মানিকচৌরির ভূত-বাংলো

মানিকচৌরির ভূত-বাংলো

সঞ্জু আর আমি হরিহর আত্মা। আমরা এক পাড়াতেই থাকি। লোকে আমাদের মাণিকজোড় বলে ডাকে। সঞ্জুর ভালো নাম সঞ্জনকান্তি। ওর দাদা অঞ্জনকান্তি এখন খড়গপুর আই.আই.টি.-তে রিসার্চ করছে। শুধু সঞ্জুর দাদা নয়, ওদের বাড়ির সবাই খুব মেধাবী আর উচ্চশিক্ষিত।

সঞ্জুদের বাড়িতে গেলে মনে হয় ঠিক যেন কোনও কলেজে ঢুকে পড়েছি। বাড়িতে অধ্যাপকের ছড়াছড়ি। সঞ্জুর বাবা বিমলকান্তি বঙ্গবাসী কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ান। আর এক কাকা কমলকান্তি ইতিহাস পড়ান পর্ণশ্রী কলেজে। ওদিকে ঠাকুরদা দুর্লভকান্তি এবং তাঁর দাদা দুর্জয়কান্তি, দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। দুর্জয়দাদু তো আবার রিটায়ার করেছেন সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে। শুধু সঞ্জুর ছোটকাকা অমলকান্তি অধ্যাপনার রাস্তায় হাঁটেননি। যদিও লেখাপড়ায় উনি কারোর থেকে কম যান না – ম্যাথমেটিক্সে ডক্টরেট। এখন যাদবপুরের কালটিভেশন অফ সায়েন্সের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট। সঞ্জুর মাথাও খুব ভালো। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে তো আমরা একসাথে পড়ছি। আমার ধারণা, বংশের ধারা মেনে ও-ও একদিন কেউকেটা হবে।
সঞ্জুদের বাড়িতে ওর পড়ার ঘরে বসে আমরা দুজন প্রায়ই একসাথে পড়াশোনা করি। ঠিকঠাক বললে সঞ্জু আমাকে পড়ায়। বিশেষত মাধ্যমিক পাশ করার পর যখন সায়েন্স নিলাম, তখন থেকে ও-ই আমার গাইড। কীভাবে কেমিস্ট্রির ইয়া বড়ো বড়ো ইকোয়েশনগুলো মনে রাখতে হবে কিংবা ফিজিক্সের প্রবলেমগুলো সলভ্‌ করতে হবে, সেসব ও আমাকে দেখিয়ে দেয়। আর যখন ওর কিছু আটকায়, তখন বাবা-কাকার শরণাপন্ন হয়। তবে আমাদের দুজনের কাছেই সবচেয়ে প্রিয় সঞ্জুর ছোটকা অর্থাৎ অমলকাকু।
অমলকাকু একজন অঙ্ক-পাগল লোক। অঙ্কই ওঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। বছর পাঁচেক আগে কাকুর যখন ছেলে হল, উনি ঠিক করলেন তার নাম রাখবেন পিথাগোরাস। ব্যস, বাড়িময় শোরগোল পড়ে গেল। কাকিমা তো ঐ অসুস্থ শরীরেও নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। সঞ্জুদের বাড়ির সবাই কাকুকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন নামটা পাল্টানোর জন্য। কিন্তু কাকু নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

এমতবস্থায় দুর্জয়কান্তি মানে অমলকাকুর জ্যাঠামশাই আসরে নামলেন। গোটা পাড়ার লোক দুর্জয়দাদুকে শ্রদ্ধা করে। অমলকাকুও কোনওদিন ওঁর কথা অমান্য করেননি। সেই ভরসাতেই দুর্জয়দাদু ভাইপোকে বোঝাতে উদ্যত হলেন। বললেন, “বাবা অমু, পিথাগোরাসের মতো গণিতজ্ঞ সারা পৃথিবীতে যে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর নাম স্মরণীয় করে রাখতে যদি একটা বনেদি বাঙালি পরিবারের ছেলের নাম হয় পিথাগোরাস চট্টোপাধ্যায়, তাহলে কেমন শোনায় বল দেখি। লোকে তো হাসবে। আমি বলি কি, ভারতেও তো অনেক নামকরা গণিতবিদ জন্মেছেন। তাঁদের কারোর নাম যদি…”
দুর্জয়দাদুর কথা শেষ হল না। অমলকাকু বললেন, “ঠিক আছে। তুমি যখন এতো করে বলছ, পিথাগোরাস নামটা তাহলে বাদই দিলাম। ছেলের নাম হোক তবে বরাহমিহির।”

নামটা শুনে দুর্জয়দাদু আরেকটু হলে ভিরমি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন। কোনওমতে নিজেকে সামলালেন। মনে মনে ভাবলেন, এর থেকে পিথাগোরাসই ছিল ভালো। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তিনি অমলকাকুকে বললেন, “নামটা তুই ভালই বেছেচিস। কিন্তু তোর ছেলেকে তো বড়ো হয়ে মনুষ্য সমাজে মেলামেশা করতে হবে। তখন নামের ঐ প্রথম অংশটুকু ওকে বড়োই বিড়ম্বনায় ফেলবে। তাই বলছিলাম কী, তোর পছন্দের নামের সাথে দুটো শব্দ একটু যোগ বিয়োগ করে নে না বাবা।”

অঙ্কের প্রসঙ্গ এলেই অমলকাকুর মনটা প্রসন্ন হয়ে যায়। তিনি জ্যাঠার কাছে কোন দুটো শব্দ যোগ বিয়োগের কথা হচ্ছে, তা জানতে চাইলেন। জবাবে দুর্জয়দাদু বললেন, “আমাদের বংশের সমস্ত ছেলের নামের সাথে ‘কান্তি’ যুক্ত করার একটা রীতি আছে। তাই তুই তোর পছন্দের নামের সাথে ঐ কান্তিটা যোগ করে প্রথমের ‘বরাহ’টা বিয়োগ করে দে। তাহলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না।”

অমলকাকু সেদিন আর জ্যাঠামশাইয়ের কথা ফেলতে পারেননি। যোগ বিয়োগ করে ছেলের নাম মিহিরকান্তি রাখাই সাব্যস্ত করেছিলেন। আর ঐ সিদ্ধান্তে সেদিন গোটা চ্যাটার্জি পরিবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কাকিমাও অনশন ভঙ্গ করেছিলেন।

এহেন অমলকাকু একদিন সঞ্জু আর আমাকে একটা বেড়ানোর প্রস্তাব দিলেন। আমরা দুজন তখন সবে ক্লাস টুয়েলভে উঠেছি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। গরমটা বেশ ভালোই পড়েছে। এক রবিবারের দুপুরে আমরা দুজনে সঞ্জুর পড়ার ঘরে অঙ্ক করছিলাম। একটা ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস সঞ্জু কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না। আমাকে বলল, “চ, ছোটকার কাছে যাই।”

ওঁর ঘরে যাওয়া মাত্র অমলকাকু অবজ্ঞাভরে একবার সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে, নিমেষে অঙ্কটা কষে দিলেন। তারপর আমাদের দুজনের উদ্দেশেই বললেন, “এ মাসের শেষে দিন পাঁচেকের ছুটি পাচ্ছি। ঠিক করেছি একটা দারুণ জায়গায় দুটো দিন কাটিয়ে আসব। ছেলেটা ছোটো বলে তোদের কাকিমা অত দূরে যেতে রাজি হচ্ছে না। তাই ভাবছি একাই যাব। তবে ঐ সময়ে তো সামার ভেকেশন। তাই চাইলে তোরাও আমার সাথে যেতে পারিস।”

বেড়ানোর প্রস্তাবে তো আমরা একপায়ে খাড়া। সঞ্জু জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় যাবে গো ছোটকা?”
অমলকাকু জবাবে বললেন, “মানিকচৌরি। ছত্তিশগড়ের একটা ছোট্ট জায়গা। সেখানে পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা, গুহা সব একসাথে আছে। আর থাকার জন্য পাবি একটা চমৎকার বাংলো, একদম নিখরচায়।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “খরচা লাগবে না কেন? বাংলোটা আপনার পরিচিত কারোর নাকি?”
“ঠিকই বলেছিস। বাংলোটা আমার কলেজের এক বন্ধু সাত্যকির। আসলে সাত্যকি ওর এক নিঃসন্তান জ্যাঠার কাছ থেকে ঐ বাংলোটা পেয়েছে। ঐ জ্যাঠা ব্যাবসার কাজে মধ্যপ্রদেশে থাকতেন। যাই হোক, বাংলোটা এখন খালিই পড়ে আছে। মাঝে মধ্যে দু’একজন টুরিস্ট ওটা ভাড়া নেয়। স্থানীয় একটা লোক বাংলোটা দেখাশোনা করে।”

এবার সঞ্জু জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ঐ বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করেছ? উনি থাকেন কোথায়?”
“সাত্যকি থাকে ল্যান্সডাউনে। ফোনে ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। আজ বিকালেই ও আসছে আমার কাছে। তোরা যদি যেতে রাজি থাকিস, তাহলে সাত্যকি এলে আমার ঘরে চলে আসিস। সবাই মিলে ট্যুর প্ল্যানটা ঠিক করে নেওয়া যাবে।”

সেদিন বিকাল পাঁচটা নাগাদ কাকুর ঐ বন্ধু এসে হাজির হলেন। আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “মানিকচৌরি জায়গাটা খুব সুন্দর। তবে ওখানে যাওয়াটা একটু ঝামেলা। ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে যাওয়ার তো অনেক ট্রেন আছে। সমস্যাটা হয় এর পরে। তোমাদের প্রথমে রায়পুর থেকে গাড়ি নিয়ে অভনপুর জংশন যেতে হবে। সেখান থেকে ন্যারোগেজ লাইনে ট্রেনে চেপে পৌঁছতে হবে মানিকচৌরি। দিনে মাত্র একজোড়া ট্রেন। একটা সকালে আর একটা বিকেলে। আগে ঐ লাইনে প্রায়শই ডাকাতি হত। ডাকাতরা যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে-কুড়ে নিত। আর কারোর কাছে কিছু না পেলে তাকে খুব মারধোর করত। এখন অবস্থার খানিক উন্নতি হয়েছে।”

ঐ ডাকাতির ব্যাপারটা শুনে অমলকাকু একদম মুষড়ে পড়লেন। আসলে উনি খুব ভীতু প্রকৃতির মানুষ। আর একবার ভয় পেলে দেখেছি, ওঁর বিচার বুদ্ধিও এক্কেবারে লোপ পেয়ে যায়। উনি সাত্যকিকাকুকে বললেন, “তাহলে তো ওখানে যাওয়া মুশকিল হয়ে গেল। আমি একা গেলে কোনও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সঙ্গে যে ঐ বাচ্চা ছেলেদুটোও থাকবে। ওদের নিয়ে আমি কীভাবে রিস্ক নিই বল?”

সাত্যকিকাকু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই সঞ্জু মন্তব্য করে বসল, “ডাকাত-ফাকাতে আমাদের কোনও ভয় নেই। তুমি যদি নিজে যেতে ভয় পাও, সেটা আলাদা ব্যাপার।”

সঞ্জুকে নিয়ে এই এক সমস্যা। ও যা ঠিক মনে করে তাই মুখের ওপর বলে দেয়, ছোটো-বড়ো জ্ঞান করে না। তবে একথাও ঠিক যে সঞ্জুর মধ্যে ভয়-ডর বিশেষ একটা নেই। সাপখোপ, পোকামাকড়, চোর-ডাকাত – কোনও কিছুকেই ও বড়ো একটা কেয়ার করে না। ও একদিকে সাপুড়েদের কাছ থেকে নেওয়া ইয়াব্বড়ো জ্যান্ত সাপ গলায় পেঁচিয়ে ‘শিবঠাকুর’ সাজতে পারে আবার মাঝরাত্তিরে খুটখাট শব্দ শুনে একাই লাঠি হাতে বাইরে বের হতেও ওর বুক কাঁপে না। এছাড়া ওর উপস্থিত বুদ্ধিও খুব।

অমলকাকুও সঞ্জুর স্বভাব ভালোই জানেন। তাই উনি আর কথা বাড়ালেন না। বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ওদের দু’জনের যখন কোনও আপত্তি নেই, তখন আর সমস্যা কোথায়? এখন মানিকচৌরি নেমে কীভাবে তোর বাংলোয় পৌঁছব, সেটা একটু বলে দে।”

সাত্যকিকাকু তাঁর বাংলো পৌঁছনোর রাস্তা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, “দ্যাখ অমল, আমি শেষবার মানিকচৌরি গিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে। তবে রামদয়াল মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন করে ওখানকার খবরাখবর জানায়। বাংলোটার বুকিং হলে সে খবরও দেয়। এজন্য অবশ্য আমি ওকে পারিশ্রমিকও দিই। আসলে ও-ই সারাবছর বাংলোটা দেখাশোনা করে। এমাসে এখনও ও আমাকে ফোন করেনি। করলেই আমি তোদের যাওয়ার খবরটা ওকে দিয়ে দেব।”

“আর বাইচান্স ফোন যদি না করে?”
“আরে, সেক্ষেত্রে ক’টা দিন দেখে আমিই ওর সাথে যোগাযোগ করব। ওর নিজের ফোন নেই বটে, তবে ওদের বাড়ির পাশেই একটা পাবলিক বুথ আছে। কোনও জরুরি দরকার থাকলে আমি ওখানেই ফোন করি। রামদয়াল সাথে সাথে খবর পেয়ে যায়। তুই ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না।”

একথা শুনে অমলকাকু স্মার্টলি জবাব দিলেন, “না না, চিন্তার কী আছে। তুই রামদয়ালের সাথে যোগাযোগ করতে না পারলেও ক্ষতি কিছু নেই। আসলে কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা অচেনা অজানা জায়গায় গিয়ে পড়ার মজাটাই আলাদা।”

।। দুই।।

মে-এর শেষে, নির্দিষ্ট দিনে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মানিকচৌরির উদ্দেশ্যে। অভনপুর জংশন অব্দি যেতে কোনও সমস্যা হল না। আমরা ওখানে বেলা দু’টো নাগাদ পৌঁছলাম। ওদিকে মানিকচৌরি যাওয়ার ট্রেন বিকাল সাড়ে চারটেয়। স্টেশনটা মোটেই ছোটো নয়। তবে লোকজন খুব একটা নেই। ট্রেনের জন্য প্রায় আড়াই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। তাই আমরা টিকিট কেটে প্লাটফর্মের একপ্রান্তে থাকা একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। লাগেজ আমাদের বেশি হয়নি। প্রত্যেকেই একটা করে ন্যাপ-স্যাক নিয়েছি। তাই চলাফেরায় কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।

অভনপুরে পৌঁছনোর পর থেকেই সাত্যকিকাকুর মুখ থেকে শোনা ট্রেন ডাকাতির ব্যাপারটা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবে টিকিট কাউন্টারের পাশে একটা জি.আর.পি. বুথ দেখে আমাদের মনে বেশ সাহস এল। অমলকাকু বললেন, “বুঝলি, ট্রেনেও বোধহয় পুলিশ থাকবে। তাই টেনশনের কিছু নেই।”

সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আমাদের মোটেই টেনশন হচ্ছে না।” তারপর আমার হাতটা টেনে বলল, “চ দীপু, ছোটকা এখানে একা বসে খানিক টেনশন করুক। আমরা বরং প্লাটফর্মের ওদিকটা একটু ঘুরে আসি।”
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম প্লাটফর্মের একেবারে অন্যপ্রান্তে। দেখি সামনেই একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে একটা ছোট্ট মেলার মতো বসেছে। মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে। বাচ্চাদের খেলনা-বেলুন, মেয়েদের চুড়ি-হার-কানের দুল যেমন আছে, তেমনই চপ-সামোসা-জিলিপিও পাওয়া যাচ্ছে। আমি আর সঞ্জু মেলাটা একচক্কর ঘুরে নিলাম। এক জায়গায় একটা বাচ্চা ছেলে রঙ-বেরঙের পাথর-বসানো আংটি বিক্রি করছিল। প্রতিটার মূল্য দশ টাকা। আর একজন বয়স্ক মহিলা বেশকিছু ঠাকুরের ছবি নিয়ে বসেছিলেন।

ওখান থেকে দূরে একটা ছোট্ট পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। বিকালের পড়ন্ত আলোয় বেশ সুন্দর লাগছিল চারপাশটা। আমি সেদিকে তাকিয়ে বেশ বিভোর হয়ে গেলাম। সঞ্জুর ডাকে আমার সম্বিৎ ফিরল। আমরা দু’জন আবার প্লাটফর্মে উঠে এলাম। একটা লোক ওখানে দাঁড়িয়ে বাদামভাজা বিক্রি করছিল। আমরা দু’জনে তাই কিনে খেতে শুরু করলাম। একটু বাদেই চোখে পড়ল, অমলকাকু হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছেন। ওঁর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। আমাদের সামনে এসে প্রথমে তো কিছু বলতেই পারলেন না। তারপর দু’ঢোঁক জল খেয়ে যা বললেন তার সারাংশ হল, আমরা চলে আসার পর অমলকাকু একটা ম্যাগাজিন খুলে পড়ছিলেন। এমন সময়ে একটা বিকট-দর্শন ডাকাত হঠাৎই এসে ওঁর হাতঘড়িটা কেড়ে নিয়েছে। কাকু কোনওমতে পালিয়ে এসেছেন।

কাকুর মুখে ডাকাতির ঐ গল্প শুনে আমরা তো থ। তবে চারদিকে তাকিয়ে কোনও ডাকাতের দেখা মিলল না। এই সময়ে সঞ্জু খপ করে অমলকাকুর হাতটা ধরে বলল, “দিনেদুপুরে প্রকাশ্য রেল স্টেশনে ঘড়ি ছিনতাই! এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। চলো তো ঐ জি.আর.পি. বুথটাতে।” এই বলে ও একরকম টানতে টানতে অমলকাকুকে নিয়ে যেতে লাগল।

বুথে ঢুকে দেখি একজন অফিসার চেয়ারে বসে আছেন। সঞ্জু ঐ অফিসারকে বেশ উত্তেজিত স্বরে বলল, “মেরা আঙ্কেল কা এক রিস্টওয়াচ…”

কিন্তু ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঐ অফিসার ভদ্রলোক ড্রয়ার থেকে একটা হাতঘড়ি বের করে বললেন, “ইয়ে ক্যায়া?”

আরে, এটাই তো অমলকাকুর সেই খোয়া যাওয়া রিস্টওয়াচ! আমরা সবাই তো একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম। অভনপুরের জি.আর.পি-দের কী অভাবনীয় দক্ষতা। ছিনতাই হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে চুরি যাওয়া মাল উদ্ধার করে ফেলেছে!

কিন্তু একটু বাদেই আসল ব্যাপারটা জানা গেল। ঐ অফিসার আমাদের বললেন যে একটু আগে একজন স্থানীয় মানুষ এসে ওঁকে ঘড়িটা জমা দিয়ে গেছে। সে ঐ অফিসারকে বলেছে যে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে থাকা এক চশমাপরা যাত্রীকে সে টাইম জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন ঐ যাত্রীটি তড়িঘড়ি তার ঘড়িটা খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে।

জি.আর.পি. অফিসারের মুখে অমলকাকুর ঘড়ি ছিনতাইয়ের এ হেন গল্প শুনে আমার তো ভীষণ হাসি পেয়ে গেল। আর অমলকাকু পড়লেন এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে। কী করবেন, কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শেষটায় আমতা আমতা করে আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আসলে লোকটা গম্ভীর মুখে ওর নিজস্ব ভাষায় আমার ঘড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে টাইম জানতে চেয়েছিল। আমি তাই ভাবলাম…”

সঞ্জু আর কাকুকে কথাটা শেষ করতে দিল না। একটু তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল, “ছিঃ ছোটকা! তুমি যে এতটা ভীতু তা তো আগে জানতাম না। একজন সাদামাটা সৎ দেহাতি মানুষকে বেমালুম ডাকাত বানিয়ে দিলে?”
অমলকাকু তখন মুখটা নামিয়ে মিনমিন করে বললেন, “বড়ো ভুল হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা আবার বাড়িতে ফিরে তোর কাকিমাকে বলিস না প্লিজ।”

।। তিন।।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা মানিকচৌরি পৌঁছলাম। তারপর টাঙ্গায় চড়ে দুর্গাচক। ওখানে সাত্যকিকাকুর বাংলোটা খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধা হল না। তালাবন্ধ বিশাল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম বাংলোটা নেহাত ছোটো নয়, চারপাশে অনেকটা জায়গাও আছে। আর গোটা এলাকাটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেট দিয়ে যতটা দেখা যায় তাতে বোঝা গেল ভিতরে অনেক গাছপালাও আছে।

দুর্গাচক মোড়ে বেশ কিছু দোকানপাট আছে। একটা হোটেল দেখে অমলকাকু বললেন, “সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। এসব এলাকায় আবার দোকানপাট তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। চ, আমরা আগে ঐ হোটেলটায় ঢুকে রাতের খাওয়াটা সেরে নিই। তারপর রামদয়ালের খোঁজ করা যাবে।”

হোটেলে ঢোকার আগে অবশ্য আমরা একটা ফোন বুথ থেকে আমাদের মানিকচৌরি পৌঁছানর সংবাদটা বাড়িতে দিয়ে দিলাম। আসলে অমলকাকুর মোবাইলে কোনও টাওয়ার ছিল না। ওখানে নাকি বি.এস.এন.এল. ছাড়া কোনও ফোনেরই টাওয়ার বিশেষ পাওয়া যায় না। যাই হোক, হোটেলে রুটি-তড়কা খেতে খেতেই রামদয়ালের বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। হোটেল মালিক রামদয়ালকে ভালোই চেনে আর ওর বাড়িটাও খুব কাছে। সে একটা ছেলেকে রামদয়ালের কাছে পাঠাল আমাদের আসার খবর দিতে। আমাদের খাওয়া শেষ হতে না হতেই দেখি রামদয়াল হাজির হয়েছে।

সে বলল যে গত পরশু সাত্যকিকাকু তাকে আমাদের আসার খবর জানিয়েছে। আমরা ততক্ষণে কলকাতা থেকে রওনা হয়ে গিয়েছিলাম। না হলে রামদয়াল নাকি মানিকচৌরি আসতে আমাদের বারণ করে দিত। কারণ, মাসখানেক হল ঐ বাংলোটায় একটা ভূত আস্তানা গেড়েছে। তার উপদ্রবে রামদয়াল নাকি আজকাল আর ঐ বাংলোতে ঢুকতে সাহস করে না এবং আমরাও যেন ওখানে ঢোকার চেষ্টা না করি। রামদয়াল তার বাড়িতেই আমাদের তিনজনের থাকার ব্যবস্থা করেছে।

কেন জানি না, ঐ ভূতের গল্পটা আমাদের কারোরই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না। তাই আমরা তিনজনেই বেঁকে বসলাম। রামদয়ালকে জানালাম, ঐ বাংলোতেই আমরা রাত কাটাব। দেখি ভূত আমাদের কী করে! কিন্তু রামদয়ালও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই আমাদের ঐ বাংলোয় যেতে দেবে না। যাই হোক, অনেক পীড়াপীড়ির পর তার কাছ থেকে বাংলোর চাবিটা পাওয়া গেল। তখন আবার লোড শেডিং হয়ে গেছে। এমনটা নাকি হামেশাই হয়। কখন কারেন্ট আসবে তার ঠিকঠিকানা নেই। তাই রামদয়ালের কাছ থেকে একটা হ্যাজাকও চেয়ে নিতে হল। কিন্তু আমাদের সাথে বাংলোয় রাত কাটাতে রামদয়াল কিছুতেই রাজি হল না।
অতঃপর রামদয়ালের দেওয়া জ্বলন্ত হ্যাজাকটা সঙ্গে নিয়ে আমরা লোহার গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। নুড়ি বিছানো সরু একটা রাস্তা কিছুটা এগিয়ে একটা পরিত্যক্ত ফোয়ারার সামনে দু’ভাগ হয়ে গেছে এবং দু’টো রাস্তাই আলাদা আলাদাভাবে শেষ হয়েছে দু’টো ছোটো সিঁড়ির সামনে। ঐ সিঁড়ি দু’টো দিয়েই বাংলোর সামনের বিশাল বারান্দাটায় ওঠা যায়।

যে ফোয়ারাটার কথা বললাম সেটাও বেশ বড়ো মাপের, পাথর বসানো। ঠিক যেন একটা চায়ের প্লেট, যার মধ্যিখানে একটা লম্বা লোহার নল দাঁড়িয়ে আছে। নলটার গায়ে লতা-পাতা-ফুল-ফলের কারুকার্য। আমার খালি মনে হচ্ছিল, ফোয়ারাটা দিয়ে যদি জল বের হত তাহলে খুব সুন্দর লাগত।

আমরা তিনজনই বারান্দায় উঠলাম। সেখানে বড়োই অন্ধকার। হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম বাংলোর ভিতরে ঢোকার একটাই বড়ো দরজা এবং সেটা তালাবন্ধ। সঞ্জু তালাটা খুলতে যাবে, এমন সময়ে অমলকাকু বললেন, “রামদয়াল তো বলছিল যে বাংলোর ভিতরে মাসখানেক ঢোকেনি। তাই ভিতরটায় নিশ্চয়ই খুব ধুলো আর ঝুল জমে আছে। সাপখোপও বাসা করতে পারে। তাই আমি ভেবে দেখলাম, আজ রাতে ভিতরে ঢোকাটা আমাদের উচিত হবে না। আজ বরং আমরা রামদয়ালের বাড়িতেই থেকে যাই। কাল সকালে না হয়…”
এটুকু শুনেই সঞ্জু বলে উঠল, “ওসব ধুলো সাপ কিচ্ছু নয়, তুমি আসলে ভূতের ভয়ে ভিতরে যেতে চাইছ না। সত্যি ছোটকা, তোমার মতো এত হাইলি এডুকেটেড ভীতু মানুষ পৃথিবীতে আর একটিও নেই! বাড়ি ফিরে তোমার এই ভীরুতার কাহিনি আমি অবশ্যই কাকিমার কাছে ফাঁস করে দেব। আর হ্যাঁ, ঐ ঘড়ি ছিনতাইয়ের ব্যাপারটাও গোপন থাকবে না।”

অমলকাকু তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিস? কী আর করা যাবে। ঢোক ভিতরে।”

ততক্ষণে সঞ্জু তালা খুলে ফেলেছে। একটা হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটাও খুলে গেল। কিন্তু ভিতরে এতটুকু ধুলো বা ঝুলের দেখা মিলল না। মনে হল কেউ যেন নিয়মিত বাড়িটা ঝাড়পোঁছ করে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “রামদয়াল কি আমাদের মিথ্যা বলল নাকি বল তো! যে বাড়িতে একমাস কেউ ঢোকেনি, সে বাড়ি কখনও এত পরিষ্কার হতে পারে?”

সঞ্জু বলল, “তুই একদম ঠিক বলেছিস। যে কোনও কারণেই হোক ও চাইছিল না যে আমরা বাংলোটার ভিতরে ঢুকি। তাই আমাদের মিথ্যা ভূতের গল্প বলেছে।”
“আই কন্ট্রাডিক্ট। রামদয়াল হ্যাজ টোল্ড ইউ দ্য ট্রুথ।”

কণ্ঠস্বরটা আমাদের কারোর নয়। প্রথমটা আমরা সকলেই বেশ চমকে গেলাম। তারপর হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম, দোতলা থেকে একটা লম্বা লোক, পরনে ফুল প্যান্ট হাফ শার্ট, সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে। আমাদের মধ্যে সঞ্জুই প্রথম মুখে ভাষা খুঁজে পেল। জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে? বাড়িটা তো বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল। তাহলে আপনি ভিতরে ঢুকলেন কী করে?”

লোকটা উত্তরে বলল, “আই অ্যাম অনিরুদ্ধ গোমস। অ্যান্ড ইউ শুড নো দ্যাট আ ঘোস্ট ক্যান ইনট্রুড ইভেন থ্রু আ ক্লোজড ডোর।”

তার মানে রামদয়াল যে ভূতের কথা বলেছিল, তা সত্যি! এবং আমরা এখন অনিরুদ্ধ গোমস নামক এক ভূতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি! একথা ভেবেই আমার হাত পা অবশ হয়ে এল। অমলকাকুরও মুখচোখ দেখলাম শুকিয়ে গেছে। কেবল সঞ্জুর মধ্যে খুব একটা ভাবান্তর চোখে পড়ল না। ও অনিরুদ্ধকে বলল, “বাংলাটা তো আপনি ভালোই বোঝেন দেখছি। আর অনিরুদ্ধও তো বাঙালি নাম। তাহলে খামোকা ইংরাজিতে কথা বলছেন কেন? ভিনরাজ্যে এসে একজন বাঙালির সাথে ইংরাজিতে কথা বলতে কারো ভাল লাগে?”
একথা শুনে ভূতটা একটু ধাক্কা খেয়েছে মনে হল। সে এবার বাংলাতেই বলল, “তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি বাঙালিই বটে। আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবই কলকাতায়, শ্যামবাজারে। আমার মাও পুরোদস্তুর বাঙালি, তবে আমার বাবার শরীরে কিন্তু ব্রিটিশ রক্ত। বাবার ঠাকুরদা রিচার্ড গোমস প্রথম আয়ারল্যান্ড থেকে এদেশে এসেছিলেন। তিনিও বিয়ে করেছিলেন এক বাঙালি মহিলাকে। তারপর আর দেশে ফিরে যাননি। তখন থেকে আমরা কলকাতায়, মানে আমাকে নিয়ে চারটে জেনারেশন।”

একটু থেমে গোমস আবার বলতে শুরু করল, “আমি ছোটো বেলাতেই বাবাকে হারিয়েছি। মা-ই বাবার ব্যাবসাটা একা সামলে আমাকে বড়ো করেছেন। তারপর ম্যানেজমেন্ট পড়তে মা আমাকে লন্ডনে পাঠান। ওখানেই মাস দুয়েক আগে একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে আমার মৃত্যু হয়। একে গায়ে ব্রিটিশ রক্ত বইছে, তার ওপর আবার ইংল্যান্ডের মাটিতে কফিনবন্দি হয়েছি, তাই আমার কথার মধ্যে ইংরাজিটা নরম্যালি চলে আসে আর কি।”

একথা শুনে সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “এই হচ্ছে আপনাদের সমস্যা। বাংলায় বড়ো হলেন, লেখাপড়া শিখলেন, তারপর ক’দিনের জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজ বনে গেলেন। এসব আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আর ঐ ব্রিটিশ রক্তের কথা একদম বলবেন না। যাঁর বাবার ঠাকুরদা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করেছিলেন তাঁর শরীরে এখনও ব্রিটিশ রক্ত অবশিষ্ট আছে বলে আমি মনে করি না।”

এই কথার প্রেক্ষিতে গোমস প্রথমটা কী বলবে ভেবে পেল না। তারপর একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, “ওকে, আমি বাংলাতেই বলছি, তোমরা এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। আমি এই বাংলোতে কোনও মানুষের উপস্থিতি টলারেট মানে বরদাস্ত করব না। আর আমার কথা যদি না শোনো তাহলে তোমরা কেউই আর মানুষ থাকবে না, এই বলে দিলাম।”

এবার অমলকাকু ক্ষীণ স্বরে বললেন, “তাহলে আপনি বলতে চাইছেন যে আপনি মানুষ নন, মানে আপনি ভূত!”

“একজ্যাক্টলি, মানে আপনি ঠিকই ধরেছেন,” গোমস গম্ভীর স্বরে জবাব দিল।
সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জু জিজ্ঞাসা করল, “কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন?”
সঞ্জুটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? একটা ভূতের কাছে তার ভূত হওয়ার প্রমাণ চাইছে! আমি ভাবলাম সঞ্জুর কথায় গোমস ভীষণ রেগে যাবে আর ওর গলা টিপে ধরবে। কিন্তু তেমনটা হল না। গোমস আরও গম্ভীর হয়ে বলল, “কী প্রমাণ চাও বলো?”

সঞ্জু বলল, “ভূতেরা শুনেছি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। আপনি সেটা করে দেখান।”
গোমস তখন একটু হতাশার সুরেই বলল, “আই কান্ট ডু দ্যাট। কারণ, মাত্র দু’মাস হল আমি ভূত হয়েছি। ভূত হওয়ার একবছর বাদে কারোর মধ্যে ঐ অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা জন্মায়। আমি বরং তোমাকে অন্য প্রমাণ দিচ্ছি।” এই বলে গোমস যা করল, তাতে তো আমার ভিরমি খেয়ে যাওয়ার অবস্থা। ও হঠাৎই নিজের বাঁ হাতটা খুলে সেটা ডান হাতে ধরে বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে লাগল। তারপর ঐ খোলা হাতটা দিয়েই নিজের পিঠটা খানিক চুলকে নিয়ে সেটা আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিল।

আমরা তো বটেই, সঞ্জুও দেখলাম এই দৃশ্য দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু নিমেষে ও নিজেকে সামলে নিল। গোমসকে ক্যাজুয়েলি বলল, “আমাদের পাড়ার পাঁচুর ঠাকুমাও শুনেছি ভূত হওয়ার পর নিজের মুন্ডুটা হাতে নিয়ে উকুন বাছত। তবে ভূত হওয়া সত্ত্বেও সে গিরগিটি দেখলে খুব ভয় পেত। কোনও গিরগিটি দেখলে তার ত্রিসীমানায় থাকত না।”

আমি আর সঞ্জু একপাড়াতেই থাকি। আমাদের পাড়ায় কোনওকালে পাঁচু নামে কোনও ছেলে ছিল না। স্বভাবতই তার ঠাকুমারও কোনও অস্তিত্ব নেই। আর ঠাকুমাই যদি না থাকে তাহলে তার ভূতই বা থাকবে কীভাবে! তাই সঞ্জুর বক্তব্যের মাথামুন্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওদিকে সঞ্জুর মুখে গিরগিটির কথা শুনে গোমস মন্তব্য করল, “আমিও একটা জিনিসে ভীষণ ভয় পাই। তবে সেটা গিরগিটি নয় ককরোচ, মানে আরশোলা। সেজন্য এই বাংলোর ঐ দক্ষিণের গুদাম ঘরটাতে আমি কখনও ঢুকি না। ওখানে প্রচুর ককরোচ আছে।”

এরপর হঠাৎ বেশ গম্ভীর হয়ে গোমস বলল, “যাই হোক, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমরা এখনই এই বাংলো ছেড়ে চলে যাও। না হলে আমার কাজে বাধা পড়বে। সেটা আমি মোটেই বরদাস্ত করব না।”
আমি ভেবেছিলাম সঞ্জু বুঝি গোমসের কথার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু ও তা করল না। উল্টে বলল, “ঠিক আছে, আমরা এক্ষুনি চলে যাব। তার আগে আমি একটু বাইরে গিয়ে রামদয়ালের খোঁজটা করে আসি। আজ রাত্তিরটা তো ওর বাড়িই থাকতে হবে।” এই বলে ও আমাদের কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার তো তখন ভয়ে মূর্চ্ছা যাওয়ার অবস্থা। অমলকাকুর মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ঐরকম একটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে আবার গোমস আমাদের কাছ থেকে নানাকিছু জানতে চাইছিল। আমাদের পরিচয়, বাসস্থান, পেশা এইসব আর কি! আর একরকম কাঁপতে কাঁপতে আমরা অ্যাংলো ভূতটার ঐসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে সঞ্জু হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। ও পিঠের স্যাকটা নামিয়ে রেখে হঠাৎই এগিয়ে গেল গোমসের দিকে। তারপর যা করল তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। ও নিজের হাতটা তুলে ধরল গোমসের মুখের সামনে। আমরা হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম সঞ্জু একটা জ্যান্ত আরশোলার শুঁড় ধরে আছে আর পোকাটা ঐ অবস্থায় ফড়ফড় করছে। ও পোকাটাকে নাচাতে নাচাতে বলল, “কোন মতলবে এখানে এসেছ সেটা এক্ষুনি বলে ফেল চাঁদু। না হলে আরশোলাটা তোমার গায়ে ছেড়ে দেব। তখন মজা বুঝবে।”

আরশোলাটাকে দেখামাত্র গোমসের চোখমুখ বদলে গেল। বুঝলাম ও ভীষণ ভয় পেয়েছে। আমি এই প্রথম কোনও ভূতকে ভয় পেতে দেখলাম। আর অমলকাকু এই দৃশ্য দেখে আমাকে ফিসফিস করে বললেন, “হতভাগা সঞ্জুটার কাণ্ড দেখেছিস! এই ঘরে ঢোকার জন্য একটু আগে আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল। আর এখন এ ঘরে থাকার জন্য ঐ অ্যাংলো ভূতটাকে করছে।”

গোমস ইতিমধ্যে ভয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কয়েক ধাপ উঠেই পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর বাঁ হাতটা খুলে গিয়ে লাট খেতে খেতে এসে পড়ল একেবারে সঞ্জুর পায়ের কাছে। সঞ্জু সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “বাঃ, চমৎকার জিনিস। যা ফিনিশিং তাতে এদেশের নয় বলেই মনে হচ্ছে। আর কি, এটা যথাস্থানে লাগিয়ে নাও। হাতকাটা গোমসকে দেখতে মোটেই ভাল লাগছে না। তারপর কেন ভূত সাজার প্রয়োজন হল, সেটা বলে ফেল।”

সঞ্জুর বাঁ হাতে তখনও আরশোলাটা ঝুলছে। সেটাকে দেখিয়ে গোমস বলল, “আগে ঐ ডেঞ্জারাস ক্রিয়েচারটাকে বিদায় কর। না হলে আমার পক্ষে কিছু বলা বা করা সম্ভব নয়।”

সঞ্জু এবার আমাকে একটা প্লাস্টিক প্যাকেট বের করতে বলল। সেটার মধ্যে ও আরশোলাটাকে ভরে প্যাকেটের মুখটা গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বলল, “আশা করি এই ডেঞ্জারাস ক্রিয়েচারটাকে আর বের করার দরকার হবে না। নাও, এবার সত্যি কথাটা বলে ফেল দেখি।”

।। চার।।

গোমস অগত্যা বলতে শুরু করল, “আমি একটু আগে নিজের সম্পর্কে যা যা বলেছি তা সবই সত্যি, শুধু ঐ মৃত্যুর ব্যাপারটা বাদ দিয়ে। ইংল্যান্ডে আমার অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। তবে বাঁ হাতটা অ্যামপুট করতে হয়েছিল। মাস ছয়েক বাদে ওখানেই এই আর্টিফিসিয়াল লিম্বটা লাগিয়ে নিই। তারপর দেশে ফিরে আসি।”

“সে নয় বুঝলাম, কিন্তু সেই শ্যামবাজার থেকে এই মানিকচৌরি এসেছ কী উদ্দেশ্যে?” সঞ্জু আবার জিজ্ঞাসা করল।

“আমার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে।”
“মানে?”
“আসলে আমি এই বাংলোয় এসেছি একটা আংটির সন্ধানে। ওটা আমি আমার মুমূর্ষু মায়ের হাতে তুলে দিতে চাই। সেটাই মায়ের শেষ ইচ্ছা। একটা ধাঁধায় বলা আছে ঐ আংটিটা এই বাংলোর ঠিক কোথায় রাখা আছে। ধাঁধাটার আবার গোটাটাই অঙ্ক। আমি চিরকালই অঙ্কে বড্ড কাঁচা। তাই গত একমাস ধরে অনেক চেষ্টা করেও ধাঁধাটার মানে উদ্ধার করতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়েই এখানে পড়ে থাকতে হচ্ছে।”
সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ও, এই ব্যাপার! তা তুমি ধাঁধাটা আমার ছোটকাকে বল। উনি ম্যাথমেটিক্সে ডক্টরেট। তোমার সমস্যা মিটে যাবে।”

আগেই বলেছি, অঙ্কের কথা শুনলেই অমলকাকুর মন ভালো হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তেমনটাই হল। সব ভয় ও জড়তা দূরে সরিয়ে রেখে কাকু বেশ কৌতূহলী হয়ে গোমসকে বললেন, “কই, বল তো ধাঁধাটা। দেখি সলভ্‌ করতে পারি কি না।”
সঙ্গে সঙ্গে গোমস ওর পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কাকুর হাতে দিল। তাতে লেখা আছে –
পশ্চিমে মেপে তিন গজে চেপে
সাত গুণে যাই।
গুণ করে পাই
ভাগ করি তাই, ঠিক একাদশটাই।

ভাগফল শেষে যেখানেই মেশে
এক মহাকবি পাই,
অর্ধে মোদের ঠাঁই।
সাথে পাঁচ-পা যুক্ত, হাতখানা অতিরিক্ত।

ওই দুটোর বর্গ কষে দেয় দৈর্ঘ্য
সেখানেই আছে
ফলখানা গাছে,
ধরে তার বোঁটাটি চাপ দিলেই আংটি।

ধাঁধাটা অমলকাকু আমাদের সকলকে পড়ে শোনালেন। গোমস বলল যে ধাঁধার ঐ তিন গজ মানে যে আসলে পাথরে খোদাই করা তিনটে হাতি, এই ব্যাপারটা ছাড়া গত একমাসে সে আর কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। তারপর সে আমাদের দোতলার সিঁড়িটা যেখান থেকে উঠেছে, তার সামনের দেওয়ালটার কাছে নিয়ে গেল। দেখি ঐ দেওয়ালে একটা সাদা পাথরখণ্ড আটকানো আছে। আর তাতে খোদাই করা আছে তিনটি হাতি।
আমি এতক্ষণে মনে একটু বল পেয়েছি। গোমসকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, আংটিটা এই বাংলোয় এল কী করে? আর ধাঁধাটাই বা তুমি পেলে কোথা থেকে?”

গোমস জবাবে যা বলল তা সংক্ষেপে এইরকম – আংটিটা আসলে গোমসের মায়ের এক দূর সম্পর্কের দাদা শচীন্দ্রনাথ চৌধুরীর। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি তো বিশাল ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেনই, তাছাড়া ব্যবসা করেও নাকি প্রচুর টাকা রোজগার করেছিলেন। এসব সত্ত্বেও ভদ্রলোক ছিলেন একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির। ধাঁধা আর অঙ্কের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। আজ থেকে বিশ বছর আগে তাঁর একমাত্র ছেলে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সিকিম বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। ওদের গাড়িটা দু’শো ফুট নিচে খাদে পড়ে যায়।

এই ঘটনার পরেই শচীনবাবুর মানসিক সুস্থিতি কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। উনি ব্যবসা-ট্যাবসা সব ছেড়ে দেন। তারপর প্রায় জলের দরে নিজের নানা সম্পত্তি বেচে দিতে শুরু করেন। আমাদের সাত্যকিকাকুর জ্যাঠামশাই এই সময়েই শচীনবাবুর কাছ থেকে মানিকচৌরির এই বাংলোটা কিনেছিলেন।

যাই হোক, মানসিক বিকার দেখা দিলেও শচীনবাবুর খামখেয়ালিপনা বা ধাঁধার প্রতি আসক্তি এই সময়ে কমেনি বই বেড়েছে। তিনি এইসময়ে প্রায়শই তাঁর বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে হাজির হতেন এবং একটা করে অঙ্কের ধাঁধা দিয়ে আসতেন। এইভাবেই মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি শ্যামবাজারে গোমসের মায়ের কাছে উপস্থিত হন। এই ছড়াটা দিয়ে বলেন, সাধ্যে কুলোলে গোমসের মা যেন মানিকচৌরির বাংলোয় এসে মহামূল্যবান আংটিটা উদ্ধার করে নিয়ে যান। এটা বছর কুড়ি আগেকার ঘটনা। গোমস তখন ছোটো। গোমসের মা ধাঁধাটাকে দাদার নিছক মস্তিষ্কবিকার ভেবে আর মানিকচৌরি আসার কথা ভাবেননি।
কিন্তু এই ঘটনার প্রায় বিশ বছর বাদে, গোমস তখন ইংল্যান্ডে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেছে। ভদ্রমহিলা জানতে পারেন যে তাঁর আরেক বোন শচীনবাবুর দেওয়া ধাঁধা সমাধান করে মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরের কোনও একটা কটেজ থেকে একটা মহার্ঘ্য সোনার হার উদ্ধার করেছে। ব্যস, একথা জানার পরেই ভদ্রমহিলার মন ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। তিনি ছেলে কবে বিলেত থেকে ফিরবে সেজন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। কারণ, ইতিমধ্যে তিনি পাকস্থলীর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। ঐ অসুস্থ শরীরে তাঁর পক্ষে কলকাতা থেকে মাণিকচৌরি আসা সম্ভব ছিল না। ওদিকে অ্যাক্সিডেন্টটা হওয়ার জন্য গোমসের বাড়ি ফেরা প্রায় ছ’মাস পিছিয়ে যায়। এই সময়ে ওর মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু ছেলেকে বিলেতে পড়াতে গিয়ে তাঁর হাত তখন একেবারে খালি।

বাড়ি ফিরে গোমস মায়ের অবস্থা দেখে খুবই ভেঙে পড়ে। বুঝতে পারে মাকে এই পৃথিবীতে আরও ক’বছর টিকিয়ে রাখতে গেলে ভালো ট্রিটমেন্ট একান্ত জরুরি এবং তার জন্য দরকার কয়েক লাখ টাকা। এই সময়েই মায়ের কাছ থেকে ও শচীনবাবুর ধাঁধাটা পায়। গোমস আর দেরি করেনি। পাশের বাড়ির একজনকে মায়ের দেখাশোনার ভার দিয়ে মানিকচৌরি চলে এসেছে। রামদয়াল ওকে প্রথমে বাংলোয় ঢুকতে দেয়নি। শেষটায় টাকার লোভ দেখিয়ে গোমস কোনওভাবে ওকে ম্যানেজ করেছে।

গোমস ভেবেছিল খুব বেশি হলে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ও ধাঁধাটার সমাধান করে ফেলতে পারবে। কিন্তু শচীনবাবু এতো অঙ্ক ঢুকিয়ে ওর আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন। ফলে গোমসের বাড়ি ফেরা হচ্ছে না। মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারটাও পিছিয়ে যাচ্ছে।

পুরো গল্পটা শুনে গোমস যে তার মাকে খুব ভালোবাসে সেটা বেশ বোঝা গেল। বুঝলাম এই বাংলোয় যাতে বাইরের কোনও লোক হুট করে ঢুকে পড়তে না পারে তার জন্য ওকে বাধ্য হয়েই ভূত সাজতে হয়েছে। আর গরিব রামদয়াল টাকার লোভে ওর সাথ দিয়েছে। তবে আংটির গল্পটা রামদয়াল জানে না।

গোমসের মুখে সবটা শুনে সঞ্জু ওকে বলল, “আমার বিশ্বাস ছোটকা দু’একদিনের মধ্যেই এই ধাঁধাটা সলভ করে ফেলবে। যাই হোক, এখন আর ওসব ভালো লাগছে না, খুব টায়ার্ড লাগছে। তুমি আমাদের শোওয়ার ঘরটা দেখিয়ে দাও।”

এই সময়েই কারেন্ট এসে গেল। গোমস আমাদের তিনজনকে গোটা বাংলোটা একবার ভালো করে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল দোতলার একটা ঘরে। ঐ ঘরের খাটটা বিশাল। আমরা তিনজনেই অনায়াসে এঁটে যাব। ঘরটায় চেয়ার টেবিলও পাতা আছে। গোমস একটা জলের জাগও দিয়ে দিল। অমলকাকু ওকে বললেন, “ভাই গোমস, আমাদের কারোরই আজ আর ঐ ধাঁধাটা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থা নেই। আমরা ভীষণ ক্লান্ত। তবে কাল সকাল থেকেই আমরা কাজ শুরু করে দেব। ছড়াটা পড়ে মনে হল আংটিটা খুঁজে বের করতে অনেক মাপজোখ করতে হবে। তাই একটা মেজারিং টেপ হলে বড়ো ভালো হত।”

গোমস সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ওটা আমি আগেই জোগাড় করেছি। কিন্তু জিনিসটা আমার কোনও কাজে লাগেনি।” বলেই পকেট থেকে একটা ফিতে বের করে কাকুর হাতে ধরিয়ে দিল।


পরদিন সকাল আটটা নাগাদ আমার আর সঞ্জুর ঘুম ভাঙল। দেখি অমলকাকু চেয়ারে বসে একটা সাদা কাগজে কীসব আঁক কষছেন। আর গোমস ওঁর দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। সঞ্জু তা দেখে বলল, “কী গো ছোটকা, তুমি কখন থেকে এসব করছ? রাতে ঘুমিয়েছিলে তো?”

“আরে ঘুমবো না কেন? তবে ভোরবেলাই চোখটা খুলে গেল। জানিসই তো, কোনও অঙ্ক যদি মেলাতে না পারি তাহলে…”
“তা কোনও কিছু বুঝতে পারলে?”
“না, এখনও অব্দি তেমন কিছু নয়। চ, ব্রেকফাস্ট সেরে একটু বেড়িয়ে আসি। তাতে যদি মাথাটা একটু খোলে।”

গোমসের সাথে কথা বলে আমরা ঠিক করলাম, পায়ে হেঁটেই আমরা এখন মানিকচৌরির উত্তর দিকটায় যাব। ওদিকে নাকি একটা সুন্দর ঝর্ণা আছে। সেইমতো ন’টা নাগাদ টিফিন খেয়ে একটা স্যাকে কিছু শুকনো খাবার, জল আর গামছা নিয়ে আমরা রওনা হলাম। ইচ্ছা স্নানটা ঝর্ণার জলেই সারব।

মানিকচৌরি জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। চারদিকটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আমরা হাঁটছিলাম একটা হালকা বনের পথ ধরে। মাঝে মাঝেই প্রকৃতির শোভা দেখে আমাদের দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছিল। অমলকাকুর ডিজিটাল ক্যামেরাটা নিয়ে সঞ্জু এন্তার ছবি তুলে যাচ্ছিল। শুধু প্রকৃতির নয়, সঙ্গে আমাদেরও। একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, ছবি তোলার ব্যাপারে গোমসের দারুণ অনীহা। সে কিছুতেই ফটোবন্দি হতে চাইছিল না। যাই হোক, তাই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে আমাদের প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। এমন সুন্দর জায়গায় কেন যে টুরিস্ট তেমন আসে না কে জানে!

আমরা দু’জন প্রকৃতির শোভা প্রাণভরে উপভোগ করলেও অমলকাকুকে কেমন যেন আনমনা লাগছিল। সঞ্জু কাকুকে বলল, “এত সুন্দর একটা ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়েও তুমি মুখ ব্যাজার করে আছ কেন ছোটকা? চল, সকলে মিলে চান করি। দারুণ মজা হবে!”

অমলকাকু আসলে এতক্ষণ ঐ ধাঁধাটার মধ্যেই ডুবে ছিলেন। উনি বললেন, “দ্যাখ সঞ্জু, পশ্চিমে মেপে তিন গজে চেপে বলতে ঐ তিনটে পাথরের হাতি যেখানে বসান আছে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ঠিক পরের লাইনেই আছে সাত গুণে যাই। এর মানে কী?”

“আমার মনে হচ্ছে, কোনও কিছুকে সাত দিয়ে গুণ করতে হবে,” সঞ্জু জবাবে বলল।
“আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু গুণটা কাকে করতে হবে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছি না।”
“আচ্ছা ছোটকা, গজ মানে যেমন হাতি, তেমনি তো আবার তিন ফুট দূরত্বকেও বোঝায়। সেক্ষেত্রে তিন গজ মানে তো নয় ফুট দাঁড়াল।”

“এক্সিলেন্ট! তুই একদম ঠিক ধরেছিস। বংশের ধারা যাবে কোথায়! তাহলে নয় ফুটকে সাত দিয়ে গুণ করে দাঁড়াল তেষট্টি ফুট। এবার পরের লাইন, গুণ করে পাই। কিন্তু তেষট্টিকে গুণটা করব কী দিয়ে?”
গোমস বেশ উদ্বেগের সাথে বলল, “বাই চান্স শচীনবাবু ধাঁধাটা বানাবার সময় ওখানে সংখ্যাটা লিখতে ভুলে জাননি তো! তাহলে তো আর কোনওদিনই ওটা সলভ করা যাবে না।”
অমলকাকু বললেন, “সেটার সম্ভাবনা নেই। যে ভদ্রলোক এতো খেটেখুটে রীতিমত ছন্দ মিলিয়ে ধাঁধাটা বানিয়েছেন তিনি ওরকম একটা সিলি মিসটেক করবেন, মনে হয় না। আমরাই বোধহয় রহস্যটা ঠিক ধরতে পারছি না।”

আমারও সেটাই মনে হচ্ছিল। আমি সঞ্জুকে বললাম, “চ, ঝর্ণার জলে চান করি। তাতে মাথাটা যদি খোলে।”
অনেকক্ষণ সেদিন ঝর্ণার জলে আমরা চান করলাম। এত আরাম লাগছিল, কী বলব! গোমস অবশ্য জলে নামেনি। ও নিজের খেয়ালে একটা বড়ো পাথরের ওপর আঁক কাটছিল। কাছে গিয়ে দেখি চারটে বড়ো বড়ো গোল্লা এঁকেছে। সঞ্জু জিজ্ঞাসা করল, “এসব কী এঁকেছ গোমস?”
গোমস মলিন হেসে জবাব দিল, “চারজন মানুষের মাথা। একটা ছোট্ট রহস্য নিয়ে এই চারটে মাথা ভেবে চলেছে অথচ সমাধান বেরোচ্ছে না। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না!”
কথাগুলো শুনে আমরা সকলেই বুঝতে পারলাম, ধাঁধাটার সমাধান করা যাচ্ছে না দেখে গোমস খুব ভেঙে পড়েছে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। আংটিটা না পেলে যে ওর মুমূর্ষ মায়ের চিকিৎসা আটকে যাবে। এদিকে গোমসের আঁকা ঐ গোল্লাগুলো দেখে আমার মাথায় হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেটা ঝর্ণার জলে মাথা ভিজানোর প্রভাব কি না জানি না। আমি অমলকাকুকে বললাম, “কাকু, বৃত্তের ক্ষেত্রফল পাই আর স্কয়ার আর পরিধি টু পাই আর। তাই আমার মন বলছে ধাঁধার ঐ পাইটা বোধহয় ত্রিকোণমিতির পাই অর্থাৎ টুয়েন্টি টু বাই সেভেন।”

আমার কথা শেষ হতে না হতেই অমলকাকু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “ব্রাভো! আমার বিশ্বাস তুই বড়ো হয়ে একজন বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী হবি। তাহলে আগের তেষট্টিকে সাত ভাগের বাইশ দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যাচ্ছে একশো আটানব্বই। এরপরের লাইনে কোনও ঝামেলা নেই – ভাগ করি তাই, একাদশটাই। অর্থাৎ, একশো আটানব্বইকে ভাগ করতে হবে এগারো দিয়ে। ভাগফল দাঁড়াচ্ছে আঠারো।”
সঞ্জু এবার বলল, “এবার ধাঁধায় আছে ভাগফল শেষে, যেখানেই মেশে। তার মানে ঐ হাতি তিনটে যেখানে রাখা আছে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে আমাদের আঠারো ফুট যেতে হবে।”

অমলকাকু বললেন, “ঠিক তাই। চ, আমরা তাড়াতাড়ি বাংলোয় ফিরে যাই। আঠারো ফুট পশ্চিমের ঠিক কোন জায়গাটাকে নির্দেশ করা হচ্ছে তা না বুঝতে পারলে ধাঁধার পরের অংশটা সমাধান করা যাবে না।”

।। ছয়।।

অমলকাকুর তাড়ায় সেদিন বেশিক্ষণ আর আমাদের ঝর্ণায় চান করা হল না। বাংলোতে ফিরেই কাকু ফিতে নিয়ে মাপামাপি শুরু করে দিলেন। গোমস হল ওঁর সহকারী। যেখানে পাথরে খোদাই করা হাতি তিনটে ছিল সেখান থেকে সোজা পশ্চিমে গিয়ে দেখা গেল বাংলোয় ঢোকার মুখেই যে ফোয়ারাটা আছে ঠিক তার কেন্দ্রবিন্দুতে আঠারো ফুট হচ্ছে। অমলকাকু এবার লাফিয়ে উঠে বললেন, “আমরা ধাঁধার প্রথম অংশটা ঠিকঠাকই সমাধান করেছি বলে মনে হচ্ছে। এবার পরের পার্টটায় যেতে হবে।”
কিন্তু তখন আমার আর সঞ্জুর পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। আমি অমলকাকুকে বললাম, “অনেক বেলা হয়েছে। চলুন, হোটেলে খেতে খেতে বাকিটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”

কিন্তু গোমস তাতে আপত্তি জানাল। বলল, “আপনারা পাবলিকলি ধাঁধাটা নিয়ে আলোচনা করবেন না, প্লিজ। ব্যাপারটা পাঁচকান হয়ে গেলে ঐ আংটিটা হাতাবার জন্য আরও অনেকে হামলে পড়তে পারে। তখন খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আংটিটা না পেলে আমি মায়ের ট্রিটমেন্ট করাতে পারব না।”
কথাটা গোমস মোটেই খারাপ বলেনি। সঞ্জু বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আংটির ব্যাপারটা আমাদের তিনজনের বাইরে কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না।”

হোটেল থেকে খেয়ে বের হওয়ার সময় একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হল। কোথা থেকে রামদয়াল এসে সোজা অমলকাকুর পা দু’টো জড়িয়ে ধরল। বক্তব্য, আমাদের মিথ্যা ভূতের ভয় দেখিয়ে সে খুব অপরাধ করেছে। তার সংসারের অবস্থা খুব খারাপ। নুন আনতে রোজ পান্তা ফুরোয়। তাই গোমসের অতগুলো টাকার অফার সে ফেরাতে পারেনি। এখন তার মালিক মানে সাত্যকিকাকু যদি জানতে পারেন যে টাকার লোভে সে একটা লোককে ঐ বাংলোয় থাকতে দিয়েছে এবং সেজন্য আমাদের মিথ্যা ভূতের গল্প শুনিয়ে ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাহলে সাত্যকিকাকু ওকে কেয়ারটেকারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবেন। সেক্ষেত্রে ওর সারাবছরের একটা বাঁধা ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে। বৌ-বাচ্চা নিয়ে ওর দুর্গতির শেষ থাকবে না। যাই হোক, অমলকাকু অনেক কষ্টে রামদয়ালকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে ওর চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমরা সাত্যকিকাকুকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাব না।

হোটেলে খাওয়াদাওয়া শেষ করতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। গোমস বিশেষ কিছু খেল না। বুঝতে পারছিলাম ধাঁধাটার সমাধান হবে কি না তা নিয়ে ও খুব টেনশনে আছে। খাওয়া সেরে আমরা যখন আবার বাংলোয় পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। ফোয়ারাটার সামনে যেতে না যেতেই গোমস বলল, “এবার তাহলে ধাঁধাটার পরের অংশটায় যাওয়া যাক।” বেচারির আর তর সইছে না।

আগেই বলেছি, ফোয়ারাটা দেখতে অনেকটা প্লেটের মতো, যার ঠিক মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা নকশাদার মোটা লোহার নল। অমলকাকু বললেন, “ধাঁধায় আছে ভাগফল শেষে, যেখানেই মেশে / এক মহাকবি পাই।”

আমি বললাম, “এতক্ষণ তো বেশ অঙ্ক চলছিল। হঠাৎ মহাকবি কোথা থেকে হাজির হলেন?”
সঞ্জু বলল, “আচ্ছা, কালিদাসকে তো মহাকবি বলা হয়। আর বাল্মিকীও তো…”
“না না, বাল্মিকীর পরিচিতি আদিকবি হিসাবে; আর রবীন্দ্রনাথ হলেন বিশ্বকবি,” অমলকাকু মন্তব্য করলেন।
গোমস বলল, “আচ্ছা, এই লোহার নলটার গায়ে কোনও বিখ্যাত কবির ছবি-টবি খোদাই করা নেই তো? সেই জায়গা থেকেই হয়তো ধাঁধাটার পরবর্তী অংশটা বোঝা যাবে।”

গোমসের কথামতো আমরা সকলেই লোহার নলটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু লতা-পাতা-ফুল-ফলের নকশা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। এবার অমলকাকু বললেন, “আমাদের ভাবনা-চিন্তায় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। ঐ মহাকবির সঙ্গে আমি নিশ্চিত গণিতের একটা সম্পর্ক আছে। কারণ, ধাঁধাটার পরের অংশটাতেও প্রচুর অঙ্কের খেলা। সামনে অঙ্ক, পিছনে অঙ্ক, শুধু মাঝখানে একজন মহাকবি। ব্যাপারটা ঠিক যেন খাপ খাচ্ছে না।”

অমলকাকুর কথায় যে যুক্তি আছে সেটা আমরা সকলেই মেনে নিলাম। তারপর মহাকবির গভীরে লুকনো অঙ্কটা অনুসন্ধানের চেষ্টা শুরু করলাম। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও আশার আলো মিলল না। চারজনই বসে রইলাম মনমরা হয়ে। সঞ্জু আমাকে বলল, “চ, সামনের দোকান থেকে একটু মুড়ি-তেলেভাজা কিনে নিয়ে আসি। অল্প অল্প খিদে পাচ্ছে।”

।। সাত।।

এখানকার মুড়িগুলো একটু অন্য ধরনের আর খেতেও বেশ ভালো। ওদিকে তেলেভাজা বলতে সামোসা আর বড়ো বড়ো লঙ্কাভাজা। তবে লঙ্কাগুলো কিন্তু মোটেই ঝাল নয়, বরং একটু টক টক গোছের। আমরা চারজনে বাংলোর সামনের বিশাল বারান্দাটায় বসে মুড়ি চিবোচ্ছিলাম। হঠাৎ কেন জানি আমার অমলকাকুর ঠোঙাটার দিকে চোখ গেল। ঠোঙায় একটা গণেশঠাকুরের ছবি। তাই দেখে আমার ঐ গণেশের মন্দিরটার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার পথে আজ সকালে দেখেছিলাম মন্দিরটা। আমি অমলকাকুকে বললাম, “মুম্বাইতে গণেশের খুব পুজো-আচ্চা হয় জানি। তবে ছত্তিশগড়ে যে গণপতিবাপ্পা এত জনপ্রিয়, জানতাম না।”

আমার কথা শেষ হতে না হতেই সঞ্জু বলল, “ঠিক বলেছিস। আমি খাবার হোটেলটাতেও একটা গণেশের ফটো দেখেছি। আর সঙ্গে ইঁদুরও। সেটা অবশ্য জ্যান্তই ছিল।”

“জানিস, গণেশের কত প্রতিভা! ঐ দেবতাটি না থাকলে মহাভারত লেখাই হত না। বেদব্যাস তো নিজের হাতে মহাভারত লেখেননি। উনি কেবল মুখে বলে গেছেন আর গণেশ তা…” এ পর্যন্ত বলেই অমলকাকু হঠাৎ চুপ করে গেলেন।

আমি বললাম, “কী হল অমলকাকু, হঠাৎ কী ভাবছেন?”
এই সময়ে কাকু হঠাৎ মেঝেতে একটা থাপ্পড় মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইউরেকা! মহাকবির মানে ধরতে পেরেছি।”
একথা শুনে আমরা বাকি তিনজনও বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। প্রায় সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী মানে?”

কাকু এককথায় জবাবটা দিলেন না। বেশ ফেলুদাসুলভ ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, “ভাগ্যিস এখন তোরা গণেশের প্রসঙ্গ তুললি। না হলে শচীনবাবুর মহাকবির ছদ্মবেশ উন্মোচন করা সম্ভবই হত না। আমরা সবাই জানি মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সংক্ষেপে ব্যাসদেব। মহাভারতের কবি বলে ওঁকে মহাকবিও বলা হয়। এবার ব্যাসদেবকে আরও সংক্ষিপ্ত করলে দেখ ব্যাস পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে ফোয়ারার বেসমেন্টে ঐ বিরাট পাথরের চাকতিটার মহাকবি থুড়ি ব্যাসের কথা ধাঁধায় বলা হয়েছে।”
কাকুর ব্যাখ্যা শুনে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। গোমস তো “জয়, গণেশ বাবার জয়” বলে চেঁচিয়েই উঠল। দুপুর থেকে আমাদের মধ্যে যে মনমরা ভাবটা ছিল তা উধাও হল এক নিমেষে। আমরা লাফিয়ে হাজির হলাম ফোয়ারাটার সামনে। অমলকাকু ফিতে দিয়ে মেপে দেখলেন ঐ পাথরের চাকতিটার ব্যাস দাঁড়াচ্ছে ছয় ফুট। আমি বললাম, “এরপর ছড়ায় আছে অর্ধে মোদের ঠাঁই / সাথে পাঁচ-পা যুক্ত, হাতখানা অতিরিক্ত।”
গোমস বলল, “ছয় ফুটের অর্ধেক তো হল গিয়ে তিন ফুট। তাহলে….”
অমলকাকু ওকে বাহবা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কে বলে তুমি অঙ্কে কাঁচা! এই তো দিব্যি ছয়কে দুই দিয়ে ভাগ করতে পারলে।”

একথা শুনে আমি আর সঞ্জু দু’জনেই হেসে ফেললাম। আর গোমস সেই যে চুপ করল, রাত্রে খাওয়ার আগে পর্যন্ত তার মুখ দিয়ে আর কোনও বাক্যি বের হল না। যাই হোক, আমরা আবার ধাঁধায় ফিরে এলাম। মাত্র তিন ফুটে মোদের ঠাঁই! এর মানেটা কী? পরের লাইনে আবার পাঁচখানা পা-যুক্ত হাতের কথা বলা আছে। সেটাই বা কী বস্তু! অমলকাকু আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “আচ্ছা, হাতের ক’টা প্রতিশব্দ বল দেখি।”
আমি বললাম, “হস্ত, কর, পাণি, ভুজ….”
“ভেরি গুড। ঐ অতিরিক্ত হাত মানে খুব সম্ভবত অতিরিক্ত ভুজ অর্থাৎ অতিভুজ।”
সঞ্জু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, “ছোটকা, তুমি একদম ঠিক ধরেছ। ওটা অতিভুজই। কিন্তু একটা অতিভুজ তো সরলরেখা। ওটা পাঁচ-পাযুক্ত হবে কীভাবে?”
আমি বললাম, “একজন মানুষ পাঁচ-পা হাঁটলে কতটা দূরত্ব যায় সেটা মাপলে হয় না?”
আমার প্রস্তাবটা অমলকাকুর পছন্দ হল না। উনি বললেন, “এই ডিসট্যান্সটা কখনই ফিক্সড নয়। ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করবে। তাই শচীনবাবুর মতো একজন অঙ্কপ্রিয় মানুষ এমন একটা কাঁচা ক্লু দেবেন, সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
“তাহলে?”
“আচ্ছা, এখানে পা মানে তো সত্যিকারের পা নাও হতে পারে,” সঞ্জু মন্তব্য করল।
“তার মানে, তুই কী বলতে চাইছিস?” আমি জানতে চাইলাম।
“যেমন ধর, ফুটবল নামকরণটা কেন হয়েছে? ঐ বলটা পা দিয়ে খেলা হয় বলেই তো? তাই এক্ষেত্রে হয়ত পা মানে ফুট। অর্থাৎ পাঁচ-পা মানে পাঁচ ফুট।”
অমলকাকু এই ব্যাখ্যা শুনে সঞ্জুকে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “সাবাস, আমার মনে হয় তুইও তোর বাবার মতোই অধ্যাপক হবি। তাহলে অতিভুজের দৈর্ঘ্য যে পাঁচ ফুট তা বেরিয়ে গেল। কিন্তু আগের লাইনটার অর্থ তো উদ্ধার হল না।”

সত্যি, ঐ তিন ফুটে মোদের ঠাঁই হবে কীভাবে তা ভেবে আমরা নাজেহাল হয়ে গেলাম। মোদের ঠাঁই বলতে তো আমাদের থাকার জায়গা বোঝায়। আর আমরা সকলেই যে যার বাড়িতে থাকি। নিজেদের বাড়িতে কোনও অঙ্কের সূত্র লুকিয়ে থাকতে পারে বলে মনে হয় না। এই সময় আবার সঞ্জুই আশার আলো দেখাল। বলল, “সব মানুষই যে কোনও বাড়িতে থাকে, এমনটা নয়। অনেকে তো মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরেও বাধ্য হয়ে দিন কাটায়। তাই মোদের ঠাঁই বলতে একটা কমন কিছু বোঝাবে, যা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
গোমস বলল, “তার মানে কি এখানে মোদের ঠাঁই বোঝাতে গোটা পৃথিবীটাকেই মিন করছে?”
“গোটা পৃথিবী মানে তো জল-স্থল-আকাশ সবই। কিন্তু মানুষ তো আর সাধারণভাবে জলে বা আকাশে থাকে না, থাকে কেবল মাটিতে। কিন্তু মাটির সাথে তো অঙ্কের কোনও সম্পর্ক নেই।”
আমার এই কথা শুনেই অমলকাকুর চোখ চিকচিক করে উঠল। উনি বললেন, “মাটির সাথে অঙ্কের সম্পর্ক নেই বটে, ভূমির সাথে অবশ্যই আছে। আরে ঐ তিন ফুট হল সমকোণী ত্রিভুজের ভূমির দৈর্ঘ্য। অতিভুজ শব্দটা দেখে এটা আমাদের অনেক আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার।”
আমি এবার বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললাম, “তাহলে দাঁড়াচ্ছে, ভূমি তিন ফুট আর অতিভুজ পাঁচ ফুট।”
এবার তাহলে ধাঁধার শেষ স্ট্যানজায় যাওয়া যাক।” অমলকাকু প্রস্তাবটা দিলেন।
কিন্তু সঞ্জু তাতে রাজি হল না। ও বলল, “ঘড়িটা দেখেছ? আটটা বেজে গেছে। এরপর আর হোটেলে খাবার পাবে ভেবেছ? তোমরা এক্ষুনি গিয়ে খাবারের অর্ডার দাও। আমি একবার টয়লেট থেকে ঘুরে যাচ্ছি।”
আমরা সকলেই বুঝতে পারছিলাম আর সামান্য কসরত করলেই ধাঁধাটা সলভ্‌ হয়ে যাবে। কিন্তু সঞ্জু হোটেলে যাবার জন্য এমন তাড়া লাগাতে শুরু করল যে আমাদের ওখান থেকে বেরিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। আমরা তিনজন হোটেলে গিয়ে রুটি আর মাংস অর্ডার দিয়ে দিলাম। মিনিট পনের বাদে গরম গরম খাবারও চলে এল। কিন্তু সঞ্জুর পাত্তা নেই। আমরা ভেবেই পেলাম না, টয়লেটে এতক্ষণ ও কী করছে!

।। আট।।

প্রায় আধঘন্টা বাদে ও হোটেলে এল। বলল, পেটটা একটু খারাপ হয়েছে। ওষুধ অবশ্য ও সঙ্গে করে এনেছে। কিন্তু স্যাকের কোথায় রেখেছে তা ভুলে গিয়েছিল। ওটা খুঁজতেই এত দেরি হয়ে গেছে। সঞ্জু পেট খারাপের কথা বলল বটে, তবে রুটি-মাংস সবই চেটেপুটে উদরস্থ করল। একটু ঝোলও প্লেটে পড়ে রইল না। আমরা সকলেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি দেখে ও বলল, “ওষুধ তো খেয়েই নিয়েছি। তাই খাবারটা নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না।”

আমরা ন’টা নাগাদ আবার বাংলোয় ফিরে এলাম। অমলকাকু বললেন, “এবার তাহলে পরের স্ট্যানজায় যাওয়া যাক – ওই দুটোর বর্গ, কষে দেয় দৈর্ঘ্য।”

“দৈর্ঘ্য মানে নিশ্চয়ই লম্বদৈর্ঘ্য,” আমি বেশ কনফিডেন্সের সঙ্গে বললাম। অমলকাকু তৎক্ষণাৎ আমার সঙ্গে সহমত হলেন। কিন্তু গোমস ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না। আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
অমলকাকু এবার একটা ছোটো ইঁটের টুকরো নিয়ে বারান্দার মেঝেতে ছবি এঁকে ওকে বোঝাতে শুরু করলেন, “একটা ত্রিভুজের তিনটে বাহু আর তিনটে কোণ থাকে। ঐ তিনটে কোণের কোনও একটা কোণ যদি সমকোণ মানে নব্বই ডিগ্রি হয় তবে সেই ত্রিভুজটাকে সমকোণী ত্রিভুজ বলে। আর ওর বাহু তিনটেকে ভূমি, লম্ব আর অতিভুজ বলা হয়। ভূমি আর লম্ব একে অপরের সাথে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে অবস্থান করে। অতিভুজ থাকে ঐ সমকোণের ঠিক বিপরীতে। পিথাগোরাস নামে একজন বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ একটি সূত্র আবিষ্কার…”

সঞ্জু এসব দেখে আর চুপ থাকতে পারল না। বলল, “ছোটকা, এই রাত্রিবেলা হ্যাজাকের আলোয় তুমি ওকে পিথাগোরাস থিয়োরেম বোঝাবে নাকি?”

“না বুঝিয়ে আর উপায় কী বল? ও তো অঙ্কটা একদমই জানে না,” একথা বলে আবার গোমসকে বোঝাতে শুরু করলেন, “সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে পিথাগোরাসের সূত্রটি হল…”
“লম্ব স্কয়ার প্লাস ভূমি স্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু অতিভূজ স্কয়ার,” গোমস মন্তব্য করল।
অমলকাকু সঙ্গে সঙ্গে ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন, “সাবাস! তুমি বিদেশে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গিয়ে তোমার প্রতিভার প্রতি অবিচার করেছ। ওর বদলে তোমার ম্যাথমেটিক্স নিয়ে পড়া উচিত ছিল।”
আমার আর ওসব ছেলে ভোলানো কথা শুনতে ভাল লাগছিল না। আমি তাই কাকুকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “অতিভুজ পাঁচ ফুট আর ভূমি তিন ফুট তো জানাই আছে। এবার তো তাহলে লম্বদৈর্ঘটা বের করে ফেললেই হয়।”

“হ্যাঁ, তা তো বটেই,” একথা বলেই উনি আবার গোমসকে বোঝাতে শুরু করলেন, “এক্ষেত্রে লম্ব-দূরত্ব বের করার জন্য পিথাগোরাসের ঐ সূত্রটিকে আমরা একটু বদলে নেব – লম্ব স্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু অতিভূজ স্কয়ার মাইনাস ভূমি স্কয়ার।”

একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে অত ভ্যানতারা আমার ভাল লাগছিল না। আমি বললাম, “অতিভুজ পাঁচ ফুট। পাঁচের বর্গ পঁচিশ। আর ভূমি তিন ফুট। তিনের বর্গ নয়। পঁচিশ থেকে নয় বিয়োগ করলে দাঁড়াচ্ছে ষোলো। ওটাই লম্ব স্কয়ার। ষোলোর বর্গমূল চার। অতএব লম্বদৈর্ঘ দাঁড়াল চার ফুট।”
অমলকাকু বললেন, “ভেরি গুড। ধাঁধায় এবার আছে, সেখানেই আছে/ ফলখানা গাছে। এবার তাহলে লোহার নলটার গোড়া থেকে চার ফুট মেপে দেখা যাক, কোনও ফল পাওয়া যায় কি না।”
আগেই বলেছিলাম, ফোয়ারার ঐ মোটা নলটার গায়ে লতা-পাতার নকশা খোদাই করা ছিল। ফিতে দিয়ে মেপে দেখা গেল চার ফুট উচ্চতায় লতা-পাতার মধ্যে সত্যিই একটা আম ঝুলছে। আমরা তখন সবাই ভীষণ উত্তেজিত। ধাঁধার শেষ লাইনে আছে – ধরে তার বোঁটাটি, চাপ দিলেই আংটি। আমরা সকলেই দেখলাম, আমটার মাথা থেকে একটা ছোট্ট লোহার তার বোঁটার মত বের হয়ে আছে। তার মানে ওটাতে চাপ দিলেই শচীনবাবুর সেই মহামূল্যবান আংটিটা পাওয়া যাবে। টেনশনের চোটে আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। আমের বোঁটাটা চাপতে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু অমলকাকু আমাকে বাধা দিলেন। বললেন, ওটা গোমসের সম্পত্তি। তাই লোহার তারটাতে ও-ই চাপ দেবে।

গোমস তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঐ নলটার দিকে। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে চাপ দিল ঐ আমের বোঁটায়। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক! আমটার উল্টোদিকের একটা অংশ ঠিক ড্রয়ারের মতো বেরিয়ে এল। আর তার মধ্যে ঝকমক করতে লাগল লাল পাথর বসানো একটা আংটি। গোমস ওটা হাতে তুলে নিয়ে একদম মোহিত হয়ে গেল। তারপর কাকুর হাতে দিয়ে বলল, “এই পাথরটা কি খুব দামী? এটার নাম কী?”

“পাথরটার নাম আমি বলতে পারব না। তবে এতকাল এই লোহার নলটার ভিতর পড়ে থেকেও ওটা যেভাবে চকচক করছে তাতে সহজেই অনুমান করা যায় জিনিসটা খুবই হাই কোয়ালিটির। আর শচীনবাবু নিশ্চয়ই কোনও সাধারণ পাথর এখানে রেখে তা খুঁজে বের করার জন্য এত কঠিন একটা ধাঁধা তৈরি করবেন না! তবে এই পাথরটার নাম আর বর্তমান মূল্য তুমি কোনও জুয়েলারি শপে গেলেই জানতে পারবে। তবে কোনও বিশ্বস্ত চেনা লোকের কাছেই যেয়ো, না হলে ঠকে যেতে পার।”

“আমার ধারণা, পাথরটার দাম কয়েক লক্ষ টাকা। এটা বেচলে যা টাকা পাবে তা দিয়ে দেখবে অনায়াসে তুমি মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবে,” সঞ্জু মন্তব্যটা করল।

একথা শুনে গোমস দারুণ খুশি। ও আমাদের সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বলল যে পরেরদিন ভোরের ট্রেনেই ও অভনপুর চলে যাবে। তারপর সেখান থেকে যেভাবেই হোক রায়পুর হয়ে কলকাতায় পৌঁছবে। আমরা ওকে একটা দিন মানিকচৌরি থেকে পরেরদিন আমাদের সাথেই ফিরে যেতে প্রস্তাব দিলাম। কারণ, আমরা অভনপুর যাব পরশু সকালে। রায়পুর থেকে পরশু বিকালের একটা ট্রেনে আমাদের রিজারভেশন আছে। কাল দুপুরে রায়পুর পৌঁছে তো আর গোমস কোনও ট্রেনের রিজার্ভড টিকিট পাবে না। ওকে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠতে হবে। তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে গেলে ওর সুবিধাই হবে। টিটিকে বলে যদি একটা স্লিপার বার্থ জোগাড় যায় তো ভাল, না হলেও অসুবিধা নেই। আমাদের কারোর সাথে কোনওভাবে ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।

কিন্তু আমাদের প্রস্তাবে গোমস কিছুতেই রাজি হল না। পরদিন ভোরেই বেরিয়ে গেল। বোধহয় অসুস্থ মায়ের কাছে পৌঁছনোর জন্য ওর মনটা খুবই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। ঐ ধাঁধার চক্করে পড়ে গতকাল আমাদের মানিকচৌরি বেড়ানোটা ঠিকঠাক হয়নি। তাই সেদিন ভোরবেলা গোমসকে বিদায় জানিয়ে আমরা গোটা এলাকাটা সারাদিন খুব ঘুরলাম। গোমস যাওয়ার সময়ও আমাদের তিনজনকে আরও একবার ওকে আংটিটা খুঁজে বের করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাল। সঙ্গে দিয়ে গেল ওর ফোন নম্বর আর বাড়ির ঠিকানাটাও। বারবার অনুরোধ করল, কলকাতায় ফিরে আমরা যেন অবশ্যই ওর বাড়ি যাই, ওর অসুস্থ মাকে একবার দেখে আসি। আমরা ওর বাড়ি অবশ্যই যাব বলে কথা দিলাম।
….
আমাদের ফেরার ট্রেন হাওড়া পৌঁছানোর কথা ছিল সকাল সাতটা নাগাদ। কিন্তু ট্রেনটা প্রায় দু’ঘন্টা লেট করল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম। রাতে ট্রেনে কারোরই ভাল ঘুম হয়নি। তাই ভাবছিলাম কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে স্নান-খাওয়া সেরে লম্বা একটা ঘুম দেব। কিন্তু সঞ্জু আমার ইচ্ছায় বাধ সাধল। ড্রাইভারকে বলল, “শ্যামবাজার।”
অমলকাকু বললেন, “শ্যামবাজার মানে! আমরা এখন বাড়ি যাব না?”
সঞ্জু সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, “না।”

তোকে এখনই গোমসের বাড়ি যেতে হবে? বাড়ি ফিরে খানিকক্ষণ রেস্ট নিয়ে বিকালবেলা গেলে চলত না?” আমি বেশ বিরক্তির সঙ্গেই কথাগুলো বললাম।
সঞ্জু এবার মৃদু হেসে বলল, “অরুন্ধতী গোমস তাঁর দাদার মহামূল্যবান আংটিটা আদৌ পেলেন কি না সেটা জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে।”

“ওঁর ছেলে মানে অনিরুদ্ধর তো গতকালই ফিরে আসার কথা। তুই কি ভাবছিস অনিরুদ্ধ এখনও শ্যামবাজারে ফিরতে পারেনি? আমি ওকে এক্ষুনি ফোন করছি,” এই বলে কাকু ওকে ফোনে ট্রাই করলেন। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। তারপর বললেন, “কী ব্যাপার বল তো? বার বার বলছে দিস টেলিফোন নাম্বার ডাজ নট একজিস্ট।”
“আমি এরকম একটা কিছুই আশা করছিলাম। যাই হোক, লোকটা আংটি নিয়ে ফিরেছে কি ফেরেনি সেটা ওর বাড়ি গেলেই বোঝা যাবে।”
“কী হেঁয়ালি করছিস সঞ্জু? একটু ঝেড়ে কাশ না,” অমলকাকু একটু রাগের সুরেই কথাটা বললেন।
“আমি এখন কিছুই খোলসা করে বলতে পারব না। আমি একটা কিছু অনুমান করেছি মাত্র। সেটা সঠিক নাও হতে পারে। আগে আমরা শ্যামবাজার পৌঁছোই। গোমসের বাড়ি যাই। তারপর তোমাদের সব বলব।”
পরের আধঘন্টা সঞ্জুর মুখ থেকে আর একটা কথাও বের করতে পারলাম না। দশটা নাগাদ আমরা শ্যামবাজার পৌঁছলাম। আমাদের গন্তব্য পাঁচ-এ, সুবল ঘোষ লেন। কিন্তু ঐ ঠিকানায় কোনও গোমস পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেল না। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলেছিলেন। তিনি আমাদের জানালেন, শুধু পাঁচ-এ কেন, ঐ গোটা সুবল ঘোষ লেনেই কোনওদিন কোনও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ছিল বলে তিনি জানেন না। আমরা তখন বেশ বুঝতে পারলাম গোমস আমাদের ইচ্ছা করেই ভুল ঠিকানা দিয়েছে। কিন্তু কেন?

উত্তরটা সঞ্জুই দিল। বলল, “লোকটা আসলে ফ্রড, বুঝলি! ও কখনোই অনিরুদ্ধ গোমস নয়। তবে গোমসদের ও ভাল করেই চেনে। আর যেভাবেই হোক ও গোমসদের কাছ থেকেই ঐ ধাঁধাটা জোগাড় করেছে। তবে বাস্তবে ঠিক কী ঘটেছে তা গোমস ফ্যামিলির কোনও একজনের সাথে দেখা না হলে জানা যাবে না।”

আমি তখন বললাম, “তোর কথামতো ঐ লোকটা যদি সত্যিই ফ্রড হয় তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের বোকা বানিয়ে ও অত দামী একটা আংটি বাগিয়ে নিয়েছে।”
সঞ্জু আমার কথার কোনও জবাব না দিয়ে অমলকাকুকে বলল, “ছোটকা, বো ব্যারাকে তোমার এক বন্ধু থাকতেন না? জয় ডিকোস্টা না কী যেন একটা নাম?”
“হ্যাঁ, জয় ডিকোস্টাই তো। তাকে দিয়ে কী হবে?”

“ওঁর ফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে? থাকলে ভদ্রলোককে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখ তো উনি অরুন্ধতী বা অনিরুদ্ধ গোমস বলে কাউকে চেনেন কি না। আসলে কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটিতে একজন আরেকজনের ভালোই খবরাখবর রাখেন বলে শুনেছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ঐ ফ্রড লোকটা নিজের সম্পর্কে মিথ্যা বললেও গোমসদের সম্পর্কে যা যা বলেছে সেগুলো সবই সত্যি।”
অমলকাকু সঙ্গে সঙ্গে জয় ডিকোস্টাকে ফোন করলেন। উনি এল.আই.সি.তে বেশ উঁচু পদে চাকরি করেন। কলকাতাতেই পোস্টেড। ফোনে ভদ্রলোকের সাথে একটুখানি কথা বলেই অমলকাকু ফোন ছেড়ে দিলেন। বললেন, “জয় এখন হাতিবাগানের অফিসে আছে। আমাদের ওখানেই যেতে বলল।”
অতঃপর আমরা আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আবার একটা ট্যাক্সি ধরে হাতিবাগানের দিকে রওনা হলাম। বলা বাহুল্য, এল.আই.সি. অফিস খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হল না। জয় ডিকোস্টা আমাদের বেশ আদর করে তাঁর চেম্বারে বসালেন। তারপর আমাদের কাছ থেকে সব শুনে যা বললেন তার সারমর্ম হল –

বছর পনের আগে একটা নিউ ইয়ার পার্টিতে ওঁর সাথে অ্যান্টনি গোমসের আলাপ হয়েছিল। গোমসের বৌ বাঙালি। একটা বাচ্চা ছেলেও ছিল। অ্যান্টনি গোমস তখন সপরিবারে বাগবাজারে থাকতেন। এরপর আরও দু’একবার অ্যান্টনি গোমসের সাথে ডিকোস্টা আঙ্কলের দেখা হয়েছে। ঐ আলাপের বছর দুয়েক বাদে হঠাৎই একদিন অ্যান্টনি গোমসের মৃত্যু সংবাদ আঙ্কলের কানে আসে। তখন তিনি বাগবাজারে গোমসদের বাড়িতে গিয়েছিলেন মিসেস অরুন্ধতী গোমসকে সমবেদনা জানাতে। তারপর মাঝে মধ্যে কয়েকবার ভদ্রমহিলার সাথে ওঁর দেখা হয়েছে। অনিরুদ্ধ যে ইংল্যান্ডে যাচ্ছে পড়াশোনা করতে, সে খবরও ডিকোস্টা আঙ্কল অরুন্ধতী গোমসের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হয়নি। অনিরুদ্ধ যে ইংল্যান্ডে মারা গেছে বা অরুন্ধতী গোমস যে ক্যানসারে আক্রান্ত, সেরকম কোনও খবর আঙ্কলের কাছে নেই।

ডিকোস্টা আঙ্কলের কাছে সবটা শুনে সঞ্জু বলল, “আঙ্কল, আমাদের এক্ষুনি একবার বাগবাজারে গোমসদের বাড়িতে যেতে হবে। খুব দরকার। আপনি কি আমাদের সাথে একটু…”
“আসলে একজন এজেন্ট একটু বাদেই আমার কাছে একটা জরুরি দরকারে আসবে। ঠিক আছে, আমি ফোন করে ওকে বলে দিচ্ছি ঘন্টাখানেক বাদে আসতে। কিন্তু অরুন্ধতী গোমসের সাথে তোমাদের এক্ষুনি কী দরকার সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।”
“আমরাও পারছি না।” অমলকাকু ঠোঁট বেঁকিয়ে মন্তব্যটা করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জু ঝাঁঝিয়ে উঠল, “তোমায় বললাম না ছোটকা, একটা ব্যাপার আমি অনুমান করেছি মাত্র। এখন সেটা কিছুটা পরিষ্কারও হয়েছে। তবে অরুন্ধতী গোমসের সাথে দেখা না হলে স্পষ্ট করে কিছুই বলা যাবে না। তাই ভদ্রমহিলার সাথে তাড়াতাড়ি দেখা হওয়াটা খুব জরুরি।”
অতঃপর ডিকোস্টা আঙ্কল বা অমলকাকু কেউই আর বাক্যব্যয় করলেন না। আমরা চারজন বাগবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অবশ্য এবার ট্যাক্সিতে নয়, ডিকোস্টা আঙ্কলের নিজের গাড়িতে।

।। দশ।।

বাগবাজারে আমরা চারজন যে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম সেটা বেশ পুরনো আমলের। ডিকোস্টা আঙ্কল দরজা নক্‌ করলেন। সামান্য বাদেই একটা কমবয়সী ছেলে দরজা খুলে দিল। তারপর আঙ্কল নিজের পরিচয় দিতেই সে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। একটা খাটের ওপর বসে ছিলেন অরূন্ধতী গোমস, পরনে একটা গাউন। সামনের টেবিলে একগাদা ওষুধপত্র। আর পাশে একটা হুইল চেয়ারে একজন বছর পঁচিশের তরুণ। ও যে অনিরুদ্ধ তা আমাদের কারোরই বুঝতে বাকি রইল না। ডিকোস্টা আঙ্কল এভাবে আমাদের নিয়ে হঠাৎ ওখানে উপস্থিত হওয়াতে মা-ছেলে দুজনেই যে বেশ অবাক হয়েছেন, তা বিলক্ষণ বোঝা গেল। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর আঙ্কল আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন দুই গোমসের সাথে।

এরপর ওঁদের দুজনের সাথেই বেশ কিছুক্ষণ আমাদের কথা হল। বুঝতে পারলাম শচীনবাবুর ধাঁধার ইতিহাস, অনিরুদ্ধর লন্ডনে পড়তে গিয়ে মায়ের ফোন থেকে সেকথা জানতে পারা এবং দেশে ফেরার আগে তার কার অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা – সবই সত্যি ঘটনা। কিন্তু ঐ অ্যাক্সিডেন্টে অনিরুদ্ধর হাত কাটা যায়নি। সে মারাত্মক চোট পেয়েছে কোমরে। যার দরুণ হুইল চেয়ার এখন তার নিত্যসঙ্গী। তাহলে মানিকচৌরিতে নকল অনিরুদ্ধ সেজে কে হাজির হয়েছিল? ধাঁধাটাই বা সে পেয়েছিল কীভাবে? আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর অনিরুদ্ধই দিল। সে যা বলল, তা সংক্ষেপে এইরকম –

যে ছেলেটিকে মানিকচৌরিতে আমরা দেখেছি, তার নাম রাজীব বসাক ওরফে রাজু। ও অনিরুদ্ধের স্কুলের বন্ধু। আগে থাকত হাতিবাগানে। এখন বোধহয় মানিকতলার কোথাও একটা থাকে। ওরা দুজনে সেই ক্লাস ফাইভ থেকে সেন্ট পলস্‌ স্কুলে পড়ত। রাজু প্রায়ই আসত গোমসের বাড়িতে। মাধ্যমিক অব্দি ওরা একসঙ্গেই পড়াশোনা করেছে। কিন্তু তারপরেই ওদের স্ট্রিম আলাদা হয়ে যায়। রাজুর কোনওদিনই পড়াশোনায় বিশেষ মন ছিল না। বাড়িতেও নানারকম সমস্যা ছিল। এর ওপর শিয়ালদার একটা কলেজে ঢুকে রাজু কিছু বদবন্ধুর পাল্লায় পড়ে একেবারে বখে যায়। নেশাভাঙ শুরু করে। তবে অনিরুদ্ধর কাছে ও মাঝেমধ্যেই আসত। এইসময় অনিরুদ্ধ ওকে শোধরানোর অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

যাই হোক, কিছুকাল বাদেই অনিরুদ্ধ ইংল্যান্ডে চলে যায়। এদিকে রাজু এক নেতার ছত্রছায়ায় গুন্ডাবাজি শুরু করে। একদিন বিপক্ষদলের ছোঁড়া বোমায় ওর বাঁ হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে উড়ে যায়। এরপর রাজু মস্তানি ছেড়ে দেয়। ওর বাড়ির লোকেরা ইতিমধ্যে হাতিবাগান ছেড়ে মালদার দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। রাজু বাড়ির লোকের সাথে যায়নি। ও মানিকতলায় উঠে গিয়ে সেখানে একটা ছোটোখাটো দোকান চালাতে শুরু করে। তবে এই সময়েও ইন্টারনেটের মাধ্যমে রাজুর সাথে অনিরুদ্ধর যোগাযোগ ভালই ছিল। ব্যাপারটা অরুন্ধতী গোমসের একদম পছন্দ ছিল না। তিনি ফোনে ছেলেকে রাজুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে মানাই করতেন। কিন্তু অনিরুদ্ধের বক্তব্য ছিল তার বন্ধু এখন ভাল হয়ে গেছে। সে-ই নিজে তৎপর হয়ে ইংল্যান্ড থেকে রাজুর জন্য আর্টিফিশিয়াল লিম্বের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, মায়ের কাছে ফোনে শচীনবাবুর ধাঁধার বিষয়টা জানতে পেরে অনিরুদ্ধ তা রাজুকে বলেও দিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল দেশে ফিরে ও বন্ধুকে নিয়েই মানিকচৌরি যাবে। কিন্তু গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য সে ইচ্ছা আর অনিরুদ্ধর পূরণ হয়নি।
অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরে আসার পরদিনই রাজু বাগবাজারের এই বাড়িতে এসে হাজির হয়। ও একাই মানিকচৌরি গিয়ে আংটিটা নিয়ে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অনিরুদ্ধ রাজি হলেও মিসেস গোমস প্রস্তাবটা মেনে নেননি। আসলে উনি রাজুকে একদম পছন্দ করতেন না। তখন ঠিক হয়, অনিরুদ্ধ যেদিন ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারবে সেদিন সে নিজেই মানিকচৌরি যাবে। কথাটা শুনে রাজু বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি। শুধু অরুন্ধতী গোমসের আড়ালে একবার তার বন্ধুর কাছে ধাঁধাটা শুনতে চেয়েছিল। আর অনিরুদ্ধও বোকার মত রাজুকে তা শুনিয়ে দিয়েছিল। এটা মাসখানেক আগেকার কথা। সেদিন থেকে রাজুর আর কোনও পাত্তা নেই।
অনিরুদ্ধের মুখে সবটা শুনে আমি বললাম, “অতো বড়ো ছড়াটা রাজু একবার শুনেই হুবহু মনে রাখল কীভাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছি না! এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি খুব একটা…”

“শোন দীপু, আজকাল প্রায় সমস্ত সেলফোনেই সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। অনিরুদ্ধদা যখন ধাঁধাটা পড়েছে, তখন রাজু সেটা হয়তো গোপনে রেকর্ড করে নিয়েছে। তারপর ধাঁধাটা কাগজে লিখে পৌঁছে গেছে মানিকচৌরি। তাই ও নিয়ে অতো অবাক হওয়ার কিছু নেই।”

সঞ্জুর এই বক্তব্যের পর আর কোনও কথা চলে না। আমি তাই চুপ করে গেলাম। ওদিকে রাজু সেই মহামূল্যবান আংটিটা নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে শুনে গোমস আর তার মা ভীষণ ভেঙে পড়লেন। ওই অসুস্থ শরীরেও মিসেস গোমস ছেলের বোকামির জন্য তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। অনিরুদ্ধ প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। শুধু বলল, “রাজু এরকম বেইমানি করল! এখন আমার আর মায়ের ট্রিটমেন্টের জন্য এই বাড়িটা বোধহয় আমাদের বেচে দিতে হবে।”

ডিকোস্টা আঙ্কল ওদের দুজনকেই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। উনি মিসেস গোমসকে বললেন, “কলকাতা পুলিশের এক ডি.আই.জি. আমার বন্ধু। ওর সাহায্য নিয়ে আমি রাজুকে ঠিক খুঁজে বের করব। আর তারপর ঐ আংটিটা আমি আপনার হাতে তুলে দেব।”

“সেটা আপনি পারবেন না ডিকোস্টা আঙ্কল। কারণ, আংটিটা রাজুর কাছে নেই,” সঞ্জু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলল।
আমরা তখন প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম, “নেই মানে! তাহলে আংটিটা কোথায়?”
“আমার কাছে,” সঞ্জু খুব শান্তস্বরে জবাবটা দিল।

সত্যি বলছি, আমরা তখন কেউই মুখে ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সঞ্জু সম্ভবত আমাদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারল। তাই ও নিজেই বলতে শুরু করল, “ঐ রাজুকে দেখে আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল। প্রথম সন্দেহটা হয় ওর ছবি তোলার অনীহা দেখে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল ও চাইছে না যে ওর কোনও ছবি আমাদের কাছে থাকুক। সঙ্গে এটাও মনে হল লোকটা আসল গোমস মানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নয়, আমাদের মতই একজন সাধারণ ভেতো বাঙালি। তোমরা হয়তো কেউই লক্ষ করোনি, ওর গলায় একটা রূপোর হার ছিল। হারটায় যে ছোট্ট লকেটটা ঝুলছিল তাতে ছিল মাকালীর ছবি। তাছাড়া যখন চপের ঠোঙায় গণেশঠাকুরের ছবি দেখে মহাকবির ব্যাপারটা সলভ্‌ হয়, তখন আনন্দে ও বলে উঠেছিল ‘জয়, বাবা গণেশের জয়’। একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চানের মুখে এমন উক্তি ঠিক খাপ খায় না। তাছাড়া যে ছেলে ম্যানেজমেন্ট পড়তে লন্ডনে গেছে সে প্রায় মাসখানেক চেষ্টা করেও ধাঁধাটার একটা অংশও সলভ্‌ করতে পারেনি এটাও ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই আমি মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে আংটিটা ওর হাতে পড়তে দেব না। আগে নিজে গোমসের বাড়ি যাব। নিজের চোখে সব দেখে তবেই জিনিসটা হস্তান্তরিত করব।”

“কিন্তু আংটিটা তো গোমস আমাদের সামনেই নিজের হাতে নিল। তাহলে ওটা তুই আবার পেলি কোথা থেকে? জিনিসটা তুই ওর কাছ থেকে চুরি করেছিস নাকি? তোকে বাপু কিচ্ছু বিশ্বাস নেই!” অমলকাকু বেশ উদ্বেগের সাথেই কথাগুলো বললেন।

সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “তুমি কী যে বল ছোটকা! একটা চোরের কাছ থেকে আংটি চুরি করা কি মুখের কথা? আসলে তোমরা ঐ ফোয়ারার নলটার ভিতরে যে আংটিটা দেখেছিলে, সেটার দাম মাত্র দশ টাকা। ওটা আমি অভনপুর স্টেশনের পাশে যে ছোট্ট মেলাটা হচ্ছিল সেখান থেকে কিনেছিলাম।”
“তার মানে? তোর ঐ আংটিটা ওখানে গেল কীভাবে?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলাম।
“একটু ভেবে দ্যাখ, শচীনবাবুর ধাঁধার প্রথম দুটো স্ট্যানজা বেশ ঝামেলার হলেও শেষ স্ট্যানজাটা কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক সোজা ছিল। পিথাগোরাসের সূত্র প্রয়োগ করে লম্ব-দূরত্ব বের করাটা আমাদের কাছে তো কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। এরপর শুধু কাজ বাকি ছিল ফলখানা খুঁজে তার বোঁটায় চাপ দেওয়া। সেটা রাজুর আড়ালে করব বলেই তোদের জোর করে সেদিন খেতে পাঠিয়েছিলাম।”

“তার মানে আমরা হোটেলে চলে আসার পর তুই ফোয়ারার নল থেকে আসল আংটিটা বের করে নিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ, আর সেখানে রেখে দিয়েছিলাম আমার দশ টাকা দামী আংটিটা। তবে ওটা প্রথমে স্যাকের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই হোটেলে পৌঁছতে আমার সেদিন কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। পাছে আমার দেরি দেখে রাজু সন্দেহ করে তাই পেট খারাপের গল্প ফেঁদেছিলাম।”

অমলকাকু পুরোটা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, “সত্যি সঞ্জু, তোর জবাব নেই! তা পুরো ব্যাপারটা দু’দিন ধরে আমাদের কাছে বেমালুম চেপে গেলি কেন? রাজু বাংলো ছেড়ে চলে যাবার পর আমাদের সব বলে দিতেই পারতিস।”

“আসলে ছোটকা, আমি তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
“সারপ্রাইজ তো ভালোই হল, এখন আসল আংটিটা দেখা। চোখ সার্থক করি।”

সঞ্জু তখন ওর স্যাকের ভিতর থেকে আংটিটা বের করল। আংটিটা সোনার আর তাতে বেশ বড়ো সাইজের সবুজ রঙের একটা পাথর বসানো। আমরা এক এক করে সকলে ওটা হাতে নিয়ে দেখলাম। ডিকোস্টা আঙ্কল বোধহয় পাথর-টাথর চেনেন। উনি বললেন, “আমার মনে হচ্ছে এটা মরকত, জুয়েলারিতে নিয়ে গেলে কনর্ফাম হওয়া যাবে। তবে আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে এই পাথরটার বর্তমান বাজারদর মিনিমাম ফাইভ ল্যাক তো হবেই। এছাড়া সোনাটাও তো বেশ ভালই আছে। অনিরুদ্ধ, এটা বেচে তোমাদের দুর্দশা কিছুটা মিটবে আশা করা যায়। ভাগ্যিস এই ছেলেটা বুদ্ধি করে আংটিটা সরিয়ে রেখেছিল। না হলে এতক্ষণে জিনিসটা তোমার বেইমান বন্ধুর নেশা আর ফুর্তির খরচ জোগাত।”

একথা শুনে অনিরুদ্ধ আর তার মা দুজনেই সঞ্জু আর আমাদের তাঁদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালেন। তারপর আমরা বারবার না করা সত্ত্বেও যে ছেলেটি ওঁদের দেখাশোনা করে তাকে দিয়ে আনালেন একগাদা মিষ্টি। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করার পর আমাদের রেহাই মিলল। ডিকোস্টা আঙ্কলের ইচ্ছা ছিল পুলিশে খবর দিয়ে রাজুকে প্রতারণার দায়ে অ্যারেস্ট করাবেন। কিন্তু অনিরুদ্ধ এবং তার মা দু’জনেরই বক্তব্য, ছেলেটা প্রায় একমাস মানিকচৌরি পড়ে থেকেও একদম খালি হাতে ঘরে ফিরেছে। সেটাই ওর বড়ো শাস্তি। তাই আর থানা-পুলিশে কাজ নেই।

গোমসদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডিকোস্টা আঙ্কল তড়িঘড়ি নিজের অফিসে ফিরে গেলেন। আর আমরা তিনজন আবার একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম। এবার গন্তব্য ভবানীপুর মানে আমাদের বাড়ি। ট্যাক্সিতে বসে আমি বললাম, “আচ্ছা অমলকাকু, রাজুর মতো একটা জালিয়াত ঐ দশ টাকার আংটিটা যে নকল সেটা ধরতে পারল না কেন বলুন তো?”

অমলকাকু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সঞ্জু গম্ভীরস্বরে বলে উঠল, “ওটা অভনপুরের যাদু, বুঝলি! যেভাবে একজন সাদামাটা দেহাতি মানুষ ছোটকার কাছে ডাকাত হয়ে গিয়েছিল, সেভাবেই একটা সাধারণ পাথরও অভনপুরের হাওয়া লেগে রাজুর কাছে মরকত হয়ে গেছে।”
কথাটা শুনে অমলকাকু প্রথমটা খানিক গুম হয়ে রইলেন। তারপর ট্যাক্সির জানলার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “ছেলেটা আজকাল বড়ো ডেঁপো হয়ে গেছে।”
আমার তখন হাসি আর ঘুম দু’টোই একসঙ্গে পাচ্ছে। তাই রুমালটা দিয়ে গোটা মুখটা ঢেকে মাথাটা এলিয়ে দিলাম সঞ্জুর কাঁধে।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত