দে আবার ঝল্‌সে উঠল বিদ্যুৎ। দিগন্তসীমাকে ফালাফালা করে দিয়ে একাধিক শিরা-উপশিরা বিস্তৃত করে জ্বলে উঠেই মিলিয়ে গেল। কিন্তু যেটুকু আলো দিয়ে গেল সেটুকুই থানার বাইরে দাঁড়ানো আগন্তুকটিকে দেখার জন্য যথেষ্ট! ক্ষণিকের জন্য ইন্সপেক্টর সিন্‌হা চমকে উঠলেন। দোষ তাঁর নয়। আগন্তুকের আবির্ভাবটাই চমকে দেওয়ার মতন! পলকের দেখায় মনে হল, কেউ বুঝি হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে এসে দাঁড়িয়েছে থানার দোরগোড়ায়। কোনও মানুষ নয়, বরং আবছা একটা সিল্যুয়েট! যার কোনও দেহ নেই! অশরীরীর মত তার ছায়াময় উপস্থিতি অনুভব করা যায়, কিন্তু কায়াহীন। হয়তো এই সাময়িক ভ্রান্তি আরও কিছুক্ষণ থাকত। কিন্তু তার আগেই ভ্রান্তিজাল ভেঙে দিয়ে গুটিগুটি পায়ে ভিতরের দিকে এগিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক।

ইন্সপেক্টর সিন্‌হা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছেন আগন্তুককে। বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ বলেই মনে হল। তবে বয়স্ক। পাটের মত ধব্‌ধবে সাদা মাথার চুল বৃষ্টির জলে ভিজে জব্‌জবে। গায়ের সিল্কের পাঞ্জাবিও খানিকটা ভেজা। ঠুক্‌ ঠুক্‌ করে অস্ফুট একটা শব্দকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছেন ভদ্রলোক। শব্দের উৎস তাঁর ডানহাতে ধরা পালিশ করা লাঠি। তিনি একটু এলোমেলো পা ফেলছেন। যেন অতিকষ্টে হাঁটতে হচ্ছে। কাছে আসতেই দেখা গেল, লাঠিটার মাথাটা সম্ভবত রুপো দিয়ে বাঁধানো। একটা মিষ্টি, অভিজাত সুগন্ধও নাকে এসে ঝাপ্টা মারল তাঁর। ভদ্রলোককে দেখতে দেখতেই বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছিল ইন্সপেক্টরের। এমন বর্ষণমুখর রাতে এরকম ধোপদুরস্ত হয়ে ভদ্রলোক করছিলেন কী? তাছাড়া এই ঝড়জলের মধ্যে বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট করে লাঠি ঠুকঠুকিয়েই বা থানায় আসতে হল কেন?

কোনরকম অপরাধ সংঘটিত না হলে তো কেউ এমন দুর্যোগ মাথায় করে থানায় আসে না! ইন্সপেক্টরের ভুরু কুঁচকে যায়। কী কেস? ছেলে-মেয়েরা বুড়ো বাপকে বাড়িছাড়া করেছে নাকি? সেই রিপোর্ট করতেই আসছেন? কিন্তু এ কি অত্যাচারিত, অসহায়, বুড়ো বাপের চেহারা! দেখলেই মনে হয় রীতিমত দুধ, ঘি, মাখন খেয়ে থাকেন! বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ত্বকের জৌলুশ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। সুন্দর চওড়া কাঠামো জরায় এখনও ভেঙে যায় নি। টানটান ঋজু চেহারা। তবে হাঁটাটা একটু অস্বাভাবিক। হাতে ধরা লাঠিটাও অল্প অল্প কাঁপছে।
ভদ্রলোকের আগমনে উপস্থিত সাব-ইন্সপেক্টর ও হাবিলদাররাও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কাটা এখনও কাটেনি। ইন্সপেক্টর দেখলেন, অনেকগুলো কৌতুহলী চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। ভদ্রলোক শ্লথ গতিতে এগিয়ে আসতে আসতেই হঠাৎ যেন একটু টাল খেলেন। হেড কনস্টেবল রতন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওঁকে ধরে ফেলেছে। ও ভদ্রলোকের লাঠিটা ধরতে যেতেই গমগমে গম্ভীর স্বরে প্রতিবাদ করলেন তিনি—

‘লাঠিটা ধরবেন না’। ভদ্রলোক একটু উত্তেজিত স্বরে বলেন—‘ওটা এভিডেন্স!’

‘এভিডেন্স!’ রতন কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়। ইন্সপেক্টর সিন্‌হা সহ সকলেরই চোখে তখন অগাধ বিস্ময়!

‘দেখছেন না!’ ভদ্রলোক রতনকে একটু আলগা ধমক দেন—‘আমি ভিজে গিয়েছি, কিন্তু লাঠিটাকে ভিজতে দিই নি। ওর বাঁটের ওপর শুকনো রক্তের দাগটাও কি দেখতে পাচ্ছেন না? এটা একটা মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌! নিন্‌, সাবধানে ধরুন’।

এ তো বক্তব্য নয়, আদেশ! রতন বিহ্বল দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল। ইন্সপেক্টরও কেমন যেন হতবাক হয়ে গিয়েছেন। উপর্যুপরি বিস্ময়ের ধাক্কায় ক্ষণিকের জন্য তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। লাঠিটা মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌! কার মার্ডার হল! তারই রিপোর্ট করতে এসেছেন এই বৃদ্ধ! একেবারে মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌ সঙ্গে নিয়ে!
পেশাগত দক্ষতায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। কড়া গলায় রতনকে লাঠিটাকে এভিডেন্স ব্যাগে ভরতে নির্দেশ দিলেন। রতন যতক্ষণে এভিডেন্স ব্যাগে লাঠিটাকে ভরে ইন্সপেক্টর সিন্‌হার সামনে আনল ততক্ষণে ভদ্রলোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে বসে পড়েছেন ইন্সপেক্টরের সামনের চেয়ারে। মৃদু স্বরে বললেন—‘জল’!

ইন্সপেক্টর টেবিলের ওপর থেকে জলের গ্লাসটা নিঃশব্দে এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে। এক চুমুকে পুরো জলটাই নিঃশেষ করে দিয়ে গ্লাসটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখলেন ভদ্রলোক। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। যেন গোটা বক্তব্যটা গুছিয়ে বলার জন্য প্রয়োজনীয় সময় চাইছেন।

‘স্যার, উনি ঠিকই বলেছেন’। রতন ইতিমধ্যেই ইন্সপেক্টরের সামনে পেশ করল লাঠিটা—‘মাথার কাছে, বাঁটে ব্লাডট্রেস আছে। তাজা নয়। তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে’।

ইন্সপেক্টর সিন্‌হা ততক্ষণে গ্লাভস পরে নিয়েছেন। লাঠিটাকে অতি সাবধানে নাড়াচাড়া করছেন। বৃদ্ধ ঠিকই বলেছেন। তিনি নিজে বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও লাঠিটার ওপরে একবিন্দু জলও পড়তে দেননি! এই দুর্যোগের রাতে এটা কী করে সম্ভব হল কে জানে। কিন্তু লাঠিটার বাঁটের মুখে শুকনো, বাদামি রক্তের দাগ একদম স্পষ্ট! লাঠিটা ভালো করে নিরীক্ষণ করতে করতেই বুঝলেন, হ্যাঁ, এরকম একটা মোক্ষম লাঠি দিয়ে অবশ্যই খুন করা যায়! এই রূপো বাঁধানো শক্ত বাঁটের আঘাতে কারোর মাথা ফেটে চৌচির হওয়া অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই তাই ঘটেছে। তবে সেই খুনটা করার জন্য অপরিসীম শক্তির প্রয়োজন, যা এই খুঁড়িয়ে চলা ভদ্রলোকের কাঁপা কাঁপা হাতে নেই বলেই মনে হয়।

ইন্সপেক্টর এবার বৃদ্ধ মানুষটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। এখন আর ওঁর চোখে কোনওরকম বিস্ময় নেই, বরং পুলিশ-সুলভ কাঠিন্য। একটু কড়া স্বরেই বললেন—‘কী ব্যাপার? কে খুন হয়েছে?’

ভদ্রলোক প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন না। বরং পিছন ফিরে বেশ কয়েকবার তাকালেন। অদ্ভুত ভয়ার্ত দৃষ্টি! যেন ওঁর ঠিক পিছনেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে! যখন খানিকটা আশ্বস্ত হলেন যে এই মুহূর্তে সেখানে কেউ নেই, তখন ধীরে ধীরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে আনলেন একটা ফটো! ইন্সপেক্টরের দিকে ছবিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন—‘দেখুন তো। ফটোতে আমার পাশে যে মহিলাকে দেখতে পাচ্ছেন, ওঁকে এখন দেখছেন কি না!’

আবার আরেকটা বিস্ময়ের ধাক্কা! সিন্‌হা কী বলবেন বুঝে পাচ্ছিলেন না। এটা একটা মার্ডার কেস! কিন্তু সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত মানুষটি একটি কথাও বলেননি। এরকম সিরিয়াস একটা ঘটনায় আচমকা এমন আবদার বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। তবু বৃদ্ধের কন্ঠে এমন কিছু ছিল যা অগ্রাহ্য করতে পারলেন না ইন্সপেক্টর। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে মানুষটির এই অদ্ভুত খামখেয়ালিপনার পেছন একটা প্রচন্ড আতঙ্ক কাজ করছে! চেয়ারে বসেও থেকে থেকে ফিরে ফিরে পেছন দিকে তাকাচ্ছেন! যেন অজান্তেই ওঁকে কেউ অনুসরণ করছে!
তিনি ফটোর দিকে দেখলেন। সামনে বসে থাকা বৃদ্ধকে ফটোতে শনাক্ত করতে অসুবিধে হল না। তাঁর পাশে সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। আটপৌরে ধরণে শাড়ি পড়েছেন। ফর্সা টুকটুকে মহিলার মাথার চুলও দুধসাদা। দুই গালে হাল্কা রক্তাভ আভা। থুতনিতে একটা আঁচিল।
‘উনি আমার স্ত্রী। আপনি কি ওঁকে আগে কখনও দেখেছেন?’

ভদ্রলোকের কন্ঠে উদ্বেগ—‘কিংবা এই মুহূর্তে দেখছেন?’

‘মানে?’

এই অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ইন্সপেক্টর কি উত্তর দেবেন ভেবে পেলেন না। অবাক স্বরে বললেন—‘আমি ওঁকে আগে কখনও দেখিনি। আর এখনই বা দেখব কী করে?’

‘কেন? আমার আশেপাশে ওঁকে একবারের জন্যও কি দেখেননি? উনি কি আমার সঙ্গে আসেননি? আমার পিছন পিছন?’ আতঙ্কে কন্ঠস্বর কাঁপছে ওঁর।

ইন্সপেক্টরের ধৈর্য প্রায় চূড়ান্তসীমায় পৌঁছেছে। লোকটা কি পাগল? এই ঝড়জলের রাত্রে ফাজলামি করতে এসেছে? কিন্তু রক্তাক্ত লাঠিটা যে অন্য ইতিহাস বলছে! অথচ…

তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন—‘আপনি এখানে একাই এসেছেন। আর এখানে একাই বসে আছেন। আর কেউ আসেনি। আপনার পিছনে পুলিশের লোকেরা ছাড়া আর কেউ নেই’।

ভদ্রলোকের সমস্ত স্নায়ু এতক্ষণ ধরে টানটান ছিল। রুদ্ধশ্বাসে তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন। এবার যেন খানিকটা শিথিল হলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—‘ওঃ ঈশ্বর! তবে সত্যিই খুনটা হয়েছে!’

প্রসঙ্গটা আবার খুনে ফিরেছে। এবার প্রবল কৌতুহলে বৃদ্ধের দিকে ঝুঁকে পড়লেন সিন্‌হা—‘খুন? কবে? কোথায়?’

‘হ্যাঁ, খুনই!’ তিনি একটা সজোর শ্বাস টানেন—‘খুন হয়েছে আমার বাড়িতে। একদিন আগে’। বলে একটু চুপ করে থেকে পরক্ষণেই যোগ করলেন—‘আমিই আমার স্ত্রী’কে খুন করেছি। ঐ লাঠিটা দিয়ে…হ্যাঁ! ওটাই মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌! অথচ…!’

ভদ্রলোক আরও কিছু বলার আগেই একটা নীল আলোর তীব্র ঝলকানি। কানের পর্দা প্রায় ফাটিয়ে দিয়ে প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল! তার ধাক্কায় জানলার কাচগুলো থর্‌থর্‌ করে কেঁপে উঠেছে। ইন্সপেক্টর কিছু বোঝার আগেই দুম্‌ করে চতুর্দিকটা অন্ধকার হয়ে গেল!
পাওয়ার কাট!

🔰🔰

জেনারেটরটাকে অজ্ঞাত কারণে অন্‌ করা গেল না। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা চলল না। দু একবার মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মত অস্ফুট ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতেই যেন শেষ নিঃশ্বাস ফেলল সেটা। রতনের অদ্ভুত লাগে! আশ্চর্য! আগে তো কখনও এটা এমন করেনি! সে যতটা সম্ভব জেনারেটরটাকে চেক করে দেখে। ব্যাটারি ঠিকই আছে। ফুয়েল যথেষ্ট আছে। কোনওরকম লিকেজও নেই। আর অন্য কোনওরকমের গোলমালও দেখা যাচ্ছে না! তবে কী হল?

‘ছেড়ে দে রতন’। সিন্‌হা বললেন—‘বরং মোমবাতি জ্বালিয়ে দে’।

‘ইয়েস স্যার’।

রতন এবার নির্দ্বিধায় হুকুম তামিল করল। ঘরে এখন বিজলী বাতির তীব্র আলোর বদলে মোমবাতির নম্র, ভীত আলো জ্বলে উঠেছে। সেই কাঁপা কাঁপা আলোয় বৃদ্ধ ভদ্রলোককে কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়! মোমবাতির ভীরু শিখাও যেন তাঁর ওপর আলো ফেলতে ভয় পাচ্ছে। সেই আলো আঁধারের মিশ্রণ মানুষটির মুখের বলিরেখায় কাটাকুটি খেলছে। এখন তাঁর অবয়ব আবছা। কিন্তু চোখদুটো আশ্চর্য উজ্জ্বল!

গলা খাঁকারি দিয়ে থেমে যাওয়া প্রসঙ্গটাকেই ফের টেনে আনলেন ইন্সপেক্টর সিন্‌হা। দৃঢ় কন্ঠে বললেন—‘আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করেছেন?’

‘হ্যাঁ’। ইন্সপেক্টরের চোখে চোখ রেখে জানালেন তিনি—‘করেছি। একদিন আগে’।

‘ঘটনার একদিন পরে থানায় আসার কারণ কী? আগেই এলেন না কেন?’

তিনি অপরাধীর মত মুখ করে বললেন–‘ভেবেছিলাম গোটা ঘটনাটা চেপে যাব। বাড়িতে বুড়ো-বুড়ি দুজনে ছাড়া কেউ নেই। ছেলে-মেয়েরা অবশ্য মাঝেমধ্যেই আসে। প্রতিবেশীরা তেমন খোঁজখবর নেয় না। বুড়ি না থাকলেও কারোর কিছু আসবে যাবে না। নিতান্তই যদি জিজ্ঞাসা করে, তবে বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেব। আমাকে ছেলে মেয়েরা কেউ অবিশ্বাস করবে না। ধরা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। বুড়ো বয়েসে জেলের ভাত খেতে কারই বা ইচ্ছে করে…!’

শেষ বাক্যটার মধ্যে খানিকটা অনুতাপ, খানিকটা হতাশা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল। সিন্‌হা ব্যঙ্গবঙ্কিম স্বরে বললেন—‘মিথ্যে কথা বলে ব্যাপারটা যখন চাপা দেবেনই ভেবেছিলেন, তখন হঠাৎ রাজা হরিশচন্দ্রের আত্মা ঢুকে পড়ল কী করে আপনার মধ্যে?’
ভদ্রলোকের চোখদুটো মোমবাতির আলোয় ঝিকিয়ে উঠল। যেন কথাটা শুনে শিউরে উঠলেন। চাপা আতঙ্কিত স্বরে ফিস্‌ফিস্‌ করে বললেন—‘আপনি আত্মায় বিশ্বাস করেন?’

‘না’

‘যদি বলি আমার কনফেশনের কারণ আত্মাই!’

‘হো-য়া-ট!’ বিরক্তি ও বিস্ময় একসঙ্গে মিশল সিন্‌হার কন্ঠে—‘আপনি বলতে চান্‌, আপনার কনফেশনের কারণ আ–ত্মা!’

‘হ্যাঁ! ওঁর আত্মা’। ছবিতে নিজের স্ত্রী’র দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন তিনি—‘ও চায় আমি শাস্তি পাই! তাই ও কিছুতেই আমায় ছাড়ছে না! পেছনে সবসময় লেগেই আছে!’

রতন ফিক্‌ করে হেসে ফেলে! দাদু তাহলে এই বৃষ্টিঝরা রাতে একটা ভূতের গল্প বলতে এসেছে! বাকিদের মুখেও মৃদু মৃদু হাসি। এতক্ষণে ভদ্রলোকের স্বভাব ওরা সকলেই ধরতে পেরেছে! কী অদ্ভুত প্রাণী এই নিঃসঙ্গ বুড়ো-বুড়িরা! এদের একেকজনের মাথায় উদ্ভট উদ্ভট রকমের খেয়াল চাপে। সম্ভবত জীবনের একঘেয়ে একাকিত্বই এর জন্য দায়ী! অলস মস্তিষ্ক থেকে তাই একের পর এক বৈচিত্রময় এবং আজগুবি কল্পকাহিনী বেরিয়ে পড়ে। এইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খুব ভালো করেই চেনে ওরা। কারোর ধারণা, সংসারের সবাই ষড়যন্ত্র করে তাকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কেউ বা কোনও আজগুবি খুনের ঘটনা বলতে চলে আসেন! তার দৃঢ় ধারণা, তিনি খুনীকে চেনেন ও স্পষ্টভাবে ‘খুনী’ হিসাবে শনাক্ত করেও ফেলেছেন। অথচ অপদার্থ পুলিশগুলো সে ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছুই জানে না! ইনিও যে সেই দলেই পড়েন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই!

ইন্সপেক্টর সিন্‌হা কী বলবেন বুঝতে পারেন না। বুড়োকে ‘ধুত্তোর’ বলে তাড়িয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু লাঠির বাঁটের ওপর রক্তের দাগটা তাঁকে নিবৃত্ত করছে। কিছু তো একটা হয়েছেই। বৃদ্ধ হয়তো অন্য কারোর অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিতে চাইছেন! কারণ এই কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠি দিয়ে কি এত জোরে মারতে পারেন উনি যে কেউ মরেই যাবে! ইন্সপেক্টর ঠিক করলেন, সত্যি হোক্‌ কী মিথ্যে—গল্পটা শুনবেন।
‘ঠিক কী হয়েছিল?’ তিনি ‘আত্মা’ থেকে বিষয়টাকে ‘খুনে’র দিকে নিয়ে গেলেন—‘কেন মারলেন স্ত্রীকে?’

‘অসহ্য হয়ে উঠেছিল!’ বৃদ্ধের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে—‘ওর পাগলামি অসহ্য হয়ে উঠেছিল আমার কাছে! মানসিক রোগ তো ছিলই।

স্কিজোফ্রেনিয়া। মেডিকেশনের ফলে অনেকটা সুস্থ হয়েও উঠেছিল। ভালোই ছিল, হঠাৎ আচম্‌কা কী হল কে জানে! এক মাস আগে থেকে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল। এমনিতে হয়তো দিব্যি সুস্থ, স্বাভাবিক আছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই কথা নেই, বার্তা নেই আমাকে তেড়ে মারতে আসে! ওর ধারণা আমি ওকে খুন করব! একদিন আগে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। এমনিতে ঝগড়া-ঝাঁটি আমাদের মধ্যে হয়ই। কিন্তু সেদিন ও একটা ছুরি নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ করে! আমাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। কিন্তু কিছুতেই ওকে থামাতে পারছিলাম না। ও ডিটারমাইন্ড ছিল আমাকে খুন করবে। তাই বাধ্য হয়ে এই লাঠিটা দিয়ে এক বাড়ি বসিয়ে দিলাম। মারটা একটু জোরে হয়ে গিয়েছিল…!’

ইন্সপেক্টর সাগ্রহে শুনছিলেন। আস্তে আস্তে বললেন—‘তার মানে সেল্‌ফ ডিফেন্সে আপনি এই হত্যাটা করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তো?’
‘সেল্‌ফ ডিফেন্সে করেছি ঠিকই’। তিনি ক্লান্ত স্বরে বললেন—‘কিন্তু খুন তো খুনই! তাই যখন বুঝতে পারলাম ও মারা গিয়েছে, তখন ভয় পেলাম। প্রচন্ড ভয়! কিছুক্ষণের জন্য মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। কী করব, কী করা উচিত—কিছুই ভেবে পেলাম না’।

সিন্‌হা সাগ্রহে শুনছেন। বৃদ্ধ তার দিকে একঝলক তাকিয়েই ফের নিজের কথা বলতে থাকলেন। তিনি খুনী হতে পারেন, কিন্তু মনের কথা কাউকে খুলে বলার প্রয়োজন তাঁরও আছে। যে যন্ত্রণা দুদিন ধরে ভোগ করে চলেছেন, সেই যন্ত্রণার বোঝা কোথাও না কোথাও তো নামিয়ে রাখতেই হবে।

‘আমি কিছুক্ষণ মৃতদেহের পাশে বসে রইলাম। চুপচাপ। অসাড়। মনে হচ্ছিল, এ সময়ের কোনও শেষ নেই! সামনে পড়ে আছে আমার স্ত্রী’র লাশ! লাঠির ঘায়ে মাথাটা চুরমার হয়ে গিয়েছে। ওর মাথা থেকে ঘন রক্ত পড়ছে মেঝের ওপর। কী টক্‌টকে লাল, বীভৎস রক্ত!’ বলতে বলতেই বৃদ্ধ যেন দৃশ্যটা কল্পনা করে কেঁপে উঠলেন। একটু চুপ করে থেকে একটা জোরালো শ্বাস টানলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন—‘কিছুক্ষণ পর আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার মাথা তখন একটু একটু করে কাজ করছে। বুঝতে পারলাম, কী সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেছি। প্রথমে ভীষণ আফসোস হল। তারপরে ভীষণ ভয়! লাশটাকে নিয়ে কী করব! আমি আমার স্ত্রীকেই খুন করে ফেলেছি জানতে পারলে কি আর রক্ষা থাকবে? কোমরে দড়ি দিয়ে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ! ছেলে-মেয়েরা ভয়ঙ্কর আঘাত পাবে। হয়তো আমার সঙ্গে সম্পর্কই রাখবে না, বাঁচানোর চেষ্টা তো দূর! তারপর কোর্ট, শাস্তি…!’

তিনি আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন—‘আমি সেটা হতে দিতে পারতাম না। ঠিক করলাম যেমন করেই হোক্‌, ঘটনাটা চাপা দিতেই হবে। এরপর মাথা ঠান্ডা করে আমি লাশটাকে সরিয়ে দিলাম। তখনই কী করব, ভেবে পাইনি। তাই মৃতদেহটাকে কার্পেটে মুড়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখি। জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিই রক্তের দাগও। লাঠিটাকেও পরিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাঁটের ওপরের দাগটা কিছুতেই উঠল না! তারপর মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগলাম যে কী করব! ছেলে-মেয়েদের কী বলব! প্রতিবেশীরা খুব একটা বাড়িতে আসে না। তাদের নিয়ে চিন্তা নেই। যেমন তেমন করে কিছু একটা বলে দিলেই হবে। কিন্তু আমাদের একটি কাজের মেয়ে আছে। সে সকাল সন্ধ্যা বাড়িতে এসে ঘরের কাজ, রান্না বান্না করে দিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ভয় হল, মালকিনকে দেখতে না পেলে সে আমাকে কী বলবে! আরও ভয়ের কথা, আমি তাকে কী বলব! যখন আমি লাশ সরাচ্ছিলাম, মেঝের রক্ত পরিষ্কার করছিলাম, তখনই আমার মাথায় এসব চিন্তা আসছিল। সমস্ত কাজ সেরে যখন ধীরে সুস্থে সোফায় এসে বসেছি, আমার স্ত্রীয়ের নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ হিসাবে কোনও বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করার চেষ্টা করছি, ঠিক তখনই মোবাইলে মেয়ের ফোন এল…।

আমি তখনও কিছু বলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কী বলব? সত্যি কথাটাকেই ঘুরিয়ে বলে দেব? সবচেয়ে সহজ ছিল সত্যিটাকেই অন্যভাবে দেখানো। বলতে পারি, তোর মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে! একথা শুনলে মেয়ে তখনই বাড়িতে চলে আসবে। মায়ের মৃতদেহটাকে হয়তো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে ডাক্তাররা দেখলেই বুঝতে পারবেন যে এটা অ্যাক্সিডেন্ট কেস নয়। ক্ষত দেখে ওদের সন্দেহ হবে, পুলিশ আসবে, পোস্টমর্টেমও হয়তো হবে। সেখানেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবারও বলছি, সেই ফাঁদে আমি পড়তে চাইনি। তাই ফোনও বাজতে থাকল। আমিও ভাবতে লাগলাম যে কী গল্প বানাবো।

মোবাইলটা বাজতে বাজতেই একসময় চুপ করে গেল। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাব, তার আগেই এবার বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এভাবে বেশিক্ষণ অ্যাভয়েড করা যাবে না। মেয়ে হয়তো আমায় ফোনে না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এবার যদি ল্যান্ডলাইনটাও না ধরি তবে বলা যায় না, হঠাৎ হয়তো বাড়িতে এসেই হাজির হল। ওর শ্বশুরবাড়ি বেশি দূরে নয়। তাছাড়া ওর নিজের গাড়ি আছে। নিজেই ড্রাইভ করতে পারে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই হয়তো চলে আসবে। অনেক প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে ওর মা কোথায়…!

ভাবতেই সেই ভয়টা আবার আমায় আঁকড়ে ধরল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ফোনটা আমায় ধরতেই হবে! কিন্তু কয়েক মিনিট আমার সঙ্গে কথা বলেই তো ও ওর মাকে চাইবে। তখন কী করব!’

ইন্সপেক্টর গভীর মনোযোগে ভদ্রলোকের কথা শুনছিলেন। তিনি আস্তে আস্তে বললেন—‘শেষপর্যন্ত কী বললেন মেয়েকে?’

মানুষটি রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন—‘সেটাই তো আসল কথা। আমায় কিছু বলতেই হয়নি! কোনও কৈফিয়ত দিতে হয়নি। শুধু মেয়েকে কেন! কাউকেই কিছু বলতে হয়নি! বলার সুযোগই ছিল না…!’

‘মানে?’

ভদ্রলোক করুণ স্বরে বললেন—‘বলব! সব কথা বলব। বলতেই তো এসেছি! অথচ…!’

‘অথচ?’

‘জানিনা আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না’।

‘হ্যালো’।

শেষপর্যন্ত একরকম বাধ্য হয়েই ফোনটা ধরতে হল আমাকে। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভয়! গল্পটা এখনও ঠিকমতন বানিয়ে উঠতে পারিনি। কী বলব মেয়েকে? বলব, যে ওর মা নিরুদ্দেশ? ধোঁপে টিঁকবে না! মেয়ে সোজা চলে যাবে পুলিশ স্টেশনে। মিসিং রিপোর্ট লেখাবে। তারপর তীব্র পুলিশি জেরার মুখে কি অবিচল থাকতে পারব! আর ওরা যদি আমার বাড়িটাই সার্চ করে দেখে।

ভাবতেই হৃৎপিন্ডটা যেন চড়াৎ করে গলার কাছে এসে গিয়েছে। বেশি কষ্ট করতে হবে না পুলিশকে। আমাদের মাস্টার বেডরুমের খাটের নীচেই কার্পেটে মোড়া…!

না…না! নিরুদ্দেশ চলবে না। তবে কি বেড়াতে পাঠিয়ে দেব! অনেকদিন ধরে ও হরিদ্বারা যাওয়ার বায়না করছিল বটে। ছেলে-মেয়েদেরও বলেছিল—‘তোরা আমাকে হরিদ্বার পাঠানোর বন্দোবস্ত কর্‌। এই ঝগড়ুটে, কুচুটে বুড়োর সঙ্গে সংসার করে অনেক অপরাধ করেছি। হরিদ্বারে গিয়ে সেসব পাপ ধুয়ে আসব’।

ছেলে-মেয়েরা হেসেছে। বলেছে—‘তুমিও না মা! পারোও!’

তবে কি বলে দেব, যে ‘তোদের মা হরিদ্বার গিয়েছে?’ না! সেক্ষেত্রেও অনেক প্রশ্ন উঠবে। কবে গেল? কার সঙ্গে গেল? ওদের মা ছেলে-মেয়েকে কিছু না বলে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার লোক নয়। তাছাড়া সকালেও মেয়ের সঙ্গে মায়ের কথা হয়েছে। তখন কিছু বলেনি, অথচ একবেলার মধ্যেই সে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে হরিদ্বার রওনা হয়ে গেল? নাঃ, মেয়ে বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া আমাকে ছাড়া একা একা কীকরে যাবে? আমাদের মতন বয়স্ক মানুষেরা কখনই অতদূরে একা যেতে পারে না। ট্র্যাভেল এজেন্সি প্রয়োজন। কিন্তু কোন্‌ ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম বলব? ওরা যদি খোঁজ নেয়।

ভাবতে ভাবতেই মাথা গরম হয়ে গেল। নাঃ, এটাও চলবে না। তবে কী বলি? কী বললে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? ওদিকে টেলিফোনটাও…!
‘হ্যালো’।

এতকিছু ভাবতে ভাবতেই ফোনটা শেষপর্যন্ত তুলেই ফেললাম। ওপাশ থেকে ভেসে এল মেয়ের অধৈর্য, উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর!

‘কী হল! এতক্ষণ ধরে ফোন করছি। ফোনটা ধরছ না কেন?’ মেয়ে একেবারে এক নিঃশ্বাসে গড়গড়িয়ে বলে যেতে থাকল—‘তাছাড়া তোমার মোবাইলটা কোথায়? প্রায় বারোবার ট্রাই করেছি। বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে! আমার তো রীতিমত টেনশন হচ্ছিল…! আঃ, মোবাইলটা হাতের কাছে রাখো না কেন? দরকারে-অদরকারে লাগে। তোমরা সত্যি! কিছুতেই বুঝবে না যে আমাদেরও চিন্তা হয়…!’

বুঝতে পারছিলাম যে মেয়ে এখন রীতিমত একটা ভাষণ দেবে। ওর মায়েরও এই একই স্বভাব। একবার জ্ঞান দেওয়া শুরু হলে আর থামতেই চায় না! অন্যদিন হলে ওকে থামিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ ওর অনর্গল কথার স্রোতকে আটকালাম না। ও যতক্ষণ কথা বলবে, ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হয়ে কিছু একটা ভেবে ফেলতে পারব।

‘বাবা!’

ও দিক থেকে মেয়ের ধমক ভেসে এল—‘আমি ফালতু বকে যাচ্ছি আর তুমি একটা কথাও শুনছ না!’

আমি ধমক খেয়ে একটু কুঁকড়ে গেলাম। কোনওরকমে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতেই বললাম—‘না শুনছি তো!’

‘ফোন তুলছিলে না কেন এতক্ষণ?’

কোনমতে বলি—‘একটু টয়লেটে গিয়েছিলাম। বল্‌…’।

মেয়ে একটু থেমে কড়া গলায় বলে—‘আচ্ছা, তোমরা আর কবে ম্যাচিওর হবে বলো তো? বয়েস তো কম হল না! ছেলে, মেয়ে—নাতি, নাতনি আছে। এখন যদি মেজাজের ওপর কন্ট্রোল রাখতে না পারো, তবে আর কবে পারবে?’

আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক্‌ করে ওঠে! ও কী করে জানতে পারল যে এরকম একটা ঘটনা হয়ে গিয়েছে! কেউ ওকে খবর দিল কি? কিন্তু কে…? এখন কী বলব? কী করে বোঝাব যে আমি কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি…! কী করে বোঝাব যে পরিস্থিতি সামলাতে পারিনি…!

মরিয়া হয়ে বললাম—‘শোন্‌ খুকু, আমি কিছু করতে চাই নি। ইনফ্যাক্ট আমি তোর মাকে অনেক ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছি…!’

‘থামো!’ মেয়ে উত্তেজিত—‘আমি সব জানি। মা আমাকে সব বলেছে!’
আমি ‘থ’! কী বলল ও? মনে হল একটা ইলেকট্রিক শক্‌ খেলাম! আর সে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শিড়দাঁড়া বেয়ে সোজা মস্তিষ্কে চলে গেল! মাথার ভেতরটা ঝন্‌ঝন্‌ করে ওঠে! এসি চলছে। তার মধ্যেও আমি কুলকুল করে ঘামছি। আমার স্ত্রী মেয়েকে সব বলেছে! কিন্তু কখন বলল? ঘটনার আগে! কিন্তু ওকে তো কোনও ফোন করতে দেখিনি। তাছাড়া মেয়েকে ফোন করে কী বলেছে? খুন হওয়ার আগে তো বলতে পারে না যে ও খুন হতে চলেছে! তবে কী জানে মেয়ে!

‘তোমরা আজ আবার ঝগড়া করেছ! তুমি মাকে উল্টোপাল্টা বলেছ! এমনকি গায়ে হাত তুলতেও গিয়েছিলে! ছিঃ বাবা, এটা তোমার কাছে এক্সপেক্ট করিনি!’ মেয়ে একটু থেমে যোগ করল—‘বুড়ো মানুষটা যে রেগে মেগে একবস্ত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, কোন্‌ চুলোয় গেল সেটাও তো জানার চেষ্টা করোনি! মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, কোনওরকম অ্যাক্সিডেন্টও তো হতে পারত! আজকাল কতরকমের দুর্ঘটনা ঘটছে চতুর্দিকে। সেরকম যদি কিছু হয়ে যেত! কোনও খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলে যে মা কোথায় গেল!’

আমার মাথায় সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। মেয়েটা কী বলছে! ওর মা রেগেমেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে! এসব কথা ওকে কে বলল! আর কোন্‌ মায়ের কথা বলছে সে! এইমাত্রই তো তার লাশটা আমি লুকিয়ে রেখে এসেছি। নিজের হাতে মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে তাকে আমি খুন করেছি…! অথচ কার কথা বলছে তবে ও! কার কথা…!

‘খুকু…!’ আমি কাতর গলায় ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি—‘তোর কোনও ভুল হচ্ছে…’।

‘কোনও ভুল হচ্ছে না’। সে রাগত ভঙ্গিতে জানায়—‘এই তো প্রায় মিনিট পনেরো আগে মা আমার কাছে এসে উপস্থিত! এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমি তো দেখে অবাক! আসার পর থেকেই কান্নাকাটি করে যাচ্ছে! তুমি নাকি রাগের মাথায় মাকে লাঠি দিয়ে মারতেও গিয়েছিলে! ছিঃ বাবা! তুমি কী! এই বয়েসে স্বামী-স্ত্রী মিলে কোথায় সুখে শান্তিতে থাকবে—তা নয় কুকুর-বিড়ালের মত মারপিট করছ! নিজের স্ত্রী’র গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছ! কী করে পারলে?’

আমি পাথরের মত দাঁড়িয়েছিলাম। আমার স্ত্রী নাকি মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত! এটা কি আদৌ সম্ভব? নাকি অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা ঠাট্টা! আমার মনে একটা অদ্ভুত আশঙ্কা ঘনিয়ে এসেছে। বুঝতে পারলাম যে ও সব কিছু জানে! কী করে জানল তা জানিনা। কিন্তু নিশ্চয়ই জানে। কায়দা করে আমার মুখ থেকে সত্যিটা বের করতে চায়। আমি অনেক ফিল্মে বা সিরিয়ালে দেখেছি, খুনীর মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের করার জন্য এই কৌশলটা অনেকেই অবলম্বন করে থাকে। আমাদের কথোপকথনটা যে রাস্তায় যাচ্ছিল, তাতে আমার রি-অ্যাকশন অনেকটা এরকম হওয়া উচিত ছিল—
‘খুকু, তোর মা কিছুতেই তোর বাড়িতে যেতে পারে না! তুই এভাবে মিথ্যে বল্‌ছিস্‌ কেন?’

মেয়ে বলবে—‘মিথ্যে কথা বলব কেন? এই তো, মা একেবারে আমার সামনে মুখোমুখি বসে আছে!’

ওর নিষ্ঠুর রসিকতা আমার অসহ্য লাগবে। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলব—‘ফাজলামিরও একটা সীমা থাকে! তোর মা কিছুতেই তোর বাড়ি যেতে পারে না! অসম্ভব!’

‘কেন অসম্ভব?’ মেয়েও উত্তেজিত—‘মা কি আমার বাড়ি চেনে না যে আসতে পারবে না? এর আগেও তো এসেছে। যতবার তোমরা ঝগড়া করেছ, মা রাগ করে ততবার আমাদের কাছে চলে এসেছে! তবে এবার আসতে পারবে না কেন? মা এসেছে, তোমার কীর্তিকাহিনীর কথাও শুনিয়েছে! বৌয়ের গায়ে হাত তোলার নোংরা অভ্যেসটা তো তোমার কখনও ছিল না বাবা? তবে এবার কী হল?’

আমাদের কথোপকথন ক্রমাগত উত্তেজনার শীর্ষে পৌঁছবে। আমি ওকে অসংখ্যবার বোঝানোর চেষ্টা করব যে ওর মা কিছুতেই ওর বাড়ি যেতে পারে না! ও আমাকে বারবার বোঝাবে যে ওর মা এই মুহূর্তে ওর নাকের সামনেই বসে আছে এবং কাঁদতে কাঁদতে আমার গুষ্টির তুষ্টি করছে। এরকম অযৌক্তিক ও অতিপ্রাকৃতিক কথা শুনতে শুনতে একসময় আমি আমার কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলব, এবং চিৎকার করে শেষপর্যন্ত বলে উঠব—‘এটা একদম অসম্ভব! ও তোর ওখানে থাকতেই পারে না, কারণ আমি ওকে একটু আগেই খুন…!’

নাঃ, কিছুতেই ও ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। আমি নিজেকে অতিকষ্টে শান্ত করি। আস্তে আস্তে বলি—‘সরি মা। আসলে মাথাটা একটু বেশিই গরম হয়ে গিয়েছিল। আর কখনও করব না। তুই তোর মাকে বোঝা। আপাতত আজকের রাতটা ওখানেই থাকুক। কাল সকালেই আমি ওকে নিয়ে আসব’।

‘তোমাকে আসতে হবে না’। মেয়ে যেন এবার একটু নরম হল—‘আমিই কাল সকালে অফিসে যাওয়ার পথে মাকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব’। কথাটা শেষ করে বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে এবার অনেক শান্ত গলায় বলল—‘বাবা, একটু বোঝার চেষ্টা করো। তোমাদের বয়েস হয়েছে। এই বয়েসে এরকম অশান্তি করতে নেই। তোমার হাই ব্লাড প্রেশার আছে। উত্তেজনার মাথায় যদি কিছু হয়ে যায়! এখন কি এরকম মারপিট-দাঙ্গা হাঙ্গামা মানায়?’

‘ঠিক আছে!’ আমি শান্ত ভাবেই গোটা ব্যাপারটা মেনে নিই—‘সব দোষ আমারই। কথা দিচ্ছি আর কখনও তোকে নালিশ করার সুযোগ দেব না’।

আরও দু একটা কথার পর মেয়ে ফোনটা রেখে দিল। ও যেন একটু হতাশ হল! আমি মিটিমিটি হাসছিলাম। এত সহজে স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারবে না আমার কাছ থেকে। সম্পর্কে আমি তো ওর বাপ! এখন একটু ভয় পেয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু বোধবুদ্ধিশূন্য হয়ে যাইনি। এত সহজে আমায় কাত করতে পারবে না! মৃত মানুষ কখনই হেঁটে চলে বেড়াতে পারে না! আমি জানি, ওর মা কখনই ওদের বাড়ি যেতে পারে না। কখনই না! শুধু একটাই প্রশ্ন—এত তাড়াতাড়ি ও খবরটা পেল কী করে! কে দিল!

তবু সেদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে কী মনে করে একবার খাটের তলাটা ভালো করে দেখে নিলাম। হ্যাঁ, লাশটা যথাস্থানেই আছে। সেইভাবেই কার্পেট মোড়া অবস্থায়। কোনও নড়ন চড়ন নেই। মৃতা স্ত্রীয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম। শরীরটা ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। গোটা দেহ মৃত্যুর স্পর্শে কঠিন!

আমি নিশ্চিত হলাম—মেয়েটা আমাকে মিথ্যে কথা বলে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওকে আমি সফল হতে দিইনি’।

এই অবধি বলে থামলেন বৃদ্ধ। সিন্‌হা চুপ করে তাঁর স্বীকারোক্তি শুনছিলেন। এবার বললেন—‘তারপর?’

🔰🔰

রোজ ঠিক ছ’টার সময়ে আমাদের কাজের মেয়ে কল্যাণী আসে। ও একসঙ্গে অনেক বাড়িতে কাজ করে। ভীষণ পাংচুয়াল। একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে মিলিয়ে কাজ করে যায়। ছ’টা থেকে ন’টার মধ্যে বাড়ির তোলা কাজ, রান্না-বান্না সব মিটিয়ে বেরিয়ে যায়। দরজা খুলতে এক সেকেন্ডও দেরি হলে বেল বাজিয়ে বাজিয়ে কানের পোকা নাড়িয়ে দেবে। অন্যান্য দিন আমার স্ত্রীই উঠে গিয়ে দরজা খোলে। কিন্তু যেহেতু এখন সেটা সম্ভব নয়, সেহেতু সকালে আমাকেই উঠতে হবে। সেজন্য একটু সজাগ ছিলাম।

সেরাতে ঘুমটা তেমন ভালো হল না। যত চেষ্টা করছি, ততই যেন ঘুমটা আমার চোখ থেকে সরে সরে যাচ্ছে। সে বীভৎস অনুভূতির কথা বলা অসম্ভব! কাউকে সে অবস্থা বোঝানো যাবে না! যে বিছানায় শুয়ে আছি, ঠিক তার নীচেই পড়ে আছে একটা মৃতদেহ! একটা শীতল, নিথর লাশ! যে লাশটা কখনও আমার জীবনসঙ্গিনী ছিল। এই শয্যাতেই ছড়িয়ে আছে তার অস্তিত্ব! বালিশে এখনও ফুলেল তেলের মিষ্টি গন্ধ!

শোবার ঘরের আলনায় থরে থরে তার শাড়ি সাজানো! ড্রেসিং টেবিলে ওর অজস্র নাম না জানা ক্রিম, চুলের কাঁটা, চিরুনি সাজানো রয়েছে। চিরুনিতে কয়েকগাছি চুল এখনও লেগে আছে। সব কিছু যথাস্থানে মজুত, কিন্তু মানুষটাই নেই!

আলো নিভিয়ে এসি অন করে চোখ বুঁজে ঘুমোনোর চেষ্টা করছি। অথচ ঘুম আসছে না। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার ঠিক পাশেই কার যেন একটা অদ্ভুত নিঃশব্দ উপস্থিতি! কেউ যেন ঠিক আমার পাশটিতেই এসে শুয়েছে! কখনও মনে হল, সে আমাকে দেখছে! কখনও আবার মনে হয় একটা বরফ শীতল হাত আমায় ছুঁয়ে গেল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসি। তাড়াতাড়ি খানিকটা সরে যাই! ভেতরে ভেতরে আবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। একটা তীব্র অস্বস্তিও মনের মধ্যে কাজ করছিল। মেয়েটা হয়তো সব জেনে গিয়েছে। এবার সে কী করবে সেটাই চিন্তার বিষয়! ও কাল সকালে হয়তো পুলিশ নিয়ে এসে হাজির হবে! নয়তো…!

এসব চিন্তা করতে করতেই ভোরের দিকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। যখন ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে আটটা বেজে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কী সর্বনাশ! এত দেরি করে ফেলেছি! কল্যাণী নিশ্চয়ই বেল বাজিয়ে বাজিয়ে শেষপর্যন্ত বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছে। আজ আর বাড়িতে রান্না-বান্না কিছু হবে না। আমি নিজে রাঁধতেও জানি না যে হাত পুড়িয়ে রান্না করব। সকালে না উঠতে পারার জন্য নিজের ওপরই ভীষণ বিরক্তি হল! এবার ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার অবধি, সব বাইরে থেকে আনিয়ে খেতে হবে। এই বয়সে বাইরের খাবার খাওয়াও ঠিক নয়! তাছাড়া আমার কি এখন চিন্তার শেষ আছে? সকাল হওয়া মানেই কিছু লোকের মুখোমুখি হওয়া! এই মুহূর্তে যেটা কোনমতেই ইপ্সিত নয়। তাছাড়া লাশটারও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে তো ঘরে ফেলে রাখা যায় না। হয়তো কয়েক ঘন্টা পরেই দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করবে। সেই গন্ধ চাপা দেব কী করে?

মনের মধ্যে চাপা বিরক্তি নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠলাম। কিন্তু পায়ের আঙুলগুলো মেঝে স্পর্শ করতেই আবার চমক! মেঝেটা কেমন ভেজা ভেজা লাগছে না? ঠিক যেন এই মুহূর্তেই কেউ মেঝেটা মুছে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই নাকে এল ফিনাইলের চাপা গন্ধ! হ্যাঁ, কল্যাণী সপ্তাহে তিনবার ফিনাইল দিয়ে ঘর মোছে। মেঝের অবস্থা দেখে মনে হল, সদ্য সদ্যই ও ঘর মুছে গিয়েছে!

কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব! দরজা কে খুলে দিল! আমি স্তম্ভিত! মাথাটা যেন কাজই করছে না। তবে কি আমিই ঘুমের ঘোরে কোনওমতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি? অথচ সেরকম কিছুই তো মনে পড়ছে না! অগত্যা কৌতুহলী হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। বেডরুমের বাইরে পা রাখতেই শুনতে পাই কল্যাণীর চাঁছাছোলা কন্ঠস্বর—‘আজকাল সব কিছুরই দাম বাড়তিছে মা! মরদটাকে কতবার বলি—কিছু একটা কাম কাজ করো! তুমি বাবু হয়ে ঘরে বসে থাকবে, আর আমি পাঁচ বাড়ি কাজ করে ইন্তি বিন্তি করে সংসার চালাব—সেটা কেমন কথা বলো! তো সে বাবুর কি শোনার সময় আছে? তিনি শুধু হুকুম করবেন আর মদ গিলবেন! এই মরদ জাতটাই বড় বেইমান মাগো! খাওয়াও-থোয়াও-মাখাও, তবু মানবে নি কো…!’

কিচেনের দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মেঝে মুছতে মুছতেই আপনমনে বকে যাচ্ছিল কল্যাণী! আমাকে দেখতে পেয়েই জিভ কাটল। সম্ভবত ‘মরদ’ জাতটাকে গালাগালি দিয়ে ফেলেছে বলে! কিন্তু আমার বিস্ময় তখন ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। কল্যাণীকে দরজাটা কে খুলে দিল! আর ও কথা বলছেই বা কার সঙ্গে! এ বাড়িতে ‘মা’ বলে ও একজনকেই ডাকে! অথচ…!

একটা গোটা প্রশ্নচিহ্নের পাহাড় আমার মাথায় ভেঙে পড়ল। মনে হল, কেউ আমার গলা চেপে ধরেছে। তবু কোনমতে বললাম—‘তুই একা একা কার সঙ্গে বক্‌বক্‌ করছিস্‌?’

কল্যাণী হেসে ফেলল। ওর কন্ঠস্বর শুনলে সম্ভবত হাঁড়িচাচাও লজ্জা পাবে। কথা বললে মনে হয়, কেউ বুঝি জোরে জোরে কাঁসার থালা, বাটি বাজাচ্ছে! এবার মনে হল, কাঁসার থালাবাটিগুলো তিনতলা থেকে কেউ ফেলে দিয়েছে। হাসতে হাসতে বলল—‘ওমা! একা একা কথা বলব কেন? মায়ের সঙ্গেই তো এট্টু সুখ-দুঃখির কথা বলতেছি! দেখতে পাচ্ছনি কো?’

মা! মানে আমার স্ত্রী! তার সঙ্গে ও সুখ দুঃখের গল্প করছে! অসম্ভব! হতেই পারে না। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! কালকে আমার মেয়ে, আজকে কল্যাণী…! ওরা সবাই মিলে এসব কী অসম্ভব কথা বলে চলেছে! এখনও বেডরুমে খাটের তলায় লুকোনো আছে লাশটা। কাল রাতেই চেক করেছি! অথচ কল্যাণী নাকি ওর ‘মা’ এর সঙ্গে কথা বলছে!

আমি ধম্‌কে উঠলাম—‘বাজে কথা বলিস্‌ না। কোথায় তোর মা? সে তো এখানে নেই!’

সে তার কাংস্য বিনিন্দিত কন্ঠে উত্তর দিল—‘তোমার চোখটা কি একেবারেই গেছে বাবা! জলজ্যান্ত মনিষ্যিটা সামনে ডেঁইড়ে আছে, কথা বলতিছে, হাসতেছে—আর তুমি কি না বলো সে এখানে নেই’!
আমি কী বলব কিছুই ভেবে পেলাম না! হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কল্যাণী আমার বেডরুমের মেঝেটা মুছতে গিয়ে লাশটা দেখে ফেলেনি তো? হয়তো ও দেখে ফেলেছে। সব জেনে গিয়েছে। তাই এই নাটক!

কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতেই বুঝলাম তা হতে পারে না। কল্যাণীর এত বুদ্ধি নেই। লাশ দেখলে ও হেসে হেসে নাটক করত না। ভির্মি খেত! চিৎকার করত! তাছাড়া তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—ওকে সকালবেলায় দরজাটা খুলে দিল কে?

আমি আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই বসলাম—‘সত্যি করে বল্‌ তো। তোকে সকালে দরজা কে খুলে দিল?’

কল্যাণী আমার প্রশ্ন শুনে হেসেই বাঁচে না—‘কে আবার খুলে দেবে! যে রোজ খুলে দেয়, সে–ই খুলে দেছে। তুমিও না বাবা! তোমার স্মিতিভেম হয়েছে!’ বলতে বলতেই ও কিচেনে ঠিক ফ্রিজের পাশে তাকাল—‘মা, তুমি বাবাকে বাম্মিশাক খাওয়াও। আমিই কাল দিয়ে যাব‘নে!’ তারপরই শোনাল সাবধানবাণী—‘আর হ্যাঁ, ওবেলা রান্নার জন্য এট্টুও তেল নেই। না সাদা তেল। না সষ্‌ষের তেল! বাবাকে বলো, তেল না আনলে ওবেলা রান্না কত্তি পারবো না’কো এই বলে রাখলাম!’

আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ফ্রিজের পাশটায় তাকালাম। একরাশ বরফশীতল হাওয়া আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেল। যেদিকে তাকিয়ে ও কথা বলছে, সেদিকে কেউ নেই! অথচ ওর দৃষ্টি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক! তাতে কোনও অভিনয়ের ছাপ নেই। একদম সহজ, সরল। যেন সত্যিই কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর ও দিব্যি তার সঙ্গে গল্প করে চলেছে।
কল্যাণী যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ আমি দমবন্ধ করে ছিলাম। আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, হয় আমার মেয়ে এবং কল্যাণী—দুজনেরই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, নয়তো আমি নিজেই অসুস্থ! কল্যাণী যেভাবে পুরো সময় আমার স্ত্রীয়ের সঙ্গে অনায়াস কথোপকথন চালিয়ে গেল, তাতে একসময় আমারই মনে হতে লাগল যে আমি নিজে যা জানি, সব ভুল! কাল রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আসলে ঘটেইনি! গোটাটাই আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের বিভ্রম মাত্র। আমার স্ত্রী বেঁচে আছে। এবং সত্যি সত্যিই ও রেগে মেগে কাল রাতে মেয়ের কাছে চলে গিয়েছিল। আজও কল্যাণীর সঙ্গে ও—ই গল্প করছে! খুনের গল্পটা নিছকই আমার মনের অসুস্থতা। একটা ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি!’

ইন্সপেক্টর সিন্‌হা খুব মনোযোগ সহকারে ভদ্রলোকের বক্তব্য শুনছিলেন। এবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে। মানুষটা হয়তো একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন। সিন্‌হা ধীরে সুস্থে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা স্টিক নিলেন এবং প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ প্যাকেট থেকে সসংকোচে একটা সিগারেট বের করেছেন। সিন্‌হা নিজের লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিলেন তাঁর স্টিকটা। তারপর আস্তে আস্তে বললেন—‘আপনি ঠিক জানেন যে খুনটা সত্যিই হয়েছে? খুনের গল্পটা সত্যিই আপনার মানসিক অসুস্থতার ফল নয়?’

ভদ্রলোক সিগারেটটায় টান মেরে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। তাঁর হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। তিনি মাথা নাড়লেন—‘হ্যাঁ অফিসার। খুনটা সত্যিই হয়েছে। আমার সে বিষয়ে যেটুকু সন্দেহ ছিল, সেটুকুরও নিরসন হল একটু পরেই’।

‘বেশ। তারপর?’

কল্যাণী কাজকর্ম সেরে চলে যাওয়ার পরই আমি তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিই। চট্‌পট্‌ সমস্ত দরজা জানলাও এঁটে দিলাম। কী জানি, যদি কেউ উঁকিঝুঁকি মারে! সাবধানের মার নেই। কাউকে জানাতে চাই না যে আমি ঘরে একটা লাশ নিয়ে বসে আছি! কিন্তু সত্যিই কি লাশ? কেমন যেন একটা বিভ্রান্তি মনের মধ্যে কাজ করছিল। কাল মেয়ের ফোন! আজ কল্যাণীর অদ্ভুত ব্যবহার! ওরা দুজনেই একসঙ্গে ভুল করতে পারে না। তবে কি ভুল আমারই? আসলে যা ভাবছি, তা নিতান্তই একটা দুঃস্বপ্ন! স্ত্রীকে আদৌ খুন করিনি। সবটাই আমার কল্পনা মাত্র!

পরীক্ষা প্রয়োজন ছিল। তাই চুপচাপ নিজের বেডরুমে ফিরে এসে খাটের তলায় উঁকি দিয়ে দেখি। হ্যাঁ, কার্পেটটাকে যেমন গোল করে পাকিয়ে রেখেছিলাম, তেমনই আছে। প্রশ্ন হল, ওর মধ্যে কি লাশটাও আছে?

কাঁপা কাঁপা হাতে টেনে বের করলাম কার্পেটটাকে। মনে মনে চাইছিলাম, সব ভুল হোক্‌। হয়তো দেখব ওর মধ্যে কিছুই নেই! স্রেফ কার্পেটটাই পাকানো আছে। ওর মধ্যে কোনও লাশ নেই! কোনও খুন হয়নি। সব ভুল…! আমার মেয়ে, কল্যাণীর কথাই সঠিক। ওদের মা জীবিত আছে। সুস্থ আছে। হয়তো একটু পরেই এ ঘরে এসে ঢুকবে…!

কার্পেটটা বের করে এনে আমি ধীরে ধীরে খুলতে লাগলাম। একটু একটু করে আবরণ সরাচ্ছি, আর বুকের মধ্যে ক্রমাগত আলোড়ন বেড়ে চলেছে। আছে, না নেই? সত্যি, না মিথ্যে? যদি সত্যিই ওর মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর লাশটা থাকে? কিন্তু তা থাকবে কী করে? যদি লাশটা থাকে তবে আমার মেয়ে আর কল্যাণী কার কথা বলছিল! আর ওরা যদি ঠিক বলে থাকে…!

কার্পেটের আবরণ খসে পড়তেই আমার মাথায় যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল! এই তো! টানটান হয়ে শুয়ে আছে আমার স্ত্রীয়ের মৃতদেহটা। একঝলক দুর্গন্ধও নাকে এসে ঝাপ্টা মেরে গেল! ফ্যাকাশে রক্তহীন মুখ, বরফশীতল কঠিন দেহ! দেহে পচন ধরার ইঙ্গিত এই দুর্গন্ধ! আমার মনে হচ্ছিল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! অথবা একটা ভূমিকম্প হচ্ছে! মেঝে কাঁপছে, দেওয়াল কাঁপছে! মাথার ওপরের ছাতটা বুঝি এখনই ভেঙে পড়বে। কোনও রিখ্‌টার স্কেলে সে কম্পন পরিমাপ করা সম্ভব নয়! প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতরে! যেন হৃৎপিন্ডটাকে কেউ খামচে ধরে আছে! চোখের সামনে অন্ধকার করে আসছে… জল…একটু জল…! ওঃ!

বেডরুমের বেডসাইড টেব্‌লেই থাকে সরবিট্রেটের বড়ি। কী কষ্ট করে যে ঐ অবধি পৌঁছেছিলাম তা শুধু আমিই জানি। কোনমতে একটা সরবিট্রেট জিভের তলায় রেখে দিলাম। আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ বাদে চেতনা ফিরে পাই। একটু সুস্থ বোধ হতেই ত্রস্ত হাতে লাশটাকে ফের যথাস্থানে চালান করে দিয়েছি! স্বাভাবিক হতে হবে। বাইরে যে করেই হোক্‌ আমার স্বাভাবিক ব্যবহারটা বজায় রাখতে হবে। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না বুঝতে পারে যে আমার মধ্যে কী চলছে! জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে আমি নিজেকে বোঝাতে লাগলাম—‘যা হয়েছে ভুলে যাও। কিছু হয়নি তোমার। বরং বাইরে বেরোও। খোলা হাওয়ায় শ্বাস নাও। সংসারের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখো। পরিচিতদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলো। দেখবে, অনেকটাই ভালো লাগবে’।

এই বাড়ির, এই হত্যাপুরীর এই ভ্যাপসা পরিবেশ আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। লাশটা যেন আমার গলায় কয়েকমণি পাথরের বোঝা হয়ে ঝুলে আছে। এই লাশটা থেকে দূরে চলে যেতে চাইছিলাম। তাছাড়া কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কিনে আনতে হবে। তেল না আনলে কল্যাণী রান্না করতে পারবে না বলে হুমকি দিয়েছে। ওদিকে সিগারেটও আনা জরুরি । ক্লান্ত মস্তিষ্ক একটু খোলা হাওয়া আর তামাকের ধোঁয়া চাইছিল। তাই অনতিবিলম্বেই দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।

রাস্তায় নামতেই আবার একটা অস্বস্তিবোধ! মনে হল, সবাই আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে! যেন ওরা সবাই সবকিছু জানে! ওরা জানে, আমি ঠিক কী করেছি! কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, সবটাই আমার মনের ভুল। অপরাধী মন স্বকৃত অপরাধের বোঝা বয়ে চলেছে। আমার সচেতন অপরাধবোধই মানুষের সহজ, সরল দৃষ্টিকে ভুল ভাবে দেখাচ্ছে। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেই মনটা অনেক হাল্কা হল। বাইরের তাজা ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ চনমনে হয়ে উঠলাম। বুকের চাপ অনেকটাই কমে গিয়েছে। আমি এবার শান্ত ভঙ্গিতে শিস্‌ দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে।

আমার বাড়ির কাছের দোকানগুলোর দোকানিরা সবাই আমাকে চেনে। মাসের মাল যা কেনার তা এইসব দোকান থেকেই কিনে থাকি। বুড়ো মানুষ। তাই বেশিদূর যাওয়ার সামর্থ নেই। একমাত্র কাঁচা বাজারটা কিনতেই একটু দূরে যেতে হয়। তাছাড়া চাল, ডাল, সর্ষের তেল, টুথপেস্ট—মাসের সমস্ত জিনিসপত্র আমি কাছের মুদি দোকানটা থেকেই আনি। তার থেকে দু পা দূরেই মেডিক্যাল স্টোর্স। ওখান থেকে সারা মাসের ওষুধ কিনি। আর তার ঠিক উল্টোদিকেই বেশ বড় একটা পান-কোল্ডড্রিঙ্কস-সিগারেটের দোকান। ঐ দোকানি তো আমার প্রায় সুখ-দুঃখের সঙ্গীই হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই সিগারেটের প্যাকেট দিতে দিতে নীচু স্বরে জ্ঞান দিতে থাকে। বলে—‘বাবু, এবার এই নেশাটা ছাড়েন। অনেক বয়স তো হল। আর কত বিষ খাবেন? আপনার না একবার বাইপাস হয়ে গিয়েছে? আর কারোর কথা না ভাবেন, গিন্নী মার কথা ভেবে দেখেন’।

আমি হেসে বলি—‘আমি বিষ না খেলে তোর দোকান চলবে কী করে? আর গিন্নী মা যে জর্দা খায়? সে বেলা দোষ নেই?’
ও উত্তরে হেঁ হেঁ করে হাসে। কিন্তু ঠিক পরের বারই আবার জ্ঞান দিতে ভোলে না।

সেদিন সংসারের খুঁটিনাটি বাজার করতে করতে বুঝলাম, সবটাই আমার কল্পনা নয়। সত্যিই কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। সমস্ত দোকানিরাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে বারবার আমার পেছন দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝেমধ্যে এমন ভাবে হাসছে বা মাথা নাড়ছে যেন কোনও অশ্রুত কথা বা ঠাট্টা-তামাশা বুঝি ওদের কানে গিয়েছে। তার জবাবেই মৃদু হাসি, বা আলতো মাথা ঝাঁকানি।
আমার অস্বস্তি ক্রমাগতই বাড়ছিল। ওদের ঐ চাউনি বরদাস্ত করতে পারছিলাম না। অসহ্য ঠেকছিল! সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসই মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ মুদি দোকানে গিয়ে আমি সব কিছু বললেও যথারীতি তেলের কথা বলতে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল মেডিক্যাল স্টোরে গিয়ে! কোনমতে ওষুধগুলো কিনেই ফের হুড়মুড় করে দৌড়লাম মুদির দোকানের দিকে। সে তখন আরেক কাস্টমারকে ডাল মেপে দিতে ব্যস্ত। তাড়াতাড়ি বললাম—‘ভাই, দু প্যাকেট সয়াবিন অয়েল আর দু প্যাকেট সর্ষের তেল।’ একটু অপ্রস্তুত হেসে যোগ করলাম—‘আগে বলতে একদম ভুলে গিয়েছি’।

মুদি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকায়। বিস্মিত গলায় বলে—‘ আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন দাদু? দিদা তো একটু আগেই চার প্যাকেট তেল নিয়ে গেল!’

এবার মনে হল গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড কাঁপছে! এরা সবাই কি আমায় নিয়ে রসিকতা করছে! ওরা সবাই কি সব জেনে গিয়েছে? যেমন করে মাকড়সা একটু একটু করে জাল বিস্তার করে শিকার ধরে, ওরাও তাই করছে না তো! না না! এতগুলো লোক কীকরে একসঙ্গে সব জানবে। তবে কি ওরাও আমার মেয়ে আর কল্যাণীর মত কিছু একটা ভুল করছে? কিন্তু তা কী করে হয়! আমার মেয়ে, কল্যাণী আর এই মুদি—তিনজনেই সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। কেউ কাউকে চেনে না। তবে?
আমার পা দুটো কাঁপছিল। এক পাও এগোতে পারছিলাম না। তবু আস্তে আস্তে এগোলাম। এখনই একটু সিগারেট খাওয়া দরকার। দরকার পড়লে একটা কোল্ডড্রিঙ্কও খাব। গলাটা শুকিয়ে কাঠ! ডাক্তার কোলড্রিঙ্কস খেতে বারণ করেছে ঠিকই—কিন্তু নিকুচি করেছে ডাক্তারের!

কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে রাস্তাটা পার হলাম। যদিও মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তেই বুঝি পড়ে যাব। হাঁটার শক্তি আর নেই আমার। মাথার ভেতরে অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা কাজ করছে। ঘটনাটা ঠিক কী ঘটছে আমার সঙ্গে? এ কী অতিপ্রাকৃতিক কোনও ঘটনা? নাকি সম্পূর্ণ মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ! কাল রাতে আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি! অথচ এখনও পর্যন্ত একটি লোককেও ওর অনুপস্থিতির কারণ বলতে হয়নি আমাকে! কেউ একবারও জানতে চায়নি, ঘরে যে আরেকটা মানুষ ছিল, সে গেল কোথায়? যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত ছিলাম—সেই প্রশ্নটাই কেউ করেনি! কিন্তু তার জন্য আমি একটুও শান্তি পাচ্ছিলাম না। বরং এখন মনে হল, ঐ প্রশ্নটাই সবাই করলে বোধহয় ভালো হত। যে মানুষটার অনুপস্থিত থাকার কথা, তার অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি আমায় আরও অনেকগুণ বেশি ভয়ার্ত করে তুলছিল! আমি ভয় পাচ্ছিলাম! ভীষণ ভয়…!

কোনমতে ক্লান্ত দেহটাকে টেনে আস্তে আস্তে পান সিগারেটের দোকানের দিকে যাই। আমার সেই চিরপরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষী দোকানি তখন নিজের দোকানে বসে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পান সাজছে। ওর চোখে চোখ রাখতে পারি না। বুকের ভিতরটা ঢিবঢিব করছে। বেশি কথা বলতে চাই না! কী জানি, এ ও আবার কী বলে বসবে!

‘একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক দে তো’।

ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। এতগুলো বছরে কোনওদিন ওর দোকান থেকে কোল্ডড্রিঙ্কস কিনে খাইনি। এই সব ঠান্ডা পানীয় আমি কখনই খুব একটা পছন্দ করি না। আগে যদিও বা কালেভদ্রে একটা-দুটো খেতাম, হৃৎযন্ত্রের সমস্যা ধরা পড়ার পর সেটুকুও বাদ দিয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়াটা খুব দরকার। আকন্ঠ কাঠের মত শুকিয়ে গিয়েছে! মনে হচ্ছে, কয়েক যুগ ধরে আমি একফোঁটা জলও খাইনি।

দোকানি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেই জানতে চাইল—‘কী কোল্ডড্রিঙ্ক দেব বাবু?’

‘দে যে কোনও একটা’।

সে আমার দিকে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ফ্রিজ থেকে একটা সাদা রঙের ঠান্ডা পানীয়ের বোতল বের করে আনল। এই পরিস্থিতির মধ্যেও দেখে খুশি হলাম যে সে আমার স্বাস্থ্যের খেয়াল রেখেছে। ডাক্তার আমায় কালো রঙের কোল্ডড্রিঙ্কস খেতেই বারণ করেছেন বটে। কোনওকথা না বাড়িয়ে চটপট ঝাঁঝালো তরল খানিকটা গলায় ঢেলে দিলাম। ঢক্‌ঢক্‌ করে বেশ খানিকটা কোল্ডড্রিঙ্ক খাওয়ার পর মনে হল, একটু চাঙ্গা হয়েছি। আস্তে আস্তে নিজেকে ফিরে পাচ্ছি।
দোকানি ততক্ষণে আমার ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট সামনে এনে রেখেছে। আমি সিগারেট আর কোল্ডড্রিঙ্কের দাম মিটিয়ে দিই। হঠাৎ সে নীচু গলায় বলল—‘বাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

আমি তখন অনেকটাই সুস্থ বোধ করছি। ধাতস্থ হয়ে জানতে চাইলাম—‘কী?’

‘গিন্নী মা’র সঙ্গে কি আপনার কিছু হয়েছে?’

চম্‌কে উঠলাম। প্রশ্নটার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ও এমন প্রশ্ন করল কেন? তবে কি সত্যিই সবাই ঘটনাটার কথা জেনে গিয়েছে! ওরা কি সব জানে?

টের পাচ্ছিলাম হাত-পায়ের কম্পনটা আবার ফিরে আসছে। কোনমতে বলি—‘কেন?’

‘না। রোজ তো আপনারা একসঙ্গেই আসেন। দিব্যি পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটেন। কিন্তু আজ…!’

বলতে বলতেই ও থামল। আমি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করি—‘আজ কী?’
‘আজ শুরু থেকেই লক্ষ্য করছি, আপনি যেখানেই যাচ্ছেন—মা জননী আপনার কয়েক হাত পেছন থেকে উঁকি মারছেন! আপনি আগে আগে! আর উনি পেছন পেছন! এখনও…!’

ওর কথা শেষ হল না! তার আগেই বিদ্যুৎবেগে আমি পিছনে ফিরেছি। পিছনে কেউ নেই। ওখানে শুধু একরাশ শূন্যতা আমায় ব্যঙ্গ করে গেল! আর কিছু নেই…আর কিছু না!

আর অগ্র-পশ্চাত কিছুই চিন্তা না করে দৌড়তে শুরু করলাম! বয়েস হয়েছে। পা দুটো কাঁপছে। শরীরটা কেমন একটা করছে। পেছন থেকে ভেসে এল দোকানির চিৎকার—‘ও বাবু, আপনার সিগারেট যে পড়ে রইল!’

পড়ে থাক্‌! সারা বিশ্ব পড়ে থাক্‌। আমি শুধু এইটুকু জানি, আমাকে পালাতে হবে। যে করেই হোক্‌, সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে! যে পাপ আমার পিছু ধাওয়া করছে, তার আওতা থেকে দূরে চলে যেতে হবে…যেতেই হবে!’

বৃদ্ধ এবার বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন! এতক্ষণ তাঁর কন্ঠস্বরে শুধু চূড়ান্ত ভয় ফুটে উঠেছিল। এখন কান্নাবিকৃত স্বরে দুই হাতজোড় করে বলেন—‘আর কোনও উপায় নেই। ও আমাকে ছাড়বে না। একমাত্র জেলের কুঠুরিটাই আমার কাছে নিরাপদ! আমি খুনী। স্বীকার করছি আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি…আমায় গ্রেফতার করুন…গ্রেফতার করুন…!’

ইন্সপেক্টর তাঁর দিকে অপলকে তাকিয়েছিলেন। গল্পটা যথারীতি ওঁর বিশ্বাস হয়নি। তাসত্ত্বেও ভদ্রলোক যখন বলেছেন খুন হয়েছে, তখন তদন্ত করতেই হবে। তিনি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন—‘লাশটা কি এখনও আপনার বাড়িতেই আছে?’

বৃদ্ধ অশ্রুভেজা মুখ তুলে তাকালেন—‘হ্যাঁ। বাড়িতেই আছে’।

‘আপনার বাড়ি কোথায়? ঠিকানা?’

‘আপনার কী মনে হয় স্যার?’ গাড়ির পিছনের সিট থেকে রতন ফিস্‌ফিসিয়ে ইন্সপেক্টর সিন্‌হাকে বলে—‘আদৌ কি ওনার বাড়িতে কোনও লাশ পাওয়া যাবে?’

ইন্সপেক্টর সিগারেটটায় শেষ সুখটান মেরে আড়চোখে পাশে বসে থাকা বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। তাঁর মন সম্ভবত এদিকে নেই। তিনি জানলার কাঁচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। সিন্‌হা নীচু স্বরে বললেন—‘দেখা যাক্‌’।

‘কিন্তু দাদু যে স্রেফ একটা ভূতের গল্প বললেন!’ রতন ফের ফিসফিসায়—‘গপ্পোটা আপনার একটুও বিশ্বাস হয়েছে?’

‘বিন্দুমাত্রও হয়নি’। তিনি আগের মতই চাপা কন্ঠে বললেন—‘উনি যা বলছেন, তা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা বারবার জোর দিয়ে বলছেন। খুন একটা হয়েছে। ওঁর এই উদ্ভট গল্পের পেছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কী কারণ সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে’।

‘আপনার বুড়োটাকে পাগল মনে হয়নি?’

কোনও উত্তর না দিয়ে এবার তিনি কট্‌মট্‌ করে তাকালেন। রতন চুপ করে গেল। ইন্সপেক্টরের নিজেরও ভদ্রলোককে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উন্মাদ মনে হয়নি। অথচ উনি এরকম আজগুবি গল্প তৈরি করলেন কেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। ইন্সপেক্টর নিজে যদি খুন করে বসতেন, তবে এর থেকে অনেকগুণ ভালো ও বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করতেন। কিন্তু এ বৃদ্ধ মানুষটি যা বলছেন, তা একেবারেই অবিশ্বাস্য!

‘ঐ যে!’ ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবার সামনের একটি অট্টালিকার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন—‘ওটাই আমার বাড়ি’।
গাড়িটা এতক্ষণে শহরতলী থেকে একটু দূরে এসে পড়েছিল। এদিকে ঘন জনবসতি নেই। বরং অনেকখানি দূরে দূরে দু একটা বাংলো প্যাটার্ণের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত যারা নিরিবিলিতে বাস করতে চান, তারাই এখানে ঘর বেঁধেছেন। ঘড়িতে রাত দশটা বেজে গিয়েছে। তাই দোকান-পাটও সব বন্ধ। রাস্তাঘাট জনবিহীন। বোঝাই যায়, এ জায়গার মানুষজন এখনও ‘নাইটলাইফ’ নামক বস্তুটিতে বিশ্বাসী নন্‌। একটু আগের তুমুল বৃষ্টিতে পিচের পথঘাট ধুয়ে চকচকে হয়ে গিয়েছে। তবে এখন আর তেমন বৃষ্টি নেই। বৃষ্টির তোড় কমে গিয়ে দু এক ফোঁটা টিপ্‌টিপ্‌ করে পড়ছে। গাড়ির ওয়াইপার বিন্দু বিন্দু স্ফটিকের গুঁড়োর মত বৃষ্টির ফোঁটাকে মুছে ফেলছে সামনে থেকে।

তার মধ্যেই স্পষ্ট দেখা গেল বাড়িটাকে। দোতলা সাদা রঙের বিরাট বাড়ি। একটু পুরনো আমলের গড়ন হলেও খুব সযত্নরক্ষিত। সামনে একটা মস্ত লোহার গেট। গেটের দুপাশে পাথরের স্তম্ভে সিংহের মুখ খোদাই করা। আইভি লতার ঝাড় গেটের ওপরের দিকে বেয়ে উঠে চমৎকার একটা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতন তোরণ সৃষ্টি করেছে।
পুলিশের গাড়িটা ঠিক লোহার গেটটার সামনেই থামল। ইন্সপেক্টর স্মার্ট ভঙ্গিতে নেমে এলেন গাড়ি থেকে। সাব-ইন্সপেক্টর, রতন ও বৃদ্ধ ভদ্রলোকও নামলেন তাঁর পিছু পিছু।

গেট খুলতেই সামনে মোরামের রাস্তা। বৃষ্টিতে রাস্তাটাও ধুয়ে গিয়েছে। তার ওপর দিয়ে কয়েক জোড়া পুলিশি বুট খট্‌খট্‌ করে এগিয়ে গেল বাড়ির মূল দরজার দিকে! হাঁটতে হাঁটতেই একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হল ইন্সপেক্টর সিন্‌হার। যতক্ষণ গেটের বাইরে ছিলেন ততক্ষণ বৃষ্টিভেজা হাওয়াটা তাজা ছিল। কিন্তু গেটের ভেতরে ঢুকতেই মনে হল বদ্ধ হাওয়ার মধ্যে এসে পড়েছেন! এ হাওয়া হিমশীতল, কিন্তু আর্দ্র নয়! যেন বহুবছর ধরে একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! এ হাওয়ায় কোনও চাঞ্চল্য নেই।

‘ও কী!’ বাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই ভদ্রলোক থম্‌কে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর কয়েক কদম পিছিয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললেন—‘বাড়িতে আলো জ্বলছে কেন?’

‘কেন? আপনি লক্ষ্য করেননি? আমরা যখন আসছিলাম তখন রাস্তাতেই তো কারেন্ট এসে গিয়েছিল’।

‘সে জানি!’ ওঁর কন্ঠস্বরে স্পষ্ট আতঙ্ক—‘কিন্তু আমার বাড়িতে কেন আলো জ্বলবে! আমি যে সেই সকালে বেরিয়েছিলাম, আর তো এ মুখো হইনি। আমার পরিষ্কার মনে আছে, তখন ফ্যান, এসির সমস্ত সুইচ অফ্‌ করে বেরিয়েছিলাম। লাইটের সুইচ অন্‌ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দরজায় তালাও দিয়েছিলাম! এই দেখুন তার চাবি। তবে এখন ভেতরে আলো কে জ্বালল!’

ইন্সপেক্টরও এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন। সত্যিই তো! বাড়ির ভেতরে দিব্যি আলো জ্বলছে। ভদ্রলোকের বয়ান অনুযায়ী তিনি সকালে তালাচাবি দিয়ে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, ভয়ের চোটে আর বাড়িই ফেরেননি! তবে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির সমস্ত আলোগুলো জ্বেলে দিল কে! কাজের মেয়ে! কিন্তু সে—ই বা তালাবন্ধ বাড়িতে ঢুকবে কী করে।

তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। কিন্তু তিনি সেই চিন্তাটাকে বেশি আমল দিলেন না। কে আলো জ্বেলেছে, কী বৃত্তান্ত এখনই বোঝা যাবে। সিন্‌হা দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে।

‘এ কী দাদু!’ হেড কনস্টেবল রতনের বিস্মিত কন্ঠস্বর ভেসে এল—‘আপনি পেছনে কোথায় লুকোচ্ছেন?’

বৃদ্ধ ততক্ষণে কাঁপতে কাঁপতে রতনের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন—‘আমার…আমার ভয় করছে! আপনারা এগোন। আমি আপনার পেছন পেছন আসছি’।

রতন মুখভঙ্গী করে। যতসব পাগল ছাগল লোক নিয়ে কারবার! এতক্ষণ বসে বসে কীসের গল্প শোনাল কে জানে! গল্পটা খুনের না ভূতের তা বুঝে উঠতে পারেনি সে! এইসব লোককে জেলে নয়, মানসিক হাসপাতালে রাখা উচিত। সিন্‌হা স্যার খামোখাই ওর পাল্লায় পড়ে পন্ডশ্রম করছেন। তার ওপর এখন আবার পেছনে গিয়ে লুকিয়েছে! বদ্ধ পাগল!

ইনস্পেক্টর সিন্‌হা এবার বাড়ির মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। দরজাটার ওপরে চোখ বুলিয়েই তিনি অবাক গলায় বললেন—‘আশ্চর্য! দরজায় তো কোনরকম তালা নেই! এটা ভেতর থেকে বন্ধ! ভেতরে কেউ আছে!’

বৃদ্ধ মানুষটি তখন রীতিমতন কাঁপতে শুরু করেছেন। কোনমতে প্রায় দমবন্ধ গলায় বললেন—‘ভেতরে কেউ কীকরে থাকবে? আমি তো তালা দিয়ে গিয়েছিলাম!’

সিন্‌হা এবার কোমরে হাত দিয়ে তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন—‘এটা আপনারই বাড়ি তো? আপনি শিওর যে খুনের মামলায় ফাঁসবার ভয়ে আমাদের মিস্‌গাইড করার জন্য ভুল বাড়িতে নিয়ে আসেননি!’

‘অফিসার’। তিনি কান্নাজড়ানো গলায় জানান—‘তেমন উদ্দেশ্য থাকলে আমি নিজের অপরাধ কবুল করব কেন? আমি তো খুনের কথা নিজের মুখে স্বীকার করেই নিয়েছি। স্বীকারোক্তি দিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে প্রমাণও দিয়েছি। এমনকি মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌টাও দিতে ভুলিনি। তবে কেন…?’

‘হুঁ’। সিন্‌হা একটু চুপ করে থেকে জানতে চান—‘আপনার বাড়ির চাবি আর কারোর কাছে থাকে? আপনার ছেলে, কিংবা মেয়ে…?’

‘হ্যাঁ…হ্যাঁ’। ভদ্রলোকের চোখে এবার যেন খানিকটা আশার আলো ফুটল—‘ওদের দুজনের কাছেই এক সেট করে এ বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি আছে। হয়তো ওদের মধ্যেই কেউ এসেছে। আলোগুলোও তাই জ্বলছে। আমি এদিকটা ভেবেই দেখিনি! মিছিমিছিই ভয় পাচ্ছিলাম।’

‘ওকে’। ইন্সপেক্টর ঘুরে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালেন। ভিতরে বেলের সুরেলা সুর স্পষ্ট শোনা গেল। কিন্তু তখনই দরজা খুলল না। ভিতর থেকে কোনও মানুষের উত্তরও ভেসে এল না। তিনি উৎকর্ণ হয়ে ছিলেন। যদি কোনও পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু তাও নেই! আশ্চর্য! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ভেতরে লোক আছে! তবু কোনও সাড়া নেই কেন? সিন্‌হা অধৈর্য হয়ে আরও কয়েকবার বেল টিপলেন।
এবার কাজ হল। ইন্সপেক্টর শুনতে পেলেন একটা পায়ের আওয়াজ খুব আস্তে আস্তে এদিকেই আসছে। একটা হাল্কা কাশির শব্দও শোনা গেল। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা! তারপরই খুট্‌ করে একটা শব্দ। কেউ দরজা খুলেছে!

দরজার পাল্লাটা এবার ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরজার ওপ্রান্তে ভেসে উঠল একটা স্পষ্ট অবয়ব। যিনি দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আচমকা কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর সিন্‌হা। মনে হল, তাঁর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়েছে! এ কে! সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে! এঁকেই তো কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন তিনি। বৃদ্ধের দেওয়া ছবিতে ইনিই তো ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ইন্সপেক্টর ঘোর অবিশ্বাসে, প্রচন্ড সংশয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখছেন। নাঃ, কোনও সন্দেহ নেই! ইনিই তিনি! সেই আটপৌরে ধরণের পরা শাড়ি! সেই ফর্সা টুকটুকে গোলগাল মুখ! সেই দুধসাদা চুল! দুই গালে হাল্কা রক্তাভ আভা! থুতনিতেও সেই আঁচিলটা স্পষ্ট! কোনও সন্দেহ নেই—ইনিই ভদ্রলোকের স্ত্রী। সেই স্ত্রী—যাঁর খুনের গল্প একটু আগেই শুনেছেন! যাঁর লাশটা খুঁজতেই এ বাড়িতে আসা! সেই ভদ্রমহিলাই এখন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে! জলজ্যান্ত!

বৃদ্ধা কিন্তু পুলিশ দেখে একটুও ঘাবড়ালেন না। বরং দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে বললেন—‘আসুন। আপনাদের অপেক্ষাই করছিলাম। তবে আপনারা এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, ভাবিনি। জাস্ট পাঁচ মিনিট আগেই থানায় ফোন করেছিলাম’। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যোগ করলেন—‘লাশটা ঐখানে আছে’।

তিনি আঙুল দিয়ে সামনের দিকে নির্দেশ করলেন! ইন্সপেক্টর এবং তাঁর সঙ্গীরাও বিস্ময়াভিভূত! ইনি তবে খুন হন্‌নি! তবে কোন্‌ লাশের কথা বলছেন ভদ্রমহিলা! ওদের কারোর মুখে কথা ফুটছে না! সবাই কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে!

ওদের মধ্যে সিন্‌হাই প্রথম সম্বিত ফিরে পেলেন। এখন তাঁরও কেমন যেন সব অলীক বলে মনে হচ্ছে। তবু এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধার দিক্‌নির্দেশ লক্ষ্য করে। এবং কয়েক পা এগোতেই দেখতে পেলেন লাশটা…!

হ্যাঁ! লাশই বটে! ইন্সপেক্টরের অভ্যস্ত চোখ বলে দিল, প্রায় চব্বিশ ঘন্টা আগেই মৃত্যুটা হয়েছে। লাশের বুকে আমূল একটা ছুরি বসানো! ওটাই মার্ডার ওয়েপ্‌ন্‌! বেশ খানিকটা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে মেঝের ওপর! পুলিশি জীবনে বহুবার লাশ দেখেছেন ইন্সপেক্টর সিন্‌হা। এর থেকেও অনেক বেশি বীভৎস লাশ দেখেও তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। সেই তুলনায় এই মৃতদেহ কিছুই না! কিন্তু এই মরদেহটি দেখেই তাঁর মুখ থেকে একটা অদ্ভুত চিৎকার বেরিয়ে এল!

‘হ্যাঁ। আমিই আমার স্বামীকে খুন করেছি!’ বৃদ্ধা স্বগতোক্তির মত আপনমনে বিড়বিড় করলেন—‘ওঁকে খুন করতে চাইনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই…! স্কিজোফ্রেনিয়া ছিল ওঁর! উল্টোপাল্টা দৃশ্য দেখতেন। ভুলভাল আওয়াজ শুনতেন। মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে বলতেন, আমি নাকি ওঁকে খুন করতে চাই। একদিন আগে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। এমনিতে ঝগড়া-ঝাঁটি আমাদের মধ্যে হয়ই। কিন্তু সেদিন উনি ওঁর লাঠিটা নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ করেন! আমাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। কিন্তু কিছুতেই ওঁকে থামাতে পারছিলাম না। উনি আমার মাথায় লাঠিটা দিয়ে বাড়ি মেরেছিলেন। আরও কয়েকটা বাড়ি মারতেন! তার আগেই এই ছুরিটা ওঁর বুকে বসিয়ে দিলাম…’।

ইন্সপেক্টর বিহ্বলের মতন দেখলেন মেঝেতে পড়ে আছেন সেই ভদ্রলোক! নাঃ, কোনও ভুল নেই! তিনিই বটে! পরনে সেই সিল্কের পাঞ্জাবি। দুধসাদা চুল তখনও পরিপাটি করে আঁচড়ানো! হাতে সেই রূপো বাঁধানো লাঠিটা ধরা…! তিনি বিদ্যুৎগতিতে পিছন ফিরে রতনের দিকে তাকালেন। একটু আগেও বৃদ্ধের ছায়া ছায়া অবয়ব রতনের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। বয়স্ক মানুষটা ভয় পাচ্ছিলেন! কিন্তু এখন সেখানে কেউ নেই!

সিন্‌হা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না! আচম্‌কা তাঁর চোখ পড়ল একদম সরাসরি দাঁড় করানো বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নার দিকে। সেদিকে তাকাতেই ভয়ার্ত আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন সিন্‌হা! তাঁর মুখের সব রক্ত যেন শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে! অজান্তেই বুঝি দেখে ফেলেছেন মূর্তিমান কোনও বিভীষিকা! তারপর কাউকে কিছু না বলেই উন্মাদের মত পিছন ফিরে দৌড় মারলেন। পেছন থেকে রতনের চিৎকার ভেসে এল—‘স্যার! স্যা—র! কোথায় যা—চ্ছে—ন!’

কিন্তু তিনি থামলেন না। কিছুতেই থামবেন না ইন্সপেক্টর! এ বাড়িতে আর নয়…আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না এখানে! এখনই পালাতে হবে…পালাতেই হবে!

বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় তখন তাঁদের সবার প্রতিফলন পড়েছিল। তখনও সাব-ইন্সপেক্টর এবং রতনের বিহ্বল, উদভ্রান্ত প্রতিবিম্ব জ্বলজ্বল করছিল সেই আয়নায়। হিসেবমতন এই বৃদ্ধারও প্রতিবিম্ব সেই আয়নায় পড়ার কথা।

অথচ…!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত