ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

ক্রস এবং ক্রিসেন্ট

ডোনা তার আব্বার কোল থেকে মুখ তুলল।

অশ্রু ধোয়া তার মুখ।

কিন্তু চোখে তার অনেকটা লড়াকু ও বেপরোয়া দৃষ্টি।

তার এই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল এলিসা গ্রেসদের উপর। তাদের চোখ-মুখের বিস্ময়ভাবের দিকে চেয়ে ডোনা বলল, ‘আপনারা ভাবছেন, আহমদ মুসার কথা বলে কাঁদছি কেন? ভাবছেন, ওমর বায়ার নাম জানলাম কি করে?’

একটু থেমে একটা ঢোক গিলে নিয়ে ডোনা বলল, ‘আহমদ মুসা আমার সব, আমার জীবন। আর তার কাছেই আমি ওমর বায়ার নাম শুনেছি। তিনি ওমর বায়াকে উদ্ধার করতেই সেইন্ট পোল ডে লিউন-এ এসেছিলেন।’

বলে ডোনা উঠে দাঁড়াল এবং এলিসা গ্রেস ও পিয়েরাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল। তারপর লুই ডোমাসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন। দেখুন, এখানে কোন রাজা-প্রজা নেই, আমরা সবাই সমান। বসুন আপনি।’

পিয়েরা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং ডোনাকে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘এখানে রাজা-প্রজা নেই ঠিক, কিন্তু রাজা-প্রজার পরিচয় মিথ্যা হয়ে যায়নি, সময়ের পরিবর্তনে রক্ত পাল্টে যায় না।’

ডোনাকে বসিয়ে দিয়ে লুই ডোমাসের দিকে চেয়ে পিয়েরা বলল, ‘তুমি এস, বিছানায় বস।’

বলে পিয়েরা এলিসা গ্রেসের পাশে গিয়ে বসল।

লুই ডোমাসও বিছানার এক প্রান্তে গিয়ে বসল।

এলিসা গ্রেস, পিয়েরা, লুই ডোমাস তিনজনের চোখেই ডোনাকে ঘিরে একটা নতুন দৃষ্টি, মনে চিন্তার নতুন স্রোত। ডোনার ঋজুতা ও স্পষ্টবাদিতায় তারা মুগ্ধ। ডোনা ও আহমদ মুসার প্রতি তাদের মন নুয়ে পড়ল অফুরান ভালোবাসা এবং ভক্তিতে।

তারা বসতেই ডোনা বলল, ‘গত চারদিন ধরে আহমদ মুসার কোন খবর পাইনি। তাই ছুটে এসেছি আমরা প্যারিস থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, খুব কাছে এসেও দেখা পেলাম না।’

কণ্ঠটা কেঁপে উঠল ডোনার। থামল সে। একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, ‘তবু আমরা খুশি এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনাদের দেখা পেয়েছি, যারা তার সাথী ছিলেন।’

আবার থামল ডোনা। এলিসা গ্রেসদের দিকে গভীরভাবে তাকাল এবং বলল, ‘এখন দয়া করে কি ঘটেছে বলুন?’ পিয়েরা এবং লুই ডোমাস দু’জনেই এলিসা গ্রেসের দিকে তাকাল। পিয়েরা বলল, ‘এলিসাই সব বলবে। আহমদ মুসা সম্পর্কে শুরুর যেটুকু ঘটনা আমি বলছি।’ একটু থামল পিয়েরা।

তারপর শুরু করল, ‘আমার নামটাই বলা হয়নি। আমি পিয়েরা পেরিন।’

একটু থেমে লুই ডোমাসকে দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো লুই ডোমাস। আমার বন্ধুর চেয়েও বড়। এলিসার অনুরোধে ওমর বায়ার অভিযানে আমি জড়িয়ে পড়ি। লুই ডোমাস আমাকে স্বতস্ফূর্তভাবে সাহায্য করে।’ আবার থামল পিয়েরা।

চোখটা একটু নিচু করল। যেন ভাবল এবং গুছিয়ে নিল কথা। তারপর শুরু করল, ‘ব্ল্যাক ক্রস-এর হেডকোয়ার্টার সংলগ্ন তাদেরই নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টের সামান্য পরিচারিকা আমি। খদ্দের হিসেবে আহমদ মুসা আমাদের রেস্টুরেন্টে আসেন।’

তারপর কিভাবে আহমদ মুসার খাওয়া, আচার-আচরণ পিয়েরা পেরিন-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, কিভাবে গতকাল এগারটার দিকে পিয়েরা আহমদ মুসার টেবিলে গিয়ে আহমদ মুসার পরিচয় জানতে পারে এবং তাকে ব্ল্যাক ক্রসের হেডকোয়ার্টারের পরিচয় বলে, কিভাবে একজন ব্ল্যাক ক্রসের নেতৃস্থানীয় লোককে দেখিয়ে দেয়, কিভাবে আহমদ মুসা তাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে যায় এবং আবার ফিরে আসে এবং আহত হয়ে ব্ল্যাক ক্রসের হাতে বন্দী হয়- সব কথা পিয়েরা পেরিন বলল ডোনাকে।

শুনতে শুনতে ডোনার মুখ মলিন এবং চোখ ছলছলে হয়ে উঠেছিল। পিয়েরা থামতেই ডোনা বলল, ‘খুব বেশি আহত হয়েছিলেন উনি?’ ডোনার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘খুব বেশি না হলেও তার মাথার এক পাশের চামড়া উঠে গিয়েছিল। রক্তে তার মুখের একপাশ এবং শরীরের একটা দিক প্রায় ভিজে গিয়েছিল।’ বলল পিয়েরা পেরিন।

‘কোন চিকিৎসা হয়নি, না?’ দু’হাতে চেয়ারের দু’টি হাতল আঁকড়ে ধরে মাথাটা চেয়ারে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল ডোনা।

‘ঐ অবস্থায় তাকে ধরে নিয়ে গেছে। ব্ল্যাক ক্রস-এর অভিধানে তার শত্রুর জন্যে হত্যা-নির্যাতন-নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু লেখা নেই।’ বলল পিয়েরা।

ডোনা কোন কথা বলল না। চোখও খুলল না সে।

পিয়েরাই বলল আবার, ‘কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি, মাথায় অতবড় আঘাত পাওয়ার পরও তার মুখে বেদনার সামান্য ভাঁজও পড়েনি কিংবা বন্দী হবার সময় ভয়-বিহ্বলতার বিন্দুমাত্র চিহ্নও তার চোখে-মুখে আমি দেখিনি।’

‘নিজের ভালো চিন্তা করলে, তবেই তো কারো মনে তার মন্দ চিন্তা নিয়ে ভয় জাগবে। উনি সবার ভালো নিয়ে ভাবেন নিজেরটা ছাড়া।’ চোখ খুলে বলল ডোনা। বলতে গিয়ে তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল যা কান্নার চেয়েও করুণ।

বলে একটু থেমেই এলিসা গ্রেসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি বলুন।’

‘গত রাতটা ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় রাত। এই রাতেই আমি ওমর বায়াকে নিয়ে পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তখন রাত আড়াইটা কিংবা তার কিছু বেশি হবে। আমি লিটলকে পালাবার পথ টাওয়ারের বেজমেন্টে পাঠিয়ে দিয়ে…।’

কান্নায় আটকে গেল এলিসা গ্রেসের কথা।

অল্পক্ষণ পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন, ‘লিটল’-এর জন্যে দুনিয়াতে কাঁদার কেউ নেই। আমাকে এবং ওমর বায়াকে সাহায্য করতে গিয়ে নির্মমভাবে নিহত হলো সে। ওমর বায়াকে সাহায্য করার পেছনে আমার স্বার্থ ছিল, ওমর বায়া আমার মাতৃধর্মের লোক এবং আমি অভিনয় করতে গিয়ে ওকে ভালোবেসে ছিলাম। কিন্তু ‘লিটল’-এর তিলমাত্র কোন স্বার্থ ছিল না। সে মিঃ বেনহামকে দু’চোখে দেখতে পারতো না। সে মনে করতো, আমাকে দিয়ে ওমর বায়ার কাছ থেকে কাজ উদ্ধার করার পর আমাদের দু’জনকেই মেরে ফেলবে। এই চিন্তা থেকেই সে নিজে একদিন আমার কাছে প্রস্তাব করল, ওমর বায়া এবং আমার পালানো উচিত। সে সাহায্য করবে। জেটি হয়ে সমুদ্রপথে পালাবার গোপন পথটির সন্ধান সে-ই আমাদের দিয়েছিল। তার সাহায্য ও সাহস না পেলে পালাবার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না।’ থামল এলিসা গ্রেস।

চোখ মুছে শুরু করল আবার, ‘‘লিটল’কে পাঠিয়ে আমি এবং ওমর বায়া বাইরের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে লিটলের সংকেতের অপেক্ষা করছিলাম। বাংলোর প্রাচীরের গেট থেকে গোটা চত্বর আমাদের চোখের সামনে ছিল।

হঠাৎ দেখলাম, স্টেনগান ও লাইট মেশিনগান সজ্জিত সাত-আটজনের একটা দল আমার বাংলোর সামনে এসে অবস্থান নিল। দেখে ভয়ে ও হতাশায় আমার ভেঙে পড়ার দশা। আমি ভাবলাম, হয় ‘লিটল’ ধরা পড়ে গেছে, না হয় অন্য কোনভাবে আমাদের প্ল্যান তারা জানতে পেরেছে। ব্ল্যাক ক্রস-এর ভয়ংকর মূর্তি আমি মনে মনে কল্পনা করলাম। কাঁপতে শুরু করেছিলাম আমি।

এই সময় দেখলাম, ব্ল্যাক ক্রস-এর গার্ডের পোশাক পরা একজন লোক এগিয়ে আসছে। তার মাথায় ব্ল্যাক ক্রস-এর গার্ডদেরই হ্যাট। ঠিক এ সময়েই আরও কয়েকজন লোক গেট দিয়ে আমাদের চত্বরে প্রবেশ করল। তাদের দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তারা সকলেই ব্ল্যাক ক্রস-এর গার্ড।

যে লোকটি একা এগিয়ে আসছিল, সে একবার পেছনে তাকিয়েই শরীরটাকে সামনের দিকে একটু বাঁকিয়ে স্টেনগানের গুলি ছুঁড়ল আমার বাংলোর সামনে বসা লোকদের লক্ষ্য করে।

গুলি করেই চোখের পলকে গড়িয়ে এসে উঠল আমাদের বারান্দায়। আসার সময় যারা ব্রাশফায়ারে মারা গিয়েছিল, তাদের লাইট মেশিনগানও নিয়ে এসেছিল।

যারা গেট থেকে এগিয়ে আসছিল, তারা গুলির শব্দ হবার সাথে সাথেই শুয়ে পড়েছিল এবং ক্রলিং করে এদিকে এগিয়ে আসছিল। তারা কাছাকাছি এগিয়ে এলে তারাও আমার বারান্দায় উঠে আসা লোকটির লাইট মেশিনগানের শিকারে পরিণত হলো।

ঠিক এই সময় দশ-বারো জনের আরেকটি বড় দল গেট দিয়ে প্রবেশ করল।

পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু দেখছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, কে কাকে মারছে। কিন্তু ভাবছিলাম, কিছু একটা করা দরকার। তাছাড়া আজ পালাতে না পারলে আর সুযোগ নাও আসতে পারে বুঝতে পারছিলাম।

অনেকটা মরিয়া হয়েই পিস্তল বাগিয়ে বাইরে গেলাম। লোকটি স্টেনগান বাগিয়ে বসেছিল গেটের দিক থেকে যারা এগিয়ে আসছিল সেদিকে লক্ষ্য করে।

আমি তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে আপনি? কোন পক্ষের?’

লোকটি স্টেনগান ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস-এর লোককে মারছি দেখেও যখন এতক্ষণ আমাকে গুলি করেননি, তখন আমি আপনার পক্ষের।’

তার মুখে ভয় কিংবা বিস্ময়ের বা অপ্রস্তুতির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। ঠোঁটে এক টুকরো নিষ্পাপ হাসি।

হঠাৎ আমার মনে হলো, এমন লোক আহমদ মুসা না হয়ে যায় না। ওমর বায়ার কাছে আহমদ মুসার কথা শুনেছিলাম, আরও শুনেছিলাম, শুধু আহমদ মুসাই আসতে পারে তাকে উদ্ধার করতে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি আহমদ মুসা?’

এরপরই ওমর বায়া বেরিয়ে এল। জড়িয়ে ধরল দু’জন দু’জনকে।’

থামল এলিসা গ্রেস।

তারপর এলিসা ধীরে ধীরে কি করে আহমদ মুসা গেটের দিক থেকে অগ্রসরমান লোকদের লাইট মেশিনগান দিয়ে চত্বরের বাইরে তাড়িয়ে দিল, কিভাবে লাইটের বাল্বগুলো নষ্ট করে তাদের টাওয়ারের বেজমেন্টে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে দিল, কি করে আহমদ মুসা বেজমেন্টে এবং জেটিতে নামার সিঁড়িতে একা মেশিনগান নিয়ে বসে ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের ঠেকিয়ে রেখে এলিসা গ্রেস ও ওমর বায়াদের যাবার পথ নিরাপদ করেছিল, কি অলৌকিকভাবে জেটির দরজা চোখের নিমেষে খুলে দিয়েছিল, কিভাবে এই দরজায় ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকদের ঠেকিয়ে রেখে এলিসা গ্রেসদের বোটে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল, কি অবিশ্বাস্যভাবে ‘লা আটলান্টিক’ রেস্টহাউসে ব্ল্যাক ক্রসের আক্রমণকে সে একাই ঠেকিয়েছিল- সবকিছু বর্ণনা করে বলল, ‘গত রাতেই ব্ল্যাক ক্রস-এর তিরিশ জন লোক আহমদ মুসার হাতে নিহত হয়েছে। কি ধরনের ভয়াবহ সংঘাত হয়েছে আপনি চিন্তা করে দেখুন।’

ডোনা চোখ বন্ধ করে বাম হাতের উপর মুখ ঠেস দিয়ে কথা শুনছিল। তার দৃষ্টিতে গভীর শূন্যতা। বলল, ‘ওর জীবনে এমন সংঘাত কিছুই নয়। ব্ল্যাক ক্রস-এরই প্রায় সাড়ে তিন ডজন লোক নিহত হয়েছে ওর হাতে এই রাতের আগে।’ তার কণ্ঠ অনেকটা স্বগতোক্তির মত।

একটু থামল। তারপর আবার বলল, ‘ওর আহত স্থানের কোন চিকিৎসা হয়নি, না?’ ভেজা কণ্ঠস্বর ডোনার।

‘না রাজকুমারী, ‘লা আটলান্টিক’ রেস্টহাউসের লবির আলোতেও আমি ওর মুখে ও মাথার চুলে রক্তের দাগ দেখেছি। তারপর আর খেয়াল করিনি।’

ডোনা আবার চোখ বুজল। তার মুখজুড়ে রাতের অন্ধকার।

‘ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করে ব্ল্যাক ক্রস কোথায় নিয়ে যেতে পারে? সেইন্ট পোল ডে লিউন-এর হেডকোয়ার্টারে?’ বলল ডোনার আব্বা।

‘না, জনাব। আমি শুনেছি, ব্ল্যাক ক্রস-এর কোন অফিস বা আস্তানায় শত্রুর পা পড়লে সে অফিস বা আস্তানা তারা সংগে সংগেই পরিত্যাগ করে।’ বলল পিয়েরা পেরিন।

‘নিশ্চয় সেইন্ট পোল ডে লিউন-এ ওদের আরও আস্তানা আছে?’ ডোনার আব্বাই আবার জিজ্ঞেস করল।

‘জনাব, আমার তা জানা নেই।’ বলল পিয়েরা।

‘আমাদের এখন কি করণীয়? আমি ও পিয়েরা ব্ল্যাক ক্রস-এর সন্দেহের মধ্যে এখনও আসিনি। আমাদের বাসা সেইন্ট পোল ডে লিউন-এ। আমরা এলিসাকেও নিয়ে যেতে পারি।’ ডোনার আব্বার দিকে চেয়ে বলল লুই ডোমাস।

‘আমার মতে, আহমদ মুসার কোন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত যে যেমন আছি সেভাবে রেস্টহাউসেই থাকা উচিত।’ বলল ডোনা।

একটু থামল, একটু ভাবল ডোনা। তারপর আবার বলল, ‘আহমদ মুসার অতিথি বা আশ্রয়ে ছিল এলিসা। আহমদ মুসা কোন নতুন সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত এলিসা গ্রেস আমার অতিথি। তার সব দায়িত্ব আমার। আপত্তি নেই তো?’

বলে ডোনা এলিসা গ্রেস, পিয়েরা, লুই ডোমাস সবার দিকে তাকাল।

এলিসা গ্রেস-এর চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার চিহ্ন ফুটে উঠল। সে মাথা নিচু করল। কিন্তু মুখ খুলল পিয়েরা। বলল, ‘সম্মানিতা রাজকুমারী, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু শুধু এলিসা গ্রেসেরই কি এ সৌভাগ্য হলো?’

‘না, আপনারা সবাই আমার অতিথি। আমি বিশেষভাবে এলিসা গ্রেসের নাম করেছি মাত্র।’

‘ধন্যবাদ।’ পিয়েরা বলল।

‘ওয়েলকাম।’ বলল ডোনা।

‘সম্মানিতা রাজকুমারী, আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?’ দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল পিয়েরা।

‘অবশ্যই।’ বলল ডোনা।

‘আমাদের রাজকুমারীর মাথায় ওড়না কেন? টিভিতে দেখেছি, এ ধরনের ওড়না মৌলবাদী মুসলিম মেয়েরা পরে।’

‘কেন পরেছি বলুন তো?’ বলল ডোনা। তার ঠোঁটে হাসি।

‘আমাদের বিস্ময় লাগছে, তাই তো জিজ্ঞেস করছি।’

‘আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।’

‘আপনি বুরবোঁ রাজকুমারী ইসলাম গ্রহণ করেছেন!’ পিয়েরার কণ্ঠে বিস্ময়।

‘কেন, বুরবোঁ রাজকুমারী ইসলাম গ্রহণ করতে পারে না?’

‘ফরাসীদের কাছে এটা বিস্ময়ের হবে।’

‘শুধু এটাই কি বিস্ময়ের হবে? এটা কি বিস্ময়ের হবে না যে, নিশ্চয় ইসলাম আরও বড় বিস্ময়ের?’

‘তাও হবে। অনেককে ইসলামের ব্যাপারে অনুসন্ধিৎসুও করে তুলবে।’

‘আপনার এবং এলিসার মাতৃধর্ম ইসলাম। আপনারা তো পক্ষে কিছু বলবেনই। মিঃ ডোমাস, আপনার মত কি?’ বলল ডোনা।

লুই ডোমাস ডোনাকে একটা বাউ করে একটু নড়ে-চড়ে বসে বলল, ‘আপনি সত্য বলেছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না।’

‘কেন?’

‘সভ্য পাশ্চাত্যের একটি শীর্ষ পরিবারের মেয়ে অসভ্য প্রাচ্য দেশের ধর্ম গ্রহণ করবে, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

‘ভুলে যাবেন না, খৃস্টধর্মও ‘অসভ্য প্রাচ্য’ দেশের। যিশুখৃস্ট একটি ‘অসভ্য’ প্রাচ্য দেশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেখানেই বড় হয়েছিলেন, ধর্ম প্রচার করেছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।’

‘আমিও শুনেছি।’

‘তাহলে?’

‘কিন্তু ইসলাম প্রাচ্য দেশের ধর্ম বলেই পরিচিত, আর খৃস্টধর্ম পাশ্চাত্যের।’

‘পাশ্চাত্য গ্রহণ করলেই তা পাশ্চাত্যের ধর্ম হয়ে উঠবে।’

‘কিন্তু পাশ্চাত্য এককভাবেই বলা যায় খৃস্টধর্মের দখলে।’

‘সত্যিই কি তাই? তাহলে শত শত গীর্জা আজ অব্যবহৃত বা পরিত্যক্ত কেন? শত শত গীর্জা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কেন?’

‘মানুষের ক্রমবর্ধমান ধর্মহীনতার কারণেই এটা ঘটছে।’ কারণ দেখাল ডোমাস।

‘ঠিক ধর্মহীনতা নয়, যারা গীর্জায় যাচ্ছে না, তারা কিন্তু নিজেদের খৃস্টানই বলছে। আসল কথা হলো, সময়ের প্রয়োজন মেটাবার মত কিছুই নেই খৃস্টান ধর্মে।’

‘সময়ের এই প্রয়োজনের অর্থ?’

‘পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত বিধিবিধান যা প্রাত্যহিক জীবন-পরিচালনায় প্রয়োজন।’ বলল ডোনা।

‘এসব প্রয়োজন কি ধর্মকেই পূরণ করতে হবে?’

‘তা না করলে ধর্ম মানুষের জীবন পরিচালনা করবে কি করে? ধর্মকে গীর্জায় রেখে জীবনের সব ক্ষেত্রে অধর্মের রাজত্ব চলতে দিলে ধর্মজীবন আর থাকে না। এই কারণেই আমাদের পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মহীনতা বাড়ছে।’

‘আবার উত্থানও তো ঘটছে।’

‘ঘটছে। কিন্তু সেটা একটা রাজনৈতিক রূপ। ব্ল্যাক ক্রস-এর মত যে সব খৃস্টান ধর্মের সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করছে, দেখবেন তাদের জীবনাচরণে কোন ধর্ম নেই।’

‘ঠিকই বলেছেন। ব্ল্যাক ক্রস-এর নেতৃবৃন্দের কাউকে গীর্জায় যেতে দেখিনি। ধর্মভীরু লিটলের তাদেরকে ঘৃণা করার একটা বড় কারণ ছিল এটা।’ বলল এলিসা।

‘যা খৃস্টান ধর্মে নেই, সেই জীবনযাপন প্রণালী কি ইসলামে আছে?’

‘আছে এবং এ কারণেই ইসলাম জীবন্ত ও পূর্ণ ধর্ম। ইসলামের প্রতি আমার আকৃষ্ট হবার কারণ এটাই।’ বলল ডোনা।

দরজায় নক করার শব্দ হলো, ডোনার কথা শেষ করার সাথে সাথেই।

ডোনা একবার তাকাল তার আব্বার দিকে। তারপর উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ডোনা তার হাত দিয়ে পকেটের রিভলভার একবার স্পর্শ করল।

দরজা খুলে দিল ডোনা।

দরজায় দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ অফিসার।

‘গুড মর্নিং।’ বলল ডোনা।

‘গুড মর্নিং।’ বলল পুলিশ অফিসারটিও। মুখে সে শব্দ ক’টি বললেও তার চোখ একবার গোটা কক্ষে ঘুরছিল।

তার চোখ গিয়ে আটকে গেল ডোনার আব্বা মিশেল প্লাতিনীর মুখে।

প্রথমে বিস্ময়! তারপর আনন্দ মিশ্রিত শ্রদ্ধা নেমে এল তার চোখে।

সে দু’ধাপ সামনে এগিয়ে মাথা নুইয়ে বাউ করল মিশেল প্লাতিনীকে। বলল, ‘স্যার, আপনিই এখানে উঠেছেন বুঝতে পারিনি।’

‘ওয়েলকাম।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে মিশেল প্লাতিনী হ্যান্ডশেকের জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিল।

পুলিশ অফিসার দ্বিধাগ্রস্থভাবে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল।

ডোনার আব্বা তাকে ডোনার চেয়ারটা দেখিয়ে দিল বসার জন্যে।

কিন্তু পুলিশ অফিসারটি বসল না। বলল, ‘মাফ করুন স্যার। আমরা দারুণ বিপদে। গত কয়েকদিনের ঘটনা আমাদের দিশেহারা করে তুলেছে। একের পর এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আজকের ঘটনা সে রকমই একটা হত্যাকাণ্ড। নিহত ও আহতদ্বয় যখন রেস্টহাউসে এসেছিলেন, সেই সময় লুই ডোমাস নামের একজন যুবকও রেস্টহাউসে আসেন। খবর পেলাম, তিনি এখানে এসেছেন। তার কাছে কোন সাহায্য পাওয়া যায় কিনা, এ জন্যেই আপনাদের বিরক্ত করছি। দুঃখিত।’ কথা শেষ করে পুলিশ অফিসারটি তাকাল লুই ডোমাসের দিকে।

‘আমিই লুই ডোমাস।’ লুই ডোমাস মাথা খাড়া করে বলল।

‘আপনি কি কোন সাহায্য করতে পারেন?’

‘কি সাহায্য?’

‘নিহত ও অপহৃতদের পরিচয় কি?’

‘দুঃখিত, তারা কেউ আমার পরিচিত নন।’

উত্তর দিয়ে একটু থেমেই লুই ডোমাস পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘ওদের পরিচয়ের চেয়ে এখন তো জরুরি খুনিদের পরিচয় বের করা?’

‘ঠিকই বলেছেন।’ বলে হাসল পুলিশ অফিসারটি। তারপর মিশেল প্লাতিনীর দিকে চেয়ে সশ্রদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘মাফ করবেন স্যার। বিরক্ত করলাম।’ বলে সে ফিরে দাঁড়াতে চাইল ঘর থেকে বের হওয়ার জন্যে।

‘লুই ডোমাস যে কথা বলল, তাতে খুনিদের পরিচয় কিছু জানতে পেরেছেন অফিসার?’

পুলিশ অফিসার ফিরে না দাঁড়িয়ে স্থির হলো। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল মিশেল প্লাতিনীর দিকে। কিন্তু কিছু বলল না।

মুহূর্ত কয়েক পরে বলল, ‘জানতে পারিনি বললে ভুল হবে স্যার।’

‘কারা সে খুনি?’

পুলিশ অফিসার একবার লুই ডোমাসদের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আপনার কিছুই অজানা থাকবে না স্যার। এখানে খুনি ব্ল্যাক ক্রসের লোকেরা।’

‘ও, শক্তিমান খুনি।’ বলল মিশেল প্লাতিনী।

‘শক্তিমান স্যার। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার স্যার, তারা ইদানিং অবিরাম মার খেয়েই চলেছে। গত কিছুদিনের কথা বাদ দিলাম, আজ রাতেই ওদের তিরিশ-চল্লিশজন লোক মারা গেছে এবং মনে হচ্ছে, ওদের হেডকোয়ার্টারটাই ধ্বংস হয়ে গেছে আজ রাতে।’

একটু থামল পুলিশ অফিসার। বলল আবার, ‘বিস্ময়ের ব্যাপার, মারা গেছে সব ব্ল্যাক ক্রসের লোক, তাদের প্রতিপক্ষের একজন লোকও মারা যায়নি। এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। মাত্র রেস্টহাউসের এই একটি ঘটনায় মারা গেল একজন ব্ল্যাক ক্রসের হাতে। সুতরাং এই নিহতের পরিচয়টা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো তার পরিচয়ের সূত্র ধরে আজকের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের এবং অতীতের হত্যাকাণ্ডগুলোর খুনিপক্ষ কারা তা জানা যেত।’

‘ব্ল্যাক ক্রসের চেয়ে শক্তিশালী কিংবা ব্ল্যাক ক্রসকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন কেউ এদেশে আছে নাকি? আপনি কি মনে করেন, অফিসার?’ বলল মারিয়ার আব্বা।

‘এ বিষয়টাই আমাদের বিস্মিত করেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্ত ভেবে কোন কূল পাচ্ছি না আমরা। শুনলাম, পাশের রেস্টহাউসের আরেকজন যুবক ঘটনার সময় থেকেই নেই। যা জানা গেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, সে ব্ল্যাক ক্রসের লোক নয়, ব্ল্যাক ক্রসকেই সে একটা গাড়ি হাইজ্যাক করে নিয়ে ধাওয়া করেছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, নিহতরা সংখ্যায় কমপক্ষে তিনজন ছিল।’

‘কোন পথে ওরা গেছে, তা কি আপনারা জানতে পেরেছেন?’

‘না, এখনও নয় স্যার। তবে তারা কাছের পেরেজ গিরেক কিংবা সেইন্ট পল ডে লিউন শহরের দিকে যায়নি। এদিকে আমাদের কড়া পাহারা ছিল।’

‘আপনারা কি ওদের পিছু নেবার কোন চেষ্টা করছেন অফিসার?’

‘সে সুযোগ হয়নি। তাদের গাড়ির নাম্বার বা কোন চিহ্ন পেলে আমরা ওদের লোকেট করার ব্যবস্থা করতাম। তবু দুটো গাড়ি সম্পর্কে একটা জেনারেল ইন্সট্রাকশন আমরা চারদিকে পাঠিয়েছি।’

‘ব্ল্যাক ক্রস সম্পর্কে কোন ইন্সট্রাকশন পাঠিয়ে কি কোন লাভ আছে?’

‘আপনি যা জানেন স্যার। তারাও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তবে বিশেষ ফেভার পায় তারা আমাদের মত অফিসারদের ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো রাজনীতি।’

‘রাজনীতি? কি সেটা?’

‘সব আপনি জানেন স্যার। আগে ওরা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বিরাট অস্ত্র ছিল। এই কারণে সুযোগ দেয়া হতো, সাহায্য করা হতো। এখন কমিউনিজম কোন বড় সমস্যা নয়, ওদেরকে এখন কাজে লাগানো হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সরকার অনেক কিছু পারে না বাইরের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে। সরকারের না পারা এসব কাজ ব্ল্যাক ক্রস করছে। সুতরাং ফেভার তাদের পাবারই কথা।’

‘তাহলে তো সরকারের এখন উচিত, ব্ল্যাক ক্রস-এর বিরুদ্ধে যে বা যারা লেগেছে, তাদের বিরুদ্ধে তৎপর হওয়া।’

‘সরকার এবং পুলিশ সে চেষ্টা করছে স্যার।’ বলেই পুলিশ অফিসার একটু হাসল এবং বলল, ‘মাফ করবেন স্যার। কিছুই আপনার অজানা নয়।’

‘ধন্যবাদ। গুড মর্নিং’- বলে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল মিশেল প্লাতিনী।

‘গুড মর্নিং’- বলে ঘুরে দাঁড়াল পুলিশ অফিসারটি। চলে গেল।

‘তাহলে তো ওরা পেরেজ পিরেক কিংবা ডে লিউন শহরের দিকে যাননি। কোথায় গেলেন ওরা?’ পুলিশ অফিসার বেরিয়ে যেতেই বলে উঠল ডোনা।

‘ওমর বায়া ব্ল্যাক ক্রসের জন্যে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। সুতরাং তাকে নতুন কোন সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে গেছে। হেডকোয়ার্টারে তারা ওমর বায়াকে রেখেছিল। হেডকোয়ার্টার ধ্বংস হবার পর তাকে তারা এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক যাকে তারা হেডকোয়ার্টারের মর্যাদা দিতে পারে।’

‘তেমন জায়গা অনেক দূরেও তো হতে পারে?’

‘দূরে হওয়াই স্বাভাবিক।’

‘খুব দূরে?’

‘হতে পারে তা দেশের একদম ভিন্ন প্রান্তে।’

মুখ মলিন হয়ে গেল ডোনার তার আব্বার কথায়। বলল, ‘তাহলে আমরা কি করব?’

ডোনার কথা শেষ না হতেই টেলিফোন বেজে উঠল।

ডোনা দ্রুত উঠে গেল টেলিফোনের কাছে।

‘হ্যালো।’

‘ইয়েস, মিস ডোনা বলছি।’

‘কে?’

‘ঠিক আছে, লাইন দিন।’

‘তুমি… তুমি! কোথায়… তুমি?’

আবেগে-আনন্দে মুখ লাল হয়ে উঠেছে ডোনার। গলা তার কাঁপছে। বহু কষ্টে কথাগুলো যেন ডোনার গলা থেকে বেরুলো।

‘কুমেট-এর কাছাকাছি থেকে বলছি।’

‘কুমেট?’

‘তুমি কবে এলে, কার সাথে এলে?’

‘সে কথা পরে। তুমি ভাল আছ?’

হঠাৎ কথা বন্ধ হয়ে গেল ডোনার। চোখ দু’টি তার আতংকে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তার পরেই চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যালো, …হ্যালো… কথা বলছো না কেন?’

কিন্তু মুহূর্তেই তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এল। তার হাত থেকে টেলিফোন পড়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল ডোনা।

আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল মিশেল প্লাতিনীসহ সবার চোখে-মুখে। এলিসা গ্রেস, পিয়েরা পেরিন এবং লুই ডোমাস বুঝল, ভয়ানক কিছু ঘটেছে। আর ডোনার আব্বা ডোনার কথা শুনেই বুঝেছিল, সে আহমদ মুসার সাথে কথা বলছে। কিন্তু কি হল? কি ঘটেছে টেলিফোনের ঐ প্রান্তে!

মিশেল প্লাতিনীসহ সবাই ছুটে এল ডোনার দিকে।

শীঘ্রই জ্ঞান ফিরে পেল ডোনা। জ্ঞান ফিরে কেঁদে উঠল।

‘কি ঘটেছে বল মা, টেলিফোন তো আহমদ মুসার ছিল?’ বলল ডোনার আব্বা।

‘আব্বা তুমি বল, তার মত একজন পরোপকারী মানুষকে আল্লাহ দীর্ঘজীবী করবেন?’ বলল ডোনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে।

‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

‘বল, শত্রুর বোমাও তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না?’

‘কি বলছ এসব মা?’

‘না বল, তার কোন ক্ষতি হয়নি, তার কোন ক্ষতি হতে পারে না।’ পিতার দু’টি হাত জড়িয়ে ধরে বলল ডোনা। তার চোখে-মুখে বিহ্বল ভাব।

‘কি হয়েছে বল মা।’

‘হঠাৎ তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। মনে হলো যে, টেলিফোনের উপরই বিস্ফোরণ।’

ডোনার কথা শোনার সাথে সাথে উদ্বেগের ছায়া নামল মিশেল প্লাতিনীর মুখে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ঘটনার এতটুকু দিয়ে নিশ্চিত করে কোন কিছুই বলা যায় না মা। তুমি চিন্তা করো না।’

‘না আব্বা, তুমি বল ওর কিছুই হয়নি।’

‘আল্লাহ তা-ই করুন মা।’

বলে একটু থামল ডোনার আব্বা। পরক্ষণেই মুখ খুলল। বলল, ‘কুমেট-এর কথা তুমি কি বললে?’

মুখ তুলল ডোনা। তার দু’চোখে নতুন চাঞ্চল্য ফুটে উঠল। বলল, ‘ও ‘কুমেট’ থেকে টেলিফোন করেছিল। আমরা তো এখন ‘কুমেট’ যেতে পারি আব্বা।’

‘পারি। যেতেই হবে। তবে আহমদ মুসার টেলিফোনের জন্যে আমাদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত। তার অসমাপ্ত কথা বলার জন্যে আবার টেলিফোন সে নিশ্চয়ই করবে।’

‘কিন্তু উনি যদি সে অবস্থায় না থাকেন?’

‘কিন্তু আমরা কিছুটা সময় দেখি।’

‘এটাই মনে হয় ভাল হবে। ইতোমধ্যে ওর নতুন লোকেশন জানা যেতে পারে।’ বলল এলিসা গ্রেস।

ডোনা কোন কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। গণ্ডে তার অশ্রুর দাগ। ঠোঁট দু’টি শুকনো। সূক্ষ্ম একটা কম্পন তাতে। অন্তরে তার যে ঝড় বইছে তারই প্রকাশ এটা।

ডোনার আব্বা উঠল।

এগোলো টেলিফোনের দিকে। বলল, ‘ভুলেই গেছি যে, আমাদের কারো নাস্তা হয়নি।’

ছুটে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সামনের গাড়িটি দু’শ গজের বেশি দূরে নয়। রাতের অন্ধকার কেটে যাবার পর এখন পরিষ্কারভাবে গাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। আট সিটের একটা বাঘা ল্যান্ড ক্রুজার। আহমদ মুসার এই পিছু নেয়া ওদের কাছে ধরা পড়েছে কিনা আহমদ মুসা বুঝতে পারছে না।

আহমদ মুসা ইচ্ছে করেই ওদের কাছাকাছি হওয়ার কিংবা ওদের ধরে ফেলার চেষ্টা করেনি। আহমদ মুসা আগে ওদের বুঝতে চায়। গাড়িতে ওমর বায়া আছে। তার নিরাপত্তার কথাও তাকে ভাবতে হচ্ছে।

কোথায় যাচ্ছে ওরা? দক্ষিণগামী হাইওয়ে ধরে গাড়ি চলার পর পুবদিকে টার্ন নিয়েছে। আহমদ মুসা বুঝতে পারছে, গাড়ি এখন ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূল ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, ফ্রান্সের এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর ব্রিস্টে ওরা গেল না, তাহলে কোথায় যেতে চায় ওরা? ডে লিউনের মতই কোন অখ্যাত শহরের কোন বড় ঘাঁটিতে কি?

চার ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। কোথায় তাদের গাড়ি এখন? ব্রিস্ট শহর পেছনে ফেলার পর যে সময় গেছে তাতে তারা নিশ্চয় পরবর্তী বড় শহর ‘কুমেট’-এর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। এ সময় একটা রোড-মাইলের উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার। দেখল, কুমেট শহর আর পঁচিশ মাইল।

গাড়ি তখন একটা সংরক্ষিত বন এলাকার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। দু’ধারেই ঘন বন।

হঠাৎ আহমদ মুসা দেখল, সামনের গাড়িটি তার স্পীড ডাবল বাড়িয়ে দিয়েছে। তীর বেগে ছুটে গাড়িটি আহমদ মুসার নজরের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আহমদ মুসাও গাড়ির স্পীড ডাবল করতে বাধ্য হলো। কিন্তু সামনে বাঁক থাকায় সামনের গাড়িটি চোখের আড়ালে চলে গেল।

কিন্তু বাঁক ঘুরে মুশকিলে পড়ে গেল আহমদ মুসা। এখানে রাস্তার একটা শাখা ডানে গেছে সমুদ্র তীরের দিকে। আর একটা সামনে এগিয়েছে। সামনে আরও একটা বাঁক। কোন রাস্তায়ই ব্ল্যাক ক্রস-এর গাড়ি দেখতে পেল না।

আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ওয়্যারলেস রিমোট সেন্সর বের করল। আইডি কার্ডের মত ছোট যন্ত্রটির বিশেষ একটি বোতামে চাপ দিতেই এর স্ক্রীনে সোজা সামনের দিক নির্দেশ করে একটা লাল অ্যারো মার্ক ফুটে উঠল।

সোজা রাস্তাটি ধরে ছুটে চলল আহমদ মুসার গাড়ি। প্রসন্ন হয়ে উঠল আহমদ মুসার বুক।

আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রস-এর পিছু নেবার পর পরই একটা ‘মাইক্রো ট্রান্সমিটার চিপ’ ছুঁড়ে দিয়েছিল তাদের গাড়ি লক্ষ্যে। এটা ছোঁড়ার একটা বিশেষ পিস্তল রয়েছে। রাবার বুলেটের গায়ে ট্রান্সমিটার চিপ সেট করা থাকে। বুলেটটি গাড়ির গায়ে আঘাত করার সাথে সাথে ‘ট্রান্সমিটার চিপ’ চুম্বকীয় প্রভাবে গাড়ির গায়ে সেঁটে যায়। এই চিপ পঞ্চাশ মাইল দূর পর্যন্ত সংকেত পাঠাতে পারে, যা বিশেষভাবে তৈরি রিমোট সেন্সর-এ ধরা পড়ে এবং রিমোট সেন্সর তখন কোনদিক ও কতদূর থেকে ‘ট্রান্সমিটার চিপ’ সংকেত পাঠাচ্ছে, সেই দিক নির্দেশ করে থাকে।

অল্প কিছুদূর চলার পরেই আহমদ মুসা ব্ল্যাক ক্রসের গাড়ি দেখতে পেল।

আহমদ মুসা ফ্রান্সের এই এলাকার একটা মানচিত্রের প্রয়োজনীয়তা খুবই অনুভব করল। আহমদ মুসা জানে, ট্যুরিস্টরা ও গাড়িতে সব সময় সফরকারীরা হাতের কাছে মানচিত্র রাখে। এই আশাতেই আহমদ মুসা গাড়ির চারদিকে নজর বোলাল। তারপর সে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের রেকর্ড ড্রয়ারটা খুলে ফেলল। দেখতে পেল বেশ কিছু কাগজপত্র। প্রথমেই নজর পড়ল ফরাসি ভাষায় ছোট একটা বইয়ের দিকে। নাম পড়ে ভীষণভাবে চমকে উঠল আহমদ মুসা। বইটি হাতে তুলে নিল সে। নামঃ Towards Understanding Islam.

রাস্তায় একটা বড় বাঁক।

আহমদ মুসার মনোযোগ স্টিয়ারিং হুইলের দিকে। তীব্র গতিতে চলছে গাড়ি, সামনের গাড়ির সাথে সমান বেগে। আহমদ মুসা ওমর বায়াকে অপহরণকারী গাড়িটাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি নয়। দরকার হলে সে লড়াই করবে, যা এতক্ষণ সে এড়িয়ে এসেছে। আর লড়াইয়ের উপযুক্ত স্থান এই বনভূমি। আহমদ মুসা গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল।

স্টিয়ারিং হুইল ধরা বাম হাতে তখনো বইটি। এমন একটি জায়গায় ইসলামের উপর এমন একটি বই! বিস্ময় কাটছে না আহমদ মুসার।

ডান হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে বাম হাতে কষ্ট করেই একটা পাতা উল্টাল আহমদ মুসা। ভেতরের টাইটেল পেজে হাতে লেখা একটা নামের প্রতি নজর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আহমদ মুসা। পরিষ্কার অক্ষরে ‘মারিয়া জোসেফাইন’-এর নাম লেখা। হস্তাক্ষরটি ডোনার, তাও চিনতে পারলো। এতক্ষণে তার মনে পড়ল, গাড়িতে উঠার পর থেকে একটা পরিচিত সেন্টের সে গন্ধ পাচ্ছে। এ রাজকীয় সেন্ট ডোনাই সব সময় ব্যবহার করে। তাছাড়া এখন সে চিনতে পারছে, এ গাড়িটাও ডোনাদের।

উত্তেজনার আকস্মিকতায় আহমদ মুসার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। ডোনা তাহলে চলে এসেছে! ঐ রেস্টহাউসে সে ছিল। হৃদয়ের কোন এক গভীরে প্রশান্তির এক স্নিগ্ধ প্রলেপ অনুভব করল আহমদ মুসা। সেই সাথে একটা উদ্বেগও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে কি একা তার ঐ পরিচারিকা নিয়ে চলে এসেছে, যেমন সে বলেছিল! ভীষণ জেদী মেয়ে- মনটা একটু বেসুরো হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কিন্তু পরক্ষণেই মন স্বীকার করল, না, ডোনা কোন অন্যায় ও অযৌক্তিক জেদ করে না। সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকবে- জীবনসঙ্গিনী তো এরই নাম!

বইয়ের ভেতর থেকে একটা নেইম কার্ড খসে পড়ল আহমদ মুসার কোলের উপর।

বইটা পাশে রেখে নেইম কার্ডটা তুলে নিল আহমদ মুসা। নেইম কার্ডটা ‘লা ইল’ রেস্টহাউসের যেখানে ওমর বায়ারা ছিল এবং যার সামনে থেকে আহমদ মুসা গাড়িটা নিয়ে এসেছে। নেইম কার্ডে ‘লা ইল’ রেস্টহাউসের ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার।

হঠাৎ আহমদ মুসার মনে ঝিলিক দিয়ে উঠল কথাটা। এ গাড়ির ড্যাশবোর্ডে টেলিফোন সেট করা, সে তো ডোনাকে টেলিফোন করতে পারে! যেই ভাবা সেই কাজ।

সামনেটা একবার দেখে নিল আহমদ মুসা। দূরত্ব কমছে সামনের গাড়ি থেকে।

আহমদ মুসা ডান হাতে স্টিয়ারিং-এর গোটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাম হাতে টেলিফোনের সুইচ অন করে নাম্বার নবগুলোতে চাপ দিল তর্জনী দিয়ে।

‘লা ইল’ রেস্টহাউসকে পাওয়া গেল। পিএবিএক্স অপারেটর লাইন দিল ডোনার সাথে।

‘আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছ ডোনা?’

‘কুমেট।’

‘তুমি কবে, কিভাবে, কার সাথে এলে?’

টেলিফোনের ইন্টারকম সিস্টেম। এতে আলাদা কোন রিসিভার নেই।

আহমদ মুসা কথা বলছিল। কিন্তু চোখ ছিল সামনে। গাড়িটা অনেক কাছে চলে এসেছে। সেদিক থেকে চোখ দু’টি গাড়ির সামনে রোডের উপর এসে পড়তেই ভূত দেখার মত আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। একদম গাড়ির মুখের সামনে রাস্তা জুড়ে কয়েক ডজন চকোলেট ছড়ানো। ওগুলো চকোলেট তো নয়, বিধ্বংসী বোমা। ওগুলোর উপর চোখ পড়তেই আহমদ মুসা বুঝতে পারল, ব্ল্যাক ক্রস তাকে পেছন থেকে সরিয়ে দেবার অতি সহজ একটা পথ অবলম্বন করেছে।

গাড়ি ব্রেক করার অথবা ঘুরিয়ে নেবার সময় পার হয়ে গেছে। আহমদ মুসা চকোলেট বোমার অবস্থান দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝেছিল, এখন ব্রেক বা ঘুরিয়ে নিতে গেলে গাড়ি বোমার উপর গিয়ে পড়বে। সুতরাং কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত আহমদ মুসা নিয়ে নিয়েছিল।

স্টিয়ারিং হুইল থেকে তার ডান হাত বিদ্যুৎ বেগে গিয়ে দরজার ইমার্জেন্সী এক্সিট সুইচে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা ছিটকে খুলে গেল। আহমদ মুসাও সুইচে চাপ দিয়েই লাফিয়ে পড়েছিল। প্রায় দরজার সাথেই তার দেহ বাইরে ছিটকে পড়ল। তার দেহ তখনও মাটিতে পড়ে সারেনি, এই সময় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ কানে এল আহমদ মুসার।

মাটিতে পড়ার সময় হাত দিয়ে মাথাটা বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু তবু পারল না। মাথার সেই আহত জায়গাটাই আবার ঠোকা খেল রাস্তার কনক্রিটের সাথে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল আহমদ মুসা তার অজান্তেই।

কিন্তু দম নেবার সুযোগ নেই। মাটিতে পড়েই তাকাল গাড়ির দিকে। দেখল, বিস্ফোরণের পর গাড়ির ধ্বংসাবশেষ তার দিকে ছুটে আসছে। চকোলেট বোমার পরপর বিস্ফোরণ ঘটছে।

সুতরাং মাটিতে পড়েই নিজের দেহকে গড়িয়ে সরিয়ে নিল। রাস্তার পাশের একখণ্ড ঝোপের আড়ালে গড়িয়ে পড়ল দেহটা।

যখন তার দেহটা রাস্তার উপর স্থির হল, বুঝলো, তার দু’হাতের তালুতেও প্রচণ্ড ব্যথা। মাথার আহত স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা। মনে হলো, উঠতে চেষ্টা করলে সবগুলো ব্যথাই যেন শতগুণে বেড়ে যাবে। সব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেকে সেই মুহূর্তে অবস্থার উপর ছেড়ে দিয়ে গভীর ক্লান্তিতে চোখ বুজল আহমদ মুসা। কোথা থেকে রাজ্যের ঘুম যেন নেমে এল চোখে। সে সময় একটা গাড়ি পেছন দিক থেকে ছুটে আসছিল। নিকটতর হচ্ছিল জ্বলন্ত গাড়িটার।

কুমেট অভিমুখে ছুটছিল পিকআপ কারটি। মোট পাঁচজন আরোহী। পাঁচজনই মহিলা। সামনের সিটে দু’জন এবং পেছনের সিটে তিনজন। তাদের পেছনে পিকআপে কিছু ব্যাগ-ব্যাগেজ।

তাদের সকলের মুখে ক্লান্তির চিহ্ন।

তারা ফিরছে ‘অল ফ্রান্স গার্লস ক্যাডেট কোর’-এর সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত জাম্বুরী থেকে। জাম্বুরী অনুষ্ঠিত হয়েছে কুমেট-এর সংরক্ষিত বনে।

এই বনের মাঝখানে একটা বিশাল লেক আছে। সেই লেকের চারদিক ঘিরে সুন্দর সবুজ পাহাড়। এই পাহাড় এবং হ্রদ মিলিয়ে এই অপরূপ জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ‘ড্রিমল্যান্ড’। আদিগন্ত বনরাজির মাঝে এই ‘ড্রিমল্যান্ড’ ফ্রান্সের একটা শ্রেষ্ঠ ট্যুরিস্ট স্পট। এখানে এলে মানুষ আধুনিক নগর সভ্যতার ইট-পাথর-সিমেন্টের উত্তাপ এবং কোলাহল থেকে মুক্তি লাভ করে নীরব-স্নিগ্ধ-প্রশান্তির আদিম যুগে যেন ফিরে যায়।

এখানেই ফ্রান্সের গার্লস ক্যাডেট কোর-এর ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।

আজ ছিল সমাপ্তি দিবস।

ইতোমধ্যে সবাই চলে গেছে কুমেট বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।

শতাধিক গাড়িবহরের সর্বশেষ হলো পিকআপ কারটি।

এ গাড়ি ড্রাইভ করছে মিস ক্লাউডিয়া। সে ছিল এই জাম্বুরীর চীফ কোর কমান্ডার। চীফ হিসেবেই সে সব শেষ করে সবার শেষে যাচ্ছে। সাথের চারজনই তার সহকারী-সহকর্মী। তবে তারা সকলে বিভিন্ন পেশার এবং বিভিন্ন এলাকার।

‘মিস ক্লাউডিয়া’ প্যারিসের এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। অন্য চারজনের একজন ডাক্তার। নাম ‘জিয়ানা বার্নেস’। উত্তর ফ্রান্সের মেয়ে। আরেকজন ‘রিশলা’, ইঞ্জিনিয়ার। পূর্ব ফ্রান্সের লিওন এলাকার মেয়ে সে। অন্য দু’জন পেশায় সাংবাদিক। একজন দক্ষিণ ফ্রান্সের পাউ শহরের ‘সুমাইয়া’, অন্যজন তুলু এলাকার ‘নেকা’।

ফুল স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল ক্লাউডিয়া। তার পাশের সিটে জিয়ানা বার্নেস।

‘এত তাড়াহুড়া করছ কেন ক্লাউডিয়া? সময় তো প্রচুর আছে। প্লেন তো সেই বারটায়।’ বলল জিয়ানা।

‘সবার পেছনে পড়ে গেছি তো, তাই।’ গাড়ির গতি স্লো করতে করতে বলল ক্লাউডিয়া।

‘আমার ফ্লাইট তো সেই ইভেনিং-এ’ বলল সুমাইয়া।

‘এতটা সময় তুমি কোথায় কাটাবে?’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘বিমানবন্দরে গিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে শহরে ঘুরতে বেরুব। একজন ফ্রেন্ড ছিল, তাকে খুঁজে দেখব।’ বলল সুমাইয়া।

‘বয়ফ্রেন্ড?’ বলল রিশলা।

‘বয়ফ্রেন্ড কোন কালেই ছিল না, এখনও নেই।’ সুমাইয়া বলল।

‘জানো না তুমি রিশলা, ও তো মুসলিম।’ বলল নেকা।

‘কেন, মুসলিম মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকে না?’ বলল জিয়ানা।

‘ছেলেদের সাথে অবাধ মেলামেশাই নিষিদ্ধ। বয়ফ্রেন্ড থাকবে কি করে?’ উত্তর দিল নেকা।

‘অসম্ভব কথা। কোন ফ্রেন্ড থাকবে না?’ বলল জিয়ানা।

‘কেন, গার্লফ্রেন্ড থাকবে।’ বলল সুমাইয়া।

হো হো করে হেসে উঠল জিয়ানা ও রিশলা। ক্লাউডিয়ার ঠোঁটেও হাসি।

‘তাহলে মুসলমানদের কি প্রেম নিষিদ্ধ?’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘প্রেম নিয়ে তো কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, মেলামেশার জন্যে বয়ফ্রেন্ড থাকা না থাকা নিয়ে।’ বলল সুমাইয়া।

‘একই কথা হলো না?’ বলল জিয়ানা।

‘না, এক কথা নয়। বয়ফ্রেন্ড তো অহরহ বদল হচ্ছে। কিন্তু প্রেমের তো এমন পাত্র বদল সম্ভব নয়।’ সুমাইয়া বলল।

‘তাহলে মুসলিম মেয়েরা বয়ফ্রেন্ড শূন্য! কি সাংঘাতিক!’ বলল রিশলা।

‘মুসলিম মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকে না, থাকে হাজব্যান্ড-ফ্রেন্ড।’ বলল সুমাইয়া।

জিয়ানা, রিশলা, নেকা হো হো করে হেসে উঠল। এ হাসিতে যোগ দিল না ক্লাউডিয়া।

‘ব্যাপারটা হাসির মনে হচ্ছে ঠিকই, তবে মনে হয় ঐ জীবনে শান্তি আছে, স্বস্তি আছে এবং নিখাদ প্রেমও আছে, এ কথা বোধ হয় আমাদের স্বীকার করতে হবে।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ক্লাউডিয়া।

‘অমুসলিম মেয়েদের জীবনে এসব নেই বলছ?’ বলল রিশলা।

‘অমুসলিম মেয়েদের কথা বলিনি, আমি বলছি পশ্চিমী মেয়েদের কথা। পশ্চিমী মেয়েদের জীবনে আজ ওসব সাধারণভাবে নেই, এ কথা সত্য।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘পশ্চিমী পরিবারে শান্তি, স্বস্তি ও নিখাদ প্রেম নেই বলছ?’

‘দেখ, আমাদের পশ্চিমা দেশে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অনেকটা দুই বন্ধুর সম্পর্কের মত। অতি সামান্য কারণেও তা ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাচ্যে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভক্তি, শ্রদ্ধা, দায়িত্ব ও প্রেম- সবকিছু মিলে গভীর এক আত্মিক ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে, যা কদাচিৎ ভেঙে থাকে। এমন স্বস্তি এবং এমন আত্মিক সম্পর্কের কথা আমরা কল্পনাই করতে পারি না।’ ক্লাউডিয়া বলল।

‘নেগেটিভ দিকও তো রয়েছে।’ বলল জিয়ানা।

‘একঘেঁয়েমি, নতুনত্বের অভাব, নির্যাতনের সুযোগ ইত্যাদিকে নেগেটিভ লিস্টে আনতে পার। আসলে এ নেগেটিভ দিকগুলো ওদের জীবনে খুবই কম। নির্যাতন সেখানে আছে, কিন্তু এমন নির্যাতন আমাদের সমাজেও আছে। তবে ওদের সমাজে আত্মিক সম্পর্কের কারণে নির্যাতনটা আমাদের সমাজের চেয়ে কম। ওদের মেয়েদের অনেক কিছুকে আমরা নির্যাতন বলি, সে সব আসলে ওদের সংস্কৃতি, রীতি, নিয়ম- যা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই মেনে নেয়। আর একঘেঁয়েমি ও নতুনত্বের কথা?’

বলে থামলো ক্লাউডিয়া। হাসলো মুখ টিপে। তারপর বলল, ‘আমাদের অবাধ মেলামেশার কালচার, সত্যি বলতে কি, আমাদেরকে একটা ঘরে স্থির হতে দিচ্ছে না। উড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের এ ঘর থেকে সে ঘরে। এতে নতুনত্বের একটা বাহ্যিক স্বাদ আছে, কিন্তু নেই শান্তি, স্বস্তি এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতা- যা আমরা মুসলিম সমাজের স্থিতিশীল পরিবারে পাই।’

‘আমাদের সভ্যতার মুণ্ডপাত করছো ক্লাউডিয়া? আর যে বড় লোভ দেখছি মুসলিম পরিবারের প্রতি!’ বলল রিশলা।

‘দেখ, একটা সভ্যতার সবকিছু ভাল হয় না। আমাদের সভ্যতা পৃথিবীকে বিজ্ঞান দিয়েছে, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে পারেনি। আমরা গ্রীক দর্শনকে অনুকরণ করছি, তাও আবার বিকৃত করে। ধর্ম ও নৈতিকতার বাঁধন যে আকারেই হোক গ্রীকদের ছিল, আমরা তা ছিঁড়ে ফেলেছি।’

ক্লাউডিয়ার কথাগুলো ভারি। সবাই গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। জিয়ানাই মুখ খুলল প্রথমে। বলল, ‘জীবনের এ জ্ঞান কি মুসলিম সমাজ দিয়েছে? দেখবে, ওদের অনেক বাড়াবাড়ির কোন যুক্তি নেই। যেমন, সামান্য ওড়নার ব্যাপার নিয়ে ওরা কি হাঙ্গামাই না বাঁধাচ্ছে। তুমি কিছু মনে করো না সুমাইয়া।’

সুমাইয়া হাসলো। সে মুখ খোলার আগেই কথা শুরু করল ক্লাউডিয়া। বলল, ‘ওড়নাকে সামান্য বলছ কেন জিয়ানা? ওটা ওদের কালচার, যা তাদের বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।’

‘তা আমি অস্বীকার করছি না ক্লাউডিয়া। এই বিশ্বাসের দিক ছাড়া এর ইউটিলিটি কি?’ বলল জিয়ানাই।

হাসল ক্লাউডিয়া। বলল, ‘এর ভাল জবাব সুমাইয়া দিতে পারবে। তবে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো, মেয়েদের সৌন্দর্যের স্থানগুলোকে ছেলেদের চোখ থেকে গোপন রাখা বা আড়ালে রাখা এর লক্ষ্য।’

থামল ক্লাউডিয়া। ক্লাউডিয়া চুপ করতেই সুমাইয়া বলল, ‘ঠিক বলেছ ক্লাউডিয়া। এটাই আমারও কথা।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু মেয়েদের একতরফাভাবে এটা করার দরকার কি? ছেলেদের এভাবে তো কিছু ঢাকা-ঢাকি নেই।’ বলল নেকা।

‘এর জবাব হলো, মেয়েরা প্রকৃতিগতভাবেই আত্মরক্ষাকারী পক্ষ এবং ছেলেরা আক্রমণকারী পক্ষ। অন্য কথায়, মেয়েরা সাধারণভাবে নিষ্ক্রিয় পক্ষ এবং ছেলেরা সক্রিয় পক্ষ। ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ছেলেরাই মেয়েদের উপর চড়াও হয়েছে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনার বিরুদ্ধে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধ হিসেবেই মেয়েদের সৌন্দর্য আড়াল করে রাখার ব্যবস্থা বলেই মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আমার মনে হয়।’ বলল সুমাইয়া।

‘এতে কি অবাঞ্ছিত ঘটনা বন্ধ হয়েছে?’ বলল রিশলা।

‘বন্ধ হয়নি, কিন্তু মুসলিম সমাজে এই ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা আমাদের তুলনায় বহুগুণ কম। এটা আমি ক্রাইম স্ট্যাটিস্টিকস-এ দেখেছি।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘শুধু ওড়না বা পর্দাতেই এই অবাঞ্ছিত ঘটনা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবার কথা নয়। সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্যে এ সংক্রান্ত অপরাধের অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।’ বলল সুমাইয়া।

‘ওরে বাবা, দোররা মারার কথা বলছ? আমি মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্সে মুসলিম সমাজের এ শাস্তি বিধানের কথা পড়েছি।’ বলল জিয়ানা।

‘ওরে বাবা বলছ কেন? নিরপরাধদের গায়ে তো দোররা পড়ার কথা নয়। অপরাধীর শাস্তি হোক চাও না?’

‘চাই, কিন্তু প্রকাশ্য জনসমক্ষে ঐ দোররা মারার ব্যাপারটাকে বর্বরতা বলে মনে হয় যেন।’ বলল জিয়ানা।

‘এটা বর্বরতা নয়, আইনসঙ্গত কঠোরতা। বরং বলতে পার, অপরাধটা অত্যন্ত বর্বর। এই বর্বর অপরাধের মূলোচ্ছেদ করতে হলে কঠোর শাস্তি অবশ্যই প্রয়োজন।’

‘মূলোচ্ছেদ কি সম্ভব?’ বলল নেকা।

‘কোন অপরাধেরই একেবারে মূলোচ্ছেদ সম্ভব নয়। কিন্তু শূন্য পর্যায়ে আনা সম্ভব।’ বলল সুমাইয়া।

‘সম্ভব?’

‘সম্ভব। যেখানে মেয়েদের পর্দার বিধানসহ শাস্তির বিধান কার্যকরী আছে, সেখানে অপরাধ এই পর্যায়ে নেমে এসেছে। সৌদি আরব এর একটি দৃষ্টান্ত।’ বলল সুমাইয়া।

‘এই তোমরা সামনে দেখ!’ ড্রাইভিং সিট থেকে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ক্লাউডিয়ার কণ্ঠ।

সবাই একসংগে তাকাল সামনে। ইতোমধ্যেই তাদের কানে এসেছিল পর পর অনেক ক’টি বিস্ফোরণের শব্দ। তারা দেখল, সামনে একটা গাড়ি বিস্ফোরণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে, জ্বলছে দাউ দাউ করে।

‘ক্লাউডিয়া, আমাদের কোন গাড়ি নয়তো?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল সুমাইয়া।

‘না, আমি লক্ষ্য করেছি, ওটা আমাদের গাড়ি নয়।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘বিস্ফোরণ কিভাবে ঘটল? কোন টেররিজম নয়তো? ইঞ্জিনের বিস্ফোরণ পরে ঘটল। এর অর্থ, প্রথম বিস্ফোরণগুলো বোমা থেকে হয়েছে।’ বলল জিয়ানা।

‘আমারও তা-ই মনে হয়। আরোহীদের কাউকে তো বেরুতে দেখা গেল না।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাতে মানুষ বেরুবে কি করে! গাড়ি স্লো করে দিলে ক্লাউডিয়া?’ জিজ্ঞেস করল জিয়ানা।

‘একটু দেখতে দাও, বুঝতে দাও। ব্যাপারটা টেররিজম হলে তো ভয়ের কথা।’

‘আশংকা করছ কিছু?’ বলল রিশলা।

‘ভেতরের বোমাতেও বিস্ফোরণ ঘটে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সুতরাং টেররিজমের ঘটনাই ঘটেছে, একথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’ বলল জিয়ানা।

বিস্ফোরণটা রাস্তা জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। পাশ কাটিয়ে যেতে হলে রাস্তার পাশে নামতে হবে।

‘আমাদের কি নামা উচিত নয়, কি ঘটেছে দেখা উচিত নয়?’ ক্লাউডিয়া বলল। গাড়ির গতি একদম থেমে যাবার পর্যায়ে নেমে এসেছে।

পেছন থেকে সুমাইয়া, রিশলা, নেকা একবাক্যে বলল, ‘নেমে কাজ নেই। চল, আমরা গিয়ে পুলিশে খবর দেব।’

‘কিন্তু দেখা প্রয়োজন কোন মানুষ বেঁচে আছে কিনা? সাহায্য করার কোন সুযোগ আমাদের আছে কিনা?’ বলল জিয়ানা।

‘অসম্ভব, কোন মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়। মোটামুটি দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে সব কিছু।’

‘ঠিক আছে, আমরা যখন গাড়ি রাস্তার পাশ দিয়ে নিয়ে যাব, তখন জিয়ানা নেমে এক নজর চারদিকটা দেখে নেবে।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘নাইস।’ বলল জিয়ানা।

জিয়ানা নামতে যাবে এমন সময় তারা দেখল, বিপরীত দিক থেকে দুটো গাড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে। তাদের গতির মধ্যে কোন দ্বিধাগ্রস্থতা নেই। মনে হচ্ছে, বিস্ফোরণের বিষয়টা তারা জানে।

জিয়ানা নামল না গাড়ি থেকে। ক্লাউডিয়াও নিষেধ করল তাকে।

ছুটে আসা গাড়িটা এসে জ্বলন্ত গাড়িটার সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে কয়েকজন নামল। একজন ছাড়া সবার হাতে স্টেনগান।

তারা এসে দাঁড়াল জ্বলন্ত গাড়িটার সামনে।

‘ফুয়েল ট্যাংকের বিস্ফোরণ সামনের সিট দুটোকে দেখো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আর দেখো, চকোলেটগুলো সবই বিস্ফোরিত হয়েছে। খেলা সাঙ্গ হয়েছে শয়তানটার, যদি সে এ গাড়িতে এসে থাকে।’ মুখে ক্রুর হাসি টেনে বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলল খালি হাতে নেমে আসা সরদার গোছের লোকটি।

অন্য চারজনও তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সায় দিল।

লোকটি তার পকেট থেকে টেবিল টেনিস বলের মত ডিম্বাকৃতি বস্তু বের করে ছুঁড়ে দিল জ্বলন্ত গাড়িটার দিকে।

প্রচণ্ড শব্দে হাত বোমাটি বিস্ফোরিত হলো। আরেক দফা ছিটকে পড়ল জ্বলন্ত গাড়িটার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

সেদিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। তারপর সে চোখে দূরবীন লাগিয়ে ক্লাউডিয়ার গাড়িটাকে দেখল।

ফিরে গেল ওরা গাড়িতে। গাড়ি দুটো ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার সেই ঝড়ের গতিতেই ছুটে চলল কুমেট-এর দিকে।

গাড়ির ভেতরে ক্লাউডিয়ারা পাঁচজন বসেছিল পাথরের মত। চোখ ভরা আতংক। ঠোঁট তাদের শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

ওরা চলে গেলেও ক্লাউডিয়াদের মুখে কিছুক্ষণ কথা ফুটল না।

প্রথম কথা বলল ক্লাউডিয়াই। বলল, ‘ওরাই তাহলে বোমা পেতে গাড়ি ধ্বংস করেছে এবং গাড়ির আরোহীকে হত্যা করেছে।’

‘সেটা তো পরিষ্কার। কি নৃশংসতা! ধ্বংস হওয়া গাড়ি লক্ষ্যে আবার বোমা নিক্ষেপ! হিংস্রতা পশুর মতই।’ বলল জিয়ানা।

‘জিয়ানা, তোমার আর নামবার দরকার নেই। চল এবার আমরা যাই।’

বলে ক্লাউডিয়া গাড়িতে স্টার্ট দিল।

বিস্ফোরণ রাস্তার কিনারা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা পাশ কাটাতে গিয়ে ক্লাউডিয়া রাস্তার পাশে নেমে এল।

রাস্তার ছোট ঝোপটার পাশ মাড়িয়ে চলার সময় ক্লাউডিয়া ঝোপের ভেতর পড়ে থাকা আহমদ মুসাকে দেখতে পেল। সংগে সংগে গাড়ি ব্রেক কষে চিৎকার করে উঠল ক্লাউডিয়া, ‘এখানে একজন মানুষ পড়ে আছে, জিয়ানা!’

গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

জিয়ানা গাড়ির দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে এল। ক্লাউডিয়া গাড়ির দরজা খুলেছে, কিন্তু নামেনি। পেছনের তিনজনও তাই। তারা ভাবছে, নিশ্চয় কেউ মরে পড়ে আছে। জিয়ানা ডাক্তার, সেই ব্যাপারটা দেখুক।

জিয়ানা আহমদ মুসার গায়ে হাত দিয়েই চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘লোকটা বেঁচে আছে, তোমরা এস।’

ক্লাউডিয়াই প্রথম গিয়ে দাঁড়াল।

‘বিদেশী ক্লাউডিয়া, মনে হচ্ছে এশিয়ান যুবক।’

চিৎ হয়ে পড়ে থাকা আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল ক্লাউডিয়া। অজ্ঞাতসারেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘এ কি!’

মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল ক্লাউডিয়ার।

জিয়ানা বিস্মিত চোখে ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি চেন একে ক্লাউডিয়া?’

ক্লাউডিয়া জবাব দেবার আগেই সেখানে এসে হাজির হলো ওরা তিনজন। এসে ঝুঁকে পড়ল ওরা আহমদ মুসার উপর। সুমাইয়া তার মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘এ কি, কি সর্বনাশ!’

বেদনায় চুপসে গেছে সুমাইয়ার মুখ।

জিয়ানা অবাক বিস্ময় নিয়ে সুমাইয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি চেন একে? ক্লাউডিয়াও দেখছি চেনে!’

সুমাইয়া ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘সত্যি তুমিও চেন?’

‘এসব পরে হবে জিয়ানা, মনে হয় ইনি মারাত্মকভাবে আহত, জ্ঞান হারিয়েছে। তুমি দেখ একে।’

জিয়ানা আহমদ মুসার ডান হাত ধরেই ছিল। বলল, ‘যুবকটি জ্ঞান হারায়নি, প্রচণ্ড অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছে।’

‘আঘাত কেমন?’ বলল সুমাইয়া।

‘একটু বড় আঘাত মাথায় ঐ এক জায়গাতেই। তবে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আঘাতটা আগে থেকেই ছিল। তার উপর নতুন করে আঘাত লেগেছে।’ বলল জিয়ানা।

‘কি মনে করছ তুমি, আঘাতটা কিভাবে পেয়েছে?’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘ব্যাপারটা খুবই পরিষ্কার। দেখ, ইনি পড়ে আছেন ধ্বংস হওয়া গাড়িটার বরাবর পাশেই। গাড়িটা বিস্ফোরিত হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ইনি ঝাঁপিয়ে পড়েন গাড়ি থেকে। সেই সময় মাথার আহত জায়গায় আবার আঘাত লাগে।’

একটু থামল জিয়ানা। জ্বলন্ত গাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি, ঠিক বিস্ফোরণের মুহূর্তে গাড়ি থেকে বের হতে পারলেন কি করে? দেখ, উনি বিস্ফোরণের পাঁচ সেকেন্ড আগেও যদি বের হতেন, তাহলে গাড়ি বর্তমান স্থানে নয়, আরও সামনে এগিয়ে বিস্ফোরিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। অর্থাৎ তার নামা এবং বিস্ফোরণ একই সাথে ঘটেছে।’

‘তার মানে, উনি বিস্ফোরণ ঘটার ব্যাপারটা দুই-পাঁচ সেকেন্ড আগেও টের পাননি। আক্রমণটা তাহলে তার অজান্তে আকস্মিকভাবে হয়েছে। এই অবস্থায় এই ধরনের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা সত্যি দুঃসাধ্য।’ বলল রিশলা।

‘ওর অভিধানে মনে হয় অসাধ্য বলে কিছু নেই।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘ঠিক বলেছে ক্লাউডিয়া। একটা বিস্ময় উনি।’ বলল সুমাইয়া।

‘কিন্তু তোমরা বলছ না কে উনি, এদেশী তো উনি নন। তোমরা চেন কেমন করে তাকে?’ বলল রিশলা ও নেকা প্রায় একসাথেই।

‘সবই জানবে তোমরা। প্রথমে এর চিকিৎসা দরকার।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘একে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।’ বলল জিয়ানা।

‘ওকে তাহলে তো জাগাতে হবে।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘সেটাই আগে দেখি চেষ্টা করে। জোর করে জাগানো ঠিক হবে না। সহজে উঠেন কিনা দেখি।’ বলে জিয়ানা পকেট থেকে চিরুনি বের করে আহমদ মুসার পায়ের তালুতে খুব আলতোভাবে সুড়সুড়ি দিল।

কাজ হলো।

খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা। মনে হলো, চোখ খোলার আগে চিন্তা করল।

চোখ খোলার পর প্রথমে তার চোখ গিয়ে পড়ল গলায় স্টেথিস্কোপ ঝোলানো জিয়ানার দিকে। তারপর তাকাল ক্লাউডিয়ার দিকে। ক্লাউডিয়ার উপর চোখ পড়তেই তার চোখ চঞ্চল এবং চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। এরপর সে দ্রুত সবার উপর চোখ বোলাল। চোখ গিয়ে পড়ল তার সুমাইয়ার উপর।

আহমদ মুসা এক ঝটকায় উঠে বসল। ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া আপনারা? এখানে?’

‘হ্যাঁ, আমরা এখানে।’ বলে ক্লাউডিয়া জিয়ানা, রিশলা ও নেকাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখান থেকে প্রথমে সরে যাওয়া প্রয়োজন, তারপর আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন।’

‘ওরা একবার ফিরে এসেছিল। আবারও আসবে আশংকা করছেন?’ বলল আহমদ মুসা।

‘কেমন করে জানলেন ওরা এসেছিল?’ প্রায় সমস্বরে বলে উঠল সকলে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়।

‘আমার মনে হচ্ছে, ওরা ফিরে না এলে আপনারা আমাকে এখান থেকে সরাবার জন্যে তাড়াহুড়া করতেন না।’

‘কেন এটা মনে করছেন?’ বলল জিয়ানা।

‘এই জন্যে করছি যে, ওরা ফিরে না এলে আপনারা বুঝতেনই না কিভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটল কিংবা কি ধরনের লোক এটা ঘটিয়েছে। অতএব আপনাদের ভয়ও জাগতো না।’

‘ভয় করছি কি আমরা?’ বলল জিয়ানা।

‘আমার তাই মনে হচ্ছে। প্রাথমিক চিকিৎসা করার আগেই যখন আপনারা এ স্থান থেকে সরতে চাচ্ছেন, তখন এটাই ধরতে হয় যে, ভয়টাই আপনাদের কাছে প্রথম বিবেচ্য।’ বলল আহমদ মুসা।

জিয়ানা, রিশলাদের চোখে-মুখে বিস্ময়ের পাশাপাশি সপ্রশংস অনুভূতির স্ফূরণ ঘটল।

‘ধন্যবাদ।’ জিয়ানা বলল। তারপর বলল, ‘আপনাকে গাড়িতে উঠতে হবে।’

‘উঠবো। কিন্তু তার আগে প্লিজ আমাকে বলুন, ওরা কতক্ষণ আগে গেছে, কোনদিকে গেছে এবং আপনারা কোনদিকে যাবেন?’

‘পাঁচ মিনিটের বেশি হবে না ওরা গেছে। ওরা কুমেটের দিকে গেছে, আমরাও কুমেটের দিকেই যাব।’

‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা উঠল। আহমদ মুসার মনে হলো, তার শরীরটা আগের চেয়ে অনেক ভারি। বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে নিজেকে।

আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেছিল গাড়ির দিকে।

আহমদ মুসার মুখে হঠাৎ নেমে আসা মলিন ছায়া নজর এড়ালো না ডাক্তার জিয়ানা বার্নেসের। বলল, ‘আপনাকে কি আমি সাহায্য করতে পারি?’

‘থ্যাংকস। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না।’

‘আপনি শেষ খাবার কখন খেয়েছেন?’

‘গতকাল দুপুরের পর। কেন বলছেন একথা?’

‘আমার মনে হচ্ছে, আপনার খালি স্টমাকই এখন বড় সমস্যা।’

গাড়ির দরজায় এসে ক্লাউডিয়া আহমদ মুসাকে বলল, ‘আপনি পেছনের সিটে বসুন।’

‘কিছু মনে করবেন না, এটাই কি ভাল নয় যে, আমি সামনের সিটে বসলাম? পেছনে আপনারা চারজন বসলেন?’

ক্লাউডিয়া সংগে সংগেই হেসে বলল, ‘একটু ভুল হয়েছিল আমার। ঠিক আছে।’ মনে মনে লজ্জিত হলো ক্লাউডিয়া। আহমদ মুসা মুসলিম এবং মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশা ও সংগ এড়িয়ে চলে, এ কথা সে ভুলে গিয়েছিল।

‘থ্যাংকস।’ বলে আহমদ মুসা সামনের সিটে গিয়ে বসল।

ক্লাউডিয়া এসে বসল ড্রাইভিং সিটে।

জিয়ানা পেছনের পিকআপ থেকে একটা ক্যান এনে আহমদ মুসার হাতে দিয়ে বলল, ‘প্রথমে এটা খেয়ে নিন। শরীরটা ভাল লাগবে। তারপর স্ন্যাকস খেয়ে নিন।’ বলে স্যান্ডউইচের একটা ঠোঙাও তার হাতে দিল।

ক্যানটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ক্লাউডিয়া বলল, ‘তুমি ভুল করেছ জিয়ানা। ইনি মুসলিম, ব্র্যান্ডি কেন, মদ জাতীয় কিছু খান না। তুমি জুস এনে দাও।’

‘স্যরি।’ বলে জিয়ানা ব্র্যান্ডির ক্যান ফিরিয়ে নিল এবং জুস এনে দিল।

পিকআপ থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে জিয়ানা গাড়ির পেছনে প্রবেশ করল।

আহমদ মুসা বুঝল, গাড়ি অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে তার আহত স্থানের শুশ্রুষা করা ওদের ইচ্ছা।

গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।

‘ডাঃ জিয়ানা, আমি কি ফাস্ট এইড বক্সটা পেতে পারি?’ বলল আহমদ মুসা।

‘অবশ্যই। কিন্তু ফাস্ট এইড বক্সের আপনি কি চান?’ বলল জিয়ানা।

‘গোটা বক্সটাই।’

জিয়ানা ফাস্ট এইড বক্স বাড়িয়ে ধরল আহমদ মুসার দিকে।

‘থ্যাংকস’ বলে বক্সটি নিল আহমদ মুসা।

‘আমরা সামনে কোথাও দাঁড়াব। আপনার ক্ষতস্থানটা ড্রেসিং করতে হবে।’ বলল জিয়ানা।

‘ঠিক আছে। আপনার কাজটা যতদূর পারি এগিয়ে দিচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা স্পিরিটে তুলা ভিজিয়ে মাথার ক্ষতটা পরিষ্কার করতে লাগল।

‘ক্লাউডিয়া, ওর পরিচয় দিলে না, তোমাদের পরিচয়ের কথাও বললে না।’ বলল রিশলা।

ক্লাউডিয়া একটু হাসল। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে সামনের দিক থেকে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে এনে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘জনাব, ওরা সকলে আমার এবং সুমাইয়ার বন্ধু। আপনার পরিচয় যদি বলি আপত্তি নেই তো?’

‘পরিচয়টা আনন্দদায়ক হবে না। তবু নিরানন্দের ভাগ ওদের দিতে পারেন।’ আহমদ মুসা বলল।

‘বাহ, আপনি বুঝি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন? সুন্দর সাহিত্যের ভাষায় কথা বলেন।’ বলল জিয়ানা।

আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কথা বলে উঠল ক্লাউডিয়া। বলল, ‘সুমাইয়া, তুমি ওদের একটু ব্রিফ করো।’

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। আহমদ মুসা তুলা দিয়ে মাথার আঘাত পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আর সুমাইয়া রিশলা, নেকা ও জিয়ানার মাথা দু’হাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে আহমদ মুসার কাহিনী বলছিল। অন্যদিকে ক্লাউডিয়ার শূন্য দৃষ্টি সামনে প্রসারিত।

এক সময় সুমাইয়ার ব্রিফ শেষ হলো। জিয়ানা, রিশলা ও নেকার মাথা খাড়া হলো। তাদের মুখ গম্ভীর, চোখে-মুখে বিস্ময়! ব্রিফ শোনার শুরুতে তাদের যে চটুলতা ছিল, হালকা মনোভাব ছিল, তা এখন নেই। সবাই ভাবছে, আর যতটুকু পারে দেখছে আহমদ মুসাকে।

ক্লাউডিয়া তার শূন্য দৃষ্টিটা এক সময় ফিরিয়ে নিল আহমদ মুসার মুখের উপর। আবার ফিরিয়ে নিল তার দৃষ্টিটা। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘ডোনা কেমন আছে?’

‘ডোনা? ডোনাকে আপনি চেনেন?’

‘আমাদের ‘আপনি’ না বললেই কি নয়?’

একটু থেমে আবার শুরু করল, ‘ডোনা আমার বন্ধু, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।’

‘ডোনার সাথে আমার পরিচয়ের কথা কি করে জানলেন?’

‘শুধু পরিচয় নয়, ডোনার সৌভাগ্যের কথাও জানি।’

‘কি সৌভাগ্য?’

মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল ক্লাউডিয়ার ঠোঁটে। বলল, ‘থাক ওসব কথা। আপনার মাথার ড্রেসিংটা হয়ে যাক।’ বলে ক্লাউডিয়া গাড়ি রাস্তা থেকে নামিয়ে নিল এবং ঝোপ ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করাল।

জায়গাটা নিরিবিলি সুন্দর। দক্ষিণ পাশ দিয়ে হাইওয়েটা পূর্বে কুমেটের দিকে চলে গেছে। কিন্তু রাস্তার পাশ দিয়ে গাছ এবং ঝোপ এত ঘন যে, রাস্তা থেকে এ জায়গাটা দেখাই যায় না। পূর্ব পাশ দিয়ে একটা পাকা রাস্তা হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে উত্তরে বনের ভেতরে চলে গেছে। হাইওয়ে থেকে বেরুবার পর প্রথম দিকে রাস্তাটার দু’পার্শ্ব বনাচ্ছাদিত হলেও পরে তা ফাঁকা এবং জায়গাটার পূর্ব পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। ফাঁকা জায়গার মাঝখানে একটা সুন্দর সবুজ টিলা।

নামল ক্লাউডিয়া গাড়ি থেকে। বলল, ‘এস জিয়ানা, ড্রেসিংটা করে দাও।’

সুমাইয়ার কাছ থেকে জিয়ানা, রিশলা ও নেকা আহমদ মুসার পরিচয় পাবার পর প্রায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। অবাক হয়ে তারা দেখছিল আহমদ মুসাকে।

আহমদ মুসা বেরিয়ে এল। বলল, ‘ক্লাউডিয়া, তোমাদের সব কথা বলা হয়নি। খুব সংকটে আছি। এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট না করলে ভাল হতো।’

‘সংকটটা আমাদের বলুন। ইতোমধ্যে জিয়ানা মাথার ড্রেসিংটা করে দেবে।’ বলল সুমাইয়া।

সুমাইয়া, জিয়ানা, রিশলা, নেকা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল।

জিয়ানা গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। মুখে তার কোন কথা নেই। বিস্ময়-বোবা দৃষ্টি তার চোখে। জিয়ানার মধ্যে দ্বিধাগ্রস্থতা।

‘রোগী যে-ই হোক, সে ডাক্তারের অধীন।’ জিয়ানার দিকে চেয়ে ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে বলল ক্লাউডিয়া।

‘না, তা নয়। আমি ভাবছিলাম আমার সৌভাগ্যের কথা।’ বলে জিয়ানা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব, আপত্তি না থাকলে আপনি বসুন। আমার সুবিধা হবে।’

ফাস্ট এইড বক্স খুলে কাজ শুরু করল জিয়ানা।

‘এবার আপনার সংকটের কথা বলুন।’ কিছু হালকা সুরে বলল সুমাইয়া।

‘এ সংকট জীবন-মৃত্যুর একটা বাজি খেলা সুমাইয়া।’

‘জানি জনাব, আপনি সামান্য কিছুতে জড়ান না।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সুমাইয়া। তার কথায় তারল্য আর নেই।

‘খুব সামান্যের মধ্যে অসামান্য দুঃখ-বেদনা থাকতে পারে সুমাইয়া।’ বলল আহমদ মুসা।

‘সামান্য আমি সে অর্থে বলিনি।’ বলল সুমাইয়া।

‘সামান্যের হস্ত স্পর্শেও সামান্য অনেক সময় অসামান্য হয়ে ওঠে।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘সামান্যের কাছে যা যায়, তা প্রকৃতই অসামান্য নয়।’ বলল আহমদ মুসা।

একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘থাক এসব। ক্লাউডিয়া তুমি ওমর বায়ার কথা শুনেছ। আর সুমাইয়া তুমি ওমর বায়াকে দেখেছও।’

‘হ্যাঁ, তাকে কেন্দ্র করেই তো আপনার সাথে পরিচয়। কোন দিনই যা ভোলার নয়।’ বলল সুমাইয়া।

‘ওমর বায়াকে ব্ল্যাক ক্রস কিডন্যাপ করেছিল। গত রাতে তাকে উদ্ধার করেছিলাম। ভোর রাতেই তাকে আবার ওরা দ্বিতীয়বার কিডন্যাপ করতে সফল হয়েছে। ওদেরই পিছু…।’

কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ মুসা। উত্তর-পূর্ব বনের দিক থেকে গুলির শব্দ এল। শব্দ এল একের পর এক।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

জিয়ানা আহত জায়গাটার উপর তুলার একটা লেয়ার দিয়ে টেপ দিয়ে আটকে দিচ্ছিল। কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছিল।

আহমদ মুসা দাঁড়ালেও জিয়ানা টেপ আটকে দেয়ার কাজ শেষ করল।

‘ধন্যবাদ জিয়ানা, ডাক্তার আপনি।’ বলে আহমদ মুসা আবার মনোযোগ নিবদ্ধ করল গুলির শব্দের দিকে।

‘মনে হচ্ছে, গাড়ি করে গুলি করতে করতে কেউ বা কারা এগিয়ে আসছে। সম্ভবত কেউ কাউকে তাড়া করেছে।’

বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘ওরা এসে গেছে। ক্লাউডিয়া, তোমরা একটু গাড়ির আড়ালে যাও।’

ক্লাউডিয়া, জিয়ানা, সুমাইয়া, রিশলা, নেকা- সবার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল ভয়ে।

আহমদ মুসার কথা শুনেই নেকা ও রিশলা ছুটে গাড়ির আড়ালে চলে গেল। কিন্তু ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া ও জিয়ানা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে উদ্বিগ্নভাবে। বলতে চাচ্ছিল, আপনি বিপদগ্রস্থ, আপনি আহত, আপনারই প্রথম সরে যাওয়া দরকার। কিন্তু আহমদ মুসার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলার সাহস হলো না।

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার পর মুহূর্তও গেল না। তীরের বেগে একটা কার বেরিয়ে এল রাস্তা ধরে বনের দিক থেকে। পাগলের মত তীব্র গতিতে ছুটে গাড়িটা হাইওয়েতে উঠতে চাচ্ছিল।

আবার গুলির শব্দ হলো। একই সাথে দুই গুলি।

বিকট শব্দ উঠলো টায়ার ফাটার। এবং তার সাথে সাথে ছুটে আসা গাড়িটা একটা পাক খেয়ে রাস্তা থেকে মাঠে প্রবেশ করে মুখ থুবড়ে পড়ে থেমে গেল আহমদ মুসার কাছ থেকে মাত্র অল্প কিছু দূরে।

ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকটি গাড়ি তীব্র বেগে প্রবেশ করল মাঠে।

আগেই মাঠে ঢোকা মুখ থুবড়ে পড়া গাড়ি থেকে একজন তরুণ ও একজন তরুণী বেরিয়ে এল। তাদের চোখে-মুখে প্রবল শংকা। মৃত্যু যেন নাচছে তাদের দৃষ্টিতে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা তরুণটি একবার চারদিকে চেয়ে দৌঁড় দিল আহমদ মুসার দিকে।

ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’জন রিভলভারধারী। তাদের একজন রিভলভার তুলল তরুণটির উদ্দেশ্যে।

আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল স্থির দৃষ্টিতে ওদিকে তাকিয়ে। দুই পকেটে তার দুই হাত।

তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া এবং জিয়ানা। ঘটনার এই আকস্মিতায় তারা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। গাড়ির পেছনে পালাবার নির্দেশ তারা ভুলে গিয়েছিল। তাদের চোখে-মুখে ভয়-উদ্বেগ ঠিকরে পড়ছে।

আহমদ মুসা তরুণটিকে বাঁচাবার জন্যে চেষ্টার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।

ঠিক সময়েই তার ডান হাত রিভলভারসমেত বেরিয়ে এল পকেট থেকে। আহমদ মুসা তরুণকে লক্ষ্য করে উদ্যত হয়ে উঠা রিভলভারধারী লোকটির হাত লক্ষ্যে গুলি করল। অব্যর্থ লক্ষ্য। লোকটার হাত থেকে রিভলভার পড়ে গেল। লোকটা বাম হাত দিয়ে চেপে ধরল ডান হাত।

কিন্তু আহমদ মুসার গুলির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই পেছনের গাড়ি থেকে নামা দ্বিতীয় ব্যক্তির রিভলভার উদ্যত হলো আহমদ মুসার লক্ষ্যে।

আহমদ মুসার রিভলভারের নলও চোখের পলকে ঘুরে গেল তার দিকে। কিন্তু এবার আহমদ মুসা দ্বিতীয় লোকটির হাতের দিকে লক্ষ্য স্থির করার সময় পেল না। রিভলভারের নল ঘুরে এসেই স্থূল লক্ষ্যে গুলি বর্ষণ করল।

গুলিটি লোকটির বক্ষ ভেদ করল। উদ্যত হয়ে উঠা তার হাতের রিভলভারসমেতই ঢলে পড়ে গেল সে।

হাতে গুলিবিদ্ধ লোকটি গুলি খাওয়ার পর মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে সে বের করে এনেছে টেবিল টেনিস বলের মত একটা হ্যান্ড গ্রেনেড। হাত উঠে আসছে তার মাথার উপর।

দ্বিতীয় গুলি ছোঁড়ার পর সেকেন্ডের মধ্যেই তৃতীয় গুলি বেরিয়ে এল আহমদ মুসার রিভলভার থেকে।

গুলিটা সম্ভবত আবার লোকটির হাতেই আঘাত করল। শব্দ উঠলো ভয়াবহ বিস্ফোরণের। বিস্ফোরিত হয়েছে হ্যান্ড গ্রেনেডটি লোকটির হাতেই। তারপর যা ঘটল তা দেখার মত নয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল লোকটির দেহ।

ক্লাউডিয়াদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। হ্যান্ড গ্রেনেডটি তাদের উপর এসে পড়লে এতক্ষণে তাদের অবস্থাও ঐ দেহের মতই হতো।

আহমদ মুসা রিভলভার পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘ওদের আমি চিনি না। আমি এ ছেলেটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, মারতে ওদের আমি চাইনি। কিন্তু…’

ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া, জিয়ানা পেছন থেকে আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রিশলা এবং নেকাও এসেছে। তাদের চোখে-মুখে আগের সেই মৃত্যুভয় নেই। কিন্তু উদ্বেগে বিবর্ণ তাদের মুখ।

‘কিন্তু কি?’ প্রশ্ন করল জিয়ানা শুষ্ক কণ্ঠে।

‘কিন্তু আমি না মরে ওদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। জানি না ওরা কারা। সাংঘাতিক বেপরোয়া। সাধারণত এমনটা দেখা যায় না।’ বলল আহমদ মুসা।

সেই তরুণ-তরুণী দু’জন মাটিতে শুয়ে পড়েছিল। তারা ছুটে এসে আহমদ মুসার পায়ের উপর পড়ে গেল। কেঁদে উঠল। বলল, ‘আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন।’

আহমদ মুসা ওদের হাত ধরে তুলল। বলল, ‘কাউকে বাঁচাবো সাধ্য কি আমার! আল্লাহ তোমাদের বাঁচিয়েছেন। আমি আমার কর্তব্য করেছি।’

তরুণ-তরুণী দু’জন তখনও কাঁপছিল। তরুণীটি ক্লাউডিয়াদের বয়সের। তরুণটি আহমদ মুসা থেকে দুই-চার বছরের ছোট। দেখে তাদের দু’জনকেই ছাত্র মনে হচ্ছে। সহজ-সরল মুখের ভাব। জীবনসংগ্রামের চিহ্ন তাতে নেই।

ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়া গিয়ে তরুণীটিকে কাছে টেনে নিল।

আর আহমদ মুসা কথা শেষ করে তরুণটির কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘এত ভয় কেন? ওরা এখন নেই।’

‘না, ওরা আছে। ওরা অনেক।’

‘ওরা কারা? কি শত্রুতা ওদের সাথে তোমাদের?’

‘সে অনেক কথা। ওরা…’

‘থাক এখন।’

বলে তরুণটিকে থামিয়ে ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘এখান থেকে এখনি আমাদের চলে যাওয়া দরকার। অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই।’

‘ঠিক বলেছেন।’

বলে সে গাড়ির দিকে এগোলো।

তার সাথে সকলে।

গাদাগাদি করে সবাই ক্লাউডিয়াদের গাড়িতেই উঠল।

ড্রাইভিং সিটে বসল আবার ক্লাউডিয়াই।

মাঠ থেকে গাড়ি বেরিয়ে ছুটল কুমেট-এর দিকে।

গাড়িটি কুমেট শহরের প্রবেশ মুখে পৌঁছলে আহমদ মুসা পকেট থেকে রিমোট সেন্সর বের করল।

রিমোট সেন্সরটি দুই ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি একটি আয়তাকার পাত। এর নিচের দিকে ক্ষুদ্রাকার কয়েকটি বোতাম আছে। এবং উপরের দিকে একটি স্ক্রীন।

আহমদ মুসার মনে একটা দুশ্চিন্তা উঁকি দিয়ে আছে। যদি ব্ল্যাক ক্রসের গাড়িটা কুমেটে না ঢুকে বন্দর অথবা হাইওয়ে ধরে ‘কুমপেল’-এর দিকে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে এতক্ষণে সেটা রিমোট সেন্সরের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

দুরু দুরু মন নিয়েই আহমদ মুসা রিমোট সেন্সর-এর একটা নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দিল।

আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। সেন্সর কথা বলেছে। সেন্সরের স্ক্রীনে লাল অ্যারো বাম পাশ ইন্ডিকেট করল।

আহমদ মুসা বলল, ‘ক্লাউডিয়া, বামে কুমেট, ডানের রাস্তা উপকূলীয় শহর অ্যাবে ও গালভিনেক এবং সামনের হাইওয়ে পুবে কুমপারলে নগরীর দিকে গেছে, তা-ই কিনা?’

ড্রাইভিং সিটে বসা ক্লাউডিয়া এবং আহমদ মুসার পাশে বসা তরুণ, দু’জনের দৃষ্টি সে সময় আহমদ মুসার হাতের দিকে নিবদ্ধ ছিল। সব ব্যাপারটা তারা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল যে, ওটা সূক্ষ কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র।

আর তরুণটির চোখে-মুখে বিস্ময়-বিমূঢ়তা এবং সেই সাথে প্রবল একটা ভীতির ভাব লেগেই ছিল। এখনও তার কাছে স্বপ্নই মনে হচ্ছে যে, তার পাশে বসা মাঝারি গড়নের প্রায় তার সমবয়সী এই যুবক প্রায় পাখি শিকারের মত করে ভয়ানক দুই লোককে হত্যা করেছে। তার আব্বার কাছ থেকে সে শুনেছে, এই ভয়ানক লোকরা বিশ্বজোড়া অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অসীম শক্তিশালী একটা দলের সদস্য। এদের গায়ে হাত দেবার সাহস কারো নেই। এরা যা চাইবে তাই করতে পারে। অথচ ওদের দু’জন এমনভাবে মরল যে, গুলি ছোঁড়ারও সময় পেল না। পরক্ষণেই আবার ভাবল সে, লোকটি সাধারণ বটে, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি ও মুখের ভাবের দিকে তাকালেই মনে হয়, সে অসাধারণ। লাখো লোকের মধ্যে দাঁড়ালেও তাকে আলাদা করা যাবে। তার দেহের স্পর্শ এবং তার হাত দু’টি দেখতে মনে হচ্ছে খুবই কোমল, কিন্তু গুলি ছোঁড়ার ঐ সময় তাকে মনে হয়েছিল ঋজু এক ইস্পাতের খণ্ড। আর কথা শুনে তাকে মনে হচ্ছে অত্যন্ত সপ্রভিত এবং নরমভাষী কোন অধ্যাপক।

‘আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু এ খোঁজ কেন?’ আহমদ মুসার প্রশ্নের জবাবে বলল ক্লাউডিয়া।

আহমদ মুসা ক্লাউডিয়ার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘তোমরা কোথায় যাবে?’

‘যাওয়ার কথা ছিল কুমেট এয়ারপোর্টে।’

‘ও, তোমরা কোন প্রোগ্রামে এসেছিলে, এখন যে যার বাড়িতে ফিরছো?’

‘কেমন করে বুঝলেন?’

‘তোমাদের লাগেজ এবং ‘অল ফ্রান্স গার্লস ক্যাডেট কোর’-এর স্টিকার দেখে।’

‘যাওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্টে, কিন্তু এখন যাচ্ছি না।’

‘কোথায় যাবেন?’

‘কারও আপত্তি না থাকলে আমাদের ক্যাডেট কোরের রেস্টহাউসে উঠবো।’

আহমদ মুসা তরুণের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনার নাম কি? আপনারা কোথায় যাবেন?’

‘আমি রালফ ফ্রিক আর ও আমার স্ত্রী ডেবরা ল্যাসজার। প্যারিসের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। আমরা ভ্যাকেশনে গিয়েছিলাম আমেরিকা। প্যারিস ফেরার পথে কুমেটে এসেছিলাম খালার সাথে দেখা করতে। আমরা এখন প্যারিস ফিরব।’

‘কিন্তু এখন কোথায় যেতে চান?’

মুহূর্তখানেক ভাবল। তারপর বলল, ‘খালা আম্মার ওখানে যেতে চাই না। ওখানে ওরা চোখ রাখবে নিশ্চয়। কিন্তু ওখানে টিকেট, লাগেজ সব আছে।’

কথা শেষ না করেই চুপ করল তরুণটি। আহমদ মুসা বুঝল, কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছে না। ভয় করছে?

‘তাহলে এদের সাথে ক্যাডেট কোরের রেস্টহাউসে গিয়ে উঠুন। এরা আপনাদের সহযোগিতা করবে।’

‘আপনার কথায় মনে হচ্ছে, আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন না।’ পেছন থেকে বলল সুমাইয়া।

‘হ্যাঁ বোন, আমাকে এখানে নামতে হবে।’

‘কিন্তু আপনি আহত, অসুস্থ। আপনার চিকিৎসার কিছুই হয়নি এখনও।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘কিন্তু ক্লাউডিয়া, আমার চেয়ে খারাপ অবস্থা ওমর বায়ার, যাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওরা এখনও এই শহরে রয়েছে।’

‘ঠিক আছে। আমরা শহরেই ঢুকছি। কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে বলুন।’ ক্লাউডিয়া বলল।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘কোথায় যেতে হবে জানি না। কি করতে হবে সে ব্যাপারে এটুকুই জানি যে, এখানে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কিডন্যাপকারী সেই গাড়িকে খুঁজে বের করব। তারপর দেখতে হবে কি করা যায়।’

‘আমাদের গাড়ি আছে। আমরা খোঁজায় তো আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি।’

‘এসব কাজ দল বেঁধে হয় না। তোমরা এদের নিয়ে রেস্টহাউসে যাও। টিকেট ও লাগেজ এনে দাও ওদের। আমার মনে হয়, তোমরা একসাথেই প্যারিস যেতে পারবে।’

বলে আহমদ মুসা একটু থেমেই আবার বলল, ‘তোমাদের কারও কি জেন্টস ডিজাইন এর হ্যাট আছে?’

‘আমার আছে, যদি আপনি পছন্দ করেন।’ বলল জিয়ানা।

বলে সে হ্যাট আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।

আহমদ মুসা হ্যাটটি হাতে নিতে নিতে বলল, ‘ধন্যবাদ, খুব ভাল হ্যাট।’

‘ওয়েলকাম।’ বলল জিয়ানা।

‘সামনে গাছতলাটায় আমাকে নামিয়ে দাও ক্লাউডিয়া।’

ক্লাউডিয়ার মুখ গম্ভীর। এভাবে আহমদ মুসার নেমে যাওয়াটাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মনের কোথায় যেন খচ খচ করে উঠছে একটা বেদনা।

ক্লাউডিয়া গাছের ছায়ায় নিয়ে দাঁড় করাল গাড়ি। গাড়ি দাঁড় করিয়েই ক্লাউডিয়া গাড়ি থেকে নেমে গাড়ি ঘুরে এসে আহমদ মুসার দরজা খুলে ধরল।

ডেবরা ছাড়া জিয়ানা, সুমাইয়ারাও নেমে এসেছে।

আহমদ মুসা নেমে এল। সুমাইয়া বলল, ‘আমাদের কি কিছুই করার নেই?’

‘দোয়া কর বোন।’ বলল আহমদ মুসা।

জিয়ানা আহমদ মুসার হাত থেকে হ্যাটটি নিয়ে আহমদ মুসার মাথায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাহ, আমার চেয়ে আপনার মাথা বড় নয়।’

‘ডাক্তারদের মাথা কারো চেয়ে ছোট হয় না।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।

‘আমি মগজ বড়োর কথা বলিনি।’

‘না মাপার আগে ছোটও বলতে পার না।’

কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ক্লাউডিয়ার ভার হয়ে থাকা মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘ রেস্টহাউস কোথায়?’

‘সাগর থেকে উঠে আসা খাঁড়ির একদম উত্তর মাথায় পুবপাশের প্রথম পাহাড়টায়।’

‘থ্যাংকস। তোমরা যাও। আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নেব।’

ক্লাউডিয়া আহমদ মুসার কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি মিলল। হাত তুলে ডাকল ক্লাউডিয়া।

ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো ক্লাউডিয়ার গাড়ির পেছনে। আহমদ মুসা সেদিকে এগিয়ে বলল, ‘শহরটা একটু ঘুরব। ঠিক আছে?’

মাথা নেড়ে ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘ওয়েলকাম স্যার।’

আহমদ মুসা উঠল গাড়িতে।

ছেড়ে দিল গাড়ি।

‘ওদে’ নদী কুমেট শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে আটলান্টিক থেকে উঠে আসা খাঁড়িতে গিয়ে পড়েছে। নদী ও খাঁড়ির মিলনস্থল থেকে সোজা সিকি মাইল পশ্চিমে একটা ছোট টিলার উপর দেয়াল ঘেরা একটা তিনতলা বাড়ি।

একটা রাস্তা বাড়ির গেটে গিয়ে শেষ হয়েছে। বাড়িতে একটাই গেট।

গেট পেরোলে একটা লাল ইট বিছানো রাস্তা গাড়ি বারান্দায় গিয়ে শেষ হয়েছে। গাড়ি বারান্দা থেকে সিঁড়ির তিনটি ধাপ পেরিয়ে উঠলে কাঠের একটা সুদৃশ্য দরজা। দরজা পার হলে একটা করিডোর। দু’দিকে কক্ষ। করিডোর কিছুদূর সামনে এগিয়ে একটা বিশাল হল ঘরের দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে।

হল ঘরটি সুন্দরভাবে সাজানো। হল ঘরের দু’প্রান্ত থেকে দু’টি সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। ডানদিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকের সিঁড়ির গোড়া থেকে দক্ষিণ দেয়ালের সাথে একটা দরজা খুললেই দেখা যাবে, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে বেজমেন্টে। বেজমেন্টেও উপর তলার মত হল ঘর এবং কক্ষের সারি।

সেই কক্ষগুলোরই একটি। একেবারে এক প্রান্তে। ওমর বায়া চেয়ারে বসা। তার হাতদু’টি চেয়ারের হাতলের সাথে বাঁধা। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। ঠোঁটের কোণ বেয়ে রক্ত ঝরছে। তার মাথাটা চেয়ারের উপর নেতিয়ে পড়া।

একটা গরিলা সদৃশ লোক দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের একপাশে। তার চোখ দু’টি জ্বলছিল যেন হিংসার আগুনে।

পিয়েরে পল বলছিল, ‘তোর জন্যে আমাদের যে লোকক্ষয় হয়েছে, যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে তোর প্রতি অণু কেটে কেটে জ্বালিয়ে দিলেও আমাদের জ্বালা মিটবে না। কিন্তু তোকে মারবো না। মারলে তুই জিতে যাবি। আর আমরা হেরে যাব, ব্ল্যাক ক্রস হেরে যাবে। কিন্তু পবিত্র ক্রস হারবে না।’

বলে একটু দম নিল পিয়েরে পল। কয়েক রাউন্ড পায়চারি করল মেঝেতে। তারপর ওমর বায়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জানিস, তোকে আর কেউ কোন দিন উদ্ধার করতে আসবে না। শয়তানের শয়তান আহমদ মুসাকে আমরা ধ্বংস করেছি।’

ওমর বায়া তার বন্ধ চোখটা খুলল। তার চোখে অনেকটা বিদ্রুপের ভাব ফুটে উঠেছে। বলল, ‘তার কেশ স্পর্শ করার সাধ্য আপনাদের নেই। উনি হলেন ক্রিসেন্টের বিজয়ের প্রতীক। এই প্রতীককে ধ্বংস করার সাধ্য আপনাদের নেই।’

হো হো করে হেসে উঠল পিয়েরে পল। বলল, ‘তোমাদের ক্রিসেন্টের প্রতীক একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। শয়তানের শয়তান আহমদ মুসা তোমাকে উদ্ধারের আশায় গাড়ি নিয়ে আমাদের অনুসরণ করছিল। আমাদের চকোলেট বোমা তাকে গাড়িসুদ্ধ শেষ করে দিয়েছে।’

‘আমি বিশ্বাস করি না। ক্রিসেন্টের প্রতীককে তোমরা ধ্বংস করতে পার না।’

‘আহমদ মুসার সাথে লড়াইয়ে কিছু ভুল ব্ল্যাক ক্রস করেছে। কিন্তু এবার ভুল হয়নি। আমরা ‘লা ইল’ থেকে খবর পেলাম, রেস্টহাউস থেকে যে লোকটি গাড়ি নিয়ে আমাদের অনুসরণ করেছিল, তার বিছানার ‘স্মেল টেস্ট’ প্রমাণ করেছে, অনুসরণকারী লোকটি আহমদ মুসা ছিল। সুতরাং, তোমাদের ক্রিসেন্ট অস্তমিত।’

ওমর বায়ার চোখে-মুখে অন্ধকার নেমে এল। কুমেটে প্রবেশের কিছু আগে সেও তাদের গাড়ির পেছনে ভয়ানক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছে এবং খুশিতে ওদের উল্লাসও সে দেখেছে। দুর্বল হয়ে পড়ল তার মন। তবু বলল সে, ‘মিঃ পল, ক্রস ভেঙে যায়, কিন্তু ক্রিসেন্ট অস্তমিত হয় না।’

ওমর বায়ার কথা শেষ হবার আগেই ফুঁসে উঠল পিয়েরে পল। কয়েক ধাপ এগিয়ে ওমর বায়ার মুখে একটা থাপ্পড় ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘শয়তানের বাচ্চা, সব দেখে-বুঝেও এ কথা বলছিস? পাঁচশ’ বছর আগে ক্রিসেন্টের তেজ নিভে গেছে এবং ক্রসের পায়ে দলিত হয়েছে। কোথায় তোমার ক্রিসেন্ট? ক্রসের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন বাড়ি-ঘর সব ফেলে?’

‘আর পালিয়ে বেড়াব না। নিজেকে এবার মুক্ত করতে পারলে বাড়িতে ফিরে যাব।’

‘ওয়েলকাম। আমরা এটাই চাই। তবে মুক্ত হয়ে নয়, আমাদের সম্মানিত অতিথি হয়ে যেতে হবে।’ বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল।

এসময় ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল একজন।

পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল পিয়েরে পল। লোকটিকে দেখেই বলল, ‘ফ্রান্সিস বাইক এসেছেন?’

লোকটি রুশো ডান্টন। ব্ল্যাক ক্রসের কুমেট অঞ্চলের প্রধান।

এই বাড়িটি ব্ল্যাক ক্রসের একটা বড় ঘাঁটি। রুশো ডান্টন এই ঘাঁটিরও প্রধান। ‘কোক’ প্রধান ও ‘ওকুয়া’-এর উপদেষ্টা ফ্রান্সিস বাইক ব্ল্যাক ক্রসের এ ঘাঁটিতে ছিল বলেই পিয়েরে পল ওমর বায়াকে নিয়ে এখানে এসেছে। পিয়েরে পল এসে ফ্রান্সিস বাইককে পায়নি। রুশো ডান্টনকে লাগিয়েছিল পিয়েরে পল তাকেই খুঁজে বের করতে।

পিয়েরে পল কক্ষ থেকে বের হলো। রুশো ডান্টনকে নিয়ে সে উঠে এল বেজমেন্ট থেকে এবং প্রবেশ করল একতলার সেই বড় হল ঘরটায়।

ফ্রান্সিস বাইক বসেছিল সোফায়। পিয়েরে পল ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল।

দু’জন হ্যান্ডশেক করল এবং পিয়েরে পল পাশের সোফায় ফ্রান্সিস বাইকের মুখোমুখি বসল।

বসেই ফ্রান্সিস বাইক বলল, ‘আমি দু্ঃখিত মিঃ পল, সব কথা আমি রুশোর কাছে শুনলাম।’

‘অপূরণীয় ক্ষতি স্বীকার করেও আমরা ওমর বায়াকে ছাড়িনি।’

‘আমি কৃতজ্ঞ মিঃ পল। এ ক্ষতি পূরণ করা ‘কোক’ (KOC-Kingdom of Christ) ও ‘ওকুয়া’ (AOCOWA-Army of Christ of West Africa)-এর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আর্থিক ক্ষতির দিকটা আমরা পূরণ করবো।’

‘থ্যাংকস ফ্রান্সিস। মানসিকভাবে আমি বিপর্যস্ত। ফ্রান্সে আমাদের প্রথম শ্রেণীর যে জনশক্তি ছিল তার অর্ধেকেরও বেশি শেষ হয়ে গেছে।’

‘আমি বুঝতে পারছি না মাত্র একজন লোক…।’

কথা শেষ না করেই ফ্রান্সিস বাইক থেমে গেল।

‘আমাদের লোকেরা অনেকে বলে, তার পাশে তার আল্লাহও নাকি যাদু করে। তবে জেনে খুশি হবেন, তার আল্লাহ তাকে বাঁচাতে পারেনি। আমাদের অনুসরণ করছিল। রিজার্ভ ফরেস্টের রাস্তায় তাকে আমরা তার গাড়িসুদ্ধ খতম করে দিয়েছি।’

খুশি হওয়ার চেয়ে ফ্রান্সিস চমকে উঠলই বেশি। বলল, ‘সত্যিই মরেছে?’

‘অবশ্যই। বাঁচবার চেষ্টা করারও সুযোগ আমরা দেইনি।’

‘ঘটনা যদি সত্যি হয়, তাহলে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঘটনা আজ সংঘটিত হলো। আহমদ মুসা মুসলমানদের কাছে বিজয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

‘যদি সত্যি হয় বলছেন কেন? আপনি কি বিশ্বাস করতে পারছেন না?’

‘মিঃ পল, অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। ঘটনা এত বড় যে ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার না করলে এর প্রতি যথার্থ মর্যাদা দেয়া হয় না। ব্ল্যাক ক্রস ইচ্ছে করলে এই খবর বিক্রি করে ইহুদী, চীন, রাশিয়া ও পশ্চিমের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার আদায় করতে পারে।’

‘ধন্যবাদ ফ্রান্সিস। সে চিন্তা আমাদের আছে।’

‘এখন বলুন, আমরা কি করতে যাচ্ছি?’

‘আমরা ওমর বায়ার মাইন্ড কন্ট্রোল প্রচেষ্টার পাশাপাশি আরেকটা বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছিলাম। প্যারিসের ‘ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব ল’-এর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ডঃ ডিফরজিস ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিস ডঃ উসাম বাইকের পালক পিতা। তিনি যদি চীফ জাস্টিসকে বলে দেন, তাহলে ওমর বায়ার স্বাক্ষরযুক্ত দরখাস্ত নিয়ে গিয়ে গোটা কেসটাই প্রত্যাহার করানো যেতে পারে। আমি ক্যামেরুনের শাসনতন্ত্র ও আইন বিষয়ে এক্সপার্ট একজন আইনজ্ঞের সাথে আলোচনা করেছি। তিনি বলেছেন, ওমর বায়া যদি এখন গোটা কেসটাই উইথড্র করতে চান, তাহলে কোর্টের মাধ্যমে তার সম্পত্তির যে বিধি ব্যবস্থা করেছে সবই বাতিল হয়ে যাবে, ঠিক উইল বাতিল করার মত। তবে এ ব্যাপারে হ্যাঁ বা না বলার এখতিয়ার চীফ জাস্টিসের। তিনি ইচ্ছে করলে ওমর বায়ার হাজিরা ছাড়াই তার নিয়োগকৃত এ্যটর্নির হিয়ারিং নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।’

‘খুব ভাল কথা। এ চেষ্টার কতদূর?’

‘ডঃ ডিফরজিস আমাদের কথায় এ পর্যন্ত রাজি হননি। আমরা একটা মোক্ষম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এখন তিনি আমাদের কথায় আসতে বাধ্য হবেন।’

ঠিক এ সময় রুশো ডান্টন দ্রুত হল রুমে প্রবেশ করল। তার চোখে-মুখে প্রবল উত্তেজনা।

পিয়েরে পল এবং ফ্রান্সিস বাইক দু’জনেই তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল।

‘কি হয়েছে রুশো? কি ঘটেছে?’ বলল মিঃ পল।

‘ডঃ ডিফরজিস–এর ছেলে রালফ ফ্রিক ও তার স্ত্রী পালিয়েছে। আমাদের পেরী ও লেভী নিহত।’

‘রালফরা পালিয়েছে! পেরী-লেভী নিহত!!’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়েছে মিঃ পল। বিস্ময় ও ক্রোধ মিশ্রিত হয়ে তার মুখ বিকৃত করে তুলেছে। ধীরে ধীরে প্রতিহিংসার আগুন সেখানে ধক ধক করে উঠল।

মুহূর্ত কয়েক পরে সোফায় বসে পড়ল পিয়েরে পল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল রুশো ডান্টন।

‘রালফ–এর মতো এক দুগ্ধপোষ্য ছেলে এবং এক বালিকা হত্যা করেছে পেরী ও লেভীকে, এ কথা বিশ্বাস করতে বল?’

‘মনে হয় তা নয়। ওদের লাশ পাওয়া গেছে আমাদের ফরেস্ট ঘাঁটি থেকে সাত মাইল দক্ষিণে কুমেট হাইওয়ের পাশে এক মাঠে। মাঠে পাওয়া গেছে পর পর দুটো গাড়ি। দুটোই আমাদের।’

‘কিভাবে মারা গেছে?’

‘লেভীর বুকে গুলির আঘাত। আর সম্ভবত গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পেরীর দেহ।’

‘দু’টি গাড়িই আমাদের কেন? গাড়ি পরীক্ষা করেছ?’

‘গাড়ি দু’টি পনের গজ আগে-পিছে দাঁড়ানো। আগের গাড়িটির পেছনের ডানদিকের চাকা গুলিবিদ্ধ এবং টায়ার ফেটে গেছে।’

‘গাড়ি দু’টি কি রাস্তায়?’

‘না, দুটোই মাঠে প্রবেশ করা।’

চোখ বন্ধ করে মুহূর্ত কয়েক ভাবল পিয়েরে পল। তারপর চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আগের গাড়ির টায়ার ফুটো হয়েছে পেরী কিংবা লেভীর গুলিতে। সামনের গাড়ি লক্ষ্যে ব্ল্যাক ক্রসের গুলি সব সময় পেছনের ডান চাকাতেই লাগে।’

একটু থেমে নিয়ে আবার শুরু করল পিয়েরে পল, ‘পেছনের গাড়িতে ছিল পেরী এবং লেভী। আর সামনের গাড়িতে ছিল রালফ এবং তার স্ত্রী। রালফরা পালাচ্ছিল এবং পেরীরা ওদের তাড়া করেছিল। আমার মনে হয়, রালফরা হত্যা করেনি পেরীদের। কোন তৃতীয় পক্ষ হত্যা করেছে লেভীকে। কিন্তু পেরী নিজের হ্যান্ড গ্রেনেডেই মারা পড়েছে। কোন শত্রুপক্ষ হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়লে তারা শুরুতেই গাড়িসমেত পেরীদের উড়িয়ে দিত। এখন কে এই তৃতীয় পক্ষ!’

‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। পেরীদের মৃতদেহের দশ গজেক দূরে আয়োডিন মাখা কিছু তুলা পাওয়া গেছে। আয়োডিন ও তুলা রালফরা যোগাড় করতে পারার কথা নয়।’

‘কিন্তু কে এই তৃতীয় পক্ষ?’

বলে মুহূর্তকাল চিন্তা করেই মিঃ পল বলল, ‘রুশো, তুমি যাও এখনি, স্থানটা দেখে এস, কোন ক্লু পাও কিনা।’

‘অলরাইট, স্যার। আর কোন নির্দেশ?’

‘না। তুমি যাও।’

রুশো ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়েছিল। এমন সময় প্রায় চিৎকার করে উঠল পিয়েরে পল, ‘দাঁড়াও রুশো। গিয়ে কাজ নেই।’

থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরল রুশো। তাকাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পিয়েরে পলের দিকে।

‘ডঃ ডিফরজিসের কুমেট পৌঁছার কথা ক’টায়?’ দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল পল।

‘সময় তিনি জানাননি স্যার। বলেছেন, কুমেট পৌঁছে তিনি আমাদের নির্দিষ্ট জায়গায় সংকেত পৌঁছাবেন।’

‘আজ প্যারিস থেকে কুমেটে আসার কয়টা ফ্লাইট আছে?’

‘বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের চারটা ফ্লাইট আছে। একটা ভোর ছ’টায়, দ্বিতীয়টা বেলা বারটায়, তৃতীয়টা ছয়টায় এবং চতুর্থটি রাত বারটায়।’

পিয়েরে পল ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘এখন বেলা সাড়ে এগারোটা। এখনি তুমি তোমাদের লোকদের নিয়ে যাও। ডঃ ডিফরজিসকে কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে আসবে। আমার বিশ্বাস, ভোর ছ’টার ফ্লাইটে তিনি আসেননি। সামনের যে কোন একটা ফ্লাইট তিনি ধরবেন। এ তিনটা ফ্লাইট তোমাদের পাহারা দিতে হবে। ডঃ ডিফরজিসকে হাতে পাওয়াই এখনকার প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি কাজ।’

‘অলরাইট, স্যার।’ বলে বেরিয়ে গেল রুশো ডান্টন।

চোখ বুজল পিয়েরে পল সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে।

মুহূর্ত কয়েক পরে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল সোফায়। বলল, ‘ছেলে হারিয়ে বাপকে পাওয়া মন্দ হবে না। তৈরি হোন মিঃ ফ্রান্সিস, আগামী কালই আমরা ক্যামেরুন যাব ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে।’

‘কালকে? কেন? কি পরিকল্পনা?’ বিস্ময় ফুটে উঠল ফ্রান্সিস বাইকের চোখে।

‘বলেছি না যে, ডঃ ডিফরজিসের পালক পুত্র ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিস ডঃ উসাম বাইক। দেখবেন কি ঘটে। চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের কাজ আদায় পানির মত তরল হয়ে যাবে। ছেলেকে হারিয়ে বাপকে পেয়ে বরং ভালই হলো।’

ফ্রান্সিস বাইকের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ মিঃ পল। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে।’

‘চলুন তাহলে উঠি। মা মেরীকে ডাকুন, রুশো ডান্টন যাতে সফল হয় ডঃ ডিফরজিসকে হাতে পেতে।’

উঠল তারা দু’জনেই।

রিমোট সেন্সরটি আহমদ মুসার হাতেই ছিল। রিমোট সেন্সরের ইন্ডিকেটরের উপর নজর রেখেই নির্দেশ দিচ্ছিল ড্রাইভারকে কোন পথে কোন দিকে যেতে হবে।
‘স্যার, আপনি শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখবেন, না কোন ঠিকানায় যাবেন?’ বলল ড্রাইভার।
‘আমার এক পুরানো বন্ধুর ঠিকানা খুঁজছি। চিন্তা করো না, তোমাকে আমি ঠিকই নিয়ে যাব।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
‘গাড়ি কোথায় থাকতে পারে’– ভাবছিল আহমদ মুসা। ব্ল্যাক ক্রসের কোন বাড়িতে বা ঘাঁটিতে থাকাটাই স্বাভাবিক। যেখানেই থাক, বোঝা যাচ্ছে, গাড়িটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
রিমোট সেন্সরে দেখা যাচ্ছে, গাড়িটা এক মাইল দূরে রয়েছে।
লোকেশন ইন্ডিকেটর অনুসরণ করে আরও দুটো রাস্তা পরিবর্তন করল আহমদ মুসা।
রিমোট সেন্সরের ডিস্ট্যান্ট ইন্ডিকেটরে দ্রুত দূরত্ব কমে আসল।
‘আর পাঁচশ’ গজ’ দেখল আহমদ মুসা। মন চঞ্চল হয়ে উঠল তার।
তখন বেশ প্রশস্ত একটা রাস্তা দিয়ে চলছিল গাড়ি দক্ষিণ দিকে। লোকেশন ইন্ডিকেটরের ‘অ্যারো হেড’ তখন বিশ ডিগ্রী অ্যাংগেলে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বাঁকানো।
যতই দূরত্ব কমছে, ডিগ্রী বেড়ে যাচ্ছে। আহমদ মুসা বুঝল, এই রাস্তার পুবপাশের কোন বাড়িতে রাখা আছে গাড়িটা।
এক সময় স্থান নির্দেশক তীর চিহ্নের কৌণিক দূরত্ব নব্বই ডিগ্রীতে উঠল। দূরত্বজ্ঞাপক নির্দেশকে দূরত্ব তখন পঞ্চাশ গজ।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাতে নির্দেশ দিল। আহমদ মুসা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল, বাড়িটা একটা ‘অটোমোবাইল সার্ভিস সেন্টার।’ বুঝতে বিলম্ব হলো না আহমদ মুসার, সার্ভিসিং–এর জন্যে সার্ভিস সেন্টারে রেখে যাওয়া হয়েছে গাড়ি।
তেতো হয়ে উঠল আহমদ মুসার মন। পরক্ষণেই মনটা আবার সজীব হয়ে উঠল, একটু সময় বেশি যাবে তাতে কি? সার্ভিস সেন্টার থেকে ঠিকানা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে। আশংকার একটা কাল মেঘ মনের কোণায় উঁকি দিল, ব্ল্যাক ক্রসের ওরা যদি গাড়ি বদল করে কুমেট থেকে চলে গিয়ে থাকে! গাড়ির ঠিকানা নিয়ে সে কি করবে!
আহমদ মুসা মন থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনে মনে বলল, পরের কাজ পরে। এখনকার কাজ হলো, গাড়ির মালিক ব্ল্যাক ক্রস–এর ঠিকানা যোগাড় করা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে প্রবেশ করল সার্ভিস সেন্টারে।
সার্ভিস সেন্টারে আট-দশটার মত গাড়ি আছে। আহমদ মুসা ঢুকেই ব্ল্যাক ক্রসের গাড়িটা চিনতে পারল।
চত্বর পেরোলে সামনেই সার্ভিস শেড। সার্ভিস শেডের বাম পাশে অফিস বিল্ডিং। মাল্টি স্টোরিড।
সার্ভিস সেন্টারের সেলস ম্যানেজারের অফিস নিচতলায়, নেমপ্লেট দেখেই তা বুঝল আহমদ মুসা।
গট গট করে হেঁটে গিয়ে আহমদ মুসা প্রবেশ করল সেলস ম্যানেজারের অফিসে।
‘গুড মর্নিং।’ বলে শুভেচ্ছা জানাল আহমদ মুসা টেবিলের পেছনে বসা মাঝবয়সী লোকটিকে লক্ষ্য করে।
‘গুড মর্নিং।’ লোকটি আহমদ মুসার জবাব দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বসল। তারপর বলল, ‘বসুন।’
‘থ্যাংকস। বসতে পারছি না। তাড়া আছে। ‘প্যারিস-৯–৮৭৫৬২১’ নং গাড়ির মালিক আমাকে পাঠালেন সার্ভিস লিস্টে আরও কয়েকটা বিষয় যোগ করার জন্যে। দয়া করে অর্ডার ফর্মটা দিন, লিখে দেই।’
‘স্যরি, উনি কোন অর্ডার ফর্ম ফিলআপ করেননি। শুধু ওয়াশিং-এর জন্যে দিয়ে গেছেন। এর জন্যে আমাদের কোন অর্ডার শীট পূরণ করতে হয় না। শুধু ওয়াশিং টোকেন নিয়ে গেলেই চলে। টোকেনের ডুপ্লিকেট আমরা রাখি।’
বলে সেলস ম্যানেজার একটা ডুপ্লিকেট টোকেন বের করে টেবিলে রেখে বলল, ‘এটাই ওর ডুপ্লিকেট টোকেন।’
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে দেখল, টোকেনে নাম্বার ছাড়া আর কিছু নেই।
হঠাৎ করে একরাশ হতাশায় ছেয়ে গেল আহমদ মুসার মন।
মনের ভাবটা গোপন করে আহমদ মুসা বলল, ‘তাহলে দয়া করে নতুন অর্ডারটায় লিখে নিন।’
সেলস ম্যানেজার অর্ডার শীট বের করল। আহমদ মুসা বলে গেল এবং সে লিখল। তারপর টোকেনের সাথে অর্ডার শীটকে অ্যাড করে রেখে দিল।
‘থ্যাংকস। গুড মর্নিং’ বলে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
সার্ভিস সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসার সময় আহমদ মুসা নিজেকে খুব দুর্বল ভাবল। আবার ব্ল্যাক ক্রস তার নাগালের বাইরে চলে গেল। ওমর বায়াকে হাতে পেয়েও রাখতে পারল না সে। বেচারার এখন কি অবস্থা কে জানে! আল্লাহ তাকে রক্ষা করুন।
‘সান্ত্বনার কথা এই, ওমর বায়াকে তারা হত্যা করবে না’- ভাবল আহমদ মুসা। ওমর বায়া বেঁচে থাকলেই শুধু তার সম্পত্তির আইনগত অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে। এ অধিকার আদায়ের জন্যে ব্ল্যাক ক্রস এবার কোন পথে এগোবে কে জানে।
‌আহমদ মুসারও মাঝে মাঝে আজকাল বিস্ময় সৃষ্টি হচ্ছে, ওমর বায়ার দশ হাজার একরের একখণ্ড জমিকে ‘কোক’, ‘ওকুয়া’ এবং ‘ব্ল্যাক ক্রস’ এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? এটা কি একটা জেদে পরিণত হয়েছে তাদের! ওমর বায়াকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত ব্ল্যাক ক্রস-এর যে ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ওমর বায়ার জমির মত শত খণ্ড জমির মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। অনুন্নত ক্যামেরুনের ম্যালেরিয়া ও পীতজ্বর পীড়িত এবং ভয়ানক সিসি মাছি অধ্যুষিত একখণ্ড জমি নিয়ে জেদ এতদূর পর্যন্ত যাওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক নয়।
‘আসল কারণ খৃস্টবাদের স্বার্থ। ‘কোক’, ‘ওকুয়া’ এবং ‘ব্ল্যাক ক্রস’ সবাই তাদের ভাষায় যিশুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করছে- ভাবল আহমদ মুসা। এই দিক দিয়ে বিচার করলে তবেই তাদের জেদের তাৎপর্য বোঝা যাবে। এ বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আহমদ মুসার চোখে ভেসে উঠল আফ্রিকার মানচিত্র। খৃস্টানদের তৈরি মানচিত্র। এই মানচিত্রে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে আফ্রিকাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মুসলিম মেজরিটি অঞ্চল, খৃস্টান মেজরিটি অঞ্চল এবং গোত্র-ধর্ম মেজরিটি অঞ্চল। সুদান, চাদ ও নাইজেরিয়া থেকে উত্তরে গোটা উত্তর আফ্রিকা মুসলিম মেজরিটি এলাকা। এই মুসলিম মেজরিটি এলাকার দক্ষিণে বিশাল আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ও পশ্চিম উপকূলের দু’টি পকেটে গোত্র-ধর্ম বিশ্বাসীরা মেজরিটি। পূর্ব উপকূলের দক্ষিণাংশে মোজাম্বিক, জাম্বিয়া ও বতসোয়ানা এবং পশ্চিম উপকূলের মধ্য অঞ্চলে গ্যাবন ও ক্যামেরুন অঞ্চলে গোত্র-ধর্ম বিশ্বাসীরা সংখ্যাগুরু। তবে বতসোয়ানা খৃস্টানদের হাতে চলে যাবার মুখে। সেখানে খৃস্টান ও গোত্র-ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা সমান সমান। এই দুই পকেটসহ ইথিওপিয়া, তাঞ্জানিয়া ও সোমালিয়াকে (ইথিওপিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় মুসলিম ও খৃস্টান সমান সমান এবং সোমালিয়ায় প্রায় সবাই মুসলমান) বাদ দিলে মুসলিম উত্তর আফ্রিকার দক্ষিণে এগারটি রাষ্ট্রে খৃস্টানরা সংখ্যাগুরু। আফ্রিকার ধর্মীয় মানচিত্রে আরেকটা বিষয় লক্ষ্যণীয়। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের সব দেশেই মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। যেমন মোজাম্বিকে দশভাগ, তাঞ্জানিয়ায় তেত্রিশ ভাগ, কেনিয়ায় ছয় ভাগ এবং ইথিওপিয়ায় চল্লিশ ভাগ মুসলিম দেখানো হয়েছে খৃস্টান মানচিত্রে। কিন্তু পশ্চিম উপকূল প্রায় মুসলিম শূন্য হয়ে পড়েছে। পশ্চিম উপকূলের নামিবিয়া, অ্যাংগোলা, কংগো, গ্যাবন ও নিরক্ষীয় গিনি- এই কয়টি দেশে মুসলিম নেই বললেই চলে। কংগোতে যে দুই পারসেন্ট মুসলমান দেখানো হয়েছে, সেটাও মনে হয় উত্তর কংগোর সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক সন্নিহিত অঞ্চলে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ছাব্বিশ পারসেন্ট মুসলমান। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলীয় ধর্মীয় মানচিত্রের এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, খৃস্টানদের মুসলিম শূন্যকরণ বা মুসলিম নির্মূলকরণ অভিযান অব্যাহত গতিতে উত্তরে অগ্রসর হচ্ছে। খৃস্টানদের মুসলিম নির্মূলকরণ এই অভিযান আজ ক্যামেরুনে এসে উপস্থিত হয়েছে। দক্ষিণ ক্যামেরুনকে মুসলিম শূন্য করার কাজ তাদের প্রায় সম্পূর্ণ। ওমর বায়ার দশ হাজার একর জমির এলাকা খৃস্টানরা পেয়ে গেলেই দক্ষিণ ক্যামেরুন দখল তাদের সম্পূর্ণ হয়ে যায়। এই কারণেই ওমর বায়ার জমি নিয়ে ‘কোক’, ‘ওকুয়া’ ও ‘ব্ল্যাক ক্রস’ এই জেদ করছে এবং এই কারণেই তারা জমিটা হাত করার জন্যে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করেছে। সুতরাং, আসল সংঘাতটা ক্রস ও ক্রিসেন্টের মধ্যে। ওমর বায়ার জমি দক্ষিণ ক্যামেরুনে ক্রিসেন্ট-এর এক অসহনীয় অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে খৃস্টানদের কাছে। ওমর বায়ার জমি দখল পাকাপোক্ত করার সাথে ক্রস-এর বিজয় একাত্ম হয়ে পড়েছে।
সার্ভিস সেন্টার থেকে বেরিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসা ফুটপাত ধরে অনির্দিষ্টভাবে হাঁটছিল। কোথায় যাবে সে? ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর নিকটবর্তী হবার সূত্র তার ছিঁড়ে গেছে। আবার নতুন করে সূত্র তাকে তৈরি করতে হবে। এ জন্যে আরও ভাবা প্রয়োজন। তার এখন ক্লাউডিয়ার ওখানে ফিরে যাওয়াই ভাল। ভাবল আহমদ মুসা।
একটা ট্যাক্সি ডাকল সে।
ট্যাক্সিতে চড়ে বলল, ‘খাঁড়ির মুখে পুব পাশের পাহাড়ে মহিলা ক্যাডেট কোরের রেস্টহাউস।’
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলতে শুরু করল গাড়ি।
বিরাট এক ঘুম দিয়েছিল আহমদ মুসা।
যখন ঘুম থেকে উঠল, দেখল, আসরের নামায যায় যায় অবস্থা। তাড়াতাড়ি আসরের নামায সেরে রেস্টহাউসের কমন লাউঞ্জটাতে এসে বসল।
সেখানে আগে থেকেই বসেছিল সুমাইয়া, জিয়ানা এবং ডেবরা।
আহমদ মুসা বসতেই জিয়ানা বলে উঠল, ‘সুমাইয়া কিন্তু আপনার মতই নামায পড়ে।’
‘নতুন কথা হলো বুঝি, গতবার পাউয়ে তো ভাইয়াই আমাদের গোটা পরিবারকে নামায শিখিয়েছিলেন। তারপর আমরা কেউ নামায ছাড়িনি। অনেক কষ্ট করে কিছু সূরা শিখেছি আমরা।’
এ সময় লাউঞ্জে প্রবেশ করল ক্লাউডিয়া। লাউঞ্জে ঢুকতে ঢুকতেই বলল, ‘ম্যারাথন ঘুম দিয়েছেন আপনি।’
বসল ক্লাউডিয়া। বসেই বলল, ‘বলতে পারি, আপনি ক’রাত নিশ্চয় ঘুমাননি। কি বল জিয়ানা তুমি?’
‘ক্লান্তি কিংবা অন্য কারণেও এমন বড় ঘুম দিতে হতে পারে।’ বলল জিয়ানা।
‘ক্লাউডিয়া ঠিকই বলেছে। গতকাল বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমি বন্দী ছিলাম। তারপর ভোররাত পর্যন্ত লড়াই হয়েছে। সে লড়াইয়ে মারা গেছে জনাতিরিশেক লোক। ওমর বায়াকে মুক্ত করেছিলাম অবশেষে। কিন্তু ভোররাতেই তাকে আবার কিডন্যাপ করা হয়। কিডন্যাপকারীদের অনুসরণ করেই এখান পর্যন্ত এসেছি। সুতরাং, ঘুমাবার প্রথম সুযোগ পেয়েই এখানে এসেছি।’
ইতোমধ্যে রালফ ফ্রিক ও অন্য দু’জন এসে লাউঞ্জে বসেছিল। রালফ অবাক চোখে গিলছিল কথাগুলো। ডেবরা এবং রালফ ফ্রিক রেস্টহাউসে আসার পর ক্লাউডিয়ার কাছে আহমদ মুসার সব কথা শুনেছে।
‘আপনার সব কথা আমরা শুনেছি। দু’টি সৌভাগ্যের আমরা মালিক হয়েছি। এক. আপনাকে দেখার এবং আপনার সাথে কথা বলার দুর্লভ সৌভাগ্য আমাদের হলো। দুই. আপনার মত বিশ্ববিখ্যাত মানুষের সাহায্যে আমরা প্রাণে বেঁচেছি- এ কাহিনী আমরা বংশানুক্রমে বলতে পারব।’ বলল ডেবরা।
‘আমাকে এভাবে ভাবলে আমি কষ্ট পাই। এমন বড় লোকদের মাথার উপরে বসানো যায়। তারা মানুষের বন্ধু বা সাথী হতে পারে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি খুব সুন্দর বলেছেন। কিন্তু নেতৃত্ব যারা দেন তাদের স্থান তো মাথার উপরেই হয়।’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘মাথার উপরে একজনই আছেন। তিনি আল্লাহ, তিনি স্রষ্টা। আমাদের সর্বকালের নেতা যিনি সেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের হৃদয়ের মানুষ। বন্ধু তিনি, সাথী তিনি আমাদের। পথপ্রদর্শককে পথযাত্রীদের একজন হয়ে সবার সাথেই থাকতে হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কঠিন কথাগুলো আপনি সুন্দর করে বলতে পারেন। আমাদের যিশুও কি তাই?’ বলল ডেবরা।
‘অবশ্যই। যিশু আমাদের রাসূল (সাঃ)-এর পূর্বসূরী মাত্র।’
কফি এল এ সময়।
সুমাইয়া গিয়ে কফি নিয়ে এসেছিল। সে বলল, ‘দীর্ঘ ঘুমের পর কফি আপনার ভাল লাগবে।’
‘ধন্যবাদ বোন। জানি না এমন সুখের ঘুম আবার কখন ঘুমাতে পারব।’
আহমদ মুসার এ কথার সাথে সাথে সুমাইয়া, ক্লাউডিয়া, জিয়ানা সবার মুখ ম্লান হয়ে গেল। তারা জেনেছে, শুনেছে, আহমদ মুসার নিশ্চিন্ত বিশ্রামের সুযোগ খুব কমই হয়। শাটল কর্কের মতই অস্থিরভাবে সে দেশ থেকে দেশে, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছুটে বেড়াচ্ছে।
‘মাফ করবেন, শান্তির, স্বস্তির একটা স্থির গৃহাঙ্গনের স্বপ্ন আপনি দেখেন না? কিংবা এর প্রতি লোভ আপনার জাগে না?’ বেদনার্ত চোখে বলল ক্লাউডিয়া।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘শান্তি ও স্বস্তির সংজ্ঞা কি ক্লাউডিয়া? শান্তি ও স্বস্তি দু’ধরনের আছে। দেহের শান্তি-স্বস্তি এবং মনের শান্তি-স্বস্তি। দেহের শান্তি ও স্বস্তির জন্যে প্রয়োজন বিশ্রাম। এর জন্যে আল্লাহ রাত এবং রাতের ঘুমকে নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তু মনের শান্তি ও স্বস্তি দিনের বিশ্রাম ও রাতের ঘুম থেকে আসে না। স্থির গৃহাঙ্গনও মনের এ শান্তি-স্বস্তি দিতে পারে না।’
‘তাহলে এ শান্তি ও স্বস্তি কোথা থেকে আসবে?’ বলল ডেবরা।
‘মানব জীবনের স্রষ্টা নির্ধারিত একটা লক্ষ্য আছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে মানুষের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্দিষ্ট রয়েছে। মানব বিবেকের প্রবণতা এই দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের সাথে সংগতিশীল। মানুষ যখন এই দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে, তখন সমাজে, পরিবারে ও ব্যক্তির জীবনে শান্তি ও স্বস্তির সৃষ্টি হয়। সমাজ ও পরিবারকে বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তির জীবনে শান্তি ও স্বস্তি আসতে পারে না।’
‘কথাগুলো খুব ভারি। ব্যক্তির শান্তি ও স্বস্তি কি পরিবার ও সমাজের সাথে এতটাই সম্পর্কিত?’ বলল ক্লাউডিয়া।
‘দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গ আছে। সব অঙ্গের সুস্থতাই দেহের শান্তি ও সুস্থতা। অনুরূপভাবে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র বা সমাজ মানবজীবনের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ হলেও অখণ্ড জীবনেরই সে সব অংশ। সুতরাং, সবগুলোর সুস্থতাই জীবনের বা ব্যক্তি জীবনের শান্তি ও সুস্থতা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এক কথায় আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?’ বলল ডেবরা।
‘বলতে চাচ্ছি, সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্যে সুস্থ পরিবার এবং তার মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তি গঠনের আবার অন্য কথায়, সুস্থ ব্যক্তি গঠনের মাধ্যমে সুস্থ পরিবার ও সুস্থ সমাজ গঠনের যে আন্দোলন বা যে কাজ তা আঞ্জাম দেয়ার মধ্যেই মানসিক শান্তি ও স্বস্তি নিহিত। অন্য কথায়, এই কাজকে সুকৃতির প্রতিষ্ঠা ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধও বলা যেতে পারে।’
‘আপনি বোধ হয় শেষ কাজটাই করছেন?’ বলল রালফ ফ্রিক।
‘এ কাজ কমবেশি সবাই করে, তোমরাও কর।’
‘বিন্দুও পানি, সিন্ধুও পানি। কিন্তু তাই বলে বিন্দু কখনই সিন্ধু নয়।’
‘তুমি বুঝি হাইড্রোলজির ছাত্র?’
‘হ্যাঁ। আপনি জানলেন কি করে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল রালফ ফ্রিক।
‘তোমার বিন্দু ও সিন্ধুর সুন্দর তুলনা দেখে। যাক এসব। তোমাদের ঘটনা এখনও জানতে পারিনি আমি।’
‘ঠিক আছে, বলছি।’ বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রালফ। তারপর শুরু করল, ‘আমার আব্বা ডঃ ডিফরজিস। আমার পিতা আইনের অধ্যাপক এবং প্যারিসের সবচেয়ে নামকরা আইন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। একটা আন্তর্জাতিক চক্র তাকে দিয়ে একটি কাজ করাতে চাচ্ছিল। কিন্তু রাজি হননি তিনি। আমাদের কিডন্যাপ করা হয় আব্বার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে। আমাদের পণবন্দী রেখে আব্বাকে রাজি হতে বাধ্য করতে চেয়েছিল ওরা।’ থামল রালফ।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে গভীর ঔৎসুক্য। বলল, ‘কি কাজ করাতে চেয়েছিল বলতে পার কি?’
‘ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিস ডঃ উসাম বাইক আমার আব্বার পালক পুত্র এবং ছাত্র। তারা চাচ্ছিল, আব্বার মাধ্যমে চীফ জাস্টিসকে দিয়ে একটা কাজ করাতে।’
‘সেই কাজটা কি?’
‘আমি ঠিক জানি না, তবে এটুকু শুনেছি যে, সেটা একটা সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যাপার।’
‘সম্পত্তি!’ আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়ের যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটল।
‘তাই শুনেছি।’ আহমদ মুসার কণ্ঠ রালফকে অবাক করেছে এবং অন্য সবাইকেও।
‘সেই আন্তর্জাতিক চক্র কারা? ‘ব্ল্যাক ক্রস’ কি?’
আহমদ মুসার কণ্ঠে ব্ল্যাক ক্রস-এর নাম উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই রালফ ফ্রিক ও ডেবরার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল ভয়ে।
রালফ সোজা হয়ে বসে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘ঠিক বলেছেন, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?’
‘ঠিক বলছ, ব্ল্যাক ক্রস?’ বলতে বলতে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ।
কয়েকবার এদিক-ওদিক পায়চারী করল। তারপর এসে সোফায় বসে বলল, ‘রালফ, তোমার আব্বাকে এখনি টেলিফোন কর। তোমাদের খবর জানাও এবং তাকে সাবধানে থাকতে বল।’
‘কেন বলছেন এ কথা?’
‘যা বলছি, দয়া করে শোন।’
রালফ আর কোন কথা বলল না। উঠে গেল তার কক্ষে। দু’মিনিটও যায়নি, ফিরে এল সে। লাউঞ্জে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আব্বা কুমেট চলে এসেছেন।’
‘কুমেট চলে এসেছেন? কবে?’
‘আজ। সন্ধ্যা ছয়টায় পৌঁছার কথা।’
আহমদ মুসা সময় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা সোয়া ছয়টা। আহমদ মুসা বলল, ‘রালফ, তৈরি হয়ে নাও। এয়ারপোর্ট যেতে হবে।’
আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে রালফ কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মাফ করবেন, আপনি কি কোন আশংকা করছেন?’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আমি ব্ল্যাক ক্রসকে যতটা জানি, তাতে আমার অনুমান, তোমার আব্বাকে তারা কিডন্যাপ করবে।’
রালফ এবং ডেবরার মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। কোন কথা রালফের মুখে যোগাল না। মুহূর্ত কয়েক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে।
ক্লাউডিয়ারাও উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্লাউডিয়া বলল, ‘আমরা যেতে পারি না? গাড়ি আছে।’
ক্লাউডিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসা রালফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার আব্বা তোমার খালাম্মার ওখানে উঠতে পারেন?’
‘জ্বি, হ্যাঁ।’ বলল রালফ।
‘তোমার খালু সাহেব, খালাম্মা নিশ্চয় এয়ারপোর্টে যাবেন তোমার আব্বাকে রিসিভ করতে?’
‘অবশ্যই।’
‘তাহলে ক্লাউডিয়া, তোমরা যেতে পার।’ বলল আহমদ মুসা ক্লাউডিয়ার দিকে চেয়ে।
ক্লাউডিয়া, জিয়ানা, সুমাইয়াদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে। এরকম একটা মুহূর্তে আহমদ মুসার পাশে থাকতে পারাকে তারা তাদের সৌভাগ্য মনে করছে।
সবাই প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা ও রালফ উঠল এক গাড়িতে এবং ক্লাউডিয়ার নেতৃত্বে মেয়েরা উঠল অন্য গাড়িতে।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেরি হয়ে গেল রালফ। প্লেনের যদি দেরি না হয়, ঠিক সময়ে পৌঁছা আমাদের জন্যে কঠিন হবে।’
বলে আহমদ মুসা গাড়িতে স্টার্ট দিল।
দুইটি গাড়ি ছুটে চলল এয়ারপোর্টের দিকে।
শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এয়ারপোর্ট।
প্রায় এসে গেছে আহমদ মুসারা এয়ারপোর্টে।
আহমদ মুসার গাড়ি আগে এবং পেছনে ক্লাউডিয়ার গাড়ি।
আহমদ মুসা সামনের সিগন্যাল দেখে বুঝল, তাকে একটু সামনে গিয়ে বাঁয়ে ঘুরতে হবে ‘আগমন’ টার্মিনালের কারপার্কে গাড়ি রাখার জন্যে।
আহমদ মুসা গিয়ারে হাত রাখল গাড়ি স্লো করে মোড় নেবার জন্যে।
ঠিক এই সময়েই আহমদ মুসা দেখল, আগমন টার্মিনালের কারপার্কের দিক থেকে রাস্তার নির্গমন লেন দিয়ে একটা গাড়ি পাগলের মত ছুটে বেরিয়ে আসছে। সামনের গাড়ি ওভারটেক করতে গিয়ে হর্নও দিল অত্যন্ত দ্রুত তালে।
হর্ন শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ব্ল্যাক ক্রসের কোড। তাহলে কি…।
চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা রিয়ার ভিউ-এর দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত গাড়িটা ডান দিকে ঘুরিয়ে রাস্তার পাশে নিয়ে নিল। কিন্তু রাস্তার নির্গমন লেনে যাওয়ার কোন উপায় নেই। মাঝখানে লোহার জালের ডাবল বেড়া। পেছনে গাড়ির সারি। কোনদিকে নড়ার উপায় নেই।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
গাড়ির দরজা খুলে এক ঝটকায় বেরিয়ে এল সে। হাতে সাদা নলের একটা পিস্তল। পিস্তলের বাঁটের দিকটা হাতের মধ্যে, শুধু লম্বা নলটাই দেখা যায়।
গাড়ি থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার ডান হাতটি বিদ্যুৎ গতিতে উপরে উঠল।
নির্গমন লেনের পাগলা গতির গাড়িটা তখন আহমদ মুসার সমান্তরাল থেকে অনেকখানি সামনে এগিয়ে গেছে। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কৌণিক অবস্থান নিয়ে আহমদ মুসার হাত উপরে উঠেছিল। পর পর দু’টি দুপ দুপ শব্দ উঠল।
রাস্তার দু’টি লেনই মহাব্যস্ত। কারও ভ্রূক্ষেপ এদিকে নেই। দু’একজনের দৃষ্টি এদিকে পড়লেও তাদের মনে সামান্য অলস ঔৎসুক্য জাগল মাত্র।
আহমদ মুসা সাইলেন্সার ও পিস্তলটি পকেটে ফেলে গাড়ির দিকে ফিরল।
আহমদ মুসার গাড়ি রাস্তার পাশে চলে আসার সাথে সাথেই ক্লাউডিয়া তার গাড়িটিও আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে রাস্তার পাশে এনে দাঁড় করিয়েছিল।
রালফ, ক্লাউডিয়া, ডেবরা, জিয়ানা, সুমাইয়াসহ সকলেরই চোখ-মুখ উদ্বেগে ভরা। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে সকলের। তারা বুঝতে পারছে না কি ঘটেছে। ভেলকিবাজীর মতই মনে হচ্ছে আহমদ মুসার গোটা কাজ।
রালফ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ক্লাউডিয়ারাও এসে দাঁড়াল সেখানে। কিন্তু তাদের মুখে কোন কথা নেই।
‘চল আমরা অ্যারাইভাল টার্মিনালে যাই। সেখানে গেলে সব জানতে পারব। এদিক দিয়ে পাগলের মত যে গাড়িটা গেল সেটা ব্ল্যাক ক্রসের বলে আমি মনে করছি।’
‘তার অর্থ…।’ কথা শেষ করতে পারল না রালফ। রুদ্ধ হয়ে গেল তার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা রালফের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ভেংগে পড়ো না। চল আমরা টার্মিনালে যাই।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে অগ্রসর হল।
সবাই গিয়ে গাড়িতে উঠল।
পৌঁছল গিয়ে টার্মিনালে।
পুলিশে-মানুষে মিলে সেখানে ছোট-খাট একটা জটলা।
আহমদ মুসা, রালফ এবং ডেবরা সেখানে গাড়ি থেকে নামল। তারা নামতেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে জড়িয়ে ধরল রালফকে। চিৎকার করে বলল, ‘তোরা কোত্থেকে এলি বাবা? তোদের জন্যে তোর আব্বা এসেছিলেন, কিন্তু সর্বনাশ হয়ে গেছে!’
মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়াল ডেবরার পাশে। কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘তোমরা কোত্থেকে এলে? কিভাবে মুক্তি পেলে? বাসায় গিয়েছিলে?’
ডেবরা আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, ‘উনি আমাদের মুক্ত করেছেন। বাসার উপর ওরা চোখ রেখেছে বলে আমরা বাসায় যাইনি।’
রালফের খালাম্মা রালফের কাছ থেকে এসে জড়িয়ে ধরল ডেবরাকে। বলল, ‘কেমন ছিলে মা তোমরা? তোমার শ্বশুর কি যে খুশি হতো তোমাদের দেখলে! কিন্তু সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন কি হবে?’
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল মধ্যবয়সী সেই ভদ্রলোকের দিকে। এ সময় রালফও এগিয়ে এল তার খালুর দিকে। আহমদ মুসাকে দেখিযে বলল, ‘ইনি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন এবং আমাদের মুক্ত করেছেন।’
‘তোমার নাম কি? তুমি কে বাবা? ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।’ বলল রালফের খালু।
রালফের খালাও তাদের কাছে এগিয়ে এসেছিল।
রালফ মুখ খুলেছিল তার খালু সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলার জন্যে। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘এসব পরে হবে। দয়া করে বলুন, যে গাড়িতে করে রালফের আব্বাকে ওরা নিয়ে গেছে, তার নাম্বার কি আপনি দেখেছেন?’
‘দেখেছি। কিন্তু…।’ বলে একটু থামল। বোঝা গেল, স্মরণ করার চেষ্টা করছে গাড়ির নাম্বার। বলল, ‘কুমেট-২৩৫…।’ থেমে গেল। স্মরণ করতে পারল না।
‘২৩৫৪৫৬ কি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক এ রকমই। তুমি জানলে কি করে?’
‘গাড়ির রং কি নীল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, নীল। তুমি দেখেছ গাড়ি?’
‘দেখেছি।’ বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর বলল, ‘আমরা এখান থেকে যেতে পারি।’
‘হ্যাঁ, পুলিশ গাড়ির নাম্বার নিয়েছে। ওরা কি করল খোঁজ নিতে হবে।’
গাড়ি থেকে ক্লাউডিয়ারা সবাই নেমে এসেছিল। সবারই উদ্বেগ ভরা মুখ।
‘গাড়ির নাম্বারটা ভুয়া। পুলিশ কিছুই খুঁজে পাবে না।’
‘ভুয়া? বুঝলে কি করে তুমি?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল রালফের খালু ভদ্রলোকটি।
‘গাড়িতে ঠিক নাম্বার প্লেটটি রেখে কি কেউ কিডন্যাপের মত কাজ করতে আসে জনাব?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছ তুমি। তোমার তো সাংঘাতিক বুদ্ধি! গাড়ির নাম্বার কেমন গড় গড় করে বলে গেলে!’
‘তাহলে আমরা এখন যেতে পারি’ আহমদ মুসা বলল।
‘যেতে পারি। একবার পুলিশ অফিসে যাওয়া দরকার কিনা। ওরা কি করছে দেখা দরকার। তাড়াও দেয়া দরকার।’
‘ঠিক আছে যেতে পারেন। আমার একটু ভিন্ন কাজ আছে।’
‘ঠিক আছে। আমি তাহলে রালফ ও ডেবরাকে নিয়ে পুলিশ অফিসের দিকে যাই।’
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই রালফ ফ্রিক তার খালু ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘খালু সাহেব, আপনি একে জানেন না। পরে বলব আপনাকে। কোন উপকার করলে ইনিই করতে পারেন। ডেবরা আপনার সাথে যাক। আমি এর সাথে থাকতে চাই।’
‘আমার ভয় করছে। দু’জন একসাথে থাকব।’ বলল ডেবরা।
‘আমার মনে হয়, রালফের আব্বাকে তাদের কাজ করিয়ে দিতে বাধ্য করার জন্যে ওরা সব উপায়েরই সদ্ব্যবহার করবে। সুতরাং, রালফ এবং ডেবরাকে একটু সরেই থাকা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
রালফের খালু ও খালাম্মার চোখে নতুন করে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। তার খালাম্মা বলল, ‘সেটাই ভাল। ওরা একটু সরে থাক। সব সময় যোগাযোগ রাখলেই চলবে।’ বলে স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, ‘চল, আমরা দু’জন পুলিশ অফিস দিয়ে যাই।’
কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা ডেবরাকে একটু চুমু খেয়ে ক্লাউডিয়াদের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা বোধ হয় একসাথেই থাকছ? ওদের দেখো বাছারা।’
বলে সে গাড়ির দিকে এগোলো। রালফের খালুও গিয়ে গাড়িতে উঠল।
আহমদ মুসারাও গাড়িতে উঠল তাদের সাথে সাথেই।
তিনটি গাড়িই একসাথে ছাড়ল। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে তারা দু’টি ভিন্ন পথে এগিয়ে চলল।

গার্লস ক্যাডেট কোরের রেস্টহাউস। রেস্টহাউসের লাউঞ্জ।

লাউঞ্জে বসে আছে রালফ, ডেবরা, ক্লাউডিয়া, জিয়ানা, সুমাইয়া এবং অন্যান্যরা। শুধু হাজির নেই আহমদ মুসা। সে টয়লেটে।

কথা বলছিল ডেবরা, ‘আহমদ মুসা সম্পর্কে গল্প শুনে বুঝতে পারতাম না তিনি কত বড়। আজ চোখে দেখে বুঝলাম।’

‘কোন ঘটনার কথা বলছ?’ ক্লাউডিয়া জিজ্ঞেস করল।

‘কোন ঘটনার কথা বলব! সব ঘটনাই একটা করে বিস্ময়। মনে হয়, যেন যাদুবলে আগে থেকেই তিনি সব জানতে পারেন। দেখ, তিনি আব্বার কিডন্যাপ হওয়ার কথা বললেন, ঠিক ঠিক তা ঘটে গেল। আবার দেখ, আমরা কিছুই বুঝলাম না, উনি ব্ল্যাক ক্রস-এর গাড়ি চিনে ফেললেন। তার নাম্বারও মুখস্থ করলেন কখন যেন। পরে প্রমাণ হলো, ঠিকই ব্ল্যাক ক্রস-এর গাড়ি।’

‘আমরা সবাই গাড়ি দেখেছিলাম, কিন্তু রং না শুনলে এখন বলতে পারতাম না।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘ঠিক, শোনার পর আমার মনে পড়েছিল গাড়িটা নীল ছিল।’ বলল জিয়ানা।

‘আমি তো ওর পাশে ছিলাম। কোন কিছু বুঝতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং তা সম্পাদন করতে কোন সময় তার নষ্ট হয় না। এমন ব্রেইন খুবই দুর্লভ, খুব অল্পই এরা পৃথিবীতে আসেন।’ বলল রালফ।

‘অদ্ভুত ঠাণ্ডা মানুষ তিনি। কোন কিছুই যেন তাকে উত্তেজিত করতে পারে না। প্রথম পরিচয় তার সাথে এক হোটেলে। একজন নিগ্রোকে বাঁচাবার জন্যে একদল গুণ্ডার সাথে লড়ে তাদের মেরে ফ্ল্যাট করে দিলেন। খেতে খেতে উঠে গিয়েছিলেন, মারামারির পর আবার এসে খেলেন। যেন কিছুই ঘটেনি।’ বলল সুমাইয়া।

এ সময় আহমদ মুসা প্রবেশ করল লাউঞ্জে। তার মাথায় টুপি। এশার নামায পড়ে এলো সে।

বসল আহমদ মুসা গদিওয়ালা একটা মোড়ায়। চার সোফাই অকুপাইড। পাঁচটি সিঙ্গেল সোফায় বসেছে রালফ, ডেবরা, নেকা, রিশলা ও জিয়ানা এবং ট্রিপল সিটের দু’টি সোফার একটিতে বসেছে ক্লাউডিয়া, অন্যটিতে সুমাইয়া। তাদের দু’জনের পাশেই দুটো করে সিট খালি। আহমদ মুসা সেখানে বসলো না।

‘মাফ করবেন জনাব, ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়া আপার মত আপনার ঘনিষ্ঠজনদের পাশে বসাও কি নিষেধ?’ বলল ডেবরা।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এমন প্রশ্ন তুললে কেন?’

‘তুললাম এ কারণে যে, ক্লাউডিয়া এবং সুমাইয়া আপার পাশে দু’জনের জায়গা খালি থাকতেও সেখানে না বসে আপনি তাদের অপমান করেছেন।’ বলল ডেবরা।

‘কি বলছ তুমি ডেবরা?’ ক্লাউডিয়া এবং সুমাইয়া দু’জনেই বলে উঠল।

‘না আপা, ওকে জবাব দিতে দাও।’ বলল ডেবরা জেদের স্বরে।

মিষ্টি একটা হাসি আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘ঘনিষ্ঠজনদের নিকটবর্তী হওয়ার ব্যাপারেই নিষেধ বেশি।’

‘কেন?’ বলল ডেবরা।

‘ছেলে ও মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে বিপদ রযেছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘যে বিপদের কথা বলছেন বুঝতে পেরেছি। ছেলে-মেয়েদের নিজস্ব শক্তির প্রতি এটা অনাস্থা নয় কি? মাফ করবেন, আপনি, ক্লাউডিয়া ও সুমাইয়ার প্রতি এই অনাস্থা কি কেউ পোষণ করতে পারে?’

গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, ‘দেখ ডেবরা, আইন বিশেষ করে খোদায়ী আইন তৈরি হয়েছে ব্যক্তিকে সামনে রেখে নয়। আল্লাহ্‌ তাঁর আইন দিয়েছেন মানুষের প্রকৃতি ও প্রবণতা সামনে রেখে, যা তিনিই সৃষ্টি করেছেন।’

‘মানুষের প্রকৃতি ও প্রবণতার গতি কি সব সময় মন্দের দিকে?’ বলল ডেবরা।

‘তুমি একটা জটিল প্রসংগ তুলেছ ডেবরা। মানুষের মধ্যে ভালো প্রকৃতি ও প্রবণতা এবং মন্দ প্রকৃতি ও প্রবণতা দুই-ই সুপ্ত আছে। বাইরের কোন দৃশ্য বা কথা বা ঘটনা মন্দ প্রবণতাকে উস্কে দেয়, আবার কোন দৃশ্য বা কথা বা ঘটনা ভালো প্রবণতাকে জাগিয়ে তোলে। আল্লাহ্‌র আইনের লক্ষ্য হলো, যে দৃশ্য বা যে কথা বা যে ঘটনা বা পরিবেশ মন্দ প্রবণতাকে উস্কে দেয়, তাকে বন্ধ করা। এটা মেনে চললে মানুষ সুস্থ থাকে, সমাজ সুস্থ থাকে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আপনাদের মত অনড় নৈতিকতা ও দৃঢ় চরিত্রের লোকদের এসব মেনে চলা কি জরুরি?’ বলল ডেবরা।

‘একজন সুস্থ–সবল ব্যক্তির শরীরে রোগ-জীবাণু কখন প্রবেশ করে, সে জানতে পারে না। যখন জানতে পারে, তখন দেখে সে আক্রান্ত। এভাবেই একজন দৃঢ় চরিত্রের লোকও ঘটনা ও পরিবেশের কারণে তার অজান্তেই মন্দ প্রবণতায় আক্রান্ত হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনার নিজের প্রতিও এ অনাস্থা আপনার আছে?’ ডেবরা বলল।

‘মানবসুলভ সকল দোষ–গুণ নিয়ে আমি একজন মানুষ। অন্যদের মধ্যে যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সে সব আমার মধ্যেও আছে। আল্লাহর আইন মেনে চলে আমি সে দুর্বলতা থেকে বাঁচতে চাই।’

‘আমাদের পশ্চিমী সমাজে এই নৈতিকতা নেই। মাথায় রুমাল পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে সহ্য করা হচ্ছে না। আপনি যে দুর্বলতা থেকে বাঁচতে চাচ্ছেন, সে দুর্বলতা থেকে বাঁচার কোন সুযোগ পাশ্চাত্য সমাজে নেই। এই অবস্থায় পাশ্চাত্যের মেয়েদের জন্যে আপনার বক্তব্য কি?’ বলল জিয়ানা।

‘এদিক থেকে পাশ্চাত্যের মেয়েরা অবস্থার একটা অসহায় শিকার। তবে সমাজ ব্যবস্থা যা-ই হোক, রীতি–সংস্কৃতি যা-ই হোক, প্রতিটি মানুষের মনে স্রষ্টার মোতায়েন করা বিবেক নামক এক প্রহরী আছে, যে সব সময় ভাল কোনটা বলে দেয়, ন্যায় কোনটা বলে দেয় এবং সকল অনুচিত কাজ ও অন্যায়ের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিবেকের এই খবরদারি আছে। পাশ্চাত্যের যে মেয়েরা বিবেকের এই নির্দেশ মেনে চলতে পারে, তারা পাশ্চাত্য সমাজে থেকেও অনন্য চরিত্রের অধিকারী হয়।’

‘নর-নারীর মধ্যে হৃদয়ের সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার যে স্বাভাবিকতা, তাকে তাহলে অস্বীকার করতে হবে?’ বলল ডেবরা।

‘না, ডেবরা। স্বাভাবিক হলে তা অস্বীকার করা যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘এর মধ্যে স্বাভাবিক–অস্বাভাবিক বলে কি দুই ভাগ আছে?’ জিয়ানার প্রশ্ন।

‘অবশ্যই আছে। ঘনিষ্ঠ না হবার পরেও হৃদয়ের সম্পর্ক কখনও সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু তা নীতি–সংস্কৃতির সীমা যদি লংঘন না করে এবং যদি তা কোন পরিবার ও সমাজ–সম্পর্কের প্রতি হস্তক্ষেপকারী না হয়, তাহলে একে স্বাভাবিক বলা যাবে।’

‘মানুষ ও সমাজ সম্পর্কের এত গভীরে গিয়ে আপনি ভাবেন?’ বলল জিয়ানা।

‘খুব গভীরের কথা এটা নয় ডাঃ জিয়ানা। মানুষ কে, কি দায়িত্ব নিয়ে সে দুনিয়ায় এসেছে এবং কোথায় কেন সে যাচ্ছে- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করলে মানুষ ও সমাজ সম্পর্কের এ বিষয়গুলো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের হয়ে দাঁড়ায়।’

‘বিপ্লবী হতে আপনাকে কে বলেছিল? কেন আপনি দার্শনিক কিংবা ধর্মপ্রচারক হননি?’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ক্লাউডিয়া।

সোফা থেকে উঠে ক্লাউডিয়া আহমদ মুসার কাছে এসে বলল, ‘আপনি ওখানে গিয়ে বসুন।’

‘আমি বসে আছি, এটা কি আসন নয়?’ বলল আহমদ মুসা।

‘দেখুন, তাহলে আমি মেঝেতে বসে পড়ব।’

আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। সে উঠে গিয়ে ক্লাউডিয়ার সোফায় গিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘এ জেদটা ঠিক ডোনার মত হলো।’

‘আকাশের চাঁদের সাথে মাটির প্রদীপের তুলনা করা ঠিক হলো না।’ বলল ক্লাউডিয়া ম্লান হেসে।

‘চাঁদ এবং মাটির প্রদীপের এই তুলনা তুমি ঠিক করলে না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘কেন? সে রাজকুমারী এবং একজন বিশ্ববিপ্লবীকে জয় করে নেয়ার মত দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী।’ ক্লাউডিয়া বলল।

‘হয়তো এতে সে জেতেনি। অনিশ্চিত ও দুঃখের এক জীবন সে বেছে নিয়েছে।’

‘এ যদি জিত না হয়, তাহলে এ পরাজয় লাখো জয়ের চেয়ে মধুর।’ বলল জিয়ানা।

এদিকে আহমদ মুসা তার মোড়ার সিট থেকে উঠার সঙ্গে সঙ্গে ডেবরা ছুটে এসে সেখানে বসে বলল, ‘আপা, আপনি ঐ সোফায় গিয়ে বসুন।’

‘বেশ ভাল, আমি রালফের পাশে গিয়ে বসি, তাই না? ওর সামনেই ওর কথা ভায়োলেট করতে বল?’

ডেবরা হাসল। বলল, ‘থ্যাংকস। আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’ বলে ডেবরা উঠে তার সোফায় ফিরে গেল।

ক্লাউডিয়া বসল আহমদ মুসার সিটে।

আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।

‘ভাইয়া, আপনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ক্লাউডিয়া আপার প্রশ্ন চাপা দিতে পারবেন না।’ আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল ডেবরা।

‘আমাকে বেরুতে হবে বোন।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। শুরু করল আবার, ‘ক্লাউডিয়ার প্রশ্নের উত্তর খুবই সোজা। আল্লাহর জীবন বিধান ইসলামে প্রত্যেকেই বিপ্লবী, প্রত্যেকেই ধর্মপ্রচারক এবং দার্শনিক। ইসলামী সমাজে ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব পালনে যিনি শীর্ষে, তিনিই রাষ্ট্রপ্রধান হন, তিনিই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করেন।’

কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘রাত একটু ভারি হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। এখন রাত এগারটা। বেরুতে হবে আমাকে এখন।’

‘কোথায়?’ সুমাইয়া বলল।

‘ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটিতে।’

‘ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি? কোথায়?’ বলল ক্লাউডিয়া।

আহমদ মুসা পকেট থেকে মাইক্রো রিমোট সেন্সর বের করল। বোতামে চাপ দিয়ে দেখল, লাল অ্যারো ইন্ডিকেটরটি ঠিক পশ্চিম দিকে ইংগিত করছে। আহমদ মুসা বলল, ‘পশ্চিম দিকে।’

আহমদ মুসাকে ছোট বস্তুটি নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখে সবাই উঠে এসেছিল। ঘিরে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসাকে। মাইক্রো স্ক্রীনে রেড অ্যারোটি সবারই নজরে পড়েছিল।

আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ক্লাউডিয়া বলে উঠল, ‘অ্যারো হেডের মাথা দেখে কি পশ্চিম দিকের কথা বললেন?’

‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।

‘কি জিনিস এটা?’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘মাইক্রো সেন্সর।’

‘কিভাবে কাজ করে?’

‘এখান থেকে পঞ্চাশ বর্গমাইলের যে কোন স্থানের মাইক্রো ট্রান্সমিটারের লোকেশন এ বলে দিতে পারে দূরত্বসহ।’

‘ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি এখান থেকে কতদূর?’ বলল রালফ।

‘সাত পয়েন্ট ছয় শূন্য কিলোমিটার।’

‘কি করে এটা সম্ভব হলো? ওখানে মাইক্রো ট্রান্সমিটার এল কোত্থেকে?’

‘তোমাদের মনে আছে, এয়ারপোর্ট টার্মিনালের সামনে যখন আমি গাড়ি থামিয়ে নেমেছিলাম, তখন ব্ল্যাক ক্রসের ঐ গাড়ি লক্ষ্যে দু’বার গুলি ছুঁড়েছিলাম। ঐ গুলিতে ছিল রাবার বুলেট। রাবার বুলেটে জড়ানো ছিল মাইক্রো ট্রান্সমিটারের চিপ। রাবার বুলেট গাড়িতে আঘাত করার সাথে সাথে চুম্বক আকর্ষণে তা সেঁটে গেছে গাড়ির বডি বা কোন পার্টসের গায়ে। সেই মাইক্রো ট্রান্সমিটারকেই এ সেন্সর এখন চিহ্নিত করছে।’

সকলের চোখে বিস্ময়! আহমদ মুসা থামলেও কারও মুখেই যেন তৎক্ষণাৎ কথা যোগাল না।

মুহূর্ত কয়েক পরে ডেবরা মুখ খুলল। বলল, ‘চোখের পলক পড়ার মত ঐ অল্প সময়ে এই বুদ্ধি আপনার মাথায় এল কি করে?’

ডেবরা থামতেই জিয়ানা বলল, ‘বলা যায়, এই সেন্সর লোকেট করছে গাড়িটাকে। কিন্তু গাড়িটা যদি হেডকোয়ার্টারে না থাকে?’

‘তাহলে অনিশ্চয়তার এক সমুদ্রে পড়ে যাব।’

‘কিছু মনে করবেন না, আমার কৌতুহল, সেই অবস্থায় আপনি কি করবেন?’ বলল ডেবরা।

‘কি করব, কি করব! গাড়ির জানালা ভেঙ্গে ঢুকে গাড়ির মালিকের ঠিকানা জেনে নেব লাইসেন্স অথবা ব্লু বুক থেকে। এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে গাড়ির নাম্বার কাজে লাগিয়ে ভেহিকেল রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে গাড়ির মালিকের ঠিকানা জেনে নেব। এ উদ্যোগ কোন ফল না দিলে বিপদেই পড়ব। সে ক্ষেত্রে রালফের নাম ও ঠিকানাসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেব তার বাবার সন্ধান চেয়ে। নিশ্চয় ব্ল্যাক ক্রস তখন হানা দেবে রালফের ঠিকানায়। পালানো শিকার ধরে তাদের দু’জন লোক হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে। ব্ল্যাক ক্রস ব্যর্থ হবে, কিন্তু তাদের অনুসরণ করে আমি তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারব।’

শ্বাসরুদ্ধভাবে ওরা শুনছিল আহমদ মুসার কথা। ওদের চোখে অপার বিস্ময় এবং আনন্দ।

‘দুনিয়ার সব বুদ্ধি আপনার মাথায় কম্পিউটারের মত প্রোগ্রাম করে ঢোকানো আছে নাকি?’ বলল ডেবরা।

‘সব মাথাই এক আল্লাহর সৃষ্টি ডেবরা।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি একটু তৈরি হয়ে আসি। বেরুবো এখনই।’

‘শুধু আপনি তৈরি হবেন, আমরা তৈরি হবো না?’ বলল রালফ।

আহমদ মুসা দু’পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। একটু হাসল। বলল, ‘না, তোমরা যাবে না।’

‘তা হয় না।’ বলল রালফ।

‘আপনাকে একা আমরা কি করে ছাড়ব?’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘দেখো, আমি যাচ্ছি অনেকটা অনিশ্চিতভাবে। গাড়ি কোথায় আছে জানি না। তোমাদের যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ক্ষতি তো নেই।’ বলল জিয়ানা।

‘ক্ষতি আছে। বেশি লোক গেলে বেশি লোকক্ষয়ের সম্ভাবনা।’

‘এখানে কম লোকক্ষয় হলে যে ক্ষতি হবে সেটাই বেশি ক্ষতিকর।’ বলল ক্লাউডিয়া।

‘তোমরা বুঝছ না, এটা যুদ্ধক্ষেত্র।’ বলল আহমদ মুসা।

‘দেখুন, আমাদের প্রত্যেকের পিস্তল আছে। আমরা পিস্তল চালাতে জানি।’

‘তোমাদের বাপ-মা আছে। সাময়িক আবেগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত তোমরা নিতে পারো না।’

‘সাময়িক আবেগ এটা আমাদের নয়। ওমর বায়া আপনার কে? তার জন্যে আপনি জীবন বাজি রেখেছেন। ডঃ ডিফরজিস আপনার কেউ নয়, কিন্তু তার জন্যে আপনি ছুটছেন মৃত্যু ভয় মাড়িয়ে। এসব কি আমাদের কোনই শিক্ষা দেয় না?’ বলল ক্লাউডিয়া আবেগপ্লাবিত স্বরে।

আহমদ মুসা সোফায় বসে পড়ল পিছিয়ে এসে। বলল, ‘আমি তোমাদের বোঝাতে পারছি না। এটা দল বেঁধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্র নয়। দুই কারণে। এক. ওরা সংখ্যায় বেশি, দুই. ওরা আগে জানতে পারলে বন্দীদের সরিয়ে নিতে পারে অথবা বন্দীদের জীবন বিপন্ন হতে পারে।’

‘ঠিক আছে। আমরা বাইরে কোথাও অপেক্ষা করতে পারি না?’ বলল রালফ।

একটু ভাবল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। পারো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমরা তৈরি হয়ে নাও।’

ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা দুই গাড়িতে করে রেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে এল।

সবুজ টিলার উপর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ব্ল্যাক ক্রসের সেই বাড়িটি। বাড়িটার আশেপাশে বাড়ি নেই বলে এবং গাছপালা থাকার কারণে আশপাশটা অন্ধকার। অন্ধকারের আরও একটা কারণ, বাড়ির বাইরের অংশে কোন আলো জ্বালানো নেই।

তিনতলার বিশাল ঘরটির পাশে বড় একটা অফিস কক্ষ। একটা সুদৃশ্য সেক্রেটারিয়েট টেবিল সামনে রেখে বসে আছে পিয়েরে পল। তার মুখে তৃপ্তির ভাব। চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল।

পিয়েরে পল টেবিলের কয়েকটা কাগজ গুছিয়ে ব্রিফকেসে রেখে ইন্টারকমের সুইচ টিপে বলল, ‘রুশো, তুমি ওমর বায়াকে তিনতলায় এনে ডঃ ডিফরজিসের পাশের রুমে রাখ। দরকার হলে ডক্টরকে ওমর বায়ার অবস্থাটা একবার দেখাবে।’

পিয়েরে পল উঠে দাঁড়াল কথা শেষ করে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত বারটা।

পিয়েরে পল ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। মুখোমুখি পাশের ঘরটাতেই রাখা হয়েছে ডঃ ডিফরজিসকে।

পিয়েরে পল গিয়ে ডঃ ডিফরজিসের দরজার সামনে একটু দাঁড়াল। তারপর দরজার নব ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ঘরে।

ঘরের এক প্রান্তে খাটে বিছানা পাতা রয়েছে। খাটের অল্প দূরে টিপয়ের দু’পাশে মুখোমুখি দু’টি সোফা পাতা রয়েছে। তারই একটিতে বসে রয়েছে ডঃ ডিফরজিস। সত্তরেরও বেশি বয়স ভদ্রলোকের। কিন্তু দেখে মনে হয় ষাট অতিক্রম করেননি। দেহের শক্ত গড়ন। তীক্ষ্ণ চোখ। উদ্বেগের একটা ছায়া ছড়িয়ে আছে তার সারা মুখে।

‘হ্যালো ডক্টর’ বলে পিয়েরে পল এগোলো ডঃ ডিফরজিসের দিকে।

ডঃ ডিফরজিস মুখ তুলে তাকাল পিয়েরে পলের দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, বেদনা এবং কৌতুহলের সংমিশ্রণ। বলল, ‘হ্যালো, বসুন।’

‘ধন্যবাদ।’ বলে পিয়েরে পল ডঃ ডিফরজিসের সামনের সোফায় বসে পড়ল। বলল, ‘আপনি একজন মহৎপ্রাণ মানুষ, ডক্টর। আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে দুঃখিত।’

‘আপনি কে? আমার সন্তান ও আমার বৌমাকে আপনারাই কি কিডন্যাপ করেছেন?’

পিয়েরে পলের মন খুশিতে ভরে গেল। সে নিশ্চিত হলো যে, রালফ-ফ্রাংকদের পালাবার কথা ডঃ ডিফরজিস এখনো জানতে পারেনি। এই না জানা তাদের কাজ উদ্ধারে অনেক সাহায্য করবে। বলল পিয়েরে পল, ‘কিডন্যাপ করেছি নয়, নিরুপায় হয়ে বাধ্য হয়েছি ঐ মন্দ কাজটা করতে।’

‘মন্দ কাজ করেছেন, সেটা বোঝেন তাহলে?’

‘বুঝি। কিন্তু মন্দ সব সময় মন্দ থাকে না। বৃহত্তর স্বার্থে, বৃহত্তর কল্যাণের জন্যে আমরা যেটা করেছি, সেটা এখন আর মন্দ নেই।’

‘আমাকে তো ধরেছেন, আমার সন্তানদের এখন ছেড়ে দিন।’

‘দেব। আপনাকেও আমরা ধরে রাখবো না। কিন্তু এ সব কিছুই নির্ভর করছে আপনার উপর।’

‘আমার উপর কেন?’

‘আপনাকে তো আমাদের পক্ষ থেকে সবই বলা হয়েছে।’

‘ও, ক্যামেরুনের বিচারপতি উসাম বাইককে তোমরা যা চাও সেই ভাবে কাজ করতে বলতে হবে।’

‘ঠিক। তবে ‘আমরা যা চাই’ তা নয়, ‘জাতি যা চায়’ তা-ই আমরা করতে বলছি।’

‘জাতিকে ব্যবহার করছেন কেন? ঐ জমি কি জাতি নিচ্ছে?’

‘জমি ‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’ নিচ্ছে চার্চের নামে।’

‘আপনার কথা সত্য হলেও ‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’-এর অন্যায়কে সমর্থন করা যায় না। অন্যান্য জাতির পক্ষ থেকে করলেও অন্যায়, ব্যাক্তি করলেও অন্যায়।’

‘আপনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন, ডক্টর।’

‘কোন বাস্তবতার কথা বলছেন?’

‘ক্রস এবং ক্রিসেন্ট-এর লড়াইয়ের কথা।’

‘এটা তো একটা পুরানো ব্যাপার।’

‘পুরানো ব্যাপার। কিন্তু নতুন করে তীব্র হয়ে উঠেছে।’

‘কিংডম অব ক্রাইস্টের ঐ অন্যায় কর্মের সাথে ক্রস এবং ক্রিসেন্টের এই যুদ্ধের সম্পর্ক কি?’

হাসল পিয়েরে পল। বলল, ‘‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’ (KOC) এবং ‘আর্মি অব ক্রাইস্ট অব ওয়েস্ট অফ্রিকা’ (AOCOWA) আফ্রিকায় ক্রস-এর পক্ষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সফল শক্তি।’

‘হতে পারে। কিন্তু তারা অন্যায় করছে। লুণ্ঠনের কাজ করছে।’

‘যদি স্বীকারও করি যে তারা এটা করছে, তবু সত্য এই যে, তারা নিজের জন্যে এটা করছে না, করছে আফ্রিকায় খৃস্টকে একচ্ছত্র বিজয়ের আসনে বসাবার জন্যে। এটা এমন বাস্তবতা যা অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই।’

বলে একটু দম নিল পিয়েরে পল। শুরু করল আবার, ‘আফ্রিকার ধর্মীয় মানচিত্রের দিকে একবার লক্ষ্য করুন। ইসলাম বা ক্রিসেন্ট আফ্রিকায় যাত্রা শুরু করেছিল উত্তর থেকে। তারপর ক্রমশ এগিয়েছিল দক্ষিণে। আফ্রিকার যতই দক্ষিণে যাওয়া যায় মুসলমানদের সংখ্যা ততই কম। তবু আফ্রিকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলেও মুসলমানরাই ছিল সবচেয়ে সক্রিয় প্রভাবশালী গ্রুপ। এ কারণেই একমাত্র আফ্রিকা মহাদেশই ‘মুসলিম মহাদেশ’ আখ্যা লাভ করেছিল। মিঃ ডিফরজিস, প্রভূত সম্ভাবনাময় এই মুসলিম মহাদেশেই খৃস্টের রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে খৃস্টের ক্রস তার যাত্রা শুরু করে। আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হয় ক্রিসেন্টের সাথে ক্রসের। ডক্টর ডিফরজিস, আফ্রিকার ধর্মীয় মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন, আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মধ্য আফ্রিকা পর্যন্ত মাত্র চারটি রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য সবগুলোতেই ক্রস আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মধ্য আফ্রিকায় চলছে আজ ক্রস এবং ক্রিসেন্টের মধ্যে লড়াই। এই মধ্য আফ্রিকা ছিল ক্রিসেন্টের শক্ত মুঠোর মধ্যে। কিন্তু সেই মধ্য আফ্রিকায় ক্রস আজ ক্রিসেন্টের শক্ত মুঠি ভেঙে দিচ্ছে। মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য সেখানে ধ্বসে পড়ছে। চাদে মুসলিম সংখ্যা শতকরা ৮৫ ভাগ থেকে ৪৪ ভাগে, নাইজেরিয়ায় ৬৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগে এবং ক্যামেরুনে ৫৫ ভাগ থেকে ১৬ ভাগে নেমে এসেছে। এছাড়া নাইজেরিয়ার উত্তরে উপকূল বরাবর মুসলিম দুর্গ অঞ্চলের কয়েকটি পকেটে আমরা বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছি। ঘানায় মুসলমানের সংখ্যা ৪৫ ভাগ থেকে ১৩ ভাগে, গিনি বিসাও ও সিয়েরালিওনে ৮০ ভাগ থেকে ৩০ ভাগে এবং বুরকিনা ফাসোতে ৫৫ থেকে ৪০ ভাগে নেমে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, নামিবিয়া থেকে ক্যামেরুনের মধ্য অঞ্চল পর্যন্ত বিশাল এলাকায় মুসলিম উচ্ছেদকরণ আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। ‘ক্রস’-এর এই যে অকল্পনীয় সাফল্য, তার জন্যে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের দাবি KOC এবং AOCOWA করতে পারে। দক্ষিণ ক্যামেরুনে ওমর বায়ার দশ হাজার একর জমি KOC দখল করতে পারলেই দক্ষিণ ক্যামেরুন থেকে মুসলিম উচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। ডঃ ডিফরজিস, আপনি এই জমিটুকু দখলে সহায়তা করে আফ্রিকায় ক্রস-এর বিজয় অভিযানে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে পারেন। ভেবে দেখুন, এই সহায়তা আপনি KOC বা AOCOWA কে করছেন না, সাহায্য করছেন প্রভু খৃস্টের ক্রসকে।’

‘আপনি বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন, আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সহায়তার জন্যে আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি আইনের ছাত্র, সারাটা জীবন আইন নিয়েই কাজ করে আসছি। আমি আপনাদের বেআইনী কাজে শরীক হতে পারবো না। আমি অনু্রোধ করছি, আমাকে ও আমার সন্তানদের অহেতুক আটকে না রেখে ছেড়ে দিন।’

‘ডক্টর ডিফরজিস, আপনি জ্ঞানী মানুষ। আপনাকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আমরা যে কাজে হাত দেই, তা শেষ না করে ছাড়ি না। আপনি যদি বিচারপতি ডক্টর উসাম বাইককে চিঠি দিতেন, টেলিফোন করে দিতেন, তাহলে আপনি এখানেই থাকতে পারতেন। কিন্তু এখন আপনাকে আমাদের সাথে ক্যামেরুন যেতে হবে।’

পিয়েরে পল কথা শেষ করলে ডঃ ডিফরজিস অনেকক্ষণ কথা বলল না। ভাবছিল সে। বলল বেশ পরে, ‘এখানে যা করছি না, ওখানে গিয়ে তা কি করব?’

‘সেটা ওখানে গিয়ে আমরা দেখব। রাজি করার আরও কিছু উপায় আমাদের আছে। তাছাড়া আপনাকে পণবন্দী দেখিয়ে ক্যামেরুনের বিচারপতিকেও আমরা আমাদের হাতের মুঠোয় আনতে পারি।’

‘জানি না সেটা আপনারা পারবেন কিনা। তবে আমাকে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না।’

‘সেটা আমাদের ব্যাপার। আমরা ভোরেই ক্যামেরুন যাচ্ছি। তাই এখানে কোন ঝামেলা করতে চাই না। তা না হলে রাজি করার দু’একটা পদ্ধতি এখানেও প্রয়োগ করা যেত।’

কথা শেষ করেই হাতের ওয়াকি-টকির একটা বোতাম টিপে মুখের কাছে তুলে ধরে বলল, ‘রুশো, দু’টো কফিন কমপ্লিট?’

‘হ্যাঁ।’ ওপাশ থেকে উত্তর এল।

‘তিনতলায় নিয়ে এস।’

‘এখনি নিয়ে যাচ্ছি স্যার।’

‘ওকে। এখন সাড়ে বারোটা। ভোর পাঁচটায় প্লেন। আমাদের ডক্টর সাহেব ও ওমর বায়াকে সসম্মানে কফিনে প্যাক করে ফেল, যেভাবে বলেছি, সেই ভাবে।’

ওয়াকি-টকি গুটিয়ে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল পিয়েরে পল। বলল, ‘ডক্টর, সব তো শুনলেন। আশা করি, আমাদের সাথে সহযোগিতা করবেন। আমার মতো আমার লোকগুলো কিন্তু ভাল নয়। মানীর মান তারা বোঝে না।’ বলে পিয়েরে পল বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

মাইক্রো সেন্সরের সংকেত অনুসরণ করে আহমদ মুসারা ব্ল্যাক ক্রস-এর টিলা বাড়িতে ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল।

অন্ধকারে ঢাকা বাড়িটি।

আহমদ মুসা টিলার গোড়ায় একটা ঝোপের আড়ালে গাড়িসমেত ক্লাউডিয়াদের রেখে আসে। আসার সময় আহমদ মুসা ওদের বলে, ‘দু’ঘণ্টার মধ্যেও যদি আমি না ফিরি, তাহলে তোমরা চলে যাবে।’

কথা শেষে একটু থেমেছিল আহমেদ মুসা। তারপর ক্লাউডিয়াকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘ডোনাকে টেলিফোন করতে চেয়েছিলাম, ভুলে গেছি। ডোনার টেলিফোন নাম্বারটা তুমি রাখ।’ বলে আহমদ মুসা টিলা বেয়ে উঠে আসে।

ক্লাউডিয়াসহ সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিল আহমদ মুসাকে। ক্লাউডিয়া, সুমাইয়া এবং জিয়ানার মুখে নতুন এক ঔজ্জ্বল্য এবং রহস্যময়তা।

আহমদ মুসা প্রাচীরের গোড়ায় এসে বাড়ির চারদিকটা একবার ঘুরে এল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়ি। ছয় ফুটের মতো উঁচু হবে প্রাচীর। একটাই মাত্র গেট। লোহার দরজা। গেটের দু’পাশে দু’টি আলো উপর থেকে শেডে ঢাকা।

গেটের পাশে কোন গেটরুম নেই।

‘তাহলে গেট কি দূর নিয়ন্ত্রিত কোন পদ্ধতিতে খোলা হয়?’ ভাবল আহমদ মুসা প্রাচীরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। ‘গেটে টিভি ক্যামেরাও পাতা থাকতে পারে’– আরও ভাবল আহমদ মুসা। প্রাচীর টপকে কি সে ভেতরে ঢুকবে? কিন্তু সেখানেও অ্যালার্ম কয়েল পাতা থাকতে পারে।

আহমদ মুসা পিঠে ঝোলানো থলে থেকে এন এন্ড এস (নাইট এন্ড স্মোক) গগলস বের করে চোখে পড়ল। তারপর পকেট থেকে ‘স্মোক টিউব’ বের করে প্রাচীরের গা ঘেঁষে পা পা করে গেটের অনেকখানি নিকটবর্তী হলো এবং টিউবের ‘উইন্ডপ্রুফ নিল’ ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিল দরজার সামনে।

মুহূর্তের মধ্যে কুয়াশার মতো সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল গেট এলাকা।

আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে দাঁড়াল গেটের সামনে। ভাবল, টিভি ক্যামেরার চোখ অন্ধ করা গেছে কিন্তু দরজার সাথে অ্যালার্ম থাকতে পারে। আহমদ মুসা জানে, গেটের অ্যালার্ম সব সময় দরজা খোলার সাথে সম্পর্কিত থাকে। তার অর্থ, অ্যালার্ম দরজার কব্জার সাথে সংযুক্ত করা হয়, যাতে দরজা খুলতে গেলেই অ্যালার্ম বেজে উঠে।

আহমদ মুসা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।

পকেট থেকে বের করল ল্যাসার কাটার এবং দরজার ঠিক মাঝখানে দুই বর্গফুট জায়গার ইস্পাত প্লেট কেটে ফেলল।

ভেতরে প্রবেশের আগে আরেকটা স্মোক টিউব ছুঁড়ে দিল ভেতরে। আহমদ মুসা সন্দেহ করছিল, ভেতরের দিকে মুখ করা ক্যামেরাও থাকতে পারে। দূর নিয়ন্ত্রিত গেটে তা-ই থাকে।

কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে আহমদ মুসা ঢুকে গেল ভেতরে।

ভেতরের চত্বরটায় সুন্দর ফুলের বাগান। গেট থেকে লাল ইটের একটা প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত।

আহমদ মুসা পকেটের রিভলভারের বাঁটে হাত রেখে বেড়ালের মত নিঃশব্দে দ্রুত এগিয়ে চলল।

আহমদ মুসা সবে গাড়ি বারান্দায় পা রেখেছে, এমন সময় পেছন থেকে আসা প্রচণ্ড ধাক্কায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে।

কিন্তু পড়ে গেলেও পকেট থেকে তার হাত সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারসমেত বেরিয়ে এসেছে।

আহমদ মুসা বুঝল, পেছন থেকে অন্তত দু’জন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

আহমদ মুসা পড়ে গিয়েই নিজের শরীরটাকে বাম দিকে উল্টে নিল ওরা তার উপর চেপে বসার আগে।

আহমদ মুসা তার শরীর বাম দিকে উল্টে নেবার ফলে তার শরীরটা পেছন থেকে আসা চাপের মূল কেন্দ্র থেকে একপাশে সরে এল, যার কারণে আক্রমণকারীদের একজন ডানপাশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। শুধু তা-ই নয়, আহমদ মুসার ডান হাতে ধরা রিভলভারের মুখেও এসে পড়ল।

শরীরটা উল্টে নেবার পর গুলি করতে মুহূর্তও বিলম্ব করেনি আহমদ মুসা। সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে অস্পষ্ট ‘দুপ’ করে একটা শব্দ উঠল। বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল লোকটার।

এদিকে দ্বিতীয় লোকটা আহমদ মুসার উপর চেপে বসেছিল। তার শক্ত দুই হাত সাঁড়াশির মত বসে যাচ্ছিল আহমদ মুসার গলায়।

আহমদ মুসার মনে হচ্ছিল, গলাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। চোখ দু’টি তার বিস্ফারিত হয়ে উঠছিল।

আহমদ মুসার ডান হাত উঠে এল। তার ডান হাতের রিভলভারটি এসে স্পর্শ করল লোকটির মাথা।

লোকটি চমকে উঠে চকিতে এদিকে একবার চোখ ঘুরিয়েই একটু কাত হয়ে মাথাটা সরিয়ে নিতে গেল। কিন্তু আহমদ মুসার আঙুল ট্রিগারে চাপ দিয়েছে তার আগেই।

আহমদ মুসার উপর থেকে উল্টে পড়ে গেল লোকটা। গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল তার মাথা।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। একটু সরে এসে একটা থামের আড়ালে দাঁড়াল সে।

প্রায় মিনিটখানেক অপেক্ষা করল। না, কোন দিক থেকে কেউ এল না। আহমদ মুসা বুঝল, প্রাচীর বরাবর এই দু’জনই ছিল পাহারায়।

থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। গাড়ি বারান্দার চারদিকে তাকাল। দেখল, একটু পশ্চিম দিকে পাকা শেড আকারের একটা ঘর। গাড়ি বারান্দা থেকে লাল ইটের একটা রাস্তা ঐ ঘর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। আহমদ মুসা বুঝল, ওটাই গ্যারেজ। ঐ গ্যারেজেই তার টার্গেট গাড়িটা রয়েছে।

আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, লাল ইটের একটা সরু রাস্তা বিল্ডিং-এর পেছন দিক থেকে এসে গ্যারেজের সামনে দিয়ে প্রাচীরের দিকে চলে গেছে।

আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দা থেকে তিনটি ধাপ ডিঙিয়ে বিল্ডিং-এর বারান্দায় উঠল।

বিরাট দরজা। দেখেই বুঝল, কাঠের দরজা। কিন্তু দরজার চার প্রান্তই ইস্পাতের পাত দিয়ে মোড়া। ‘কী-হোল’ পরীক্ষা করে দেখল। নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা, এ দরজাও দূর নিয়ন্ত্রিত।
আহমদ মুসা মুশকিলে পড়ল। ল্যাসার কাটার দিয়ে কাঠের দরজা ধীরে ধীরে পোড়ানো যায়, কিন্তু কাটা যায় না। পোড়ানোর ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ। তাহলে?
আহমদ মুসার মনে পড়ল বাড়ির পেছন থেকে আসা রাস্তার কথা। ওটা ক্লিনার প্যাসেজ নয়তো?
আহমদ মুসা নেমে এল বারান্দা থেকে।
লাল ইটের সরু রাস্তা ধরে এগোলো বাড়ির পেছন দিকে।
সেই রাস্তাটি আহমদ মুসাকে একটা ছোট সাইজের দরজার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। ভারি ইস্পাতের তৈরি দরজা। পরীক্ষা করে দেখল, অটো লক সিস্টেম। বাইরে থেকে চাবি দিয়ে খোলার কোন ব্যবস্থা নেই। তবু খুশি হলো আহমদ মুসা। এ লকগুলো কাটা ল্যাসার কাটার দিয়ে খুব সহজ। দরজার গায়ে কী-লকের চিহ্ন দেখে ‘লক’-এর অবস্থান চিহ্নিত করল আহমদ মুসা। তারপর সেই স্থানে দরজা ও চৌকাঠের মাঝ বরাবর ল্যাসার কাটারের বীম প্রবেশ করাল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নড়ে উঠল দরজা। ‘লক’ কেটে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
জায়গাটা করিডোরের একটা প্রান্ত। আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে চমকে উঠল। দেখল, ‘লক’-এর সাথে একটা অ্যালার্ম ট্রান্সমিটার লাগানো। এর অর্থ, ‘লক’-এর উপর আঘাত এলে তা আহত করবে ট্রান্সমিটারকেও। সঙ্গে সঙ্গেই তা সংকেত পাঠাবে অ্যালার্ম-এর গ্রাহক যন্ত্রে বা বাজিয়ে দেবে অ্যালার্ম।
দরজা বন্ধ না করেই ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। সে নিশ্চিত, এতক্ষণে অ্যালার্ম বেজে গেছে এবং ব্ল্যাক ক্রস-এর লোকেরা এতক্ষণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা রিভলভার হাতে নিয়ে বেড়ালের মত সামনে এগোলো।
করিডোরের দুই পাশের রুমগুলোকে বিভিন্ন জিনিসের স্টোর বলে মনে হলো আহমদ মুসার।
করিডোরটি একটি বড় ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। কক্ষে কয়েকটি কাটিং টেবিল এবং কয়েকটি ওয়াশ বেসিন। আহমদ মুসা বুঝল, এটা কুকিং প্রিপারেশন রুম।
কক্ষে এসে শেষ হওয়া করিডোর-মুখ থেকে বিপরীত দিকে কক্ষটিতে আরেকটা দরজা আছে। সেখান থেকে আরেকটা করিডোরের শুরু।
করিডোরে উঁকি দিতেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা।
চকিতে সরে এসে দরজা ঘেঁষে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল সে।
ছুটে আসা প্রথম লোকটি ঘরের ভেতরে পা বাড়ালে আহমদ মুসা তার ডান পা এগিয়ে দিল ছুটে আসা পায়ের সামনে। লোকটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। তার স্টেনগানটা ছিটকে চলে এল আহমদ মুসার পায়ের কাছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান তুলে নিয়েই গুলি চালাল। পড়ে যাওয়া লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছিল এবং ইতোমধ্যে আরেকজন লোক এসে ঘরে ঢুকেছিল। তারা দু’জনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল।
ওদের উপর গুলি চালিয়ে স্টেনগানের ব্যারেলটা ঘুরিয়ে নিল করিডোরের দিকে।
করিডোর দিয়ে ছুটে আসা চারজন একদম গুলির মুখে পড়ল। কোন কিছুর আড়াল নেবার কোন সুযোগ ছিল না তাদের। চারজনই গুলি খেয়ে বোঁটা ছেঁড়া ফলের মত করিডোরের উপর ঝরে পড়ল।
আহমদ মুসা করিডোরে উঁকি দিয়ে দেখল, কেউ নেই আর করিডোরে।
স্টেনগান বাগিয়ে করিডোরের মুখে গিয়ে দাঁড়াল। অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। বিস্মিত হলো, কোন তৎপরতা তাদের নেই কেন? আশংকার এক মেঘ দ্রুত মনে উদয় হলো, তারা কি আক্রমণের পথ পরিবর্তন করেছে?
মনের এ চিন্তাটা শেষ না হতেই তার কানে এল পেছন থেকে পায়ের শব্দ।
সঙ্গে সঙ্গেই বোঁ করে ঘুরল আহমদ মুসা। কিন্তু স্টেনগান তোলার সুযোগ হলো না। দেখল, তার মাত্র দুই গজ পেছনে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে একজন। তার স্টেনগানের নল আহমদ মুসার বুক বরাবর উঠানো।
আহমদ মুসার প্রাথমিক বিমূঢ়তা তখনও কাটেনি। এমন সময় রিভলভারের একটা গুলির শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। আর সাথে সাথেই সামনের স্টেনগানধারী লোকটির দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পেছন দিকে উল্টে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা দেখতে পেল পিস্তল হাতে ক্লাউডিয়াকে এবং তার পেছনে ওপাশের করিডোরের মুখে সুমাইয়া ও জিয়ানাকে। তাদের হাতেও পিস্তল। ক্লাউডিয়া এবং ওরা তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা ওদিকে এগোবার জন্যে পা একধাপ বাড়িয়েছিল। এই সময় রিভলভারের গর্জন শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাউডিয়া বুক চেপে ধরে মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা শব্দ শুনেই তাকাল ঘরের উত্তর দিকে। দেখল, সেখানে একটা দরজা খুলে গেছে। এ দরজা আহমদ মুসার নজরে পড়েনি আগে। দরজার এপারে দাঁড়িয়ে একজন লোক। তার রিভলভারের নল ঘুরে আসছে ক্লাউডিয়ার দিক থেকে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা স্টেনগান তুলেই তাকিয়েছিল শব্দ লক্ষ্যে। লোকটির উপর তার নজর পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার স্টেনগান গুলি বৃষ্টি করল।
লোকটি গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই পড়ে গেল।
আহমদ মুসা গুলি করেই ছুটে গেল ক্লাউডিয়ার কাছে। রক্তপ্লাবিত ক্লাউডিয়ার মাথাটা হাতে তুলে নিল।
জিয়ানা ও সুমাইয়াও ছুটে আসছিল ক্লাউডিয়ার দিকে। ডাঃ জিয়ানা ছিল সামনে। ঘরের মাঝখানে যখন সে, উত্তরের দরজার দিকে শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখতে পেল, দরজায় দাঁড়িয়ে একজন লোক। তার হাতের ভয়ংকর মেশিন রিভলভার উঠেছে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
ডাঃ জিয়ানা একটা চিৎকার তুলে ছুটে গিয়ে নিজের দেহ দিয়ে আহমদ মুসার দেহ ঢেকে দিল। প্রায় সাথে সাথেই মেশিন রিভলভার থেকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। সবগুলো গুলিই এসে বিদ্ধ করল জিয়ানাকে।
ওদিকে সুমাইয়া জিয়ানাকে উত্তরের দরজার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসার দিকে চিৎকার করে ছুটতে দেখে উত্তরের দরজার দিকে চাইল। সে দেখতে পেল, একজন লোকের রিভলভার আহমদ মুসার দিকে উদ্যত। সে মুহূর্তে তার মেশিন রিভলভার গুলিবর্ষণ করল।
সুমাইয়াও তার রিভলভার তুলেছিল। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সুমাইয়ার গুলি যখন লোকটির বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল, তখন যা হবার হয়ে গেছে। ঝাঁঝরা হয়ে গেল ডাঃ জিয়ানার দেহ।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে জিয়ানার নিষ্প্রাণ দেহ মেঝেয় রাখল।
দেখল, ক্লাউডিয়া কিছু বলতে চাচ্ছে। সুমাইয়া ছুটে এসে ক্লাউডিয়ার মাথাটা তুলে ধরেছে।
আহমদ মুসা একটু এগিয়ে ক্লাউডিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘এ তোমরা কি করলে ক্লাউডিয়া! কি ঘটে গেল এসব!’
ক্লাউডিয়া ঠোঁট নাড়ল। শুকনো ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নিতে চেষ্টা করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘আমি এবং জিয়ানা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরা ইসলাম গ্রহণ করব। আমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে প্রা-র্থ-না ক-রো।’ ক্ষীণ হয়ে এসে তার কণ্ঠ থেমে গেল। কণ্ঠ থেমে যাওয়ার সাথে সাথে মুখ একদিকে ঢলে পড়ল তার। স্থির হয়ে গেল তার দেহ।
আহমদ মুসা কয়েকবার ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকল ক্লাউডিয়াকে। তারপর মাথাটা নিচু করে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
সুমাইয়া ক্লাউডিয়ার মাথা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
‘রুশো’ ‘রুশো’- এই শব্দগুলো কানে প্রবেশ করল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা মুখ থেকে হাত সরিয়ে শব্দ লক্ষ্যে উত্তরের দরজার দিকে তাকাল। আহমদ মুসার দু’টি গণ্ড চোখের পানিতে ধোয়া। সুমাইয়ার গুলিতে নিহত লোকটার পকেটে ওয়াকি-টকি দেখতে পেল আহমদ মুসা। ঐ ওয়াকি-টকিই শব্দের উৎস।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে গিয়ে ওয়াকি-টকি তুলে নিল। তখনও ওয়াকি-টকিতে কেউ বলছিল, ‘ওদিকে কি খবর, কথা বলছ না কেন, রুশো?’
আহমদ মুসা বুঝল, এই লোকটার নাম রুশো। নিশ্চয় পিয়েরে পল কিংবা কোন বড় নেতা কথা বলছে।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে বলল, ‘আমরা ব্যস্ত স্যার। আমি লাইনে আছি, বলুন।’
‘বুঝেছি। শোন, আমরা দু’টো কফিন নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমরা এ ঘাঁটি ছেড়ে দাও। ক্যামেরুনে যোগাযোগ করবে।’
বন্ধ হয়ে গেল ওয়াকি-টকি।
আহমদ মুসা দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘সুমাইয়া, আমার সাথে এস। ওরা পালাচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা করিডোর ধরে ছুটল ভেতরে। তার লক্ষ্য বাইরে বেরুবার সেই বড় গেট।
আহমদ মুসা এ করিডোর, সে করিডোর ঘুরে বাইরে বেরুবার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, সে দরজা আগের মতই বন্ধ।
এই সময় আহমদ মুসা মাথার উপর থেকে ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ শুনতে পেল। একটু শুনে আহমদ মুসা বলল, ‘নিশ্চয় ছাদের উপর একটা হেলিকপ্টার স্টার্ট নিচ্ছে।’
বলে পেছন ফিরে ছুটল হল ঘরের দিকে উপরে উঠার জন্যে।
পেছনে ছুটল সুমাইয়াও।
যখন আহমদ মুসা ছাদের উপর উঠল, তখন হেলিকপ্টারটি স্টার্ট নিয়ে ছাদ ছেড়ে বেশ উপরে উঠেছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাড়ির এলাকা ছেড়ে চলে গেল হেলিকপ্টারটি।
ক্লান্ত দেহ নিয়ে আহমদ মুসা বসে পড়ল ছাদে। বলল, ‘ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে পিয়েরে পল পালিয়ে গেল সুমাইয়া। পারলাম না ওদের কাছে পৌঁছতে। জানতাম না, ছাদে ওরা হেলিকপ্টার রেখেছে।’
একটু দম নিল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘ওরা হাতের বাইরে চলে গেল সুমাইয়া।’
‘হাতের বাইরে? কোথায়?’
‘পিয়েরে পল ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিসকে নিয়ে ক্যামেরুন চলে গেল।’
একটু থামল। বলল আবার, ‘কিন্তু বুঝতে পারছি না, ওমর বায়া ও ডঃ ডিফরজিসকে কফিনে করে নিয়ে গেল কেন?’
কথাটা বলেই আহমদ মুসা ভাবল, নিশ্চয় ওদেরকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু অস্বীকৃত এবং কিডন্যাপ করা দু’জন লোককে বিমানে মুক্তভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এই কথা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার মনে হলো, বিমানবন্দরের সাহায্যে তো দুটো কফিনকে চেক করানোর ব্যবস্থা করা যায়! চেক করা গেলেই তারা ধরা পড়ে যাবে।
নতুন আশার আনন্দে আহমদ মুসার মন সজীব হয়ে উঠল। বলল, ‘চল সুমাইয়া, এদের ঘাঁটিটা একটু পরীক্ষা করে আমরা চলে যাব।’
কিছু অস্ত্র ছাড়া গোটা ঘাঁটিতে কোন কাগজপত্র পেল না। কোন টেলিফোন গাইডও নয়। টেলিফোনগুলোতেও কোন নাম্বার নেই।
আবার পুরানো বিস্ময়টাই আহমদ মুসাকে আচ্ছন্ন করল, আশ্চর্য এই দল! কোন চিহ্ন এরা পেছনে রেখে যায় না।
আহমদ মুসা ও সুমাইয়া বেরিয়ে এল ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটি থেকে। সাথে নিল ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার নিষ্প্রাণ দেহ।
সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠল আহমদ মুসা।
ভোর রাতেই ক্লাউডিয়া ও জিয়ানার লাশ আহমদ মুসা পাঠিয়ে দিয়েছিল তাদের বাড়িতে। সাথে আহমদ মুসা লিখে দিয়েছিল চিঠি। রালফ এবং ডেবরারা পরামর্শ দিয়েছিল গুণ্ডা-বদমাইশদের হাতে আক্রান্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার কাহিনী লিখতে। কিন্তু আহমদ মুসা তাতে রাজি হয়নি। কারণ, তাতে তাদের আত্মত্যাগের কাহিনী সবার অজানা থাকবে। সত্য জানার পর তাদের বাপ-মা যদি আহমদ মুসার প্রতি বিরূপ হয়, গালি দেয়, তাহলে আহমদ মুসা তার প্রাপ্য বলে সেটা মাথা পেতে নেবে। এটুকু গালমন্দ খেয়ে আহমদ মুসা তাদের বিরাট আত্মত্যাগকে বুলন্দ করতে যদি পারে, তাহলে এটা হবে আহমদ মুসার জন্যে বিরাট সান্ত্বনা। খুব অল্প সময়ে তারা পৃথিবী থেকে চলে গেছে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকবে তাদের এই ত্যাগের আদর্শের মধ্যে। এসব চিন্তা করে আহমদ মুসাকে ক্লাউডিয়ারা উদ্ধার করা থেকে শুরু করে তাদের ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সব কথাই আহমদ মুসা লিখে দিয়েছে।
পরে আহমদ মুসার এ সিদ্ধান্তের সাথে সবাই একমত হয়েছে। বলেছে, ‘সত্যের এমন একটা শক্তি আছে যা মানুষকে জয় করতে পারে।’
আহমদ মুসা ঘুম থেকে উঠে লাউঞ্জে গেল। সেখানে আগে থেকেই রালফ, ডেবরা, সুমাইয়া বসেছিল। নেকা, রিশলা ভোরেই চলে গিয়েছিল।
‘স্যরি রালফ, ঘুমিয়ে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। সকালেই বিমানবন্দরে খোঁজ নেয়া দরকার ছিল। রালফ, বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে লাগাও দেখি।’
‘কি বলব ভাইয়া?’
‘ক্যামেরুনের ‘দুয়ালা’ অথবা রাজধানী ‘ইয়াউন্ডি’তে আজ ফ্লাইট কখন? ফ্লাইট থাকলে জিজ্ঞেস করবে, ঐ ফ্লাইটের জন্যে দুটো কফিন বুক হবার কথা ছিল, হয়েছে কিনা। ব্যস।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি।’ বলে রালফ পাশ থেকে মাইক্রো টেলিফোন তুলে নিয়ে উঠে গেল পাশের কক্ষে।
মিনিটখানেক পরেই ফিরে এল রালফ। তার মুখ মলিন। বলল, ‘আজ ভোর পাঁচটায় ক্যামেরুনে ডাইরেক্ট ফ্লাইট ছিল। সে ফ্লাইটে দুটো কফিন গেছে।’
‘ফ্লাইটটা ‘দুয়ালা’ না ‘ইয়াউন্ডি’তে?’
‘দুয়ালা।’
‘আর কোন খবর?’
‘আজ আর কোন ফ্লাইট ক্যামেরুনে নেই। তবে নাইজেরিয়ার লাগোস-এ একটা ফ্লাইট আছে। লাগোস থেকে কানেক্টিং ফ্লাইট আছে দুয়ালা’র জন্যে।’
‘ক’টায়?’
‘বারটায়।’
আহমদ মুসা কথা বলল না। মাথা নিচু করে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বলল, ‘রালফ, আরেকটু কষ্ট কর। এয়ারপোর্টের বুকিং–এ টেলিফোন করে একটা সিট বুক করো লাগোসগামী ফ্লাইটে।’
‘কেন? কে যাবে?’
‘আমি।’
‘আপনি?’ বলল রালফ। সুমাইয়া, ডেবরা এবং রালফ- সবারই বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
কিছুক্ষণ তারা কথা বলতে পারলো না। কথা বলল অবশেষে সুমাইয়া, ‘আপনি ক্যামেরুনে যাবেন- এ চিন্তা আমার মাথায় এসেছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যাবেন, তা ভাবিনি।’
‘ওদের ষড়যন্ত্র আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার। ওরা ডক্টর ডিফরজিসকে বাধ্য করবে অথবা তাকে পণবন্দী করে বাধ্য করবে ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিসকে তাদের ষড়যন্ত্র সফল করতে। এ সুযোগ তাদের দেয়া যাবে না।’
‘তাহলে টিকেট একটা নয়, দু’টি করতে হবে।’ বলল রালফ।
‘কেন?’
‘আমিও যাব।’
‘না, তোমার যাওয়া হবে না।’
‘কেন, আমার পিতাকে মুক্ত করার অভিযানে আমি যাব না?’
‘গেলে ভালই হতো। কিন্তু ডেবরাকে একা রেখে বর্তমান অবস্থায় তোমার যাওয়া হবে না।’
‘এখানে আমার মন মানবে না।’
‘দেখ, প্রয়োজন হলে তোমাকে জোর করেই নিতাম। প্রয়োজন যদি হয় তোমাকে ডাকব।’
‘কিন্তু আমার পিতার মুক্তির জন্যে আপনি যাবেন, আমি যাব না, এ কেমন কথা হবে?’
‘কিন্তু আমার স্বার্থই বড়। ব্ল্যাক ক্রস-এর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে পারলে একটা যুদ্ধে আমার জাতির বিজয় হবে, না পারলে পরাজয়ের গতি আরও তীব্রতর হবে। সুতরাং, তোমার পিতাকে উদ্ধার করা আমার স্বার্থের অংগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘ঠিক আছে, আমার অনুরোধ, আমাকে ডাকার কথা বলেছেন, সেটা রাখবেন।’ বলে রালফ উঠল টেলিফোনে বিমানবন্দরে কথা বলার জন্যে।
রালফ উঠে গেলে কিছুক্ষণ নীরবতা। তিনজনই নীরব। চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছে আহমদ মুসা।
‘কি হলো, কি হচ্ছে সুমাইয়া আপা! পৃথিবীর রূপটা আমার কাছে পাল্টে যাচ্ছে।’ বলল ডেবরা।
আহমদ মুসা চোখ খুলেছিল। সুমাইয়া কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না সুমাইয়া, ব্ল্যাক ক্রসের ঘাঁটিতে ঢোকার সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত তোমরা কেমন করে নিয়েছিলে?’
সুমাইয়ার মুখ ম্লান হয়ে গেল।
কথা বলল ডেবরা, ‘ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার জেদে এটা ঘটেছে। তাদেরকে রালফ এবং আমরা রুখতে পারিনি। শেষে তাদের সাথী হয় সুমাইয়া।’
সুমাইয়া বলল, ‘তবে আমরা ঘাঁটিতে ঢুকব, এ কথা তারাও প্রথমে ভাবেনি। ক্লাউডিয়া বলেছিল, আমরা কি হচ্ছে তা দেখব মাত্র। কিন্তু এগিয়ে গাড়ি বারান্দায় যখন দুটো লাশ দেখা গেল, তখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। আপনাকে ঐ দু’জনের আক্রমণ এবং তাদের সাথে আপনার লড়াই আমরা গেটের আড়ালে থেকে দেখেছি। আপনি যখন বাড়ির পেছন দিকে এগোলেন, আমরাও এগোলাম। ঐ দু’জনের লাশ দেখে ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানা দু’জনেই বলল, ‘আমাদের ওর পেছনে থাকা উচিত, যাতে এই ঘটনার মত আর কেউ তাকে পেছন থেকে আক্রমণ করতে না পারে।’ এরপরই আমরা আপনার পেছনে পেছনে ঘাঁটিতে ঢুকেছি।’ থামল একটু সুমাইয়া।
সুমাইয়া তার চোখের কোণায় জড়ো হওয়া অশ্রু ওড়না দিয়ে মুছে আবার শুরু করল, ‘ইসলামের জন্য ক্লাউডিয়া ও জিয়ানার মধ্যে কি যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল! গত রাতে আপনার পিছে পিছে এগোবার সময় ক্লাউডিয়া বলেছিল, সে ফ্রান্সের সব মুসলিম ছাত্রীকে গার্লস ক্যাডেট কোরে নিয়ে আসবে এবং তাদেরকে ফ্রান্সের একটা সক্রিয় শক্তি হিসেবে গড়ে তুলবে। জিয়ানা বলেছিল, মুসলিম ছাত্রীদের নিয়ে সে একটা গার্লস হিউম্যান রাইটস ফোরাম গড়ে তুলবে, যারা লড়াই করবে ফরাসী সরকারের সাংস্কৃতিক নির্যাতন ও বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে। এসব কথা আমাকে এখন খুব পীড়া দিচ্ছে। তাদের এই স্বপ্ন কে বাস্তবায়ন করবে!’
থামল সুমাইয়া। তার দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
‘তুমি, আমি কি ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানা হতে পারি না? পারি না তাদের স্বপ্ন সফল করতে?’ বলল ডেবরা ভারি কণ্ঠে।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে শুনছিল তাদের কথা।
রালফ ফিরে এসে বসেছিল ডেবরার পাশে। সে ডেবরার একটা হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, ‘পারবে ডেবরা এটা! তাহলে সবচেয়ে খুশি হবো আমি। আমি তোমাদের সহযোগিতা করব সকল শক্তি দিয়ে।’
‘পারব আমরা। ডোনা আপা আমাদের নেতৃত্ব দেবে। তার মত সাহসী ও প্রাণবন্ত মেয়ে আমি ফ্রান্সে আর দেখিনি।’ বলল সুমাইয়া।
আহমদ মুসা চোখ খুলল। তার চোখের কোণা ভেজা। বলল, ‘আমি ফরাসি নই, তবু কিছু সহযোগিতা তোমাদের করতে পারব।’
‘কে বলল আপনি ফরাসি নন? ডোনা আপা ফ্রান্সের একজন শীর্ষ নাগরিক। আপনি ফরাসি হবেন না কেন?’ বলল ডেবরা।
ব্রেকফাস্ট রেডি হওয়ার খবর এল এ সময়।
ব্রেকফাস্ট শেষে আবার এসে বসল তারা।
বসেই সুমাইয়া বলল, ‘আপনাকে বলতে ভুলে গেছি, ক্লাউডিয়াকে যে নাম্বার দিয়েছিলেন সেই নাম্বারে আমি ডোনাকে টেলিফোন করেছিলাম।’
‘কখন?’
‘আটটার দিকে। কিন্তু ডোনা ভাবীকে পাইনি। ওর আব্বা ওকে নিয়ে একটু বাইরে বেরিয়েছেন।’
‘কার সাথে কথা বলেছ?’
‘এলিসা গ্রেস নামের কে একজনের সাথে। আপনি টেলিফোন করুন ওখানে। ডোনা ভাবী গতকাল থেকে কান্নার উপরে আছে। সবাই উদ্বিগ্ন সেখানে। ডোনা ভাবী বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। ডোনাকে একটু সান্ত্বনা দেবার জন্যেই ওর আব্বা ওকে একটু বাইরে নিয়ে গেছেন।’
‘আমার ভুল হয়েছে, গতকালই ওকে টেলিফোন করা উচিত ছিল। তুমি এলিসাকে আর কি বলেছ?’
‘আমি শুধু আপনার খবর দিয়েছি, আর কিছু নয়।’
‘তোমাদের আপত্তি না থাকলে একটা রিং করি লা-ইলে।’
‘আমাদের আপত্তি নেই, আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমাদের মাঝে বসে কথা বলতে।’ বলল ডেবরা।
বলে ডেবরাই রিং করল লা-ইলে। লা-ইল রেস্টহাউসের পিএবিএক্স অপারেটরের কাছে ডেবরা লাইন চাইল ডোনাদের কক্ষের। কয়েক সেকেন্ড নীরবে অপারেটরের কথা শুনে টেলিফোন কানে রেখেই মুখ সরিয়ে নিয়ে ডেবরা বলল, ‘অপারেটর বলছে, ওরা আজ হোটেল ছেড়ে দিয়েছে।’
শুনেই আহমদ মুসা ডেবরার কাছ থেকে টেলিফোন হাতে নিল। টেলিফোনের স্পীকার মুখের কাছে এনে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘ক’টায় ওরা হোটেল ছেড়েছেন?’
‘দশটায়।’
‘কোন মেসেজ রেখে গেছেন তারা?’
‘একটু ধরুন, দেখি।’
আধ মিনিট পরেই ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে এল। বলল, ‘একটা মেসেজ আছে স্যার। আমি পড়ছি, ‘সকাল আটটায় টেলিফোন পেয়ে আমি সেখানে চলে গেলাম।’-মারিয়া জোসেফাইন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা রেখে দিল টেলিফোন।
আহমদ মুসার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিল সুমাইয়া, ডেবরা এবং রালফ।
‘ডোনারা এখানে আসছে।’ বলেই আহমদ মুসা সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি এই রেস্টহাউসের ঠিকানা দিয়েছিলে?’
‘দিয়েছি।’ বলল সুমাইয়া।
‘ডোনা দেখছি সাংঘাতিক চালাক হয়ে উঠেছে।’
‘কি ঘটেছে?’ বলল ডেবরা।
‘সে একটা মেসেজ রেখে এসেছে। তাতে সে বলেনি যে, সে কুমেট আসছে। বলেছে, ‘আটটার টেলিফোন পেয়ে সেখানে চলে গেলাম।’ অত্যন্ত বুদ্ধিমতীর কাজ করেছে সে।’
‘কেন করবে না? একে রাজরক্ত, তার উপর সুপারম্যানের সাহচর্য্য।’ বলল ডেবরা।
আহমদ মুসা আর এদিকে কান না দিয়ে ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘এখন তো সাড়ে দশটা। আমাকে অন্তত এগারটায় এয়ারপোর্ট রওয়ানা হতে হবে।’
‘কিন্তু কোন সময় নষ্ট না করে খুব ভাল স্পীডেও যদি ডোনা আসেন, তবুও সাড়ে এগারটার আগে তিনি পৌঁছতে পারবেন না।’ বলল সুমাইয়া।
‘ঠিক। সব আল্লাহর ইচ্ছা। ঘটনার উপর আমাদের আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।’
‘কেন, ক্যামেরুন যাত্রা একদিন পেছানো যায় না? উনি আসছেন জানার পর এভাবে চলে যাওয়াটা শোভন নয়।’ বলল ডেবরা।
‘ঠিক বলেছ ডেবরা, কিন্তু ওমর বায়া এবং ডঃ ডিফরজিস যে অবস্থায় ওদের হাতে আছে এবং যে ষড়যন্ত্র নিয়ে ওরা এগোচ্ছে, তাতে একদিনও তো নষ্ট করা যায় না। ডোনার সাথে দেখা হওয়াটা একান্তই একটা পারসোনাল ব্যাপার, কিন্তু ক্যামেরুনের ব্যাপারটা জাতীয় এবং অনেকটা জীবন-মরণের প্রশ্ন।’
‘জিজ্ঞেস করি, আপনার জীবনে আপনি কি নিজের জন্যে কোন সময় রেখেছেন? আপনি ডোনার প্রতি অবিচার করছেন।’ বলল সুমাইয়া।
‘এই মুহূর্তে ক্যামেরুন যাত্রা স্থগিত করা ঠিক হবে না। ডোনাও এটা পছন্দ করবে না।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা বস, আমি তৈরি হয়ে নেই।’
আহমদ মুসা চলে গেল তার কক্ষের দিকে।
মিনিট পাঁচেক পরেই তৈরি হয়ে এল আহমদ মুসা। তার পিঠে ঝুলিয়ে রাখার মত একটা ট্যুরিস্ট ব্যাগ।
বসল আহমদ মুসা সুমাইয়ার মুখোমুখি সোফাটায়।
বসেই বলল, ‘সুমাইয়া, তুমি সাংবাদিক। তোমাকে একটা বড় কাজের দায়িত্ব দিয়ে যাব।’
‘কি সেটা?’ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুমাইয়ার মুখ।
‘তোমাকে একটা নিউজ করতে হবে।’
‘নিউজ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি নিউজ, কেন?’
‘দক্ষিণ ক্যামেরুনে মুসলমানদের ভূমি আত্মসাৎ এবং তাদের উচ্ছেদ চলছে- এই বিষয়ের উপর একটা রিপোর্ট তোমাকে করতে হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ওমর বায়ার সম্পত্তি ঘিরে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা নিয়ে আসতে হবে। বলতে হবে, ওমর বায়াকে পণবন্দী করে রাখা হয়েছে, তার যে জমি আত্মসাৎ করা হয়েছে তাকে বৈধ করিয়ে নেবার জন্যে। ক্যামেরুনের প্রধান বিচারপতি উসাম বাইকের আদালত থেকে নানা কৌশলে এই বৈধকরণ রায় লাভের চেষ্টা ষড়যন্ত্রকারীরা শুরু করে দিয়েছে।’ থামল আহমদ মুসা।
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সুমাইয়ার। বলল, ‘সাংঘাতিক বুদ্ধি করেছেন। তাদের ষড়যন্ত্রকে ব্লক করার জন্যে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে এটা, এ চিন্তা আপনার মাথায় এল কি করে? পারব আমি এ রিপোর্ট করতে। তবে এ জন্যে আরও কিছু তথ্যের প্রয়োজন হবে।’
আহমদ মুসা তার পকেট থেকে ফোল্ডিং করা একখণ্ড কাগজ বের করে সুমাইয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘প্রয়োজনীয় তথ্য তুমি এ থেকে পাবে।’
সুমাইয়া কাগজটি হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে গোটা কাগজটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। প্রয়োজনীয় সাহায্য এ থেকে পাব আশা করি।’
সুমাইয়া একটু থামল। ভাবল। সে-ই আবার শুরু করল কথা, ‘পরবর্তী নির্দেশ কি? কি করব আমি এই নিউজ? আমার কাগজে ছাপব কি?’
‘না, তোমার কাগজে ছাপাবে না। আমি চাই একে আন্তর্জাতিক নিউজ করতে, যাতে ক্যামেরুনেও পৌঁছে।’
আহমদ মুসা একটু থামল। সোজা হয়ে বসল সোফায়। বলল, ‘তুমি তো ‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি’ (WNA) এবং ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন’ (FWTV)-এর একজন প্রতিনিধিও, তাই না?’
‘জি, আমি প্রতিনিধি। কিন্তু আপনি তো ওদের মাথার মণি।’ বলল সুমাইয়া।
‘শেষ কথাটা ওভাবে না বললেই ভালো হতো। বিশেষণের ব্যবহার কোন সময়ই সঠিক হয় না। আচ্ছা থাক এ কথা। তুমি যখন WNA এবং FWTV-তে নিউজ পাঠাবে, তখন নিউজের শেষে ‘RFAM-7’-এই কোডটি লিখে দেবে।’
সুমাইয়া হাসল। বলল, ‘বুঝলাম, ঐ দুই সংবাদমাধ্যমের জন্যে এটা আপনার কোড। কিন্তু কোডটা যে খুবই স্পষ্টঃ নাম্বার সেভেন রিকোয়েস্ট ফ্রম আহমদ মুসা।’
‘খুবই সহজ। কিন্তু শেষের নাম্বারটাই আসল। রিকোয়েস্টের সিরিয়াল নাম্বার তারা এবং আমি জানি। সুতরাং, সহজ হলেও এই কোড অন্য কারও পক্ষেই ব্যবহার করা সম্ভব নয়।’
কথা শেষ করে ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন উঠতে হয়।’
‘কিন্তু আরেকটা জিনিস আপনি বলেননি, রিপোর্টটা কবে পাঠাব।’ সুমাইয়া বলল।
‘হ্যাঁ, ঠিক কথা মনে করেছ। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই, ব্ল্যাক ক্রস চীফ জাস্টিস উসাম বাইকের সাথে যোগাযোগ করার পর এ রিপোর্টটা ছাপা হোক। সুতরাং, এ রিপোর্টটা তুমি আজ থেকে ঠিক তৃতীয় দিনে পাঠাবে, তাহলে চতুর্থ দিনে রিপোর্টটা ছাপা হবে।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘কিন্তু এর মধ্যে যদি বিচারপতি উসাম বাইকের সাথে ওদের যোগাযোগ বা দেখা না হয়?’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল সুমাইয়া।
‘নাও হতে পারে। তবে যোগাযোগ করার জন্যে খুব বেশি সময় নেবার তাদের প্রয়োজন আছে কি? তারা চাইবে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে, এটাই স্বাভাবিক।’
উঠে দাঁড়িয়েছে রালফ এবং ডেবরাও।
‘তাহলে সুমাইয়া, ডেবরা, সময় যদি থাকে ডোনাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।’
‘কেন, আমরা এয়ারপোর্টে যাচ্ছি না?’ বলল সুমাইয়া।
‘না, আমার সাথে রালফ যাবে। তোমাদের এখানে থাকা উচিত, অন্তত ডোনার জন্যে।’
‘ঠিক আছে, থাকব। তাহলে আপনার সাথে আর দেখা হচ্ছে না?’ বলল ডেবরা।
‘যদি এয়ারপোর্টে যাও, দেখা হবে।’
‘সেটা ‘যদি’-এর প্রশ্ন।’ বলল ডেবরা।
‘একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাজ ছাড়া দুনিয়ার সব কাজ, সব সাফল্য-ব্যর্থতাই তো এই ‘যদি’-এর মুখাপেক্ষী।’
‘ঠিক আছে। ‘যদি’সহই আমার প্রশ্নের জবাব হতে পারে।’ বলল ডেবরা।
‘যদি লাগিয়েও অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় না। তবুও বলছি, যখন আল্লাহ ফ্রান্সে নিয়ে আসবেন এবং যদি আল্লাহ্‌ সুযোগ দেন, তাহলে দেখা হবে।’ বলে হাসল আহমদ মুসা।
কিন্তু ডেবরার মুখ গম্ভীর। সে বলল, ‘গত দু’দিনের সম্পর্ক স্মৃতির সামান্য খেলাঘর হলেও একে ভেঙে যেতে আপনার কষ্ট লাগছে না?’
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। তারপর সেই গাম্ভীর্যের উপর সজল বেদনার একটা আস্তরণ নেমে এল। তার উদাস দৃষ্টি জানালা দিয়ে দূর আকাশে নিবদ্ধ হলো। মুখ দিয়ে তার খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল, ‘ডেবরা, বোন, জীবন একটা বড় গ্রন্থের নাম। এর পেছনের সব পাতা কখনোই উল্টানো হয় না। কিন্তু আনন্দ অথবা বেদনার অশরীরী আঙুল কতকগুলো পাতাকে বার বার উল্টিয়ে দেয়। কুমেট আমার জীবনের এমনই একটা পাতা। ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার গৌরবময় ত্যাগের অমূল্য লাল রক্ত এ পাতাকে চিরকালের জন্যে চিহ্নিত করেছে। এদিকে তাকিয়ে মানুষকে আমি আরও ভালবাসতে শিখব, দায়িত্ব পালনে আরও উদ্বুদ্ধ হবো আমি।’
থামল আহমদ মুসা। শেষের কথাগুলো তার ভারি হয়ে ভেংগে পড়ার মত হলো। তার দুই চোখের কোণাও সিক্ত মনে হলো।
ডেবরা, সুমাইয়া, রালফ-এর মুখেও বেদনার ছায়া নেমে এসেছে।
‘আমি বুঝতে পারিনি। যাবার সময় আপনাকে এভাবে আঘাত করা আমার ঠিক হয়নি। আমাকে মাফ করুন।’ মুখ নিচু করে ভারি কণ্ঠে বলল ডেবরা।
ডেবরার কথাগুলো মনে হয় আহমদ মুসার কানে পৌঁছতে পারেনি। সে নির্বিকারভাবে তার চোখ দু’টি সরিয়ে নিল জানালা থেকে। তাকাল ডেবরা ও সুমাইয়াদের দিকে। পকেট থেকে এনভেলাপ বের করে সুমাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এ চিঠিটা ডোনাকে দিও। আর তোমরা তাকে বলো, সে যেন আমার পক্ষ থেকে ক্লাউডিয়া এবং জিয়ানার আব্বার সাথে কথা বলে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা রালফকে বলল, ‘চল, দেরি হয়ে যাবে।’
বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল।
তার সাথে রালফও।
ডেবরা এবং সুমাইয়াও তাদের সাথে নিচে গাড়ি বারান্দায় নেমে এল আহমদ মুসাদের বিদায় জানাবার জন্যে।

লা স্যামসন রোড ধরে আহমদ মুসার নতুন নাম্বার প্লেটওয়ালা গাড়িটা যখন একাত্তর নাম্বার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছল, তখন রাত ঠিক বারটা।

এই গাড়িতে করেই পিয়েরে পল ও ফ্রান্সিস বাইকের লোকরা থমাস নিকানোর বাড়িতে আহমদ মুসাকে ধরতে গিয়েছিল। একটা গ্যারেজে পড়ে থাকা পুরানো জীপের নাম্বার প্লেট খুলে এনে আহমদ মুসা এ জীপে লাগিয়েছে।

একাত্তর নাম্বার বাড়িটার বিপরীত দিকে অন্ধকারে রাস্তার একটা গাছের আড়ালে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আহমদ মুসা নামল গাড়ি থেকে।

‘লা স্যামসন’ পূর্ব দুয়ালার বিখ্যাত আবাসিক এলাকার একটি রাস্তা। ফরাসি দখলদারিত্বের সময় আবাসিক এলাকার পত্তন হয়। রাস্তার নামটা একজন ফরাসি জেনারেলের নাম অনুসারে।

গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা একাত্তর নাম্বার বাড়িটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।

বাড়িটার ঠিকানা পেয়েছে ব্লু বুকের সাথে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের এক কেবিনে।

আহমদ মুসা থমাসের বাড়ি থেকে গাড়িটা নিয়ে পাঁচ মিনিট ড্রাইভ করে আসার পর একটা বিল্ডিং-এর পাশে অন্ধকার মত জায়গা দেখে গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিল। তারপর তন্ন তন্ন করে সার্চ করেছিল গাড়িটা। কিন্তু সাহায্যে আসার মত তেমন কিছুই পায়নি। শুধু পেয়েছিল একটা ব্লু বুক, একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং সাথে একটা এনভেলাপ।

এনভেলাপে যে ঠিকানা সে পেয়েছিল, সেই একই ঠিকানা ছিল ব্লু বুক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সে, শুধু ব্যক্তির নাম ছিল ভিন্ন।

আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছিল, নিশ্চয় এ বাড়িটা ব্ল্যাক ক্রস অথবা ‘ওকুয়া’র একটা ঘাঁটি বা ঠিকানা হবে। তবে ঠিকানা বা ঘাঁটিটা ওকুয়ার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, যে লোকগুলো তাকে ধরতে গিয়েছিল মিঃ থমাসের বাড়িতে, তারা ব্ল্যাক ক্রস-এর লোক নয়।

বাড়িটা তিনতলা। প্রাচীর ঘেরা বাড়ি। প্রথমেই একটা গেট। গেট পেরুলে প্রাচীরের ভেতরে ঢোকা যাবে।

দূর থেকে গেটটিকে লোহার বলেই মনে হচ্ছে।

আহমদ মুসা রাস্তা পার হয়ে গেটটার সামনে ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়াল।

গেটের সাথে একটা গার্ড রুম আছে। একটা কলিং বেল দেখল আহমদ মুসা গেটের নেমপ্লেটের ঠিক উপরে। গার্ড রুমের বাইরের দেয়ালের মাথা বরাবর উঁচুতে একটা লুকিং হোল রয়েছে। আহমদ মুসা বুঝল, কলিং বেলের শব্দ শুনে লুকিং হোল দিয়ে আগন্তুককে দেখে পরে দরজা খুলে দেয়। গেট নিয়ন্ত্রণের এই সাবেকি কায়দা দেখে আহমদ মুসা বুঝল, ‘ওকুয়া’ বা ‘ব্ল্যাক ক্রস’- এর কোন ঘাঁটি এটা হলে বুঝতে হবে, পশ্চিমের মত আধুনিক ব্যবস্থাপনার কোন ছোঁয়াই এখানে লাগেনি।

আহমদ মুসা একবার মনে করল, কলিং বেল টিপে গার্ডের কাছে এনভেলাপে দেখা নামটির খোঁজ করে ভেতরে ঢোকার একটা পথ সে করতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, আগে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে লাভ নেই। গোপনে ঢুকে ওমর বায়াদের অবস্থান খুঁজে বের করাই হবে সবচেয়ে জরুরি।

গাছপালার ছায়ার ঘন অন্ধকারের আড়াল নিয়ে আহমদ মুসা বাড়িটার পেছনের অংশে প্রাচীরের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

প্রাচীর ছয় ফিটের মত উঁচু।

প্রাচীর টপকে ভেতরের ঘাসওয়ালা চত্বরে লাফিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। ভেতরের চত্বরটা অনেকটা বাগানের মত। ছোট-বড় মিলে অনেক গাছ রয়েছে।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগোতেই ভয়ানক শব্দ করতে করতে ছুটে এল একটা কুকুর। বিশাল তার সাইজ।

আহমদ মুসা সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার হাতে তুলে নিয়েছে।

কুকুরটি একেবারে সামনে এসে মুহূর্তের জন্যে তার শিকারের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করল। তারপরই শিকার লক্ষ্যে লাফ দেবার জন্যে তার দেহকে একটা ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু আহমদ মুসার রিভলভার থেকে ছুটে যাওয়া বুলেট তার দেহের সেই ঝাঁকুনিকে আরও প্রবল করে তুলল। মাটি থেকে আর উঠল না কুকুরটি।

আহমদ মুসা কুকুরকে পাশ কাটিয়ে পনের-বিশ হাত এগিয়েছে, এমন সময়ে সামনে সে পায়ের শব্দ পেল। দেখল, অন্ধকার ঠেলে দুই অন্ধকার মূর্তি ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছে।

আহমদ মুসা চট করে পাশের এক গাছের আড়ালে আশ্রয় নিল। ওরা নাক বরাবর এ পথেই ছুটে আসছে।

গাছের পাশ দিয়েই ওরা ছুটে যাচ্ছিল। ঠিক গাছ বরাবর আসতেই আহমদ মুসা বাম পা বাড়িয়ে দিল।

সংগে সংগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সামনের লোকটা। পেছনের লোকটা পড়ে গেল তার উপর।

ওরা উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘উঠতে চেষ্টা করলে ঐ কুকুরের মতই গুলি খেয়ে মরবে। তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’

ওরা হুকুম তামিল করল।

আহমদ মুসা ওদের কাছে এগিয়ে ওদের গায়ের গেঞ্জি ছিঁড়ে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।

তারপর একজনের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলল, ‘আমি যা জিজ্ঞেস করব সংগে সংগে জবাব দেবে। এক মুহূর্ত দেরি হলে মাথায় বুলেট ঢুকে যাবে।’

অন্ধকারেও আহমদ মুসা বুঝল, দু’জনেই কৃষ্ণাংগ।

‘বল, এ বাড়িতে কারা থাকে?’

কোন উত্তর এল না।

আহমদ মুসার তর্জনী ট্রিগারে চাপ দিল। লোকটির দেহ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল।

আহমদ মুসা এবার তার রিভলভারের নল দ্বিতীয় লোকটির মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘দেখলে তো, আমি এক কথা দু’বার বলি না। এখন বল, এই বাড়িতে কারা থাকে?’

‘এটা ‘ওকুয়া’র একটা ঘাঁটি।’

‘এখন এখানে কয়জন লোক আছে?’

‘আমরা দু’জন ছিলাম, আর গেটে একজন আছে।’

‘কুমেট থেকে পিয়েরে পল এসেছে, সে কোথায়?’

‘এখানেই ছিল। চলে গেছে।’

‘কোথায় গেছে, কখন গেছে?’

‘এইতো কিছুক্ষণ আগে চলে গেল।’

‘কোথায় গেল?’

‘ইয়াউন্ডিতে।’

‘কুমেট থেকে দু’জন লোক ধরে এনেছে, তারা কোথায়?’

‘তাদেরও নিয়ে গেছে।’

‘ঠিক বলছ, তাদের নাম জান?’

‘জানব না কেন, একজন তো পরিচিত। ওমর বায়া। অন্যজন ডিফরজিস।’

‘ওরা কিসে গেছে?’

‘সবাই মিলে দু’টি গাড়ি নিয়ে গেছে।’

‘ইয়াউন্ডির কোথায় ওদের ঠিকানা?’

‘মঁশিয়ে, আমি তা জানি না। এক ঘাঁটির লোককে অন্য ঘাঁটির ঠিকানা বলা হয় না।’

‘তুমি যদি কোথাও গিয়ে ‘ওকুয়া’র অফিস খুঁজে পেতে চাও, তাহলে কি করবে?’

লোকটি কথা বলল না।

আহমদ মুসা তার রিভলভারের নল দিয়ে তার মাথায় চাপ দিয়ে বলল, ‘বলেছি, দ্বিতীয়বার আদেশ আমি করি না।’

‘‘ওকুয়া’র অফিস বা ঘাঁটির কোন একটি দর্শনীয় জায়গায় কালো ক্রস হাতে ‘ব্ল্যাক আর্মি’-এর একটা মূর্তি অংকিত থাকবে।’

‘সে দর্শনীয় জায়গা কোনটা?’

‘আমি জানি না, তবে আমাদের এখানে বাড়ির নামফলকের ঠিক উপরে।’

আহমদ মুসা তার পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, ‘চল, তোমাদের এ বাড়িতে কেউ আছে কি না, তুমি ঠিক বলেছ কি না দেখব।’

লোকটি আগে আগে চলল।

আহমদ মুসা তার মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে পেছনে পেছনে চলল।

প্রথমে একতলা, তারপর দোতলা এবং সব শেষে তিনতলার সবগুলো ঘর তন্ন তন্ন করে দেখল আহমদ মুসা। কিন্তু কোথাও এমন কোন কাগজপত্র পেল না যা দিয়ে ওকুয়া’র পরবর্তী ঘাঁটির সন্ধান করা যায়।

‘কোন টেলিফোন গাইড নেই তোমাদের?’

‘আমাদের টেলিফোন করা এবং ধরা, দুই-ই নিষিদ্ধ। ঘাঁটির কর্তাই টেলিফোন ব্যবহার করতে পারেন। তাদের গাইডের প্রয়োজন হয় না। ওদের পকেট কম্পিউটারে সবকিছু নোট করা থাকে।’

‘এখান থেকে টেলিফোন করা যাবে না?’

‘যাবে না। কোড-লক দিয়ে বন্ধ করা আছে।’

‘ওমর বায়াদের নিয়ে ওরা ইয়াউন্ডি গেছে কেন?’

‘আমি জানি না মঁশিয়ে।’

‘যে দু’টি গাড়ি ওরা নিয়ে গেছে তার নাম্বার?’

‘বিশ্বাস করুন, নাম্বার জানি না। গাড়ি দু’টি আজ কোত্থেকে যোগাড় করেছে।’

‘সহযোগিতার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ বলে তাকে দু’খণ্ড রশি দিতে বলল।

রশি পেলে আহমদ মুসা তাকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে বলল, ‘তোমার হাত-পা বাঁধা না থাকলে তুমি সন্দেহের শিকার হবে।’

বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। এল গেটে। দেখল, গেটম্যান ঘুমুচ্ছে চেয়ারে বসে।

আহমদ মুসা রিভলভার দিয়ে গুঁতো মারল। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। একবার আহমদ মুসার রিভলভারের নল আর একবার আহমদ মুসার মুখের দিকে চেয়ে দু’হাত উপরে তুলল।

‘হাত উপরে তোলো না। গেট খোল।’ বলল আহমদ মুসা।

লোকটা কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে গেট খুলে দিল।

আহমদ মুসা রাস্তা পার হয়ে গাড়ির কাছে চলে আসার আগে গেটের নামফলকের উপরে কালো ক্রস হাতে কালো সৈনিকের ছবি দেখে নিল।

আহমদ মুসা এসে গাড়িতে উঠতে উঠতে ভাবল, ওকুয়া’র লোকদের সাথে দু’বার দেখা হওয়া থেকে বোঝা গেল, ওরা মারতেই অভ্যস্ত। লড়াই-এর অভ্যেস এদের খুব কম। এর অর্থ, এদের মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখানে এতই দুর্বল যে, লড়াইয়ের প্রয়োজন তাদের কোন সময়ই হয়নি। এই উপলব্ধি আহমদ মুসাকে একদিকে খুব আহত করল, অন্যদিকে আনন্দিত করল যে, তাদের এই দুর্বলতা আমাদের মিশনকে সহজ করতে পারে।

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সময় রাত একটা। সমগ্র দুয়ালাতে এই মুহূর্তে তার যাবার কোন জায়গা নেই, সুতরাং ইয়াউন্ডি যাত্রা করাই ভাল, ভাবল আহমদ মুসা। মনে হলো একবার মেরীদের বাড়ির কথা। কিন্তু ওখান থেকে সে বিদায় নিয়ে এসেছে। যদিও আসার সময় ওরা বলেছে, তাদের বাড়ির দুয়ার সব সময় আহমদ মুসার জন্যে খোলা। বিপদের কথা জানার পরেও তার প্রতি ওদের এই আন্তরিকতা আহমদ মুসার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আহমদ মুসা ওদের জিজ্ঞেস করেছিল, তারা তো তাদের জাতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। মেরীর মুখে ফুটে উঠেছিল রহস্যময় হাসি। তার আব্বার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে সে বলেছিল, ‘রক্তের একটা টান আছে। আব্বা ফ্রান্সে পড়ার সময় খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু আমাদের পরিবারের অবশিষ্ট সকলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তারা বাস করছেন নাইজেরিয়ার লাগোসে। আব্বা ওখান থেকেই আজ আসলেন।’

দূরে কোথাও পুলিশের বাঁশি আহমদ মুসার সম্বিত ফিরিয়ে আনল।

গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। তার কল্পনার চোখে ইয়াউন্ডিগামী সড়কটার একটা চিত্র ফুটে উঠল। দুয়ালা থেকে পুবের হাইওয়ে ধরে বেরিয়ে যেতে হবে, তারপর পূর্ব-দক্ষিণে একটু বেঁকে ইদিয়া পর্যন্ত। সেখান থেকে সোজা পুবদিকে ইয়াউন্ডি মালভূমির চিরহরিৎ বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ইয়াউন্ডি।

আহমদ মুসার গাড়ি তখন ইদিয়া পার হয়ে প্রবেশ করেছে ইয়াউন্ডি মালভূমির চিরহরিৎ বনাঞ্চলে। বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে মাঝে মাঝেই উন্মুক্ত মাঠ, আবার দিগন্ত প্রসারিত চিরহরিৎ বৃক্ষরাজির সারি। গাড়ি তখন প্রবেশ করেছে একটা উন্মুক্ত এলাকা পেরিয়ে বনের ভেতর।

এই সময় আযানের একটা দরাজ কণ্ঠ এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসার কানে।

আহমদ মুসা হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। ভোর সাড়ে চারটা।

গাড়ির ব্রেক কষল আহমদ মুসা। থেমে গেল গাড়ি।

রাস্তার বাম দিক অর্থাৎ উত্তর দিক থেকে আসছে আযানের আওয়াজ।

আহমদ মুসা খুব খুশি হলো। সিদ্ধান্ত নিল, সে ঐ মসজিদে গিয়ে নামায পড়বে। ক্যামেরুনে প্রথমবারের মত মুসলমানদের সাথে দেখা হবে তার।

খুঁজে রাস্তা বের করল আহমদ মুসা উত্তর দিকে যাবার। তারপর হাইওয়ে থেকে নেমে আযানের শব্দ লক্ষ্যে চলল উত্তরের রাস্তা ধরে।

রাস্তা থেকে অল্প অগ্রসর হবার পরেই রাস্তার দু’ধারে কোথাও দেখল পাম গাছের সারি, কোথাও কফি গাছের সারি, আবার কোথাও কোকো গাছের ক্ষেত। মনে পড়ল আহমদ মুসার, এ অঞ্চলে এগুলোই প্রধান ফসল। আগে এখানকার যাযাবর কালো মানুষরা বন কেটে গম-যবের মত দানাদার ফসল ফলাতো। কিন্তু যুগ-যুগের এই অভ্যাসের ফলে মাটির উর্বরতা শেষ হয়ে যায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি এবং ভূমি পরিচর্যার অভাবে। এ কারণে রাষ্ট্রের আইন এবং অবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে এ অঞ্চলের মানুষ পাম তেল, কফি এবং কোকোর মত গাছজাত ফসলের চাষে ফিরে এসেছে মাটির সেই উর্বরতা আবার ফিরিয়ে আনার জন্যে। অর্থকরী এ ফসল উৎপাদনে এ অঞ্চলের মানুষ আগের চেয়ে লাভবানই হয়েছে।

আহমদ মুসা রাস্তার দু’ধারে দিগন্তপ্রসারী এই গাছজাত ফসলের ক্ষেত দেখে ভাবল, ইয়াউন্ডি মালভূমির নিশ্চয় খুব উর্বর এলাকা এটা।

মাইলখানেক চলার পর পাম গাছের ফাঁকে ফাঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ি তার নজরে এল। বাড়িগুলো কাঠের বেড়া দিয়ে তৈরি। তার উপর টিনের চালা। দু’একটা বাড়িতে পাতার চাল দেখতে পেল। কোন কোন বাড়ি আবার টিনের বেড়া এবং টিনের চালা বিশিষ্ট। বাড়ি-ঘরের চেহারা দেখে আহমদ মুসার মনে হলো, এ এলাকার মানুষ তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছল এবং ক্যামেরুনের এক সমৃদ্ধ এলাকা এটা।

আহমদ মুসা তখন চলছে পুবপাশের পাম গাছ আচ্ছাদিত গ্রাম এবং রাস্তার পশ্চিম পাশের দিগন্ত বিস্তৃত কফি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে। তার গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ এবং মাঝে মাঝে হর্নের আওয়াজ শান্ত ভোরের অখণ্ড নিস্তব্ধতাকে নিষ্ঠুরভাবে যেন ভেঙে দিচ্ছে। চারদিকের ঘুমন্ত নীরব পরিবেশের মাঝে একে খুব বেসুরো মনে হচ্ছে।

আহমদ মুসা হঠাৎ তার সামনের পথ রুদ্ধ দেখতে পেল। একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে তার পথ রোধ করে। সুবহে সাদেকের স্বচ্ছতায় তাদের হাতের বর্শা, তীর-ধনুক এবং কয়েকটি বন্দুক বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার বরাবর রাস্তার পুবপাশে একটা চত্বর এবং তারপরেই একটা বড় ঘর। ঘরটি পূর্ব-দক্ষিণে কোণাকুণি করে তৈরি। চত্বরের গেটে কাঠের তৈরি মিনারের মত একটা স্থাপনা। তার মাথায় চারদিকে চারটা মাইক্রোফোনের হর্ন।

আহমদ মুসা দেখেই বুঝল, এটা মসজিদ। এই মসজিদের এই মিনারের হর্নগুলো থেকেই নিশ্চয় দরাজ কণ্ঠের আযান ধ্বনিত হচ্ছিল।

আহমদ মুসা নিশ্চিতই বুঝতে পারল, মসজিদের এত কাছে নিশ্চয়ই ওরা মুসলিম। ওরা তাকে শত্রু ভেবেছে এবং মোকাবিলার জন্যে অস্ত্রসজ্জিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা দেখল, পুরুষদের একটু পেছনে মাথা ও গায়ে কাপড় জড়িয়ে তীর-ধনুক হাতে মেয়েরাও দাঁড়িয়ে আছে।

বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, একটা গাড়ির শব্দ শুনে বা একটা গাড়িকে আসতে দেখে এত বড় প্রতিক্রিয়া ওদের মধ্যে হলো কেন!

আহমদ মুসা ওদের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।

তারপর সে গাড়ি থেকে নামল। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল গাড়ির সামনে। প্রথমে সবাইকে সালাম দিল। তারপর বলল, ‘আমি একজন বিদেশী। যাচ্ছিলাম ইয়াউন্ডি। আযান শুনে এলাম ফজরের নামায পড়তে।’

সামনে দাঁড়ানো লোকদের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল একজন যুবক। বিশ-বাইশ বছরের হবে। পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট। মাথায় টুপি। শুধু সে নয়, পুরুষ সকলের মাথায় টুপি ছিল।

যুবকটি সালাম গ্রহণ করে বলল, ‘আপনার নাম কি? কোন দেশে বাড়ি?’

‘নাম আহমদ মুসা। বাড়ি মধ্য এশিয়ায়।’

‘সূরা বাকারার কয়েকটা আয়াত পড়ুন।’

আহমদ মুসা একটু হাসল। তারপর সূরা বাকারার প্রথম একটা রূকুই মুখস্ত পড়ল।

কোরআন পাঠ শুনে যুবকসহ সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাদের সকলের উদ্যত অস্ত্রগুলো নেমে গেছে।

সামনের যুবকটি এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাদের মাফ করুন ভাই। আমরা বড় বিপদে, তাই পরিচিত নয় এমন সবাইকে আমরা সন্দেহ করি, শত্রু ভাবি।’

বলে আহমদ মুসাকে হাত ধরে এনে লোকদের সারির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাকা চুল ও শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘ইনি আমার আব্বা আবুবকর বিগোভিট। কুন্তা কুম্বে এলাকার ইনি সরদার।’

বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করল এবং ফরাসি ভাষায় স্বাগত জানাল। বৃদ্ধ তারপর যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নামাযের দেরি হয়ে গেছে।’

বলে বৃদ্ধ মসজিদের দিকে পা বাড়াল। তার সাথে সবাই চলল মসজিদের দিকে। যুবকটি আহমদ মুসার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল।

সুন্নাত নামায পড়া হয়ে গেছে সবার। বসে আছে সবাই। সামনে পুরুষরা। মেয়েরা বসেছে পেছনে।

বুদ্ধ আবুবকর বিগোভিট উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাদের ইমামকে আমাদের শত্রুরা পণবন্দী করে রেখেছে। আমি সম্মানিত অতিথিকে নামায পড়াবার জন্যে সবার তরফ থেকে অনুরোধ করছি। তার মত কোরআন পাঠ আমরা কেউ জানি না।’

আহমদ মুসার মনে পড়ল যুবকের উক্তি, ‘আমরা বড় বিপদে, তাই অপরিচিত সবাইকে শত্রু ভাবি।’ এই সাথে ‘শত্রুরা ইমামকে পণবন্দী করে রেখেছে’ শীর্ষক সরদারের কথার মধ্য দিয়ে বড় একটি দুর্ঘটনার আঁচ পেল সে।

কোন কথা না বলে আহমদ মুসা ইমামের আসনে গিয়ে দাঁড়াল।

ইমামের আসনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার মন আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। আফ্রিকার হৃদয়ের গভীরে ইয়াউন্ডি মালভূমির চিরহরিৎ বনের মধ্যে জ্বলে আছে ইসলামের আলো। কারা কত কষ্ট করে এখানে ইসলামের আলো পৌঁছিয়েছিল কে জানে! আফ্রিকার অজ্ঞাত-অপরিচিত এ কালো মানিক ভাই-বোনদের সাথে নামাযে দাঁড়াতে গিয়ে চোখ দু’টি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার।

নামাযে কোরআন পাঠের সময় আবেগ আরও উথলে উঠল তার। সূরা আর-রাহমান ও সূরা মুজাম্মিল- এই দুই সূরা দিয়ে দুই রাকাত নামায পড়ল আহমদ মুসা। তার হৃদয় নিংড়ানো ক্বেরাতের মর্মস্পর্শী সুরে প্রত্যেক নামাযীর চোখই অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।

নামাযের পর অবতারণা হলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের। প্রথমে বৃদ্ধ আবুবকর এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘কোরআন শরীফকে আজ নতুন করে চিনলাম, উপলব্ধি করলাম।’

একে একে সবাই এসে আহমদ মুসার হাতে চুমু খেল।

মেয়েরা পেছনে স্থির বসেছিল। তাদেরও চোখ ভেজা। কোরআনের তেলাওয়াত মানুষের মনকে আল্লাহর প্রতি ভয়, ভক্তি, ভালোবাসায় কতখানি উদ্বেলিত করতে পারে, এই অভিজ্ঞতা তাদের এই প্রথম হলো।

আহমদ মুসার একপাশে বসেছিল যুবকটি।

‘তোমার নাম কি?’ আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করল।

‘মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।’

‘তুমি যে বিপদের কথা বললে এবং তোমার আব্বা যে তোমাদের ইমাম পণবন্দী থাকার কথা বললেন, এ বিষয়টা আমি জানতে চাই।’

মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর চোখ তখনও পানিতে ভরা। সে চোখ দুটো মুছে বলল, ‘ঠিক আছে, আব্বাকে বলছি।’

বলে সে তার আব্বার কাছাকাছি হলো এবং কথা বলল।

বৃদ্ধ আহমদ মুসার কাছে এগিয়ে এল। বলল, ‘সে অনেক কথা। শুনবে আমাদের দুঃখের কাহিনী? শুনতে পার। আবার অপেক্ষা করলে আমাদের সংকটটা দেখতেও পাবে।’

‘কেমন?’

‘শত্রুরা আজ সকাল পর্যন্ত শেষ সময় দিয়েছে। ওরা সকালেই আসবে।’

‘শত্রু আপনাদের কে?’

‘কিংডম অব ক্রাইস্ট (KOC)।’

‘কিংডম অব ক্রাইস্ট?’ কপাল কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।

‘হ্যাঁ।’

‘তারা কি করেছে, তাদের সাথে কি হয়েছে?’

‘সে অনেক কথা।’ বলে বৃদ্ধ আবুবকর বিগোভিট একটু দম নিল।

তারপর শুরু করলঃ ‘ইদিয়া থেকে ইয়াউন্ডিগামী যে সড়ক দিয়ে তুমি এলে, সে সড়কের দক্ষিণ দিকের গোটা ক্যামেরুন বলা যায় ওরা দখল করে নিয়েছে। কিছু কিছু জমি ও এলাকা মুসলমানদের ও গোত্র ধর্মানুসারীদের এখন রাস্তার আশে-পাশের অঞ্চলে আছে। কিন্তু সেগুলো না থাকার শামিল। তাদের সাধ্য নেই ঐ জমিগুলোর দখল তারা নেয়। দক্ষিণ এলাকার অনেক মুসলমান আমাদের কুন্তা কুম্বে এলাকাতেও এসে আশ্রয় নিয়েছে।

ওদের সাথে আমাদের প্রথম বিরোধ ওদের এক প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। ওরা আমাদের কুন্তা কুম্বে এলাকায় তাদের স্বনির্ভর কর্মসূচি প্রকল্পের জন্যে বিশ একর জমি কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে আমরা রাজি হই না। কারণ, ওদের ভূমিদখল কৌশলের এটা প্রথম পদক্ষেপ। তাদের এ ধরনের ফাঁদে পা দিয়ে দক্ষিণ ক্যামেরুনের মুসলমানরা যে ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি আমরা করতে চাই না।

ওদের প্রস্তাব গ্রহণ না করায় ওরা ক্ষেপে যায়। এরপর ওরা গোপনে একটা গোত্র-ধর্মানুসারী পরিবারের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে চার একর জমি কিনে নিয়ে একটা গীর্জা তৈরির উদ্যোগ নেয়। জমিটা আমাদের এলাকার মাঝ বরাবর। আমরা তাদেরকে জমি দখল নিতে বাঁধা দেই এবং জমিটা আমাদের একটা মাদ্রাসা-সংলগ্ন বিষয়। জমিটা আমরা কেনার জন্যে দেশের আইন অনুসারে কোর্টে টাকা জমা দেই।

ভীষণ ক্ষেপে যায় ওরা। এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটে। ওদের এলাকার দু’টি গোত্র-ধর্মানুসারী পরিবার স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং আমাদের এলাকায় এসে আশ্রয় নেয় সপ্তাহখানেক আগে। কোক(KOC)-এর লোকরা দলবল নিয়ে এখানে আসে এবং ঐ দু’টি পরিবারকে তাদের হাতে তুলে দেবার দাবি জানায়। আমরা তাদেরকে বুঝিয়ে বলি যে, তারা ইসলাম গ্রহণের পর আর তাদের হাতে তুলে দেয়া যায় না। কিন্তু তারা কিছুই শোনে না। তারা তিনদিনের মধ্যে পরিবার দুটোকে তাদের হাতে তুলে দেবার দাবি জানিয়ে চলে যায়।

তাদের দাবি দেশের আইনে বেআইনী বিধায় তিনদিনের মধ্যেই আমরা থানায় মামলা দায়ের করি এবং ঠিক তিনদিনের মাথায় আমাদের ইমামের নেতৃত্বে পাঁচজনকে আমরা কোক(KOC)-এর এলাকায় পাঠাই তাদেরকে একথা বলে আসার জন্যে যে, তারা যেন না আসে।

ইমাম সাহেবরা ওখানে গেলে সব শোনার পর ইমাম সাহেবকে তারা আটক করে। তার সাথী পাঁচজন এতে বাঁধা দিতে গেলে তিনজনকে তারা গুলি করে হত্যা করে। অবশিষ্ট দু’জন কোনমতে পালিয়ে আসে।

পাঁচদিন আগে তারা খবর পাঠিয়েছে, এবার যদি ইসলাম গ্রহণকারী ঐ দু’টি পরিবারকে আমরা ফেরত দেই এবং সেই চার একর জমিসহ তাদের দাবিকৃত বিশ একর জমি ছেড়ে দিতে রাজি হই, তাহলে তারা ইমাম সাহেবকে ছেড়ে দেবে। তাদের এ প্রস্তাবের চূড়ান্ত জবাব জানার জন্যে তারা আজ সকালে আসবে।’

থামল বৃদ্ধ।

‘চার একর জমির ব্যাপারে আপনারা যে টাকা জমা দিয়েছিলেন তার কি হয়েছে?’ বলল আহমদ মুসা।

‘কিছুই হয়নি। ‘কোক’-এর মত খৃস্টান সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা করে কোনই ফল পাওয়া যায় না কোন সময়ই। আইনজীবী, বিচারক কেউই ওদের বিরাগভাজন হতে চায় না।’ বলল বৃদ্ধ।

‘ইমামকে আটক এবং তিনজনকে হত্যা করার পর কোন মামলা দায়ের করা হয়নি?’

‘হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থল একবার দেখতেও যায়নি।’

‘না যাক, কেস দু’টি করে অত্যন্ত ভাল কাজ করেছেন। ওরা সেদিন এখানে কি নিয়ে এসেছিল? কতজন লোক ছিল সাথে?’

‘দু’টি গাড়িতে করে ওরা সেদিন দশজন এসেছিল।’ বলল বৃদ্ধ সরদার।

‘ওদের সাথে কি অস্ত্র ছিল?’

‘রাইফেল, স্টেনগান।’

‘আপনারা তো অবশ্যই পরিবার দু’টিকে দেবেন না। ওরা সেক্ষেত্রে কি করতে পারে?’

‘ওরা আমাদের ইমাম সাহেবকে ফেরত দেবে না। আবার দু’টি পরিবারকে জোর করে কেড়ে নিয়ে যেতেও চেষ্টা করতে পারে। ওদের অসাধ্য কিছু নেই। থানা-পুলিশ ওদেরই হাতে। কোর্টেও ওদের বিরুদ্ধে কথা বলতে কেউ সাহস করে না।’

‘আপনারা ওদের মোকাবিলা কিভাবে করবেন ঠিক করেছেন?’

‘যে পরিণতিই হোক আমরা তাদের মোকাবিলা করব। ইমাম সাহেবকে আমরা মুক্ত করতে চাই। আবার ঐ দু’টি পরিবারকেও আমরা ফেরত দেব না।’

‘মোকাবিলা কিভাবে করবেন?’

‘ওদের কাছে আধুনিক অস্ত্র আছে। রাইফেল তো আছেই। রিভলভার ও স্টেনগানও আছে। আমরাও আধুনিক অস্ত্র যোগাড়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু সমস্যা হলো, ওরা চেষ্টা করছে কোন অস্ত্র-কালোবাজারী যেন আমাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করে। দ্বিতীয়ত, কালোবাজারে অস্ত্র কিনতে ক্যাশ ডলারের প্রয়োজন হয়। ডলারের বড় অভাব আমাদের।’

‘আত্মরক্ষার জন্যে অস্ত্র প্রয়োজন। কিন্ত নিছক অস্ত্রের উপর নির্ভর করলে ওদের সাথে পারা যাবে না।’

একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘‘কোক’-এর সাথে কোন সংঘর্ষ অতীতে মুসলমানদের হয়েছে?’

‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ তাদের সাথে সংঘাতে গেছে। ব্যাপক পর্যায়ের কোন সংঘর্ষ হয়নি। কৌশলে তারা একেকজনের সম্পত্তি একেকবার গ্রাস করেছে এবং তাদের উচ্ছেদ করেছে। ঐক্যবদ্ধ সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার কোন সুযোগই দেয়নি। কারণ, শুরুতে তারা এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে দু’চার খণ্ড জমি কিনে। তারপর বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং এই বিভেদের সুযোগ নিয়ে একজন একজন করে উচ্ছেদ করেছে। বহুদিন পর আমাদের এখানে এসে ওরা একটা সমস্যায় পড়েছে। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। তাই ভীষণ ক্ষ্যাপা তারা।’

‘আজ ওরা এলে কি করবেন আপনারা?’

‘আমরা যদি ওদের কথায় রাজি না হই, তাহলে আজ ওরা সংঘর্ষ বাঁধাতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা আত্মরক্ষা করব।’

‘পুলিশে খবর দিলে তারা কোন ভূমিকা পালন করবে না?’

‘করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের সংঘাতে তারা ভূমিকা পালন করে না। একে তারা রাজনৈতিক দাংগা বলে চালিয়ে দেয়।’

‘রাজনৈতিকভাবে এর কোন প্রতিকার করা যায় না?’

‘দেশে একদলীয় শাসন। আমাদের এলাকার এম.পি. একজন গোত্র ধর্মীয় কৃষ্ণাংগ। সে নিরপেক্ষ থাকতে চায়। খৃস্টানদের চটাতে সে ভয় করে। আবার আমাদের বিরোধী সে নয়।’

পুরুষরা সবাই তখনও মসজিদে বসেছিল। দু’একজন ছাড়া মহিলারা সবাই চলে গিয়েছিল।

কথা শেষ করে সরদার আবুবকর বিগোভিট সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা সবাই এখন যাও। মসজিদের মিনার থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিলে তোমরা এসে যাবে। ওরা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করলেই এ ধ্বনি দেয়া হবে।’

সবাই সালাম জানিয়ে চলে গেল।

‘ওরা আপনাদের এলাকায় প্রবেশ করলে জানতে পারবেন কেমন করে?’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমাদের সীমান্তে বড় গাছের মাথায় আমাদের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে। সেখান থেকে রাতের বেলা আলোকসংকেত দেয়ার ব্যবস্থা আছে এবং দিনের বেলা ধোঁয়া সৃষ্টি করা হয়। আমাদের মসজিদের মিনার থেকে এসব পর্যবেক্ষণের সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা রয়েছে।’

কথা শেষ করে বৃদ্ধ আবুবকর বিগোভিট তার ছেলে মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে চেয়ে বলল, ‘মেহমানকে তুমি বাড়িতে নিয়ে যাও। আমি আসছি।’

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী উঠল।

উঠল আহমদ মুসাও।

মুহাম্মাদ ইয়েকিনীদের বাড়ি দোতলা। টিনের বেড়া এবং টিনের চাল। নিচের তলায় বসার ঘর।

সেখানে আহমদ মুসা এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী গিয়ে প্রবেশ করল।

আহমদ মুসাকে বসিয়ে ভেতরে গেল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

অল্পক্ষণ পর ফিরে এসে বসল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী আহমদ মুসার পাশে।

প্রায় তার সাথে সাথে নাশতা নিয়ে প্রবেশ করল একজন তরুণী। বয়স বিশ-একুশ বছর হবে।

তরুণী সালাম দিল ঘরে ঢুকে।

তার পরনে ঢিলা আফ্রিকান পোশাক। মাথায় রুমাল বাঁধা। মুখ ছাড়া গোটা দেহই আবৃত।

আহমদ মুসা অবাক হলো, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং তরুণীটির চেহারায় নিগ্রো ছাপ নেই। রং কিছুটা কালো বটে, চেহারার অন্য বৈশিষ্ট্য নিগ্রোদের মত নয়।

তরুণীর দিকে ইংগিত করে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী বলল, ‘এ আমার ছোট বোন ‘ফাতেমা মুনেকা’।’

ফাতেমা মুনেকা নাশতা রেখে দাঁড়িয়েছিল।

‘বস ফাতেমা।’ বলল আহমদ মুসা।

ফাতেমা মুনেকা বসলে আহমদ মুসা মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা ক’ভাই বোন?’

‘দু’ভাইবোন আমরা। আব্বা ও আম্মা মিলে চারজন নিয়ে আমাদের সংসার।’

একটু থেমেই আবার সে বলল, ‘আমরা দু’ভাইবোন ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, আর ফাতেমা পদার্থবিজ্ঞানে।’

আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় মসজিদের মাইক থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দ ভেসে এল।

সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মাদ ইয়াকিনী এবং ফাতেমার মুখ মলিন হয়ে গেল। তারা উঠে দাঁড়াল।

‘উঠলে কেন তোমরা? শত্রু আগমনের সংকেত শুনে?’ বলল আহমদ মুসা।

‘হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। নারী-পুরুষ সবাইকে এখন যার যে অস্ত্র আছে তা নিয়ে হাজির হতে হবে মসজিদে।’ মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর কথায় উত্তেজনা এবং তার ও ফাতেমার চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘দেখ, খাবার পরিবেশিত হলে নামায পড়ারও হুকুম নেই। এর অর্থ, খাবার খেয়ে তারপর নামায পড়তে হবে। অতএব তোমরা বস। খেয়ে তারপর আমরা যাব।’

আহমদ মুসার নিশ্চিন্ত চেহারার দিকে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে তারা ধীরে ধীরে বসল।

আহমদ মুসাই ওদের হাতে খাবার তুলে দিল। তারপর নিজে খেতে শুরু করল।

‘আমাদের দেরি দেখলে আব্বা চিন্তা করবেন। আহবান শোনার পর দেরি করা এখানকার নিয়মও নয়।’ খেতে খেতে বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

‘দেরি হবে না, আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছব। এখনও ওরা দু’মাইল দূরে আছে। এ রাস্তায় ঘণ্টায় বিশ মাইলের বেশি জোরে গাড়ি আসবে না। সুতরাং, ওরা পৌঁছতে ছয় মিনিটের মত লাগবে। আর আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব।’ বলল আহমদ মুসা।

‘অঙ্কটা আপনি কিভাবে কষলেন?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল ফাতেমা।

‘তুমিও পারবে। শত্রুপক্ষকে এ রাস্তায় প্রবেশ করতে দেখেই ওরা সংকেত পাঠিয়েছে। সুতরাং যখন সংকেত এসেছে, ওরা তখন দু’মাইল দূরে ছিল। কাঁচা রাস্তায় ওদের গাড়ির স্পীড বিশ মাইলের বেশি হবে না। অতএব বিষয়টা পরিষ্কার।’

‘কোন বিষয়কে আপনি এত নিখুঁতভাবে দেখেন!’ বলল ফাতেমা।

আহমদ মুসা এ কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘চল একটু তাড়াতাড়ি যাই। রাস্তার উপর আমার গাড়িটা সরিয়ে রাখতে হবে। ওরা গাড়ি না দেখাই ভাল।’

ওরা তিনজন চলে এল। আহমদ মুসা তার গাড়িটা রাস্তা থেকে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে চলে এল মসজিদে।

মসজিদ এবং মসজিদের চত্বর তখন ভরে গেছে।

আহমদ মুসারা মসজিদে ঢুকতেই তাকে সবাই সরদারের কাছে যাওয়ার জন্যে জায়গা ছেড়ে দিল।

এলাকার প্রধানদের নিয়ে সরদার আবুবকর তখন করণীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করছিল।

আহমদ মুসা বসলে সরদার সবার দিকে একবার চেয়ে বলল, ‘আমরা করণীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। সময় বেশি নেই। তুমি সম্মানিত মেহমান। তোমার মূল্যবান পরামর্শ আমরা চাই।’

আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সম্মানিত ভাই ও বোনেরা। মুহতারাম সরদারের কাছে আমি সব কথা শুনেছি। ‘কোক’ এবং ‘ওকুয়া’দের সম্বন্ধে আমি আগে থেকেই জানি। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি আপনাদের পক্ষ থেকে ওদের সাথে কথা বলতে চাই।’

বলে আহমদ মুসা থামল এবং সরদারের দিকে চাইল। সরদার সবার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনাদের মত আছে?’ সবাই একবাক্যে সম্মতি দিল। তবে সেই সাথে অনেকে বলল, সরদার পাশে থাকবেন এবং ভুল হলে তিনি শুধরে দেবেন।

আহমদ মুসা বলল, ‘ঠিক আছে। তাই হবে। এরপর, আপনাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ, তারা আপনাদের এলাকায় আসছে। সুতরাং তারা মেহমান। কথাবার্তায় যাই হোক, তারা আঘাত করতে না এলে আপনারা আঘাত করবেন না।’

আহমদ মুসা থামল। এবং আবার তাকালো সরদারের দিকে। সরদার আবার আগের মত করেই সবার মত চাইলেন। সবাই একবাক্যে সম্মতি দিল।

আহমদ মুসা খুব খুশি হলো এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি দেখে। আফ্রিকার গভীর জংগলে যে গণতন্ত্র সে দেখছে, সভ্য সমাজের শহুরে রাজনীতিকদের মধ্যে এর চিহ্নও দেখা যায় না।

মসজিদ চত্বরের উত্তর পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় দু’পক্ষের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আহমদ মুসাসহ গোত্রের প্রধানগণ সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওদের গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। সরদার এবং অন্যান্য সকলের মুখে উদ্বেগ এসে নতুন করে ছায়া ফেলল। উত্তেজনায় চোখ তাদের চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

আহমদ মুসা পেছন ফিরে সকলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ভাই-বোনেরা, আপনারা একটুও ভাববেন না। আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথে আছে।’

দুইটি ছোট মাইক্রোবাস এসে ঠিক মসজিদের সামনে দাঁড়াল।

দাঁড়ানোর সাথে সাথে গাড়ি থেকে স্রোতের মত নেমে এল প্রায় জনা বিশেক মানুষ। ওদের কারও হাতে রাইফেল, কারো হাতে স্টেনগান।

ওরা নেমে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল এবং কয়েক পা এগিয়ে এল আহমদ মুসাদের দিকে।

এদিকে আহমদ মুসা সামনের সারির মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। তার একপাশে সরদার, অন্যপাশে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী। তাদের পেছনে অন্যান্য লোকজন। মেয়েরা পাশে মসজিদের চত্বরে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে তীর-ধনুক, কিন্তু নিচু করে রাখা।

আহমদ মুসা কয়েক পা এগোলো। বলল, ‘আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা বসার জায়গা করেছি। আসুন, বসুন।’

‘আমরা বসতে আসিনি। আমরা জবাব শুনতে এসেছি।’ আহমদ মুসার স্বাগত সম্ভাষণের কোন জবাব না দিয়ে নিরেট অভদ্রের মত কথাগুলো বলল ওপক্ষের একজন। লোকটি কৃষ্ণাংগ। তবে আশে-পাশের চার-পাঁচজন সবাই শ্বেতকায়।

‘জবাব অবশ্যই আমরা দেব। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা কি শোভন হবে!’

‘আমাদের কথা বলার কিছু নেই। আমরা জবাব শোনার জন্যে এসেছি। জবাবও খুব বড় হবে না। এক বাক্যে কিংবা এক শব্দেও বলা যায়।’

আহমদ মুসারা এবং ওদের মধ্যেকার দূরত্ব চারগজের মত। ওপক্ষের যে কৃষ্ণাংগ কথা বলছে তার পাশেই দীর্ঘদেহী এক শ্বেতকায় দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসার মনে হলো, সেই হলো আসল নেতা। কৃষ্ণাংগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই শ্বেতকায়ের দু’পাশে দাঁড়িয়ে দু’জন স্টেনগানধারী।

‘এক কথায় জবাব সব কিছুর হয় না। আমাদের কিছু জানার এবং বলার আছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমরা নতুন কোন দরকষাকষি করতে আসিনি। আমাদের প্রস্তাবে রাজি থাকলে এক্ষুণি দু’টি পরিবারকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আর সে দু’টি ভূ-খণ্ডের দখল আমরা যেদিন পাব, সেদিন আপনাদের ইমামকে আমরা ছেড়ে দেব।’

‘আমাদের ইমাম বেঁচে আছেন, তার কি নিশ্চয়তা আছে এবং আপনারা যে কথা রাখবেন, তার কি গ্যারান্টি দেবেন?’

আহমদ মুসা চাচ্ছিল সময় বাড়াতে এবং কোনভাবে আজকের মত আলোচনা স্থগিত রাখতে।

আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই দীর্ঘকায় শ্বেতাঙ্গটি মুখ খুলল। বলল, ‘তোমাকে একজন চালাক এশিয়ান মনে হচ্ছে। শোন, আমরা এখানে খোশগল্প করতে আসিনি। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুণবো। এর মধ্যে যদি আমি আমার প্রস্তাবের হ্যাঁ সূচক জবাব না পাই, তাহলে পরবর্তী ঘটনার জন্যে আমরা আর দায়ী হবো না।’

তার কথা শেষ হতেই তার দু’পাশের দুই স্টেনগানধারী তাদের স্টেনগান তাক করল আহমদ মুসাদের দিকে।

সরদার আবুবকর এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী দু’জনেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার দুই রিভলভার তার দুই পকেটে। সে সরদারের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘ধৈর্য্য ধরুন।’

শ্বেতকায় সেই লোকটি ‘তিন’ পর্যন্ত গোণা শুরু করেছে।

এক….

দুই…

দুই বলার সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগানধারীদের হাত স্টেনগানের ফায়ারিং পয়েন্টে চলে গেল, লক্ষ্য করল আহমদ মুসা।

সরদার, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং পাশের সকলের ব্যাকুল চোখ আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। পেছনে সকলের মধ্যে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা।

আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি সামনে।

শ্বেতকায় লোকটি উচ্চারণ করল-

তিন…।

স্টেনগানধারী দু’জনের দেহ নড়ে উঠল একটু, এরপরই ছুটে আসার কথা গুলির দেয়াল।

কিন্তু ‘তিন’ বলার সাথে সাথেই আহমদ মুসার দুই পকেট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এল দু’টি রিভলভার। সেই সাথে দু’টি গুলি বেরিয়ে এল তার দুই রিভলভার থেকে এবং তক্ষুণিই দেখা গেল, আহমদ মুসার দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে সামনে ছিটকে পড়ল। যখন তার দেহটি উঠে দাঁড়াল, দেখা গেল, তার দুই হাতের দুই রিভলভারের নল সেই শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় লোক দু’জনের বুকে।

‘তোমরা তোমাদের সব লোককে অস্ত্র ফেলে দিতে বল, নইলে এক্ষুণি দু’জনের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবে।’ গর্জে উঠল আহমদ মুসার কণ্ঠ তাদের উদ্দেশ্যে।

সেকেন্ডের মধ্যেই এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। ভানুমতির খেলার মত। সেকেন্ডের খেলা যখন শেষ তখন সরদার আবুবকর, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং সকলে বিস্ফারিত চোখে দেখল, দুই স্টেনগানধারীর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে এবং তাদের মেহমান দাঁড়িয়ে আছে ওপক্ষের দুই সরদারের বুকে রিভলভার ধরে। এক মুহূর্তেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। কিন্তু এই অসাধ্য সাধন করল কি করে তাদের মেহমান আহমদ মুসা!

বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল সেই কৃষ্ণকায় ও শ্বেতকায় দু’জনেরও চোখ। প্রথমে তাদের কাছে স্বপ্ন মনে হয়েছে। কিন্তু সাথী দু’জনের রক্তাক্ত লাশ ও রিভলভারের নলের শক্ত স্পর্শ তাদের বলে দিল স্বপ্ন নয়, সবই বাস্তব। আহমদ মুসার চোখের দিকে একবার চেয়েই তারা বুঝেছিল, এ লোকের অসাধ্য কিছু নেই। সুতরাং, আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই শ্বেতকায় লোকটি চিৎকার করে উঠল, ‘তোমরা সবাই অস্ত্র ফেলে দাও।’ তার চিৎকার আর্ত-চিৎকারের মত শোনাল।

তার আদেশের সাথে সাথেই তার দলের সবাই অস্ত্র ফেলে দিল।

আহমদ মুসা তাদের বুকে রিভলভার ধরে রেখে উচ্চস্বরে বলল, ‘মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, তোমার লোকজন দিয়ে অস্ত্রগুলো কুড়িয়ে নাও। সকলের পকেট সার্চ করবে, রিভলভার থাকতে পারে তাদের পকেটে।’

আদেশের সাথে সাথে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী কয়েকজনকে ডাক দিয়ে নিজেই ছুটল। প্রথমে সার্চ করল সেই শ্বেতকায় ও কৃষ্ণাংগ লোক দু’জনকে। তাদের পকেটে রিভলভার পেল।

সমস্ত অস্ত্র সংগ্রহ করে মসজিদের চত্বরে স্তুপীকৃত করা হলো।

রিভলভার পকেটে রেখে আহমদ মুসা হাতে তুলে নিয়েছে স্টেনগান। ওদের দিকে স্টেনগান বাগিয়ে আহমদ মুসা নির্দেশ দিল, ‘তোমরা সবাই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।’

সঙ্গে সঙ্গে সবাই তার নির্দেশ পালন করল।

আহমদ মুসা মুহাম্মাদ ইয়েকিনীকে বলল, ‘তোমরা ওদের সবাইকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে ফেল।’

ওদের সবাইকে বেঁধে ফেলা হলো।

মুহাম্মাদ ইয়েকিনীকে আবার নির্দেশ দিল আহমদ মুসা, ‘ওদের গাড়ির সব জায়গা চেক করে এস।’

গাড়ি থেকে পাওয়া গেল আরও দু’টি স্টেনগান এবং চার বাক্স গুলি।

অস্ত্র ও গোলা-বারুদের দিকে তাকিয়ে পাশের সরদার ও অন্যান্যদের বলল, ‘ওরা ছোটখাট একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল।’

‘এতক্ষণ যা দেখলাম, যা দেখছি সব যে সত্য একথা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। অলৌকিক কোন কিছু দেখিনি কোনদিন। আজ চোখের সামনে তা দেখলাম। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব তা আমি জানি না।’ বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি নেমে এল।

বৃদ্ধের মতই সকলের অবস্থা। সকলে আহমদ মুসাকে দেখছে এমন দৃষ্টিতে যেন সে কোন অলৌকিক জীব।

আহমদ মুসা বৃদ্ধ সরদারকে বলল, ‘একখণ্ড ভাল সাদা কাগজ দরকার।’

বৃদ্ধ সরদার তাকাল ইয়েকিনীর দিকে। ইয়েকিনীর পাশেই দাঁড়িয়েছিল ফাতেমা মুনেকা। সে বলল, ‘আমি নিয়ে আসছি ভাইয়া।’ বলে ছুটল বাড়ির দিকে।

একটা প্যাড নিয়ে ফিরে এল ফাতেমা মুনেকা দ্রুত।

প্যাড ও কলম নিয়ে আহমদ মুসা গেল সেই শ্বেতাঙ্গ লোকটির কাছে। খুলে দিল তার হাতের বাঁধন।

উঠে বসল শ্বেতাঙ্গ লোকটি।

আহমদ মুসা তার প্যাড ও কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘লিখুন সেখানকার দায়িত্বশীলকে, পত্রবাহকদের হাতে ইমাম সাহেবকে দিয়ে দিতে। দেরি করবেন না। আমার সময় খুব কম।’

বৃদ্ধ সরদার, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, ফাতেমা এবং আরও কয়েকজন প্রধান ব্যক্তি আহমদ মুসাদের চারদিকে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা বুঝতে পারল আহমদ মুসা কি করতে যাচ্ছে।

শ্বেতাঙ্গ লোকটি প্যাড ও কলম হাতে তুলে নিল। তারপর পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কে?’

‘এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। আপনি লিখুন।’

‘আমি জানি, আমাকে লিখতেই হবে। কিন্তু আপনার মত একজন মানুষ এই প্রথম দেখলাম। বলবেন কি, আপনার নাম কি?’

‘আমার নামও আমি বলব না।’

‘মনে হচ্ছে, কোথাও দেখেছি আপনাকে।’

‘দেখুন, আমি আপনার কোন প্রশ্নেরই জবাব দেব না। লিখুন তাড়াতাড়ি। আর শুনুন, কোন সঙ্কেত পাঠাবার চেষ্টা করবেন না।’

লিখল লোকটি।

প্যাড ও কলম সে ফেরত দিল আহমদ মুসার হাতে। বলল, ‘আপনাদের এ প্রতারণার ফল ভালো হবে না।’

হো হো করে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রতারণা আমরা করেছি? না আপনাদের প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল ও জঘন্য ষড়যন্ত্রের মোকাবিলার আমরা চেষ্টা করছি? তবে কিছু একটা করব আমরা। সব অন্যায়ের প্রতিবিধান না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের ছাড়ব না।’

শ্বেতাঙ্গ লোকটির চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত কঠোর কণ্ঠে কথা কয়টি বলল আহমদ মুসা।

লোকটির মুখ ম্লান হয়ে গেল। সে বিশ্বাস করল আহমদ মুসার প্রতিটি কথা।

আহমদ মুসা সরে এল ওদের কাছ থেকে। সরদারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একটু পরামর্শ দরকার, চলুন মসজিদে বসি।’

এলাকার প্রধানগণ সকলে মসজিদে বসল।

দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন তিনটি আশু করণীয় কাজ আছে। এক, বন্দী লোকদের কোথাও কোন নিরাপদ জায়গায় রাখতে হবে। দুই, পুলিশ স্টেশনে কেউ গিয়ে মামলা দায়ের করে আসতে হবে যে, আমাদের ইমামকে কিডন্যাপ করে রাখার পর ইসলাম গ্রহণকারী দু’টি পরিবারকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে ওরা মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা করেছিল আমাদের পল্লীতে। রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ওদের পরাজিত করা হয়েছে। সংঘর্ষে মারা পড়েছে তাদের কয়েকজন নেতা এবং তাদের বেশ কিছু লোক। ওদের চরমপত্রের একটা কপি পুলিশকে দিতে হবে। তিন নাম্বার কাজ হলো, কয়েকজন যেতে হবে ইমাম সাহেবকে খুলে আনতে।’

আহমদ মুসা বলল।

মুখ খুলল আবুবকর বিগোভিট। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এ কাজগুলো আমাদের মাথায় ছিল না। সম্মানিত মেহমানকে মোবারকবাদ। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমার এখন মনে হচ্ছে, আল্লাহ মেহমানকে পাঠিয়েছেন এক গুরুতর সঙ্কটে আমাদের সাহায্য করতে। কল্পনা করতে ভয় হয়, তিনি আজ না থাকলে আমাদের কি ঘটত! এখনও আমার মনে হচ্ছে, যা দেখলাম সব যেন স্বপ্ন দেখলাম। বিপর্যয়কে তিনি যেভাবে বিজয়ে পরিণত করলেন, তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে আমার জানা ছিল না।’

উপস্থিত সবাই আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে উঠল।

বৃদ্ধ সরদার থেমে গিয়েছিল। আবার বলতে শুরু করল, ‘আমাদের যে বন্দীশালা আছে, সেখানে বন্দীরা আপাতত থাকবে। আমাদের এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বশীল ‘আলী ওকোচা’ কয়েকজনকে নিয়ে থানায় যাবেন। ইতোপূর্বের মামলাগুলো তিনিই করেছেন। আর ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করতে কে যাবেন, এটা সম্মানিত মেহমান ঠিক করলে ভালো হয়। এই উদ্ধার কাজ কেমন করে কিভাবে হবে তা আমার মাথায় আসছে না।’

থামল বৃদ্ধ।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করতে আমি যাব। আমার সাথে থাকবে দু’জন। তাদের একজন মুহাম্মাদ ইয়েকিনী। আরেকজনকে ঠিক করে দেবেন সরদার।’

আহমদ মুসার পাশেই বসা মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেহমান নিজে তাকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছেন- এই আনন্দ তার বুকে ধরছে না। আবেগ-উচ্ছ্বাসে তার দু’চোখের কোণায় অশ্রু দেখা দিল।

আহমদ মুসার কথা শেষ হলে সরদার চারদিকে চেয়ে বলল, ‘হাসান ইকোকু, তুমি দাঁড়াও।’

সঙ্গে সঙ্গে সুগঠিত দেহের একজন বলিষ্ঠ কৃষ্ণাংগ নব্য যুবক উঠে দাঁড়াল। বিনয়ের ভাব তার মুখে, একটা সলজ্জ দৃষ্টি তার চোখে। নিরেট নিগ্রো যুবক সে।

সরদার বলল, ‘খুব ভালো ছেলে হাসান ইকোকু। আমাদের একজন সেনাধ্যক্ষ সে।’

‘খোশ আমদেদ।’ যুবকটির দিকে চেয়ে সহাস্যে বলল আহমদ মুসা।

বৃদ্ধ সরদার আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিন্তু তিনজনে কি হবে? শত্রুদের একদম মাঝখানে গিয়ে তো পড়তে হবে।’

‘কম লোক যেতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি।’

‘কিন্তু কিছু যদি ঘটে?’

‘আল্লাহ্‌ সাহায্য করবেন।’

বৃদ্ধ সরদার আহমদ মুসার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কাছ থেকে আল্লাহ্‌ আমাদের অনেক শিক্ষা লাভের সুযোগ দিয়েছেন।’

‘আমাদের এখন ওঠা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।

উঠে দাঁড়াল বৃদ্ধ সরদার।

পরে উঠে দাঁড়াল সবাই।

হাসান ইকোকু মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল।

ফাতেমা মুনেকা বাইরে থেকে বাড়ির দিকে আসছিল। হাসান ইকোকুকে দেখে সে দাঁড়াল। বলল, ‘ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে দরখাস্ত করার কথা, করেছ দরখাস্ত?’

‘রাগ করো না, দরখাস্ত আমি করিনি।’

‘করনি? কেন?’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসারী করার সময় কি আমাদের এটা? ক্রস এবং ক্রিসেন্টের এ লড়াই না মিটলে…।’

ফাতেমা মুনেকা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘প্রফেসারী করে এ লড়াই করা যাবে না, কে বলেছে?’

‘সেটা পার্টটাইম হবে। কিন্তু জাতি যে ফুলটাইম চায়। তুমিও কি এটা চাও না মুনেকা?’

ফাতেমা মুনেকার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘চাই। কিন্তু লড়াই-এর ক্ষেত্র কি একটাই? বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই কি লড়াই নয়? বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে আমাদের লোক নেই!’

‘তোমার সাথে আমি একমত মুনেকা। কিন্তু আগ্রাসনের মুখে জাতির অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়, তখন সশস্ত্র লড়াইটাই অগ্রাধিকার পায়। আমি সেটাই করেছি।’

‘তুমি দরখাস্ত করনি, সে কথা আগে কেন বলনি?’

‘তুমি এটা পছন্দ করবে না, তাই বলিনি।’

‘কেন, জাতিকে আমি ভালোবাসি না?’

‘না, তা আমি বলিনি।’

‘দেখ, আমিও জাতিকে ভালোবাসি। জাতির জন্যে জীবন দিতে হলে তোমার চেয়ে পেছনে থাকবো না। কিন্তু আমি মনে করি, সবার অগ্রাধিকার এক রকমের হওয়া ঠিক নয়।’

‘তুমি ঠিক বলেছ। এ সংকটটা কেটে যাক, তুমি যা চাও তা-ই করব।’

ফাতেমা মুনেকার মুখে একটা সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এভাবে কথা বলো না। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, পথপ্রদর্শক হতে চাইনি কখনও।’

হাসান ইকোকু কথার মোড় ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, ‘খুশি হওনি, আমি আহমদ মুসার সঙ্গী হতে পারছি অভিযানে?’

‘আমার হিংসে হচ্ছে। তুমি যে সৌভাগ্য পেলে আমার তা জুটল না।’

‘আচ্ছা, আমাদের মেহমান এই আহমদ মুসা কে?’

‘আমারও প্রশ্ন এটা। উনি যে পরিচয়টুকু দিয়েছেন, সেটা আসল পরিচয় নয়। যে বুদ্ধি, যে সাহস এবং যে ক্ষিপ্রতা উনি দেখিয়েছেন, সেটা অলৌকিকের মত। গোটা পৃথিবীতে দু’চারজন লোক এমন থাকে।’

হাসান ইকোকু কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলতে গিয়ে থেমে গেল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে আহমদ মুসা এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

ওরা কাছাকাছি আসতেই ফাতেমা মুনেকা সালাম দিল আহমদ মুসাকে এবং বলল, ‘জনাব, এ ধরনের অভিযানে মেয়েদের অংশগ্রহণ কি নিষিদ্ধ?’

‘না, নিষিদ্ধ নয়। তবে মেয়েদেরকে প্রথমেই আক্রমণকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। প্রথমে তারা প্রতিরক্ষা শক্তি, পরে তারা আক্রমণকারী শক্তি। আর ছেলেরা সব সময় আক্রমণকারী শক্তি, যদি আক্রমণের প্রয়োজন হয়।’

‘আক্রমণে মেয়েরা দ্বিতীয় পর্যায়ের শক্তি কেন?’

‘ছেলেদের আক্রমণ ব্যর্থ হলে মেয়েরা তাদের সহযোগিতায় আসবে, এটাই সবদিক দিয়ে স্বাভাবিক।’

‘ধন্যবাদ। আমি বুঝেছি। কিন্তু মাঠে যখন লড়াই, তখন ঘরে থাকা কত কষ্টকর বুঝবেন না।’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বোন, ঘরে করার মত অনেক কাজ আছে। আমি তোমাকে একটা কাজ দিয়ে যেতে চাই।’

‘কাজ চাওয়ার পরে তো বলছেন!’ ফাতেমা মুনেকার কণ্ঠে অভিমানের সুর।

‘সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছ।’

‘ধন্যবাদ। বলুন।’ হেসে বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘তুমি একটা রিপোর্ট তৈরি কর। এখানকার মুসলিম অধিবাসীরা কি ধরনের জুলুম ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে KOC-এর পক্ষ থেকে, এর প্রতিবিধানের জন্যে তোমরা সরকারের কাছে কিভাবে কতবার গেছ এবং তার কোন ফল হয়নি-এসবসহ ইসলাম ধর্মগ্রহণকারী দু’টি পরিবারকে কিভাবে ফেরত চাইল ওরা, কিভাবে ইমাম সাহেবকে পণবন্দী করল, কি করে দু’টি ভূখণ্ড দাবি করল, কি চরমপত্র তারা দিল এবং সর্বশেষে আজকের ঘটনা- সবই তোমার রিপোর্টে থাকতে হবে।’

বলে আহমদ মুসা পিঠের ব্যাগ থেকে ক্ষুদ্র একটা অটো-ক্যাসেট বের করে ফাতেমা মুনেকার হাতে দিয়ে বলল, ‘রিপোর্ট লেখার পর এই ক্যাসেটে সেটা রেকর্ড করবে। সবশেষে তোমার পরিচয় বলবে, ‘ফাতেমা মুনেকা, ইয়াউন্ডি, ক্যামেরুন, কোডঃ এ, এম-১১ এবং আর, এফ, এ, এম-৮।’’

‘কিন্তু কিছুই বুঝলাম না। রেকর্ড করবো কেন, আমার পরিচয় কি দরকার, কোড নাম্বার কি এবং কেন?’

‘রেকর্ড করবে। কারণ, তোমার এই রেকর্ড যাবে ‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী’ (WNA) এবং ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশন’ (FWTV)-এর কাছে। তোমার পরিচয় দরকার। কারণ, পরিচয়হীন কারও রিপোর্ট তারা পড়েও দেখে না। আর কোড নাম্বার দরকার। কারণ, কোড নাম্বার না হলে তারা রিপোর্ট বিশ্বাস করবে না।’

‘রিপোর্ট কি করবে তারা?’

‘ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সী ও ফ্রি ওয়ার্ল্ড টেলিভিশনের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়বে।’

‘আমার এই রিপোর্ট?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু তারা তা করবে কেন? আমার পাঠানো এই রিপোর্টের প্রতি তারা গুরুত্ব দেবে কেন?’

‘এই জন্যে তো কোড নাম্বার।’

‘এ, এম-১১ -এর অর্থ কি?’

‘আহমদ মুসা-১১। এর অর্থ, আহমদ মুসা তার এগারোতম রিপোর্টার হিসেবে ফাতেমা মুনেকাকে রিকমেন্ড করছে।’

‘ঐ দুই নিউজ মিডিয়ার তাহলে আমি সাংবাদিক হয়ে যাব!’ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফাতেমা মুনেকার চোখ-মুখ।

‘অবশ্যই।’

‘শেষোক্ত কোডটার অর্থ কি?’

‘আর, এফ, এ, এম-৮ -এর অর্থ হলো, আহমদ মুসার পক্ষ থেকে অষ্টম রিপোর্ট।’

‘আগের কোড এবং এই কোডের মধ্যে পার্থক্য বুঝলাম না।’

‘আগেরটা তোমার নিজস্ব সাংবাদিক কোড। আর দ্বিতীয়টা আমার নিজস্ব রিপোর্টের কোড।’

‘কিন্তু রিপোর্টটি তো আমি পাঠাচ্ছি।’

‘তুমি পাঠাচ্ছ বটে। তবে রিপোর্টটি আমার নির্দেশে পাঠানো হয়েছে বলে তারা ধরে নেবে এবং জরুরি ভিত্তিতে তখনই রিপোর্টটা প্রচার করবে।’

‘তাহলে আমাদের নিজস্ব পাঠানো রিপোর্ট এই ধরনের জরুরি বিবেচিত হবে না, তাই না?’

‘তোমাদের রিপোর্টের প্রচার নির্ভর করবে গুরুত্বের উপর। সঙ্গে সঙ্গেও প্রচার হতে পারে, আবার পরেও হতে পারে।’

‘আমরা যদি আপনার কোড ব্যবহার করি?’

‘তা পারবে না। কারণ, আমার কোড এবার ৮ হয়েছে, পরে কত হবে তুমি জানবে না।’

‘বুঝেছি। আরেকটা কথা।’

‘কি?’

‘আপনি আমাকে ঐ দু’টি নিউজ মিডিয়ার সাংবাদিক বানালেন, আপনার রিপোর্টকে ওরা তক্ষুণি প্রচার করবে- এসবের কারণ কি? আপনার সাথে ওদের সম্পর্ক কি?’

‘এসব কথা পরে হবে। এখন সময় নেই। তুমি রিপোর্ট রেকর্ড কর।’ বলে আহমদ মুসা তাকাল মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে। বলল, ‘চল।’

‘আল্লাহ্ হাফেজ হাসান, আল্লাহ্ হাফেজ মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।’ বিদায় জানাতে গিয়ে বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘সত্যি হিংসে হচ্ছে। এমনভাবে বিদায় কেউ আমাকে দেয় না।’ বলল আহমদ মুসা। হাসি তার মুখে।

‘কেন আব্বা, আম্মা, ভাই, বোন, কিংবা নিজস্ব কেউ নেই আপনার?’

‘যখন ছিল, তখনকার কথা প্রায় ভুলেই গেছি।’

‘বাড়িতে তাহলে কে আছে আপনার?’

‘বাড়ি থাকলে তবেই তো সেখানে কারও থাকার প্রশ্ন আসে।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।

কিন্তু এই হাসি ফাতেমা মুনেকা, হাসান ইকোকু ও মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর কাছে কান্নার চেয়েও করুণ মনে হলো। বিস্মিত দৃষ্টিতে তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে।

‘এস’ বলে হাঁটতে শুরু করেছে।

‘খোদা হাফেজ, আহমদ মুসা ভাইয়া।’ মুখে হাসি টেনে বলল ফাতেমা মুনেকা।

আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে ফাতেমা মুনেকার দিকে চেয়ে বলল, ‘ফি আমানিল্লাহ্ বোন।’ আহমদ মুসার ঠোঁটেও হাসি। কিন্তু চোখে নিঃসীম তৃষ্ণার একটা ছায়া। হঠাৎ করেই তার চোখে ভেসে উঠেছিল সিংকিয়াং-এর এক মরু-পল্লীর দৃশ্য। যেখানে নিজেকে সে দেখতে পেল মায়ের কোলে, পিতার বাহুবন্ধনে এবং ছোট ভাই ও বোনের মিষ্টি ডাকে পরিপ্লাবিত অবস্থায়।

আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে। ওদের তিনজনের কারোরই তা নজর এড়াল না।

পরক্ষণেই আহমদ মুসা হেসে উঠল। বলল, ‘স্মৃতির আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম। চল।’

বলে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা।

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকুও হাঁটতে শুরু করল তার পেছনে।

‘কোক’দের নিয়ে আসা একটি গাড়ি নিল আহমদ মুসা।

মাইক্রোবাসটির ড্রাইভিং সিটে বসল সে।

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকু বলল পাশের সিটে।

‘ইদেজা, যেখানে আমাদের যেতে হবে, কতদূর হবে?’

‘হাইওয়ে থেকে দক্ষিণে বিশ মাইলের মত হবে।’

‘তোমরা দু’জনেই তো চেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

‘তোমাদের দু’জনের কাছে কাগজ-কলম আছে?’

‘আছে।’ বলল তারা দু’জনেই।

‘‘ইদেজা’য় ‘কোক’-এর যে ঘাঁটি, তার বিল্ডিংগুলোর লোকেশন তোমাদের মনে আছে?’

‘আছে।’ বলল তারা একসাথে।

‘তাহলে তোমরা দু’জনে ওদের ঘাঁটির দু’টি স্কেচ আঁক। তাতে যতদূর সম্ভব রাস্তা, ফাঁকা জায়গা, বিল্ডিং, দরজা ইত্যাদির অবস্থান দেখাবে।’

খুশি মনে ওরা দু’জন পকেট থেকে কাগজ বের করে স্কেচ আঁকায় মনোযোগ দিল।

গাড়ি ছুটে চলল দক্ষিণে কোক-এর উত্তরাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ইদেজার উদ্দেশ্যে।

ইয়াউন্ডিগামী হাইওয়েতে উঠার পর হাইওয়ে ধরে কিছুটা পুবে এগিয়ে ইদেজাগামী সড়কে উঠল আহমদ মুসারা। সড়কটি সম্প্রতি পাকা করা হয়েছে।

ইদেজা ছোট একটা শহর।

সুঙ্গা নদীর একটা শাখার তীরে এই শহরটি। শহরের পূর্ব প্রান্তে নদীর তীরে একটা এলাকা জুড়ে ‘কোক’-এর আঞ্চলিক সদর দফতর।

‘কোক’-এর দফতরটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে নদী আর উত্তর পাশ দিয়ে ইয়াউন্ডির দিক থেকে আসা সড়ক।

সড়ক থেকে গজ পাঁচেক দূরে একটা বড় গেট। গেটে একটা বড় নামফলকঃ ‘কিংডম অব ক্রাইস্ট’।

গেটটি খোলা। গেটের দু’পারে দু’জন গার্ড দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে রাইফেল।

আহমদ মুসার সামনে ড্যাশবোর্ডে হাসান ও মুহাম্মাদের আঁকা দুইটি স্কেচই মেলে রাখা।

স্কেচ দেখেই জায়গাটা আহমদ মুসা ঠিক চিনল।

যে গতিতে আহমদ মুসা সড়ক দিয়ে এসেছিল, সে একই গতিতে সে গেটের দিকে অগ্রসর হলো।

গাড়িটি দেখেই গেটম্যানরা গাড়িটিকে প্রথমে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিল। কিন্তু গেটের কাছাকাছি হলে আহমদ মুসাদের দেখার পর তারা হাত তুলে গাড়ির গতিরোধ করে দাঁড়াল।

গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা।

গেটম্যান দু’জন শ্বেতাংগ।

তারা দু’দিক থেকে দু’জন গাড়ির জানালায় দাঁড়াল।

‘জন স্টিফেন আমাদের পাঠিয়েছেন। তিনি চিঠি দিয়েছেন ফ্রাসোয়া বিবসিয়েরের কাছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘দেখি চিঠি?’ বলল গার্ডদের একজন।

‘চিঠি তো ফ্রাসোয়ার জন্যে, আপনার জন্যে নয়।’

‘কিন্তু আমরা দেখতে পারি।’

‘দেখতে হলে তাকে ডাকুন, তিনিই দেখাবেন।’

গার্ড দু’জন পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর তারা সরে দাঁড়াল গাড়ির রাস্তা থেকে।

ভেতরে ঢুকল আহমদ মুসার গাড়ি।

সামনের দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা, ‘তোমাদের স্কেচ অনুসারে প্রথম গাড়ি বারান্দাই মূল অফিস বিল্ডিং-এর প্রবেশপথ, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

গাড়ি বারান্দায় আহমদ মুসার গাড়ি এসে দাঁড়াতেই করিডোরের মুখে দরজায় দাঁড়ানো স্টেনগানধারী ছুটে এল। বলল, ‘কাকে চাই?’

‘ফ্রাসোয়া বিবসিয়ের। তার জন্যে ‘জন স্টিফেন’-এর চিঠি নিয়ে এসেছি।’

‘ওয়েলকাম। চলুন, তিনি অফিসে।’

স্টেনগানধারী আহমদ মুসাদেরকে এ করিডোর সে করিডোর ঘুরিয়ে একটা দরজার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এখানেই তিনি বসেন। চেনেন মঁশিয়ে ফ্রাসোয়াকে?’

‘চিনি না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘তিনি জন স্টিফেনের ডেপুটি।’

বলে স্টেনগানধারী তার জায়গায় ফিরে গেল।

আহমদ মুসা দরজায় নক করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ফিরল হাসান ইকোকু এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর দিকে। বলল, ‘হিসেবে একটা ভুল করেছি আমরা।’ একটু আনমনা আহমদ মুসা।

‘কি ভুল হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হাসান ইকোকু প্রশ্ন করল।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘পেছনের কথা ভেবে আর লাভ নেই। চল, সামনে এগোই।’

দরজায় নক করতেই প্রশস্ত দরজাটি খুলে গেল।

ঘরের ভেতর চোখ পড়তেই আহমদ মুসা দেখল, তিনটি স্টেনগান হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। আর তাদের পেছনে বিশাল টেবিলের ওপারে বিরাট এক রাজাসনে বসে আছে একজন শ্বেতাংগ। আহমদ মুসা ভাবল, এই-ই হবে ফ্রাসোয়া বিবসিয়ের।

শ্বেতাংগ লোকটি হো হো করে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা হাত তুলে দাঁড়াও।’

আহমদ মুসা নিজে হাত তুলল। দেখে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকুও হাত তুলল। অপরিসীম উদ্বেগ এবং আশংকা এসে তাদেরকে ঘিরে ধরেছে। তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দেখল, আহমদ মুসার মুখে ভয়-ভাবনার কোন চিহ্নই নেই। যেন কিছুই ঘটেনি। বিস্মিত হলো তারা আহমদ মুসার নার্ভের শক্তি দেখে।

ফ্রাসোয়া এগিয়ে এল। আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রাসোয়ার হাতে রিভলভার। বলল আহমদ মুসার দিকে রিভলভার নাচিয়ে, ‘কই চিঠি, দাও? জন স্টিফেনের চিঠি।’

‘তার আর প্রয়োজন নেই মিঃ ফ্রাসোয়া।’ বলল আহমদ মুসা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে।

‘কেন?’

‘চিঠি দিয়ে যে কোন লাভ হবে না তা আপনি প্রমাণ করেছেন।’

‘তবু আমি দেখতে চাই স্টিফেনকে দিয়ে তোমরা কি লিখিয়েছ।’

‘একটাই কথা, আমাদের ইমাম সাহেবকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন।’

আবার হো হো করে হেসে উঠল ফ্রাসোয়া। হাসি থামলে বলল, ‘মনে করেছ স্টিফেনকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেই আমরা বিশ্বাস করবো?’

‘বিশ্বাস করবেন না তা জানি। কিন্তু চিঠি ছিল আপনার কাছ পর্যন্ত আমাদের পৌঁছার মাধ্যম।’

‘বেশ মজার লোক তো তুমি। কথা বলছ এমনভাবে যেন আমরা দুই বন্ধু। তোমার ভয় করছে না?’

‘ভয় করার মধ্যে কোন লাভ আছে? বিপদ তাতে কিছু কি কমবে?’

‘খুব সাহসের কথা বলেছ। মনে হয়, এ লাইনে তুমি খুব নতুন। ভয়ের কোন কিছু এখনও দেখনি।’

বলে ফ্রাসোয়া মুখ ঘুরিয়ে স্টেনগানধারীদের একজনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমরা একজন এসে এদের সার্চ…।’

ফ্রাসোয়া তার কথা শেষ করতে পারলো না। আহমদ মুসা বিদ্যুৎ গতিতে এক ধাপ এগিয়ে ফ্রাসোয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাত দিয়ে তার হাতের রিভলভার কেড়ে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে তার মাথায় রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বলল, ‘ওদের স্টেনগান ফেলে দিতে বল ফ্রাসোয়া। দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেব না। তার বদলে তোমার মাথা ছাতু হয়ে যাবে।’

ঘটনার আকস্মিকতায় ফ্রাসোয়ার দু’চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। সে নির্দেশ দিল তার তিনজন লোককে স্টেনগান ফেলে দেবার জন্যে।

ওরা স্টেনগান ফেলে দিতেই মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকু দৌঁড়ে গিয়ে স্টেনগানগুলো কুড়িয়ে নিল।

‘ধন্যবাদ তোমাদের। তোমরা এখন তিনজনকে ঘরে ঢোকাও।’ মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকুকে উদ্দেশ্য করে বলল আহমদ মুসা।

ইয়েকিনী ও ইকোকু স্টেনগান বাগিয়ে ওদের ঘরে ঢোকাল। দু’হাত তুলে সুবোধ বালকের মত ওরা ঘরে ঢুকল।

আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার মাথায় রিভলভার ধরে রেখেই তাকে ঠেলে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

দরজা বন্ধ করে দিল। বলল ইয়েকিনীদের উদ্দেশ্য করে, ‘টেবিলে ঐ দেখ কস্টিক টেপ। ওদেরকে বেঁধে ফেল।’

হাসান ইকোকু স্টেনগান ধরে ওদের পাহারা দিল। আর ইয়েকিনী পিছমোড়া করে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।

এবার আহমদ মুসা ফ্রাসোয়াকে ছেড়ে দিল। বলল, ‘তুমি টেবিলের উপর বস।’

বসল ফ্রাসোয়া টেবিলের উপর। ভয়ার্ত দু’টি চোখ তার।

আহমদ মুসা তার বুকের উপর রিভলভার নাচিয়ে বলল, ‘দেখ মিঃ ফ্রাসোয়া, আমার হাতে সময় খুব কম। একটা আদেশ একবার করব এবং তা তুমি তামিল করবে। অন্যথা হলে রিভলভারের বুলেট এর জবাব দেবে।’ বলল আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে।

‘ইমাম সাহেব কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।

ফ্রাসোয়া ভয়ার্ত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ঠোঁট তার নড়ল, কিন্তু কথা বলল না।

আহমদ মুসার সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারের নল বিদ্যুৎ গতিতে উঠে এল। নিঃশব্দে অগ্নি উদগীরণ করল। ফ্রাসোয়ার বাম কানের একাংশ নিয়ে তা বেরিয়ে গেল।

কান চেপে ধরে ফ্রাসোয়া বলল, ‘বলছি। আমাকে মের না তোমরা।’

ইয়েকিনী এবং হাসান অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার এই চেহারা তাদের কাছে নতুন।

একটু থেমে ফ্রাসোয়া আবার শুরু করেছিল, ‘এই বিল্ডিং-এর একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে বন্দী আছে।’

‘সেখানে নামার পথ কোথায়?’

ফ্রাসোয়া আহমদ মুসার দিকে এক পলক তাকিয়ে ত্বরিত জবাব দিল, ‘পাশের হল ঘর থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে আন্ডারগ্রাউন্ডে।’

‘পাশের হল ঘরে যাবার রাস্তা কোন দিকে?’

তার অফিস ঘরের একটা পার্টিশন ডোরের দিকে ইংগিত করে বলল, ‘ঐ দরজা দিয়ে হল ঘরে যাওয়া যাবে।’

‘মিঃ ফ্রাসোয়া, উঠে দাঁড়াও। তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে। কোন চালাকির সামান্য ইংগিত পেলে তোমার মাথা গুঁড়ো হয়ে যাবে।’

বলে আহমদ মুসা ইয়েকিনীকে নির্দেশ দিল, ‘এ অফিস ঘরের বাইরের দরজাটা লক করে দাও। তোমরা দু’জন চারদিকে চোখ রেখে স্টেনগান নিয়ে আমাদের পেছনে পেছনে এস। কোন মানুষকে দেখলে নির্বিচারে গুলি চালাবে।’

ফ্রাসোয়াকে নিয়ে আহমদ মুসা হল রুমে প্রবেশ করল। দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, এটা সভা কক্ষ। অনেকগুলো দরজা চারদিকে।

আহমদ মুসা হল রুমে ঢুকেই ইয়েকিনী ও ইকোকুকে বলল, ‘তোমরা হল রুমের প্রত্যেকটা দরজা লক করে দাও।’

আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার সিঁড়িপথটা একটা দরজার আবরণে ঢাকা। দরজা খুলতেই সিঁড়ি বেরিয়ে পড়ল।

সিঁড়ি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে নামল তারা। আন্ডারগ্রাউন্ডে কোন প্রহরী দেখা গেল না।

ফ্রাসোয়া রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল ইমাম সাহেবের কক্ষে।

ইমাম সাহেব মধ্যবয়সী মানুষ। কৃষ্ণাংগ। স্বাস্থ্য সুন্দর। থুতনিতে অল্প একটু দাড়ি। উজ্জ্বল ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পবিত্র চেহারা। দেখলেই বোঝা যায়, একজন আল্লাহওয়ালা লোক।

প্রথমেই ইমাম সাহেব ফ্রাসোয়া এবং আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছিল। ফ্রাসোয়ার মাথায় অপরিচিত একজন লোককে রিভলভার ধরে রাখার দৃশ্য দেখে সে ভীত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পেছনে ইয়েকিনী ও হাসানকে আসতে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ইয়েকিনী ও হাসানকে। আনন্দের অশ্রু এসে জমেছিল ইমাম সাহেবের দুই চোখে।

ইমাম সাহেবকে নিয়ে তারা ফিরে এল ফ্রাসোয়ার সেই অফিস কক্ষে।

মেঝেয় পড়ে থাকা তৃতীয় স্টেনগানটি তুলে নিয়ে কাঁধে রাখল আহমদ মুসা। তারপর সে ইয়েকিনী ও হাসানকে বলল, ‘তোমরা পেছনটা দেখবে।’

বলে আহমদ মুসা রিভলভারের নল দিয়ে ফ্রাসোয়ার কাঁধে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, ‘দরজা খুলুন।’

দরজা খুলে দিল ফ্রাসোয়া।

আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে। তার রিভলভারের নল ফ্রাসোয়ার মাথায়।

দরজা খুলতেই আহমদ মুসা দেখল, উদ্যত স্টেনগান হাতে দু’জন দাঁড়িয়ে।

‘স্টেনগান তোমরা ফেলে দাও।’ বলল আহমদ মুসা।

স্টেনগান তাদের হাত থেকে পড়ল না।

আহমদ মুসার বাম হাত বেঁকে গিয়ে পেঁচিয়ে ধরল ফ্রাসোয়ার গলা এবং ডান হাতে ধরা তার রিভলভার সরে গেল তার মাথা থেকে। পর পর দু’বার গুলি বর্ষণ করল তার রিভলভার। স্টেনগানধারী দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল দরজার সামনেই।

রিভলভার দিয়ে ফ্রাসোয়াকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এগোন সামনে, চলুন গাড়ি বারান্দায়।’

একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘ইয়েকিনী, হাসান, স্টেনগান দু’টি তুলে নাও। শত্রুকে যত নিরস্ত্র করা যায়, ততই ভাল।’

ইয়েকিনী ও ইকোকু স্টেনগান দু’টি তুলে নিয়ে কাঁধে ঝোলাল।

এগিয়ে চলল ছোট দলটি গাড়ি বারান্দার দিকে।

আহমদ মুসা ফ্রাসোয়ার ঠিক পেছনে। তার রিভলভারের নল ফ্রাসোয়ার পিঠে সেঁটে আছে।

আহমদ মুসার পেছনেই ইমাম সাহেব।

ইমাম সাহেবের পেছনেই স্টেনগান বাগিয়ে পেছন ফিরে হাঁটছে মুহাম্মাদ ইয়েকিনী এবং হাসান ইকোকু। চোখে তাদের সতর্ক দৃষ্টি। মুখে তাদের প্রসন্ন ভাব, কোন উদ্বেগের চিহ্ন সেখানে নেই। তাদের এই ধরনের অভিযান এই প্রথম, তবু তাদের মনে হচ্ছে, এই এক অভিযানে এসে আহমদ মুসার কাছে তারা এত কিছু শিখেছে যা বছরের পর বছরের চেষ্টায় শেখা সম্ভব ছিল না। এই সাংঘাতিক অবস্থাতেও তাদের মনে কোন উদ্বেগ নেই। কারণ, ইতোমধ্যেই তাদের বিশ্বাস জন্মেছে, তারা এমন একজন লোকের সাথী যিনি অলৌকিক বুদ্ধি, শক্তি ও সাহসের অধিকারী।

করিডোরের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল আহমদ মুসারা। এরপরেই বারান্দা, তারপর সিঁড়ির তিন ধাপ নামলেই গাড়ি বারান্দা।

বারান্দায় করিডোরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আরও চারজন স্টেনগানধারী।

আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে ফ্রাসোয়ার গলা পেঁচিয়ে ধরে রিভলভারের নল দিয়ে ফ্রাসোয়ার মাথায় একটা চাপ দিয়ে বলল, ‘তোমার লোকদের নির্দেশ দাও স্টেনগানগুলো মাইক্রোবাসের সামনে রাখতে।’

আহমদ মুসাকে ইতোমধ্যেই চিনে ফেলেছে ফ্রাসোয়া। সুতরাং আহমদ মুসার নির্দেশের সংগে সংগেই সে তার লোকদের মাইক্রোবাসের সামনে নিয়ে অস্ত্র রাখার নির্দেশ দিল।

ওরা চারজন অস্ত্র রাখার জন্যে মাইক্রোবাসের দিকে চলল। আহমদ মুসাও ফ্রাসোয়াকে নিয়ে তাদের পেছন পেছন গাড়ি বারান্দায় নেমে এল।

ওরা অস্ত্র রাখলে ওদের উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই ওরা নির্দেশ তামিল করল।

আহমদ মুসা গাড়ির আড়ালে এসে ইয়েকিনীকে গাড়ির গোটা ভেতরটা এবং ইঞ্জিনের স্টার্টার পরীক্ষা করতে বলল।

ইয়েকিনী সবটা পরীক্ষা করে বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া।’

‘তাহলে স্টেনগানগুলো এবং ইমাম সাহেবকে তুলে নাও গাড়িতে।’

ওরা উঠলে আ্হমদ মুসা ফ্রাসোয়াকে টেনে নিয়ে সামনের সিটে উঠে এল। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসল এবং ফ্রাসোয়াকে তার পাশে সামনের সিটে বসাল।

হাসান ইকোকু বাইরে স্টেনগান বাগিয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল।

আহমদ মুসা ইঞ্জিনের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়ে বলল, ‘হাসান ইকোকু, তুমি উঠে এসে ফ্রাসোয়ার পাশে বস।’

হাসান ইকোকু উঠে এসে ফ্রাসোয়ার পাশে বসল। আহমদ মুসা সুইচ টিপে সবগুলো দরজা লক করে দিল।

তারপর হাতের রিভলভারটা ড্যাশবোর্ডের উপরে রেখে ফ্রাসোয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আশা করি, কোন চালাকির চেষ্টা করবেন না।’

আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটে চলল গেটের দিকে।

দূর থেকে আহমদ মুসা দেখল, গেটের দরজা বন্ধ।

আহমদ মুসা কার-মাইক্রোফোনের সুইচ বাম হাতে অন করে বাম হাতেই স্পীকারটা ফ্রাসোয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘তোমার গার্ডদের বলে দাও গেট খুলে দিতে।’

গাড়ি ততক্ষণে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একেবারে গেটের সামনে।

রাইফেলধারী গার্ড দু’জন গেটের পাশে ফ্রাসোয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।

আহমদ মুসা মাইক্রোফোনের স্পীকার ফ্রাসোয়ার হাতে তুলে দেবার সাথে সাথে সে গেট খুলে দেবার নির্দেশ দিল।

গেট খুলে গেল।

শাঁ করে বেরিয়ে এল গাড়ি গেট দিয়ে। উঠে এল হাইওয়েতে।

আহমদ মুসা তার রিয়ার ভিউতে দেখল, আরেকটা গাড়ি কোক-এর গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে তাদের পেছনে পেছনে হাইওয়েতে উঠল।

আহমদ মুসা আবার স্পীকারটা ফ্রাসোয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘তোমাদের গাড়ি পিছু নিয়েছে আমাদের। গাড়িটাকে ফিরে যেতে বল। না হলে গাড়ি আমি ওদের দিকে ঘুরিয়ে নেব। তোমাদের আরো লোকের প্রাণ যাবে, গাড়িটাও নষ্ট হবে, ফলে কিছুই করতে পারবে না।’ শান্ত অথচ কঠোর তার কণ্ঠ।

ফ্রাসোয়া আগের মত করেই তাদের গাড়িকে ঘাঁটিতে ফিরে যেতে নির্দেশ দিল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়িটাকে আবার ঘাঁটির দিকে ফিরে যেতে দেখা গেল।

‘ধন্যবাদ ফ্রাসোয়া। এ ধরনের সহযোগিতা যদি করেন এবং অতীতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি হন, তাহলে আপনাদের সাথে আমাদের সহজেই ‘নো-ওয়ার’ প্যাক্ট হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?’

‘কেন, জন স্টিফেনের সাথে কিছুদিন আমাদের মেহমান হতে আপত্তি আছে?’

‘আপনি কে জানি না, কিন্তু এটাই শেষ ঘটনা নয় মনে রাখবেন।’

‘কোন ঘটনাই শেষ ঘটনা নয়। তবে ভবিষ্যতের ঘটনা অতীতের মতই ঘটতে থাকবে, এমনটা ভাবাও ঠিক হবে না।’

‘দেখুন, আপনি সব জানেন না, কিংডম অব ক্রাইস্ট (KOC) একা নয়।’

‘তা আমি জানি, ‘ওকুয়া’ আছে, ‘ব্ল্যাক ক্রস’ আছে।’

‘‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর কথা আপনি জানেন কি করে?’

‘জানা কি অসম্ভব?’

‘অসম্ভব নয়, কিন্তু ব্ল্যাক ক্রস-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে, এটা জানলেন কি করে?’

‘সেটাও কি জানা অসম্ভব?’

‘অসম্ভব নয়, কিন্তু একটু অস্বাভাবিক বৈকি! এটা খুবই গোপন ব্যাপার।’

‘দেখুন, আপনাদের কোন আঁতাত, কোন ষড়যন্ত্রই গোপন নেই।’

‘তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি… আপনি কে?’

‘সময়ে সবই জানতে পারবেন।’ কথা শেষ করে আহমদ মুসা সামনের দিকে মনোযোগ দিল। এবং মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমরা জন স্টিফেনের চিঠি নিয়ে ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করতে গিয়ে কি ধরনের আতিথ্য পেলাম, তা তোমরা কেউ লিখে ফেলো। ফাতেমা মুনেকার রিপোর্টের সাথে এটা যুক্ত করা যাবে।’

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকু আহমদ মুসা এবং ফ্রাসোয়ার মধ্যেকার কথাবার্তা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল। তাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে গেল, তাদের মেহমান আহমদ মুসা ‘কোক’, ‘ওকুয়া’দের জানে আগে থেকেই অনেক বেশি। এমনকি ‘ব্ল্যাক ক্রস’, যার নাম তারা শোনেনি, তাকেও আহমদ মুসা জানে। এসব নতুন করে জানার পর ফ্রাসোয়ার মত তাদের মনেও এ প্রশ্নটা খুব বড় হয়ে দেখা দিল, তাদের এই অতিথি আসলে কে? তাদের আরও মনে হলো, ক্যামেরুনের মুসলমানদের সাহায্যের জন্যে তারা ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’ নামে যে যুব সংগঠন গড়ে তুলেছে, তার জন্যে এ রকম একজনের নেতৃত্ব পেলে মুসলমানদের বাঁচানো যেত ‘ক্রস’–এর আগ্রাসন থেকে।

আহমদ মুসার কথা তাদের চিন্তায় ছেদ নামাল। তারা একটু নড়ে-চড়ে বলল, ‘ঠিক আছে ভাইয়া।’

তাদের এই উত্তর আহমদ মুসার কানে বোধ হয় পৌঁছল না। তার মনে তখন অন্য চিন্তা। ক্রস যে সংঘাত চাপিয়ে দিয়েছে ক্রিসেন্টের উপর, সে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অন্ধকার আফ্রিকায় কোন ইতিহাসের সৃষ্টি করবে! ইসলামের আলো আফ্রিকার অন্ধকার বুকে যে আলোর বন্যা সৃষ্টি করেছিল, তাকে কি আবার এবং আরও প্রোজ্জ্বলতর করে তোলা যাবে না!

সরদার আবুবকর বিগোভিট এর বৈঠকখানা।

কথা বলছিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী। ইমাম সাহেবকে উদ্ধারের কাহিনীটাই সে বলছিল। শুনছিল বসে তার আব্বা-আম্মা এবং বোন ফাতেমা মুনেকা।

এই কাহিনী ইয়েকিনী ইতোপূর্বে কয়েকবার বলেছে। কিন্তু শুনে যেন কারও তৃপ্তি নেই। স্বাদ যেন কাহিনীর বাড়ছেই। পিতার নির্দেশে তাই তাকে কাহিনীটা আবার বলতে হচ্ছে।

বিশাল বৈঠকখানাটি আজ সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। আজ সরদার আবুবকর বিগোভিট আহমদ মুসার সম্মানে এলাকার গণ্যমান্যদের দাওয়াত করেছে।

কেউ এসে এখনও পৌঁছায়নি। আহমদ মুসা গেছে হাসান ইকোকুকে সাথে নিয়ে এলাকাটা ঘুরে দেখতে। গত দু’দিন আহমদ মুসা শুধু বেড়িয়েই কাটিয়েছে। মুসলমানদের ঘরে ঘরে গেছে। বাচ্চাদের কোলে নিয়েছে। রোগীদের পাশে গিয়ে তাদের সান্ত্বনা দিয়েছে। কুন্তা কুম্বে এলাকায় একটা ভালো ক্লিনিক করার জন্যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এলাকাটা দেখে, এলাকার মুসলমানদের সাথে কথা বলে আহমদ মুসা মন্তব্য করেছে, ক্রস-এর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্যামেরুনে সংঘবদ্ধ যে প্রতিরোধ এতদিন হতে পারেনি, এখান থেকে তা শুরু হতে পারে।

‘কোক’-এর কাছ থেকে যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, তা দিয়ে একটা প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলার ব্যবস্থা আহমদ মুসা করেছে।

জন স্টিফেন, ফ্রাসোয়াসহ ‘কোক’দের যাদেরকে আটক করা হয়েছে, তাদের কুন্তা কুম্বে এলাকার অনেক উত্তরে একটা মুসলিম এলাকায় আটক রাখা হয়েছে। তাদের মাধ্যমে কোককে জানানো হয়েছে, চারটি শর্ত পূরণ করলে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু কতজন এবং কারা বন্দী আছে, সে কথা ‘কোক’কে জানতে দেয়া হয়নি। অন্যদিকে পুলিশকে বলা হয়েছে, আক্রমণকারী প্রায় সবাই মারা গেছে। এই সতর্কতার মাধ্যমে বাইরের প্রতিক্রিয়া এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে জন স্টিফেন ও ফ্রাসোয়াকে আরও চাপের মধ্যে ফেলা হয়েছে, যাতে তারা দাবি মেনে নিতে তৎপর হয়।

প্রথম শর্ত হলোঃ কুন্তা কুম্বে এলাকার যে জমিখণ্ড ‘কোক’ প্রতারণামূলকভাবে কিনে নিয়েছে এবং ইয়াউন্ডিগামী হাইওয়ের দক্ষিণে ইদেজা অঞ্চলের যে হাজার হাজার একর মুসলিম ভূমিখণ্ড ‘কোক’ গত পাঁচ বছরে জাল দলিল, জবরদস্তিমূলক ক্রয় এবং নানা প্রতারণার মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে, তা ফেরত দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্তঃ ইদেজা অঞ্চল থেকে গত পাঁচ বছরে উচ্ছেদকৃত মুসলমানদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে যাতে তারা আবার বাড়ি-ঘর তৈরি করে পুনর্বাসিত হতে পারে। তৃতীয় শর্তঃ প্রকৃত খ্রিস্টান মিশনারীরা তাদের কাজ চালাতে পারবে, কিন্তু সেবার নামে ষড়যন্ত্ররত সকল এনজিও-এর কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। এবং চতুর্থ শর্ত হলোঃ ‘কোক’কে তার অতীতের সকল দুষ্কর্ম স্বীকার করে লিখিতভাবে মুসলমানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। ‘কোক’ যতদিন এ শর্তগুলো পূরণ না করবে, ততদিন ‘কোক’-এর লোকদের আটক রাখা হবে।

সরদার আবুবকর বিগোভিট এবং তার পরিবারের সদস্যরা বৈঠকখানায় বসে মেহমানদের অপেক্ষা করছে এবং ইয়েকিনীর কাছ থেকে কাহিনী শুনছে ইমাম সাহেবকে উদ্ধারের।

কাহিনী শেষ করে থামল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

‘সেদিনের সে ভোর থেকে আজ পর্যন্ত আহমদ মুসা ভাইয়ার সবকিছুই আমার কাছে রূপকথা মনে হচ্ছে। আর তিনি যেন রূপকথার সর্বজয়ী এক রাজপুত্র।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘কিন্তু রাজপুত্রের রাজকন্যা তো নেই।’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

‘থাকবে না কেন, তার রূপকথার জগত তো আমরা দেখিনি, আমরা চিনি না।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘সত্যি বলেছিস মা, তার আমরা কিছুই চিনি না, কিছুই জানি না। মাঝে মাঝে আমার মনে কি হচ্ছে জানিস, ও আসলে ফেরেশতা। আল্লাহ পাঠিয়েছেন আমাদের মত অসহায়দের জন্যে। দেখ না, কি দুঃসময়ে সে নাযিল হয়েছে, আর কিভাবে সব ঘটনার মোড় আমাদের অনুকূলে ফিরিয়ে দিল।’ বলল সরদার আবুবকর বিগোভিট।

তার কথা শেষ না হতেই হেসে উঠেছিল ফাতেমা মুনেকা। তার আব্বা থামতেই সে বলল, ‘আব্বা তুমি মজার কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। আমি কালকে যাচ্ছিলাম স্কুলের দিকে। ‘মোকাচি’ চাচাজানের চার বছরের মেয়েটি ছুটে আমার কাছে এসে বলল, ‘ফেরেশতা কোথায়? আসেনি?’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘ফেরেশতা কোথায়? আসবে কোত্থেকে?’

‘ইশ, মিথ্যে বলছ। বল না।’

আমি বললাম, ‘বোকা মেয়ে। আমি ঠিক বলছি। ফেরেশতা কোত্থেকে আসবে?’

এই সময় চাচী মা এলেন। তিনি শুনছিলেন আমাদের কথা। হেসে বললেন, ‘আয়েশা ঠিকই বলেছে।’

‘কি ঠিক বলেছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘তুমি জান না? তোমাদের যে মেহমান, তাকে তো সবাই ফেরেশতা বলছে।’

‘কেন?’

‘এমন মানুষ হঠাৎ কোত্থেকে আসবে? আর এমন সময়ে? আল্লাহ তো ফেরেশতা পাঠান এভাবে।’

উত্তরে আমি কিছু বলিনি আব্বা। হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিলাম। এখন দেখছি, তুমিও একই কথা বলছ।’

‘ওদের কোন দোষ নেই, আমারও দোষ নেই। যখন কোন ঘটনার কোন বোধগম্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, তখন এভাবে একটা উত্তর যোগাড় করে নিতে হয়। তাছাড়া এভাবে ফেরেশতা তো আল্লাহ পাঠাতে পারেন মানুষের সাহায্যে।’

ফাতেমা মুনেকা গম্ভীর হলো। বলল, ‘ঠিকই বলেছ আব্বা, ব্যাখ্যা না পেয়েই আমি তাকে রূপকথার রাজপুত্র বলেছি। একইভাবে ফেরেশতাও তাকে বলা যেতে পারে। কিন্তু আসলেই উনি কে আব্বা?’

এই সময় বাইরে গলার শব্দ পাওয়া গেল।

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী তাড়াতাড়ি উঠে গেল। বাইরে একটু নজর বুলিয়ে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘ইমাম সাহেব এসেছেন।’

ফাতেমা মুনেকা এবং তার মা সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমরা পর্দার ওপাশে যাচ্ছি।’ বলে চলে গেল পর্দার ওপাশে।

বৈঠকখানার বিরাট হল ঘরের একটা অংশকে পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করা হয়েছে।

ইয়েকিনী ইমাম সাহেবকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

মধ্যবয়সী ইমাম সাহেবের নাম আলী উকেচুকু। সে লেখাপড়া করেছে নাইজেরিয়ার ঐতিহাসিক মুসলিম নগরী ‘কানো’র ‘আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ইমাম আলী উকেচুকু শুধু ইমামের দায়িত্বই পালন করেন না, এখানকার মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতাও করেন। সরদারের তিনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপদেষ্টারও দায়িত্ব পালন করেন।

ইমাম সাহেব বসলে সরদার ইমাম সাহেবকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি আসার আগের মুহূর্তে ফাতেমা মুনেকার প্রশ্ন ছিল, অলৌকিক মেধা ও বুদ্ধিসম্পন্ন আমাদের মেহমানের আসল পরিচয় কি?’

ইমাম আলী উকেচুকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে। বলল, ‘আমিও দু’দিন ধরে এ বিষয়টা ভেবেছি। আমি মনে হয় তাকে চিনতে পেরেছি সরদার।’

‘আপনি তাকে চিনতে পেরেছেন হুযুর?’ পর্দার ওপার থেকে বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘হ্যাঁ মা, আমি তাকে চিনতে পেরেছি। আমি এখানে আসার আগে টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গিয়ে গত বছর ‘কানো’র আন্তর্জাতিক সেমিনার থেকে যে কাগজপত্র এনেছিলাম, তা হাতে পড়ল। সে কাগজপত্র ঘাঁটার সময় যত্ন করে একটা এনভেলাপে তুলে রাখা ফটো পেয়ে গেলাম। ফটোটা ওখানকার দৈনিক থেকে কেটে নিয়েছিলাম। এই ফটোর দিকে নজর পড়ার সাথে সাথে সব কিছু মনে পড়ে গেছে আমার।’

‘ফটোটা কার?’ ইয়েকিনীর কণ্ঠে অধৈর্য্যের সুর।

‘এই ফটোটাই আমাদের মেহমান আহমদ মুসার।’

‘এতে আর কি হলো? কি বোঝা গেল?’ বলল ইয়েকিনী।

‘বলছি বাবা।’ বলে হাসল ইমাম সাহেব। তারপর একটু থামল। গম্ভীর হলো তার মুখ। বলল, ‘আসলে আমি বড় বোকা। মেহমানের নাম শুনে এবং তার কাজ দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল ইনি কে? কিন্তু আমি পারিনি। কারণ, নাম একইরকম হলেও বহু বিপ্লবের নায়ক, বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যে আমাদের এই কুন্তা কুম্বেয় আমাদের মাঝে আসবেন তা ভাবতেই পারিনি।’

ইমাম সাহেবের কথা শেষ না হতেই ইয়েকিনী ছিটকে উঠে দাঁড়াল এবং পর্দার ওপার থেকে ফাতেমা মুনেকা ছুটে বেরিয়ে এল মাথা ও গায়ের চাদর জড়িয়ে ধরে। বলল দু’জনেই, ‘হুযুর, এ আপনি কি বলছেন, ইনিই কি সেই আহমদ মুসা?’ তাদের দু’জনের চোখে-মুখে আকাশজোড়া বিস্ময় উপচে পড়ছে।

‘কোন আহমদ মুসার কথা বলছ? তোমরা চেন তাকে?’ বলল সরদার আবুবকর।

‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মক্কার রাবেতা জার্নালে তার সম্পর্কে পড়েছি। অন্যান্য কাগজেও পড়েছি। আব্বা, ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, বলকান, স্পেন প্রভৃতি বিপ্লব ও পরিবর্তনে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন।’

বৃদ্ধ আবুবকর বিগোভিট-এর চোখে-মুখে নেমে এল প্রথমে একরাশ বিস্ময়! তারপর সে বিস্ময়ের স্থানে ফুটে উঠল উজ্জ্বল এক আনন্দের দ্যুতি। বলল, ‘ঠিকই বলেছ তোমরা। যাকে ফেরেশতা ভেবেছি, তিনি ফেরেশতা না হলেও জগতের শ্রেষ্ঠ মুজাহিদ অবশ্যই হবেন।’

ইমাম আলী উকেচুকু পকেট থেকে খবরের কাগজ থেকে কেটে নেয়া একটি ছবি টেবিলে রাখল।

ইয়েকিনী ও ফাতেমা মুনেকা ঝুঁকে পড়ল ছবির উপর। সাদা শার্টের উপর কোট-টাই পরা একজন যুবক। ছবিটির নিচে ক্যাপশনঃ ‘আহমদ মুসা- গ্রেটেস্ট রিভ্যুলুশনারী অব দ্য এজ’।

ফাতেমা মুনেকা ছবিটি নিয়ে ছুটে তার পিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘দেখ আব্বা, আমাদের মেহমান। কোন পার্থক্য নেই। ইউরোপীয় পোশাক বাদ দিয়ে দেখ।’

বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ঘরের সবাই সেদিকে তাকাল।

ঘরে এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসা এবং হাসান ইকোকু। দরজায় পা দিয়েই আহমদ মুসা সালাম দিয়েছিল।

সালাম নিয়ে ফাতেমা মুনেকা ছুটল হাসান ইকোকুর দিকে। তার সামনে ছবিটি মেলে ধরল। ছবি ও ক্যাপশনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত হলো হাসান ইকোকুর। সে ছবি থেকে চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে অফুরান বিস্ময় ও শত জিজ্ঞাসা।

আহমদ মুসা তার এই পরিবর্তন দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল এবং ছবিটি নিল মুনেকার হাত থেকে। ছবির দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা সে বুঝল। হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।

কিন্তু সে তাকিয়ে দেখল, কারও মুখে হাসি নেই। শুধু তাই নয়, আহমদ মুসা ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সরদার আবুবকর, ইমাম আলী উকেচুকুসহ সবাই দাঁড়িয়ে গেছে এবং দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বিস্ময়-বিহ্বলতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আহমদ মুসা ছবিটা ফাতেমা মুনেকার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে চেয়ারে এসে বসল এবং সবাইকে বসতে অনুরোধ করে বলল, ‘বুঝতে পারছি, আমার পরিচয় আপনারা জেনে গেছেন। আমিও গোপন রাখতাম না।’

সবাই বসল। কিন্তু মুহাম্মাদ ইয়েকিনী ও হাসান ইকোকু আগে হলে যেভাবে কাছে এসে বসত, সেভাবে তারা বসল না। বসল দূরে গিয়ে।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ইয়েকিনী, হাসান ইকোকু, আমার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ার পর আমি কি পর হয়ে গেলাম, দূরে সরে গেলে এমন করে!’

কিন্তু তাদের মুখভাবের পরিবর্তন ঘটল না। তারা কথা বলল না। বলতে পারল না।

বিস্ময় ও সংকোচের জড়তা সবাইকে জড়িয়ে আছে।

অস্বস্তিকর নীরবতা ভাঙল সরদার আবুবকর। বলল, ‘কি বলব, কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। ইমাম সাহেবের কাছে ছবি দেখে আমরা আপনার পরিচয় জানতে পেরেছি। ইয়েকিনী ও ফাতেমাও আপনার সম্পর্কে অনেক পড়েছে শুনলাম। এত বড় অতিথি যে আমাদের মাঝে, বুঝতে পারিনি আমরা। কত যে বেআদবি হয়েছে আমাদের!’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর। তার দু’চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল দু’ফোঁটা অশ্রু।

আহমদ মুসা বৃদ্ধের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনি আমার পিতার মত। আপনি এভাবে কথা বললে আমি দুঃখ পাব। আমার প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন আমাকে খুব পীড়া দেয়। আপনাদের কাছে আমার পরিচয় না দেয়ার একটা বড় কারণ এটাই। আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়, আমি মুসলিম, আমি আপনাদের কারও সন্তান, কারও ভাই- এ পরিচয়কেই আমি সবচেয়ে ভালবাসি।’ আহমদ মুসার কথাগুলো খুব শান্ত, খুব ভারি শোনাল।

আহমদ মুসার হৃদয় নিঃসৃত কথাগুলো অন্তর স্পর্শ করল সকলের। এক আনন্দময় আবেগ ফুটে উঠল তাদের চোখে-মুখে।

কিন্তু কথা কেউ বলতে পারল না। এবারও বৃদ্ধ সরদারই মুখ খুলল। বলল, ‘আপনি কত বড়, একথাগুলোও তার প্রমাণ…’

কথা শেষ করতে পারলো না সরদার আবুবকর। বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ এবং অনেকের কণ্ঠ শোনা গেল।

বৃদ্ধ সরদার চোখ মুছে মুহাম্মাদ ইয়েকিনীকে বলল, ‘মেহমানদের নিয়ে এস, বসতে দাও।’

ফাতেমা মুনেকা উঠে চলে যাচ্ছিল পর্দার ওপারে মেয়েদের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায়। তার চোখের দুই কোণ অশ্রুসিক্ত।

‘ফাতেমা বোন।’ ডাকল আহমদ মুসা।

ফাতেমা থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে দাঁড়াল।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। ফাতেমা মুনেকার দিকে এক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘রিপোর্টের রেকর্ড সম্পূর্ণ করেছ?’

ফাতেমা মুনেকা চোখ তুলে তাকাতে পারল না আহমদ মুসার দিকে। মুখ নিচু রেখেই বলল, ‘জ্বি, সম্পূর্ণ করেছি।’ ফাতেমা মুনেকার কথা সংযত ও সম্ভ্রমপূর্ণ।

‘ইদেজার রিপোর্টও রেকর্ড করেছ?’

ফাতেমা মুনেকা আহমদ মুসার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘জ্বি, করেছি।’

‘ধন্যবাদ, ফাতেমা।’ বলে আহমদ মুসা তার চেয়ারে ফিরে এল।

ফাতেমা চলে গেল।

সব মেহমান আসার পর খাওয়ার আগে সরদার আবুবকর বিগোভিট আহমদ মুসার নতুন পরিচয় প্রকাশ করল সকলের কাছে। সকলেই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশি হলো। সকলে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে।

আহমদ মুসাও বর্তমান সংকটকালের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কিছু বলল।

খাবার শেষে সকলে চলে যাবার পর সরদার আবুবকরের বৈঠকখানায় বসে থাকল আহমদ মুসা, মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, হাসান ইকোকু, সরদার আবুবকর। পরে ফাতেমা মুনেকা এবং তার মা’ও এসে বসল।

এবার প্রথম কথা বলল হাসান ইকোকু। বলল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, ‘কিছু মনে করবেন না। মনে হচ্ছে, আপনি এক নিমেষে আকাশে উঠে গেছেন এবং আমরা মাটিতে রয়েছি। কিছুতেই যেন আপনার নাগাল পাচ্ছি না।’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা আমার দুর্ভাগ্য।’

‘তা মনে করতে পারেন। কিন্তু জাতির জন্যে এটা সৌভাগ্য।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘তাহলে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটাই আমার ভাগ্য?’

‘উপরে থাকাকে বিচ্ছিন্ন বলে না।’ বলল ইয়েকিনী।

‘আপনার সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে চাই।’ বলল হাসান ইকোকু।

‘কিছুই জানার নেই। বলেছি, আমার জন্ম মধ্য এশিয়ার সিংকিয়াং-এ। আর নাম তো আমার জানই। অন্য সব কথাই শুনেছ।’

আহমদ মুসা একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘জনাব, আজ আমি ইয়াউন্ডি যেতে চাই।’ সরদারকে উদ্দেশ্য করে বলল আহমদ মুসা।

সকলের মুখ ম্লান হয়ে গেল আহমদ মুসার একথায়। হঠাৎ পাল্টে গেল ঘরের পরিবেশ।

বৃদ্ধ সরদার দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘যাবেন? কেন? আজই? এদিকে যে সমস্যা থেকেই গেল?’

‘এত তাড়াতাড়ি কেন? নিশ্চয় অসন্তুষ্ট হয়েছেন?’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

‘না, আপনার যাওয়া হবে না। গত দু’দিন যিনি ছিলেন, তিনি প্রকৃত আহমদ মুসা নন। আজ আমরা প্রকৃত আহমদ মুসাকে পেলাম। কমপক্ষে দু’দিন থাকতে হবে।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।

হাসল আহমদ মুসা। সকলেই হাসল মুনেকার একথায়।

‘ফাতেমা বোন, যদি সব কথা জানতে, দু’দিন নয়, দু’ঘণ্টাও থাকতে বলতে পারতে না।’ একটু থামল আহমদ মুসা। টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেল। তারপর বলল, ‘যে ভোরে আমি এখানে এসেছি, সেই ভোরেই আমি ইয়াউন্ডি পৌঁছতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আযান শুনে নামায পড়তে এসে আটকে গেলাম। আল্লাহই এখানে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। এখানকার জরুরি কাজগুলো শেষ হয়েছে। আর দেরি করা যায় না।’

‘দেখুন, কত বড় ভুল আমাদের! আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, ক্যামেরুনে আসার আপনার উদ্দেশ্য কি? ইয়াউন্ডিতে কেন যাচ্ছিলেন?’ বলল সরদার আবুবকর।

‘ঠিক বলেছ আব্বা। এমন জিজ্ঞাসা আমাদের মনে জাগা উচিত ছিল। আমি আমেরিকান জার্নালের এক রিপোর্টে পড়েছিলামঃ ‘আহমদ মুসা ঝড়ের ডাকে ঝড় নিয়েই কোথাও যায়। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ইতিহাস।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘একদিক দিয়ে ঠিকই বলেছে ওরা। ঝড়ো পরিস্থিতিই আমাকে টেনে নিয়ে যায়, অথবা ঠেলে নিয়ে যায়। ক্যামেরুনে মুসলিম জাতিসত্তা বিলোপের যে ঝড় উঠেছে, ‘ক্রস’-এর আগ্রাসী বন্যা ‘ক্রিসেন্ট’কে ভাসিয়ে নেয়ার যে পরিস্থিতি- তা-ই আমাকে ক্যামেরুনে টেনে এনেছে।’

থামল আহমদ মুসা। সকলের চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।

গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। শুরু করল তার কথা আবার, ‘দু’জন লোককে ফ্রান্স থেকে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছে ক্যামেরুনে। মূলত তাদের উদ্ধারের জন্যেই আমি তাদের পেছনে পেছনে ছুটে এসেছি ক্যামেরুনে।

এই কিডন্যাপের পেছনে জড়িয়ে রয়েছে ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে মুসলিম উচ্ছেদের বিরাট এক কাহিনী। সমগ্র দক্ষিণ ক্যামেরুনের মত উপকূলীয় কাম্পু উপত্যকা থেকেও মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই কাম্পু ছিল দক্ষিণ ক্যামেরুনের সর্বশেষ মুসলিম বসতি। কিন্তু কাম্পু উপত্যকা থেকে সব মুসলিম পরিবার উচ্ছেদ হলেও দশ হাজার একরের একটা ভূখণ্ডের মালিক ওমর বায়া খ্রিস্টানদের ভয়, হুমকি, নির্যাতন কোন কিছুর কাছে নতি স্বীকার করেনি। তার আব্বাকে খুন করা হয়। যখন কাম্পু এলাকায় তার এক পরিবারের জন্যে বাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, সে পালিয়ে আসে উত্তর ক্যামেরুনের পশ্চিমাঞ্চলে। তবু সে জমি খ্রিস্টানদের দেয়নি। ‘কোক’-এর সন্ত্রাসবাদী সহযোগী সংগঠন ‘ওকুয়া’ ছুটে আসে ওমর বায়ার পেছনে পেছনে। তারা ওমর বায়াকে খুন করার জন্যে হামলা করে, ওমর বায়া প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হয়। কিন্তু খুন হয় তার মা। প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ওমর বায়া পালিয়ে যায় ফ্রান্সে। ‘ওকুয়া’ও ছুটে যায় ফ্রান্সে। ‘ব্ল্যাক ক্রস’-এর সাহায্য নিয়ে তারা চেষ্টা করে ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করতে।’

এইভাবে আহমদ মুসা কিভাবে এক হোটেলে ওমর বায়াকে বাঁচাতে গিয়ে তার সাথে আহমদ মুসার পরিচয় হয়, কিভাবে ব্ল্যাক ক্রস পরে ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করে, কিভাবে আহমদ মুসা তাকে উদ্ধার করে, কিভাবে ওমর বায়া আবার কিডন্যাপ হয় এবং তাকে কিভাবে কফিনে করে ক্যামেরুনে নিয়ে এসেছে, তার বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করে আহমদ মুসা বলল, ‘‘ব্ল্যাক ক্রস’ ও ‘ওকুয়া’ ক্যামেরুনের চীফ জাস্টিসের এক প্রিয়জনকেও কিডন্যাপ করে এনেছে। তাদের লক্ষ্য, তাকে পণবন্দী রেখে চীফ জাস্টিসকে বাধ্য করে ওমর বায়ার জমি তারা হস্তান্তর করে নেবে এবং তারপর ওমর বায়াকে খুন করে সব সমস্যার ইতি ঘটাবে।’

থামল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা থামলেও কেউ কোন কথা বলল না। সকলের বিস্ময় ও বেদনাপীড়িত দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। আর তাদের চোখে ভাসছে আহমদ মুসা বর্ণিত কাহিনীর দৃশ্যগুলো।

বেশ কিছু পর কথা বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, ‘আপনি এসেছেন, ‘ব্ল্যাক ক্রস’ এবং ‘ওকুয়া’ কি জানে?’

‘বোধ হয় জানে না। আমি মরে গেছি- এই ধারণা তারা নিশ্চয় এখনও পোষণ করে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘কেন?’ বলল হাসান ইকোকু।

‘ফ্রান্সের লা-ইল থেকে যখন তারা ওমর বায়াকে কিডন্যাপ করে, আমি তাদের পিছু নিয়েছিলাম। পথে এক জায়গায় ওরা আমার গাড়িতে বোমা হামলা চালায়। বোমা বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তে আমি গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হই। বোমা বিস্ফোরণে গাড়ি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আমি যখন পথের পাশে ঝোপের আড়ালে অবসাদগ্রস্তের মতো নির্জীব হয়ে পড়েছিলাম, তখন ওরা প্রজ্জ্বলিত গাড়ি দেখে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আমি গাড়ির সাথে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি।’

‘কিন্তু তারপরও তো ওদের সাথে আপনার সংঘাত হয়েছে?’

‘হয়েছে। কিন্তু সেটা যে আমি ছিলাম সেটা তারা সম্ভবত বোঝেনি।’

আহমদ মুসা থামলেও কেউ কথা বলল না।

ফাতেমা মুনেকা একটু পর বলল, ‘‘ব্ল্যাক ক্রস’ ও ‘ওকুয়া’ এখানে ‘কোক’-এর লোকদেরও সহায়তা পাবে। এদের মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে আপনি একা।’

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘শত্রু কত বড়, কত শক্তিশালী সেটা ভাবার সময় নয় এটা। আমি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমার লক্ষ্য আমার ভাইকে মুক্ত করা, শত্রুর ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা করা। সাফল্য-ব্যর্থতা আমার হাতে নয়, সে চিন্তাও আমার নেই।’

‘বাবা, এই আল্লাহ নির্ভরতাই আপনাকে জগতজোড়া নাম দিয়েছে, সাফল্য দিয়েছে। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।’

‘আমাদের একটি ছোট্ট সংগঠন আছে।’ বলল হাসান ইকোকু।

‘সংগঠন? কি নাম?’ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার।

‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট।’ বলল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী।

‘বাহ, সুন্দর নাম! কবে করেছ? কোথায় অফিস? কতজন সদস্য? কি উদ্দেশ্য?’ প্রশ্নের বান ডাকল আহমদ মুসার আনন্দিত মুখে।

‘ইয়াউন্ডির মুসলিম ছাত্র-যুবক মিলে আমরা করেছি। দুয়ালাসহ কয়েকটি শহরে আমরা শাখা করেছি। সব মিলে আমাদের সদস্য সংখ্যা এখন পাঁচশ’। ইয়াউন্ডিতে আমাদের মূল অফিস। আমাদের লক্ষ্য, মুসলমানদেরকে আর্থিক ও আইনগত সহায়তা দেয়া এবং তাদের পুনর্বাসনে সাহায্য করা।’

‘চমৎকার। তোমাদের নেতা কে?’

চট করে জবাব দিল মুহাম্মাদ ইয়েকিনী। বলল, ‘আমাদের হাসান ইকোকু সেক্রেটারি জেনারেল।’

মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর কথা শেষ না হতেই আহমদ মুসা উঠে গিয়ে হাসান ইকোকুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘মোবারকবাদ হাসান।’

লজ্জিত হাসান ইকোকু মাথা নত করে বলল, ‘দোয়া করবেন।’

বলেই হাসান ইকোকু ইয়েকিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিজের কথা বলেনি ও। ইয়েকিনী আমাদের সংগঠনের পরিকল্পনা সম্পাদক।’

আহমদ মুসা ইয়েকিনীকে কাছে টেনে নিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আসল পদটা তুমি পেয়েছ ইয়েকিনী।’

‘তোমাদের সভাপতি কে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।

‘গারুয়ার রাজপুত্র আবদুল্লাহ রাশিদি ইয়েসুগো। সেও ইয়াউন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’

‘‘গারুয়ার রাজপুত্র’ কথার অর্থ পরিষ্কার হলো না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘উত্তর ক্যামেরুনের মান্দারা পর্বতের দক্ষিণে নাইজেরিয়া ও চাদ-এর মাঝখানে বেনু নদী এবং বেনুর উপনদীগুলো দ্বারা বিধৌত বিশাল উপত্যকার নাম গারুয়া। এই গারুয়া উপত্যকার মাঝখানে বেনু নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত ‘গারুয়া’ নগরী। নাইজেরিয়ার ‘কানো’ যেমন নাইজেরিয়ার ঐতিহাসিক মুসলিম নগরী, তেমনি ‘গারুয়া’ ক্যামেরুনের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম শহর। এই শহর ছিল ‘গারুয়া’ উপত্যকা, লেক চাদ পর্যন্ত ক্যামেরুনের গোটা এলাকা এবং চাদ ও নাইজেরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত মুসলিম সালতানাতের রাজধানী। উনবিংশ শতকে ফরাসি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সময় ইয়েসুগো রাজবংশের মুসলিম শাসকের সাথে তাদের ঘোরতর যুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত ফরাসীরা তাদের স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নেয়। পরে ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রে ইয়েসুগো মুসলিম সালতানাতের অবলুপ্তি ঘটলেও ইয়েসুগো পরিবার উত্তর ক্যামেরুনের গারুয়া উপত্যকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। ভূখণ্ডগত সালতানাত তাদের না থাকলেও মানুষের মনের সালতানাতে তারা এখনও বাদশাহ। আবদুল্লাহ রাশিদি ইয়েসুগো গারুয়ার এই রাজবংশের সন্তান। ইতিহাসের ছাত্র সে। আপনার দেখা পেলে সে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত খুশি হবে।’ দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল ইয়েকিনী।

‘ইয়েকিনীর বর্ণনার মধ্যে উৎসাহ যেন একটু বেশিই ছিল, তাই না হাসান? তবে রক্ষা, রাজকন্যার বিবরণ আসেনি।’ মুখ টিপে হেসে বলল ফাতেমা মুনেকা।

মুহাম্মাদ ইয়েকিনীর মুখে লজ্জার একটা ছায়া নামল। তাদের আব্বা-আম্মা যেখানে বসেছিল সেদিকে এক পলক চেয়ে বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে ইয়েকিনী বলল, ‘চোরের সাক্ষী বানানো হচ্ছে গাঁইট কাটাকে। বলব তোদের দু’জনের কথা আহমদ মুসা ভাইকে?’

ইয়েকিনীদের আম্মা কিছু আগে ভেতরে গিয়েছিল এবং তাদের আব্বাও সম্ভবত উঠে গিয়েছিল টয়লেটে।

‘ক্ষেপছ কেন? আমি মিথ্যা বা খারাপ কিছু বলিনি।’ বলল ফাতেমা মুনেকা।

ইয়েকিনীর কথায় ফাতেমা মুনেকা ও হাসান ইকোকু দু’জনের মুখেই বিব্রতকর ভাব ফুটে উঠেছিল।

ইয়েকিনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, আহমদ মুসা তাকে বাঁধা দিয়ে হেসে বলল, ‘আমি জানি, তোমরা মিথ্যা কেউ বলনি। ফাতেমা ও হাসানকে আমি দেখছি। তাদের কথা না বললেও চলবে। ইয়েসুগো রাজকন্যার কথা আরেকদিন শুনব।’

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী, ফাতেমা মুনেকা, হাসান ইকোকু তিনজনের চোখে-মুখেই এক ঝলক লজ্জা নেমে এল। মুখ নিচু করেছিল তারা তিনজনেই।

কথা শেষ করে একটু থামল আহমদ মুসা। গম্ভীর হলো তার মুখ। বলল, ‘তোমাদের ‘ক্যামেরুন ক্রিসেন্ট’-এর কথা শুনে কি খুশি হয়েছি বোঝাতে পারবো না। আমি আফ্রিকার এ অঞ্চলের অন্ধকার বুকে একে আলোর সূর্য মনে করছি। ইয়াউন্ডি গিয়ে নিশ্চয় এ সংগঠনের সাথে আরও পরিচিত হতে পারব।’

‘ইনশাআল্লাহ।’ বলল ইয়েকিনী এবং হাসান দু’জনেই।

এ সময় সরদার আবুবকর বিগোভিট প্রবেশ করল বৈঠকখানায়।

আহমদ মুসা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘জনাব, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যাত্রা করতে চাই, আপনি অনুমতি দিন।’

‘এ কি বাবা! তুমি আমাদের সকলের সরদার। তুমি বিশ্বের মজলুম মুসলমানদের মাথার মণি। তুমি অনুমতি চাচ্ছ আমার কাছে! আর অপরাধী করো না বাবা।’ বৃদ্ধের শেষ কথাগুলো ভেঙ্গে পড়ল বুক উপচানো আবেগে।

একটু দম নিল। তারপর আবার শুরু করল, ‘অবশ্যই তুমি যাবে বাবা। সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান তোমার সময়। বিশেষ কাজেই আল্লাহ তোমাকে এখানে এনেছিলেন। কাজ না থাকলেও তুমি আমাদের দেখতে আসবে, এ আশা আমরা অবশ্যই করব।’

‘দোয়া করুন, এমন অবসর যেন আমার হয়। শান্তি যেন আসে সব দেশে, গোটা দুনিয়ায়।’

‘তুমি একা যাবে ইয়াউন্ডি?’

‘একাই এসেছিলাম, একা যেতে কোন অসুবিধা নেই। তবে কেউ সাথে গেলে খুশি হবো।’

‘কাকে সাথে নিতে চাও? বল?’

‘হাসান ইকোকুর এখানে প্রয়োজন আছে। ইয়েকিনীকে ছাড়তে পারেন কিনা।’

‘তুমি যাকে ইচ্ছা নিয়ে যাবে, জিজ্ঞাসার কোন প্রয়োজন নেই বাবা।’

আহমদ মুসা ইয়েকিনীর নাম করার সাথে সাথে ইয়েকিনী লাফিয়ে উঠেছিল ‘আল্লাহু আকবার’ বলে। ছুটে গিয়েছিল ফাতেমা মুনেকার কাছে। তার মাথায় একটা শক্ত টোকা দিয়ে বলেছিল, ‘কেমন এখন, দেখলি তো?’

‘এভাবে বলছ কেন? তোমার সাথে আমার প্রতিযোগিতা নাকি?’ বলল মুনেকা মুখ ভার করে।

বৃদ্ধ সরদার সস্নেহ হাসিতে বলল, আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি কিছু মনে করো না বাবা। পিঠাপিঠি এ দু’ভাই-বোনের গণ্ডগোল সব সময় লেগেই থাকে।’

‘মুনেকাই সব সময় লেগে থাকে আব্বা, আমি কিছু বলি না।’ বলল ইয়েকিনী।

‘আমি লেগে থাকি? আমার সব কথা, সব কাজে তুমি বাগড়া দাও।’ তীব্র প্রতিবাদ করে বলল ফাতেমা মুনেকা।

‘ধন্যবাদ ইয়েকিনী, ফাতেমা। ভাই-বোনের মধুর ঝগড়া আমার খুব ভাল লাগছে। সত্যি বলছি, আমার কাছে এ এক দুর্লভ দৃশ্য। আমার মত একা এক পৃথিবীর বাসিন্দা যারা তারা ছাড়া কেউ এটা বুঝবে না।’ হাসিমুখে কথাগুলো বলতে শুরু করেছিল আহমদ মুসা। কিন্তু যখন কথা শেষ করল, কণ্ঠ তখন প্রায় রুদ্ধ হয়ে এসেছিল তার।

আহমদ মুসার কণ্ঠস্বরে ফাতেমা মুনেকা, ইয়েকিনী, হাসান সকলেরই চেহারা হঠাৎ পাল্টে গিয়েছিল। তাদের মুখে ফুটে উঠেছিল একটা বেদনাময় বিস্ময়ের চিহ্ন।

পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘ইয়েকিনী, আমার সঙ্গী হওয়ার মধ্যে তুমি যেমন আনন্দ দেখছ, তেমনি নিরানন্দও আছে। আমার সাথী হওয়া মানে সাক্ষাৎ বিপদের সাথী হওয়া, মনে রেখ। ব্ল্যাক ক্রস ও ওকুয়া যখন জানবে, আমি বেঁচে আছি এবং ক্যামেরুনে এসেছি, তখন পাগল হয়ে উঠবে ওরা আমাকে ধরা অথবা মারার জন্যে।’

মুহাম্মাদ ইয়েকিনী উঠে আহমদ মুসার পায়ের কাছে এসে বসল। বলল, ‘আপনার সাথী হয়ে আমি আগুনেও ঝাঁপ দিতে পারব।’

আহমদ মুসা তাকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘আগুনে ঝাঁপ দেয়া নয়, আমরা জয়ী হয়ে গাজী হতে চাই।’

বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সময় বেশি নেই। তৈরি হতে হবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও ইয়েকিনী।’

ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসা ফাতেমা মুনেকাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘রিপোর্টের রেকর্ডগুলো আমাকে দিয়ে যাও, ফাতেমা।’

আহমদ মুসা হাঁটছিল গাড়ির দিকে। তার আগে আগে চলছিল ইয়েকিনী, বড় এক ব্যাগ হাতে।

আহমদ মুসার পাশাপাশি চলছিল ফাতেমা মুনেকা এবং হাসান ইকোকু।

কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিল তারা।

ফাতেমা মুনেকা বলল এক সময়, ‘ভাইয়া, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘কি কথা?’

‘দেখুন, আমরা মায়ের জাতি। ঘরই আমাদের পৃথিবী, ঘরই আমাদের সব।’

বলে একটু থামল ফাতেমা। একটু দ্বিধা করল। ঢোক গিলল একটা। তারপর বলল, ‘আপনি সেদিন বলেছিলেন, আপনার ঘর নেই, বাড়ি নেই এবং কেউ নেই। আজ আবার বললেন, এই পৃথিবীতে আপনি একা। কথাগুলো ভুলতে পারছি না। ঘর নেই কেন আপনার?’

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ওটা আমি কথার কথা বলেছি। ঘর থাকা খুব বড় কথা নয়। আমার একটা ঘর নেই, কিন্তু দুনিয়ার শত ঘর আমার ঘর হয়েছে।’

‘এসব কথা বলে প্রশ্ন পাশ কাটাতে পারেন, কিন্তু এক বোনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন না। ঘর নিজের একটাই হয়, শত ঘর নিজের ঘর হয় না ভাইয়া। এবং একটি ঘর থাকা মানুষের মৌলিক অধিকার।’ বলল ফাতেমা।

‘বোনের কথা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু ঘর থাকা বড় কথা নয়, ঘরে যিনি থাকবেন তিনি ঘরে থাকা বড় কথা। তিনি যদি ঘরে না থাকেন, ঘর আর ঘর থাকে না।’

‘ঘরে তিনি থাকবেন না কেন? ঘর ছাড়া জীবন হয় না।’

‘তোমার একথাও ঠিক বোন। কিন্তু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিছু লোককে যেমন প্রয়োজনে দেশ ছাড়তে হয়, তেমনি কিছু লোককে ঘর ছাড়তে হতে পারে।’

‘কিন্তু দেশ ছাড়া আর ঘর ছাড়া এক কথা নয়। দেশ ছাড়লেও ঘর সবারই থাকে। মানুষ ঘর ছাড়তে পারে না। কোন সময়ের জন্যে বা বহু সময়ের জন্যে কেউ ঘরে না থাকলেও ঘর থাকে, ঘরে আলো জ্বলে এবং একজোড়া বা দুইজোড়া কিংবা তারও বেশি চোখ ঘরে ফেরার পথ চেয়ে অপেক্ষার প্রহর গোনে।’

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ফাতেমা, তোমাকে আমি সাংবাদিক বানাতে চাচ্ছি। আমি আশাবাদী, তুমি ভাল লেখিকাও হবে।’

কিন্তু ফাতেমা হাসল না। বলল, ‘না ভাইয়া, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন।’

গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। দূর দিগন্তের দিকে চোখ তুলে চাইল। বলল ধীরে ধীরে, ‘সিংকিয়াং-এ তোমারই মত আর এক বোন নাছোড়বান্দা হয়ে একটা ঘর করে দিয়েছিল। কিন্তু সে ঘরের বাতি নিভে গেছে, প্রবল ঝড় সে ঘর উড়িয়ে নিয়েছে বোন।’ আহমদ মুসার কথাগুলো এত নরম, এত বেদনাসিক্ত যে তা ফাতেমা মুনেকা এবং হাসান ইকোকুর হৃদয়কেও আলোড়িত করল।

তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারলো না ফাতেমা। পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘সে কাহিনী এখনও আমরা জানি না ভাইয়া। তবে নিভে যাওয়া বাতি আবার জ্বলে উঠে, ভেঙ্গে যাওয়া ঘর আবার উঠে দাঁড়ায়, এটাই দুনিয়ার নিয়ম।’

‘আমি সে বাতি জ্বলে উঠার অপেক্ষা করছি না, তা বলতে পার না বোন।’

‘ধন্যবাদ ভাইয়া। জ্বলে উঠবে যে আলোকখণ্ড, তার সন্ধানও তো ভাইয়ার জানার কথা।’

‘সব কথা একদিনে শেষ করা ঠিক হবে না বোন।’ বলে হেসে উঠল আহমদ মুসা।

ইয়েকিনী গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল।

আহমদ মুসারা সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল।

আহমদ মুসার কথার উত্তরে ফাতেমা মুনেকা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ইয়েকিনী তাতে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, ফাতেমার কথার প্যাঁচে পড়লে এখানেই রাত কাবার হবে। আর বিপ্লব ছেড়ে সাহিত্যও করতে হতে পারে। ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিবেটে এক নাম্বার।’

‘দেখুন, সে গায়ে পড়ে আমার সাথে লাগছে। আমি তো তার সাথে কথা বলিনি। আব্বার কাছে তখন সে কি ভালটাই সাজল!’ তীব্র প্রতিবাদ করে বলল ফাতেমা মুনেকা।

সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ইয়েকিনী। আহমদ মুসা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজ থাক, একদিন আয়োজন করে তোমাদের দু’জনের ডিবেট শুনবো।’

বলে আহমদ মুসা ফাতেমার দিকে চেয়ে বলল, ‘ঠিক আছে বোন?’

‘ঠিক আছে। কিন্তু আসল কথাই ভাইয়ার না বলা থাকল।’ একটু হেসে ওড়নাটা কপালের উপর আরও টেনে দিতে দিতে বলল ফাতেমা।

‘ধৈর্য্যে পুরষ্কার ডাবল হয়।’ বলল আহমদ মুসা।

‘সেটা কি শোনার বদলে দেখা?’ আনন্দে নেচে উঠল ফাতেমার চোখ।

‘তা আমি বলতে পারব না।’ বলে হাসতে হাসতে আহমদ মুসা গাড়িতে উঠার জন্যে সেদিকে এগোলো।

ফাতেমা ও হাসান ইকোকুর কাছে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসা ও ইয়েকিনী গাড়িতে উঠল।

গাড়িটা ‘দুয়ালা’ থেকে আনা ‘কোক’-এর সেই জীপ।

আহমদ মুসা বসল ড্রাইভিং সিটে এবং তার পাশের সিটে বসল ইয়েকিনী।

‘বিসমিল্লাহ’ বলে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন অন করল আহমদ মুসা।

জেগে উঠল ইঞ্জিন। স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল গাড়ি।

পেছনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে ফাতেমা ও হাসান।

জবাবে ইয়েকিনী হাত নাড়ল গাড়ি থেকে।

ড্রাইভিং সিটে বসা আহমদ মুসার দৃষ্টি তখন সামনে- ইয়াউন্ডির দিকে। সে চোখে একটা স্বপ্ন, কুন্তা কুম্বেয় যে আলোর বীজ বপিত হলো তা যদি ইয়াউন্ডিতে প্রজ্জ্বলিত করা যায়, তাহলে সেটা আজকের অন্ধকার আফ্রিকার জন্যে হবে এক মহান সূর্যোদয়।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত