সোনাবিল

সোনাবিল

বিলের নাম সোনাবিল। এই বিলের পাশ ঘেঁষেই বয়ে গেছে মাটির রাস্তাটা। লোকালয় ছেড়ে একটু দূরে রাস্তার ধারেই আছে অনেক তালগাছ। তালগাছগুলোর পাশেই আছে একটা ছোটো ঝোপ। এই ঝোপকে ঘিরেই যত রহস্য আর আতঙ্ক। গত কয়েকদিন ধরে এখানে প্রায়ই নাকি ভূত দেখা যায়। কখনো পা কাটা, কখনো হাত কাটা, আবার কখনো বা মাথা কাটা মানুষ হয়ে তার আগমন ঘটে। রাত হলেই তার উপদ্রব শুরু হয়। বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে সে পথযাত্রীদের হি হি হো হো করে হেসে ভয় দেখায়। এরই মধ্যে অনেকেই এই ভূতের দেখা পেয়েছে। সর্বশেষ যিনি ভূতকে দেখেছেন তিনি হলেন কামরুল সাহেব। রাতুলের বাবা। গতকাল রাতে হাট থেকে সাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার পথে তিনি ভূতের কবলে পড়েছেন। একটা মস্তকবিহীন সাদা কাপড়ে মোড়ানো ভূত নাকি ওই ঝোপটার পাশে একা একা দাঁড়িয়ে ছিল। রাতুলের বাবার সাইকেলের আওয়াজ শুনেই নাকি সে ঝোপ ছেড়ে আস্তে আস্তে রাস্তায় উঠতে থাকে। আর হি হি করে হাসতে থাকে। রাতুলের বাবা সাহসী মানুষ। তিনি ঘাবড়ে না গিয়ে সাহস করে সজোরে সাইকেল চালিয়ে কোনোমতে বাড়িতে চলে আসেন। বাসায় এসেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এখন তার গায়ে প্রচ- জ্বর।

বন্ধু রাতুলের মুখে তার বাবার এমন কথা শুনে ভূত দেখার ইচ্ছ িজাগে শিপনের। দুই বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করে ভূত দেখার। সঙ্গে যোগ হয় আরো দুজন। মঞ্জু আর আরেফিন। তারা রাতুল আর শিপনের খুব ভালো বন্ধু। ওরা খুব সাহসী বলে বন্ধুদের মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত। তারা চারজন মিলে যুক্তি করে যে আজ রাতেই তারা ভূত দেখে তবেই ছাড়বে। যেই কথা সেই কাজ। রাতের বেলা। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতুল, শিপন, মঞ্জু আর আরেফিন মিলে হাজির হয় তালগাছের অদূরে ধানক্ষেতে। তারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গায়ের সাথে গা মিলিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। রাত তখন ১০টা। সারা গ্রাম ঘুমিয়ে। কোথাও কোনো সাড়া নেই। মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে এখানে-সেখানে। আর থেমে থেমে আসছে হালকা বাতাস। সে বাতাসে শরীর শিরশির করে উঠছে তাদের। কিন্তু কেউ কিছুই বলছে না। অপেক্ষা ভূতের। হাত কাটা, পা কাটা নাকি ডানা কাটা ভূত দেখা দেবে এ আশায় সবাই। বুদ্ধি করে চার বন্ধুই কালো জামা আর কালোপ্যান্ট পরে এসেছে। যাতে কেউ তাদের না দেখতে পায়। কিন্তু আসল কাজের খবর নেই। ভূতের সাক্ষাৎ মেলেনি এখনো। অনেকক্ষণ তারা চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকে। চেয়ে থাকে তালগাছের সারিতে। কিন্তু কোথায় ভূত! ভূতের দেখা না পেয়ে ফিসফিস করে মঞ্জু বলে,

-কোথায় ভূত! ধুত্তুরি, ভূতের জন্য বৃথায় খাটছি না তো!

তার কথার রেশ থাকতেই শিপন কাঁপা কাঁপা গলায় আচমকা বলে ওঠে,

-এই আস্তে। ওই যে দ্যাখ ঝোপটার পাশে সাদা কাপড় পরা মাথা কাটা ভূত!

শিপনের কথা শুনেই সবাই ভয় পেয়ে যায়। আস্তে আস্তে তারা দেখতে পায় ভূত। মাথাবিহীন আস্ত এক ভূত ঝোপের পাশে একা একা ঘোরাফেরা করছে। একবার এদিক তো আরেকবার ওইদিক। ভূতের এমন পায়চারি দেখেই আরেফিন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। সে রাতুলের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। মঞ্জুর গলাটাও শুকিয়ে আসছে। এই প্রথম শিপন আর রাতুল তাদের সত্যিকারের সাহস দেখল। রাতুল কিছুক্ষণ সেটা খেয়াল করে। অতঃপর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে ভূতের দিকে। কিছুক্ষণ পায়চারি করেই ভূতটা ঝোপের পাশ থেকে দৌড়ে রাস্তায় ওঠে। ভূতের এমন কা- দেখে রাতুল শিপনকে বলে,

-শিপন, ভূতটা রাস্তায় কেন উঠল?
-জানি না।

ফিসফিস করে বলে শিপন। আরেফিন আর মঞ্জু ভয়ে কোনো কথা বলে না। ভূতটা রাস্তায় উঠতেই তারা একজন মানুষের কণ্ঠ আবিষ্কার করে। ওরে বাবা রে, মারে, আমারে বাঁচারে বলে কে যেন দৌড়াতে থাকে। রাতুল, শিপন, আরেফিন আর মঞ্জু লোকটার ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনে দৌড়ে আসে রাস্তায়। শিপন পকেটে রাখা টর্চটা জ্বালাতেই চোখে পড়ে লোকটাকে।

-একি, এ তো দেখি ওই পাড়ার তরু চাচা!

শিপন ফিসফিস করে বলে। তারা সবাই তাকে সাহস দিয়ে স্বাভাবিক করার রূপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি উল্টো তাদেরই ভূত ভেবে ভয়ে কাঁপতে থাকে। আমাকে ছেড়ে দে বাবা, তোরা আমার বাবা, আমার মা, আমাকে ছেড়ে দে ভাই। তারা সবাই মিলে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে তারা আসলে ভূত-টুত কেউ না। তারা মানুষ। এই গ্রামেরই সন্তান। এদিকে একসঙ্গে এত মানুষের কথা শুনে আসল ভূতটা রাস্তা থেকে দৌড় দেয় বিলের দিক। ঝোপের পাশের ধানক্ষেতের আইল দিয়ে ছুটে চলে সে। ওইদিকে চোখ যায় শিপন আর রাতুলের। ভূতের এমন আচরণ দেখে সন্দেহ হয় রাতুলের। সে বলে,

-এটা ভূত নয়। ভূত হলে তো পালানোর কথা নয়, শিপন।

রাতুলের কথা শুনে সবাই ঠিক ঠিক বলে তার কথায় সমর্থন দেয়। তারা সবাই বুঝে যায় এটা নিশ্চিত কোনো মানুষের কাজ। তাই আর দেরি না করে সবাই মিলে দৌড় দেয় ভূতের পেছনে। তারা সবাই ভূত, ভূত বলে হইচই শুরু করে দেয়। তাদের হইচই শুনে গ্রামবাসী জেগে যায়। সবাই মিলে ভূতের পেছনে ছোটে। ক্ষিপ্রগতিতে শিপন সবার আগে গিয়ে জাপটে ধরে ভূতকে। ধানক্ষেতের পানিতে পড়ে লেপটে যায় তারা। তার হাতের টর্চের আলো গিয়ে পড়ে ভূতের মাথার কালো স্কার্ফে। তার সারা শরীর তার সাদা কাপড়ে মোড়ানো। শিপন বুঝে যায় কিভাবে সে মস্তকবিহীন ভূত সাজে। মাথার কালো স্কার্ফ একটানে সরাতেই শিপন আবিষ্কার করে পাশের পাড়ার কালুকে। যে নেশা করে সারাদিন টইটই করে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আস্তে আস্তে আসে রাতুল, মঞ্জু আর আরেফিন। তারাও কালুকে উত্তম-মধ্যম দিতে থাকে। তাদের পিটুনিতে উহ, উহ করতে থাকে কালু। আস্তে আস্তে আসে সারা গ্রামের মানুষ। কালুকে দেখে সবাই ছি ছি করতে থাকে। আর শিপন, রাতুল, মঞ্জু আর আরেফিনের সাহসের প্রশংসায় সবাই থাকে পঞ্চমুখ। ওই রাতে কালুকে শাস্তিস্বরূপ তারা দাঁড় করিয়ে বেঁধে রাখে তালগাছের সঙ্গে। সেখানেই সারা রাত একা দাঁড়িয়ে থাকে কালু। পরের দিন মুখে কালি মেখে আর গলায় স্যান্ডেলের মালা পরিয়ে শিপন, রাতুল, মঞ্জু আর আরেফিন সারা গ্রামে ঘোরায় তাকে। কালুকে দিয়ে তওবা পড়ায় যাতে সে এমন কাজ না করে। এরপর থেকে যত রাতই হোক না কেন সবাই অবাধে ওই তালগাছগুলোর পাশ দিয়ে নির্ভয়ে হেঁটে যায়। গ্রামে ফিরে আসে স্বস্তি। কেটে যায় ভূতের ভয়।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত