এই কাহিনিটা ট্র্যাজিক

এই কাহিনিটা ট্র্যাজিক

একটা কাহিনি লিখছি যেটা হবে মারাত্মকভাবে বিয়োগান্তক মানে ট্র্যাজিক। পাঠকরা পড়বে আর নোনাজলে বই ভেজাবে। খেয়াল করে দেখলাম, পাঠকরা প্রেমের গল্পের ট্র্যাজেডি খুব ভালোবাসে। শিরি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট আরও কত রোমান্টিক ট্র্যাজেডিই তার প্রমাণ। তাই আমার কাহিনিটা রোমান্টিক ট্র্যাজেডি।
কাহিনির নায়ক অক্ষর। আলাভোলা টাইপ চরিত্র। চাকরির সন্ধানে স্যান্ডেলের বারোটা বাজিয়েছে। ছেলেটা পড়াশোনায় ভালোই। কিন্তু ট্র্যাজিক আনতেই তাকে আর চাকরি পেতে দেই না। ইন্টার্ভিউতে পাশ করলেও বুদ্ধি করে বাদ দিয়ে দেই। আসলে উপন্যাসে চাকরি পাওয়া ছেলেদের দিয়ে ট্র্যাজেডি হয় না।

নায়িকার নাম সাবিহা। স্বাভাবিকভাবেই সে বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সুন্দরী মেয়ে। পাঠকরা চায়ই ধনী পরিবারের মেয়েটা দরিদ্র ছেলের প্রেমে পড়ুক। বাংলা চলচ্চিত্র গড়েও উঠেছে এই ছকে। কারণ এতে একটা ড্রামাটিক আবহ পাওয়া যায়। ট্র্যাজেডিতে এটার দরকার আছে।

অবশ্য তারা প্রেমে পড়ছিল না। বহুবার দেখা করিয়ে, নানান ফন্দিফিকির করে প্রেমে ফেলাতে হয়েছে। দেবদাসের প্লট মাথায় রেখে ঠিক করেছি কাহিনির শেষে ছেলেটাকে মেরে ফেলবো। তাহলে বেশ ভালো ট্র্যাজিক হবে। যাই হোক, কথায় কথায় অনেক কথা বলে ফেললাম, কাহিনি শুরু করি। আজকে তাদের দেখা করার কথা — দেখি তারা কী বলে।

মার্বেল পাথরের বেঞ্চে অক্ষর মাথা নিচু করে বসে আছে। সাবিহা তার পাশে এসে বসতে বসতে বলল, ‘ইন্টার্ভিউ কেমন হলো?’

‘ভালো। তবে জানোই তো আমার চাকরি হবে না।’
‘কেন হবে না? অবশ্যই হবে। তুমি অত ভেবো নাতো।’

‘সাবিহা, তুমি তো জানোই লেখক আমাকে চাকরি পেতে দেয় না। আমাকে গল্পের শেষে মেরেও ফেলবে। তুমি কেন আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো না? এই কাহিনিটা ট্র্যাজিক।’

‘তোমাকে এইসব কে বলেছে? আমি বাবাকে সব বোঝাবো। তিনি রাজি হলে অবশ্যই আমাদের বিয়ে হবে। লেখক ব্যাটা কিছুই করতে পারবে না। তুমি দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কিচ্ছু ঠিক হবে না। তুমি কিছুই জানো না, শুধুমাত্র পাঠককে বইটা খাওয়াতেই আমাদের বিচ্ছেদ করাবে।’ অক্ষর তালুর উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।

‘ওসব কিছু হবে না। সামনের কথা ভাবো। আমাদের বাবুর কথা ভাবো। সে হবে ঠিক তোমার মতো আলাভোলা, তোমার মতো খাড়া নাক, গোল গোল মায়াভরা চোখ, এলোমেলো চুল…’

সাবিহার কথা কেড়ে নিয়ে অক্ষর বলে, ‘উহু, তোমার মতো দীঘল কালো চুল থাকবে। ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা। ছোট্ট ছোট্ট আঙুল। আধো আধো বোল। আমাদের ছোট্ট রাজকন্যা।’

সাবিহা লাফিয়ে উঠে বলে, ‘না না না। রাজপুত্র হবে। তোমার মতো।’
‘নাহ, রাজকন্যা।’
‘নাহ, রাজপুত্র।’

ওরা খুনসুটিতে মেতে উঠতেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কীভাবে যে ছেলেটা কাহিনিটা জেনে গিয়েছে বুঝতে পারছি না। বারবার যখন কাহিনি বলে দেয়, তখন এই বাচ্চার কথা আনতে হয়। বাচ্চার কথা বলতে বলতে সে কাহিনি ভুলে যায়। কিছু একটা করতে হবে। মেয়েটার বাবাকে খুব জাঁদরেল বানাতে হবে। তাহলে সে কোনোভাবেই তাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। দুঃখে ছেলেটা মারা যাবে। আর আমার কাহিনিটাও ট্র্যাজিক হবে। এক ঢিলে দুই পাখি। হা হা হা। শুরু করি —

সাবিহার বাবা শওকত মোল্লা — পুরো পরিবার তার কথায় ওঠে বসে। কেউ তার কথার একটু নড়চড় করলেই কেয়ামত নেমে আসে। কার কাছে থেকে তিনি যেন খবর পেয়েছেন, তার মেয়ে কোন এক নচ্ছার ছেলের পাল্লায় পড়েছে। কে বলেছে তা তার মনে নেই। তবে কথাটার সত্যতা যাচাই করার খুব প্রয়োজনবোধ করছেন। আজকে আসুক, এই বিষয়ে কথা বলতে হবে।

হা হা হা। আর কেউ না, আমিই তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। এবার তো আমার কাহিনি ট্র্যাজিক হতেই হবে।
অক্ষরকে মেসে নামিয়ে সাবিহা বাসায় ফিরতেই বাবার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে গেল। ঠাণ্ডা কন্ঠে তার বাবা বললেন, ‘শুনলাম, কোন ছেলের সাথে তোমাকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। কাহিনি কী?’
‘বাবা, ওর নাম অক্ষর হোসেন।’
‘নাম, জানতে চাইনি, কাহিনি কী? ছেলেটার সাথে তোমার এতো ঘোরাফেরা কেন?’
‘বাবা…’ সাবিহা হালকা দম নিলো। সাবিহা ভাবছে, অনেক হয়েছে, আজকেই বাবাকে জানাতে হবে।
‘কী চুপ কেন?’
‘বাবা, আমি ওকে ভালোবাসি।’

চোখ রাঙিয়ে শওকত মোল্লা বললেন, ‘তোমাদের ভালোবাসার দৌড় জানা আছে। তা ছেলে কী করে? বাসায় কে কে আছে? বাবা কী করে?’

‘বাবা, ও চাকরি খুঁজছে। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কয়েকদিনের মাঝেই পেয়ে যাবে। ওর বাসায় ওর বোন আর মা আছে। বাবা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। মা শিক্ষকতা করেন।’

‘কী!’ শওকত মোল্লা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। ‘এমন পরিবারে আমি তোকে…’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ওকে কাল আমার অফিসে দেখা করতে বলবি।’

সাবিহা মাথা উপরে নিচে নেড়ে রুমে চলে আসে।

বাহ! বেশ চমৎকারভাবেই কাহিনিটা এগুচ্ছে। এভাবে এগুলে আমার কাহিনিটা অবশ্যই ট্র্যাজিক হবে, আর পাঠকও ভালোই খাবে।

সাবিহার কথামতো তার বাবার কাছে অক্ষর এসেছে। শওকত মোল্লা বারকয়েক অক্ষরকে আপাদমস্তক দেখে বসতে বললেন।

‘আমার মেয়ের সাথে কতদিনের পরিচয়?’
‘জি, তিন বছরের মতো।’
‘তুমি কি জানো সাবিহাকে আমি কতটা ভালোবাসি?’
‘জি, না। আমি আমার বাবার আদর পাইনি। তাই বলতে পারছি না।’

‘থাকলেও বলতে পারতা না। আমি খুব গরীব ঘরের ছেলে ছিলাম। বাবা-মা আমার কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু আমি আমার মেয়ের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখিনি। আমি চাই না সে বাকি জীবনটা অপূর্ণতা নিয়ে কাটাক। আমার কথাটা বুঝতে পেরেছ?’

‘জি, বুঝতে পেরেছি। আমি ওর সাথে আর দেখা কখনো দেখা করব না।’

এইতো ট্র্যাজেডি আসছে। আমার কাহিনিটা অবশ্যই ট্র্যাজিক হবে। পাঠকের মাঝে হইচই পড়ে যাবে। আমি বিখ্যাত হয়ে যাবো। হা হা হা। এখন, তাদের বাকি কথা শুনি।

শওকত মোল্লা চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বললেন, ‘সাবিহা আমার একমাত্র সন্তান। ও সময়ের আগে জন্মেছিল। পুরো পাঁচ সপ্তাহ ইনকিউবেটরে রাখতে হয়েছিল। সেসময় আমার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অনেক মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছিল। সরকারি চাকরি করায় বেতনের উপরে লোন নিতে পেরেছিলাম। তখন এটা ভাবিনি যে কীভাবে এত টাকা শোধ দেবো, মাথায় তখন একটাই ভাবনা কী করে সাবিহাকে বাঁচাবো। প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গতো দুঃস্বপ্ন দেখে, স্বপ্নে দেখতাম পাওনাদাররা আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে।’ শওকত সাহেব একটু থামলেন, স্টিলফ্রেমের চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছলেন। চশমাটা আবার চোখে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তাই ঘুম ভাঙ্গা মাত্রই আমি ইনকিউবেটরের কাছে যেতাম। গিয়ে দেখতাম মেয়েটা আছে কিনা। তার ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা নাড়া দেখতে এতো ভালো লাগতো যে নার্স এসে আমাকে সরিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কেবল দাঁড়িয়ে দেখতাম। সেই সময় ঠিক করেছিলাম আমার মেয়ের ইচ্ছা কখনও অপূর্ণ রাখবো না। আমি চাই তোমরা সংসারী হও। তোমাকে না পেলে ওর বাকি জীবনটা অপূর্ণ থেকে যাবে। আমি তা হতে দিতে পারি না।’ এবার চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। ‘আমার মতো আমার মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। তুমিও না।’

অক্ষর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। সে একপ্রকার হতভম্ব।

ও আর কী হতভম্ব হবে, আমিই তো পুরাই হতভম্ব। আমি চাইলাম আমার উপন্যাস ট্র্যাজিক হবে। আর এই ব্যাটা আমার কাহিনিকে রোমান্টিক বানাচ্ছে। পিতা-কন্যার ভালোবাসা যেন উথলে পড়ছে। আজব! দেখি অক্ষর কী বলে…

অক্ষর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। কালো ডেক্সটা পেরিয়ে শওকত সাহেবের দিকে এগুলো। শওকত সাহেবের চেয়ার ঘুরিয়ে তার পা ধরে বলতে লাগলো, ‘আমি জানি আপনার মতো আপনার মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। কিন্তু আমিও চাই না সে বাকি জীবন অপূর্ণতায় কাটাক, নিঃসঙ্গভাবে কাটাক। এই কাহিনির লেখক চাচ্ছে তার উপন্যাসটা ট্র্যাজিক হোক, তাই সে আমাকে কোনো চাকরি পেতে দেয় না। সে ঠিক করে রেখেছে সে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি জানি সে আমাকে মারবেই। তাই আমি চাই না আপনি সাবিহার সাথে আমার বিয়েতে রাজি হোন। আপনি তাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেন। প্রথমে কষ্ট পাবে, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সে ভালো আছে — এটা দেখে আমি সানন্দে মরতে পারবো। দয়া করে আমার কথা রাখুন।’

অক্ষর উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায়। শওকত মোল্লা অবাক হয়ে দেখলেন, তারচেয়েও তার মেয়েকে কেউ ভালোবাসে।

বাহ! চমৎকার। আমার কাহিনিটা খুব ভালো ট্র্যাজিক হবে। একদিকে নায়িকার বিয়ে হবে, আরেকদিকে নায়ক মারা যাবে। দৃশ্যটা ভাবতেই ভালো লাগছে। পাঠক যা খাবে না! সেই-ই খাবে!

শওকত মোল্লা দ্বিধাগ্রস্থ অবস্থায় বাসায় এলেন। তার মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে রুমের সামনে আসতেই মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেলেন। মোবাইলে কথা বলছে,

তুমি চিন্তা করো না তো। ওসব কিচ্ছু হবে না। বাবা যখন রাজি হয়েছেন তখন আর কোনো চিন্তা নেই। তুমি আরেকটু চেষ্টা করো, ঠিকই চাকরি পেয়ে যাবা।’

খানিকক্ষণ নীরবতা। শওকত মোল্লা বুঝলেন অক্ষর কিছু বলছে। সাবিহা আবার বলল, ‘তুমি হাল ছেড়ো নাতো। আর ওসব কিছু হবে না। আমাদের বাবুর কথা ভাবো…’

‘না না না। রাজপুত্র হবে। তোমার মতো।’
‘নাহ, রাজপুত্র।’

শওকত মোল্লা নিচে নেমে এলেন। সোফায় বসে কপাল ভাঁজে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, ‘লেখক সাহেব…’
আমি চমকে উঠলাম। আমার চরিত্র আমার সাথে কথা বলছে। আমি কি উত্তর দেবো? নাহ, দেই। ‘জি, বলেন।’
‘ভাবছেন, আপনার সাথে কীভাবে কথা বলছি?’
‘জি।’

‘ওসব ভাবা বাদ দেন। আপনার কী সন্তান আছে?’
‘এক ছেলে আছে।’
‘কেউ যদি তাকে মেরে ফেলে আপনার কেমন লাগবে?’
‘ওকে কেউ কেন মারবে? ও কার কী ক্ষতি করেছে?’

‘দেখেছেন, আপনি তার মৃত্যুর কথা ভাবতেও পারছেন না। অথচ শুধুমাত্র কাহিনির প্রয়োজনে আরেকজনের ছেলেকে মেরে ফেলছেন।’

‘এটা মাত্র একটা উপন্যাস। এসব কোনো চরিত্রই বাস্তব না। একটাকে মারলে কিছুই হবে না। আর ওকে না মারলে কাহিনি ট্র্যাজিকও হবে না। পাঠকও খাবে না।’

‘সব চরিত্রই বাস্তব। আপনার মাথায় আমাদের বসবাস। এরপর হয়তো পাঠকদের মাথায় সঞ্চারিত হবো। কিন্তু আপনার মাথায় আজীবন রয়ে যাবো। হাজার লেখার ভিড়ে পাঠকের মাথায় একসময় আমরা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবো, কিন্তু আপনার মাথায়, একজন লেখকের মাথায় তার চরিত্র কখনই মরে যায় না, হারিয়ে যায় না। আপনি যদি কাহিনির প্রয়োজনে অক্ষরকে একবার মেরে ফেলেন তাহলে একে আর কখনই বাঁচানো যাবে না। সে হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো।’

‘এটা কোনো কথা হলো? কত চরিত্রকেই তো মেরে ফেলি।’
‘একে মারলে আমার মেয়ে যে সারাজীবন কষ্ট পাবে। আমি বাবা হয়ে সেটা কী করে মেনে নেই, বলেন?’
‘সিনেমার ডায়লগ দিয়েন না।’

‘আপনার ছেলের কসম। প্লিজ।’
‘আবার সিনেমার ডায়লগ!’

বিরক্তি নিয়ে আমার পাশে তাকালাম, আমার ছেলেটা দোলনায় শুয়ে আছে। সবে ছয় মাস হলো। ও দেখতে ঠিক আমার মতো আলাভোলা, আমার মতো খাড়া নাক, গোল গোল মায়াভরা চোখ, এলোমেলো চুল…

হঠাৎ মাথায় বিদ্যুৎ খেললো। চকিত একবার আমার কাহিনির চরিত্র অক্ষর আর আমার ছেলের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে যেন আমি আমার ছেলেকেই মারতে চাচ্ছি!

শওকত মোল্লা বলে উঠলেন, ‘আপনি একবার মন থেকে ভাবুন তো আপনি আসলেই অক্ষরকে মারতে চাচ্ছেন? এতো সুন্দর ভালোবাসাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন? নাকি শুধুমাত্র পাঠককে খাওয়াতেই তাকে মারছেন?’
‘ইয়ে মানে, মন থেকে তো চাচ্ছি না। পাঠককে খাওয়ানোর জন্য চাচ্ছি।’

‘একজন লেখককে নিজের মনের কথা শোনা উচিত। পাঠকরা বই পড়ে লেখকের মনের কথা জানতে — তাদের নিজেদের মনের কথা জানতে নয়।’

‘কিন্তু পাঠক না খেলে তো প্রকাশক টাকা দেবে না। এটাই আমার সপ্তম বই। আগের ছয়টাই মার খেয়েছে। এটা মার খেলে আমার ক্যারিয়ার একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার লেখা টাকা ছাড়া আর কেউ ছাপাবে না।’
‘পাঠককে খাওয়ানোর চিন্তা করেন দেখেই তো মার খান। একবার নিজের মনের কথা শুনে দেখেন।’

আমি ভাবতে শুরু করলাম। কী করা যায় কিছুই বুঝতে পারছি না। মিল দেবো? ধ্যাত, আমি কী সব আজগুবি কথা ভাবছি। আমার লেখার চরিত্র কী আর আমার সাথে কথা বলবে না! সবই ভ্রম। অক্ষরকে মরতেই হবে। এই কাহিনিটা অবশ্যই ট্র্যাজিক হবে।

কয়েক সপ্তাহ খেঁটে প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি দিলাম। তিনি মুখ ব্যাজার করে নিলেন। অনেকটা শাসানোর মতো করে বললেন, যদি না চলে তাহলে যেন আর মুখ না দেখাই।

বইমেলা এলো, চলেও গেল। প্রকাশক আমাকে একগাল কথা শুনিয়ে দয়া দেখিয়ে সবকপি বই আমাকে দিয়ে বিদায় করে দিলেন। বিদায় করার সময় বললেন, ‘এইসব গতানুগতিক প্রেম কাহিনি সস্তা হয়ে গিয়েছে। পাঠক এসব আর খায় না।’

আমার বাসায় সবগুলো কপি স্তুপ করে সাঁজালাম। বউ ছেলেকে নিয়ে তার বাবার বাসায় চলে গিয়েছে। সে আমার মতো অকর্মণ্য মানুষের সাথে সংসার করবে না।

সাতাশ বছর ধরে কেরানির চাকরি করছি। এখনও লিখি, কিন্তু আর গল্প লেখি না। লিখি অন্যের লেনদেন। আমার জীবনের লেনদেন যেন সব চুকিয়ে ফেলেছি।

কিছুদিন পর বউকে আনতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে তো এলোই না, উল্টো তার খালার সাথে আমার ছেলেকে নিয়ে বিদেশ চলে গেল। ছেলেটাকে কতদিন দেখি না। কেমন আছে সে? কীরকম দেখতে হয়েছে? ভাবি…

আলমারি থেকে আমার সপ্তম এবং শেষ উপন্যাসটা হাতে নেই। সেই যে অভিমানে লেখা ছাড়লাম, আর ছুঁয়েও দেখলাম না। লেখকদের অভিমান বোধহয় একটু বেশিই কড়া।

প্রকাশকের কথা এখনও কানে বাজে, ‘এইসব গতানুগতিক প্রেম কাহিনি সস্তা হয়ে গিয়েছে। পাঠক এসব আর খায় না।’

উপন্যাসের শেষ পাতায় এলাম, ঠিক করেছিলাম অক্ষরকে আত্মহত্যার মাধ্যমে মেরে ফেলব। সে সময় তার গায়ে থাকবে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। রুমের সিলিং এ ঝোলানো ফাঁসির ফাঁসের সামনে তখন যখন আনলাম, ঠিক তখনই আমার ছেলের কথা মনে পড়লো। আমি যেন দেখতে পেলাম, আমি আমার ছেলেকে মেরে ফেলছি। সাবিহার আকুতি, শওকত মোল্লার মিনতি যেন কানে বাজছিল। পারিনি — আমি আমার কাহিনির নায়ককে মারতে পারিনি। মিল দিয়ে দিয়েছি। আর তাতেই ট্র্যাজেডি হয়ে গিয়েছে গতানুগতিক মিলনাত্মক প্রেমকাহিনি। অন্তত প্রকাশকের ভাষায় তাই।

আজকে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পড়েছি, সিলিং এ দড়িটাও ঝুলিয়েছি। বইটা টেবিলে রেখে টুলে উঠে ফাঁসটা দুই হাত দিয়ে ধরে মুখের সামনে আনলাম। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, শওকত মোল্লা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তার পিছন থেকে প্রথমে অক্ষর, তারপর সাদা তোয়ালায় জড়ানো এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সাবিহা এসে দাঁড়ালো। আমি নেমে এলাম।

সাবিহা এগিয়ে এসে আমার কোলে বাচ্চাটাকে দিল। বাচ্চাটা দেখতে ঠিক আমার ছেলের মতো আলাভোলা, খাড়া নাক, গোল গোল মায়াভরা চোখ, এলোমেলো চুল…

সাতাশ বছর ধরে আমাকে এরা প্রতিবার আত্মহত্যার সময় এভাবেই বাঁচিয়ে রেখেছে, আর আমিও বেঁচে রয়েছি তাদের ভালোবাসায়।

এই কাহিনিটা ট্র্যাজিক নয়।

……………………………………………………………সমাপ্ত…………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত