পাঁচ মুন্ডির আসর

পাঁচ মুন্ডির আসর

স্টেশনের নাম লোচনপুর। সেখান থেকে আবার দু ক্রোশ পথ। যানবাহন বলতে কিচ্ছু নেই। গরমে আর শীতে যাও-বা গরুর গাড়ি চলে কিন্তু বর্ষায় তা আর সম্ভব নয়। মাঝখানে দু-দুটো খাল। অন্য সময়ে বালির স্তুপ হয়ে থাকে কিন্তু বর্ষায় ফুলেফেঁপে একেবারে অন্য চেহারা। তখন খেয়া নৌকো ছাড়া যাতায়াত একেবারেই অসম্ভব।

কিন্তু আমার না গিয়ে উপায় নেই। কোর্টের কাজ। এই চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে পুবাই গাঁয়ের সর্বেশ্বর জানা’কে ধরতে হবে। ধরা মানে, কোর্টের ভাষায় সমন ধরিয়ে দেওয়া। এই কাজ না করতে পারলে চাকরি থাকবে না।

হয়তো গিয়ে দেখব আগে থাকতে খবর পেয়ে সর্বেশ্বর জানা ডুব মেরেছে। কোথাও পাওয়া যাবে না তাকে। তাই যদি হয়, তাহলে তার বাড়ির দরজায় নোটিশ সেঁটে দিয়ে আসতে হবে। মোট কথা, যেতে আমাকে হবেই।

যাত্রা শুরু করলাম। কাঁচা মাটির পথ কিছুটা গিয়েই শেষ হয়ে গেল। তারপর আল। হাতখানেক চওড়া। সার্কাসে সরু দড়ির ওপর দিয়ে যেভাবে লোকে ব্যালেন্স রেখে হাঁটে, তেমনিই সাবধানে ব্যালেন্স রেখে আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটু এদিকওদিক হলেই কাদাগোলা জলে নাকানিচোবানি খেতে হবে। একমাত্র ভরসা, এখনও যথেষ্ট দিনের আলো রয়েছে, চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে চললাম।

যা শুনেছিলাম, তা ভুল। খাল দুটো নয়, একটা। খেয়া নৌকোর ব্যবস্থা নেই। সরু খালের ওপর বাঁশের একটা সেতু আছে। দু’হাতে বাঁশ আঁকড়ে ধরে খাল পার হলাম।

তারপর একটা সরু পায়ে চলা পথ। দু’পাশে ঘোড়া নিম আর আশশ্যাওড়ার গাছ। জায়গাটা বেশ অন্ধকার।

মাইলকখানেক পথ পার হয়ে এসে পুবাই গাঁয়ে এসে হাজির হলাম।

ছোট্ট গ্রাম। একটা দোকান আর গোটা দশেক চালাঘর এই গ্রামের সীমানায়।

বরাত ভালই বলতে হবে। সর্বেশ্বরকে একেবারে বাড়ির দাওয়াতেই পেয়ে গেলাম। বসে বসে গাবের আটা দিয়ে জাল মাজছিল।

তার কাছে খোঁজ করতেই বাজখাঁই গলায় বলল, “আমিই সর্বেশ্বর জানা। বাবার নাম ঈশ্বর পতিতপাবন জানা। মশাইয়ের প্রয়োজন? “

প্রয়োজনের কথাটা তাকে শোনাতেই চমকে উঠল সর্বেশ্বর। এমন জানলে হয়তো জাঁক করে নিজের পরিচয়ই দিত না।

কাজ শেষ করে কোঁচার খুঁটে গাল, কপাল মুছে নিয়ে বললাম, “একটু জল খাওয়াতে পারেন?”

সর্বেশ্বর একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে।

তারপর বলল, “লোচনপুর থেকে আসবার সময় একটা খাল পার হয়ে এসেছেন না?”

ঘাড় নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ”।

সর্বেশ্বর বলল, “অনেক জল পাবেন সেই খালে। পেট ভরে চুমুক দিতে পারবেন।’’

অবস্থা দেখে আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। দাঁড়াতে সাহস হলো না। কিছু বলা যায় না, দলবল ডেকে এনে যদি লাঠির ঘায়ে এখানেই খতম করে মাটিতে পুঁতে দেয়, তাহলেও কেউ জানতে পারবে না।

কোর্টের পেয়াদার ভাগ্যে মারধোর হামেশাই জোটে। লোকজন ক্ষেপে উঠে আধমরা করে দেয়। একবারও ভাবে না, আমরা কর্মচারী মাত্র। আদেশ পালন করছি। শুধু নির্দেশ জারি করাই আমাদের কাজ।

বুঝতে পারলাম, এ গাঁয়ে ঠাঁই হবে না। ভেবেছিলাম, রাতটা কোথাও বিশ্রাম নিয়ে ভোর ভোর রওনা হব, কিন্তু তা হবার নয়।

একেবারে গাঁয়ে প্রবেশের মুখে যে দোকানটা দেখেছিলাম, সেখানে এসে দাঁড়ালাম।

দোকানী দোকানেই ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, “খাবার জিনিস কিছু পাওয়া যাবে?”

দোকানী নড়েচড়ে বসে বলল, “কি চাই বলুন কত্তা?”

চেয়ে দেখলাম, দুটো মুড়ির ধামা পাশাপাশি সাজানো। আরও গোটা কয়েক জার আছে, সবকটিই খালি।

দোকানীই আবার বলল, “মুড়ি আছে, পাটালিগুড় আছে”।

“আর কিছু? দুধ কিংবা কলা?”

“আজ্ঞে না, ওসব পাবেন না।”

নিরুপায়। মুড়ি আর পাটালিগুড় নিয়েই কাঠের বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। দু এক গাল মুখে দিয়েই বুঝতে পারলাম, মুড়িগুলো অন্তত এক সপ্তাহের বাসি আর পাটালিগুড় যে এত তেতো হয় কি করে, ভেবে কুলকিনারা পেলাম না।

খাওয়া শেষ করে, জল খেয়ে পয়সা দেবার মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে রাতটা কাটাবার জায়গা হবে? এই দোকানঘরের একপাশে একটু জায়গা পেলেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারব।”

কোনও উত্তর নেই দেখে মুখটা তুলেই শঙ্কিত হলাম।

দোকানী একদৃষ্টে আমার বুকের ওপর আটকানো পেতলের চাকতিটার দিকে দেখছে। যেটার ওপর কোর্টের নাম খোদাই করা আছে।

তাড়াতাড়ি আমার হাত থেকে পয়সা কটা কেড়ে নিয়ে দোকানী হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “না মশাই, থাকার জায়গা টায়গা হবে না। ছেলেপুলে নিয়ে থাকি, এখানে আপনি শোবেন কোথা?”

বললাম, “সন্ধে তো হয়ে গেল। তাহলে এখন যাই কোথা?”

দোকানী বলল, “এইবেলা স্টেশনের দিকে রওনা হয়ে পড়ুন। কতটা আর পথ। কলকাতা যাবার শেষ গাড়ি দশটা বত্রিশে। অনায়াসেই পেয়ে যাবেন।”

আমাকে আর কিছু বলার অবসর না দিয়ে দোকানী ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করল। যাতে দোকানের সামনে থেকে অন্তত সরে যেতে বাধ্য হই।

বুঝতে পারলাম, এ গাঁয়ে আশ্রয়ের কোনও আশা নেই। বুকে কোর্টের নামাঙ্কিত চাকতিটাই আমার কাল। কোর্টের পেয়াদাকে এরা সমনের শামিল বলে মনে করে।

ঠিক করলাম, স্টেশনেই চলে যাব। সত্যিই তো, আর কতটাই বা পথ। যেতে ঘন্টা দুই বা তিন লাগলেও হাতে অনেক সময় থাকবে।

অগত্যা লাঠিটা বাগিয়ে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। কোর্টের নামাঙ্কিত চাকতিটা খুলে নিয়ে পকেটের মধ্যে রেখে দিলাম।

চারদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। গাছপালার জন্য আরও ঝুপসি ঠেকছে। যাবার সময় দিনের আলোয় যে পথ মসৃণ, সরল মনে হয়েছিল, আধো অন্ধকারে সেই পথেই বারবার হোঁচট খেতে লাগলাম।

একটু পরে অন্ধকার ঘন হলো। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। চাঁদের দেখা নেই। তারাও নেই। ঝোপের ফাঁক থেকে শেয়াল ডেকে উঠল। হুক্কা হুয়া…হুক্কা হুয়া…..হুয়া….হুয়া…..।

শক্ত হাতে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। শেয়ালকে ভয় নেই। শেয়াল জ্যান্ত মানুষের কাছে ঘেঁষে না। কিন্তু এই জঙ্গলে আর কোনও হিংস্র জন্তু নেই তো? কোনও ভয়ানক জংলি জানোয়ার?

প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর খেয়াল হলো এতক্ষণে খালের পারে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল। বাঁশের সেতুর কাছ বরাবর। দুটো হাত আড়াআড়িভাবে চোখের ওপর রেখে চারদিক নিরীক্ষণ করলাম। এখনও অন্ধকার সূচিভেদ্য হয়ে ওঠেনি। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে আবছা আবছা দেখা যায়। চারদিকে গাছের জটলা। অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে গাছের পাতাগুলো শিরশির করে কাঁপছে।

আর কোনও সন্দেহ নেই। নিশ্চয় পথ হারিয়েছি। সম্ভবত জঙ্গলের মধ্যে একাধিক পায়ে চলা পথ আছে। অন্ধকারে ঠাহর হয়নি। একটা পথের বদলে আরেকটা পথ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করেছি।

এখন উপায়?

লাঠিটা ঠুকে চিৎকার করে বললাম, “কে আছ? আমি পথ হারিয়েছি। আমায় সাহায্য করো।”

একবার, দু’বার, তিনবার। চিৎকারে কোনও ফল হলো না। শুধু গাছের ডালে বিশ্রামরত কাকের দল কা-কা করে ঝটপট শব্দে উড়ে গেল।

কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। যেভাবেই হোক, এই জঙ্গল থেকে বেরোতেই হবে। নইলে রাত বাড়বে, আর এই জায়গাটাকে দেখে মোটেও নিরাপদ মনে হচ্ছে না।

সোজা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। গাছপালার যেন আর শেষ নেই। যত এগোই, জঙ্গল যেন ততই দুর্ভেদ্য হয়ে আসে।

পায়ের পাশ দিয়ে সরসর করে সরীসৃপগতিতে যেসব প্রাণী চলাফেরা করছে, সেগুলোর কথা ভেবে গলা কাঠ হয়ে এল আমার।

বেশ কিছুক্ষণ চলাফেরার পর মনে হলো, জঙ্গল যেন একটু ফিকে হয়ে এসেছে। চারদিকে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। অন্ধকারে জোড়া জোড়া জ্বলন্ত চোখ ঘোরাফেরা করছে। বুঝলাম, সে চোখের মালিক শেয়ালের দল।

জঙ্গল পার হয়ে এসে মনে একটু সাহস ফিরে এল আমার। ভাল করে চেয়ে দেখলাম, কোথাও এতটুকু যদি আলোর বিন্দু চোখে পড়ে। গ্রামের নিশানা।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা বিকট শব্দ এল।

“বলো হরি, হরিবোল……বলো হরি, হরিবোল…..বলো হরি……”

হিন্দুদের শবযাত্রা চলেছে কোথাও। সেই শব্দে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার।তবু এই ভেবে মনে আশ্বাস পেলাম যে, এই নির্জন জঙ্গলে আমি একলা নই। আরও লোক আছে। এই শবযাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেই সঠিক পথের হদিশ পাব।

হরিধ্বনি আরও কাছে আসতেই আমি পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। সেটাই নিয়ম। অনন্তপথের যাত্রীকে প্রথমে পথ দেওয়া উচিত।

লাঠিতে ভর দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।

অন্ধকারের বুক চিরে একটা মশাল এগিয়ে আসছে। একটু পরেই শববাহীদের দেখা গেল। সামনেপিছনে শুধু চারজন একটা খাটিয়াকে বহন করে নিয়ে চলেছে। সামনের ডান দিকের লোকটার হাতে মশাল। আর কারোর হাতে আলো নেই।

“শুনুন!”

কাতর কন্ঠে অনুরোধ জানালাম।

শববাহকরা থামল না, শুধু চলার গতি একটু মৃদু করল আর চারজনেই আমার দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল। আমি ভীতু, এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না, কিন্তু আমার মনে হল, আমার হাতের মুঠিটা আলগা হয়ে লাঠিটা বোধহয় পড়েই যাবে মাটিতে, সমস্ত শরীর অজানা একটা কিছুর আতঙ্কে কেঁপে উঠল।

চারজন লোকেরই ঠিক একরকম চেহারা। একইরকম দেখতে। মাথায় অবিন্যস্ত চুল, রক্তিম চোখ, এমনকি মুখে বসন্তের দাগ পর্যন্ত – অবিকল একরকম।

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শববাহকরা আবার ‘ বলো হরি, হরিবোল’ বলতে বলতে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

ক্রমে ওরা আমায় ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে গেল।

আর গোটা ব্যাপারটা নিয়ে আমার ভেতর উথালপাতাল হয়ে যেতে লাগল। দুজনের চেহারায় এইরকম সাদৃশ্য থাকলে অস্বাভাবিক কিছু মনে হতো না আমার। ভাবতাম, তারা যমজ ভাই। কিন্তু চারজনের মুখ এবং চেহারা হুবহু একরকম হয় কি করে।

মনের মধ্যে অলৌকিক যে প্রসঙ্গ উঁকি দিচ্ছিল, নিজেকে ধমক দিয়ে অনেক কষ্টে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমারই চোখের ভুল এসব। মনের মধ্যে একটা অলৌকিক ভয় বাসা বেঁধে ছিল, মশালের আলোয় ক্ষণিকের দেখায় আমার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছিল।

নিজেকে সাহস দেবার জন্য চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করলাম। বেসুরো, বেতালা। কিন্তু পরমূহুর্তেই আবার সেই ‘বল হরি, হরিবোল’ বিকট ধ্বনিতে চমকে থেমে গেলাম।

মনে হলো, এবার শব্দটা যেন আমার পাশ থেকে উঠছে। অথচ শববাহকের দল ততক্ষণে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। তাদের চিৎকার এত কাছ থেকে শ্রুতিগোচর হবার তো কথা নয়!

মনের মধ্যে আবার একটু অস্বস্তি শুরু হলো। কিন্তু এভাবে চুপচাপ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তাই জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

লক্ষ্য করিনি, এরইমধ্যে কখন যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। ছুরির ফলার মতো বিদ্যুতের শানিত স্ফুরণ। দমকা ঝড় উঠল। সেই ঝড়ের এমন বেগ যে পথচলাই দুষ্কর হয়ে পড়ল।

ঝড়ে বনের গাছগুলোর মর্মর ধ্বনি কানে এসে বাজতে লাগল আর আমার বুকের রক্ত সেই শব্দে যেন তুহিন শীতল হয়ে যেতে লাগল।

হঠাৎ ঝড়ের মাতন আর গাছপালার মর্মরধ্বনি ছাপিয়ে আবার সেই চিৎকার। এবারে যেন একেবারে আমার কানের সামনে। ‘বল হরি, হরিবোল….বল হরি, হরিবোল…..’

কিন্তু চমকে পাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। শবযাত্রীদের দল সামনে কতদূর এগিয়ে গেছে, কে জানে! কিন্তু কানের পাশে এখনো তাদের সেই ধ্বনি চলছে!

বুঝলাম, চিন্তা করে লাভ নেই। চিন্তা করে এর জট ছাড়ানো যাবে না। রহস্য যাই হোক, যেভাবেই হোক আমায় প্রাণে বাঁচতে হবে। কোনওরকমে একটা লোকালয়ে গিয়ে পৌঁছতেই হবে আমায়।

বড় বড় বৃষ্টির ফলা সারা গায়ে যেন হুল ফোটাতে লাগল। ছুটতে আরম্ভ করলাম। লাঠিটা প্রাণপনে বগলে চেপে।

জানি না বোধহয় আধ মাইলেরও বেশী একটানা দৌড়েছি। হিসেব রাখিনি। হঠাৎ আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখলাম, পথের পাশে যেন একটা চালাঘর।

মনে মনে ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে চালাঘরে আশ্রয় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, অন্তত প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। এমনও হতে পারে, চালাঘরে আরও কোনও লোকের সাক্ষাৎ মিলবে।

অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে দেখলাম, এটা চালাঘর নয়, শুধু চালা। তিনদিক আচ্ছাদিত, একদিক খোলা। বোধহয় রোদের তাপ বা বৃষ্টির ছাঁট থেকে পথচারীকে বাঁচাতেই এটা তৈরি হয়েছিল।

আস্তে আস্তে এগোতে গিয়ে থেমে গেলাম।

আকাশে আঁকাবাঁকা হয়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল আর সেইসঙ্গে কড়কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল। কিন্তু সেই বিদ্যুতের আলোয় এবার আরও পরিষ্কার দেখলাম। আরও কাছ থেকে দেখলাম।

শবের খাটিয়াটা রেখে সেই চারজন শববাহক দাঁড়িয়ে আছে। সারি দিয়ে। হুবহু এক চেহারা। একইরকম দেখতে। সেই অবিন্যস্ত দাড়িগোঁফের জঙ্গল, রক্তাভ দুটি চোখ, মাথার চুল উস্কোখুস্ক।

আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সেই চারজন একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। শিকারকে যেন কুক্ষিগত করে ফেলেছে, এমন একটা উৎকট পৈশাচিক উল্লাসে। লাঠিটা বজ্রমুষ্টিতে ধরে পাষাণের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম এক জায়গায়। নিঃসন্দেহ হলাম, এই হাসি মোটেও স্বাভাবিক নয়। রক্তমাংসের কোনও মানুষ এভাবে হাসতে পারে না। অশরীরী আত্মার বীভৎস হাসি।

আমাকে আবার আতঙ্কিত হতে দেখে সেই চারজনের একজন খনখনে গলায় বলল, “আপনি এইহানে একটু লাশের কাছে থাইকেন। আমরা যাচ্ছি জঙ্গল থেইক্যা কাঠ কাইটতে।”

কোনওরকমে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস রোধ করে বললাম, “আপনারা সবাই যাবেন?”

আবার সেই রক্তজল করা হাসি।

উত্তর এল, “আমরা যেইহানে যাই, একসঙ্গেই যাই।”

যাবার আগে লোকগুলো মশালটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।

বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে তখনও শুধু বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন।

আড়চোখে একবার খাটিয়ায় শোয়ান মড়াটার দিকে চাইলাম আমি। সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা। মশালের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আচমকা দমকা হাওয়ায় শবের মুখের আবরণ সরে গেল। আমি একবার সেদিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠলাম।

সেই একইরকম মুখ। চুল, গোঁফদাড়ি, মুখ, চেহারা – কোথাও এতটুকু প্রভেদ নেই। এমনকি মুখে বসন্তের দাগটা পর্যন্ত আছে।

দুহাতে চোখ রগড়ে নিলাম। এ’ও কি সম্ভব? সেই চারজন শববাহক আর খাটিয়ায় শোয়ানো এই মড়ার মধ্যে এতটুকু প্রভেদ নেই! সবার এক চেহারা!

বুকের স্পন্দন দ্রুততর হলো। লাঠিটা যে হাতে শক্ত করে ধরব, সেই ক্ষমতাটুকুও রইল না আমার। এরপর যা ঘটল, তা অবর্ণনীয়।

চোখ মেলে তাকাল শব। রক্তিম দুটো চোখ। প্রথমে তার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল তিরতির করে, তারপর খনখনে গলা ভেসে এল তার। শোয়া অবস্থা থেকে একটু উঠে বসার মতো করে উঠে সে বলতে লাগল :

“ঠিকই ভেবেছ। আমরা পাঁচজন একই লোক। কোনও তফাত নেই। বসন্ত রোগে মারা গিয়েছিলাম বলে প্রতিবেশীরা কেউ ভয়ে পোড়াতে এলো না। তাই বলে কি আমার সৎকার হবে না? তাই নিজের দেহ থেকেই চারজন বাহক সৃষ্টি করলাম। তারাই বয়ে নিয়ে এলো শ্মশানে। কেমন বুদ্ধি বের করলাম, বলো দেখি?”

বলেই খনখনে গলায় হেসে উঠল সেই জ্যান্ত মড়া।

তারপর আর আমার জ্ঞান ছিল না।

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি সকাল হয়ে গেছে। পথের একপাশে আমি কর্দমাক্ত দেহে পড়ে আছি। পরনের পোশাক ছিন্নভিন্ন। জেলেরা আমার মুখেচোখে জল দিচ্ছে, বাতাস করছে।

একটু সুস্থ বোধ করে ধীরেধীরে উঠে বসলাম। চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চালাঘরটা আছে কিন্তু এখন শূন্য। রাতের বিভীষিকা কোথাও নেই।

আস্তে আস্তে জেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করলাম, “লোচনপুর স্টেশন এখান থেকে কতদূর?”

তাদের একজন বলল, “লোচনপুর? সে তো এখান থেকে পাক্কা দশ মাইল। একেবারে উল্টোপথ।”

জিজ্ঞেস করলাম, “এ জায়গাটার নাম কি?”

“এ জায়গাটাকে বলে পাঁচ মুন্ডীর আসর।”

পাঁচ মুন্ডীর আসর? চমকে উঠলাম।

“হ্যাঁ গো কত্তা। এক রকমের পাঁচজন তেনাদের দেখা যায়। পথ ভুলিয়ে মানুষকে এখানে নিয়ে আসে। তারপর সাবাড় করে দেয়। কত লোক যে সন্ধের মুখে জঙ্গলে পথ হারিয়ে একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেছে , আর তাদের কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার ঠিক নেই। তুমি দেখছি বামুন মানুষ, তাই বোধহয় বেঁচে গেলে।”

ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে আমার গলার পৈতেটা দেখা যাচ্ছিল। শক্ত করে পৈতেটাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম। রোজ গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করি, তারই জোরে গত রাতে…নইলে বোধহয় আর রক্ষা ছিল না।

এ কাহিনী অনেককে বলেছি, কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেনি, তারাও এমনকি রাতের বেলা পুবাই গাঁ থেকে পশ্চিমমুখো রাস্তা ধরে পাঁচ মুন্ডীর আসরের দিকে আসতে কোনওদিন রাজি হয়নি। আমাকে যদি কেউ এক থলি আকবরী মোহর দেয়, তবু আমি ওপথে আর জীবনে যাব না।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত