অঙ্কিত চিত্র

অঙ্কিত চিত্র

দো-হাড়া গড়ন। চিকন কটিদেশ। তাতে ঘন কালো দীর্ঘ চুলের আস্তরণ। রোদে পোড়া গায়ের রঙ। বাদামি। চওড়া কপাল, টিকলো নাক আর সহজ সরল দুটো চোখ। বড় বড়। ব্যতিক্রম শুধু চোখের মণিগুলো। নিকষ কালো আঁধারে ঢাকা। তাতে এক সাগর শীতল মায়া। সৃষ্টিকর্তা নিপুণ হাতে সৌন্দর্য্যের রঙ তুলি দিয়ে যাকে অনন্য করে তুলেছেন। নাম…’

(এক)

ধীর ধীরে চোখ মেলে তাকালাম আমি। ইচ্ছা করেই বন্ধ করেছিলাম। মনের গহীনে অঙ্কিত চিত্রটা আবারো দেখে নিলাম। সবার মনেই একটা অঙ্কিত চিত্র থাকে। হোক ছেলে কিংবা মেয়ে। সামনের মেয়েটার সাথে চিত্রটার মিল খুঁজছিলাম আমি। মনের গহীনে চিত্রটার অস্তিত্ব অনুভবের পর থেকে এমনটা প্রায়ই করি। অপরিচিত যে কোন মেয়ের সাথে। অন্তত একবার তো বটেই। কিন্তু সামনের মেয়েটার সাথে চিত্রটা ক’বার যে মিলেয়েছি মনে নেই। তবে, প্রতিবার আশ্চর্য্য জনক ভাবে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে।

ও এখন আমার সামনে বসা। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরে। আমরা বসে আছি জিয়া উদ্যানে। একটু পশ্চিম দিক ঘেঁষে। একটা গাছের নিচে। ঘাসের উপর। আমাদের চতুর্পাশে এমন অনেকেই বসা। প্রেমিক জুটি সবাই। কিন্তু ওসবে নজর নেই আমার। আমি তাকিয়ে আছি ওর চোখের দিকে। যেন শান্ত-শীতল দুটো নিকষ কালো টলটলে সমুদ্র। তবে ঝড় উঠতে পারে যখন তখন। যেমন ওদিন সন্ধায়…।

‘কি দেখ?’
আকস্মিক প্রশ্ন করল সে। আমি সরল গলায় উত্তর দিলাম,
‘তোমাকে।’
অবান্তর প্রশ্ন-উত্তর। কিন্তু লজ্জা পেল সে। সব প্রেমিকারা স্বভাবতই প্রশ্নটা করে এবং লজ্জা পায়। স্বাভাবিক। এটাই নারীর ভূষণ।

দ্রুত লজ্জাভাব কাটিয়ে আবারো বলল সে,
‘আমার মাঝে এমন কি দেখ?’
আমি ঘোরের মাঝে থেকেই বলি, ‘বর্ণনা দেখি, চিত্র আঁকি।’
‘তুমি ছবি আঁকতে পার নাকি!’ চোখ মুখ নাচিয়ে আগ্রহভরে জানতে চাইল ও।
‘নাহ।’ আমি ওর আগ্রহে পানি ঢেলে দেই।
‘তাহল কি কবিতা লেখ?’
আগ্রহ ধরে রাখার চেষ্টা করল ও। ‘নাহ।’ আমি আবারো ওর আগ্রহে পানি ঢালি। মন খারাপ করে ফেলল ও। প্রাকৃতিকভাবে মেয়েরা এ দুটোর প্রতি বেশ দূর্বল থাকে। এবার সে বিরস গলায় বলল,
‘তাহলে?’ আমি মুচকি হেসে বলি,
‘গল্প লেখি, কল্পনা করি।’

কিছুক্ষণ ঘাস ছিড়ল সে। এরপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি কি এভাবেই তাকিয়ে থাকবে?’ আমি চোখ না নামিয়ে মাথা নেড়ে বললাম,
‘হুমমম।’
এবার চোখ রাঙিয়ে ধমকের সুরে বলল সে, ‘চোখ সরাও, আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’

বিরক্ত হয়েছে নিশ্চই। মৃদুস্বরে ‘পাগল একটা’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। প্রেম করতে এসে কেউ চুপ করে বসে থাকে না। বরং তোতাপাখির মত বকবক করে যায়। কিন্তু এত কি বলব আমি? শব্দ ফুরিয়ে যায়, তাই এই চুপ করে তাকিয়ে থাকা। মোবাইলে কথা হলে না হয় চুপ করে ওর প্রতিটি শ্বাস শুনে যেতাম। এখন তো দেখা। মন ভরে দেখা। না দেখা প্রতিটা মূহুর্তের কাযা-কাফ্ফারা আদায় করা।

আশপাশের সবুজ শ্যামল গাছ-পালা, তরু-লতা আর নানা রঙের মানুষ দেখছে সে, কিন্তু আমি দেখছি ওকে। খালি পা। পায়ে নূপুর থাকলে ভালো হত কিংবা মেহেদি। না থাকুক, আবরণ এগুলো। সৌন্দর্য্যকে ঢেকে রাখে। সজীব ঘাসের উপর একের পর এক পা ফেলে আর কোমর অবধি চুলের ঢেউ তুলে ছন্দে ছন্দে ধীর পায়ে হাঁটে সে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখি। কবি হলে না হয় এই ছন্দে ছন্দে কবিতা সমগ্র রচনা করা যেত। তাতে কি? গল্প লিখব। দীর্ঘ বর্ণনা দিব এই রূপ সৌন্দর্য্যের। যে সৌন্দর্য্যের প্রথম দেখা পেয়েছি আমি প্রায় এক মাস আগে। দু’চোখ বন্ধ করে ফেলি আমি। চোখে ভেসে উঠে সে দিনের চিত্র…।

(দুই)

এক মাস আগে,
চোখ দুটো খোলার পর মূহুর্তে আবারো বন্ধ করে নিলাম। এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে আমার। জ্ঞান হারানোর কারণটা কিছুক্ষণ স্মৃতি হাতরে খুঁজে নিলাম এবং আবারো চোখ খুললাম। আমার চোখে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকা দুটো চোখের দেখা পেলাম। পরক্ষণে শীতল একটা শক খেলাম। এমন মায়াবী চোখের অস্তিত্ব সত্যই কি আছে? উত্তর না খুঁজে আমিও এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকরি শক্তি মায়া। এই মায়ার জালে এখন বন্দি আমি। হঠাত্‍ ওই চোখের মণিতে এক খণ্ড উল্কাপিণ্ডের আবির্ভাব হল। কারারুদ্ধ আমি। মুক্তি নেই। কিন্তু ভস্ম হবার আগেই ওই চোখের মালকিন মুক্তি দিল আমাকে। আমি অবাক হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। লজ্জা পেল সে। টিকলো নাকটা ফুলে উঠল সামান্য। মৃদু ঘাম জমল তাতে। গালটা সামান্য গোলাপী হয়ে উঠল। চোখে বিনম্র লজ্জা-রাগ। হঠাত্‍ কি যেন হল, দ্রুত পায়ে চলে গেল সে। আমি ওর গমন পথে তাকিয়ে রইলাম। মুখ ফুটে কেবল বেরিয়ে এলো, ‘তিতি? নেফারতিতি!’

শব্দ করে রুমে ঢুকলো মুবিব। আমার বন্ধু। শুভ্রতায় ঢাকা নিস্তব্ধ ফ্লোরে কেবল ওর জুতোর খটাশ খটাশ শব্দ। চোখ বন্ধ করে মনে মনে খিঁচ ঝাড়লাম আতমি। ওর এই বিদঘুঁটে শব্দের কারণেই মেয়েটি চলে গেছে! শোরগোলহীন প্রাইভেট হাসপাতালে সামান্য শব্দেই যেন বাজ পড়ে।

‘কিরে বেটা?’ নিকটে এসেই শব্দ করে বলে উঠল মুবিব,
‘রাস্তায় নামলেই নিজেকে হিরো ভাবিস নাকি?’
‘নারে দোস্ত,’ হতাশ গলায় বলি আমি, ‘আসলে বিকালে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। জাহাজ বাড়ীর কাছে আসতেই একটা প্রাইভেট কার কোত্থোকে এসে খোঁচা মেরে দিল।’ দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠে আমার, ‘বুঝতেই পারিনি।’
‘বুঝতে পারবিই বা কিভাবে?’ টিটকারির সুরে বলে মুবিব, ‘তখন কি নিয়ে মগ্ন ছিলি কে জানে!’

একটা চেয়ার টেনে এনে আমার পাশে বসে বলল, ‘তুই তো সব সময় আবার কল্পনার জগতে হাট বসাছ।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মুবিব। আমি চুপ করে থাকি। জানি, এখন কথা বললে নির্ঘাত মার খেতে হবে। তবুও আমি ওকে থামাতে বলি, ‘থাক দোস্ত…

কিন্তু মুবিব আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’সারাদিন এত্ত কি ভাবিস বলতো দেখি?’ আবারো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘টুকটাক লেখালেখি আমরাও তো করি তাইনা?’

আমি ওর কথা নিয়ে না ভেবে বরং ওর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভাবি। ওর বাবার দীর্ঘশ্বাসের কোন ফ্যক্টরী আছে কিনা আমার ঘোর সন্দেহ আছে। নচেত্‍ সারাদিন ওয় এত দীর্ঘশ্বাস পায় কই! এরপর ও চুপ করে থাকে। আমার ভাবনা শেষ হয় কিন্তু ও মন খারাপ করে বসে থাকে। আমি সান্ত্বনার সুরে বলি, ‘চিন্তা করিস না, আল্লায় যা করে ভালোর জন্যই করে।’

‘হ…’ রেগে যায় মুবিব,
‘আমি চিন্তা করুম নাতো তোর বাপে করবে!’ কথাটা বলেই ও বুঝতে পারে রাগের বশে কি বলে ফেলেছে ও। কিন্তু ‘গুলি আর বুলি’ বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসে না। তাই আমি বিষয়টা এড়িয়ে যাবার জন্য বলি,
‘দোস্ত, তোর ভাবীরে দেখে আয় যা।’
‘আমার ভাবী!’

হতভম্ব দেখায় ওকে। আমি একটু ভেবে ওকে বলি,’নাহ,তোর ভাবী না! আমার বউ’রে ভাবী বললে তুই খারাপ নজর দিবি! এরচে’ বরং ও তোর বোন আর তুই আমার একমাত্র শ্যালক।’ কথাটা বলেই হা হা হা করে হেসে উঠি আমি। হাসির চোটে মাথা ব্যাথাটা বেড়ে যায় আমার।

‘বালামার…’ খেঁকিয়ে উঠে মুবিব। ‘ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ কর।’
আমি বলি,’বিশ্বাস না হলে রিসিপশনে গিয়ে ‘তিতি’ নামটা বলে খোঁজ নে।’
এবার সিরিয়াস হয় মুবিব। চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাস করে, ‘কাহিনী কীরে?’
আমি মুচকি হেসে বললাম,’যা না আগে দেখে তো আয়।’

চলে গেল মুবিব। আর আমি ভাবতে থাকি শীতল সেই দু’চোখের কথা। মায়াবী সেই রূপের কথা। দু’চোখ বন্ধ করে মনের গহীনে লুকায়িত দীর্ঘদিনের অঙ্কিত চিত্রের সাথে মিলাতে থাকি। ‘…দো-হাড়া গড়ন। চিকন কটিদেশ। তাতে ঘন কালো দীর্ঘ চুল…’

(তিন)

আমার গা ঘেষে বসল নেফারতিতি। আমি ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলাম। এতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এসেছে ও। ওর নাম তিতি। নেফারতিতি নামটা আমার দেওয়া। তিতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করল,
‘তুমি কি ওই বিষয়টা নিয়ে ভেবছ?’
‘কোন বিষয়?’
‘এরই মাঝে ভুল মেরে দিলে!’
প্রশ্ন নয় যেন বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে তিতি। আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাই না বরং ভেবে যাই গতরাতের কথা।

এমনিতেই আমি ঘুমকাতুড়ে মানুষ। ভালোবাসি স্বপ্ন দেখতে। ঘুমন্ত স্বপ্ন। এই স্বপ্নরা গল্প লেখায় আমাকে ভীষণ সাহায্য করে। কিন্তু গতরাতটা নির্ঘুম কাটিয়েছি আমি। জেগে থাকার কারণ ছিল ‘তফাত্‍’। তিতির সাথে আমার তফাত্‍। এসব নিয়ে আমি কখনোই ভাবতাম না। যদি তিতি আমাকে বাধ্য না করত। তফাত্গুালো নিয়ে ভাবলাম, তিতি হলো সফল শিক্ষিত আমি হলাম ব্যর্থ্য শিক্ষিত। তিতি চাকুরীজীবী আমি ভবঘুরে। তিতি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আর আমার কোন বিত্ত নাই। তিতি পেটের দায়ে চাকুরী করে আমি ঘুরি-ফিরি। আরেকটা ডিফারেন্স আছে, ওর ভাষায় যেটা ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্ট- বয়স। তিতি নাকি আমার চেয়ে বড়। সংখ্যাটা অনেক। মেয়েদের বয়স নাকি বলতে নেই! ওর এই ভাবনা দেখে আমার ‘কুড়িতেই..’ প্রবাদ বাক্যটা মনে পড়ে। কিন্তু ওর মন খারাপ হবে ভেবে আমি বলি, ‘ভালবাসি তোমার সত্বাকে।’

মনে পড়ছে?’ আমাকে ভাবতে দেখে প্রশ্ন করে ও।
‘হুমমম।’ মাথা নাড়ি আমি।
‘কি সিদ্ধান্ত নিলে?’
ওর গলাটা কেমন যেন শুনালো। কিছুটা উত্কেণ্ঠা মিশানো। এতটা আশা করিনি আমি। অনেকক্ষণ ভেবে আমি বললাম,’আমার কোন সমস্যা নাই।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।

(চার)

উভয়ে বসে আছি। পাশাপাশি। নিশ্চুপ। কে কি ভাবছে কে জানে। একটা পিচ্চি ছেলে এগিয়ে এলো। ছন্নছাড়া। বাদাম বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করে। আমাকে চিনে। কাছে এসে বলল,
‘ভাই, বাদাম খাইবেন?’ আমি মুচকি হেসে বলি,
‘তোর আপারে জিজ্ঞাস কর।’
চোখ দুটো পিংপং বলের মত নাচায় ও। ওর নামটা জানা হয়নি। দাঁত কেলিয়ে হাসি দেয়। মেকি হাসি। নেফারতিতির হাসিটা নির্ঝর। প্রাঞ্জল। দশ টাকার বাদাম নেই আমি। দ্রুত প্রস্থান করে পিচ্চিটা। কিছুদূর গিয়ে ভীরু চোখে পিছনে ফিরে তাকায়। এখানকার হকাররা প্রেমিকের চেয়ে প্রেমিকাকে বেশি ভয় পায়। হয়ত আরো দুটো টাকা চাইত। কিন্তু আমার পকেট ফাঁকা। তিতি আমার হাত থেকে বাদামের প্যাকটা নিয়ে গেল। নিজে খাবেনা বরং আমাকে খোসা ছাড়িয়ে দিবে। তিতি বাহিরের কিছু খায় না। ওর হাত থেকে দুটো বাদাম নিয়ে চিবুতে লাগলাম আমি। এটাকে নাকি প্রেমের ট্যাবলেট বলে। প্রেম করতে এসে বাদাম না খেলে নাকি প্রেমটাই অপূর্ণ থেকে যায়! ফালতু বচন।

মন দিয়ে বাদাম চিবুচ্ছিলাম আমি। ও এক মনে খোসা ছড়াচ্ছিল। মনটা ভাল। টেনশন মুক্ত। কিন্তু তখনি বোমা ফাটলো তিতি।
‘আমি বিবাহিত…!’
মৃদু আওয়াজের ছোট্ট শব্দটা শুনে আমি বিষম খাই। দাঁতের ফাঁকে আর তালুতে আটকে যাওয়া বাদামের লাল আবরণের কথাও ভুলে যাই। চিত্কানর করে বলতে ইচ্ছে করছিল,’ধরণী দ্বিধা হও, আমি তোমার চরণে আত্মবলি দেই। কিছুক্ষণ পর আবারো ছোট্ট আওয়াজে তিতি বলল, ‘…ছিলাম।’

আমি থমকে যাওয়া নিশ্বাস ধীরে ধীরে ছেড়ে দেই। চুপ করে বসে থাকি। কিছু বলা উচিত। তিতি চোখ নামিয়ে রেখেছে। ঘাস ছিঁড়ছে নিঃশব্দে।

‘আর কিছু?’
প্রতিটি অক্ষর ধীর ধীরে উচ্চারণ করি আমি। বোধহয় এজন্যই ‘তফাত্‍’ এর উপর জোর দিয়েছিল তিতি।
‘না, তবে…।’
‘বলে ফেলো।’ আশ্বাস দেই আমি।
‘আমরা আগে বিয়ে করব এবং সেটা কালই।’
যেন ঘোষণা দেয় ও। কিন্তু আঁতকে উঠি আমি। উদ্বেগমাখা কণ্ঠে বলি, ‘বিয়ে! তাও কাল!’

কিছু বলেনা তিতি। ওকে এতটা সেকেলে ভাবিনি আমি। এখনকার ছেলে-মেয়ে কেউই তিন চার বছর প্রেম না করে বিয়ে করে না। মা-বাবা পছন্দের কাউকে এক নজর দেখে বিয়ে করা এখন ইতিহাস। যাক ওসব না ভেবে আমি ওকে জিজ্ঞাস করলাম,
‘এটাও কি আমার সাথে প্রেম করার পূর্বশর্তের একটা?’
কিছু না বলে মাথা নাড়ে তিতি। চিন্তায় পড়ে যাই আমি। যার রাত-দিন কাটে যাযাবরের বেশে, যেখানে রাত সেখানেই কাত এই যার নীতি- সে করবে বিয়ে! তাছাড়া প্রেম করা যতটা সোজা; বিয়ে করা ঠিক ততটাই প্যাঁরা। বোধহয় এইজন্যই জনৈক মহামানব বলেছিলেন, ‘পুরুষ দুই প্রকার- জীবিত ও বিবাহিত।’ তবুও আমি ওকে বুঝানোর জন্য বলি, ‘আমাকে কিছু সময় দাও। আগে কিছু ব্যবস্থা করে নেই।’
সাথে সাথেই উত্তর দেয় তিতি।
‘উহুঁ, তোমাকে ব্যবস্থা করতে হবে না।’
‘তাহলে…,’মেজাজ গরম হয়ে যায় আমার। চিত্কাছর করে খেঁকিয়ে উঠি, ‘তোমাকে বিয়ে করে কি আমি মাথায় নিয়ে ঘুরব?’

‘উহুঁ…।’ দ্রুত উত্তর দেয় তিতি,’কিছুই করতে হবে না তোমাকে। প্রেম করলে আমরা যেমন থাকতাম তেমনিই থাকব।’ ‘মানে কী?’ মেজাজ চড়তে থাকে আমার, ‘বিয়ে করব আবার প্রেম করার মত করে থাকব!’
‘বুঝ নাই?’ ব্যাখ্যা দেয় তিতি,’মানে আমরা বিয়ে করব এটা কেউ জানবে না।’ এবার চুড়ান্ত রাগটা ঝেড়ে দেই আমি, ‘প্রেম করার মাঝে এসব বিষয় আসছে কেন তিতি?’ কিন্তু কিছু বলে না ও। চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটা নির্ভেজাল উত্তর দেয়, ‘জানি না!’
আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কি বলব ভেবে কূল পাই না। বোধহয় একেই বলে ‘ভালবাসার অত্যাচার!’

আমি উঠে দাঁড়াই। আর ভালো লাগছিল না। আমাদের সম্পর্কগুলো বড় বেশি অদ্ভুত। মাঝে মাঝে এরা এমন স্থানে এসে দাঁড়ায় ; যেটা কাম্য ছিলো না কারোরই। তখন আমরা সম্পর্ক’কে অনেক কিছু বলতে চাই। কিন্তু বলার ভাষা খুঁজে পাই না। মনেপ্রাণে কামনা করি এই মূহুর্তের কথা ভুলে গিয়ে ভালো কোন মূহুর্তে ফিরে যাই। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না। সময় বয়ে যায় আর অব্যক্ত দুই ‘কিন্তু’র কষাঘাতে সম্পর্ক’রা ভেঙে যায়।

তিতি নেই। আমাকে ভাবতে দেখে চলে গেছে। উঠে যাওয়ার আগে ওকে বলেছিলাম, ‘আমি রাতে একটু ভেবে দেখি।’ এরপর কিছু না বলে তিতি চলে গেছে। আমি হাঁটতে থাকি ধীর পায়ে। গাছ-পালা দেখি। অন্ধকার ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে নিচ্ছে। শীতল বাতাস। বিষণ্ণ আকাশ। আমার মনটাও বিষণ্ণ। পশ্চিম আকাশটা টকটকে লাল হয়ে আছে। আকাশ হতে ফোটায় ফোটায় রক্ত ঝরছে যেন। আমার মনের গহীনের আঙ্কিত চিত্র হতেও কি রক্ত ঝরছে? জানি না! কিচ্ছু জানি না আমি!

(পাঁচ)

বাসায় ফিরে এলাম। মুবিব নেই। বাড়ী গেছে। ওদিন হাসপাতালে এসে খরচটা দিয়ে গেছিল। টাকা কার কাছ থেকে ব্যবস্থা করেছে কে জানে! এর পর আর দেখা হয়নি। নিঃসঙ্গতা আমাকে দুশ্চিন্তার দিকে ঠেলে দেয়। ছন্নছাড়া মানুষ আমি। উল্লেখ যোগ্য কোন পিছুটান নেই। এজন্য তিতিকে বিয়ে করতে আমার তেমন কোন সমস্যা নেই। যদিও আমাদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে কেবল সমাজ। কারণ, আমাদের সমাজে পূর্বে একবার বিবাহিতদের এখনো আপয়া, অশুভ আর কুলক্ষণা মনে করা হয়। সমাজের সবাই তাদের খারাপ চোখে দেখে। অনেককে তো আবার ব্যবহৃত পন্যের মত ছুঁড়ে ফেলা হয়! ওদের জীবনে প্রেম ভালবাসার নতুন জোয়ার আসতে নেই। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকে পূর্বেকার স্মৃতি নিয়েই জীবন পার করতে হয়। বিবাহিত পুরুষকে অবিবাহিত কোন নারী কিংবা বিবাহিত নারীকে অবিবাহিত কোন পুরুষ কখনোই বিয়ে করতে চায় না। মনে বড় ভয় থাকে ‘সমাজ কি বলবে!’ অথচ ভারত উপমহাদেশ ছাড়া এমন উদ্ভট চিন্তাধারা না আরবে- না ইউরোপে কোথাও নেই।

হঠাত্‍ একটা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিল আমার, তিতি প্রেম শুরু না করতেই বিয়ের বিষয়টা আনলো কেন?
যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। প্রশ্নটা তিতির সামনে থাকতে মনে পড়েনি বলে উত্তর পাচ্ছি না। এজন্যই মাঝে মাঝে নিজের পশ্চাতে নিজেরই লথি কষাতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু সেটাও সম্ভবপর নয়! তিতিকে একবার ফোন করব ভাবছিলাম। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না করে অসময়ে করে বোকারা। আমি বোকাদের দলে নই। তাই আমার ভাবনার জগতকে বিস্তৃত করলাম। আমার ভাবনা’রা কখনোই বিরক্ত হয়না বরং আমাকে যে কোন বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করে। মনে মনে কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

‘অবিশ্বাসের কারণে?’
মনে মনে তিতিকে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রথম প্রশ্নটা করলাম আমি। কারণ, পৃথিবীর সবচে দামি বস্তু বিশ্বাস। বস্তুতঃ এর কোন মূল্যই হয় না! কিন্তু ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার মত উল্লেখ যোগ্য কোন কারণ খুঁজে পেলাম না আমি। তাই এটা বাদ।

‘তাহলে..পারিবারিক কারণে?’
দ্বিতীয় প্রশ্নটার ক্ষেত্রেও তিতিকে সামনে দাঁড় করালাম। দেখলাম তিতি মাথা নেড়ে না করছে। ওর পরিবারের ব্যাপারে যতটুকু জানা আছে তা হল, পরিবারের সামান্য সচ্ছলতার জন্যই ওর চাকুরীতে আসা। এজন্য পারিবারিক ভাবে বাঁধা না আসাটাই স্বাভাবিক।

‘তাহলে… সামাজিক কারণে?’
আমার সামনে দাঁড়ানো তিতি মন খারাপ করে ফেলে। আমাদের সমাজে একটা ছেলে ও মেয়ের বিবাহপূর্ব সম্পর্ককে কখনোই ভালো চোখে দেখা হয় না। কিন্তু এই মেয়েতো সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে। তাই এটাও মূল কারণ হতে পারে না।

‘তাহলে…?’ কিছুক্ষণ ভেবেও আর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। হঠাত্‍ মনে হল, বিষয়টা কি ধর্মীয় কোন বাধ্যবাধকতার কারণে হতে পারে? হয়ত পারিবারিক ভাবেই ধর্মীয় চাপ আসছে। আমরা বাঙালীরা আবার বেশ ধর্মপ্রাণ। হোক না সেটা যে কোন ধর্ম। প্রত্যেকেই বেশ নিষ্ঠার সাথেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করে থাকে। আর পৃথিবীর সাড়ে চার হাজার ধর্মের অধিকাংশ ধর্মই বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্কের বৈধতা দেয়নি। আর প্রধান প্রধান কয়েকটা ধর্মে বিবাহপূর্ব নারী-পুরুষের কোন সম্পর্ককেই বৈধতা দেয়নি। বিশেষত ইসলাম ধর্মেতো স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে! তাছাড়া ধর্মীয় বিষয়গুলো আমার কাছে সিম্পল একটা বিষয়। রাতদিনে আমি যেমন পাঁচবার খাওয়া-দাওয়া করি তেমনি পাঁচবার সৃষ্টিকর্তার সামনে মাথাও ঝুকাই। যিনি আমাকে সৃষ্টি করে দৈনিক চব্বিশটা ঘন্টা দিয়েছেন আমি কি তাঁর জন্য পাঁচ পনেরো পঁচাত্তর মিনিট দিতে পারব না? তিতি অনেকটা আমার মতই। তাহলে ওকে বিয়ে করতে আমার এত ভাবনা কিসের? বালামার!

(ছয়)

রাতে দেরী করে ঘুমালেও সূর্যোদয়ের অনেক আগেই উঠে গেলাম আমি। ছোটবেলার অভ্যাস। শীতটা বেশ জাঁকিয়ে ধরেছে ইদানীং। সারাদিনের এই একটা সময়ই আমার মায়ের চেহারাটা মনে পড়ে। যদিও দীর্ঘদিনের পুরনো ছবিটাতে ধূলোবালির আস্তরণ পড়ে গেছে। হয়ত একদিন এটাও মুছে যাবে। আলো ফোটার আগেই প্রয়োজনাদি সেরে হাঁটতে বের হলাম। সকালের এই হাঁটা আমাকে ভাবনার অনেক সুযোগ দেয়। মন ও মাথা ফ্রেশ থাকে তাই ভাবনাটাও ফ্রেশ হয়। আর এই সময়ের ভিতরেই আমি গুছিয়ে ফেলি সারাদিনের রুটিন ওয়ার্ক। গত রাতে ঘুমানোর পূর্বে তিতিকে ফোন দিয়েছিলাম। তিতি জেগেই ছিল। হয়ত এই কলের অপেক্ষায়ই! আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বন্ধু রুমী ও সরফরাজের বাসায়। ওরা আমার আর মুবিবের মতই এক সাথে থাকে। মুবিব যেহেতু নেই তাই ওরাই ভরসা। বিয়ে করতে হলে অন্তত দু’জন তো সাক্ষি লাগবেই, তাই না?

(সাত)

বিকাল ০৩.৩৪
আমি বসে আছি জাহাজবাড়ী। ধানমণ্ডি জাহাজবাড়ী। আমার প্রিয় স্থান। গতরাতে তিতিকে চারটায় আসতে বলেছিলাম। কারো সাথে দেখা করতে সময়ের আগেই ওখানটায় পৌঁছে যাওয়া -এটা রীতিমত অভ্যাস আমার। তিতি তো এখনো আসেনি, রুমী আর সরফরাজও আসেনি। অপেক্ষা নাকি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর! কিন্তু আমার কাছে সেটা মনে হয় না, কেউ তো মৃত্যুর পর ফিরে এসে একথা বলে যায়নি। এজন্য অপেক্ষার মূহুর্তগুলো আমি ভাবনায় ডুবে থাকি। ভেবে ভেবে কল্পনার সূঁতোয় স্বপ্ন বুনি।

এভাবেই ভাবতে ভাবতে ওরা যখন এলো। ঘড়ির কাটা তখন চারটা পেরিয়ে ঊনিশ মিনিটে পৌঁছে গেছে। এদিকে তিতির কোন খবর নেই। এসেই ওরা বলল, ‘কিরে ও আসেনি?’ আমি বললাম, ‘দেখতেই তো পারছিস।’
সরফরাজ বলল,’আমি ভেবেছি আরেকটু দেরী করেই আসি। বিয়ের আগে না হয় আরেকটু প্রেম করে নিলি।’ ওরা হাসতে শুরু করল। সাথে আমিও হাসলাম। বিয়ের দিন বর-কনেদের এমন টিটকারী মূলক কিছু কথা শুনতে হয়। তাছাড়া সরফরাজ ছেলে ভালো। চুপচাপ কবি মানুষ। সাহিত্য জ্ঞানে আমি ওর হাঁটুর সমান। হঠাত্‍ রুমী দাঁড়িয়ে গেল। ওর ডান হাতটা গলার নিচে দিয়ে থুতনিতে হাতের তালুটা রেখে আঙুলগুলোকে ডান গালের উপর রেখে দিল। আর বাম হাতটা দিয়ে পেটের উপর ডানটা চেপে ধরল। ওর চেহারা আর কাজের এক্সপ্রেশন দেখে সরফরাজ হাসিতে গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বললাম, শালায় আমাকে ভেঙাচ্ছে! তবুও আমি নিজেই হাসি আটকাতে পারলাম না। এক চোট হাসাহাসির পরও রুমীর কোন হের ফের নেই। ও অভিনয় বজায় রেখে গম্ভীর গলায় বলল,’বুদ্ধুরাম, বিয়ের আগেই বিপত্নীক হয়ে ভাবনায় বসে গেছে!’ এবার সবাই মিলে হো হো করে হেসে উঠলাম। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে আপনাতেই মন কিছুটা ভালো হয়ে গেল। আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম। নেফারতিতিকে একটা ফোন দিয়ে যাক। পুরনো মডেলের নোকিয়ার ভাঙাচুরা সেটে নাম্বারটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না। নেটওয়ারর্কের টানাহেঁছড়া শেষে যখনি কলটা ঢুকতে গেল তখনি যান্ত্রিক কণ্ঠটা বলে উঠল, ‘নাম্বারটি ব্যস্ত আছে – দ্য নাম্বার ইজ বিজি নাউ!’

কিছু মনে করার কোন কারণ নেই। বিজি তো থাকেতেই পারে। আমাদের তিন বন্ধুর আড্ডা চলতেই লাগল। এভাবেই পাঁচটা বিশ বেজে গেল। অথচ তিতির দেখা নেই। অবশ্য মাঝে আমি বারকয়েক সংযোগের ব্যর্থ্য চেষ্টা করেছি। মনে খানিক উত্কেণ্ঠা জাগে। কিন্তু কিছু বলিনা আমি। রুমী আর সরফরাজ হয়ত এটা নিয়েই খোঁচাতে শুরু করবে। এমনিতেই ওদের অনেক কানপড়া দিয়ে বুঝিয়ে বিয়েতে সাক্ষী হবার জন্য রাজী করতে হয়েছে। ওরা এখন বিয়ের পর আমার পকেট থেকে কি পরিমাণ খসাবে সে হিসাব করছে। অথচ আমার পকেটে একটা ফুঁটো পয়সাও নেই! বিয়ের খরচটা তিতি দিবে বলেছিল। কথটা শুনে প্রথমে মন খারাপ হয়ে গেছিল আমার। তিতি ব্যপারটা বুঝতে পেরে বলেছিল পরে পরিশোধ করে দিলেই তো হল। এখন বাজে পাঁচটা পঁচিশ। এখান থেকে কাজী অফিসে যেতে পনের মিনিট তো লাগবেই। পৌনে ছয়টায় আবার মাগরিবের আজান। কি যে করি ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। মনকে বারবার একথা বলে প্রবোধ দিচ্ছি, ‘এই তো এসে যাবে তিতি।’

(আট)

পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। সূর্য ডুবে সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে। এদিক সেদিক হতে আজানের আওয়াজ ভেসে আসছে। কিন্তু তিতির কোন পাত্তা নেই! মনের শঙ্কাটা ধীরে ধীরে ভয়ে রুপান্তরিত হচ্ছে আমার। রুমী ও সরফরাজের হাসাহাসি বন্ধ হয়ে গেছে। দুঃখের একটা বিষাক্ত বাতাস সবাইকে গ্রাস করে নিয়েছে। রুমী আমার কাঁধে হাত রাখল। সান্ত্বনার ছোঁয়া। নিচু স্বরে বলল, ‘তুই একবার ওর বাসায় গিয়েছিলি না?’ আমি যেন অন্ধকারেও আলোর সন্ধান পেলাম। ওর দিকে তাকিয়ে একটা ম্লান হাসি দিলাম। এটাই ওর পুরস্কার। কিছু না বলে অমি হাঁটতে লাগলাম। নিরবে।

ছয়টা তের বাজে। মাগরীবের পর দ্রুত পায়ে লালমাটিয়ায় এসে পৌঁছলাম। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিতির ব্যাপারে বাজে কোন চিন্তা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একবার এটা অন্যবার আরেকটা ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। এভাবে ভাবতে ভাবতে লালমাটিয়ার কানা গলিতে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরতে থাকি। রুমী আর সরফরাজও আমার পিছে পিছে ঘুরছে। হয়ত বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে কিছুই বলছে না। হঠাত্‍ আমার মনের মাঝে কেউ বলে উঠল ডানে এসো! আমি ডানে গেলাম। ওরাও আসছে। কিছুদূর সামনে আবারো রাস্তা ডানে-বামে মোড় নিয়েছে। আমি মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ালাম। কোনদিকে যাব দিশা পাচ্ছি না। মনে মনে তিতিকে বলছি, ‘আমায় পথ দেখিয়ে দাও।’ ওর মায়াবী চোখ দুটো আমার চোখে ভেসে উঠে। আমি ওই শীতল মায়ায় ডুব দিয়ে পথ খুঁজতে থাকি।

(নয়)

‘কিরে এবার কোনদিকে?’
রুমীর গলা শুনে সম্বিত্‍ ফিরে পেলাম আমি। অনেকটা বিরক্তি ঝরা কণ্ঠ ওর। সরফরাজ বরাবরের মতোই নিরব। কবি হয়ত আমার অবস্থা কিছুটা বুঝতে পারছে। মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। আমি কিছু না বলে বাম দিকে হাঁটা ধরলাম। এটা কোন সুত্র নয় যে ডানের পরেই তো বাম আসবে। বরং আমার মন বলছে বামে যেতে তাই হাঁটছি। হঠাত্‍ খানিক দূরের গাছে ঢাকা একটা বাড়ি দেখে আমার মনে হল এটাই সেই বাড়ি। আমি আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে ওদের এগিয়ে যেতে বললাম। নিজের ক্লান্ত শরীরটা বেশ ভারী মনে হচ্ছিল। পা দুটো আটকে যাচ্ছিল পিচ ঢালা রাস্তায়। মন বলছিল,’সামনে আর যাসনে বোকা! যদি সয্য করতে না পারিস।’ তবুও আমি এগিয়ে যাচ্ছি সত্য সন্ধানের টানে। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছি, ‘এইতো আর মাত্র কয়েক সেকেন্ট। তারপরেই আমি প্রিয়তমার সান্যিধ্য পাব।’ আমার মুখের রসায়ন নিঃশেষ হয়ে আসে ধীরে ধিরে। তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠদ্বয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখন যদি একটুখানি ওর অমৃত পেতাম হয়ত বেঁচে যেতাম। পানি শূন্যতায় মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে শুরু করে। কপালের রগ দুটো ফুলো ফেঁপে উঠছে ক্রমান্বয়ে। ওদিন একসিডেন্টের পর থেকেই মাঝে মাঝে এমনটা হয়। রুমী ও সরফরাজ বাড়িটার সামনে পৌঁছে যায়। উঁকি মেরে দেখছে আলো জ্বলছে কিনা। এর মাঝেই আমি ওদের পিছনে পৌঁছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে সরফরাজ পিছনে ফিরে আমাকে বলল,’এটা দেখি নির্মাণাধীন বাড়ি!’
কথাটা শুনে যেন শক খেলাম আমি। থরথর করে কেঁপে উঠল আমার সমগ্র সত্বা। সেদিনের কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে! নিজেই নিজের উপর কেমন যেন বিশ্বাস হারালাম। এটা কীভাবে সম্ভব? আকস্মিক আমার চতুর্পাশে ঘূর্ণিঝড় উঠে। পৃথিবী ঘোলাটে হয়ে উঠে আমার দু’চোখে। হাঁটু কাঁপতে থাকে থরথর করে। রুমী আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে গেল। আর আমি ঢলে পড়লাম জমিনের বুকে। দু’চোখ বন্ধ হয়ে মাটিতে পড়ার সময় শুনতে পেলাম রুমীর মুখের কয়েকটি শব্দ, ‘শালা! এটা দেখি তোর নিজের নাম্বার!’

আমার দুচোখে ভেসে উঠে মনের গহীনে অঙ্কিত সেই চিত্রের বর্ণনা, ‘দো-হাড়া গড়ন। চিকন কটিদেশ। তাতে ঘন কালো দীর্ঘ চুল।…’

(দশ)

ধবধবে সাদা একটা রুমে শুয়ে আছি। রুমের প্রতিটি কোণে মৃত্যুর শীতলতা বিরাজ করছে যেন। এমন একটা রুমেই সর্বপ্রথম নেফারতিতির দেখা পেয়ে ছিলাম আমি। রুমের প্রতিটি জিনিষেই মেডিনোভা মেডিকেলের লোগো সিল করা। চোখ খোলার পর শিয়রে বসা এক শুভ্রকেশী বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম। চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা পরা। আগেরবার ইনার কাছেই চিকিত্সায় নিয়ে ছিলাম আমি। ডা. শিবলী নোমানী। ভদ্রলোক যথেষ্ট স্নেহ করেন আমাকে। উনি তাঁর হাত দিয়ে আমার কপাল মুছে দিচ্ছিলেন। মুখে প্রশ্রয় আর ভরসামাখা হাসি মিশ্রন। হয়ত বিশ্রী ব্যপারটা উনি জেনে গেছেন। তবুও আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা প্রথম কথা ছিল, ‘নেফারতিতি কি এসেছে?’
উনি আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সান্ত্বনা দেন। এবং বলেন, ‘তোমার কি ওর চেহারার কথা স্পষ্ট মনে আছে?’ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে আমার। নিরব সম্মতিতে মাথা নাড়লাম আমি। আর মনে মনে বললাম, ‘এই চিত্র যে মুছে যাবার নয়।’ উনি এক নার্সকে ইশারা করলেন। নার্স একজন লোককে ডেকে আনল। আবারো মুখটা উজ্জ্বল হয়ে হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটের ফাঁকে। এবার দুচোখ বন্ধ করে কিছুটা উচ্চ আওয়াজে আমি বিড় বিড় করতে লাগলাম, ‘দো-হাড়া গড়ন। চিকন কটিদেশ। তাতে ঘন কালো দীর্ঘ চুল।…’

তিন ঘন্টা পর-
ডা. শিবলী নোমানীর রুমে বসে আছে রুমী ও সরফরাজ। দীর্ঘক্ষণ ওদের রুমে বসিয়ে রেখে মাত্র ফিরে এলেন তিনি। তাঁর সামনে একটা ফাইল রাখা। ফাইলের পরিচয়ের ঘরে ছোট্ট করে লেখা একটা শব্দ। তিনি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন শব্দটা, ‘ধ্রুব…।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তার সামনে বসা রুমী ও সরফরাজের দিকে তাকালেন তিনি। চিন্তিত উভয়ের চেহারা। উত্কঘণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় আছে তার মুখ থেকে কিছু শুনার জন্য। ডা. শিবলী তাঁর ভারী ফ্রেমের চশমাটা সামান্য নাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা ওর বন্ধু?’
রুমী আর সরফরাজ উভয়ের সম্মতিতে মাথা নাড়ল। তিনি তাঁর পেশাগত গাম্ভীর্য্যে ফিরে এসে বলতে শুরু করেন,
‘দেখ, কেউ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার ব্রেইনে প্রচুর পরিমাণে ‘ডোপামিন’ এবং ‘নর-ইপিনেফ্রিন’ তৈরি হয়, যে কারণে নেশাগ্রস্তের মত অনুভূতি হয়। শুধু মানুষ নয় অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। একটি উদাহরণ দিলে তোমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন ইঁদুর জাতীয় প্রেইরি ভোলের কথা বলছি। এদের স্ত্রী প্রেইরি ভোলকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রেমের শুরুতে পুরুষ প্রেইরি ভোল তার প্রস্রাবের গন্ধ শোকায়। এতে স্ত্রী প্রেইরি ভোলের ব্রেইনে ‘ডোপামিন’ এবং ‘নর-ইপিনেফ্রিন’র মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে স্ত্রী প্রেইরি ভোল পুরুষ প্রেইরি ভোলের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
অবশ্য পশুদের ক্ষেত্রে এই নেশার ঘোর মিলিত হবার পর কেটে গেলেও মানুষের ক্ষেত্রে এটা মাসের পর মাস-বছরের পর বছর এমন কি অনেক ক্ষেত্রে আজীবনও থেকে যায়। এজন্যে দেখবে দীর্ঘদিন প্রেম করার পরও যারা বিয়ে করে তাদের অধিকাংশ বেশিদিন সংসার করতে পারে না। এর অন্যতম কারণ হল ওই নেশার ঘোরটা কেটে যাওয়া।’

‘কিন্তু স্যার…?’ ডা. শিবলী নোমানী চুপ করার পর পরই প্রশ্ন করে রুমী, ‘ওর সাথে এসবের কি সম্পর্ক?’

ডা. শিবলী মুচকি হাসি দিয়ে স্নেহসূলভ গলায় বলেন,’বত্স , আগে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনো। দেখবে আপনাতেই বুঝে আসবে।’

সরফরাজ তো এমনিতেই চুপ ছিল। ডাক্তারের কথা শুনে রুমীও চুপ হয়ে যায়। সায়েন্সের এসব গাঁজাখুরি গল্প ওর ভালো না লাগলেও মন দিয়ে শুনতে থাকে। আর ডা. শিবলী নোমানী আবারো লেকচার দেওয়া শুরু করেন,

‘প্রোফেসর র্যামিরেজ অহিও। যিনি আমেরিকার স্টেট ইউনিভর্সিটির একজন গবেষক। তিনি বলেছিলেন, কারও সাথে আমাদের সাক্ষাত হওয়া বা কারো চিত্র আমাদের মনস্পটে ভেসে উঠা মাত্রই আমাস্ন্যাপ জাজমেন্টের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে তার সাথে কি ধরনের সম্পর্ক হতে যাচ্ছে। ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমাজিং’র মাধ্যমে ব্রেইন স্ক্যান করে তিনি দেখেন যে প্রিয় বন্ধু এবং প্রেমিক কিং প্রেমিকার মধ্যে ব্রেইনের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা আছে। প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার ছবি দেখলে ব্রেইনের উভয় পার্শ্বের মিডিয়াল ইনসুলা, এন্টেরিয়র সিংগুলেট করটেক্স, কডেট নিউক্লিয়াস এবং পুটামেন সক্রিয় হয়। অক্রিয়তা দেখা যায় পোস্টেরিয়র সিংগুলেট জাইরাস, এমিগডালা এবং ডান পার্শ্বের প্রি-ফ্রন্টাল, প্যারাইটাল ও মিডল- টেম্পোরাল করটেক্সে।

ব্রেইন স্ক্যানে আরও দেখা যায় যারা পাগলপ্রায় ভালোবাসে তাদের ব্রেইনের উত্তেজিত অংশ এবং কোকেইনে আসক্তদের উত্তেজিত অংশ একই। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে ব্রেইনের একই জায়গা উত্তেজিত হয়।’

লেকচারটা থামিয়ে একটু স্বস্তির শ্বাস ছাড়েন ডা. শিবলী নোমানী। এই বয়সে এমন লেকচার না দিলেও হত। কিন্তু ওর বন্ধুদের বিষয়গুলো বুঝিয়ে না দিলে ওরা কিছুই বুঝবে না। তাই শুরু যেহেতু করেছেন শেষ তাকে করতেই হবে। অসম্পূর্ণ কাজ আবার তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। টেবিলে রাখা গ্লাস হাতে নিয়ে তিনি পানি পানে মনযোগী হলেন। আর এই নতিদীর্ঘ লেকচার শুনে সরফরাজের কেমন লাগছে রুমীর জানা নেই। কিন্তু সায়েন্সে ভর্তি না হওয়ার জন্য মনে মনে নিজের পিট নিজেই চাপড়ে দিচ্ছিল। আর সরফরাজের কাছে এসব ভালো লাগা বা না লাগা কোন ফ্যক্ট না। সাহিত্য ও সংবাদিকতা নিয়েই ওর কাজ। ও কেবল শুনে যাচ্ছে। দেখলে মনে হবে ও একনিষ্ঠ শ্রোতা! টেবলে গ্লাস রাখার শব্দে উভয়ে ডাক্তারের লেকচারের দিকে মনোনিবেশ করে। আর ডা. শিবলী পানি দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে আবারো বলা শুরু করেন,

‘দেখ, তোমাদের দু’জনকে এতক্ষণ যে বিষয়টা বুঝানোর জন্য এত কথা বলা সেটা হল, এই প্রেম বলো আর ভালবাসা বল এটা উভয় পক্ষের একসাথে হলে ভালো, একটি সুন্দর সম্পর্কের সূচনা হয়। না হলে যে প্রেমে পড়ে তার জন্য শুরু হয় এক কষ্টকর জীবন। কথায় বলে প্রেমরোগ বড় রোগ।’

এই কথা বলে ডা. শিবলী মুচকি হেসে ওদের একটা চোখ টিপ দিলেন। এরপর আবার বলা শুরু করেন,
‘বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডরোথি টিনভ এধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়ার নাম দিয়েছেন লিমিরেন্ট রিঅ্যাকশন। আর যার প্রেমে পড়া হয় তার নাম দিয়েছেন লিমিরেন্ট অবজেক্ট। লিমিরেন্ট অবজেক্টকে নিয়ে লিমিরেন্ট রিঅ্যাকশনের মনে ইনট্রুসিভ চিন্তা আসতে থাকে। ইনট্রুসিভ চিন্তা হলো মনের বিরুদ্ধে চিন্তা আসা। আর এই চিন্তার ফলে সে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। পড়াশুনা, কাজে-কর্মে মনোনিবেশ করতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো ব্যর্থও হয়। আর যেরকম অনুভূতি তার মধ্যে হচ্ছে, সেরকম অনুভূতি যেন লিমিরেন্ট অবজেক্টের মধ্যেও হয় এমনটা প্রত্যাশা করতে থাকে তীব্রভাবে। যদি লিমিরেন্ট অবজেক্টের মধ্যে সামান্য কোনো প্রতিক্রিয়াও সে দেখতে পায় তাহলে ভীষণ আনন্দিত হয়। আর তাই সব চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, কাজ-কর্ম লিমিরেন্ট অবজেক্টের প্রতি লক্ষ্য করে চলতে থাকে লিমিরেন্ট রিঅ্যাকশনের। এমনকি সে লিমিরেন্ট অবজেক্টের নেতিবাচক দিকগুলি দেখতে পায় না। ডিল্যুশন পর্যায়ের এক ভ্রান্ত বিশ্বাসের ফলে সে বিশ্বাস করে লিমিরেন্ট অবজেক্টও তাকে ভালবাসে! এক পর্যায়ে সে জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, প্যানিক ডিসওর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়।

আর যে প্রেমে পড়ে অর্থাত্‍ লিমিরেন্ট রিঅ্যাকশন যদি লিমিরেন্ট অবজেক্টের মধ্যে ভালবাসা দেখতে না পায তখন অনেকেই দুশ্চিন্তা জনিত সমস্যায় পড়ে। যেমন- ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার ইত্যাদি রোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এবার তোমাদের বন্ধুর প্রসঙ্গে আসি-‘

এ পর্যন্ত বলেই টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে তিন চুমুক পানি পান করেন ডা. শিবলী নোমানী। ওদেরকে মন দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি বলতে শুরু করেন,

‘তোমাদের বন্ধু ছোটবেলা থেকেই মায়া-মমতা ও স্নেহের ছিঁটেফোটাও পায়নি। এটা আমার চেয়ে তোমরাই ভালো জানো। এছাড়া ও টুকটাক গল্প-উপন্যাস লেখত সেটা মুবিব শেখ আমাকে বলেছিল। ও সাধারণত কয়েকটা চরিত্রকে ঘিরেই লেখালেখি করত। এর মাঝে ছেলে চরিত্র কয়েকটা থাকলেও মেয়ে চরিত্র ছিল মাত্র একটা। যেই চরিত্রের ও নাম দিয়েছিল নেফারতিতি। এই নেফারতিতি মূলত মিশরের এক রাণীর নাম। নেফারতিতির সঙ্গে রাজা তৃতীয় অ্যামেনহোটেপের ছেলে চতুর্থ অ্যামেনহোটেপের (আখেনাটেন) বিয়ে হয়েছিল, নেফারতিতি ও আখেনাটেন খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৫৩ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩৬ সাল পর্যন্ত যৌথভাবে মিশর শাসন করেন। তাদের ছয় কন্যা ছিল। অনেক ইতিহাসবিদের দাবি, তাদের একটি ছেলেও ছিল। এই নেফারতিতি ছিল সৌন্দর্ষের রাণী। তাই নেফারতিতির উপর ওর কিছু দূর্বলতা ছিল। কিন্তু নেফারতিতির কয়েকটি মূর্তি থাকলেও কোন ছবি কোথাও নেই। এজন্য তোমাদের বন্ধু মনে মনে নেফারতিতির একটা চিত্র এঁকে নিয়েছিল।

এরপরের ঘটনা এক মাস পূর্বেকার। আমাদের হাসপাতালের নিকটেই ও একটা দূর্ঘটনার শিকার হয়। শরীরের কোথাও তেমন আঘাত না পেলেও মাথার আঘাতটা বেশ গুরুতর ছিল। আর ঘটনার সময় ও নেফারতিতিকে নিয়েই ভাবছিল। ফলে ওই চিত্রটা ওর মাথায় নিখুঁত ভাবে গেঁথে যায়। যার ফল স্বরুপ এই স্কেচ।’

এই বলে তিনি রুমী ও সরফরাজের হাতে কিছুক্ষণ পূর্বে আঁকা একটা স্কেচ তুলে দেন। ধ্রুবের বর্ণনা অনুযায়ী একজন আর্টিস্ট যে স্কেচ এঁকেছিলেন। রুমী ও সরফরাজ স্কেচটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। ডা. শিবলী নোমানী আবার বলতে শুরু করেন,

‘দূর্ঘটনার আগ থেকেই ও পূর্বে উল্লেখিত অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল। এই রোগটা একদিনে হয় না বরং ধীরে ধীরে এই রোগটা রুগীকে গ্রাস করে নেয়। ও ভাবত ওর মনে আঁকা চিত্রের মেয়েটাও ওকে ভালবাসে। কিন্ত দূর্ঘটনার পর রোগটা আরো মারাত্মক রুপ নেয়। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয় ও। যাকে সিজোফেন্সনিয়া ও বলা হয়। ব্রেনের জৈব-রসায়নিকের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা ও অসামঞ্জস্যতার কারণে যার উত্পকত্তি হয়। ১৮৮৭ সালে জার্মান মনোবিদ এমিল ক্রেপলিন প্রথম এই রোগের সন্ধান পান। বর্তমানে এই রোগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয় –
এক, ইনসিডিয়াল সিজোফ্রেনিয়া,
দুই, একিউট বা ক্রাইসিস সিজোফ্রেনিয়া
তিন, ক্রনিক সিজোফ্রেনিয়া।

এখন দেখার বিষয় ওর রোগটা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এজন্য এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করার জন্য আমি আমার পরিচিত ও স্নেহধন্য সাইকলোজিস্ট হাসান সাব্বিরকে ওর ব্যাপারে জানিয়েছি।’

ডা. শিবলী নোমানীর বক্তব্য শেষ। সরফরাজ লেকচারের প্রভাবটা দ্রুত কাটিয়েই প্রশ্ন করল, ‘স্যার, এখন আমরা কী করব?’

কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। এরপর বললেন,’তোমরা ওকে ওর রোগের ব্যপারে কিছু বলবে না। বরং ওকে ওর মত থাকতে দাও। আমরা দেখি কি করতে পারি।’ ওরা উঠে দাঁড়াল ডা. শিবলীর রুম ছেড়ে বের হবার জন্য।

(এগারো)

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। নেফারতিতির দেখা আজও পাইনি আমি। রুমী আর সরফরাজ ওকে নাকি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ডা. শিবলী ওদেরকে সাহায্য করছেন। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে নেফারতিতিকে খুঁজে আমার সামনে নিয়ে আসবেন। আমি বলেছিলাম আমাকে যেন হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয় তাহলে আমিই ওকে খুঁজে বের করব। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। আমিতো সুস্থ তবুও আমাকে কেন আটকে রাখা হচ্ছে! সন্দেহ ঢুকে পড়ে আমার মনে। আমার মন বলছে নেফারতিতি নিশ্চিত কোন বিপদে পড়ছে নচেত্‍ এতদিন পর্যন্ত ও আমাকে ছেড়ে থাকতে পারত না। এজন্য আজ ঘুম থেকে উঠেই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পালিয়ে যাব আমি হাসপাতাল ছেড়ে। বিপদ থেকে উদ্ধার করব আমার তিতিকে। জানালার দুটো গ্রিল শক্ত করে ধরে দুচোখ বন্ধ করে স্বগোক্তি করলাম আমি, ‘নেফারতিতি আমি আসছি!’

*************************************** (সমাপ্ত) ************************************

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত