নিমানুষ

নিমানুষ

মাসুমকে দেখলে নিতান্তই গোবেচারা একজন মনে হয়। বয়স তার পঁচিশ পেরিয়ে গেছে কিন্তু ফরসা গোলগাল মুখে দাঁড়ি-গোঁফ খুব একটা উঠেনি। সব সময় ঢিলেঢালা হাফ হাতা শার্ট আর টাখনু পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা প্যান্ট পরা যুবকটাকে দেখলে কেউ চিন্তাও করতে পারবে না সে বর্তমানে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বেশি পেমেন্ট পাওয়া কিলার।

মাসুমের জন্ম কমলাপুর বস্তিতে। তার মা ভাল ফ্যমিলির মেয়ে ছিলেন, মাসুম তার মায়ের চেহারা পেয়েছে।কলেজ পড়ুয়া মা তার বখাটে বাবার হাত ধরে পালিয়ে আসেন । মাসুমের জন্মের সময়ই মারা যান তার মা। বয়স যখন তার ১২,তখন তার সামনেই তার বাপকে কুপিয়ে মারা হয়। সেই থেকে মাসুম এত বড় পৃথিবীতে পুরো একা। বস্তির দূষিত পরিবেশ আর বস্তির সবার অকথ্য নির্যাতনে মাসুম হয়ে উঠে নির্মম এক পিশাচ। তারপরও মাসুম সবার চেয়ে আলাদা।

কেউ কোনো দিন মাসুমকে হাসতে দেখেনি। মদ,ড্রাগ,গাঁজা দুরের কথা, জীবনে কোনোদিন সিগেরেটে একটা টান দেয়নি সে। খুবই সিম্পল থাকতে পছন্দ করে সে, ঢাকায় তার নামে বেনামে বেশ কিছু ফ্ল্যাট থাকলেও মোহাম্মদপুরের দিকে ছোট একটা একতলায় বাসায় একা থাকে সে। নারী সংঘটিত কোনো গুজব তার সম্পর্কে তার শত্রুও বলতে পারবে না।

মাসুম মাসের বেশির ভাগ সময় ফ্রি থাকে, একটা বা দুইটা কন্ট্রাক্ট পায় মাসে। মাঝে মাঝে টানা অনেক দিন হাতে কাজ থাকে না। তখন সেফ ডিপোজিটে হাত দিতে হয়।তবে এটা কোনো সমস্যা না। প্রায়ই আন্ডারওয়ার্ল্ডে বড় রকমের ঝামেলা লেগে যায়,তখন তার দম ফেলার টাইমই থাকে না।

ডিসেম্বরের শেষের দিকের কথা, শীত পড়তে শুরু করেছে। সকালের দিকে ভালই কুয়াশা থাকে। মাসুম পুরোপুরি নিজেকে ঘরের ভিতর বন্দি করে ফেলেছে, খেতেও যায় না বাইরে। কাছের এক হোটেলের সাথে মাস-কারবারী করে রেখেছে। দুইবেলা খাবার দিয়ে যায়। দুপুরের দিকে ঘুম ভাঙ্গে তার, হাতমুখ ধুয়ে শুরু করে মুভি দেখা। কোনো বাছাবাছি নাই তার। DVD এর দোকানে গিয়ে যত গুলো পছন্দ হয় কিনে আনে। হিন্দি,ইংলিশ সব দেখে সে।

সকালে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। স্ক্রীনে নাম্বারটা দেখেই ঘুম চটে যায় । অনেক পুরনো পার্টি। নিশ্চয়ই বড় কোনো ব্যাপার, নইলে তারা যোগাযোগ করতো না। খুশি হয় সে মনে মনে,হাতে ক্যাশ টাকা নাই বেশি। একটা ছোটো নোট বুকে লোকেশন, টার্গেটের বর্ণনা আর টাইমটা টুকে রাখে সে। ঐপাশ থেকে পেমেন্ট ডেলেভারির নতুন একাউন্ট নাম্বারটাও নেয়া হয়।

মাসুমের খুব প্রিয় অস্ত্র হলো ইতালীর তৈরী Beretta Cheetah,সাথে একটা সাপ্রেসর লাগিয়ে নিয়েছে। .32 ACP নিকেল কোটেট বুলেট ইউজ করে সে, খুব নিট-ক্লিন কাজ করে এটা। নির্বিকার মুখে টার্গেটের খুব কাছ থেকে শুট করা তার স্টাইল,সাপ্রেসরের কারণে টার্গেটের খুব কাছে কেউ থাকলেও কিছু টের পায় না প্রথমে।

মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থেকে খুব কাছেই একটা তিন তলা বাসার সামনে নিজের মোটর সাইকেলটা থেকে নামে মাসুম। গায়ে একটা কালো জেকেট তার। মাফলার আনেনি দেখে একটু আফসোস লাগছে। শীত মানছে না। রাত আটটা বাজে,মেইন রাস্তা থেকে বেশ ভেতরের দিকে এদিকটা শুনশান এখনই।

তিনতলায় কলিংবেলটা চেপে দরজার উপরে লিখা নামটার দিকে তাকায় সে। মোঃ লুৎফুর কবির,

একাউন্টেন্ট,বাংলাদেশ ব্যাংক। একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে,নামটা কেন যেন আগেও কোথাও শুনেছে, তার স্মৃতির খুব গোপন একটা কোথাও নামটা পরিচিত লাগছে। ভ্রু কুচকে মনে করার চেষ্টা করে সে। দরজা খোলার আওয়াজ পায় তখনই আর বিদ্যুৎ চমকের মত নামটা কার মনে পরে যায়।

দরজা খুলেছেন একজন পক্ককেশ পৌঢ়, চেহারাটা দেখে চমকে উঠে সে। যেন তার নিজের ৩০-৩৫ বছর পরের রূপটা দেখছে আয়নায়। লোকটিও কম অবাক হননি, হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মাসুমের দিকে। হঠাৎ জড়িয়ে ধরে লোকটি মাসুমকে। মাসুম কিছু বুঝতেপারছে না,তার মাথায় ঝড়ের মত চিন্তা খেলে যাচ্ছে। লোকটা মাসুমকে ছেড়ে তারপর তার চোখে মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে থাকেন,” আমি জানতাম তুই একদিন ঠিকই আমাদের খুঁজে বের করবি। আমি জানতাম…তোর হারামি বাপটাকে কত অনুরোধ করলাম…একটা বার তোকে যেন দেখতে দেয়…” কথা জড়িয়ে আসে লোকটার,মাসুমকে জড়িয়ে ধরেই ঘরের ভেতরে নিয়ে যেতে থাকেন। ঘরের ভেতর তখন হুলস্থুল শুরু হয়ে গেছে,মাসুম হঠাৎ নিজেকে প্রায় আট-দশ জনএকেবারেই অপরিচিত নারীপুরুষের আগ্রহের মধ্যমণি হিসেবে আবিষ্কার করে। সবাই ই বকবক করছে, কে যে কি বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

আর যাই হোক মাসুমের মাথা খুব ঠান্ডা। সে বুঝতে পারছে,ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সে তার জন্মদাতা মা’র পিতা অর্থাৎ তার নানাকেই খুনকরার দায়িত্ব পেয়েছে। এখন সে যদি মিশন এবর্ট করে তাহলে কি হবে? মোল্লা কুতুব আলী কোনো ব্যাখ্যা শুনবেন না। অন্য এক এস্যাসিনকে পাঠায় দেয়া হবে তার নানার জন্য, আরেকটা আসবে তার জন্য। এসকল ক্ষেত্রে কোনো কন্সিডারেশন নেই এই জগতে।

আরাম করে রাতের খাবার খায় মাসুম সবার সাথে বসে। তারপর তার নানা কেডেকে নেয় বারান্দায়। থ্যাপ করে ভোঁতা একটা শব্দ হয়, কেউ খেয়াল করে না সেটা। তার কিছুক্ষণ পর নিচথেকে একটা মোটর সাইকেল স্টার্ট নেয়ার আওয়াজ পাওয়া যায়।

শীতের রাতে উত্তরের শীতল বাতাস মাসুমের চোখ মুখ কেটে বের হয়ে যাচ্ছে। হু হু করে খালি হাইওয়েতে ছুটে চলতে চলতে মাসুমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে, না,সে মানুষ নয়। অমানুষের কোনো আপন জন থাকে না,তারা কেবল বেঁচে থাকে। তাকেও বেঁচে থাকতে হবে। গত পঁচিশটি বছর সে একা থাকতে পেরেছে, বাকি জীবনটাও সে একা কাটিয়ে দিতে পারবে।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত