বেগোভূত

বেগোভূত

ইদানীং সুন্দরবনে তেমন আর যাওয়া হয় না। হরেক বিধিনিষেধের কারণে বেড়াবার মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সেই রোমাঞ্চও আর নেই। মনে পড়ে‚ সেবার পীরখালির জঙ্গলে এক ফোড়ন খালের ভিতর রাতে ভটভটি নোঙর করা হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত একটা হরিণ থেকে থেকেই টাঁউ–টাউঁ শব্দে সমানে ডেকে গেল। আমাদের গাইড এক অভিজ্ঞ বাউলে‚ হুঁশিয়ারি দিয়ে জানালেন‚ জায়গাটা গরম আছে বাবুরা। রাতে একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। গরম বলতে তিনি কী বোঝাচ্ছেন‚ জানতে বাকি ছিল না। বোট থেকে জঙ্গল বড় জোর পঞ্চাশ গজ। ভটভটিও এমন বড় নয়। তিনি ইচ্ছে করলে‚ সাঁতরে সহজেই ভটভটিতে উঠে পড়তে পারেন। আমরা অবশ্য বাউলের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে হরিণের সেই ডাক শুনতে শুনতে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কালিরচরে এমনই এক রাতের কথা। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাত্ ঘুম ভাঙতে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেঙে তীব্র গতিতে ভটভটি ছুটেছে। ঘড়িতে রাত তখন আড়াইটে। পাশে একজন আগেই উঠে পড়েছিল। জিজ্ঞাসা করতে জানাল‚ ডাকাতের নৌকো। শেষ মুহূর্তে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভটভটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরে এসে দেখি পিছনে সেই নৌকো থেকে তখনও আলো ফেলা হচ্ছে। সেটা আশির দশক। তখনও সুন্দরবনের বেশিরভাগ নৌকোই দাঁড়ে টানা। পিছনের নৌকোটাও তাই। সেই কারণে আমাদের নাগাল পায়নি। প্রায় চারটে নাগাদ ভটভটি এসে থেমেছিল লাহিড়ীপুরের জেটিঘাটে।
সুন্দবন বেড়াতে গিয়ে সবাই বাঘ দেখতে চায়। বার তিনেক আমিও দেখেছি। কিন্তু তার থেকেও আমার কাছে অনেক বেশি রোমাঞ্চকর অসংখ্য অন্য ঘটনা। সেবার চলতে চলতে অনেকটা দক্ষিণে নেমে গেছি। শেষ বিকেলে বোট নোঙর করা হল কেওড়াসুদের কাছে হলদি নদীতে। সন্ধেয় দেখা মিলল এক জেলে নৌকোর। তাদের কাছ থেকে রাতের জন্য টাটকা ভেটকি আর বড় চাপড়া চিংড়ি কেনা হল। ভেবেছিলাম‚ ওরাও হয়তো আমাদের এখানেই রাত কাটাবে। সেই কথা বলতে তারা জানাল‚ বড় নদীতে রাতে ডাকাতের ভয় থাকায় ওরা কাছেই এক খালে নৌকো ভেড়াবে। অকাট্য যুক্তি। আমাদের গাইডও অভিজ্ঞ বাউলে। আমরা কয়েকজন তাকেও ফোড়নখালে ভটভটি ঢোকাতে বললাম। তিনি কিন্তু রাজি হলেন না।
তারপর যথারীতি রাতের ভুরিভোজের পর শুয়ে পড়েছি‚ অনেক রাতে চিত্কার চ্যাঁচামেচিতে ঘুমটা ভেঙে গেল। বোটের প্রায় সবাই তখন উঠে বসেছে। দূরে জঙ্গলের ভিতর অনেক মানুষের আর্ত চিত্কার। হইচই। মনে হল‚ সন্ধের সেই জেলে নৌকোয় কিছু একটা ঘটেছে। চিত্কার চ্যাঁচামেচি একটু পরেই অবশ্য থেমে গেল। আমরাও ফের শুয়ে পড়লাম। পরের দিন ভোরে বোট ছাড়ার তোড়জোড় চলছে। দেখি‚ গতকালের সেই জেলে নৌকো পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ডেকে রাতের কথা জিজ্ঞাসা করতে একজন কপালে বার কয়েক হাত ঠেকিয়ে খরখরে গলায় বলল‚ ‘আপনারা বাবু সুন্দরবনে আসেন মজা করতে। ওসব জেনে কী দরকার?’
উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ধরলাম আমাদের বাউলেকে। কোনও সদুত্তর পেলাম না তাঁর কাছেও। শুধু বার কয়েক কপালে হাত ছোঁয়ালেন। আমার সন্দেহ হল‚ সম্ভবত এমন কিছু অনুমান করেই উনি রাতে খালের ভিতর বোট ঢোকাননি।
সুন্দরবনে শুধু বাঘ বা ডাকাত নয়‚ অন্য ব্যাপারও আছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি‚ সুন্দরবনের মানুষ‚ জঙ্গলে ঢুকে বাঘের নাম কমই মুখে আনেন। বেশিরভাগ সময় বড় শেয়াল‚ নয়তো গরম বিশেষণে কাজ সারেন। কিন্তু অন্য যে ব্যাপারটা প্রায় মুখেই আনেন না‚ সেটা হল বেগোভূত। হ্যাঁ‚ সুন্দরবনে যাঁরা বাঘের কবলে প্রাণ হারায়‚ সত্কার হয় না‚ তাদের অতৃপ্ত আত্মা নাকি জঙ্গলে হাহাকার করে বেড়ায়। বাদাজঙ্গলে ‘বেগোভূত’ নামেই তারা সাধারণের মধ্যে পরিচিত। এই বেগোভূতের গল্প বইতে কিছু পড়েছি। বাদাজঙ্গলে এক কাঁকড়া ধরা নৌকোর মাঝির কাছেও একবার এক দারুণ গল্প শুনেছিলাম।
আমি বিড়ি–সিগারেট খাই না। কিন্তু সুন্দরবনে গেলে কয়েক প্যাকেট বিড়ি সঙ্গে রাখি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি‚ বাদার মানুষের সঙ্গে আলাপ জমাতে ওই জিনিসটির জুড়ি নেই। সেবার রাত কাটিয়েছিলাম হেমনগর ট্যুরিস্ট লজে। সকালে দেখি সামনের জেটিঘাটে এক জেলে নৌকো। কাঁকড়া ধরে ফিরছে ওরা। জোয়ার ধরে হেমনগর পৌঁছেছে অনেক রাতে। ফের জোয়ার শুরু হলেই নৌকো ছেড়ে দেবে। তার আগে কাঁকড়ার দাঁড়া বাঁধার কাজ চলছে। আলাপ জমে উঠতেই একসময় বেগোভূতের কথা উঠল। হেমনগর মানে‚ মোটামুটি জঙ্গল তখন ছেড়ে আসা হয়েছে। কতকটা সেই কারণেই হয়তো বিড়িতে সুখটান দিয়ে মুখ খুলেছিলেন নৌকোর সাঁইদার গদাধর মণ্ডল। শুনিয়েছিলেন এক অদ্ভূত ঘটনার কথা।
হাসনাবাদের ওদিকে বাড়ি। নিজের ছোট নৌকো আছে। খেতের কাজ না থাকলে দোন পেতে কাঁকড়া ধরতেও বের হয়। দোন মানে বিশাল লম্বা এক দড়ি। এক দেড় হাত অন্তর বাঁধা সুতোয় শুঁটকি মাছের টোপ। মোট তিনজন লাগে এই কাজে। তাই দু’জন সঙ্গী নিতে হয়। সেবার কাঁকড়ার খোঁজে একটু বেশি ভাটির দিকে নেমে গেছে। পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও চলছে কাঁকড়া ধরার কাজ। তাই একটু হুঁশিয়ার থাকতে হচ্ছে। ধরা পড়লেই হেনস্তার একশেষ। তা কপাল খারাপ। চাঁদখালির কাছে এক ফোড়নখালে তখন দোন পাতার তোড়জোড় চলছে‚ হঠাত্ কাছেই ভটভটির আওয়াজ। অভিজ্ঞ মানুষ। আওয়াজ যে বনদপ্তরের পেট্রোল বোটের বুঝতে ভুল হয়নি। দেরি না করে ওরা তাড়াতাড়ি দোন তুলে সরু এক ফোড়নখাল বেয়ে ঢুকে পড়ল গভীর জঙ্গলের ভিতর। খানিক বাদে আওয়াজে বুঝল‚ পেট্রোল বোট ওদের উপস্থিতি টের পায়নি। চলে যাচ্ছে বাঘমারার দিকে। ওরা অবশ্য ঝুঁকি নেয়নি তবু। সারাদিন আর বাইরে বড় নদীর দিকে যায়নি। ভিতরে দু’একটা খালে কাঁকড়া ধরে বিকেলের দিকে নৌকো নোঙর করেছিল এক সুঁতিখালের মুখে। সুঁতিখাল মানে যে খালের অন্য দিকের মুখ বন্ধ। জঙ্গলের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। ভাটায় এসব খালে বেশিরভাগ সময় জল থাকে না। শুকিয়ে যায়। এদিকে ওরা আগে তেমন আসেনি। তবু পুরোনো অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছিল‚ সুঁতিখালটির মুখের দিকে জল ভালই থাকবে। খালের মুখেই চমত্কার একটা বাঁক। বড়নদীর খুব কাছে থাকলেও নৌকো নজরে পড়বে না।
সন্ধেয় আলো তখন যথেষ্টই মরে এসেছে। সরু সুঁতিখালের ভিতর অন্ধকার বেশ ঘন। দু’দিকে গরান আর হেঁতাল জঙ্গলের ভিতর অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির কোরাস। নৌকোয় রান্নার তোড়াজাড় চলছে। আলুভাতে ভাত হলেই ডাল চাপাবে। খেয়ে শুয়ে পড়বে তারপর। পালা করে একজন অবশ্য জেগে থাকবে। হঠাত্ ধপ্ করে একতাল কাদা ছইয়ের উপর এসে পড়ল। গোড়ায় অবশ্য বোঝেনি ওরা। ভেবেছিল‚ গাছের কোনও ফল বা শুকনো মরা ডালের টুকরো খসে পড়েছে। কিন্তু পরে খেয়াল হল‚ কাছে কোনও বড় গাছ নেই। লম্ফ হাতে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখে ওই ব্যাপার। টাটকা এক খাবলা কাদা পড়ে আছে ছইয়ের উপর। কে এমন কাজ করল‚ অবাক হয়ে সবাই যখন ভাবেছে‚ সেই মুহূর্তে অন্ধকার ফুঁড়ে আর এক খাবলা কাদা পাশে এসে পড়ল। বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ওরা অন্ধকারে চারপাশে তাকাচ্ছে। তারমধ্যেই ফের এক খাবলা। এবার আর ছইয়ের উপর নয়। একজনের গায়ে।
ততক্ষণে যা বুঝবার বুঝে ফেলেছে ওরা। রান্না মাথায় পড়ে রইল। বনবিবির নাম জপতে জপতে সেই দণ্ডেই কোনও মতে নোঙর তুলে ছেড়ে দেওয়া হল নৌকো। নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসুত মিলল ফাঁকায় বড় নদীতে এসে। পেট্রোল বোট ফের এদিকে এলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। তবু সেখানেই নোঙর করা হল নৌকো। রান্না খাওযা বন্ধ করে বনবিবির নাম জপতে জপতে রাত ভোর হল একসময়। দিনের আলো ফুটতে প্রায় যেন নবজন্ম হল সবার। সেবার কাঁকড়া ধরার ওইখানেই ইতি।
এমন আগে শুনিনি। ফের একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে আগ্রহে বললাম‚ ‘বাদাবনের ওনারা এভাবে কাদা ছুঁড়ে ভয় দেখায় নাকি?’
‘এ গল্পের আর একটু বাকি আছে। বলি শোনেন।’ এগিয়ে দেওয়া বিড়ি কানে গুঁজে ডান হাত কপালে ঠেকিয়ে গদাধর মণ্ডল বললেন‚ ‘সকালে দিনের আলোয় সাহস কিছু বেড়েছিল অবশ্যই। তার উপর কৌতূহল তো ছিলই। এদিকে জোয়ার না এলে নৌকো ছাড়ার উপায় নেই। তারও দেরি আছে কিছু। ভাবলাম‚ এই ফাঁকে আর একবার ঘুরে যাই জায়গাটা। যদি রহস্যের কিছু হদিস মেলে। সঙ্গীরা অবশ্য রাজি হতে চাইছিল না। যাই হোক ওদের রাজি করিয়ে একসময় সুঁতিখালের সেই বাঁকের কাছে পৌঁছে যা দেখলাম‚ তাতে সারা শরীর হিম হবার জোগাড়।
খালের গড়নটা অদ্ভূত। গতকাল জোয়ার থাকায় বুঝতে পারিনি‚ বাঁকের পিছনে খালের গভীরতা অত্যন্ত কম। ভাটায় সেখানে কিছুমাত্র জল নেই এখন। শুধু থকথকে কাদা। আর সেই কাদার উপর বাঘের টাটকা পায়ের দাগ। গতরাতে পায়চারি করে গেছে। সেই অসংখ্য পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে বাকি থাকেনি‚ অভিজ্ঞ নরখাদক গতকাল সন্ধে থেকেই আমাদের নিশানা করে অদূরে হেঁতাল ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে ছিল। গভীর রাতে ভাটায় আমাদের নৌকো কাদায় আটকে গেলে সহজেই কাজ সেরে ফেলবে‚ সেই মতলবে। হঠাত্ ওইভাবে খাবলা খাবলা কাদা এসে পড়ার কারণে ভয় পেয়ে নৌকো সরিয়ে না নিলে সেই রাতে আমাদের একজন বাঘের পেটে যেতই।
অভিজ্ঞ নরখাদক বাঘটা ওই জায়গায় এভাবে অল্পদিন আগেই যে শিকার ধরেছে‚ এরপর বুঝতে পেরেছিলাম সেটাও। চারপাশে ভাল করে নজর করতেই চোখে পড়েছিল‚ কাছেই গরান গাছে বাঁধা বিবর্ণ এক টুকরো গামছার নিশান। হতভাগ্য সেই মানুষটির। জানেন বোধহয়‚ বাদাবনে কেউ বাঘের পেটে গেলে তার সঙ্গীরা হতভাগ্য মানুষটির এক টুকরো কাপড় কাছেই কোনও গাছে বেঁধে দেয়। অন্যদের সাবধান হবার জন্য। আগের দিন সন্ধের অন্ধকারে আমরা কিন্তু একেবারেই দেখতে পাইনি সেটা।’

…………………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত