শ্মশানের কান্না

শ্মশানের কান্না

আমি অনেকের মুখে শুনতাম , শ্মশান হলো এক শান্তির জায়গা l যেখানে মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তার যতো অহংকার , লোভ , কাম , উচ্চাশা , প্রতিহিংসা সমেত সব কিছু l …শুধু অবশিষ্ট থাকে, দুমুঠো ছাই l

কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে , এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আজও বহন করে চলেছি l আজ থেকে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, শ্মশান গুলোর অবস্থা এতো আধুনিক ছিল না l তখন কোথায় ইলেকট্রিক চুল্লি ? কোথায় বসা বা বিশ্রামের জায়গা ? কোথায় এতো টিউব নিয়নের ছড়াছড়ি ?সকালের দিকে যেতেই গা ছমছম করতো , রাতের কথা বাদই দিলাম l আমাদের এলাকার শ্যাম বাবুর শ্মশান ঘাট ছিল , গঙ্গার ধারে…বট, অশত্থ , নিম গাছ দিয়ে ঘেরা l একটু পাঁচিল ঘেরা জায়গায় দুটো গর্ত কাটা থাকতো , মড়া পোড়াবার জন্যে l যাতে হাওয়ায় চিতা না নিভে যায় ! অসুবিধে হতো বর্ষাকালে l কাঁধে করে পুরোনো সাইকেল টায়ার নিয়ে যেতে হতো l মড়া পোড়ানোর গন্ধ সারা এলাকা জুড়ে পাওয়া যেত l আবার হাসপাতালের বাসি মড়া হলে তো গন্ধে টেঁকা যেত না l

আমার বন্ধু রঞ্জনের মা তিনদিনের জ্বরে মারা গেলো l সন্ধ্যে বেলা খবর পেলাম l প্রিয় বন্ধুর মা , শ্মশানে যেতে হবে l শীতের সময়…মৃতদেহ বাড়ি থেকে বের করতেই রাত দশ টা বেজে গেলো l

আমরা চার বন্ধু আর রঞ্জনের দুজন আত্মীয় l শ্মশানে পৌঁছে দেখি, কোন চুল্লি জ্বলছে না l তার মানে কোন মৃতদেহ আসেনি l চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার l শুধু ডোমেদের ঘরের সামনে একটা ছোট্ট ল্যাম্প টিমটিম করে জ্বলছে l সামনের ঝাঁকড়া বিশাল বট গাছটার জন্যে, অন্ধকার আরও বেশি লাগছে lগঙ্গার ওপরও কুয়াশার একটা চাদর বিছানো l

আমি বললাম ” ভালোই হলো, আমাদের ওয়েট করতে হবে না l তাড়াতাড়ি দাহর কাজ শেষ হয়ে যাবে “,l আসলে আমি মনে মনে চাইছি এইরকম পরিবেশ থেকে যত শীঘ্র সম্ভব চলে যেতে l ঠান্ডাটা এই ফাঁকা জায়গায় আরও বেশি করে গায়ে কামড় বসাচ্ছে l

রঞ্জনের আত্মীয় বললো ” কই ডেথ সার্টিফিকেটটা দাও ” — রঞ্জন ফ্যাকাশে মুখে তাকালো ! আনতে ভুলে গেছে l আমাদের সবাইয়ের মাথায় হাত l ￰সাইকেলও কেউ আনিনি , যে চট করে নিয়ে আসবো l ….এতটা পথ , এই শীতের রাত্রে যেতে হবে ! আর আমাদেরও মড়া নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে l মনে মনে রাগ হলেও কিছু বলা গেলো না l বেচারীর মাথার ঠিক নেই l ঠিক হলো , আমাদের দুই বন্ধু যাবে l এখনকার দিন হলে , মোবাইলে কাজ সারা হয়ে যেত l ওর দুই আত্মীয় গেলো ডোমেদের ডেকে তুলে , কাঠ কিনতে l

রঞ্জনের পিসেমশাই কাঠ কিনতে যাবার আগে বললো ” পুরুত এখানে পাওয়া যাবে তো ? বাবা রঞ্জন — তুমি মায়ের মৃতদেহ ছুঁয়ে বসে থেকো l ” আমরা দুজন গঙ্গার পাড়ের কাছে , মড়ার খাট ধরে বসে রইলাম l ￰অদূরে একটা তালগাছ থেকে শকুনির বাচ্চা গুলো কুঁ কুঁ করছে l মনে হচ্ছে বাচ্ছা ছেলে কাঁদছে ! মাঝে মাঝে গঙ্গার ঢেউ ভাঙার শব্দ কানে আসছে l

” শঙ্কর , আমার কিরকম ভয় ভয় করছে ” রঞ্জনের কাঁপা গলা l আমারও একটা কিরকম যেন আলাদা অনুভূতি লাগছে l এখানে এই অন্ধকারে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই l পিসেমশাই কাঠ কিনতে , ঢালু বেয়ে উঠে ডোমেদের ডেরায় গেছে l বাকি দুজন এখন বাড়ির পথে l

আমার পকেটে ছোট একটা টর্চ আছে l গঙ্গার অন্ধকারের দিকে তাকলাম l ওপারটা দেখাই যাচ্ছে না , কুয়াশার জন্যে l কালো আঁধার আর কুয়াশা যেন কোলাকুলি করে চলেছে l ও বলে উঠলো..
” মায়ের দেহটা কেমন কাঁপছে..” ওর কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে এলো l

” তুই এই রাত বিরেতে কি সব ভুল ভাল বকছিস ? ” নিজের মনকেই সান্তনা দিলাম l
” গায়ে হাত দিয়ে দেখ, মিথ্যে বলছি না ” ওর দাঁত ঠকঠকানির শব্দ পেলাম l ঠান্ডায় না ভয়ে বুঝলাম না l
” তুই নিজে শীতে কাঁপছিস, তাই এরকম মনে হচ্ছে l ” — পকেট থেকে টর্চটা বার করে জ্বালালাম l চোখে তুলসীপাতা চাপা দেওয়া ওর মায়ের মৃতদেহ একদম স্থির l

….হঠাৎ গঙ্গার ঢেউ ভাঙার শব্দ ছাপিয়ে অন্যরকম শব্দ আমাদের কানে এলো ! — মনে হচ্ছে জলে কে বা কারা হুটোপাটি করছে ! সাঁতার কাটলে বা জল ছোঁড়া ছুঁড়ি করলে যেই রকম আওয়াজ হয়… l কিন্তু এতো রাতে, এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কে স্নান করবে ? …দেখবার জন্যে দাঁড়িয়ে উঠে টর্চটা জ্বালালাম l

আচমকা বিরাট ভয় খেলাম l আমরা দুজনে দেখতে পাচ্ছি…তিন চারটে বাচ্ছা ছেলে মেয়ে মনের আনন্দে স্নান করছে…জল নিয়ে এর ওর গায়ে ছুঁড়ে মারছে, আর হেসে লুটিয়ে পড়ছে l টর্চের আলোটা ওদের গায়ে পড়তেই , আমাদের দিকে তাকালো l সবার চোখগুলো …রাত্রে শেয়াল , কুকুরদের যেমন চোখ গুলো জ্বলে, তেমনি জ্বলছে l
আমরা সম্মোহিতের মতো এক দৃষ্টে ওই জল কেলি দেখে চলেছি l বাচ্ছা গুলো এবার জল থেকে উঠে , কাদায় হামাগুড়ি দিয়ে পাড়ে উঠে এসেছে l টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে , ওদের ছোট্ট শরীর কাদা আর জলে মাখামাখি …l মুখে জান্তব হাসি নিয়ে অনেক কাছে চলে এসেছে ! হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে l …পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে…বড় বড় মাথা , নাকের জায়গায় শুধু কালো গর্ত , লম্বা কান দুটো পতপত করছে ! উঃ কি বীভৎস দেখতে লাগছে l
মন অনেক্ষন থেকে বিপদের নোটিশ দিয়ে চলেছে ….l ￰সম্বিৎ ফিরে এলো, মগজ ঘোষণা করছে ….এরা মানব জগতের বাসিন্দা নয় l ￰হ্যাঁচকা টানে রঞ্জনকে টেনে নিয়ে , ঢালু জমি বেয়ে ওপর দিকে উঠতে লাগলাম…ডোমেদের ঘর লক্ষ্য করে l তখন আর মাথায় নেই , রঞ্জনের মায়ের মৃতদেহ একা পড়ে আছে.. l পিছন ফিরে দেখার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেছি l …শুধু কানে আসছে , খিল খিল হাসির শব্দ !

আমাদের ছুটে আসা, পিসেমশাই ও বাকি রা দেখতে পেলো l হাঁফাতে হাঁফাতে সব বলতে….শ্মশান ঘাটের কর্মচারী আর ডোম রা বললো..” মরা বাচ্ছাদের ওই গঙ্গার ঢালুতে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হয়, ওদেরতো দাহ করা হয় না l তাই হয়তো কিছু দেখে টেখে থাকতে পারেন…. l ”

এইসময় সবাইয়ের খেয়াল পড়লো…মৃতদেহ একাকী ওখানে পড়ে আছে l দ্রুত পায়ে সবাই চললো…না জানি অন্য কি অঘটন ঘটে ?

….তারপর , কোনরকমে মড়া পুড়িয়ে শীতে আর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরলাম l …বিরাট একটা ফাঁড়া থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে গেলাম l

সেই থেকে অনেকদিন আর শ্মশান মুখো হইনি l অনুরোধ এলেও সযত্নে এড়িয়ে গেছি।

………………………………………..(সমাপ্ত)………………………………………

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত