বোবা আতঙ্ক

বোবা আতঙ্ক

একটা নোংরা দুর্গন্ধময় জায়গায় প্রায় ভাঙ্গা একটা হুইলচেয়ারে বসে আছি আমি। ঠিক বসে আছি বললে ভুল হবে।কোনোমতে চেয়ারটার পিঠের দিকে হেলান দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছি।

তাছাড়া নিজের ইচ্ছায় তো বসে নেই। আমাকে জোর করে এখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছে একদল মানুষ। হাত বাঁধেনি। শুধু পা দুটো আমার ঠিক সামনের ভারী লোহার টেবিলের পায়ার সাথে শিকল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে গেছে। হাত দিয়ে ধরতে গেলে শুধু ঝনঝন শব্দ হয় কিন্তু খুলে ফেলার কোন সুযোগ নেই। শিকলের একপ্রান্তে ছোট একটা তালা ঝুলছে। দেখতে ছোট হলেও বেশ শক্ত। তাছাড়া হাতের কাছে এমন কিছুই নেই যা দিয়ে তালাটা ভাঙা যাবে। অর্থাৎ আজকে রাতের জন্য আমি এই ঘরে সম্পূর্নরুপে বন্দী।

টিমটিমে একটা মোমবাতির আলোয় ঘরের ঘুটঘুটে অন্ধকার ভাবটা যেন কমার বদলে আরো বেড়ে গেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

টেবিলের ওপর একটা মাঝারী আকৃতির খাতা আর কমদামী কলম পড়ে আছে। দিয়ে গেছে শয়তানগুলো। ওদের নির্দেশমতো আমার কাজ হবে এই ঘরে আজ রাতে কি কি ঘটনা ঘটে সব খাতায় লিখে ফেলা।
আমি অগত্যা লিখতে বসেছি ঠিকই কিন্তু মোটেই শান্তি পাচ্ছিনা। ওরকম একটা ময়লা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে অন্যের বেগার খাটার মতন দুর্ভাগ্য কজনের হয়! একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে কি এমন ঘটতে পারে যা লিখতেই হবে? খুব বেশি হলে ভৌতিক কিছু?

সেক্ষেত্রে আমায় এখানে এনে ওরা ভালো করেনি। ব্যক্তিগত জীবনে ভূত বা অলৌকিক ব্যপারগুলোতে ঘোর নাস্তিক আমি। আমার ধারণা পৃথিবীর সব অলৌকিক ঘটনার পেছনে সুন্দর সাবলীল একটা ব্যখ্যা থাকে। যত বড় অদ্ভুত ঘটনা তত বেশি সাধারণ তার ব্যখ্যা।

আমি ঠিক ভয় পাচ্ছিনা। খানিকটা ঘোরলাগা ভাব আর অনেকটা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছি মোমের আলোয় হলদেটে হয়ে যাওয়া লেখাশূন্য খাতাটার দিকে। টেবিল থেকে হাতে তুলে নিলাম কলমটা। ওটার একটা বিশাল ছায়া পড়েছে টেবিলের ওপারের জানালার পাশের দেয়ালে। সেই ছায়াকে দেখে মনে হচ্ছে লিকলিকে একটা লোক দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মাঝেমধ্যে যখন মোমের আগুন কেঁপে কেঁপে উঠছে তারসাথে কেঁপে উঠছে দেয়ালের ওপর পড়া কলমের ছায়া।

বেশ কিচ্ছুক্ষন কেটে যাবার পরেও খাতায় লিখে ফেলার মতন কোন বিশেষ ঘটনা পেলাম না।
অথচ মনের ভেতরে দানা বাঁধা অস্বস্তিটা কিছুতেই পিছু ছাড়তে চাইছেনা। বেড়েই চলেছে। কিছুই দেখিনি অথচ অস্থির মনটা বারবার বলে চলেছে ‘সামনে খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে শিমুল। সাবধান হয়ে যা। পারলে পালা এখান থেকে।’

যেন ভারী গমগমে গলায় সাবধানবানী উচ্চারন করছে কেউ। নিস্তব্ধ রাত চিরে কানে প্রবেশ করছে। এ যেন শব্দহীন চিৎকার। যার অস্তিত্ব কানের পর্দার চাইতে মনের দরজায় আঘাত করে বেশি।

বেড়ে চলার রাতের সাথে সেই কন্ঠস্বর প্রায় নিঃশব্দ এই ঘরে বারবার আলোড়িত হচ্ছে। সেই গুঞ্জরিত শব্দে এই হাসপাতাল নিয়ে প্রচলিত অদ্ভুত গল্পগুলো কেমন জানি সত্য বলে মনে হতে লাগলো। দিনের বেলায় এইই গল্পগুলোই আজগুবি গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। এখন বুঝতে পারছি বাইরের অন্ধকার মনের ভেতরটাকেও আলোহীন করে ফেলে। মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে যত রাজ্যের বিকৃত কল্পনা। দিনের বেলা যাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার।

রাঙামাটির আদিবাসীদের সুবিধার জন্য বানানো এই হাসপাতাল নিয়ে প্রচলিত একটা বিশেষ গল্প হলো
খাবারের বিষক্রিয়ায় হাসপাতালের রোগীদের মরতে হয়েছিলো। বিশ পঁচিশজন রোগীর সবাই একদিনে মারা যায়। সবার মাঝেই একটা ব্যপারে মিল আছে। সবাই মানসিক রোগী। তেমন উন্নত না হলেও এই হাসপাতালে ওদের জন্য আলাদা একটা ওয়ার্ড ছিলো।

অনেকের ধারণা ইচ্ছা করেই বিষ মেশানো হয়েছিলো খাবারে। কে বা কারা ঠিক কি কারণে অতোগুলো রোগীর জানের পেছনে পড়েছিলো সেটা নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে। তবে সন্দেহের তালিকায় যারা ছিলো তাদের কারো বিরুদ্ধে এ ব্যপারে কোন উপযুক্ত প্রমান পাওয়া যায়নি।

পরে হাসপাতাল কতৃপক্ষ কিভাবে ঘটনাটা সামলেছিলো তা কেউ বলতে পারবেনা। তবে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো চিরতরে। শেষে রোগীদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা হয়।
অন্যান্য ঘটনার মতো এই ঘটনাটাও কালের স্রোতে হারিয়েই যেতো। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই হঠাৎ একদিন অন্য আরেকটা ঘটনা সবার সামনে চলে আসে। ঠিক ঘটনা নয়। আমার কাছে ব্যপারটা নিছক ভুল ধারণা বলে মনে হয়েছিলো।

জানা গেলো সন্ধ্যার পর হাসপাতালের চত্বরের আশেপাশে থাকলেই অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পাচ্ছে মানুষজন। বিশেষ করে মানসিক রোগীদের ওয়ার্ড থেকে নাকি ভেসে আসতো করুণ আর্তনাদ। চিৎকার চেচামেচির শব্দ শোনা যেতো । সবাই যেন বন্দী হয়ে আছে ওয়ার্ডের ঐ ঘরটাতে। অনেকে দাবি করে তারা নাকি ভেতর থেকে স্থানীয় ভাষায় তাদের এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্রার্থনা করতে শুনেছে। অনেকগুলো মানুষের করুণ কান্নার শব্দ শুনে যারাই আবেগে পড়ে সাহায্যের জন্য গিয়েছে তারাই পড়েছে বিপদে। যারা একবার হাসপাতালের ঐ ঘরে ঢুকেছে তারা কেউ ই আর নিজের ঘরে ফিরতে পারেনি। জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যদিও আমার মতন শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে একটা স্থির বিশ্বাস ছিলো যে যারা গায়েব হয়েছে তারা হয়তো পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে নিহত হয়েছে অথবা শত্রুর হাতে খুন হয়েছে। হাসপাতালের গল্পটা নিছক বানানো একটা গল্প। সুযোগসন্ধানী কিছু নৃশংস অপরাধীর অপরাধ লুকানোর একটা হাতিয়ার মাত্র। আমারো অনেকটা একইরকম ধারণা ছিলো। অবশ্য আমাকে খুন করে গুম করে ফেলার মতন শত্রু আমার নেই। তাই ব্যপারটা কোনদিন তেমন পাত্তা দেইনি।

আজ এমুখো হতাম না। বাড়িতে একঘেয়ে লাগায় বিকেলে বেরিয়েছিলাম। মাতামুহুরির তীরে কিছুক্ষণ একা বসবো বলে। সবুজ পাহাড়ের কোলে স্রোতস্বিনী নদীর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কখন সন্ধ্যা নেমেছে টের পাইনি। হাসপাতালের এদিক দিয়ে গেলে গেলে বাড়ি যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা পাওয়া যায় তাই হুট করেই মনের খেয়ালে এদিক দিয়ে আসা। কখনো ভাবিনি আমার সাথে এমনটা ঘটতে পারে। যারা আমায় এই ঘরে রেখে গিয়েছে তারা হাসপাতাল চত্বরেই ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। যত্তসব বিকৃতমস্তিষ্ক নেশাখোরের দল!

আজ দেখছি অপরিচিত হাসপাতালের অচেনা ঘর থেকে আমায় একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হবে। যদিও ফেরার ব্যপারটা এখনি এতো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছেনা।

এই সামান্য আগে একটা ছোট ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অন্ধকারে এই ছোট ঘটনাটাই আমার জন্য বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বাসের ভীত নড়বড়ে হয়ে গেছে। আমি যে হুইলচেয়ারে বসে ছিলাম সেটা আপনা থেকেই দুলে উঠেছে এইমাত্র! তীক্ষ্ণ ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে টেবিল থেকে সরে গিয়েছে পেছনের দিকে। প্রথমে ভেবেছিলাম আলস্যে আমি হেলান দেয়াতেই বুঝি নড়েছে হুইলচেয়ারটা। কিন্তু ওটাকে আবার আগের অবস্থানে নিয়ে আসতেই আগের ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। চেয়ার তার হাতলের দুপাশের বাঁকানো চাকায় ভর করে আবার নিজে নিজে পেছনের দিকে সরে গেলো প্রায় দেড় হাত!

জং ধরা চাকা থেকে আবার একটা ধাতব শব্দ ভেসে এলো।

কোন অদৃশ্য হাত যেন পেছন থেকে চেয়ারের হাতল ধরে আলতো করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেছনে! শিহরিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কিন্তু পায়ের শিকলে টান পড়লো। আঁটকে গেলো পা। অগত্যা বসে পড়তে হলো। সাহস করে মোমটা হাতে নিয়ে পেছনে তাকালাম। এমন তো হতে পারে আমায় যারা এখানে বন্দী করে গিয়েছে তারা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আমার সাথে রসিকতা করার জন্য। ভয় পাইয়ে দেবার জন্য। এই ঘটনার একমাত্র স্বাভাবিক ব্যখ্যা হতে পারে ওটাই। কিন্তু আমি তখনো জানিনা সামনে আর ঠিক কি কি ঘটনা ঘটতে চলেছে।

কিছুক্ষণ সাধারনভাবে কেটে গেলো। চেয়ার আর নড়ছেনা। ঘাড়ের ওপর যে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে সেটা নিশ্চয় কোন অশরীরীর নয়! ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পাইনি বটে তবে ঐ ঘন ভারী নিঃশ্বাসের মতন উষ্ণ বাতাসটা হয়তো বাইরে থেকে ভেসে আসছে। ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছি। নিজে নিজেই ঘটনাগুলোর ব্যখ্যা তৈরী করছি। খুব হাস্যকর বিজ্ঞান বিবর্জিত ব্যখ্যা। কারণ আমার পেছনে কোন খোলা দরজা বা জানালা কিছুই নেই। গরম বাতাস ভেসে আসতে হলে সামনের খোলা জানালা
দিয়ে আসতে হবে।

আমি জানি এখন ভয় পেয়ে গেলে পরিস্থিতি আরো অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ পালাতে তো পারবোনা। শুধু শুধু বৃথা আস্ফালন করে কি লাভ!

খানিক আবার সব চুপচাপ। আমি এই বিরতিতে পয়েন্ট করে খাতায় লিখলাম

১) হুইলচেয়ার
২) উষ্ণ নিঃশ্বাস

পুরো ঘটনা না লিখলেও চলবে। পয়েন্ট দেখলেই পুরো ঘটনার বর্ননা আমি দিতে পারবো। অনুভূতিতে পুরোপুরি গেঁথে যাচ্ছে সব ঘটনা।

ঘরে আটকা পড়ার পর শুরুর দিকে ভেবেছিলাম টেবিলের ওপর মাথা রেখে একটা লম্বা ঘুম দেবো। কিন্তু যা শুরু হয়েছে তাতে এই ঘরের ঘটনা মনে হলে কয় রাতের ঘুম যে নষ্ট হবে তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
হঠাৎ একটা খুটখাট শব্দে চটকা ভাংলো। শব্দের উৎস আমার সামনের জানালা।

ওদিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। জানালার গ্রিল ধরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে! ঠিকমতো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একজন নয়। একজনের পেছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে একটা ছোট লাইনের মতন বানিয়েছে। মোমের আলোয় শুধু সামনের জনের চেহারা মোটামুটি বোঝা গেলো। একজন বয়স্ক চাকমা মহিলা। মুখের কোঁচকানো চামড়া ঝুলে পড়েছে। কানে ঝুলছে বালার মতন বড় দুল। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছে ঠিক আমারই দিকে। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও মানুষ দেখে এবার মনে কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। এই কঠিন সময়ে এরাই হতে পারে আমার ত্রানকর্তা।

আমি কোনোমতে ঢোক গিললাম। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় একদমে ওদের আঞ্চলিক ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম
‘কারা আপনারা? আপনারা যেই হোন দয়া করে আমাকে এই ভয়ানক বিপদ থেকে বাঁচান। এলাকার কিছু নেশাখোর আমাকে শিকল দিয়ে আঁটকে রেখেছে এই ঘরে। ভালোই হয়েছে আপনারা এসেছেন। ওরা হয়তো বাইরেই আছে। ওরা কিছু বুঝে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি কিছু একটা করুন।’

কিন্তু আমার কথায় কোন কাজ হলোনা। আমার কথা যেন উনার কানেই ঢোকেনি। মুখের ভাবটা তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। আবার একই অনুরোধ করলাম তাকে। এবার মনে হয় কাজ হলো। কারণ মহিলা তার পেছনের লোকগুলোকে ফিসফিস করে কি যেন বললো। লোকগুলো সেই কথা শুনে জানালার একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। মোমের স্বল্প আলোয় কিনা জানিনা সবার মুখ কেমন যেন রক্তশূন্য লাগছিলো আমার কাছে। জানালা কিছুক্ষনের মধ্যেই ভরে গেলো ছোট বড় মাঝারী মাথায়। তারসাথে যুক্ত হলো সবার নিষ্পলক চোখের চাউনি! চোখের মণির কালো অংশটা যেন তুলে ফেলা হয়েছে ওদের প্রত্যকের চোখ থেকে! অসহ্যকর সেই চাউনির সমাপ্তি ঘটলো একটা বীভৎস ঘটনার মধ্য দিয়ে! ওরা যে কখন ওদের সরু সরু হাতগুলো জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে আমার দুই হাত ওদের মুঠোর মধ্যে বন্দী করে ফেলেছে বুঝিনি। আমায় ধরে ফেলামাত্র ওদের সবার কন্ঠে ফুটে উঠলো বুনো উল্লাস।

একটা সমবেত হাড় হিম করা শীতল চিৎকার বেরিয়ে এলো প্রত্যকের গলা থেকে। বন্য হিংস্র জন্তুর মতন ঘড়ঘড়ে পাশবিক সেই গলার আওয়াজ। গগনবিদারী সেই চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো পুরো পাহাড়জুড়ে। শিকারি পশু শিকারকে বশে আনতে পারলে অমন জান্তব উল্লাস করে।

আমি প্রানপনে আমার হাতদুটোকে ছাড়াবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলোনা। ওদের হাতগুলো যেন ঠিক হাত নয়। বিষাক্ত সাপের ফণা। পেঁচিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে জানালার ওপারে! কি অপার্থিব জোর ঐ পৈশাচিক হাতগুলোতে! ওগুলো আমার হাতকে স্পর্শ করতেই শুরু হয়েছে অসহ্য যন্ত্রনা। বিষাক্ত ফণার মত দেখতে কালো কালো হাতগুলো যেন সত্যিই ছোবল দিচ্ছে আমার হাতে। ঢেলে দিচ্ছে সমস্ত বিষ। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার কব্জী। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিনা আর। চিৎকার করার শক্তি তো সেই কখন হারিয়েছি। আর চিৎকার করে হবেটাই বা কি? এই নির্জন পাহাড়ে কে শুনবে আমার ডাক?

কিন্তু কেন হচ্ছে এসব? কি করেছি আমি। শুধুমাত্র সাহায্য চেয়েছি। নাকি এরাও আমাকে যারা অপহরন করেছে তাদের সাথে যুক্ত। আচ্ছা এরা কোন মানব পাচারকারী সংগঠনের সদস্য নয়তো! হয়তো ভোরের আগেই আমাকে পাচার করে দিতে চাইছে কোন অজানা গন্তব্যে। এই ঠুনকো ভাবনাটা আর আগের মতন আমায় সাহস যোগাতে পারলোনা। কারণ ওরা যৌক্তিক কাজের গন্ডিটা বহুক্ষণ হলো পার করে ফেলেছে।
শুধুমাত্র প্রবল মনের জোরে এখনো আমার হৃদপিণ্ডটা স্পন্দিত হচ্ছে। যদিও স্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবেও দ্রুত।

মনের জোরকে বাড়িয়ে নিয়ে এবার শেষ চেষ্টাটা করলাম আমি। হাতে শক্তি না পেলেও দেহের সমস্ত শক্তি নিয়ে পেছনের দিকে ঝুঁকলাম।

আকস্মিক টানে হাতদুটো ছাড়িয়ে আনতেই টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়ে গেলাম হুইলচেয়ারের পাশের মেঝেতে। টেবিলের পায়ার সাথে মাথা ঠুকে গেলো । মারাত্মক ব্যথা পেলাম। আঘাতের পর আঘাত! হাতের অবশ ভাবটা ছাড়তে কিছুটা সময় লাগলো। পরে মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম জায়গাটা অল্প ভেজা। কেটে গেছে নিশ্চিত। সেটা নিয়ে ভাবনা হচ্ছেনা। ওদের অস্বাভাবিক আচরন মনকে আন্দোলিত করে দিয়ে গেছে। টেবিলের নিচ থেকে জানালা দেখা যায়না। ঘরে আবার নেমে এসেছে নৈশব্দ। এত কিছুর পরেও কৌতুহলী মন জানতে চাইছিলো ওরা এখনো জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে কি করছে। তাই মাথাটাকে আলতো করে উঁচিয়ে তুললাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি কেউ নেই। এই অল্প সময়ের মধ্যে ওরা কোথায় গায়েব হয়ে গেলো? ওদের যাবার কোন আওয়াজ তো পাইনি। অতগুলো মানুষ নিমেষে গায়েব হয়ে গেলো কি করে! মাথায় কিছুই ঢুকছে না। উলটো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একটা ভয় জাগানো সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে মনে। ভয় হচ্ছে এই বুঝি ওরা দরজা ঠেলে ভেতরে চলে আসে।

ওদিকে একটা ক্ষীণ আশার আলোও মনের কোণে জ্বলছিলো। যদিও ভরসার পাল্লাটা আগেই হালকা হয়ে এসেছে।
আচ্ছা এমন হতে পারে কি যে আমি অনেকক্ষণ মোমের আলোয় প্রায় অন্ধকার একটা ঘরে একা বসে থাকায় চিন্তাভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে? দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। হয়তো এসবের কিছুই ঘটেনি। সবটা আমার অলীক কল্পনা। জানিনা। আবার হুইলচেয়ারে উঠে বসার সাহস পাচ্ছিনা। ওরা যদি জানালার দিক থেকে আবার হামলা করে বসে! কিন্তু এই ঘরেই কি আমি খুব নিরাপদ? কেন জানি মনে হচ্ছে এই ঘরে আমি একা নই। ঘাড়ের ওপর যে শ্বাস ফেলছিলো তার অস্তিত্ব আছে। শুধু সেই নয় আরো অনেকে আছে এই ঘরে। দু একজনের পায়ের শব্দ কানে এসেছে।আমি মোমটাকে আবার ওপরে উঁচিয়ে ধরলাম। পুরো ঘরটা আরেকবার দেখতে হবে। পা খোলা থাকলে হেঁটে হেঁটে দেখা যেতো কিন্তু সেটা এখন অসম্ভব। মোমের আলোর বলয় যতদূর গেলো সেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। বেশীরভাগ জিনিস অস্পষ্ট দেখাচ্ছিলো। এরজন্য অন্ধকারের পাশাপাশি ধূসর ধূলোর আস্তরন দায়ী। ঘরটা খুব বেশি একটা বড় নয়। অনেকদিন থেকে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা ঘরের চিহ্ন সর্বত্র ছড়ানো।

প্রথম যেদিকে মোমের আলো ফেললাম সেদিকটায় একটা ফ্রিজ রাখা। সম্ভবত ওষুধ রাখার ফ্রিজ।
ফ্রিজের দিকে আলো তাক করতেই যেন জড়বস্তুটা নড়েচড়ে উঠলো। চোখ কচলে আবার তাকালাম। হ্যা! একটা মৃদু কম্পন বোঝা যাচ্ছে। শুনতে পেলাম একটা খচখচ শব্দ। ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঠেসে ধরলে যেমন তীক্ষ্ণ শব্দ হয় তেমন।কেউ যেন ফ্রিজের ভেতর থেকেই আঁচড় কাটছে ফ্রিজের দরজায়।

তাতে দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে ফ্রিজের কম্পন। ফ্রিজটাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন নিশাচর প্রানী মোমের আলো সহ্য করতে না পেরে হাত দিয়ে চোখদুটো ঢেকে ঠকঠক করে কাঁপছে। ফ্রিজের ক্রমাগত কম্পনের ফলে একসময় ওটার দরজা দুটো খুলে গেলো। আর দরজার কপাটের মতন আমার মুখটাও ভয়ে বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো!

এই আবছা অন্ধকারেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সব। আমাকে যেন সব দেখতে বলা হচ্ছে।

ফ্রিজের ওপরের তাকে জীবন্ত একটা কিছু গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে! আর কিছুক্ষণ পরপর
গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে। তার গোটা শরীর একটা কালো তরলে ভেসে যাচ্ছে। টপটপ শব্দে সেই তরল আস্তে আস্তে গড়িয়ে গড়িয়ে মেঝেতে এসে পড়তে লাগলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই বিশ্রী একটা বোটকা গন্ধে ভরে গেলো পুরো ঘর।
মোমের কাঁপতে থাকা অস্থির আলো প্রানীটার ওপর পড়াতে যেন ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠলো ও। তারপর গুটিয়ে থাকা শরীরটা এক ঝটকায় স্বাভাবিক করে নিলো। আমি বুঝলাম এটা অন্য কোন প্রানী নয়। হাড় জিরিজিরে একটা মানুষের মূর্তি। কিন্তু ও ফ্রিজে কি করছিলো? ফ্রিজটা খুব বেশি একটা বড় নয়। সাধারণ আকৃতির একটা মানুষকে ওর ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা অসম্ভব। যদি মানুষের হাড় ছাড়িয়ে একতাল মাংসপিন্ডের মতন করে রাখা যায় তাহলেই হয়তো সম্ভব ।

ওর দেহের ওপর যে কালো তরল মাখামাখি হয়ে আছে সেটাই বা কি? মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। মানুষটার ফ্রিজ থেকে বের হবার কায়দা দেখেই ভয় পেয়ে গেছি। ওর ভয়ানক অবয়বটা দেখার পর থেকে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা।। গলা দিয়ে একটা বিদঘুটে জোরালো গরগর আওয়াজ বের হচ্ছে।

আমি চিৎকার করার কথা ভুলে গেছি কারণ খানিকটা কাছে আসতেই নিশ্চিতভাবে বুঝেছি ওটা জীবন্ত কোন স্বত্তা নয়। ওর গায়ের কালো তরলটা কি বুঝে গেছি। টাটকা রক্ত! মোমের আলোয় যেটা কালচে দেখাচ্ছে।

পরের দৃশ্যটা দেখার পর ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। হাত পা সেঁধিয়ে যেতে চাইছে পেটের মধ্যে।

মানুষটার সারাদেহে কোন একটা অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ তাদের নিজ নিজ জায়গায় নেই। বুক থেকে পেট পর্যন্ত নির্মমভাবে ধারালো কিছু দিয়ে চিরে দুভাগ করে দিয়েছে কেউ! ছিড়ে যাওয়া চামড়া দুপাশে কাগজের মতন গুটিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর পেরেক জাতীয় কিছু দিয়ে গেঁথে দেয়া হয়েছে পিঠের সাথে যেন খুলে ঝুলে না পড়ে!

ভেতরের নাড়িভুঁড়ির দিকে তাকাতেই বমি চলে এলো। ওটার একটা অংশ নিচে ঝুলে পড়ে সাপের মতন পেঁচিয়ে রয়েছে মানুষটার বাম হাটুর সাথে। অন্য অংশটা হা হয়ে থাকা পেটের এক কোণে পড়ে আছে। পেটের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো থেঁতলে মিশে গেছে নাড়িভুঁড়ির সাথে। আলাদা করে বোঝবার উপায় নেই।

ওর স্পন্দনরত হৃদপিন্ডটাকে পাঁজরের খাঁচায় কাঁত হয়ে ঝুলে পড়তে দেখলাম। কোন এক অশুভ শক্তির বলে বেশ জোরে জোরেই এখনো সচল অবস্থায় ধুকপুক করছে ওটা! একটা ছটফট করতে থাকা জীবন্ত প্রানীর মতন।
চোখের কোটর আছে ঠিকই কিন্তু চোখদুটো ঠিক নেই সেখানে! ওগুলোর অবস্থান ওর ডানহাতে! মার্বেলের মতন হাতে নিয়ে খেলছে পিশাচটা! নাকের জায়গায় মাংস নেই। বেরিয়ে পড়েছে ভেতরের কঙ্কাল। মাথার একপাশেও একই অবস্থা। খুলির একটা সাদা অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বুকটা ধড়াস করে উঠলো। কারণ ও উঠে দাঁড়িয়েছে। আর ঠিক আমারই দিকে মুখ করে বাড়িয়ে দিয়েছে পা।
ওটা আমার দিকে আসছে কেন? কি চায় ও? আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে মনে চাইছিলাম ও যেন জানালার বাইরের মানুষগুলোর মতন তাৎক্ষনিক অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার আর এই দৃশ্য সহ্য হচ্ছেনা। কিন্তু চোখ খুলে দেখি দুর্বল পায়ে ওটা ঠিকই আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। আমি যে কখন পেছাতে পেছাতে নিজের অজান্তেই টেবিলের তলায় ঢুকে পড়েছি জানিনা। তাই প্রানীটা আমার নাগাল পায়নি।

কিন্তু ততক্ষণে মোমের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। সেটা শেষবারের মতন দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেলো। নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে লাগলাম আমি। ঘরের তাপমাত্রাও কমে গেলো অস্বাভাবিকভাবে। শীত করতে শুরু করেছে। ভয়ের শীতলতার ওপর জেঁকে বসলো ঘরের শীতলতা। চোখের সামনের সব ঝাপসা হয়ে আসছে। এই গ্রীষ্মের রাতে সত্যি কি কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে ঘরের চারপাশ! এই ঘরে কি অসম্ভব বলে কিছুই নেই?

তবুও কোথাও একটা ভরসা এই যে প্রানীটা হয়তো এই ঝাপসা আর অন্ধকার পরিবেশে এখন আমায় আর দেখতে পাবেনা। অবশ্য দেখলে হয়তো আগেই দেখতো। মোমের আলোর প্রয়োজন পড়তো না। এমনও তো হতে পারে যে সে আমায় দেখেছে ঠিকই। হিংস্র প্রানীরা যেমন মেরে ফেলার আগে শিকারকে নিয়ে খেলে তেমনি এই পিশাচ হয়তো আমায় নিয়ে তেমনভাবেই খেলবে। ও হয়তো জানে যে আমার পায়ে শিকল পড়ানো আছে। আমি চাইলেই পালাতে পারবোনা। তাই অমন না দেখার ভান করছে। সময়মতো ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। তারপর কি করবে? মেরে ফেলবে?

শুনেছি ওদের জগতের কেউ নাকি কখনোই চায়না যে তাদের মৃত্যুর পরের সত্তার অস্তিত্বের রহস্য কেউ জানুক। আর যে জেনে ফেলে তার জন্যেও বরাদ্দ হয় মৃত্যু। কিন্তু সেই মৃত্যু হয় ভয়ানক কঠিন। সহজ মৃত্যু যে আমার কপালে নেই সেটা আমি ভেতরে ভেতরে মেনে নিয়েছি।। মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছি চরম দুর্ভাগ্যের জন্য।
ও যে আমায় পেলে ছিঁড়ে খুবলে নিয়ে ঠিক ওর মতন বিক্ষিপ্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একটা চলমান লাশে পরিণত করবে না তার নিশ্চয়তা কি!

নেহায়েতই যদি বেঁচে থাকি তবে এটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় রাত। যে রাতের কথা আমি কোনদিনও ভুলবোনা।
এবার আমার চিন্তাভাবনার ধারায় আচমকা ছেদ পড়লো।

আপনা আপনি বদলে গেলো চোখের সামনের দৃশ্য। ঠিক সিনেমার রিল ঘুরে যাবার মতন।
প্রথমে ঘরে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো। অন্ধকার ফুড়ে চোখ ধাধিয়ে দিলো একশো ওয়াটের একটা হলুদ বাতি। ঘরের ভেতরটা মোমের আলোয় যেমনটা দেখেছিলাম তার কোনটাই আর আগের মতন নেই।
একটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম হাসপাতালের ঘর । সারি করে লোহার বেড পাতা। শুধু টেবিল আর হুইলচেয়ারের অবস্থান ঠিক আছে। প্রত্যেক বেডে রোগী আছে। রোগীদের চালচলন দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা কেউ সাধারণ রোগী নয়। সবাই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কেউ এমনি হাসছে, কেউ কাঁদছে। কেউ লোহার বেডের নিচে ঢুকে অন্য আরেকজনের সাথে লুকোচুরি খেলছে। আবার কেউবা ওষুধের বাক্স নিয়ে ছোড়াছুঁড়ি করছে।
সময়টা রাতের প্রথমার্ধ।

জানালার বাইরে থেকে যারা আমার হাত ধরে টান দিয়েছিলো তাদের সবাইকে একে একে দেখতে পেলাম বিভিন্ন বেডে।

একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী স্টিলের ট্রেতে করে রাতের ওষুধ আর ইঞ্জেকশন নিয়ে এসেছে। সাথে আছেন একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার। কিন্তু তার চোখেমুখে ডাক্তারের দয়ালু ভাবটা একেবারেই নেই। বরং রাজ্যের বিরক্তি ভর করে আছে। যেন রাতেরবেলা রোগীদের ঝামেলা তার সহ্য হচ্ছেনা।

তবু তাচ্ছিল্যভরে এক এক করে যাকে ওষুধ খাওয়ানোর দরকার তাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন আর যাকে ইনজেকশন দেয়ার কথা তাকে ইনজেকশন দিচ্ছেন। শুধু একটা রোগীর কাছে গিয়ে তার মুখে একটা বিশ্রী হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু রোগীর মুখে ভয় আর ঘৃনার ছাপ স্পষ্ট। যেন ডাক্তারকে তার একেবারেই পছন্দ নয়।
ডাক্তার কিন্তু হাসিমুখেই রোগীর নাম ধরে প্রশ্ন করলো

‘দ্বীপন, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি হলেনা তাহলে? তোমাকে তাই আজ আর ভেবে দেখার সুযোগ দিলাম না। ভালো থেকো।’

বলে ইনজেকশনের সুঁইটা প্রায় জোর করেই বিঁধিয়ে দিলেন দ্বীপনের হাতের মাংসপেশীতে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো সে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ডাক্তারকে একবার ভেংচিও কাটলো।
তারপর বেডে ধপ করে বসে পড়লো। থমথমে হয়ে গেলো তার মুখ।
ডাক্তার সব কিছু দেখে আবার সেই বাজে রকমের হাসিটা দিয়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে তার কর্মচারীর সাথে কথা হচ্ছিলো। সেই কথা আমি এখান থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট।

কর্মচারীটা বলছে ‘ছার কাজডা ঠিক হইলো না। তাই বইলা একদম মরণসুই মাইরা দিলেন। বেচারার লাইগা কষ্ট হইতাছে।’

‘শোন মনসুর একটা আদিবাসি বদ্ধ পাগল আমার কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে আর আমি এর একটা জবাব দেবোনা সেটা কি করে হয়। ওর প্রাপ্য শাস্তি ওকে দিয়ে দিলাম। যদিও শাস্তির অনেকটা এখনো বাকি।’

মনসুর চমকে উঠে বললো ‘ও তো ছার মইরাই যাইবো দু ঘন্টার মইদ্যে। যে কঠিন বিষ শইলে ঢুকায় দিছেন! আর কি শাস্তি দিবেন ওরে? ছার ওর মেয়েরে একলা পাইয়া আফনে সুযোগ নিতে চাইছিলেন। ও দেইখা ফেলছে। পাগল হইলেই মাইয়ার ভালাডা সব বাপেই বোঝে। দোষটা তো ওর না ছার।’

‘দোষ না! আমি ঐ হতচ্ছাড়া গেয়ো ভূতটাকে পরে অনেকগুলো টাকা সেধেছি যেন ও ব্যপারটা হাসপাতালের আর কাউকে না জানায়। পাঁচকান না করে। কচকচে টাকার নোট তো পাগলেও চেনে। টাকা না নিয়ে ও ঘটনাটা সারা হাসপাতাল রাষ্ট্র করেছে। আমার দুর্নাম করেছে বড় স্যারের কাছে। এই ডক্টর আজাহার আলীর মানসম্মান সব গেছে। এখন যে ওর লাশটাও ঠিকমতন সৎকার হবেনা জানো মনসুর?’ ডাক্তারের কন্ঠে চরম জিঘাংসা ফুটে উঠলো।
মনসুর ভয়ার্ত গলায় বললো ‘কি কন ছার! আর কি করবেন আফনে?’

‘রাতটা গভীর হোক। সব জানতে পারবে। তোমার সাহায্য লাগবে তো। তোমায় থাকতে হবে কাজটা শেষ করার জন্য।’জবাব দিলো ডাক্তার। তার ঠোঁটের কোণে বিরক্তিকর সেই হাসি ঝুলছে।
যথানিয়মে রাত বাড়লো। মানসিক ওয়ার্ডের সবাই গভীর ঘুমে অচেতন।

সুযোগ বুঝে দ্বীপনের প্রানহীন দেহটা মনসুরের সহায়তায় কায়দা করে বেড থেকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো ডাক্তার আজাহার। শুইয়ে দিলো অপারেটিং টেবিলে। ইনজেকশনে কাজ হয়েছে। দ্বীপনের আত্মাটা দেহের মায়া ত্যাগ করেছে কিছুক্ষণ হলো। না করলেও ডাক্তারের ক্ষতি ছিলোনা। কেন সেটা টের পেলাম কিছুক্ষণ পর।
টেবিলের পাশেই স্টিলের ট্রে ভর্তি ছুরি কেঁচির জঞ্জাল। পিশাচ ডাক্তার আর দেরী করলো না। সদ্য লাশ হয়ে যাওয়া দ্বীপনের সারা দেহে ছুরি আর কেঁচি দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত হানতে লাগলো পাগলের মতন। ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেললো টাটকা লাশটাকে। ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুটলো। ভিজে গেলো টেবিলের চারপাশ। রক্তে তখনো কিছুটা উষ্ণতা রয়ে গেছে। মনসুর চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সেই শুরুতেই।

যে আমাকে এসব দৃশ্য দেখাচ্ছে সে আমায় চোখ বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়নি। নইলে আমারো সহ্য হচ্ছিলোনা এই নৃশংসতা। এই অমানবিক বর্বরতা।

আমি ত্রস্ত চোখে পরে কি হয় দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ডাক্তার লাশটাকে যত টুকরো করা যায় করে সাথে করে আনা বস্তায় ভরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো। মনসুর এলো পিছুপিছু। তারপর পাহাড়ের একদম কিনারে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে নিচের ঘন জঙ্গলের দিকে ছুড়ে মারলো বস্তাটা। সবুজ পাহাড়ের নিচের ঘিঞ্জি গাছপালার ভীড়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হলো দ্বীপন নামের এক পাগলের খণ্ডিত লাশ।

এর আগেও দু একটা লাশের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু মনসুর লাশের এরকম নিষ্ঠুর ব্যবচ্ছেদ এর আগে কখনো দেখেনি। ও এই জঘন্য অপরাধের একমাত্র সহযোগী আর সাক্ষী হয়ে বাড়ি ফিরলো সে রাতে।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। সে রাতে আজাহার আর মনসুরের অগোচরে আরেকজন এই ঘটনাটা নিজ চোখে দেখে ফেলেছিলো। সেও একজন মানসিক রোগী। দ্বীপনের পাশে বেডে চিকিৎসাধীন ছিলো। আড়ালে থেকে সব দেখেছে সে।

তাই দেরী না করে পরেরদিন সকালে সবাইকে বলে দেয় ব্যপারটা। দ্বীপনের খুনী কে সেটা ইশারায় বুঝিয়ে বলে সবাইকে।

সব রোগী হাসপাতাল চত্বরে বসে যায়। কেঁদেকেটে ইশারা ইঙ্গিতে দ্বীপনের খুনের ব্যপারটা বোঝানোর চেষ্টা করে বড়কর্তাকে। কিন্তু পাগলদের কথার মর্ম বোঝা তো এতো সোজা নয়। এদের কথা বড়কর্তা কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। আগেই ঘটে গেলো মর্মান্তিক ঘটনাটা। সেরাতের চাঁদটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওদের কারোর। খুনী ডাক্তার আর সহযোগী মনসুরের হাতেই মারা পরে সবাই। দুপুরের খাবারে বিষ মেশানোর কাজটা ডাক্তার নিজের হাতেই সেরেছিলো। এই জঘন্য হত্যাকান্ডের বিচার আর হয়নি। ডাক্তার আজাহার আলী প্রকৃতির নিয়মেই শাস্তি পেয়েছিলো। তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে অসাবধান অবস্থায় সে পড়ে গিয়েছিলো পাহাড় থেকে। কিন্তু তাতে অতোগুলো নিরপরাধ রোগীর আত্মা মোটেই শান্তি পায়নি।

কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো হাসপাতাল। হাসপাতাল প্রধান অর্থাৎ বড়কর্তা চাকরী ছেড়ে ফিরে গেলেন ঢাকায়। কর্মচারী মনসুর আত্মগ্লানিতে ভুগে শেষে আত্মহত্যা করলো।

হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার কয়েক মাস পর থেকেই হাসপাতালের এই মানসিক রোগীদের ওয়ার্ডে যারাই ঢুকতে চেয়েছে তারা আর জীবিত বের হতে পারেনি। এমনকি মৃত রোগীদের নিজেদের জীবিত আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত রেহাই পায়নি। কারো মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছে অশরীরীর দল। কারো দেহ চরম আক্রোশে কেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে দ্বীপনের দেহের মতন। তারপর গিলেছে তাদের দেহাবশেষ। একজনেরও লাশ আর পাওয়া যায়নি। সব একই নিয়মে গুম হয়েছে। লাশের পেটে গেছে লাশ!

অথচ জীবিতরা ভেবেছে নিখোঁজ মানুষগুলো অপহৃত হয়েছে অথবা শত্রুর হাতে মরেছে।

এসব ঘটনার কিছুই আমি জানতাম না। জানতে চাইনি কখনো। কিন্তু যারা সব কিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে তারাই চোখের সামনে ঘটনার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে আমার দৃষ্টিগোচর করেছে সব। কারণ একটাই। আমার এই ঘরে উপস্থিত থাকা। মৃত্যুর আগে আমি যেন সব জেনে নিতে পারি। যেন শান্তিতে মরতে পারি।

আমি জানি আমার অবস্থাটাও একই হবে । কারণ দ্বীপনের চলমান লাশটা আমায় ধরার জন্য এইমাত্র ওর লম্বা লিকলিকে হাতদুটো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে সব মৃত মানসিক রোগী। তারা একটা নির্মম তামাশা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি।

অপারেশনের টেবিলটা আনা হয়েছে এই ঘরে। টেবিলের পাশে স্টিলের ট্রে তে সাজানো ছুরি আর কেঁচি চকচক করছে বাল্বের হলুদ আলোয়। ওগুলো হয়তো অনেকদিন থেকেই অপেক্ষা করছে টাটকা উষ্ণ রক্তে ভেসে যাবার জন্য। আজ ওদের আবদার মিটবে……………!

এতটুকু পড়ার পর কাওসার সাহেবের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে এসেছেন রাঙামাটির মাতামুহুরি নদীর একদম কাছে অবস্থিত পরিত্যাক্ত পাহাড়ি এই হাসপাতাল কে আবার সচল করার জন্য। মানসিক রোগীদের ওয়ার্ড ঠিক করার সময় এক শ্রমিক তাকে এই কাগজটা দিয়ে যায়। কেউ গুছিয়ে গুছিয়ে একটা ভয়ানক ঘটনার বর্ননা দিয়েছে কাগজে। শেষের কয়েকটা লাইন প্রায় অস্পষ্ট। বোঝা যায় মনের জোর ঠিক রেখে লিখতে হয়েছে। হাত কেঁপে গেছে বারবার। বেঁকে গেছে অক্ষরগুলো। কাগজের ঘটনাটা যেভাবে লেখা হয়েছে তা পড়লে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। শিমুল নামের একটা ছেলে ভাগ্যচক্রে এমন বলির পাঠা হয়েছে জেনে তার খুব খারাপ লাগছিলো । কিন্তু তার কয়েকটা বিষয়ে খটকা লেগেই রইলো। শিমুলকে আসলে ঠিক কারা হাসপাতালে শিকল দিয়ে বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলো? ঐ ছেলেগুলো কে? শিমুলের কোন শত্রু নাকি মৃত উন্মাদ রোগীদের একাংশ এসেছিলো নতুন শিকারে খোঁজে। হয়তো জীবিতদের শেষ করে দিতে দিতে ব্যপারটা নেশায় পরিণত হয়ে গেছে ওদের। নেশাগ্রস্থ শিকারী শিকার খুঁজে খুঁজে মারবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে! শিকার শুধু অসহায়ভাবে বলি হবে বিদেহীদের হাতে। সাহায্য করতে আসবে না কেউ। ঘরজুড়ে থাকবে শুধু একটা গাঢ় অনুভূতি। একটা বোবা আতঙ্ক!

………………………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত