দ্য লস্ট মিরর অফ অ্যালড্যারিন

দ্য লস্ট মিরর অফ অ্যালড্যারিন

পাতালপুরীর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খুব দ্রুত সামনের দিকে দৌড়াচ্ছে এক এলফ উইজার্ড। ডান হাতে তলোয়ার আর বাম হাতে শক্ত করে ম্যাজিক স্টাফটা ধরা। মাথার সাদা-সাদা লম্বা চুলগুলো ঘাড়ের দুপাশে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। ওর নাম এগেনগ।

এই অন্ধকার পাতালপুরী এক সময় ছিল গবলিনদের আবাসস্থল। সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তারা এই পাতালপুরীতে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছিল, এই জায়গাটাকে সাজিয়েছিল সুন্দর করে। এভাবেই তারা এখানে গড়ে তুলেছিল তাদের বিশাল কিংডম। কিন্তু গুহাটার চারপাশে এখন শুধু হাজার হাজার বছর আগের স্মৃতিই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। সেই গবলিনরা এখন আর নেই। অনেক আগেই তারা রহস্যজনকভাবে নেই হয়ে গিয়েছিল। আজো কেউ জানে যে কিভাবে এবং কেন সেই গবলিনরা অদৃশ্য হয়ে গেল। কেউ মনে করে, যে ডোয়ার্ফরা এই গুহাটার বাইরের অঞ্চলে থাকে, তারাই ওদের হত্যা করে এই অংশটা জয় করে নিয়েছিল। কেউবা মনে করে যে ওদের রহস্যজনক অন্তর্ধানের জন্যে ওরা নিজেরাই দায়ী। ওরাই নিজেরা নিজেদের সাথে মারামারি করে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই তত্ত্বটা অনেকেই বিশ্বাস করে, কারণ, গবলিনরা খুবই ঝগড়াটে আর হিংস্র স্বভাবের হয়। কথায় কথায় মারামারি না করলে ওদের চলেই না। তাই স্বাভাবিকভাবেই ২য় থিওরিটা বিশ্বাস করার মত লোকের অভাব নেই। তবে বেশিরভাগ লোকই অন্য একটা তত্ত্বে বিশ্বাস করে। আর সেটা হচ্ছে, এই জায়গাটার বর্তমান অধিবাসীই ঐ গবলিনদেরকে হত্যা করেছিল, পুড়িয়ে দিয়েছিল জ্বলন্ত আগুনে…এবং সে তারপর থেকে এখানেই বাস করছে…এখনও পর্যন্ত।

এগেনগ অবশ্য বিনা কারণে এমন ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় আসেনি। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে সে এখানে। আজ যে কাজটা ওকে দেয়া হয়েছে ওটাতে ওকে সফল হতেই হবে। যদি সে ব্যর্থ হয়, তাহলে ওদের পুরো জাতিই ম্যাপ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

হঠাত করেই একটা স্বর্গীয় সুর বেজে উঠল ওর কানে। সুমধুর সুরটা এলভেন ভাষায় ফিসফিস করে বলল, ‘টলো ড্যান ন্যান এন্নি আব টেলা হেইন, ইন্ড আল লি? (তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে তো, আসবে না, বলো?)…লি ভেস্টা (কথা দাও?)…আমিন ডার…(আমি তোমার অপেক্ষায় থাকলাম)…’

এগেনগ চাইছিল কণ্ঠস্বরটাকে নিশ্চিত করতে, চিৎকার করে বলতে, ‘তুমি চিন্তা করো না…আমি ফিরে আসবই…’ কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। কারণ, ওর চিৎকার সেই সুমধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারীর কাছে পৌঁছাবে না। সে এখন অনেক, অনেক দূরে। ওর কানে বেজে উঠা সুমধুর কণ্ঠস্বরটা স্রেফ একটা মায়া, একটা বিভ্রম, একটা স্মৃতি…সিয়েরার স্মৃতি। ঠিক এই কথাগুলোই ওকে বলেছিল সিয়েরা, বিদায় নেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে।

সিয়েরার চুলগুলো উজ্জ্বল সোনালি রঙের। সূর্যের আলো পড়লে জ্বলজ্বল করতো ওগুলো। দেখে মনে হত যেন পুরো মাথাটায় কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! ওর স্মিত হাসি সবার মনের দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারতো মুহূর্তের মাঝেই। ওর আলোকিত নীল চোখের অপার্থিব চাহনির পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবকেও বশ করে ফেলার ক্ষমতা ছিল।

সিয়েরা আর এগেনগ দুইজনেই যোদ্ধা। অনেক আগে থেকেই দুইজন একসাথে তাদের এলভেন মিলিটারিতে যুদ্ধ করে আসছে। সেখান থেকেই পরিচয়, এরপর প্রণয়, তারপর বিয়ে। এখানে আসার আগে থেকেই অনেক কান্নাকাটি করছিল সিয়েরা। বলছিল, এই সব যুদ্ধ বিগ্রহ ওর আর একদম ভালো লাগছে না। এসব থেকে নিস্তার চায় ও। এগেনগ ওকে বলেছিল, এই যুদ্ধটা শেষ হলেই ওকে আর ওদের একমাত্র সন্তান ক্যাসিয়াসকে নিয়ে অনেক অনেক দূরে চলে যাবে ও। দরকার হলে পাহাড়ের গুহায় থাকবে। তখন অন্তত সারাক্ষণ মৃত্যু ভয়ের ভেতর কাটাতে হবে না। আপনজন হারানোর আশঙ্কায় থাকতে হবে না। শুধু কালকের যুদ্ধটা যাক।

কোন এক অজানা কারণে গত কয়েক মাস ধরে টানা যুদ্ধ চলছে। প্রথমে হলো উইজার্ডদের সাথে। যুদ্ধে জিতলেও অসংখ্য এলফ মারা পড়েছিল তাতে। এরপরেই যুদ্ধ হল ট্রলদের সাথে। অনেক রক্তপাত হল সেখানেও। এখন যুদ্ধ বেধেছে ডোয়ার্ফদের সাথে। এসব হচ্ছেটা কি? গত তিনশ বছরে তো কোন যুদ্ধই হয়নি! তাহলে? হঠাত করে যুদ্ধ বিগ্রহ বেড়ে গেল কেন? কি সেই কারণ যার জন্যে শান্ত পৃথিবীটা হঠাত করেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো?

পেছন থেকে পাতালপুরী কাঁপানো গর্জন ধেয়ে এলো। খুব কাছে চলে এসেছে এই জায়গাটার বর্তমান অধিবাসী। ঘাড় ফিরিয়ে টানেলের শেষ প্রান্তে তাকাতেই এগেনগের চোখে পড়ল ওটাকে। একটা হিংস্র, ভীতিকর এবং দানবীয় ড্রাগন!

ওর চামড়ার রঙ রক্তের ন্যায় লাল। পেট বাদে শরীর বাকি অংশ শক্ত আঁশ এ আবৃত। চোখগুলো হলদেটে এবং বিশাল, চোখের মনি শিকারি প্রাণীর মত লম্বাটে। শক্ত স্পাইকগুলো গলা থেকে লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশাল আকারের ডানা দুটির মাথায় চারটে করে আঙ্গুল আছে, যেগুলোকে সে হাতের মত করে ব্যবহার করতে পারে। ওর লম্বাটে লেজটা সাপের মত এঁকে বেঁকে দেয়ালের গায়ে আঘাত করছিল…ক্রমাগত। প্রতিটা ধাক্কার সাথে দেয়াল থেকে চুন আর সিমেন্ট খসে পড়ছিল।

বিশাল দেহী লাল রঙের ড্রাগনটা খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে এগেনগের দিকে। ওটার বড়-বড় চোখগুলো দিয়ে ভয়ঙ্করভাবে তাকিয়ে আছে এগেনগের দিকে। লেজটা এদিক-ওদিক নড়ছে অলুক্ষুণে ভঙ্গিতে। বিরক্ত করায় খুব ক্ষেপে গেছে। মুখটা হা করল সে। ওর বড়-বড় সুতীক্ষ্ণ দাঁতগুলো যে কাউকে টুকরো-টুকরো করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। হঠাত করে ওর গলা থেকে শুরু করে পেটের নিচের দিকের অংশ পর্যন্ত অদ্ভুত উপায়ে জ্বলে উঠল। দেখে মনে হচ্ছে যেন পেটের ভেতর জ্বলন্ত ফার্নেস নিয়ে বসে আছে দানবটা।

মুহূর্তেই তীব্র আগুনের হল্কা বেরিয়ে এলো এগেনগের পেছন থেকে। সামনে থাকা সবকিছুকে নিমিষেই গোগ্রাসে গিলে ফেলে এগেনগকে তাড়া করতে লাগল উন্মাদের মত। চোখের পলকে এগেনগ নিজের হাতে থাকা ম্যাজিক স্টাফটা জামার ভেতর চালান করে দিল, তারপর তলোয়ারটাকে খাপে ঢুকিয়ে নিল। এরপর লাফ দিয়ে সামনে থাকা লোহার চেইনটা ধরে প্রাণপণে একটা ঝাঁকুনি দিল ওটাতে। বুলেটের বেগে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এগেনগ, দুই হাতে শক্ত করে চেইনটা ধরা। ওর পেছন পেছন ধেয়ে আসছে আগুনের ফোয়ারা। সামনে থাকা সবকিছুকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে ওটা।

পেছনের আগুন ওকে প্রায় ধরেই ফেলেছে। প্রচণ্ড উত্তাপে ওর শরীর জ্বলে যাচ্ছে…

সাথে-সাথে সুতোটাকে বাম দিকে একটা ঝাঁকুনি দিল এগেনগ। ওটা দিক পরিবর্তন করে বাম দিকে নিয়ে গেল ওকে। পেছনের আগুনের ফোয়ারা আর মাত্র এক ফুট দূরত্বে…আগুনের উত্তাপে মাথাটা মনে হচ্ছে যেন গলেই যাবে…ব্রেইন যেন টগবগ করে ফুটছে…

চোখের পলকে লাফ দিয়ে বাম পাশের প্যাসেজের ভেতর আড়াল হয়ে গেল এগেনগ। ঠিক এক সেকেন্ড পরেই দেখতে পেল প্যাসেজের সামনে দিয়ে তীব্র আগুনের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। প্যাসেজের দেয়ালের সামনের দিকের অংশ পুড়িয়ে দিল মুহূর্তের মাঝেই।

আগুনের ফোয়ারা থেমে যাওয়া মাত্রই ড্রাগনটার চিৎকার শোনা গেল। প্যাসেজের মুখে ওটার বড়-বড় লাল চোখগুলো দেখা গেল। প্যাসেজের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা। ওটাকে দেখতে পেয়েই এগেনগ বিদ্যুৎ গতিতে ম্যাজিক স্টাফটা বের করে মধ্য আকাশে ওটাকে দোলাল দুইবার। পরপর দুইটা নীল আলোর ব্লাস্ট বেরিয়ে এলো ওটার মুখ থেকে। সাথে-সাথে ড্রাগনটার মাথার উপর প্যাসেজের ছাদ ভেঙ্গে হুড়মুড় করে পড়তে শুরু করল। আর্তনাদ করে উঠল ড্রাগনটা।

সাথে-সাথে এগেনগ সোজা দৌড় লাগাল সামনের দিকে। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ড্রাগনটাও ওর পিছু নিয়েছে।

প্যাসেজের শেষ মাথায় থাকা বড় সিঁড়িটাতে উঠে গেল এগেনগ। এদিকে ওর পেছনে ড্রাগনটা তেতে উঠেছে। একের পর এক দেয়াল হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে ওর শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে, মুখ দিয়ে ক্রমাগত আগুনের হল্কা বের করছে সে। পুড়িয়ে দিচ্ছে সে সামনের সব কিছুকে। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে বারবার এগেনগের ম্যাজিক স্টাফের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে রুপালি আলোর শিল্ড।

‘আলো! আর বেশিদূরে নেই, ঐ তো গুহার মুখটা দেখা যাচ্ছে,’ মার্বেল পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে স্বগোক্তি করল এগেনগ। ড্রাগনটা সিঁড়ির নিচের ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। জ্বলজ্বলে চোখে এগেনগকে দেখে নিল একবার। এরপর আবার ওর শরীরটা জ্বলে উঠল অদ্ভুতভাবে। খোলা মুখটা দিয়ে আবারও স্রোতের মত বেরিয়ে এলো উত্তপ্ত আগুন। দৌড় লাগাল এগেনগ। আগুন ওকে প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছে। উত্তাপে ওর শরীর গলে যাচ্ছে মোমের মত…

এক লাফে গুহার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো এগেনগ। সাথে-সাথে গুহার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তীব্র আগুনের ফোয়ারা। পেছনের দিকে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে দৌড় লাগাল এগেনগ। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে পেছন দিকে ফিরল সে। ড্রাগনটা বেরিয়ে এসেছে। এগেনগকে দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। জ্বলজ্বলে চোখ দুটো দিয়ে ওকে দেখল কয়েক সেকেন্ড। এরপর তেড়ে এলো সামনের দিকে।

মুখে হাসি ফুটে উঠল এগেনগের। ‘কাম অন বিস্টি…’

হঠাত মাঝপথেই থমকে দাঁড়াল ড্রাগনটা। কিছু একটা যেন ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অবাক হয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আকাশের ও পাশটা অদ্ভুত রকম লাল হয়ে আছে। গাড় অন্ধকারের মাঝেও সেই রক্তের মত লাল রঙ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল, পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসছে বিশাল আকারের তিনটা গোলক…

ওয়াম…

অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিপদ টের পেতে যথেষ্ট দেরি করে ফেলেছে সে। তিনটা বিশাল লোহার বল সরাসরি ড্রাগনটার মাথায়, বুকে এবং পেটে আঘাত করল। মাথা ঘুরে গেল ড্রাগনটার। এরপর ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল। টের পেল ওর পায়ে এবং গলায় লোহার শেকল পরানো হচ্ছে।

পাহাড়ের গুহার প্রবেশ পথের বাইরে পূর্ব পাশে উঁচু জায়গার উপরে তিনটা সিজ উইপন রাখা আছে সমান্তরালে। প্রত্যেকটা সিজ উইপনের মাথায় একটা করে লম্বা চেইন লাগানো আছে। প্রতিটা চেইনের মাথায় একটা করে বিশাল আকৃতির লোহার বল সংযুক্ত আছে। এটা তাহলে একটা ফাঁদ ছিল! এলফটা তাহলে একা আসেনি! স্রেফ ওকে পথ দেখিয়ে ফাঁদের দিকে নিয়ে গেছে…মনে মনে ভাবল ড্রাগনটা। ওর আগেই বোঝা উচিত ছিল। তার মত বিশাল দানবকে কেন যেচে পড়ে একটা ছোট-খাট এলফ উত্ত্যক্ত করতে যাবে? নিজের বোকামির জন্যে মনে মনে নিজেকে গালি দিতে লাগল সে।

‘গোয়েন্না অ্যামলুগ! (তোমার মৃত্যু নিশ্চিত, ড্রাগন!) ভাবছ, আমরা আবার কে, তাইতো? আমরা উত্তরের এলফ সম্প্রদায়। আমাদের রাজ্যের উত্তরে ডোয়ার্ফদের সীমান্তের কাছাকাছি যেই গ্রামটাকে তুমি পুড়িয়ে দিয়েছ, তার প্রতিশোধ নিতেই আমরা এখানে এসেছি, বুঝলে? তোমাকে হত্যা করলে সে সব এলফদের আত্মা শান্তি পাবে,’ এগেনগ ড্রাগনটার কাছে মুখ এনে বলল। এগেনগের সঙ্গী সাথিরা সবাই তাদের বড়-বড় স্পিয়ারগুলো নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। এগেনগের হুকুম পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে ড্রাগনটার উপর।

ড্রাগনটার চোখ বড়-বড় হয়ে গেল। কি যেন ভাবল, এরপর মাথা নাড়াতে-নাড়াতে স্বগোক্তি করল, ‘আবার শুরু হয়েছে ব্যাপারটা, আবার শুরু হয়েছে…’ এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল ও। মৃত্যুর জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবতে লাগল এগেনগ। ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, ওর মনের একটা অংশ চাইছিল ড্রাগনটাকে এখুনি হত্যা করে এলফ হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আরেক অংশ চাইছিল ড্রাগনটার কথাটা শুনতে। কিছু একটা ব্যাপার আছে এখানে। ওটা না জেনে ওকে হত্যা করে ফেললে ব্যাপারটা কখনই জানা হবে না ওদের।

‘কি বলতে চাও তুমি?’ সঙ্গীদের ইশারায় চুপ থাকতে আদেশ দিয়ে ড্রাগনটাকে উদ্দেশ্য করে বলল এগেনগ।

‘আমি উত্তরের সেই এলফ গ্রামটাকে পোড়াইনি। অন্য কেউ পুড়িয়েছিল।’

‘মিথ্যুক!’ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে এগেনগ। ‘তুমিই উত্তরের গ্রামটাকে পুড়িয়ে দিয়েছিলে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শী কেউই জীবিত নেই, কারণ সবাইকে তুমি মেরে ফেলছ! কিন্তু এলফদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোন ধারনাই নেই, ড্রাগন। খুব শীঘ্রই আমরা জানতে পারলাম যে উত্তরের সেই গ্রামটার থেকে খানিকটা দূরে ডোয়ার্ফদের সীমানার ভেতরে এই প্রাচীন গুহায় একটা দানব থাকে। আর সেটা হচ্ছো, তুমি! একটা ফাউল, ফায়ার ব্রিদিং ড্রাগন! দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে সমস্যা হয়নি আমাদের। আমরা বুঝতে পারলাম যে তুমি, ডোয়ার্ফদের সাথে একত্রিত হয়ে আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছ। মজার ব্যাপার হচ্ছে কি জানো? ডোয়ার্ফরা ঠিক তার পরদিনই বার্তা পাঠাল যে তারা যুদ্ধ চায়, কারণ আমরা নাকি ওদের অনেকগুলো নিরীহ মহিলা এবং শিশুকে রাতের আঁধারে হত্যা করেছি! কত বড় জোচ্চোর! আমাদেরই লোক মেরে তোমরা আমাদের নামেই মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে যুদ্ধ বাঁধাতে চাইছ? অনেক সহ্য করেছি, আর না। তাই আমাদের রাজা, ডোয়ার্ফদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আগামীকাল যুদ্ধের ময়দানে দেখা হচ্ছে ডোয়ার্ফদের সাথে,’ এইটুকু বলেই শ্বাস ফেলার জন্যে একটু থামল এগেনগ। দ্রুত কথা বলার জন্যে হাঁপাচ্ছে ও।

‘কিন্তু আমরা বেশ ভালো করেই জানি যে তোমাকে ওরা যুদ্ধের ময়দানে আমাদের বিপক্ষে ব্যবহার করবে। আর যুদ্ধের ময়দানে তোমার মত জানোয়ারের হাতে হাজার হাজার এলফ মারা পড়তে পারে। আর তাই, আমাদের কয়েকজনকে রাতের আঁধারে এখানে পাঠানো হয়েছে তোমাকে আগেই হত্যা করার জন্যে,’ হিসহিস করে বলল এগেনগ।

‘আমি তোমাদের এলাকায় আক্রমণ করিনি,’ আবারো শান্ত স্বরে বলল ড্রাগনটা।

‘ও তাই? তাহলে কে করেছে এসব? বল?’ রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বলল এগেনগ।

‘ম্যালাস…’ ফিসফিসিয়ে বলল ড্রাগনটা।

‘কে?’ সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করল। এগেনগের সঙ্গী-সাথিরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এই নাম ওরা কখনোই শুনেনি।

‘প্রতি ৫ হাজার বছর পরপর পৃথিবীর বুকে আগমন ঘটে নরক থেকে উঠে আসা এক শয়তানের, ম্যালাস। সকল শয়তানের রাজা সে। ও আসা মাত্রই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের মনকে সন্দেহ দিয়ে ভরিয়ে তুলে, একের বিরুদ্ধে অন্যকে বিষিয়ে তোলে। প্রচণ্ড চালাক সে। এমনভাবে একজনের বিরুদ্ধে অন্যজনকে উসকিয়ে দেয় যে খুব দ্রুত অনেকগুলো রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধের সৃষ্টি হয়। লাখ লাখ এলফ, ডোয়ার্ফ, গবলিন, জাদুকর, মানুষ আর ট্রল মারা যায়। যত দিনে পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়, ততদিনে পৃথিবীর অর্ধেক প্রাণীই লাশ হয়ে যায়, বিলীন হয়ে যায় অনেক জাতি। যেমন এই গুহাটার কথাই ধরো। এখানে প্রায় ৫০০০ বছর আগে গবিলনদের বিশাল রাজত্ব ছিল। এরপর সে আসলো…ম্যালাস। ও আসা মাত্রই গবলিনগুলোর মাথার ভেতরে ঢুকে একের বিরুদ্ধে অন্যকে লেলিয়ে দিল। প্রচণ্ড ঘৃণা আর প্রতিহিংসার বীজ বপন করল। ফলস্বরূপ সিভিল ওয়ার শুরু হয়ে গেল, একে অন্যকে কাটতে লাগল বিনা কারণে। এরপর…একজনও বাঁচেনি। আর এভাবেই শেষ হয়ে গেল গবলিনদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কিংডম…’

‘তাহলে তুমি বলতে চাইছ, গত সপ্তাহের সেই আগুন তুমি লাগাওনি?’

‘না, এটা ম্যালাসের কাজ। তোমাদের কি একবারও মনে হয়নি, গত ছয় মাস ধরে প্রতিদিন, প্রতি রাত, পশ্চিম আকাশ কেন রক্তের ন্যায় লাল হয়ে থাকে? এটা ম্যালাসের রাজত্বেরই একটা চিহ্নস্বরূপ। এটাই দুনিয়াতে ওর বিচরণের সংকেত। যখনই তার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কেউ হত্যা করে, আকাশের গায়ের লাল আভা আরো গাড় হয়ে উঠে। এই লাল রঙ, রক্তপাতেরই প্রতীক। ও যতদিন থাকে, ততদিন পর্যন্ত এই চিহ্নটা আকাশের গায়েই লেগে থাকে। আর ওর রাজত্বের সময়কাল হচ্ছে ৬ মাস…বরাবর ৬ মাস। এর পরে, ওকে আবার ফিরে যেতে হয় এবিস (নরক) এ। আবার সে অপেক্ষা করতে থাকে ৫০০০ বছর পর্যন্ত। এটা একটা চক্র। যার কোন শেষ নেই…

‘কিন্তু সে নিজে আমাদের গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়ে তোমার উপর দায়টা চাপালো কেন? তোমাকে সে হত্যা করতে চায় কেন?’

‘কারণ…’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ড্রাগনটা, ‘একমাত্র ড্রাগনরাই ম্যালাসের আগমনী সংকেত ধরতে পারে, ওর পৃথিবীতে আসার পূর্ব লক্ষণ বুঝতে পারে। দুনিয়াতে ওর অস্তিত্বের গন্ধ পায় একমাত্র ড্রাগনরাই। আমি খুবই বোকা একটা প্রাণী। অনেক দীর্ঘ একটা ঘুম দিয়েছিলাম আমি…চক্রটার কথা মাথাতেই ছিল না আমার। হিসেবে গড়মিল হয়ে গিয়েছিল। আর তাই আমি ওর আগমনী সংকেত ধরতে পারিনি। এমনকি এই এক ঘণ্টা আগে তুমি যখন আমাকে আমার ঘুম থেকে জাগালে তখন আমি রাগে এতটাই দিশেহারা হয়ে ছিলাম যে আমি ম্যালাসের অস্তিত্ব ও অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু তোমার ধন্যবাদ প্রাপ্য, বন্ধু। তুমি আমাকে না জাগালে আমি জানতেই পারতাম না যে আগের চক্রটা একদম শেষ মুহূর্তে চলে এসেছে, ম্যালাসের আগমণ হয়েছে পৃথিবীতে।’

এই পর্যন্ত বলে একটু থামল ড্রাগনটা। ওর বুকটা উঠা নামা করছিল সজোরে।

‘আসলে, ওর সময় প্রায় শেষ। আর তাই সে মরিয়া হয়ে উঠেছে শেষ একটা মহাযুদ্ধ বাঁধাতে, লাখ লাখ নিরীহ প্রাণী হত্যা করার ব্যবস্থা করতে। সে একমাত্র ড্রাগন ছাড়া আর যেকোনো প্রাণীদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে, তাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। আর এভাবেই সে এলফ আর ডোয়ার্ফ, এই দুই জাতিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। আর, আমার বিরুদ্ধে সেই তোমাদেরকে উসকে দিয়েছে, কারণ আগেই বলেছি। সে ভেবেছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। শেষ একটা মহাযুদ্ধও বাঁধানো যাবে, আবার ওর জন্মগত শত্রুকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে। তাই সে চেয়েছিল নিজে আগুন লাগিয়ে দোষটা আমার ঘাড়ে দিয়ে দেবে, আমাকে হত্যা করাবে তোমাদেরকে দিয়ে। তাছাড়া পৃথিবীতে ওর আগমনই হয় ধ্বংস করার জন্যে, এটাই ওর একমাত্র কাজ। তাই সে নিজে ধ্বংসলীলা চালায় এবং প্রত্যেকবারই দোষটা চাপায় কোন নির্দোষ প্রাণীর উপরে।’

‘তাহলে তোমরা কখনো কাউকে বলোনি কেন? তোমরা তো থামাতে পারতে সেই যুদ্ধগুলোকে, লাখ লাখ প্রাণীর জীবন বাঁচাতে পারতে তোমরা,’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো এগেনগ। ড্রাগনটার কথা সে পুরোপুরি ফেলে দিতে পারছে না। ওর সঙ্গী সাথীরাও হাতের স্পিয়ারগুলো নামিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ড্রাগনটা।

‘পারতাম, আমার পূর্বপুরুষেরা চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। উল্টো ম্যালাস তার কৃতকর্মগুলোর দায়ভার আমাদের উপরই চাপিয়ে দিত। খুব সহজেই বিশ্বাস করত সবাই। কারণ, আমাদের আকৃতি এবং আমাদের গায়ের জোর, এ দুটোই আমাদের বিপক্ষে কথা বলত। আমরা চাইলেই পুরো দুনিয়াকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারি…বুঝতেই পারছ। আর এই জন্যেই কেউই আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি, উল্টো ম্যালাসের প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যা করেছে অসংখ্য ড্রাগন। এই কারণেই এখন পৃথিবীতে ড্রাগনদের সংখ্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এরপর থেকেই আমরা ড্রাগনরা শপথ নিয়েছিলাম যে, অনেক হয়েছে, আর নয়। আমরা আর এই পৃথিবীর কোন ব্যাপারেই মাথা ঘামাবো না।’

‘কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছিনা, ম্যালাস একটা শয়তান, ওকে দেখে কেউ চিনতে পারেনা কেন, সে কি শেইপ শিফটার, একজন মেটামরফ?’

‘না, ওকে কেউই চিনতে পারেনা কারণ, ম্যালাস এই দুনিয়াতে নিজের আসল রূপে ঘুরে বেড়াতে পারেনা। এখানে আসার আগেই তাকে একজন হোস্ট বেছে নিতে হয়, যার ভেতর সে আশ্রয় নেয়। সাধারণত একজন নিষ্পাপ মানুষকেই সে বেছে নেয়, কারণ সেই মানুষটাকে কেউই কখনো সন্দেহ করবে না। আর একবার যখন হোস্ট পেয়ে যায় তখন সে ছয় মাসের জন্যে পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি পেয়ে যায়। যে কারো মাথার ভেতর ঢুকে তার চিন্তাকে কলুষিত করে দেয়ার শক্তি পেয়ে যায়। এভাবেই প্রত্যেকের মাথায় ঢুকে সে হিংসা আর সন্দেহের বীজ বুনতে থাকে, একের বিরুদ্ধে অন্যকে লেলিয়ে দেয়।’

‘ওকে হত্যা করার কোন উপায়ই কি নেই?’ মরীয়া হয়ে জানতে চাইল এগেনগ।

‘না, সে অমর,’ শান্তভাবে বলল ড্রাগনটা।

‘তাহলে উপায়? একটা কিছু তো উপায় থাকবেই, নাকি?’ প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে বলল এগেনগ। রাগে-দুঃখে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ও।

‘মৃত্যু, একজন নিষ্পাপ প্রাণীর মৃত্যু,’ দুঃখিত স্বরে বলল ড্রাগনটা।

‘কি বলতে চাও?’

‘একমাত্র ওর হোস্টকে হত্যার মাধ্যমেই ওকে এই দুনিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব। আমি দুঃখিত, কিন্তু এছাড়া আসলেই আর কোন উপায় নেই,’ বিমর্ষ গলায় বলল ড্রাগনটা।

‘তুমি বলতে চাইছ, ওর হোস্টকে হত্যা করলেই তাকে চিরতরে নরকে ফেরত পাঠানো যাবে?’

‘না, শুধু মাত্র পাঁচ হাজার বছরের জন্যে, এরপর…সে আবার আসবে।’

‘এবার ওর হোস্ট কে? জানো তুমি?’ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল এগেনগ।

‘দুঃখিত, সেটা আমার জানার বাইরে।’

হতাশায় হাত দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগল এগেনগ।

‘তবে আমি জানি কিভাবে হোস্টকে খুঁজে বের করা সম্ভব,’ ড্রাগনটার হলদেটে চোখ দুটো জ্বলে উঠল।

এগেনগ মুখ তুলল। ‘কিভাবে?’

‘দ্য লস্ট মিরর অফ অ্যালড্যারিন, একমাত্র ওটাই বলতে পারবে হোস্ট কে, এবং তাকে কোথায় পাওয়া যাবে।’

এগেনগ দ্রুত ভাবছে। সময় বেশি নেই। এই আয়নাটা হাজার হাজার বছর ধরে এলফ, ডোয়ার্ফ, মানুষ, গবলিন সবাই খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু কেউই এর সন্ধান পায়নি আজ পর্যন্ত। এর নামই বলে দিচ্ছে এটা লস্ট, হারানো রেলিক। তাহলে?

‘তুমি জানো সেটা কোথায় আছে?’ এগেনগ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

ড্রাগনটার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। ‘আমার পিঠে চড়ে বসো।’

শিকল খুলে দেয়া হল ড্রাগনটার। আর সময় নষ্ট না করে সাথে-সাথেই এগেনগ এবং তার সঙ্গীরা ড্রাগনটার পিঠের উপর চড়ে বসল। দুপাশে বিশাল-বিশাল দুটো ডানা মেলে আকাশে উঠে গেল ওটা। ওদেরকে নিয়ে চলল অনেক দূরের এক মৃত আগ্নেয়গিরির দিকে। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা বারবার মুখে লাগছিল এগেনগের। কিন্তু সেটা নিয়ে ও চিন্তিত নয়। ওর চিন্তা একটাই। সত্য বলছে তো ড্রাগনটা?

***

লাফ দিয়ে ড্রাগনটার পিঠ থেকে নামল এগেনগ। সামনেই একটা ধ্বংসস্তূপ, যেখানে একটা গোলাকার বেদি দেখা যাচ্ছে। বেদিটা খুবই মূল্যবান চকচকে পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এরকম পাথর এগেনগ কখনোই দেখেনি। বেদির চারপাশে চারটা উঁচু পিলার। ডায়াসের মাঝখানে পাথরের তৈরি গোল একটা ফ্রেম। ফ্রেমটা সেই একই পাথর দিয়ে তৈরি। কিন্তু সমস্যা একটাই। ওখানে কোন আয়না নেই।

‘আয়নাটা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না কেন ওটাকে?’ সন্দেহ ভরা চোখে ড্রাগনটার দিকে তাকাল এগেনগ।

‘আয়নাটাকে হাজার হাজার বছর ধরে এলফ, ডোয়ার্ফ, উইজার্ড, মানুষ সবাই খুঁজেছে। কিন্তু কেউই খুঁজে পায়নি। সবাই এই জায়গাটায় এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছে। কেন জানো?’

এগেনগ মাথা নাড়ল। সে জানে না।

‘কারণ কারো কাছেই আয়নাটা ধরা দেয়নি…’

‘কেন?’

‘কারণ, এটা শুধুমাত্র তার কাছেই ধরা দেবে যে ম্যালাস এর দুনিয়াতে আসার ব্যাপারটাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করবে, এই আয়না ব্যবহার করে ম্যালাসকে দুনিয়া থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু যেহেতু আজ পর্যন্ত কেউই ম্যালাসের ব্যাপারটা বিশ্বাস করেনি, তাই কারও কাছেই আয়নাটা ধরা দেয়নি। যারা এতকাল ধরে আয়নাটা খুঁজে বেড়িয়েছে তারা কেউই আয়নাটার প্রকৃত ব্যবহার সম্পর্কে জানতো না। তারা ভাবতো, এটা এমন একটা অবজেক্ট, যা রহস্যময় ম্যাজিকেল শক্তিতে ভরপুর। সেই শক্তি তারা ব্যবহার করতে চাইতো নিজেদের স্বার্থে। আয়নাটার প্রকৃত উদ্দেশ্য তারা কখনোই জানতো না। আর তাই, আয়নাটা তাদের কারও কাছেই ধরা দেয়নি। সে কখনোই লোভী আর জোচ্চোরদের পছন্দ করেনা। আর তাই সে অপেক্ষা করে গেছে যুগের পর যুগ, একজন প্রকৃত প্রভুর আশায়…’

এগেনগের কাছে মনে হল ওর হার্ট যেন দুইটা বিট মিস করল। আয়নাটা যদি ওকেও লোভী হিসেবে ভেবে নেয়…

‘এখন আর সময় নষ্ট না করে বেদির উপরে গিয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসো,’ ড্রাগনটার গলা শুনতে পাওয়া গেল। এগেনগ ড্রাগনটার নির্দেশ মত বেদির উপর হাঁটু গেড়ে বসল।

‘নাও ক্লোজ ইউর আইজ…’ ড্রাগনটা ফিসফিসিয়ে বলল। এগেনগ চোখ বন্ধ করলো।

‘আয়নাটাকে ডাকো…’ ড্রাগনটার গলা যেন অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। ‘যদি তুমি এর যোগ্য হয়ে থাকো তাহলে সে তোমার কাছে অবশ্যই ধরা দেবে…’

মনে মনে আয়নাটার নাম ধরে ডাকল এগেনগ। সাথে-সাথেই সে যেন অদ্ভুত এক জগতে হারিয়ে গেল। ওর চারপাশে বিপুল পরিমাণ ম্যাজিকেল পাওয়ার স্রোতের মত বয়ে চলেছে। সেই ম্যাজিকেল পাওয়ারের কাছে ও কিছুই না। কানের কাছে কারা যেন অনবরত ফিসফিস করে কথা বলছে। যেন অনেকগুলো লোক একসাথে কোন একটা ব্যাপারে তর্ক করছে…একমত হওয়ার চেষ্টা করছে…

এগেনগ অদ্ভুত একটা রহস্যময় আওয়াজ শুনতে পেল ওর সামনে। ঠিক যেন জল তরঙ্গ বইছে। ম্যাজিকেল পাওয়ারের স্রোত ধারা বিলীন হয়ে গিয়েছে। ফিসফিস আওয়াজও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

‘চোখ খোল…তোমার পুরষ্কার গ্রহণ করো,’ ড্রাগনটা বলল। ওর গলাতে কোন অবাক হওয়ার ভাব নেই। যেন সে আগে থেকেই জানত যে এটাই হতে চলেছে।

খুব ধীরে-ধীরে চোখ খুলল এগেনগ। ফ্রেমটা এখন আর খালি নেই। সেখানে আছে একটি আয়না। ওটার গায়ের উপর জল তরঙ্গের মত মৃদু স্রোত বইছে। কিন্তু সেই আয়নায় কোন কিছুরই প্রতিচ্ছবি পড়ছে না।

ফ্রেমের গায়ে খুব প্রাচীন একটা ভাষায় লেখা, ‘ইন ডায়ির সিনেড্রিল নেড অ্যালড্যারিন।’ হলুদ আলো সহকারে জ্বলছে লেখাগুলো। হাজার বছর ধরে লুকিয়ে থাকা আয়নাটা অবশেষে ধরা দিয়েছে, যোগ্য ব্যক্তির কাছে।

যুদ্ধের ময়দানে নিজের সেরা বীরকে দেখতে না পেয়ে যথেষ্ট বিব্রত বোধ করছেন এলফ রাজা ইভানোভ। সবাই আশংকা প্রকাশ করে বলছে যে, এগেনগকে হয়তো ঐ ড্রাগনটা খেয়ে ফেলেছে। এখন হয়তো সেই গুহার ভেতর এগেনগ আর তার সঙ্গীদের অবশিষ্ট ছাই পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা নিয়ে ইভানোভও অনেক চিন্তিত। কিন্তু এখন অবশ্য এগেনগের কথা ভাবার মত সময়ও নেই উনার হাতে। ওকে ছাড়াই এখন যুদ্ধটা চালিয়ে নিতে হবে, যেভাবেই হোক।

দুই দলের সৈন্যরা জড়ো হয়েছে ‘আগার’ নামের যুদ্ধের ময়দানে। ‘আগার’ শব্দের অর্থ রক্ত। বাস্তবিক অর্থেই এই প্রান্তর একটু পর রক্তাক্ত হতে যাচ্ছে।

এলফ ব্যাটেল হর্ন বেজে উঠল পূর্ব পাশ থেকে। বহুদূরে পশ্চিম পাশ থেকেও ভেসে এলো একটা গম্ভীর হর্নের আওয়াজ। ডোয়ার্ফ ব্যাটেল হর্ন।

প্রচণ্ড আক্রোশে একে অন্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো এলফ এবং ডোয়ার্ফরা। ছিন্ন-ভিন্ন করে দিচ্ছে ওরা একে অপরকে। ২০ মিনিটের মাঝেই লাশের স্তূপ দাঁড়িয়ে গেল আগার এর ময়দানে। রক্তে আর বিচ্ছিন্ন মাংসে চারদিক সয়লাব হয়ে গেল।

এদিকে একের পর এক তলোয়ার দিয়ে শত্রুদেরকে কেটেই চলেছে সিয়েরা। কিন্তু ওর পুরো মনোযোগ যুদ্ধে নেই। এগেনগ গত রাতের পর আর ফিরে আসেনি। সবাই বলছিল, ওকে ড্রাগনটা শুকনো পাতার মত পুড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা ভাবতেই ওর গা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। না, এটা হতেই পারে না। এগেনগ মরতে পারে না। ও আসবে, ও তাকে কথা দিয়েছিল…কই, আজ পর্যন্ত কখনো কোন কথা রাখতে কি ব্যর্থ হয়েছে এগেনগ? তাহলে? ও ফিরে আসবেই, সিয়েরাকে দেয়া কথা তাকে রাখতেই হবে।

সিয়েরাকে যদিও কেউ জোর করেনি যুদ্ধে আসতে, কিন্তু এরপরও, তার কাছে সবার আগে কর্তব্যই বড়। আজ যুদ্ধে হেরে গেলে তাদের জন্যে আগামীকাল নামে আর কোন শব্দই থাকবে না। তাই নিজের জাতির জন্যে হোক, নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যে হোক, ওকে যুদ্ধে আসতেই হয়েছে। ওর পুরো জাতি যখন যুদ্ধে লিপ্ত, ও তখন কিভাবে নিজের বাসায় লুকিয়ে থাকতে পারে? আর তাই, ছোট্ট ক্যাসিয়াসকে তার দাদুর কাছে রেখে নিজে ঢাল তলোয়ার নিয়ে ময়দানে চলে এসেছে।

তিনজন ডোয়ার্ফ ওকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ওরা এগিয়ে আসছে তাদের ব্যাটল এক্স উঁচিয়ে। দু পাশের দুইজন আঘাত করার আগেই চোখের পলকে মাথা নিচু করে এক পা এগিয়ে দুই হাতে ধরা দুই তলোয়ার সপাটে চালিয়ে দিলো সামনের দিকে…

স্প্ল্যাঙ্ক…

লোহার আর্মারটা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে কোমর বরাবর কেটে গেল সামনে থাকা ডোয়ার্ফটার। মাথা নিচু করে ফেলার কারণে দু পাশের দুই জনের আঘাত থেকে বেঁচে গেছে সিয়েরা। ওরা আবার আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ক্ল্যাঙ্ক…

তলোয়ার দুটো বুকের উপর ক্রস অবস্থায় রেখে ডোয়ার্ফদের কুড়ালের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সিয়েরা। এরপর মাটিতে থাকা অবস্থাতেই সে ল্যাং মেরে ফেলে দিল বাম পাশের ডোয়ার্ফটাকে। এরপর উল্টো লাফ দিয়ে সোজা উঠে গেল ডান পাশের হতভম্ব ডোয়ার্ফ ওয়ারিয়রের মাথার উপর। সাথে-সাথে ওর হাতে থাকা দ্বি-ধার বিশিষ্ট একটি তলোয়ার বাট সহ ঢুকিয়ে দিল ডোয়ার্ফটার বুকে…যেখানে হৃৎপিণ্ড আছে, একদম সেইখানে।

‘তুই…তোর এত বড় সাহস,’ চেঁচিয়ে উঠল প্রথম ডোয়ার্ফটা। হাতের কুড়ালটা নিয়ে উন্মাদের মত ছুটে এলো সামনের দিকে। মধ্য আকাশেই অদ্ভুতভাবে শরীরটাকে মোচড় দিল সিয়েরা।

সুইশ…

ডোয়ার্ফ ওয়ারিয়রের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। এক সেকেন্ড পরেই সেখানে ধুপ করে এসে পড়ল ওর কাটা মুণ্ডু।

এ দৃশ্য দেখে আশেপাশের অন্তত ২০ জন ডোয়ার্ফ হিংস্র হয়ে উঠল। এই নৃশংসতার বদলা নিতে চায় তারা। ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। ডোয়ার্ফরা তাদের ব্যাটেল এক্স উঁচিয়ে তেড়ে এলো সিয়েরার দিকে। এতজনের সাথে তলোয়ার দিয়ে লড়তে পারবে না সিয়েরা। তাই তলোয়ারটা এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখে ওরা আরো কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল ও।

ওরা কাছাকাছি আসতেই ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা কপালে ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে অদ্ভুতভাবে বিড়বিড় করতে লাগল সিয়েরা।

বুম…

বিস্ফোরণের শব্দটা কয়েক মেইল দূর থেকেও শোনা গিয়েছিল। এর তীব্রতা এত বেশি ছিল যে ২০ জন ডোয়ার্ফ মধ্য আকাশে প্রায় ৫০ ফুট উড়ে গিয়ে একেক জন একেক দিকে পড়ল। সিয়েরা নিজেই হতবাক হয়ে গেছে। ম্যাজিক স্টাফ ছাড়াই বেশ কিছু ডিফেন্সিভ ম্যাজিক প্রয়োগ করার জন্মগত ক্ষমতা আছে ওর। কিন্তু আজকে ওর ম্যাজিকগুলো যেন অদম্য হয়ে উঠেছে। আসলে আজকে সে নিজেও সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশিই লড়াই করছে।

হঠাত আকাশ বাতাস কাঁপানো এক গর্জনে মাটিতে থাকা সমস্ত যোদ্ধা কানে আঙ্গুল দিল। মনে হচ্ছে যেন কানের পর্দা ফেটেই যাবে। বিশাল প্রান্তরে ধুলো উড়তে শুরু করছে। সেই ধুলোর ঘূর্ণির ভেতরেই ওরা দেখতে পেল বিশাল এক জোড়া পা।

যুদ্ধের ময়দানে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে বিশাল এক ড্রাগন। তার পিঠে এগেনগ এবং তার সঙ্গীরা! লাফ দিয়ে ড্রাগনের পিঠ থেকে নামল এগেনগ। ওর পেছন পেছন নামলো বাকিরা।

‘স্টপ!’ বিশাল প্রান্তরে ওর গলা ট্রাম্পেটের মত শুনালো। ওকে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। ওরা কেউই ভাবেনি এগেনগ আবার ফিরে আসবে। ভেবেছিল সে হয়তো মারা গেছে। কিন্তু একি…ওকে তো পাঠানো হয়েছিল ড্রাগনটাকে হত্যা করতে। আর সে কিনা ওটাকে হত্যা না করে উল্টো ওটার পিঠে চড়ে এখানে চলে এসেছে? ব্যাপারটা কি হচ্ছে?

‘বন্ধ করো এ অর্থহীন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের জন্যে না এলফরা দায়ী, না ডোয়ার্ফরা। তোমাদেরকে ভুল বোঝানো হয়েছে,’ আবারো চেঁচিয়ে উঠল এগেনগ।

‘কে ভুল বুঝিয়েছে আমাদের? আর তুমি এই ড্রাগনটাকে কোত্থেকে পেয়েছ? ওহ…অবশ্য আমি জিজ্ঞেস করছিই বা কেন। এইটুকু বোঝার মত ক্ষমতা আমার অবশ্যই আছে! একে আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে অসহায় ডোয়ার্ফদের রক্তে উৎসব করতে এসেছ, তাই না?’ ডোয়ার্ফ রাজা হারমেস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।

‘শাট আপ হারমেস! অসহায় তো ছিল আমাদের উত্তরের সেই গ্রামবাসীরা, যাদের পেছনে তুমি এই ড্রাগনটাকে লেলিয়ে দিয়েছিলে। সেই সাথে এও ভেবেছিলে যে আজকের যুদ্ধের ময়দানে দানবটাকে আমাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে,’ ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেল এলফ রাজা ইভানোভ এর মুখ। ‘লজ্জার ব্যাপার…তোমার ট্রাম্প কার্ড তোমার সাথে বেঈমানি করে তার আনুগত্য পরিবর্তন করে ফেলেছে…দেখতেই পারছো…এবার তোমার কি হবে হার্মেস?’

‘কী? আমি ড্রাগন লেলিয়ে দিয়েছি তোমাদের পেছনে? আমি?! মিথ্যুক! জোচ্চোর! আমারই মানুষ মেরে তুমি আমার বিরুদ্ধেই অপবাদ দিচ্ছ? তোমার সাহসের তারিফ করতে হয় ইভানোভ,’ চিৎকার করতে করতে বললেন কিং হারমেস।

‘এনাফ!’ ড্রাগনটা মেঘের মত গর্জন করে উঠল, ‘না আমি এলফ গ্রামটাকে পুড়িয়েছি, না এলফরা নিরীহ ডোয়ার্ফদেরকে হত্যা করেছে। ইটস এ গ্রেট ফ্যাট লাই! তোমাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে স্রেফ লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।’

ওর গর্জন শুনে পিন পতন নীরবতা নেমে এলো যুদ্ধের ময়দানে। ওটাকে ঘাঁটানোর মত সাহস কারোই নেই।

‘কি হচ্ছে এসব এগেনগ, কে এসবের জন্যে দায়ী? প্লিজ ব্যাখ্যা করো,’ ডোয়ার্ফ রাজা হারমেস যেন আকুতি জানালেন এগেনগের কাছে।

‘যে আমাদেরকে ভুল বুঝিয়েছে তার বাসস্থান পৃথিবী নয়, নরক! সেখান থেকেই উঠে এসেছে সে, আমাদের সবগুলো জাতির মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি করার জন্যে। গত ছয় মাসে যতগুলো অর্থহীন যুদ্ধ হয়েছে, সবগুলোর জন্যে সেই দায়ী,’ গলা ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠল এগেনগ।

‘কি সব গাঁজাখুরি কথা বলছ এগেনগ, তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’ বিরক্ত হয়ে বললেন এলফ রাজা ইভানোভ।

‘সব কিছু ব্যাখ্যা করার মত সময় আমার হাতে নেই। কিন্তু যদি তাকে দেখাতে পারি, সবার চোখের সামনে তাকে প্রকৃত রূপ ধারণ করতে বাধ্য করতে পারি, তাহলে আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন তো? ব্যাখ্যাটা আমি করবো ওকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে বাধ্য করার পর, তার আগে নয়,’ গর্জন করে উঠল এগেনগ।

সবাই চুপ করে রইলো। এগেনগের মত বীর যোদ্ধার কথা এত সহজে ফেলে দেওয়া যায়না।

‘ঠিক আছে এগেনগ, দেখাও। দেখাতে পারলে কথা দিচ্ছি, তোমার সব কথা আমরা মেনে নেবো, এবং আমি এই যুদ্ধ সাথে-সাথে বন্ধ করে দেব,’ লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললেন ডোয়ার্ফ রাজা হারমেস। উনার নিজেরও আজকে যুদ্ধে মন নেই। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে…

আকাশের দিকে তাকিয়ে দু হাত দুদিকে প্রসারিত করল এগেনগ, যেন সে উড়তে চলেছে পাখির মত। এরপর চোখ বন্ধ করে এলভেন ভাষায় বলল, ‘টল সি, ইন ডায়ির সিনেড্রিল নেড অ্যালড্যারিন…’

এগেনগের ঠিক সামনের জায়গায় মাঝারি আকারের একটা ঘূর্ণিবায়ুর সৃষ্টি হলো। ঠিক যেন বালুময় প্রান্তরে মেলস্ট্রোম শুরু হয়েছে। চোখে-মুখে ধুলো এসে ঢুকছে। সেই ধুলোর ঝড়ের মাঝে অনেক কষ্ট করে তাকিয়ে আছে এগেনগ। অপেক্ষা করে আছে, কিছু একটার জন্যে।

শূন্য থেকে সেই বালুর ঝড়ের কেন্দ্রে ধপাস করে কিছু একটা এসে পড়ল। ওটার গায়ে হালকা ঢেউ খেলছে। ফ্রেমে অনেক প্রাচীন ভাষায় লেখা, ‘ইন ডায়ির সিনেড্রিল নেড অ্যালড্যারিন।’

সবাই আয়নাটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে। নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে সবার। যুগের পর যুগ অনেকেই খুঁজেছে ওটাকে। কেউ কেউ তাদের পুরো জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে শুধু এর পেছনে ঘুরে। কত অজস্র লোকের জীবন নষ্ট হয়েছে এর কথা ভেবে ভেবে। হাজার হাজার বছর লুকিয়ে ছিল এটা…কারণ, সে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পায়নি, যার কাছে নিজেকে সে প্রকাশ করতে পারে…আজকের আগ পর্যন্ত…

অবশেষে আয়নাটা তার প্রকৃত প্রভুকে খুঁজে পেয়েছে।

এক দৃষ্টিতে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে রইলো এগেনগ। ওটাতে এখনো কোন প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে না। উল্টো আয়নার পৃষ্ঠদেশটা ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। ভাবতে না ভাবতেই আয়নাটাতে হালকা নীল আলো জ্বলে উঠল। এর অর্থ, ওদের শত্রু আশেপাশেই আছে। আয়নাটাকে যখন ও প্রথম খুঁজে পেয়েছিল তখনই ওটা ওকে জানিয়েছিল যে ম্যালাসের হোস্টকে কোথায় পাওয়া যাবে। আর আয়নাটার দেখানো পথ ধরেই ওরা এই যুদ্ধের ময়দানে এসেছে।

আর বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। ধীরে-ধীরে ধোঁয়াগুলো সরে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ধোঁয়াশা ভাবটা সরে যেতেই আয়নায় ভেসে উঠল একজনের প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু একি! এ কি করে সম্ভব! এ হতেই পারেনা! সে হয়তো ভুল দেখছে! আয়নাটা হয়তো মিথ্যা বলছে।

কিন্তু এগেনগ অনেক ভালো করেই জানে যে এই আয়না কখনোই মিথ্যা বলে না। শুধু সত্যকেই প্রতিফলিত করে। আর সেই সত্য, এখন দাঁড়িয়ে আছে ওর ঠিক পেছনেই। ঐ তো দেখা যাচ্ছে তার ভেতরের সেই কালো ছায়াকে, যা ওকেই হোস্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে। না, এখন ইমোশানাল হওয়ার সময় নয়, এখন কঠোর হওয়ার সময়। কারণ, এখন এগেনগের হাতে নির্ভর করছে পুরো পৃথিবীর ভাগ্য।

কোমরের লুকোনো ছুরিটা খাপ থেকে বের করল এগেনগ। হাত কাঁপছে ওর। পুরো শরীর বিদ্রোহ করছে। বলছে, না, এটা করতে পারো না তুমি…

এগেনগ ভয়ঙ্কর একটা আর্তনাদ করে বিদ্যুৎ বেগে পেছন দিকে ফিরে বাতাসে ছুঁড়ে দিল ছোরাটা। কয়েক মিলি সেকেন্ড এর ভেতরেই খচ করে একটা শব্দ হল, আর তারপরেই কেউ একজন তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল।

আশেপাশের সব এলফ এবং ডোয়ার্ফ মুখে হাত দিল। যা হচ্ছে, সেটা ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না।

পর মুহূর্তেই সবাই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করল। মাটিতে পড়ে থাকা দেহটার ভেতর থেকে প্রচণ্ড বেগে একটা কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এলো। অমানুষিক চিৎকার করতে লাগল সেটা। মাথার উপরের সারা আকাশ ঢেকে ফেলল সেই কালো ধোঁয়া। সৈন্যরা ভয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে। ঘোড়াগুলো ডাক দিতে দিতে পালিয়ে যাচ্ছে। এলফ আর ডোয়ার্ফদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। বজ্রের মত গলায় কিছু একটা হেসে উঠল।

‘আহহাহাহাহাহা…এগেনগ…আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, যে তুমি এটা করতে সাহস পাবে,’ গর্জন করে উঠল কালো ছায়াটা। ইতিমধ্যেই সে একটা অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে।

‘ইগো গ্রৌগ! ইগো এন ভান্ডা! (দূর হয়ে যা শয়তান! ফিরে যা তোর নরকে!) এখানে তোর সময় শেষ! চলে যা তুই, যেখান থেকে এসেছিস, সেখানে…’ চিৎকার করে উঠল এগেনগ।

‘কথাটা সত্যিই বলেছ এগেনগ,’ মেঘের গর্জনটা আবার বলল, ’আমার আপাতত এখানে সময় শেষ। কিন্তু মনে রেখ এগেনগ, আমি আবার আসবো। আর এরপর আমি, ম্যালাস, দ্য কিং অফ অল ডিমন’স, তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি যখন ফিরে আসব, তখন তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে খুব ভয়ঙ্কর শাস্তি উপহার দেব। তোমারই আজকের এই ধৃষ্টতার জন্যে শাস্তি ভোগ করবে বেচারারা। তাদের এমন দুর্দশা করবো, এমনভাবে অভিশপ্ত করবো, যে সবাই ঘৃণায় তাদের থেকে মুখ সরিয়ে নেবে।’

‘আমার উত্তরাধিকারীরা যেই থাকুক সেই সময়, সে অবশ্যই তোর ফাঁদে পা দেবে না। সে অবশ্যই তোর সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে তোকে আবার সেই নরকে ফেরত পাঠাবে, একবার নয়, দুই বার নয়, হাজার বার, যতবার তুই ফিরে আসবি, ততবার,’ গলা ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠল এগেনগ। রাগে ওর শরীর কাঁপছে।

‘ঠিক আছে এগেনগ। দেখা যাবে, কার কথা সত্য হয়…পাঁচ হাজার বছর পরে আবার দেখা হবে তোমার উত্তরাধিকারীদের সাথে, তখন, তাদেরকে আমার ক্রোধ থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। মনে রেখো, মাত্র পাঁচ হাজার বছর, পাঁচ হাজার বছর…’ বলতে বলতে ধোঁয়াটা তীব্র বেগে উপরের দিকে ধেয়ে গেল। অনেক অনেক উপরে উঠার পর প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হল, যার ফলে সৃষ্টি হল প্রকাণ্ড একটা ওয়েভ। পৃথিবীর সমস্ত বাড়ি, ঘর এবং গাছপালা কেঁপে উঠল।

এরপর…সব শান্ত, নিস্তব্ধ। চলে গেছে ওটা।

‘এগেনগ…’ খুব দুর্বল স্বরে কেউ একজন ডাকছে খুব কাছ থেকে। মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে ম্যালাসের সেই হতভাগ্য হোস্ট! এগেনগ দৌড়ে গিয়ে ওর মাথাটা কোলের উপর রাখল।

‘সিয়েরা, আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি তোমাকে দেয়া কথা রাখতে পারিনি। বলেছিলাম গোটা জীবন একসাথে থাকবো, পারিনি…বলেছিলাম, তোমার জন্যে নতুন এক পৃথিবী সৃষ্টি করবো, যেখানে তুমি, আমি আর আমাদের ক্যাসিয়াস থাকবো একসাথে, ভয়হীনভাবে জীবন-যাপন করবো আমাদের প্রশান্ত পৃথিবীতে…তাও পারিনি…উল্টো…নিজের হাতেই তোমাকে…’ আর বলতে পারল না এগেনগ। গলা ধরে এলো ওর। বহু কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখল ও। বীরদের চোখে জল মানায় না।

‘আমার বিন্দু মাত্রও আফসোস নেই এগেনগ। তুমি যা করেছো তা আজ থেকে হাজার হাজার বছর পরেও সবাই মনে রাখবে। ইতিহাসের পাতায় তুমি অমর হয়ে গেলে। সেই সাথে আমাকেও অমর করে দিলে। আমার কোন দুঃখ নেই যে এ পৃথিবীতে তোমার সাথে আর থাকা হচ্ছে না, সুখের মুহূর্তগুলো আর থাকছে না, যে রঙ্গিন স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম তা আর পূরণ হচ্ছে না, কিন্তু আমি সুখী এই ভেবে যে তুমি সামান্য ভালবাসার কাছে পুরো পৃথিবীকে বিকিয়ে দাওনি, বরং রক্ষা করেছো…এবং সেই জন্যে, আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করি, গর্ব করে যাবো সব সময়, যেখানেই থাকি…’ স্মিত হেসে বলল সিয়েরা। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

এগেনগ কিছুই বলতে পারলো না। সিয়েরার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। আর কখনোই দেখা হবে না সদা জ্বলতে থাকা ওই নীল চোখের মায়া কাড়া চাহনি…আর কখনো সেই আগুন ঝরানো সোনালী চুলগুলো বাতাসে দোল খাবে না। আর এই একাকী পৃথিবীতে সে সবচেয়ে বেশি মিস করবে কোনটা, জানা আছে কি কারো? ঐ ভুবন ভোলানো হাসি, যা আর কখনও কেউ দেবে না…

‘ভালো থেকো এগেনগ…আবার দেখা হবে, অন্য কোথাও, অন্য কোন রূপে…যতদিন পর্যন্ত না আবার দেখা হচ্ছে তোমার সাথে, ততদিন পর্যন্ত আমার হৃদয় কাঁদতেই থাকবে…নোভায়ির! গিউরেন নিনিয়েথা নি’ লু নি’ এ-গোভেনিথাম…’ এইটুকু বলার পরেই ধীরে ধীরে নীল চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল সিয়েরার। মারা গেছে ও।

বিশাল যুদ্ধের প্রান্তরে এক নিকষ কালো বিশাদের সুর বেজে উঠল।

ধুলো জমে যাওয়া বিশাল বড় বইটা ধুপ করে বন্ধ করে দিল অ্যারোসিয়াস। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তার কাজিন সারবেলাসের দিকে।

‘তুই এসব গাল গল্পে বিশ্বাস করিস?’ সারবেলাস জিজ্ঞেস করল। ওর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে… সিয়েরার পরিণতি সে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু দিন শেষে এটা তো শুধুই একটা গল্প, তাই না?

উত্তর দেয়ার আগে খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে নিল অ্যারোসিয়াস। এরপর ধীর পায়ে জানালার দিকে হেঁটে গিয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস যে করতেই হবে সারবেলাস। কারণ, এতক্ষণে তুইও হয়তো বুঝতে পেরেছিস যে…আমরাই হচ্ছি উত্তরের সেই লিজেন্ডারি এলফ ওয়ারিয়র এগেনগের প্রকৃত বংশধর।’

পশ্চিম আকাশটা অদ্ভুতভাবে লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

‘ও ফিরে এসেছে…হি ইজ ব্যাক…’ ফিসফিস করে বলল অ্যারোসিয়াস।

আরও একটি চক্র সমাপ্তির পথে। এই চক্রটি শেষ হওয়া মাত্রই আবার নতুন করে একটি চক্র শুরু হবে। ৫০০০ বছরের চক্র…যা কখনোই শেষ হয় না।

********************************************সমাপ্ত***************************************

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত