ভয়ঙ্কর রাতের গল্প

ভয়ঙ্কর রাতের গল্প

১৯৯৬ সালের একটি শীতের রাত। তখন আমি খুব ছোট ক্লাস সেভেনে পড়ি ,এখনকার মতন তখন কিন্তু পড়ালেখার এতো চাপ ছিল না। কোনমতে একটা ভালো রেজাল্ট করে উপরের ক্লাসে উঠলেই বাবা-মা খুশি থাকতেন আর আমরা পেতাম অগাধ স্বধীনতা। এখনকার ছেলে মেয়েদের মতন না , আমরা প্রচুর খেলতাম কখনো ফুটবল কখনো ক্রিকেট একটা না একটা লেগেই থাকতো।

তা যা বলছিলাম ঘটনার দিন আমি সবে মাত্র মাঠ থেকে এসে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসে বড় দুই আপুর সাথে খুনসুটি মারামারি করছি আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছি কখোন সাড়ে আটটা বাঁজবে আর আলিফ লায়লা দেখতে যাবো।তখন বিটিভিই কিন্তু ছিল এক মাত্র টিভি চ্যানেল অনেক সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হতো তখন প্রায় সব বাড়িতে দেখা যেত বিশাল বিশাল বাশের মাথায় এন্টিনা বাঁধা যা এখন চোঁখেও পড়ে না।এমন সময় বাড়ির ডোর বেলটা বেজে উঠল।

এতটুকু বলে সৈকত সাহেব একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন , আমি আবার আরেকটু নষ্টালজিয়ায় যাবো কেমন। অমল মাথা ঝাকিয়ে বলল জ্বি আপনি বলতে থাকুন ভালো লাগছে হ্যা তাহলে শোন সেই সময় কিন্তু মোবাইল ছিল না ফোন আর চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন তাও ফোনোও অনেকেই ব্যবহার করতে পারত না। বাবা বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকরি করতেন সেই সুবাদে আমাদের যোগাযোগ মাধ্যমটা একটু সহজ ছিল আত্নীয় স্বজনরা অফিসের ফোনে ফোন করে মেসেজ দিয়ে দিলে অফিসের পিওন বাসায় এসে খবর দিয়ে যেত।

আর সময় নষ্ট করব না এবার আমি মূল গল্পে চলে যাব, দরজার ডোরবেলের শব্দ শোনে বারান্দায় যেয়ে দেখি অফিসের পিওন রতন দা দাড়িয়ে আছে আমি সৌজন্যমূলক ভাবে আদাব দিতেই রতন দা আমাকে নিচে ডাকলেন আমি গেটের চাবিটা নিয়ে নিচে চলে গেলাম।নিচে যাওয়ার পরে রতন দা যা বললেন তা হলো বড় মামা ফোন করেছিল আমার নানীজান মারা গেছেন , আমরা যেন বিলম্ব না করে রাতের ভেতরেই রওনা দিয়ে দেয় আর আম্মুকে যেন এ কথা না বলি আম্মুকে যেন বলি নানীজান ভীষণ অসুস্থ আমাদেরকে রাতের ভেতরেই যেতে বলেছেন।

আমি নেহাৎ ছোট মানুষ আমার মাথায় কিছুই কাজ করছিল না যে কি বলব বা কি করব তাই বাসায় যেয়ে চুপি চুপি আগে বড় আপুকে বললাম। সব শুনে আপু বললেন আম্মুকে আমি দেখছি তুই বরং দৌড় দিয়ে যেয়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।আমি এক মিনিট দেরি না করে দৌড় দিলাম। সন্ধ্যার পর বাবা এবং এলাকার পরিচিত কয়েকজন কাকু হাসান কাকুর চেম্বারে বসে আড্ডা দেন।

হাসান কাকু ছিলেন আমাদের এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার তো আমি হাসান কাকুর চেম্বারে যেয়েই বাবা কে পেয়ে গেলাম। বাবাকে সব খুলে বললাম বাবা বললেন ঠিক আছে তুমি বাসায় যাও আমি দেখি একটা মাইক্রো বা কার যা পায় নিয়ে আসি।আমি বাসায় এসে দেখি আম্মু রিতিমত কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন আশেপাশের অন্যান্য আন্টিরা ততক্ষনে এসে ভিড় জমিয়ে আম্মুকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।বড় আপুকে ফিস ফিসিয়ে বললাম আম্মুকে বলতে গেলে কেন ?

আপু বলল তুই ছোট মানুষ ঐসব বুঝবি না পরেতো জানতেই পারবে তার চেয়ে একটু হাল্কা হোক। ঠিক দশটার দিকে বাবা মাইক্রো নিয়ে আসল মাইক্রোতে শামীম কাকুকে দেখতে পেলাম , পরে যা জানতে পারলাম কোন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না তাই পরে শামীম কাকুর গাড়িটা পাওয়া যায় কিন্তু কাকুর ড্রাইভার আবার বাড়িতে গেছে তাই শেষমেস কাকুই ড্রাভিং করে চালিয়ে নিয়ে যাবে।আমরা সব কিছু ঠিক ঠাক করে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে রওনা দিলাম।

নানীজানের বাড়ি ঈশ্বরদী থানার অন্তর্গত রুপপুরে তাই আমাদের কে যেতে হচ্ছিল নাটোরের রাস্তা ধরে তখন কিন্ত এত জনবসতি ছিল না।তো নাটোর পেরিয়ে দাশুড়িয়ার কাছা কাছি একটা জায়গা এক দম শন শান এলাকা দুই পাশ জুরে শুধু আখের ক্ষেত বিস্তৃত দূর দূর প্রর্যন্ত কোন জনবসতির অস্তিত্ব নেই।বাবা আর কাকু সবে মাত্র বলছেন যে এই এলাকাটা খুব খারাপ প্রায় দিনই এই রাস্তায় ডাকাতি হয়,ভালোই ভালোই এই রাস্তাটা পার হতে পারলেই বাঁচি আর অমনি ধুম করে শব্দ হয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল।

বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই স্টার্ট করানো গেল না। তার চেয়ে বড় সমস্যা আমাদের কারো কাছে কোন টর্চলাইট ছিল না কি করা যায় কি করা যায় এমন সময় শামীম কাকু নিচে থেকে কয়েকটা আখের পাতাতে আগুন জ্বলিয়ে একটা লাঠির মাথায় আগুন ধরালেন তারপর গাড়ির ডেক খুলে চেক করে দেখলেন ওয়াটার টেঙ্কের পাইপ ফেটে গেছে এখন এটা চেঞ্জ না করা গেলে গাড়ি স্টার্ট করানো সম্ভব না।

কোন উপায়ন্তর না পেয়ে আম্মু আর আপুরা গাড়ির ভেতরে আর আমি ততক্ষনে মাইক্রোর ছাদে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে আছি আর একটু দূরে বাবা আর কাকু দাঁড়িয়ে গল্প করছে জায়গাটা এমন মাঝখান দিয়ে রাস্তা আর দুই পাশ একটু ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে বিস্তৃত বিশাল আখের ক্ষেত।তা যা ঘটল হঠাৎ নীচের দিকে কে যেন কাশল।একবার না,পর পর দুবার আমরা ভীষণ চমকে গেলাম বাবা সাহস নিয়ে বলল , কে ? কে ওখানে? ঢালুর ঠিক নীচের দিকে পা তোলে চাদর মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে কে যেন বসে আছে। বাবা উঁচু গলায় বলল , কে ওখানে বসে আছে ?

জ্বি আমি। উপরে উঠে আসুন দয়া করে। লোকটা অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসল। চাদর দিয়ে নাক প্রর্যন্ত মুখটা ঢাকা চোঁখ দুইটা ছিল অদ্ভুত অনেকটা বিড়াল বা নেকড়েদের যেমন হয় ঠিক তেমন অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল।কিন্তু তখন আমাদের ভুত নিয়ে মাথায় কোন চিন্তা ছিল না আমাদের তখন ডাকাতের ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল মনে মনে তখন ভাবছিলাম যে আমরা ডাকাতের কবলে পড়লাম বুঝি। বাবা বলল , আপনি কে ?

জ্বি আমি হারু এখানে কি করছিলেন? কিছু করছিলাম না। বসে ছিলাম।বাবা ভাবলেন হয়তো এই ক্ষেত পাহাড়া দেওয়ার জন্য মনে হয় পাহারাদার রেখেছে। বাবা বললেন আমরা বিপদে পড়েছি বুঝতে পেরেছেন? জ্বি,আপনাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। তা এখানে কোন মেকানিক কি পাওয়া যাবে ?

না ! যদিও অনেক রাত তবে দাশুড়িয়া বাজারে যেয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। হুম তা বুঝলাম কিন্তু দাশুরিয়া বাজার প্রর্যন্ত কিভাবে যাওয়া যাবে শুনি ?

জ্বি ঠেলে নিয়ে যেতে হবে আপনারা দুইজন যদি সামনে থেকে দুইপাশে ঠেলেন আমি আর নিশুতন না হয় পেছন থেকে ধাক্কা দিব। এই নিশুতনটা আবার কে ?

হারু নামের লোকটি একটা অদ্ভুত শব্দ করে উঠল সেটা যে কি ধরনের শব্দ ছিল বুঝাতে পারব না। আমরা দেখলাম পাশের ক্ষেতের ভেতর থেকে একটা মাঝারি আকারের লোক চাদর মুড়িয়ে বের হয়ে আসলেন।

বাবা দেখলেন সারারাত এখানে বসে থাকার চেয়ে এটা একটা ভালো বুদ্ধি কোনমতে বাজার প্রর্যন্ত যেতে পারলে একটা গতি করা যাবে আর তা ছাড়া দাশুড়িয়ায় আমার ফুপুর বাসা ছিল সেখানে উঠা যাবে পরে সকাল হলে একটা ব্যাবস্থা করা যাবে।তো সামনের দুই জানালা ধরে বাবা আর কাকু আর পেছনে তারা দুইজন ধাক্কা দিচ্ছেন আর আমি বাবা্র পেছন পেছন হাটছি আবার একটু দৌড়াচ্ছি এভাবে চলছি।বাবা হঠাৎ একটা সিগারেট ধরাতে চাইলে হারু কর্কশ স্বরে বলল সিগারেট না ! আগুন না ! আগুন না !

তো বাবা আর সিগারেট ধরালেন না এভাবে যে কতক্ষন আমরা চলেছি মনে নেই শেষ প্রর্যন্ত আমরা দাশুড়িয়া বাজারে যেয়ে পৌছালাম বাবা মনে করলেন এত কষ্ট করে তারা দুইজন গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে এতদুর নিয়ে আসল ওদের কিছু টাকা দিবে তো পেছনে তাকিয়ে দেখেন কেউ নেই কিন্তু মিনিট দুয়েক আগেও তাদের উপস্থিতি বুঝা যাচ্ছিল দুইজনেই হাপাচ্ছিল।আমরা এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছি এমন সময় এক বৃদ্ধ বয়সের এক লোককে লাঠিতে ভর দিয়ে আসতে দেখা গেল।লোকটার অদ্ভুত চেহারা কাছে এসে কাশতে কাশতে বলল , তোমরা কে ? এত রাতে এখানে কিভাবে এলে ?

বাবা মনে করলেন ইনি মনে হয় পাহারাদার হবে যাই হোক বাবা সম্মান দিয়ে বললেন বাবা আমরা বিপদে পড়েছিলাম। আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছিল , যাবো রুপপুর তো দুইজন আমাদের গাড়ি ঠেলে এতদুর নিয়ে আসল কিন্তু তাদেরকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। কি বল ঐ রাস্তায় মানুষ কোথায় পাবা ? এত রাতে কি কেঊ ওখানে থাকে ?

না ছিলতো হারু আর আরেকজনার যেন কি নাম কি নাম বললে হারু ! তাকে কোথায় পাবা সেতো মারা গেছে আজ থেকে দুই বছর আগে সেতো অনেক কাহিনী হারু ছিল এই এলাকার নাম করা চোর আর তার সাগরিদ ছিল নিশুত। বাবা মনে করলেন লোকটা মনে হয় পাগোল তাগোল হবে তাই হাসতে হাসতে যেই লোকটার দিকে তাকালেন আর সেই লোকটা একটা আগুনের কুন্ডলি হয়ে স্যাৎ! করে মিলিয়ে গেল।

আমরা এই ঘটনা দেখে যা ভয় পেলাম সে কথা আর বলে বুঝাতে পারব না। তাকিয়ে দেখি পুরো বাজার শন শান করছে সাধারানত রাতের বেলায় এমন বাজারে দুই একটা কুকুর দেখা যায় কিন্তু সেখানে তাও ছিল না।তা আমরা সেই রাতে কোনরকম গাড়িটা লক করে ফুপুর বাসায় চলে গেলাম পরের দিন সকালে গাড়ি ঠিক করে নানীজানের বাড়িতে যেয়ে পৌছালাম। অমল চশমাটা মুছতে মুছতে বলল কিন্তু দাদা আপনার ফুপুর বাড়িতে যেয়ে ঘটনাটা তাদের বলেন নি ?

হ্যা বলেছিলাম।সেখান থেকে জানতে পারি ঐ বৃদ্ধ লোকটার নাম ছিল রহিম। তার তিন ছেলের কেউ তাকে দেখত না , তাই এলাকার লোকজন তাকে বাজারের পাহারাদার হিসাবে রাখে যাতে করে খেয়ে পড়ে চলতে পারে।তো একদিন সকালে সবাই দেখে রহিম খুন হয়েছে আর বিভিন্ন দোকানে চুরি হয়েছে।

এরপর থেকে প্রায়ই তাকে গভির রাতে বাজারে দেখা যায়। বুঝলে অমল এই হলো ঘটনা। এখানে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে , রহিমকে কে খুন করেছিল ? দোকানেই বা চুরি হলো কিভাবে ? হারু এবং তার সাগরিদ নিশুত কিভাবে মারা গেল ?

সময়ে অসময়ে আমি এই প্রশ্নগুলোর একটা উত্তর দাড় করালেও যুক্তিযুক্ত কোন উত্তর পায় নি এটাও আমার একটা অন্যতম রহস্য যা আজো আমাকে ভাবাই।।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত