গোয়েন্দা গল্প:তদন্তের খসড়া

গোয়েন্দা গল্প:তদন্তের খসড়া

পুরো ব্যাপারটা যেভাবে ঘটা উচিত, ঠিক সেভাবেই ঘটতে যাচ্ছিল। সূর্য যেমন পুব থেকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়, ঘোর অমাবশ্যার পর এক ফালি চাঁদ যেমন দিনে দিনে বড় হতে হতে ভরা পূর্ণিমার দিকে এগোয়, তেমন করেই। প্রকৃতির এমন অমোঘ নিয়মের মতই একটা সুদর্শন ছেলের সাথে একটা সুন্দরী মেয়ের প্রেম হতে পারে-এবং প্রেম থেকে পরিণয়ও।
সাকিব আর শ্যামলীর বেলায়ও তাই ঘটেছিল। সূর্যের পুব-পশ্চিমে উদয়-অস্ত কিংবা চাঁদের অমাবশ্যা-পূর্ণিমার মতই মসৃণ গতিতে।
তাছাড়া ওদের প্রেম আর পরিণয়ের বেলায় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে দু’জনের শিক্ষা দীক্ষা আর আর্থিক প্রাচুর্যও। ঢাকা শহরের বনানীতে শ্যামলীদের বিশাল বাড়ি আর ধানমণ্ডিতে সাকিবদের পাঁচ কাঠা জমি জুড়ে আলিশান ফ্লাট। শ্যামলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অন্যতম এক্সিকিউটিভ আর সাকিব মেধার জোরে অল্প বয়সেই নামকরা একটি দৈনিকের ডাকসাইটে বার্তা সম্পাদক। সুতরাং মাস ছয়েকের চুটিয়ে প্রেমের পরিণতি পরিণয়ে গিয়ে ঠেকতে বাধেনি কোথাও।
মোটামুটি ধুমধামের মধ্য দিয়েই দুই পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছে তাদের। এ পর্যন্ত চাঁদ-সূর্যের মতই স্বাভাবিক ও অমোঘ নিয়ম, বাকি জীবনটাও হয়তো আনুষঙ্গিক অপরাপর বিষয় নিয়ে ওই নিয়মেই কেটে যেতে পারত। কিন্তু কাটল না।
মধুচন্দ্রিমা কাটাতে হনলুলু কিংবা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার মত আর্থিক সঙ্গতি দু’জনেরই ছিল। কিন্তু ওসব জায়গায় না-গিয়ে একমাসের ছুটিতে রাঙামাটিতে গিয়েছিল তারা। তাও কারো একক সিদ্ধান্তে নয়, দু’জনেরই পারস্পরিক সম্মতিতে। বন্ধুবান্ধবের প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলেছে, ‘নিজের দেশে রাজার মত না-বেড়িয়ে আসামির মত পরের দেশে কেন বউয়ের সাথে প্রেম করতে যাব?’
আর কক্সবাজারের বদলে রাঙামাটিতে কেনÑতার জবাবে দু’জনেরই কাব্যিক জবাব, ‘নীল পাহাড়ের নিবিড় রহস্য যেমন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও তেমন হওয়া উচিত। তাতেই আবিষ্কারের অপার আনন্দ আর উপভোগের ছায়াঘন শিহরণ।’
বন্ধুরা এর বেশি আর ঘাটায়নি। সাকিব সাংবাদিক মানুষ, রহস্যটহস্য নিয়েই তো তার কাজকারবার। আর বান্ধবীরা জানত কলেজ জীবনে শ্যামলীর কবিতা লেখার বাতিকের কথা। সুতরাং দম্পতির রাঙামাটি থেকে ফেরার আশায় উৎসুক দিন কাটাচ্ছিল তারা। তাদের কারো কারো কাছে একমাস সময় খুব বেশি দীর্ঘ বলেও মনে হচ্ছিল।
তবে একমাস সময় আর লাগেনি। তার আগেই ফিরে এসেছে দু’জন। না, দু’জন নয়, একজন। সাকিব। আসলে সাকিবও নয়। সাকিবের লাশ। আর শ্যামলী গ্রেফতার হয়েছে খুনের আসামি হিসেবে। সাকিবকে খুনের অভিযোগে রাঙামাটি পুলিশ ওকেই গ্রেফতার করেছে। মোটিফ? সেটা পুলিশ এখনো পায়নি, তবে জোর তদন্ত চলছে। রাঙামাটি সদর থানা পুলিশের বড়কর্তা আশফাকুর রহমান বলেছেন, সাকিবের লাশ সুবলংয়ের এক পাহাড়ের কাছে পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। যে সাম্পানমাঝি তাদের ওই পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, সে-ই পুলিশকে প্রথমে সাকিবের মৃত্যুর কথা জানায়। ওকে জেরা করে পুলিশ জেনেছে, ওই পাহাড়ে সে সময় সাকিব আর শ্যামলী ছাড়া আর কেউ ছিল না। ময়না তদন্তে সাকিবের মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মানে সাকিবকে সম্ভবত আগে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। এরপর পাহাড় থেকে ঠেলে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। পুলিশের ধারণা, নির্জন পাহাড়ে এই কাজটা কেবল শ্যামলীর পক্ষেই সম্ভব। সাকিবের পত্রিকার রাঙামাটি প্রতিনিধি গৌরকিশোর চাঙমাও অবশ্য সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছে তার পাঠানো প্রতিবেদনে। তবে গৌরকিশোর শান্তি বাহিনীর প্রতিও সন্দেহের আঙুল উঁচিয়েছে।

দুই
সাকিবের পত্রিকা দৈনিক জাগরণের ক্রাইম সেকশনের তরুণ রিপোর্টার শোয়েব সাঈদ সাকিব-হত্যা নিয়ে রাঙামাটি থেকে পাঠানো গৌরকিশোর চাঙমার রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছে।
রাঙামাটি থেকে সাকিবের নিহত হওয়ার খবর প্রথম যখন অফিসে আসে, তখন সে ব্যস্ত ছিল আগারগাঁওয়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মিন্নত আলীর একমাত্র ছেলেকে অপহরণ ও ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে পাঠানোর ঘটনা নিয়ে। রাইট আপটা দারুণ দাঁড় করিয়েছিল। নিজে প্রতিভাবান, তাতে নিউজ এডিটর সাকিবুল হকের পরিচর্যা পেয়ে তর তর করে উঠে এসেছে শোয়েব। তাছাড়া ওপর মহলে বাবার পরিচিতির সুবাদে আর নিজের আন্তরিক খাটাখাটুনির কারণে কিছু সোর্স টোর্সও দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এদিকে ডিএমপির এডিসি কাজী জিয়ার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুত্বের সুফল কর্মজীবনেও টের পাচ্ছে। ঢাকা শহরের অপরাধ জগতের নাড়ি-নক্ষত্রের হদিশও মোটামুটি পাচ্ছে কিছু। জিয়া আগে খুলনায় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বেকার জীবনের শুরুতে কিছুকাল বন্ধুত্বের সুতোয় বিচ্ছিন্নতার গিট্টু পড়লেও খুলনার ছেলে শোয়েবের সঙ্গে খুলনাতেই ফের যোগাযোগ হয়ে যায় জিয়ার। মেধাবী সাংবাদিক বন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে সৎ পুলিশ অফিসার জিয়া সম্ভবপর কোন ইনফরমেশন দিয়ে সাহায্য করার কাজটা আনন্দের সঙ্গেই করে থাকে।
সাকিবুল হকের হত্যাকাণ্ডের সংবাদ অফিসের সবাইকে শোকে মুহ্যমান করে ফেলে। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে শোয়েবকে। আগারগাঁও-অপহরণ রিপোর্টের দারুণ রাইটআপটা অসমাপ্ত রেখেই শিফট ইনচার্জকে ইনফরমেশনগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে সে। ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে শিফট ইনচার্জ তেমন কিছু বলেননি।
সে রাতে ভাত খেতে পারেনি শোয়েব। ওর স্মৃতিতে কেবল ভেসে উঠেছে সাকিব ভাইয়ের শান্ত কিন্তু তেজী মুখটা।
সাকিব ভাই কেবল ওর নিউজ এডিটরই নয়, ওর গাইডও। দৈনিক জাগরণে সাকিব ভাই-ই ওকে নিয়ে এসেছিলেন দৈনিক নববাণী নামের একটি ওঁচা পত্রিকা থেকে। নববাণীতে ওর কয়েকটা রিপোর্ট দেখে একদিন ওই অফিসেই ফোন দিয়ে তাকে চান। দেখা করতে বলেন প্রেস ক্লাবে। প্রথম দিনই কোনোরকম রাখঢাক না-করে দৈনিক জাগরণে কাজ করার প্রস্তাব দেন। শোয়েব প্রস্তাবটা শুনে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার দরকার মনে করেনি। তারপর দিনই জয়েন করে। বেতন টেতন ওসব সাকিব ভাই ঠিক করে দিয়েছিলেন। তবে স্কেল এবং ওয়েজবোর্ডটা প্রথম দৈনিক জাগরণে এসেই পেয়েছে শোয়েব। সে সাকিব ভাইয়ের মত তরতাজা যুবক খুন হয়ে গেলেন বিয়ে করার পর এক মাস না পেরোতেই! ভাবতেই মাথা খারাপের উপক্রম শোয়েবের। প্রায় সারাটা রাতই এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে ও।
গৌরকিশোর তার রিপোর্টে পুলিশের স্টেটমেন্ট নিয়েছে। পুলিশ বলছে সাকিব ভাইকে শ্যামলী ভাবীই খুন করেছে। পুলিশের এই দাবির কারণ হলো, ঘটনার সময় ওই পাহাড়ে সাকিব আর শ্যামলী ছাড়া কেউ ছিল না। সুতরাং খুন করতে চাইলে শ্যামলীর জন্যে ওটাই ছিল সবচেয়ে সহজ উপায়। পাহাড়ে পাথরের অভাব নেই। গল্প করতে করতে শ্যামলীর পক্ষে সাকিবকে পেছন থেকে পাথরের আঘাতে অজ্ঞান করে তারপর ঠেলে হ্রদের পানিতে ফেলে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়।
কিন্তু শ্যামলী কেন তার নববিবাহিত প্রেমিক বরকে খুন করবে, সে প্রশ্নের জবাবে পুলিশের অনুমান, তাদের মধ্যে হয়তো কোনো ব্যাপারে মন কষাকষি হয়েছিল এবং তাতে ক্রোধের বশে শ্যামলীর পক্ষে সাকিবকে খুন করা অস্বাভাবিক নয়। গৌরকিশোরকে পুলিশের বড়কর্তা আশফাকুর রহমান নাকি বলেছেন, ‘আরে ভাই, ফ্যাক্টস আর স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। পড়েননি?’
গৌরকিশোর রাঙামাটির যে মোটেলে সাকিব ভাইয়েরা উঠেছিলেন, সে মোটেলের ম্যানেজারের বক্তব্যও নিয়েছে। মোটেলের ম্যানেজার তেমন কিছু বলতে পারেননি। গৌরের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সাকিব-শ্যামলী দম্পতির মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিক কিছু তিনি বা তার কর্মচারীরা দেখেননি। তবে যেদিন সাংবাদিক সাহেব খুন হন, সেদিন সকালে মোটেল থেকে বেরোনোর সময় দু’জনের মধ্যে খুব হাসিখুশি ভাব ছিল না, এটা তিনি খেয়াল করেছেন। না, ঝগড়া-বিবাদ বা মনোমালিন্যের কোনো আঁচ অবশ্য তারা পাননি।
গৌরকিশোর লিখেছে, শান্তি বাহিনী চাঁদার জন্যে কাজটা করতে পারে। পুলিশও সম্ভাবনাটা নাকচ করে দেয়নি। ওদিকে মোটেল ম্যানেজার নিজেও সে ভয় করেছেন। কিন্তু শোয়েব এই ব্যাপারে একমত হয়নি ওদের সাথে। শান্তি বাহিনী র্চাঁদার জন্যে খুন করবে না। খুন না করে অপহরণ করলেই তাদের লাভ। সাকিব ভাই এবং শ্যামলী ভাবী দু’জনকে অপহরণ করে দশ-বিশ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলে সেটা পূরণের আশা তারা করতেই পারত। সেটা না করে অনর্থক অচেনা একটা মানুষকে খুন করতে যাবে কেন?
কিন্তু সে জন্য গৌরকিশোর বা রাঙামাটি পুলিশ কাউকে দোষ দিতে পারছে না শোয়েব। গৌরকিশোর রাঙামাটি প্রতিনিধি হিসেবে দৈনিক জাগরণের জন্য নিউজ পাঠিয়েছে। একজন সাংবাদিক হিসেবে শোয়েব জানে, সাংবাদিকের খবর সংগ্রহের সুবিধে-অসুবিধের ব্যাপারটা। ওর পাঠানো নিউজে অনেক অসঙ্গতি রয়ে গেছে। ওদিকে পুলিশের বক্তব্যও সোজা। নির্জন পাহাড়ে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। সেখানে স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কেউ একজন যদি খুন হয়, তাহলে প্রথম সন্দেহটা স্বামী বা স্ত্রীর ওপরই পড়বে। পুলিশের জেরার জবাবে শ্যামলী ভাবী শুধু বলেছেন, ‘আমি কিছু জানি না। আমি আর সাকিব পাহাড়ে উঠে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। তারপর দুষ্টুমি করে লুকোচুরি খেলতে শুরু করি। আমি একটা ঝোপের আড়ালে লুকোই। সাকিব আমাকে খুঁজতে শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে ওর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি বেরিয়ে আসি। নিজেই ওকে খুঁজতে শুরু করি। ওর নাম ধরে ডাকি। শেষে সাম্পানমাঝিসহ ওকে খুঁজে পাই পাহাড়ের নীচে হ্রদের মধ্যে। ও তখন মারা গেছে। ও সাঁতার জানত না। আমার মনে হয়, আমাকে খুঁজতে গিয়ে পাহাড়ের একদম প্রান্তে চলে যাওয়ায় পা ফসকে পড়ে যায়। আমি কিছু টের পাইনি।’
বোঝাই যায়, শ্যামলী ভাবীর কথা বিশ্বাস করেনি পুলিশ। তারা তাকে অ্যারেস্ট করে কোর্টে চালান করে দিয়েছে। সেখান থেকে জেলহাজতে।

তিন
রিজার্ভ বাজারের বাংলাদেশ হোটেলের কেবিনে বসে গৌরকিশোর চাঙমাসহ সকালের নাস্তা সারছে শোয়েব। অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়ে গতকাল সন্ধেয় রাঙামাটি এসেছে সে। সাকিবুল হক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় প্রতিনিধি গৌরের রিপোর্টে ওর কৌতূহল মেটেনি। ও নিজে ক্রাইম রিপোর্টার। ক্রাইমের ওপর বেশ কিছু বহুল আলোচিত রিপোর্ট রয়েছে ওর। গত বছর ঢাকার পূর্র্ব রাজাবাজারে জোড়াখুনের ব্যাপারে ওর রিপোর্টের সূত্র ধরে পুলিশ শেষ পর্যন্ত খুনিচক্রের সন্ধান পেয়েছিল। বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল তখন। সরকারের কাছ থেকে একটা পুরস্কারও জুটেছিল। তবে পুরস্কারের চেয়ে সাকিব ভাইয়ের প্রশংসাকেই বড় মেনেছিল শোয়েব। সাকিব ভাই ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মনে হয় মিডিয়ার চেয়ে পুলিশে আরো ভাল করতে পারতি রে, শোয়েব। গোয়েন্দা পুলিশে নাম লেখাবি কিনা ভেবে দেখ।’
শোয়েব কেবল হেসেছে তখন। ক্রাইম রিপোর্টারকে পুলিশে পর্যন্ত সমীহ করে, জেনে গেছে সে। তবে সে রকম রিপোর্টার হতে হয় অবশ্যই। শোয়েব মনের ভেতর একধরনের চ্যালেঞ্জ অনুভব করে। সাকিব ভাই গত বছর তার প্রশংসা করেছিলেন। বছর না ঘুরতেই তিনি নিজেই সে ক্রাইমের শিকার। তাকে খুন করা হয়েছে এমন এক জায়গায়, যেখানে এমন আশঙ্কা প্রায় ছিল না বললেই চলে।
গৌরকে সাথে নিয়ে যে পাহাড়ে সাকিব ভাই খুন হন, প্রথমে সে পাহাড়ে গেল শোয়েব। নির্জন পাহাড়টা। আশেপাশের টিলায় চাকমাদের ঘরবাড়ি থাকলেও এই টিলায় ঘরবাড়ি নেই। পুরো টিলাটা ন্যাড়া বলতে গেলে। ছোট বুনো ঝোপঝাড়, বিশাল বিশাল কয়েকটা সিবিট গাছ আর রামকলার ঝাড়। দেখার মত আছে কেবল একটা ঝরনা, অনেক উঁচু থেকে নেমে এসেছে। স্বচ্ছ, নীল পানি। ঝির ঝির পানি ঝরার শব্দ শুনতে মিষ্টি মধুর গানের মত। এইটুকু শুধু বৈশিষ্ট্য। রাঙামাটিতে দেখার জন্য এর চেয়ে ভাল অনেক জায়গা আছে। তবু সাকিব ভাই আর শ্যামলী ভাবীর এখানে আসার আগ্রহ কেন হলো, বুঝতে পারছে না সে। তাছাড়া রাঙামাটি শহর থেকে পাহাড়টার দূরত্বও নেহাৎ কম নয়। নানা কথা বলছিল গৌর। বেশির ভাগই সাকিব ভাইয়ের প্রশংসা। সাকিব ভাই সত্যিই ভাল মানুষ ছিলেন। হানিমুনে এসে গৌরকেই বেছে নিয়েছিলেন গাইড হিসেবে। তাকে খুব সম্মান করত গৌর। নিজের পত্রিকার বার্তা সম্পাদক বলেই নয়, মানুষ হিসেবেও সাকিব ভাই অসাধারণ ছিলেন। সামান্য কদিনের পরিচয়ে শ্যামলী ভাবীও তাকে আপন করে নিয়েছিলেন ছোটভাইয়ের মত। সে সাকিব ভাই তার দেশে এসে খুন হয়ে গেলেন, ভাবতেই পারছে না সে।
গৌরের কাছে কিছু প্রশ্নের জবাব চেয়েছে শোয়েব। সাকিব ভাই খুন হওয়ার সময় তাদের ওই পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া সাম্পান মাঝি কোথায় ছিল? সে কি ওই পাহাড়ের কাছে অপেক্ষা করছিল? শ্যামলী ভাবী বলেছেন, সাম্পানমাঝিসহ তিনি সাকিবের লাশ খুঁজে পেয়েছেন পানিতে। সুতরাং ধরে নেয়া যাক, সাম্পানমাঝি পাহাড়ের কাছেই ছিল এবং শ্যামলী ভাবী তাকে ডাকামাত্র পেয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, খুনি সাকিব ভাইকে খুন করতে ওঠার সময় সে টের পায়নি কেন? ওই পাহাড়ে কি তাহলে খুনি আগে থেকেই বসেছিল? সাকিব ভাই আর শ্যামলী ভাবী যে সেদিন ওই পাহাড়েই যাবে, সে কি তাহলে জানত?
গৌর এর জবাব দিতে পারেনি।

চার
সাম্পানমাঝির নাম শামসু। ঝকঝকে কালো রঙ করা সাম্পান নিয়ে রিজার্ভ বাজারের সিঁড়িঘাটায় যাত্রীর অপেক্ষায় ছিল লোকটা। শোয়েব ওর কাছে গেল। গৌরকিশোরকে সঙ্গে নেয়নি ও। দূর থেকে ওর সাম্পানটা দেখিয়ে দিয়ে শোয়েবের কথামত সরে পড়েছিল ওখান থেকে।
সাম্পানের রঙের মতই কালো লোকটা। স্বাস্থ্যবান। ছোটবেলায় হওয়া বসন্ত রোগের দগদগে দাগ মুখে। একটা চোখ কিছুটা ঘোলাটে। অপরটা পরিষ্কার কালো। গোল মুখে চ্যাপ্টা নাক আর তার নীচে থ্যাবড়া দুই ঠোঁট।
সাম্পানের দাঁড়ে ক্যাঁক্কোরোৎ শব্দ তুলে যাত্রী ডাকছিল লোকটা। কাপ্তাই..সুবলং..বুড়িঘাট..। শোয়েব তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পানখাওয়া লাল দাঁত দেখিয়ে হাসল। ‘যাইবাননি সাব… কাপ্তাই..সুবলং..বুড়িঘাট..।
হাসল শোয়েবও। ‘হুঁ, সুবলং যাব। ভাড়া কত?’
‘আরে, আইয়েন। আমনেরা সা’ব মানুষ। আমনের গো লগে কিয়ের দরদাম?’
‘না। আগে ভাড়া ঠিক করো।’
‘দিয়েন ১০০ টাকা। আপডাউন হলে ২৫০।’
‘হ্যাঁ, আপডাউন। যাব আবার আসব।’
‘ছার, কই থাইকা আইছেন? ঢাকা থাইকা?’
‘না, রাজশাহী থেকে। কেন?’
‘না না, এমনি জিগাইলাম। তয় উডেন ছার।’
সাম্পান রিজার্ভ বাজার ঘাট ছেড়ে পুবদিকে চলল। মৃদু বাতাসে হ্রদের বুকে ঢেউ খেলছে। পুবদিকে নিবিড় নীল পাহাড়। আকাশের সাথে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমানোর দৃশ্য কল্পনা করে লেখা গানটা গাইতে ইচ্ছে করছে শোয়েবের। মন চাইছে পরিষ্কার ঝকঝকে নীলাকাশের নীচে মৃদু ঢেউজাগা পানিতে হাত ভেজাতে। নির্ভার মন হলে চুটিয়ে উপভোগ করার মত দৃশ্য বটে।
কিন্তু শোয়েবের মনে চিন্তার ঝড়। সাকিব ভাই কেন খুন হলো, সারাক্ষণ এই চিন্তাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়। নীল পাহাড়ী চট্টলার অনুপম রূপৈশ্বর্যে মন ঢেলে দেয়ার অবকাশ পাচ্ছে না।
সাম্পান মাঝি দাঁড় বাইছে। অবিরাম শব্দ হচ্ছে ক্যাঁক্কোরোৎ…। শব্দটার মধ্যেও একধরনের ছন্দ। অভ্যস্ত হাতের কারিগরিতে দু’পাশে কাঠের দুটো দাঁড়ের পাতা পেছন দিকে উল্টে দিচ্ছে পানিকে। তারই প্রতিধাক্কায় রাজহাঁসের মত গলা বাড়িয়ে এগোচ্ছে সাম্পান। রাঙামাটি পাড়ি আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে পুবের পাহাড়গুলোর দিকে যাচ্ছে।
‘সূর্য উডেল্লে ভাই লাল মারি
লুসাই পাহাড়ত্তুন নামিয়েরে
যারগৈ কর্ণফুলী…
সাম্পানমাঝি গান ধরেছে। বোঝাই যাচ্ছে, কোনো কারণে মনে বেজায় ফুর্তি লোকটার।
‘মাঝিভাই, সাম্পান বাইছ কতদিন ধরে?’ লোকটার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছে শোয়েব।
সাম্পান মাঝি হাসল। বোঝা গেল, সেও কথা বলার জন্যে মুখিয়ে ছিল এতক্ষণ। কিন্তু সাহেবের মুড অফ দেখে মুখ খোলেনি।
‘তা অইব পেরায় বছর বিশেক। সাব, কোতায় উটেছেন? হোটেলে নাকি মোটেলে?’
‘আজ সকালেই তো আসলাম। দেখি হোটেলে…আচ্ছা, ভাল একটা হোটেলের নাম বলো তো?’
‘ভালা হোটেল আর কই পাইবেন? সব খানেই তো হৈ চৈ..হট্টগোল। তার চেয়ে মোটেলে উডেন।’
‘মোটেল?’
‘হ্যাঁ, ছার। বনরূপার মোটেল নিবিড় নীলিমা এখানকার সবচেয়ে ভালা মোটেল।’
‘ওরে বাবা! মোটেলে তো অনেক টাকা নেবে।’
‘আমি কইয়া দিলে অনেক কম নিব।’
‘তুমি বললে কম নেবে? তুমি তো সামান্য সাম্পানমাঝি, মোটেল তোমার কথা শুনবে?’
‘ছার, সাম্পানমাঝি বলি ঘৃণা করেন, ঠিক আছে। কিন্তু আমরা কথা কইলে…’ থেমে গেল। সামান্য সাম্পানমাঝি বলায় মাইন্ড করেছে লোকটা।
প্রায় পৌণে একঘণ্টা পর। সাম্পান এখন কাইন্দা পাহাড়ের পাশ ঘেষে যাচ্ছে। এই টিলায় খুন হয়েছিলেন সাকিব ভাই। টিলাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে শোয়েব। শান্ত নির্জন টিলা। মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। দু’একটা পাখপাখালির ডাক শোনা যাচ্ছে মাত্র। দেখেই বোঝাই যাবে না, মাত্র দিন পনেরো আগে এখানে ঘটে গেছে একটি বিয়োগান্ত ঘটনা, যে ঘটনায় সাকিব ভাইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে আর শ্যামলী ভাবীকে স্বামী-হত্যার দায় কাঁধে নিয়ে রাঙামাটির জেলখানায় পচে মরতে হচ্ছে। শোয়েব গোয়েন্দা নয়, সে একজন ক্রাইম রিপোর্টার। দৈনিক জাগরণের রাঙামাটি প্রতিনিধি গৌরকিশোরের পাঠানো রিপোর্ট তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে সে নিজে এসেছে ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখতে। কিন্তু কী দেখছে, আর কী দেখতে চাইছে বুঝতে পারছে না সে। বুঝতে পারছে না কাকে কী জিজ্ঞেস করবে? রাঙামাটি বেড়াতে এসে ঢাকার একজন সাংবাদিক খুন হয়েছে, এখানকার মানুষের কাছে তা তাৎক্ষণিকভাবে শোনার মত একটি খবরের বেশি কিছু আর নয়। আর খুনোখুনির ব্যাপারটা এখন এত স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, এ নিয়ে খুব বেশি কৌতূহল দেখানোর দরকার মনে করে না মানুষ।
‘শামসু,’ সাম্পান মাঝিকে ডাকল শোয়েব।
‘জি ছার?’ সাড়া দিল সাম্পান মাঝি। কৌতূহলী চোখে চাইল। পরক্ষণে মুখের ভাব পাল্টে গেল লোকটার। সরু চোখে চাইল। ‘আমনে আমার নাম জানলেন কেমনে?’ শোয়েব তার কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘এই টিলাটায় একটু নামব।’
‘এই টিলায় নামবেন? কেন?’
‘আহ্, থামাও তো? এত প্রশ্ন করছ কেন?’
‘এই টিলায় নামা যাবে না। এইখানে শান্তি বাহিনীর ভয় আছে। কদিন আগে একজনরে মারছে। ঢাকা থেকে আইছিল বউ লইয়া। বেডারে মারি বউডারে ধরি লই গেছে। পেপারে পড়েন নাই? আমনেরা শিক্ষিত মানুষ…’
জোরে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করল শামসু মাঝি। রাজশাহী থেকে আসা ওর প্যাসেঞ্জার কী করে ওর নাম জানল, দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল না। সুবলং পৌঁছে বলল, ‘আপডাউন যামু না, ছার। আমনে আঁর ভাড়া দিয়া দেন।’
শোয়েব ওর ভাড়া মিটিয়ে দিল।

পাঁচ
বনরূপা। রাঙামাটির নামকরা মোটেল নিবিড় নীলিমা এখানেই। বাংলাদেশ হোটেলে গৌরকিশোরসহ নাস্তা খেয়ে নিল শোয়েব। তারপর তাকে কাছে পিঠে থাকতে বলে ট্যাক্সি ভাড়া করে রিজার্ভ বাজার থেকে নিবিড় নীলিমায় এল। গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে লোকটার দিকে চোখ পড়ল শোয়েবের। হন হন করে বেরিয়ে আসছে। শোয়েবকে খেয়াল করল না। লোকটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে একই সাথে ভীত ও বিরক্ত। দামি সুতীর লুঙ্গিটায় ফাঁৎ ফাঁৎ শব্দ তুলে শোয়েবের প্রায় গা ঘেঁষেই গেটের বাইরে চলে গেল।
অবাক হলো শোয়েব। নিবিড় নীলিমার মত অভিজাত একটি মোটেলে একজন সাম্পানমাঝির কী কাজ থাকতে পারে? গতকাল লোকটা তাকে নিবিড় নীলিমায় ওঠার জন্যে সেধেছে। বলেছে, ভাড়া বেশি মনে হলে সে বলে কয়ে কমিয়ে দিতে পারবে। তার মানে কি লোকটা নিবিড় নীলিমার খদ্দের ধরার দালাল? খদ্দের এনে দিতে পারলে কমিশন পায়? কিন্তু এমন অভিজাত মোটেলের খদ্দের ধরার দালাল একজন অশিক্ষিত সাম্পানমাঝি হয় কী করে?
ব্যাপারটাকে এক পাশে সরিয়ে রাখল সে। মোটেলে একজন সাম্পানমাঝি কেন এল, সেটা নিয়ে এ মুহূর্তে মাথা ঘামানোর দরকার মনে করছে না। তাই বলে বিষয়টাকে হালকাভাবে নেয়ার কথাও ভাবছে না সে। তবে আপাতত ওর উদ্দেশ্য হলো, মোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলা।
ম্যানেজার লোকটার বয়স বছর চল্লিশ। খাটো চেহারার ফরসা লোকটা। গোঁফ-দাড়ি কামানো পরিচ্ছন্ন চেহারা। ভুরু কুঁচকে আগন্তুকের দিকে তাকাল।
নিজের পরিচয় দিল শোয়েব। সাথে সাথে যেন আগুনের মত ঝলসে উঠল ম্যানেজার। ‘কী পেয়েছেনটা কী আপনারা? সাংবাদিক হয়েছেন বলে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি? আপনার লোক আমার মোটেলে খুন হয়নি। খুন হয়েছে কাইন্দার পাহাড়ে। যান, সেখান গিয়ে খোঁজ করুন গিয়ে। কেউ নিষেধ করবে না। আমাদের জ্বালাতে এসেছেন কেন?’
এরকম আপ্যায়ন আশা করেনি শোয়েব। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। মিন মিন করে বলল, ‘ভাই, আপনি রাগ করছেন কেন? আমি তো আপনাকে খারাপ কিছু বলিনি। আমরা সাংবাদিক মানুষ। অফিস থেকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। সেটা পালন করতে গেলে আপনাদের কাছে তো সাহায্যের জন্যে আসতেই হবে। আপনারা সাহায্য না করলে…’
‘কেন, এর আগেই তো ওই চাকমা সাংবাদিক এসে কথা বলে গেছে। তারপর পুলিশ এসে জ্বালিয়েছে। কজনের সাথে কথা বলতে হবে? মোটেল খুলে কি অপরাধ করে ফেলেছি নাকি? এভাবে সারাক্ষণ খুনখারাপির খোঁজখবর নিতে এলে কাস্টমার পাব আমরা? মোটেল বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে হবে…’ কথা বন্ধ করে একজন রূমবয়ের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, ‘এই ব্যাটা, ২৭ নম্বর কমপ্লেন করেছে, সকাল থেকে ওই রূমের ডিশে প্রবলেম দিচ্ছে। আমাকে বলেছিলি?’ তারপর ফের ফিরল শোয়েবের দিকে। ‘যান ভাই, ঝামেলা পাকাবেন না। যা বলেছি, পুলিশকে বলেছি। ওদের কাছে গিয়ে জেনে নিন আপনার কী জানার আছে।’
‘যাচ্ছি। তবে একটা দয়া করে একটা প্রশ্নের জবাব অন্তত দিন।’
‘কী প্রশ্ন?’
‘আচ্ছা শামসু মাঝি কি আপনাদের খদ্দের ধরে দেয়ার কাজ করে থাকে? লোকটা বলেছিল আপনাদের…’
‘ক্কী বলেছে…আরে ধ্যাৎ মিয়া কোথাকার কোন শামসু মাঝি? যান তো যান, ভাগেন।’

ছয়
রাঙামাটি থেকে ফিরে এসে অফিসে যোগ দেয়নি শোয়েব। ওর ছুটি শেষ হওয়ার আরো দু’দিন বাকি। সকালে উঠে পত্রিকার পাতা উল্টে রাঙামাটি প্রতিনিধির পাঠানো ছোট্ট নিউজটা প্রথম পাতায় চোখে পড়ল ওর। শামসু মাঝি নামের একজন সাম্পানমাঝির লাশ পাওয়া গেছে গতকাল বুড়িঘাটের কাছে আম্বুরি পাড়া নমের এক জায়গায়। লোকটাকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ, কাজটা শান্তি বাহিনীর। ওর সাম্পানটা ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। রাঙামাটি প্রতিনিধি লিখেছে, দৈনিক জাগরণের বার্তা সম্পাদক সাকিবুল হকের খুন হওয়ার কথা এই লোকটিই জানিয়েছিল পুলিশকে।
গৌরকিশোরকে ফোন করল শোয়েব। কিছুক্ষণ আলাপ করে নিল ওর সাথে। তারপর বেরোল। ওর গন্তব্য ডিএমপি এডিসি কাজী জিয়ার অফিস।

চুপচাপ শোয়েবের কথা শুনল জিয়া।
‘তুই কি কাউকে স্পেসিফিক সন্দেহ করছিস?’ চায়ের কাপটা ঠক করে টেবিলের ওপর রেখে প্রশ্ন্ করল।
‘আমার সন্দেহের তালিকায় আছে সাম্পানমাঝি শামসু মিয়া, মোটেল নিবিড় নীলিমার ম্যানেজার আবদুল বাসেত আর…’ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল শোয়েব। ‘তোদের ওই পুলিশ কর্মকর্তা আশফাকুর রহমান।’
‘কী?’
‘হ্যাঁ। সাম্পান মাঝি গতকাল খুন হয়ে গেছে। পুলিশ বলেছে, শান্তিবাহিনীর কাজ। নাহ্, সব দেখছি, শান্তি বাহিনীই করছে। বুঝছি না, ঢাকার দৈনিক জাগরণের নিউজ এডিটর শান্তিবাহিনীর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে, তাকে খুন না করলে তাদের চলছিল না। অথচ লোকটাকে চিনতই না ওরা। আর যদি চিনতেই পারত, তাহলে তো উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে চাঁদা চাইলে টাকা-পয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। আর একটা সাম্পানমাঝিকে খুন করে ফেলল, তাও শান্তিবাহিনী? নাহ্, একজন পুলিশ হিসেবে তুই-ই বল, অনুমান দিয়ে অপরাধী ধরা যায়?’
‘হুম। বলে যা।’
‘শামসু মাঝি কখনো মুখ খুলতে পারে, এ ভয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে ওকে। বাকি দু’জন। মোটেল ম্যানেজার আর তোর ওই আশফাকুর রহমান। মোটেল ম্যানেজার সাকিব ভাইকে খুন করবে কেন? তার মোটিফ কী? নিজের ব্যবসার ক্ষতি করে অজানা অচেনা একজন লোককে খুন করে ওর লাভটা কী? কিংবা লাভ আছে। হোটেল মোটেল ব্যবসায়ীদের পুলিশের সাথে হাত রাখতে হয়। হয় কিনা?’
‘তুই দেখছি চেনা জানার ওপর খুব গুরুত্ব দিচ্ছিস। তাহলে কী বলতে চাস, আশফাকুর রহমান সাকিব সাহেবকে চিনত?’
‘না, চিনত না। তবে শ্যামলী ভাবীকে চিনত। লোকটা এক সময় ভালবাসত শ্যামলী ভাবীকে। তখন ওরা ইন্টারে পড়ত ঢাকা কলেজে। অশ্লীল আচরণ করায় জুতো দেখিয়েছিলেন ওকে শ্যামলী ভাবী কলেজ ক্যাম্পাসে।’
‘তুই কী করে জানলি?’
‘আমি কী করে জানলাম, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু যা জেনেছি, তা সত্যি কি মিথ্যে যাচাই করে দেখতে পারিস। আমার সন্দেহ সত্যি হবে, তা বলছি না। তবে আমি তোর হাতে তদন্তের একটা খসড়া ধরিয়ে দিলাম। তুই বরং আমার জানাটাকে সম্ভাবনা হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করার ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা দেখ। তোদের আশফাকুর রহমান সাহেব বলেছেন, ফ্যাক্টস আর স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আমি তার কথাটাকে উড়িয়ে দিতে চাই না। তিনি আরেকটা কথা আমাকে বলেছেন। বলেছেন, শ্যামলীর মত মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না। বিচারাধীন একটা মামলায় নিজের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত সন্দেহভাজন মহিলা আসামীর ব্যাপারে এরকম মন্তব্য কোনো পুলিশের করা স্বাভাবিক কিনা তুই-ই ভেবে দেখ। কথাটা অবশ্য বেফাঁসে বলে ফেলেছেন। ওখানেই আমার সন্দেহের ভিত্তি। আমি ওটাকেই পয়েন্ট হিসেবে নিয়েছি। শ্যামলী ভাবী ঢাকা কলেজে ইন্টার পড়েছেন জানা ছিল বলেই খোঁজ নেয়াটা সম্ভব হয়েছে। একতরফা প্রেমের ব্যাপারটা মাথায় রাখ। প্রত্যাখ্যানের জ্বালা অবশ্য আমার নেই। তোর আছে কিনা জানি না। ভার্সিটিতে তো মেয়েদের যমের মত ভয় করেছিস দেখেছি। তোদের পুলিশের শাস্ত্রেই তো আছে, খুন খারাবির ব্যাপারে মোটিফ একটা ভাইটাল জিনিস। ভেবে দেখ, একটা লোক বউ নিয়ে বেড়াতে গিয়ে খুন হয়ে গেছে। পুলিশ স্বামী-হত্যার অভিযোগে বউটাকে অ্যারেস্ট করে চুপচাপ বসে আছে। ওরা যে মোটেলে থাকত, সে মোটেলে একটা প্রপার ইনভেস্টিগেশন পর্যন্ত হয়নি। মনে হচ্ছে পুলিশই যেন চাইছে যেন মেয়েটার ফাঁসি হয়ে যায়। এটা কি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নাকি অবহেলা? দেখ, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের জন্যে জ্বালা জুড়ানোর চেয়ে ভাল মোটিফ আর কী চাই? কেন তুই কি পুলিশকে মানুষ মনে করিস না? ওরা অপরাধ করতে পারে না? তুই ফেরেশতা বলে সবাই কি তা-ই?

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত