নাগিনী কন্যার কাহিনী

নাগিনী কন্যার কাহিনী

মা-ভাগীরথীর কূলে কূলে চরভূমিতে ঝাউবন আর ঘাসবন, তারই মধ্যে বড় বড় দেবদারু গাছ। উলুঘাস কাশশর আর সিদ্ধি গাছে চাপ বেঁধে আছে। মানুষের মাথার চেয়েও উঁচু। এরই মধ্যে গঙ্গার স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হিজল বিল এঁকেবেঁকে নানান ধরনের আকার নিয়ে চলে গেছে। ক্রোশের পর ক্রোশ লম্বা হিজল বিল। বর্ষার সময় হিজল বিল বিস্তীৰ্ণ বিপুল গভীর, শীতে জল কমে আসে, গঙ্গার টানে জল নেমে যায়, সূর্যের উত্তাপে শুকিয়ে আসে, তখন হিজল বিল টুকরো টুকরো। হিজল বিল থেকে নালার শতনরী গিয়ে মিশেছে গঙ্গার স্রোতের সঙ্গে; আশ্বিনের পর থেকে টুকরো টুকরো বিলগুলিকে দেখে মনে হয়, ওই হারের সঙ্গে গাঁথা কালো মানিকের ধুকধুকি। তখন হিজল বিলের জলের রঙ কাজলকালো, নীল আকাশ জলের বুকে স্থির হয়ে আসে, যেন ঘুমোয়। চারিপাশের ঘাসবনে তখন ফুল ফোটে। সাদা নরম পালকের ফুলের মত কাশফুল, শরফুল—অজস্র, রাশি রাশি। দূর থেকে মনে হয়, শরতের সাদা মেঘের পুঞ্জ বুঝি হিজল বিলের কূলে নেমে এসেছে—তার সেই ঘন কালো রঙ, বর্ষায় যা ধুয়ে ধুয়ে গলে গলে। ঝরে পড়ে জমা হয়ে আছে ওই হিজল বিলের বুকে—তাই ফিরিয়ে নিতে এসে বিলের কূলে প্রতীক্ষমাণ হয়ে বসে আছে। মধ্যে মধ্যে হিজল বিলের বাতাস ভরে ওঠে অপরূপ সুগন্ধে। পাশেই গঙ্গার বুকে নৌকা চলে অহরহ,সেই সব নৌকার মাঝি-মাল্লারা পুরুষানুক্রমে জানে, কোথা থেকে আসছে এ সুগন্ধ। তাদের মনে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কোনো কথাও বলে না–গন্ধ নাকে ঢুকবামাত্র শুধু হিজল বিলের ঘাসবনের দিকে যেন অকারণেই বারেকের জন্য তাকিয়ে নেয়। আরোহী থাকলে তারাই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে—কোথা থেকে এমন গন্ধ আসছে মাঝি? আঃ!

মাঝি আবার একবার তাকায় হিজলের ঘাসবনের দিকে, বলে-ওই হিজল বিলের ঘাসবন থেকা বাবু। ঘাসবনের ভিতর কোথাকে বুনো লতায় কি বুনো ঝোপে-ঝাড়ে ফুল ফুটি থাকবে।

হিজল বিলের ডাক শুধু গন্ধেরই নয়–শব্দেরও আছে।

হিজল বিলে ওঠে বিচিত্ৰ কলকল শব্দ।

আরোহী যদি ঘুমিয়ে থাকে, তবে ওই শব্দে যায় ভেঙে সে ঘুম। সে শব্দ যেমন উচ্চ তেমনি বিচিত্র। মধ্যে মধ্যে উচ্চ শব্দকে উচ্চতমগ্রামে তুলে আকাশে ঠিক যেন ভেরীনাদ বেজে ওঠেক কর্‌ কর্‌ কর্‌ কর্‌ কর্‌! ভেরীর আওয়াজের মত শব্দ ছড়িয়ে পড়ে হিজলের আকাশের দিকে দিগন্তরে। আরোহী জেগে উঠে সবিস্ময়ে তাকায়—কি হল? কোথায়, কে বাজায় ভেরী? সত্যিই কি আকাশে ভেরী বাজছে? কে বাজাচ্ছে? মাঝি আরোহীর বিস্ময় অনুমান করে হেসে রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে–পাখি বাবু—গগন-ভেরী পাখি; হুই-হুই-উড়ে চলছে।

ওই দেখ বিপুল আকারের পাখি তার বিশাল পাখা মেলে ভেসে চলছে আকাশে। ভেরীর আওয়াজের মত ডাক, নাম তাই গগন-ভেরী। গরুড়ের বংশধর ওরা। গরুড় আকাশপথে চলেন। লক্ষ্মীনারায়ণকে পিঠে বয়ে নিয়ে। বংশধরেরা নাকি আগে চলে এই ভেরীনাদ কণ্ঠে বাজিয়ে। মাঝিই বলবে আরোহীকে। ওরাই জানে এ দিব্য সংবাদ। নিচে অন্য পাখিরাও কলরব করে ডেকে ওঠে। তারাও পুলকিত হয় দেবতার আবির্ভাবে।

বিলের বুকে হাঁসের মেলা বসেছে, কার্তিক মাস পড়তে না পড়তে। হাজারে-হাজারে কঁকে-কঁকে নানান আকারের বহু বিচিত্র বর্ণের হস এসে বাসা নিয়েছে। জলের বুকে ভাসছে, ড়ুবছে, উঠছে, বিলের চারি পাশের শালুক-পানাড়ি-পদ্মবনের মধ্যে ঠুকরে ঠুকরে টাটি ভেঙে খাচ্ছে, ড়ুব দিয়ে শামুকগুগলি তুলছে, কলরব করছে, মধ্যে মধ্যে পাক দিয়ে উড়ছে, ঘুরছে, আবার ঝাপঝপ করে জলের বুকে ঝাঁপিয়ে ভেসে পড়ছে। বহু জাতের হাঁসের বিভিন্ন ডাক একসঙ্গে মেশানো এক কলরব–কলকল, ক্যাঁক ক্যাঁক ক্যাও-ক্যাও ক্যা-ও-ক্যা-ও। তার সঙ্গে ওই ভেরীনাদের মত কর্‌-কর্‌-কর্‌-কর্‌ ধ্বনি।

নৌকার আরোহীরা সবিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকায়—এই বিচিত্র সঙ্গীতময় শব্দ শুনে দেখতে পায়, আকাশ ছেয়ে উড়ছে পাখির ঝাঁক।

—এত পাখি!

–হিজল বিল বাবু। ওই তো ওই ঘাসবনের ঝাউবনের উ–পারে। ওই যে দেখছেন নালাগুলি, ওই সব নালা আসছে ওই বিল থেক্যা।

শিকারিরা প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। পুষ্পবিলাসী যারা, তারাও ব্যগ্রতা প্রকাশ করে।

–শিকারি গেলে তো হয়!

–ওই ফুলের চারা পাওয়া যায় না মাঝি?

মাঝিরা শিউরে ওঠে। কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে।

—এমন কথাটি মুখে আনবেন না হুজুর। যমরাজার দখিন-দুয়ার হিজলেরই বিল।

খুব সত্য কথা। এক বিন্দু অতিরঞ্জিত নয়। হিজলের ঘাসবনে, জলতলে মৃত্যুর বসতিই বটে।

রাত্রি হলে সে কথা বলে বুঝিয়ে দিতে হয় না। ঘাসবনের কোল ঘেষে স্রোত বেয়ে রাত্রে যখন নৌকা চলে তখন এ সত্য আপনি উপলব্ধি করে আরোহীরা। জ্যোৎস্না রাত্রি হয়ত; হিজল বিলের উপরে আকাশে চাঁদ, নিচে জলের অতলে চাঁদ। সাদা ফুলে ভরা কাশবন শরবন জ্যোত্সায় ঝলমল করছে; ঝাউগাছের মাথা দেবদারুর পাতা ঝিকঝিক করছে; বাতাসের সর্বাঙ্গে ফুলের গন্ধের সমারোহ, আকাশে প্রতিধ্বনি উঠছে রাত্রিচর হাঁসের ফঁকের কলকণ্ঠের ডাকের বিচিত্র বিশাল একন সঙ্গীতের মত, এমন সময় সমস্ত কিছুকে চকিত করে দিয়ে একটা ডাক উঠল—ফে-উ। মুহূর্তে শিউরে উঠল সর্বাঙ্গ।

কয়েক মিনিট বিরতির পর আবার উঠল ডাক-ফে-উ—ফে-উ।

আবার–ফেউ-ফেউ-ফেউ।

এবার স্তব্ধ ঘাসবনের খানিকটা ঠাঁই সশব্দে নড়ে উঠল। জলে কুমির পাক খেলে লেজের ঝাপটা মারলে যেমন আলোড়ন ওঠে, জল যেমন উতলপাতল করে ওঠে, হিজলের ঘাসবনে তেমনি একটা আলোড়ন ওঠে সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায়—নিম্ন ক্রুদ্ধ গর্জন—গরর্‌!—গ—র্‌–র্‌! ফ্যাঁস-ফ্যাঁস!—গ—র্‌–র্‌! গোঁ! ওঁ!

চতুর কুটিল চিতাবাঘের বাসভূমি—এই ঘাসবন সিদ্ধির জঙ্গল, ঝাউ এবং দেবদারুর তলদেশগুলি। রাত্রে তারা বের হয়, পিছনে বের হয় ফেউ ফেউয়ের ডাকে দাঁড়িয়ে উত্যক্ত চিতা লেজ আছড়ে নিম্ন ক্রুদ্ধ গর্জন করে শাসায়—গর-র গর-! কখনও কখনও এক-একটা উঁচু হকও দিয়ে ওঠেঅ্যাঁক! অ্যাঁও! সঙ্গে সঙ্গে দেয় একটা লাফ! চকিতে জ্যোৎস্নায় দেখা যায় চিত্রিত হলুদ পিঠখানা।

বিলের জলের ধারে কালো কিছু চঞ্চল হয়ে মুখ তুলে কান খাড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। গজরায়—গোঁ-গোঁ-গোঁ! কখনও কখনও অবরুদ্ধ ক্রোধে অধীর হয়ে ছুটে যায় শব্দের দিক লক্ষ্য করে, কখনও বা ছুটেও পালায়। বুনো শুয়োরের দল, বিলের ধারে মাটি খুঁড়ে জলজ উদ্ভিদের কন্দ খেতে খেতে বাঘের সাড়ায় তারাও চঞ্চল হয়ে ওঠে।

ভয় কিন্তু ওসবে নয়। চিতাবাঘ বুনো শুয়োর বল্লমের খোঁচায় লাঠির ঘায়ে মারা যায়। এ দেশের গোয়ালারা চাষীরা জোয়ানেরা দল বেঁধে অত্যাচারী চিতাবাঘ বুনো শুয়োর খুঁজে বের করে মেরে ফেলে। কিন্তু বাঘ শুয়োরের চেয়ে আরও ভয়ের কিছু আছে। বাঘ, শুয়োর—এরাও তাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত। ঘাসের বনের মধ্যে একফালি সরু পথের উপর দিয়ে যখন ওরা চলে, তখন চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে অতর্কিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর আক্রমণের আশঙ্কা। সামান্য শব্দে চকিত হয়ে থমকে দাঁড়ায়, কান পেতে শোনে, মৃদু গর্জন করে। কোথা থেকে হয়ত কোনো ঝাউগাছের ডাল থেকে বা দেবদারুর ঘন পল্লবের মধ্য থেকে অথবা ঘন ঘাসবনের মাথার উপর বিস্তৃত লতার জাল থেকে একটা মোটা লম্বা দড়ি চাবুকের মত শিস দিয়ে আছড়ে এসে পড়বে। তার গায়ে-চোখের সামনে লকলক করে দুলে উঠবে চেরা একখানা লম্বা সরু জিভ, মুহূর্তে বিঁধে যাবে একটা অগ্ন্যুত্তপ্ত সূক্ষ্ম সুচের মত কিছু; সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের শিরায় স্নায়ুতে বয়ে যাবে বিদ্যুতের প্রবাহের মত অনুভূতি; পৃথিবী দুলে উঠবে, ঝিমঝিম করে উঠবে সর্বাঙ্গ।… তারপর আর ভাবতে পারে না, দুরন্ত ভয়ে পিছিয়ে যায় কয়েক পা।

হিজল বিলে মা-মনসার আটন। পদ্মাবতী হিজল বনের পদ্মশালুকের বনে বাসা বেঁধে আছেন। চাঁদো বেনের সাত ডিঙা মধুকর সমুদ্রের বুকে ঝড়ে ড়ুবিয়ে এইখানে এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বৃন্দাবনের কালীদহের কালীগ কালো ঠাকুরের দণ্ড মাথায় করে কালীদহ ছেড়ে এসে এখানেই বাসা বেঁধেছে। কালীনাগ বলেছিল—তুমি তো আমাকে দণ্ড দিয়ে এখান থেকে নির্বাসন দিলে; কিন্তু আমি যাব কোথায় বল? ঠাকুর বলেছিলেন ভাগীরথীর তীরে হিজল বিল, সেখানে মানুষের বাস নাই, সেখানে যাও। বিশ্বাস না হয়, বর্ষার সময় গঙ্গার বন্যায় যখন হিজল বিল আর গঙ্গা এক হয়ে যায় তখন গঙ্গার বুকের উপর নৌকা চড়ে হিজলের চারিপাশে একবার ঘুরে এস। দেখবে, জল জল আর জল; উত্তর-দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে জল ছাড়া মাটি দেখা যায়। না, জলের উপর জেগে থাকে ঝাউ আর দেবদারুর মাথাগুলি। দেখ, আকাশে পাখি উড়ে চলেছে—চলেছে তো চলেইছে। পাখা ভেরে আসছে, তবু সে গাছগুলির মাথার উপর বসছে না, কখনও কখনও খুব ক্লান্ত পাখি গাছের চারিদিকে পাক দিয়ে ঘুরে হতাশকণ্ঠে যেন মরণ কান্না কেঁদে আবার উড়ে যেতে চেষ্টা করে। কেন জান? গাছের মাথাগুলির দিকে তাকিয়ে দেখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। শরীর তোমার শিউরে উঠবে। হয়ত ভয়ে ঢলে পড়ে যাবে। মা-মনসার ব্ৰতকথায় মর্ত্যের মেয়ে বেনে-বেটী মায়ের দক্ষিণমুখী যে মূর্তি দেখেছিল—সেই মূৰ্তি মনে পড়ে যাবে। মা বলেছিলেন বেনের মেয়েকে সব দিক পানে তাকিয়ো, শুধু দক্ষিণ দিক পানে তাকিয়ো না। বেনের মেয়ে নাগলোক থেকে মধামে আসবার আগে দক্ষিণ দিকের দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারে নি। তাকিয়ে দেখেই সে ঢলে পড়ে গিয়েছিল। মা-মনসা বিষহরির ভয়ঙ্করী মূর্তিতে দক্ষিণ দিকে মৃত্যুপুরীর অন্ধকার তোরণের সামনে অজগরের কুণ্ডলীর পদ্মাসনে বসেছেন পরনে তার রক্তাম্বর, মাথায় পিঙ্গল জটাজুট, পিঙ্গল নাগেরা মাথায় জটা হয়ে দুলছে, সর্বাঙ্গে সাপের অলঙ্কার, মাথায় গোখুরা ধরেছে ফণার ছাতা, মণিবন্ধে চিত্রিতা অর্থাৎ চিতি সাপের বলয়, শঙ্খিনী সাপের শঙ্খ, বাহুতে মণিনাগের বাজুবন্ধ, গলায় সবুজ পান্নার কন্ঠির মত হরিদ্রক অর্থাৎ লাউডগা সাপের বেষ্টনী, বুকে দুলছে কালনাগিনীর নীল অপরাজিতার মালা, কানে দুলছে তক্ষকের কর্ণভূষা, কোমরে জড়িয়ে আছে চন্দ্রচিত্র অর্থাৎ চন্দ্ৰবোড়ার চন্দ্রহার, পায়ে জড়িয়ে আছে সোনালি রঙের লম্বা সরু কাঁড় সাপ পাকে পাকে বাঁকের মত; সাপেরা হয়েছে চামর, সেই চামরে বাতাস দিচ্ছে নাগকন্যারাবিষের বাতাস। সে বাতাসে মায়ের চোখ করছে। ঢুলুঢ়লু। মায়ের কাঁধে রয়েছে বিষকুম্ভ, সেই কুম্ভ থেকে শঙ্খের পানপাত্রে বিষ ঢেলে পান করছেন, আবার সেই বিষ গলগল করে উগরে ফেলে বিষকুম্ভকে পরিপূর্ণ করছেন। মায়ের পিঠের কাছে মৃত্যুপুরীর তোরণে অন্ধকার করছে থমথম।

এই রূপই যেন তুমি দেখতে পাবে গাছের দিকে তাকালে। দেখবে হয়ত গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটি জড়িয়ে ফণা তুলে ফুসছে বিশালফণা এক দুধে-গোখরো। শকুনি-গৃধিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করবার জন্য সে অহরহ প্রস্তুত হয়ে আছে। তারপর তাকাও ডালে ডালে। দেখবে, পাকে পাকে জড়িয়ে কি যেন সব নড়ছে, দুলছে কখনও বা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। সাপসব সাপ। বন্যায় ড়ুবেছে হিজলের ঘাসবন, সাপেরা উঠেছে গাছের ডালে ডালে। কত নূতন কালীনাগকত দেশ থেকে গঙ্গার জলে ভেসে আসতে আসতে হিজলের ঝাউডাল দেবদারুডাল জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠেছে। খুব সাবধান! চারিপাশের জলের স্রোতে সতর্ক দৃষ্টি রেখ, হয়ত ছপ করে নৌকার কিনারা জড়িয়ে ধরবে স্রোতে-ভেসে-চলা সাপ। গাছের তলাগুলি সযত্নে এড়িয়ে চল; হয়ত উপর থেকে ঝপ করে খসে পড়বে—সাপ। হয়ত পড়বে তোমার মাথায়। শিরে হৈলে সর্পাঘাত তাগা বাঁধিবি কোথা?

হিজল বিলে মা-মনসার আটন পাতা আছে—জনশ্রুতি মিথ্যা নয়।

প্রাচীন কবিরাজ শিবরাম সেন হিজলের গল্প বললেন।

সে আমলের ধন্বন্তরিবংশে জন্ম বলে বিখ্যাত ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য শিবরাম সেন। ধূর্জটি কবিরাজকে লোকে বলত সাক্ষাৎ ধূর্জটি অর্থাৎ শিবের মত আয়ুর্বেদ-পারঙ্গম। ধূর্জটির সূচিকাভরণ মৃতের দেহে উত্তাপ সঞ্চার করত। লোকে বলে—মৃত্যু যখন এসে হাত বাড়িয়েছে, তখনও যদি ধূর্জটি কবিরাজের সূচিকাভরণ প্রয়োগ করা হত, তবে মৃত্যু পিছিয়ে যেত কয়েক পা, উদ্যত হাত গুটিয়ে নিত কিছুক্ষণের জন্য বা কয়েক দিনের জন্য। নিয়তিকে লঙ্ন করা। যায় না, কবিরাজ কখনও সে চেষ্টা করতেন না, তবে ক্ষেত্রবিশেষে তার সূচিকাভরণ প্রয়োগ করে মৃত্যুকে বলতেন—তিষ্ঠ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর।

স্ত্রী আসছে পথে, শেষ দেখা হওয়ার জন্য অপেক্ষা কর। এমনই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন সূচিকাভরণ এবং সে প্রয়োগ কখনও ব্যর্থ হয় নাই। সাপের বিষ থেকে তৈরি ওষুধ সূচিকাভরণ-সুরে ডগায় যতটুকু ওঠে সেই তার মাত্রা। মৃত্যুশক্তিকে আয়ুর্বেদবিদ্যায় শোধন করে মৃত্যুঞ্জয়ী সুধায় পরিণত করতেন। সকল কবিরাজই চেষ্টা করে, কিন্তু তাঁর সূচিকাভরণ ছিল অদ্ভুত। তিনি সাপ চিনতেন, সাপ দেখে তার বিষের শক্তি নির্ধারণ করতে পারতেন।

ওই হিজলের বিলের নাগ-নাগিনীর বিষ থেকে সূচিকাভরণ তৈরি করতেন।

শিবরাম সেন গল্প করেন—তখন তাঁর বয়স সতের-আঠার, দেশে তর্কপঞ্চাননের টোলে ব্যাকরণ শেষ করে আয়ুর্বেদ শিক্ষার জন্য ধূর্জটি কবিরাজের পদপ্রান্তে গিয়ে বসেছেন। হঠাৎ একদিন আচার্য বললেন–হিজলে যাবেন। সূচিকাভরণের আধারটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। নৌকায় যাত্রা। সঙ্গে শিবরামের যাবার ভাগ্য হয়েছিল।

হিজলের ধারে এসে গঙ্গার বালুচরে নৌকা বাঁধা হল। গঙ্গার পশ্চিম তীরে সুবিস্তীর্ণ সমতল প্রান্তর; সবুজ এক বুক উঁচু ঘাস, যতদূর দৃষ্টি যায় চলে গেছে। ঘাসের বনের মধ্যে দেবদারু আর বুনো ঝাউয়ের গাছ। শিবরামই বলেন—ঘাসবনের ভিতর দিয়ে অসংখ্য নালা খাল গঙ্গায় এসে পড়েছে। ঘন সবুজ ঘাসবন। বাতাসে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের উপর; সরসর শব্দ উঠছে, যেন কোনো অভিনব বাদ্যযন্ত্র বাজছে। ঝাউয়ের শব্দ উঠছে সন্স সন্স। আকাশে উড়ছে হাঁসের অ্যাঁক। জনমানবের চিহ্ন নাই। হঠাৎ মাঝি বললে—খালের পানিতে কি একটা ভেস্যা আসছে কর্তা।

আচার্য কৌতূহল প্রকাশ করেন নাই। তরুণ শিবরাম কৌতূহলবশে নৌকার উপর উঠে দাঁড়িয়েছিল। বিস্মিত হয়েছিল—একটা বাচ্চা চিতাবাঘের শব দেখে; শবটা ভেসে আসছে, তার উপরে কাক উড়ে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে; মধ্যে মধ্যে উপরে বসছে; কিন্তু আশ্চর্য, খাচ্ছে না।

আচার্য বলেছিলেন বিষ। সৰ্পবিষে মৃত্যু হয়েছে। ওর মাংস বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। খাবে না। হিজলের ঘাসবনে বাঘ মরে সাপের বিষেই বেশি।

হঠাৎ পাখিগুলির আনন্দ-কলরব ছাপিয়ে কোন একটা পাখির আর্ত চিৎকার উঠেছিল। সে চিৎকার আর থামে না। যেন তিলে তিলে তাকে কেউ হত্যা করছে। এর অর্থ শিবরামকে বলে দিতে হয় নি। তিনি বুঝেছিলেন–পাখিকে সাপে ধরেছে।

শিবরাম এবং আরও দুজন ছাত্র চড়ার উপরে নেমেছিল। আচার্য বলেছিলেন–সাবধান! সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলাফেরা কোরো। জনশ্রুতি, হিজলের বিলে আছে বিষহরির আটন।

খাওয়াদাওয়ার পর নৌকা ঢুকল একটা খালের মধে। দুধারে ঘাসবন দুলছে, মানুষের। চেয়েও উঁচু ঘন জমাট ঘাসবন।

শিবরাম বলেন—সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময় যেন ওই ঘাসবনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। পাশের ঘাসবন থেকে ছপ করে একটা মোটা দড়ি আছড়ে পড়ল। একটা সাপ। কালো—একেবারে অমাবস্যার রাত্রির মেঘের মত কালো তার গায়ের রঙ, সুকেশী সুন্দরীর তৈলাক্ত বেণির মত সুগঠিত দীর্ঘ আর তেমনি তার কালো রঙের ছটা। জলে পড়ে একখানি তীরের মত গতিতে, সে জল কেটে ছুটল ওপারের দিকে। মাঝখানে জলে মুখ ড়ুবিয়ে দিলে, তার নিশ্বাসে জলের ধারা উঠল ফোয়ারার মত। নৌকা তখন থেমে গিয়েছে। বিহ্বল হয়ে শিবরাম দেখছেন ওদিকে পিছনের ঘাসবনে আলোড়ন প্রবল হয়ে উঠেছে। তীরবেগে বৃহৎ সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু যেন ঘাসবন কেটে এগিয়ে আসছে। এল, শিবরাম অবাক হয়ে গেলেন এ তো ভয়ঙ্কর নয়। ঘাসবন থেকে বেরিয়ে এল। একটি মেয়ে। ওই কালো সাপের মতই গায়ের রঙ। খাটো মোটা কাপড়ে গাছকোমর বেঁধেছে। ভাল করে দেখবার সময় হল না। সাপের পিছনে মেয়েটাও ঝুপ করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল খালের জলে। তবে নাকে এল একটা বিচিত্র তীব্র গন্ধ, আর কানে এল কঠিন আক্রোশ-ভরা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কয়টা কথা, তার ভাষা বিচিত্র, উচ্চারণের ভঙ্গি বিচিত্র, কিন্তু সব চেয়ে বিস্ময়কর বাক্যগুলির ভাবার্থ। বললে-পালাবি? পলায়ে বাঁচবি? মুই তুর যম, মোর হাত থেক্যা পলায়ে বাঁচবি?

বললে ওই সাপটাকে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেও চলল সাঁতার কেটে। সাপের যম? সাপকে চলেছে তাড়া করে? কে এ মেয়ে?

নালাগুলি অদ্ভুত আঁকাবাঁকা। একটা বাঁকের মুখে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার আচার্য এসে দাঁড়ালেন নৌকার ছইয়ের বাইরে। মুখে তাঁর প্রসন্ন সস্নেহ হাস্যরেখা। বললেন—চল বাবা মাঝি, চল। যাত্ৰা ভাল। হিজলে ঢুকতেই দেবাদিদেবের দয়া হয়েছে। ধরা পড়ল একটি কালো সাপ। খাঁটি কালজাতের।

নৌকার গতি সঞ্চারিত হতে হতে অদূরবর্তী বাঁকের মাথায় ঘাসবন থেকে সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এবার কণ্ঠস্বরের মধ্যে বিজয়-হাস্যের তৃপ্তির সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শাসনের সঙ্গে সমাদর। ইবার? ইবারে কি হয়? দিব? দিব কষটা নিঙুড়ে? এর পরই বেজে উঠল হাসি। কালো সাপটার আঁকাবাকা তীব্র গতিতে যেমন অসংখ্য তরঙ্গরেখায় খালের জল চঞ্চল তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমিন চঞ্চল হয়ে উঠল হিজল বিলের বায়ুস্তর খিলখিল হাসির সঙ্গে মেয়েটি কোন কৌতুকে হেসে যেন ভেঙে পড়ছে। হাসির শেষে তার কথা শোনা গেল-ইরে বাবা রে, ইরে বানাস্ রে! মুই কুথাকে যাব রে! গোসা করিছে গো, মোর কালনাগিনীর গোসা হছে গো! ইরে বাবা রে, ফুসানি দেখ গো! আবার সেই খিলখিল হাসি। তরঙ্গায়িত বায়ুস্তর মানুষের বুকে ছলছল করে ঢেউয়ের মত এসে এলিয়ে পড়ছে।

নৌকাখানা বাঁক ঘুরছে তখন।

বাঁকের মাথায় জলের কিনারায় ঘাসের বনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়ে, তার হাতের মুঠোয় ধরা সেই কালো সাপটার মুখ ছোট ছেলের চোয়াল ধরে কথা বলার মত ভঙ্গিতে। সাপটার মুখ নিজের মুখের সামনে ধরে সে তার সঙ্গে কথা বলছে। সাপটার জিভ সকলক করে বেরুচ্ছে; কিন্তু নিমেষহীন তার চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে রয়েছে একান্ত অসহায়ের মত। সারা দেহটা শূন্যে ঝুলছে, এঁকেবেঁকে পাক খাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে মেয়েটার হাতে পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে। জড়িয়ে ধরতে পারলে নিজের নিশ্বাস রুদ্ধ করে সর্বশক্তি প্রয়োগে নিষ্ঠুর পাকে জড়িয়ে পিষে মেয়েটির নিটোল কালো নরম হাতখানির ভিতরের মাংস মেদ স্নায়ু শিরা ছিন্নভিন্ন করে দেবে। হাতের শিরা-উপশিরাগুলি নিরুদ্ধগতি রক্তের চাপে ফেটে যাবে। কিন্তু সে চেষ্টা তার ব্যর্থ। ওই নরম হাতের মুঠিখানি লোহার সঁড়াশির মত শক্ত; আর তেমনি কি বিচিত্র কৌশল তার হাতের, সাপটার সঙ্গে সমানে এঁকেবেঁকে পাল্লা দিয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ ক্ষিপ্ৰ আঁকাবাকা গতিতে সারা দীর্ঘ দেহখানা সঞ্চালিত করে সাপটা যখনই বেদেনীর হাতখানাকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে তখনই বেদের মেয়ের হাতে একটা ক্ষিপ্ৰতর সঞ্চালন খেলে যাচ্ছে, তারই একটা ঝাঁকি এসে সাপটার সকল চেষ্টা ধাক্কা দিয়ে প্রতিহত করে দিচ্ছে। মুহূর্তে তার দেহ শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

শিবরাম কবিরাজ বলেন-এ যেন বাবা নাঙ্গা, মানেখোলা তলোয়ারধারী আর খাপে-ভরা তলোয়ারধারীর তলোয়ার খেলা। একবার তখন আমি, বাবা, মুর্শিদাবাদের গ্রামে কবিরাজি করি, বড় জমিদার ছিলেন সিংহ মশায়রা, তারাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার গুরুর সুপারিশে। তাদের গৃহচিকিৎসক হিসেবে থাকি, গ্রামেও চিকি সাদি করি। সেই সময় একদিন রাত্রে ডাকাত পড়ল তাদের বাড়িতে। দেউড়িতে বাইরে দুজন তলোয়ারধারী দারোয়ান, তারা জেগেই ছিল, খাপে তলোয়ার ঝুলছে—দুজনে কথাবার্তা বলছে। হঠাৎ তাদের সামনে একটা আ-বা-বা-আবা-বা-বা হুঙ্কার উঠল। আমি দেউড়ির সামনের রাস্তাটার ওপারে আমার ঘরে, তখনও চরকের পাতা ওন্টাচ্ছি। চমকে উঠলাম, সঙ্গে সঙ্গে দপদপ করে মশাল জ্বলে উঠল। মনে হল, যেন ওরা মাটি থেকে গজিয়ে উঠল। মশালের আলোয় দেখলাম বাবা, দারোয়ান দুজনের সামনে দুজন খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ানেরা খাপেপোরা তলোয়ারের মুঠিতে হাত দিয়েছে; কিন্তু যেই টানে, অমনি ডাকাতদের ভোলা তলোয়ার দুলে ওঠে। দারোয়ানদের হাত অবশ হয়ে যায়, খাপের তলোয়ার আবার মুঠি পর্যন্ত খাপে ঢুকে যায়—তলোয়ারখানাও যেন অবশ হয়ে গেছে। ডাকাতেরা খিলখিল করে হাসে। বলে–থাক্ যেমন আছে তেমনি থাক; মরতে না চাস তো চাবি দে দেউড়ির। একজন দারোয়ান একটা ট্র্যাক পেয়েছিল। সড়াৎ করে একটা শব্দ হল—সে বের করেছে তলোয়ারখানা; কিন্তু তোলবার আর সময় পেলে না, ডাকাতের খোলা তোয়ার মশালের আলোয় ঝলকে উঠল। ঝনাৎ শব্দে আছড়ে পড়ল দারোয়ানের বের করা তলোয়ারখানার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ারখানা হাতের থেকে খসে পড়ে গেল। ডাকাতটা বললে–হাত নিলাম না তোর রুটি যাবে বলে, নিলে মাথা নোবো। দে, চাবি দে। সাপটার সঙ্গে বেদের মেয়েটার প্যাচের খেলাটা ঠিক তেমনি। সেদিন, মানে ওই ডাকাতির রাত্রে আমার, বাবা, মনে পড়েছিল ওই ছবিটা। তাই বেদের মেয়েটার সেদিনের ছবি মনে পড়লে ওই খোলা তলোয়ার আর খাপে-পিেরা তলোয়ারের খেলাটা মনে পড়ে যায়।

সাপটা হার মেনে শিথিল দেহে এলিয়ে পড়ছে দেখে মেয়েটার সে কি খিলখিল হাসি।

হিজল বিলের ঘাসবনের উপর বাতাস বাধাবন্ধহীন খেলায় একটানা বয়ে যাচ্ছিল—তাতে খিলখিল হাসির কাপন বয়ে গেল, যেন কোনো তপস্বিনী রাজকন্যার এলোচুলে জাদুপুকুরের জলের ছিটে লেগে দীর্ঘ রুক্ষ নরম চুলের রাশি কোকড়া হয়ে গিয়ে ফুলে ফেঁপে দুলে উঠল।

ধূর্জটি কবিরাজ নৌকার মাথায় দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন-আরে বেট, তুই! শবলা মায়ী! যাত্রা ভাল আমার, একেবারে মা-বিষহরির কন্যের সঙ্গে দেখা!

মেয়েটিও মুখ তুলে সুপ্ৰসন্ন বিস্ময়ে ঝলকে উঠল, সেও বলে উঠলই বাবা! ই বাবা গো! ধন্বন্তরি বাবা! আপুনি হেথা কোথেকে গো! ইরে বাবা।

শিবরাম অবাক হয়ে দেখছিলেন মেয়েটিকে। চিনতে দেরি হয় নাই, এ মেয়ে সাপুড়েদের মেয়ে, বেদেনী। কিন্তু এ বেদেনী আগের-দেখা সব বেদেনী থেকে আলাদা। মালবেদে, মাঝি-বেদে এরা তার দেশের মানুষ। এ বেদেনীর জাত আলাদা। চেহারাতে আলাদা, কথায় আলাদা, সাজে পোশাকে আলাদা—এমন বেদের মেয়ে নতুন দেখলেন শিবরাম তাঁর জীবনে। বেদেরা কালোই হয়, কিন্তু এমন মসৃণ উজ্জ্বল কালো রঙ কখনও দেখেন নাই শিবরাম। তেমনি কি ধারালো গড়ন! মেয়েটির বয়স অবশ্য অল্প, কিন্তু বেশি বয়স হলেও একে দূর থেকে মনে হবে কিশোরী মেয়ে। ছিপছিপে পাতলা গড়ন, দীৰ্ঘাঙ্গী, মাথায় একরাশি চুল রুখু কালো। করকরে কোকড়া চুল, খুলে দিলে পিঠের আধখানা ঢেকে চামরের মত ফাপা হয়ে বাতাসে দোলে, কোঁকড়া চুল টেনে সোজা করলে এসে পড়ে জানুর উপর। কালো রঙের মধ্যে চিকচিক। করছে তিন অঙ্গে চার ফালি তুলির রেখায় টানা সাদা রেখা। কালো চুলের ঠিক মাঝখানে পৈতের সুতোর মত লম্বা সিঁথিটি, ধারালো নাকটির দুপাশে নpন দিয়ে চেরা সরু অথচ লম্বা টানা পদ্মের একেবারে ভিতরের পাপড়ির মত দুটি চোখের সাদা ক্ষেত, আর ঠোঁটের ফাঁকে ছোট সাদা। দাঁতের সারি। পরনে লালরঙে ছাপানো তাতে বোনা খাটো মোটা রাঙা শাড়ি, গলায় পদ্মবীজের। মালা, তার সঙ্গে লাল সুতো দিয়ে ঝুলছে মাদুলি পাথর আরও অনেক কিছু; হাতের মণিবন্ধ খালি, উপর-হাতে লাল সুতোর তাগা টান করে বাধা, নরম কালো হাতের বাইরে যেন কেটে বসে। গেছে। তাতেও মাদুলি পাথর জড়িবুটি। গাছ-কোমর বাঁধা, পরনের ভিজে কাপড় হিলহিলে দেহখানির সঙ্গে সেঁটে লেগে রয়েছে; মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, যেন বাতাসে প্রতিমার মত দুলছে। নৌকাখানা আর একটু এগিয়ে যেতেই নাকে একটা তীব্ৰ গন্ধ ঢুকল এসে শিবরামের। মেয়েটি যখন ঘাসবন ঠেলে সাপটার পিছনে বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল, তখন ঠিক মুহূর্তের। জন্য এই গন্ধ নাকে এসে পৌঁছেছিল। শিবরাম বুঝলেন, এ গন্ধ ওর গায়ের গন্ধ। শরীরটা যেন পাক দিয়ে উঠল। যারা বন্য, যারা পোড়া মাংস খায়, তেল মাখে না, তাদের গায়ে একটু গন্ধ থাকে। মাল মাঝি বেদেদের গায়েও গন্ধ আছে, কিন্তু তাতে এই তীব্রতা নাই। এ যেন ঝাজ!

অবাক হয়ে চেয়ে দেখছিলেন শিবরাম। বেদের মেয়ে, কিন্তু এমন বেদের মেয়ে তিনি দেখেন নাই।

–হি–, কন্যে রইছিস্ গঃ! হি–গঃ–

একটা করকরে রুক্ষ মোটা গলার ডাক ভেসে এল। ওই মানুষের-চেয়ে-উঁচু ঘাসবনের থেকে কেউ ডাকছে।

মেয়েটা ডান হাতে ধরে ছিল সাপটা। বা হাতের ছোট তালুখানি মুখের পাশে ধরে গঙ্গার খোলা দিকটা আড়াল করে প্রদীপ্ত হয়ে সাড়া দিয়ে উঠল—হি–গঃ হেথাকে—গঃ! হাঙরমুখীর প্যাঁটের বাঁকে গঃ! ত্বরতি এস গঃ! দেখা যাও, দেখা যাও পা চালায়ে এস গঃ!

কণ্ঠস্বরে উল্লাস উচ্ছ্বসিত হয়ে উপচে উপচে পড়ছে যেন। ব্যগ্ৰ দৃষ্টিতে ঘাসবনের দিকে। চেয়ে কৌতুকহাস্যে বিকশিত মুখে সে বললে—বুড়া অবাক হয়া যাবে গ বাবা! কৌতুকে চোখ যেন নাচছে চঞ্চল পাখির মত।

স্মিতহাস্য ফুটে উঠল ধূর্জটি কবিরাজের মুখে। তিনিও দৃষ্টি ফেরালেন ঘাসবনের দিকে। ঘাসবন চঞ্চল হয়ে উঠেছে, দুলছে; দুপাশে হেলে নুয়ে পড়েছে ঘাসবন—সবল দ্রুতগতিতে চলে আসছে কেউ বুনো দাতালের মত। সবিস্ময়ে প্রতীক্ষা করছিলেন শিবরাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল মানুষটার মাথা, পাকা দাড়ি গোঁফ ও কাঁকড়া চুলে ভরা মানুষের মুখ, রঙ ঘন কালো, চোখে বন্য দৃষ্টি। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে, চোখের বন্য দৃষ্টি বিস্ময়ে বিচিত্র হয়ে উঠল; সস্মিতবিস্ময়ে পুলকিত কণ্ঠে সেও বলে উঠল—ধন্বন্তরি বাবা! সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

কবিরাজ বললেনভাল আছ মহাদেব? ছেলেপুলে পাড়া-ঘর তোমার সব ভাল?

তার কথা শেষ হতে না হতে ঘাসবন থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল সেই মহাদেব। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত গামছার মত একফালি মোটা একটা কাপড়ের আবরণ শুধু, নইলে নগ্নদেহ এক বন্য বর্বর। গলায় হাতে তাবিজ জড়িবুটি কালো সুতোয় বাধা, আর গলায় একগাছি রুদ্ৰাক্ষের মালা। তারও গায়ে ওই উৎকট তীব্র গন্ধ। বৃদ্ধ তবু লোকটা খাড়া সোজা। দেহখানা যেন। শ্যাওলা-ধরা অতি প্রাচীন একটা পাথরের দেওয়াল, কালচে সবুজ শ্যাওলায় ছেয়ে গিয়েছে, কতকালের শ্যাওলার স্তরের উপরে শ্যাওলার স্তর, কিন্তু এখনও শক্ত অটুট রয়েছে। নির্বাকবিস্ময়ে চেয়ে রইলেন তরুণ শিবরাম। হাঁ, এই বাপের ওই বেটীই বটে।

বেদে কিন্তু সাধারণ মাল বা মাঝি বেদে নয়। সাঁতালীর বিষ-বেদে। সাঁতালী ওদের নাম। ওই হিজল বিলের ধারে ভাগীরথীর চরভূমির ঘাসবন ঝাউবন দেবদারু গাছের সারির আড়ালে ওই হাঙরমুখী নালার ঘাট থেকে চলে গেছে একফালি সরু পথ, দুদিকে ঘাসবন, পায়ে-পায়ে-রচা পথ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে ওই বিষ-বেদেদের সাঁতালী গ্রামের মাঝখানে বিষহরি মায়ের থান অর্থাৎ স্থান পর্যন্ত। গ্রামের মাঝখানে ওই দেবস্থানটিকে ঘিরে চারিপাশে বিচিত্ৰ বসতি। দেবস্থানের চারিদিকে দেবদারুডালের খুঁটো পুঁতে মাচা বেঁধে তারই উপর ঘর। মাচাটির চারিপাশে ঝাউডালের বেড়া বেঁধে গায়ে পাতলা মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি করা দেওয়াল, তার উপর ওই ঘাসবনের ঘাসে ছাওয়া চাল, এই ওদের ঘর। প্রতি বৎসরই ঝড়ে উড়ে যায়, বর্ষায় গলে পড়ে, শুধু নিচের শক্ত মাচাটি টিকে থাকে। গঙ্গায় বন্যা আসে, ঘাসবন ড়ুবে যায়, হিজল। বিল আর গঙ্গায় এক হয়ে যায়, সাঁতালী গা জলে ডোবে, মাচাগুলি জেগে থাকে, ঝড় বন্যা হলে তাও ডোবে। তখন গেলে দেখতে পাবে, ঝাউগাছের ভেলার উপর, ছোট ছোট নৌকার উপর বিষ-বেদেরা সেই অথৈ বন্যার মধ্যে ভাসছে। বন্যার জল নেমে যায়, মাটি জাগে, ভিজে পলির আস্তরণ পড়ে যায়, বিষ-বেদেরা নৌকা এবং ভেলার উপর থেকে নেমে আসে, মাচার মেঝের পলি কাদা পরিষ্কার করে। দেওয়ালের খসেপড়া কাদার আস্তরণ আবার লাগায়, ছোট ছেলেমেয়েরা কাদা ঘেঁটে মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে। বড়রা দেবদারু গাছে অ্যাঁকশি লাগিয়ে শুকনো কাঠ ভেঙে আনে, বিলে ফাঁদ পেতে হাঁস ধরে, গুলতি ছুঁড়েও মেরে আনে, আবার সাঁতালীর ঘরে ঘরে উনানের ধোঁয়া ওঠে, ওদের ঘরকন্না আবার শুরু হয়ে যায়। তারপর চলে এক দফা নৌকা নিয়ে সাপ ধরার কাজ। হিজল বিলের চারিপাশে ঝাউ-দেবদারুর উঁচু ডালে, মাথায়—বন্যায় ভেসে এসে নানান ধরনের সাপেরা আশ্রয় নেয়, ওরা সেইসব সাপ দেখে দেখে প্রায় বেছে বেছে। ধরে ঝাঁপি বোঝাই করে। ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে এমন সাপ সৃষ্টিতে নাই। দেবদারুর মাথায় যে দুধে গোখরো ফণা তুলে আকাশের উড়ন্ত শকুন বা গাঙচিল বা বড় বড় বাজের ঠোঁট-নখকে উপেক্ষা করে, সে দুধে-গোখরো ঠিক বন্দি হয়ে এসে ঢেকে ওদের কাঁপিতে। যে ঘন সবুজ রঙের লাউডগা সাপটা গাছের পাতার সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে সাধারণ লোকের চক্ষে পড়ে না, সেও ঠিক ওদের চক্ষে পড়বে এবং তাকে ধরে পুরবে ওদের ঝাপিতে। ভোরবেলা সূর্য যখন সবে পুবের আকাশে লালি ছড়িয়ে উঠি-উঠি করে, তখন ওরা নৌকার উপর দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গাছের মাথার দিকে। উদয়নাগেরা এবার বেরিয়ে ফণা মেলে দাঁড়াবে, দুলবে, দিনের দেবতাকে প্রণাম করে আবার লুকিয়ে পড়বে গাছের পাতার আবরণের অন্ধকারের মধ্যে। তারাও ধরা পড়বে ওদের হাতে। কালকেউটের তো কথাই নাই। কালনাগিনী ওদের কাছে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। তারাই ওদের ঘরের লক্ষ্মী, কালনাগিনীই ওদের অন্ন যোগায়, কালনাগিনী বিষ-বেদের কন্যে। ওই কালনাগিনীর বিষ থেকেই হয় মহাসঞ্জীবনীসূচিকাভরণ। সেও মা-বিষহরির বর। রাত্রির মত কালো কালনাগিনী, সুন্দরী সুকেশী মেয়ের সুচিকণ তৈলমসৃণ চুলে রচনা করা বেণির গঠন আর তেমনি তার কালো রঙের। দীপ্তি। কালো কেউটে অনেক জাতের আছে, কালোর উপর শ্বেত সরষের মত সাদা ছিট আছে যে কেউটের কালো গায়ে, সে কেউটে জেনো—শামুকভাঙা কেউটে। যে কেউটের গলায় তার গায়ের রঙের চেয়েও ঘন কালো রঙের কণ্ঠিমালার মত দুটি দাগের বেড় আছে, সে জেনো কালীদহের কালীগের ছেলের বংশের জাত। কালনাগিনী শুধু কালো। কালীনাগের কন্যে নাগিনী, ও বংশে কন্যে ছাড়া পুরুষ নাই। তার লেজ খানিকটা মোটা। বেহুলা অ্যাঁতি দিয়ে কেটে নিয়েছিল তার লেজের খানিকটা। কালনাগিনীর নাগের জাত নাই। অন্য নাগের জাতের সন্তান প্রসব করে কালনাগিনী। তাই থেকে হয়েছে নাকি নানা জাতের কেউটের সৃষ্টি। মা-বিষহরির ইচ্ছায় ওদের মধ্যে দুই-চারিটি কন্যা একেবারে মায়ের জাত নিয়ে জন্মায়, কালনাগিনীর ধারা অব্যাহত রাখবার জন্য। কালনাগিনী চেনে ওই বিষ-বেদেরা। ওদের ভুল হয় না। ধূর্জটি কবিরাজ জানেন সে তথ্য। তাই তিনি বিষ-বেদের কাছ ছাড়া অন্য বেদের কাছে সূচিকাভরণের উপাদান সংগ্রহ করেন না। সেই কারণেই তার সূচিকাভরণ সাক্ষাৎ সঞ্জীবনী।

আর ভাগীরথীর কূলে হিজল বিলের পাশে মা-মনসার আটনের পাট-অঙ্গনে সাঁতালী গাঁয়ের চারিপাশেই কালনাগিনীর বাসভূমি। তাই তো বিষ-বেদেরা এই ঘাসবনের মধ্যে বন্যার জলে পাকাল মাটির উপরই বাস করে পরমানন্দে। বন্যায় কাদা হয়। ঘাস পচে, ভ্যাপসা গন্ধ হয়, মশায় মাছিতে ভনভন করে চারিদিক, ঘাসবনের মধ্যে বাঘ গৰ্জায়, হিজল বিলের অসংখ্য নালায় কুমির ঘুরে বেড়ায়, হাঙর আসে, কামঠ আসে, তারই মধ্যে ওরা বাস করে চলেছে। এখান ছেড়ে বিষ-বেদেরা স্বর্গেও যেতে চায় না। বাপ রে বাপ, এখানকার বাস কি ছাড়া যায়। মা-বিষহরির সনদ দেওয়া জমি—এ জমির খাজনা নাই। লোকে বলে, অমুক রাজার রাজত্বি ও গায়ের ওই জমিদারের এলাকা, কিন্তু বিষ-বেদেদের খাজনা আদায় নিতে আজও কোনো তসিলদারের নৌকো হাঙরমুখীর নালা বেয়ে সাঁতালী গাঁয়ের ঘাটে এসে পৌঁছে নাই। হুকুম নাইমা-বিষহরির হুকুম নাই। বেদেদের শিরবেদে সমাজের সমাজপতি বুড়ো মহাদেব বলে–মা-বিষহরির হুকুম নাই। তার সনদে মোরা ঘর বাঁধলাম হেথাকে এসে। চম্পাই নগরের ধারে সাতালী পাহাড়ে ছিষ্টির আদিকাল থেকে বাস ছিল–শতেক পুরুষের বাস—জাতে ছিলাম বিষবৈদ্য—সে বাস গেছে, সে জাত গেছে, মা-লক্ষ্মী ছেড়ে গেছেন—তার বদলে পেয়েছি। মা-বিষহরির সনদে কালনাগিনী-কন্যে, মা-গঙ্গার পলি-পড়া জমির ওপর এই নতুন সাঁতালী গাঁয়ে জমি, এ ছেড়ে কোথাকে যাব?

বলে—সে এক বিচিত্ৰ উপাখ্যান।
জয় বিষহরি গ! জয় বিষহরি!
চাঁদো বেনে দণ্ড দিল।
তোমার কৃপায় তরি গ!
অ–গ!
চম্পাই নগরের ধারে
সাঁতালী পাহাড় গ!
অ–গ!

ধন্বন্তরি মন্তে বাধা
সীমেনা তাহার গ!
অ–গ!

বিরিখ্যে ময়ূর বৈসে
গত্তে গত্তে নেউল গ!
অ–গ!

বিষবৈদ্য বৈসে সেথায়
বাণ্ডুলা বাউল গ!
অ–গ!

ধন্বন্তরি সাঁতালী পাহাড়ের সীমেনায় সীমেনায় গণ্ডি কেটে দিয়েছিলেন মন্ত্ৰ পড়ে। ভূত পেরেত পিশাচ রাক্ষস ডাইন ডাকিনী বিষধর সেখানে ঢুকতে পারত না। বিশেষ করে পারত না। বিষধর নাগ-নাগিনী, বিচ্ছ-বিছা, পোকা-মাকড়, ভিমরুল-বোলতা, এরা ঢুকলে কি সীমানার মধ্যে পা দিলে, নিশ্চিন্ত মরণ ছিল—ময়ূরে নেউলে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলত। ধন্বন্তরি পৃথিবীর গাছপালা লতাপাতা ফুল-মূল খুঁজে সাত সমুদুরের তলা থেকে, স্বৰ্গলোকের ধন্বন্তরির বাগান থেকে পেয়েছিলেন যত বিষঘনী অর্থাৎ বিষম্ন গাছগাছড়া—সব এনে তার বীজ ছড়িয়েছিলেন এই সাঁতালী পাহাড়ের মাটি-পাথরের গায়ে। ঈশের মূল থেকে বিশল্যকরণী পর্যন্ত। তার গন্ধে সাঁতালী পাহাড়ের নুড়ি-পাথরের মধ্যে বিষ-পাথর থাকত ছড়িয়ে, সমুদুরের ধারের বালির উপর ছড়ানো ঝিনুক শামুক শাঁখের মত। বিষ-পাথর বিষ শুষে নেয় মাটির জল শুষে নেওয়ার মত। সেই বিষঘনী জড়িবুটি লতাপাতার গন্ধে বিষধরেরা চেতনা হারিয়ে। নেতিয়ে পড়ত শিকড়-কাটা লতার মত, বিষ-পাথরের আকর্ষণে তাদের কষ বেয়ে মুখের থলির বিষ গলে বেরিয়ে আসত।

ধন্বন্তরি শিষ্যদের ওপর ভার দিয়েছিলেন সাঁতালী পাহাড়ের। ঊদসদাগর ধন্বন্তরির মিতা–বিষহরির বিবাদী সে—দিয়েছিল সাঁতালী পাহাড়ের নিষ্কর বসবাসের ছাড়পত্র। ধন্বন্তরির শিষ্য বিষবৈদ্যরা সমাজে আসন পেত, সম্মান পেত অঙ্গুৎ ছিল না, বিষঘ্ন লতা পৈতের মত পরতে পেত গলায়। তবু তারা ছিল বিবাগী বাউল; বিষ-চিকিৎসার মূল্য নাই—অমূল্য এ বিদ্যা, ধনলোভীর এ বিদ্যা নিষ্ফল, তারা দক্ষিণা নিত না, মূল্য নিত না–নিত যৎসামান্য দান।

তুরা খাস গো সুধার মধু মোরা খাইব বিষ গ!
অ–গ!
তুদের ঘরের কালসপ্য মোদের গলায় দিস গ!
অ–গ!
আর দিস গো ঘেঁড়া বস্তর মুষ্টি মেপ্যা চাউল গ!
অ–গ!
গুরুর আজ্ঞায় বিষবৈদ্য বাঞ্জুলা বাউল গ!
অ-গ!

মর্ত্যধামের অধিকারী সাতডিঙা মধুকরের মালিক চাঁদো বেনে শিবভক্ত; তবু বাদ করলে শিবকন্যে বিষহরির সঙ্গে। চ্যাঙমুড়ি কাণি, চ্যাঙমাছের মত মাথা, এক চোখ কানা, সাপের দেবতা বিষহরি-মনসাকে কিছুতেই দেবে না পুজো। আরম্ভ হল যুদ্ধ দেবতার সঙ্গে মর্তের অধিকারী সমাজের মাথার মণির বাদ। মহাজ্ঞান গেল, ধন্বন্তরি গেলেন, বিষবৈদ্যেরা হায় হায় করে উঠল, গুরু গেল—অন্ধকার হয়ে গেল তাদের জীবন, মন্ত্রের পাপড়ি ভেঙে গেল। চাঁদো বেনের ছয় ছয় বেটা গেল। বিষবৈদ্যদের শিরবৈদ্য—তারও গেল একমাত্র কন্যা। অপরাজিতা। ফুলের কুঁড়ির মত কালো বরণের কচি মেয়ে, নূপুর পায়ে দিয়ে বাপের বাঁশির তালে তালে নাচছিল, হঠাৎ টলতে লাগল, তারপর পড়ে গেল—মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙল, আর উঠল না। মন্ত্রতন্ত্র জড়িবুটি সব হয়ে গেল মিছে। আকাশ থেকে মা-মনসা হাঁক দিয়ে বললেন যে বিষ তোরা বিষহরির অনুচর নাগ-নাগিনীর বিষ নষ্ট করতে, তাদের জীবন নিতে সাঁতালী পাহাড়ের চারিদিক ছেয়ে রেখেছি—সেই বিষেই গেল তোর কন্যের জীবন।

সাপের বিষের ওষুধ ওই সব লতাপাতা, সেও যে বিষ। যে বিষে বিষক্ষয় করে, সে বিষও যে সাক্ষাৎ মৃত্যু! কোনো লতাতে ধরেছিল রাঙা ফল–কচি মেয়ে সেই টুকটুকে ফল তুলে খেয়ে। তারই বিষে প্রাণ হারালে।

তুমি পুঁতলে বিষ-বিরিক্ষি ফল খাইবে কে?

শিরবৈদ্য বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল। হায় হায় করে উঠল বৈদ্যপাড়া। বললে—

মরুক মরুক চাঁদো বেনে মুণ্ডে পড়ুক বাজ গ!
অ–গ!
এত দেবতা থাকতে হৈল মনসার সঙ্গে বাদ গ!
অ–গ!

ছয় পুত্র গিয়েছে, ধন্বন্তরি গিয়েছে, মহাজ্ঞান গিয়েছে, সাতডিঙা মধুকর গিয়েছে; তবু যার জ্ঞান হয় নাই, তাকে এসব কথা বলা মিছে। আবার ঘরে জন্মেছে চাঁদের মত লখিন্দর—গণকে বলেছে, বাসরে হবে সর্পাঘাত। তবু না। তবু চাঁদো বেনে ভেঙে দিলে সনকার পাতা মনসার ঘট তার হিন্তাল কাঠের লাঠির ঘায়ে। তবু সে লখিন্দরের বিয়ের আয়োজন করলে সায় বেনের কন্যে বেহুলার সঙ্গে। সাঁতালী পাহাড়ে কামিলা দিয়ে তৈরি করালে লোহার গড় তার মধ্যে লোহার বাসরঘর। সেই রাত্রে পালটে গেল বিষবৈদ্যদের ভাগ্য। সে কি রাত্রি! আকাশে মেঘ জমেছে, সেই মেঘের পুরীতে মা-বিষহরির দরবার বসেছে। অন্ধকার থমথম করছে। সেই থমথমে অন্ধকারের মধ্যে বিষবৈদ্যদের লাল চোখ আঙরার টুকরোর মত জ্বলছিল। মধ্যে মধ্যে শিরবৈদ্য তার গম্ভীর গলায় হাঁকছিল-কে? কে যায়? সাঁতালী পাহাড়ের গাছপালার ডালপালা সে হাঁকে দুলে উঠছিল, গাছের ডালে ডালে ময়ূরেরা উঠছিল পাখসাট মেরে, গর্তে গর্তে নেউলেরা মুখ বার করে রোঁয়া ফুলিয়ে নরুনের মত ধারালো সাদা দাঁত বের করে গর্জে উঠছিল সেই হাঁকের সঙ্গে।

মনসার নগেরা এসে দূর থেকে দেখে থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাথা হেঁট করে ফিরে যাচ্ছিল। আকাশে মেঘ ঘন থেকে ঘন হয়ে উঠেছিল—বিষহরির ভ্রুকুটির ছায়া পড়ছিল। বিদ্যুৎ চমকালি ঘন ঘন, মায়ের চোখে ঝিলিক মেরে উঠছিল ক্রোধের ছটা।

এমন সময় সাঁতালীর সীমানার ধারে করুণস্বরে কে কেঁদে উঠল! মেয়েকণ্ঠের কান্না! শুধু মেয়েকণ্ঠই নয় কচি মেয়ের কণ্ঠস্বর; দুরন্ত ভয়ে সে যেন পৃথিবী আকুল করে কেঁদে উঠেছে।

—বাঁচাও গো! ওগো, বাঁচাও গো! আমাকে বাঁচাও গো!

সর্দার বসে ঝিমোচ্ছিল। সে চমকে উঠল। কে? কে এমন করে কাদে! কচি মেয়ে? কে রে?

—মরে গেলাম! মেরে ফেললে! ওগো! শেষের দিকে মনে হল, সে চিৎকারে আকাশে ঘন মেঘও যেন চিড় খেয়ে গেল, পৃথিবী কেঁদে উঠল।

সর্দার হেঁকে উঠল ভয় নাইভয় নাই।

হাতের চিমটে নিয়ে সে ছুটে এগিয়ে গেল। বিষবৈদ্যদের তখন অস্ত্র ছিল বড় বড় লোহার চিমটে, ডগায় ছিল শূলের মত ধার, সে চিমটে দিয়ে নাগরাজকে ধরলেও তার নিস্তার ছিল না। মাথার দিকে থাকত কড়াচলার সঙ্গে সঙ্গে সে কড়াটা চিমটের গায়ে আছড়ে পড়ে বাদ্যযন্ত্রের মত বাজত—ঝনাৎ ঝঝনাৎ ঝন্—ঝনাৎ!

সাঁতালী পাহাড়ের সীমানার ধারে ঠিক ওপারে আট-দশ বছরের ছোট একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। শীতের শেষে উত্তর-বাতাসে অশ্বত্থপাতা যেমন থরথর করে কাঁপে, তেমনি ভাবে কাঁপছে। আর চোখে মুখে তার সে কি ভয়!

ভয় কি সাধে! হিজল বিলের ধারের ভাগীরথীর চরের উপর ঘাসবনের ভিতর বেদের গা–সাঁতালী গাঁয়ের শিরবেদে সেকালের উপাখ্যান বলতে বলতে নড়েচড়ে বসে। তার দুই কাঁধের মোটা মোটা হাড়গুলো নড়ে নড়ে ওঠে বুকের ভিতরের আবেগে; চোখ ওদের ছোট–নরুন–দিয়ে-চেরা লম্বা সরু চোখও বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। বলে—সাঁতালীর সীমানা বরাবর তখন উপরে নিচে যেন গৰ্জনের তুফান উঠেছে। গাছের উপরে ডালে ডালে ঝটপট ঝটপট শব্দ উঠছে, ময়ুরগুলোর পাখসাটের যেন ঝড় উঠছে, ক্যাঁওক্যাঁও শব্দে সব চমকে উঠছে, নিচে মাটিতে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে রোয়া ফুলিয়ে নেউলেরা, ফ্যাসাস শব্দে রব তুলছে, উপরে ময়ূরের মধ্যে মধ্যে দু পায়ের নখ মেলে ঠোঁট লম্বা করে পাক দিয়ে উড়ে এ-ডাল থেকে ও-ডালে গিয়ে বসছে, নেউলগুলোর দাঁতের সারি বেরিয়ে পড়েছে—তাতে ক্ষুরের ধার, অন্ধকারের মধ্যেও আবছা দেখা যাচ্ছে সাদা দাঁতের সারি। আক্রোশ যেন ওই কচি মেয়েটার উপর। ঝাঁপিয়ে পড়লে টুকরো টুকরো করে ফেলবে লহমায়। শুধু অপেক্ষা মেয়েটার পা বাড়াবার।

শিরবেদে এসে দাঁড়াল থমকে। এ কি আশ্চর্য রূপের কন্যে! এ কি রূপ! ন-দশ বছরের মেয়ে; কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, অ্যাঁধার রাত্রেও জলের তলার মানিকের মত ঝিকমিক করছে; হিলহিলে লম্বা; ঝকমকে সাদা দুটি চোখ! তেমনি কি নরম ওর গড়ন, যেন কচি লতা, যেন। কালো রঙের রেশমি উড়ানি, ওকে যদি কাঁধে ফেলে কেউ, কি গলায় জড়ায়, তবে লেপটে জড়িয়ে যাবে।

মেয়েটা কাঁপছিল; সঙ্গে সঙ্গে যেন নেতিয়েও পড়ছিল, সাঁতালী পাহাড়ের শিরবৈদ্যের মনে হল, শিকড়-কাটা একটি কচি শ্যামলতা যেন নেতিয়ে পড়ছে। মেয়েটা শিরবৈদ্যের দিকে আশ্চর্য চাউনিতে চেয়ে বললেও বাবা, আমাকে বাঁচাও, বাবা গো–

শিরবৈদ্য কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল মরা মেয়েকে। সেও এমনি করে শিকড়-কাটা লতার মত নেতিয়ে পড়েছিল। চোখের উপরে দেখতে দেখতে আলে মানে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তার কণ্ঠের স্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর কণ্ঠে সে ডাকলে—বাবা গো!

আর থাকতে পারলে না শিরবৈদ্য। মা! মা গো! বলে দু হাত মেলে পা বাড়ালে। সঙ্গে সঙ্গে ময়ূরগুলো মাথার উপর চিৎকার করে উঠল, নেউলেরা চিৎকার করে শিরবৈদ্যের পথ। আগলে দাঁড়াল। গোটা সাঁতালী পাহাড় যেন শিউরে উঠল। চাঁদো বেনে হিন্তাল কাঠের লাঠি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে চিৎকার করে উঠল—কে?

শিরবৈদ্য থমকে দাঁড়াল। তার উঁশ ফিরে এল।

কে? কে এ অপরূপ কালো মেয়ে! ময়ূরেরা কেন হায় হায় বলে চিৎকার করে উঠল, নেউলেরা কেন না না বলে পথ আগলে দাঁড়াল! কেন শিউরে উঠল সাঁতালী পাহাড়ের মন্ত্ৰপূত মাটি!

গাঙের কূলের ঘাসবনের সাঁতালী গাঁয়ের শিরবেদে এ কাহিনী বলতে বলতে বলে–বিষবৈদ্যেরা তখন বিষবেদে হয় নাই ধন্বন্তরি বাবা। তখন তারা ছিল সিদ্ধবিদ্যের অধিকারী, মন্তরের ছিল মহিমা, সেই মন্তরের বলে, বিদ্যের বলে বুঝতে পারত জীবজন্তু পশুপাখির বাক্; তখন তাদের মন্তরের বলে গাছ উড়ত আকাশে, গাছে চড়ে মন্তর পড়ে বলত-চল্‌ উড়ে; মাটিপাথর চড়চড় করে ফাটিয়ে শিকড়বাকড় নিয়ে গাছ হুহু করে আকাশে উঠত। মন্তর পড়ে গণ্ডি এঁকে দিলে সে গণ্ডি পার হয়ে কারুর যাবার হুকুম ছিল না, হোক না কেন দেবতা, হোক না। কেন দত্যি, যক্ষ বল, রক্ষ বল কারুর না। শিরবৈদ্য বুঝতে পারত ময়ূর-নেউলের বাক, সাঁতালীর মাটির শিউরে ওঠা। হুঁশ ফিরল তার, থমকে দাঁড়াল, ভুরু কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, শুধালে কে তু? অ্যাঁ?

মেয়েটা তখন ভুঁইয়ের উপর বসে পড়েছে—নেতিয়ে পড়েছে। টলছে, বিসর্জনের প্রতিমার মত টলছে। তবু সে কন্যে কোনোমতে বললে তিন ভুবনে আমার ঠাঁই নাই, তিন ভুবনে আপন নাই; ছিল শুধু মা; সেও আমাকে দিলে তাড়িয়ে। মায়ের কাজ করতে নারলাম তাই দিলে তাড়িয়ে। তোমার নাম শুনেছি, তোমার কাছে এসেছি ঠাঁইয়ের জন্যে। তুমি যদি ঠাঁই দাও তো বঁচি, নইলে আমাকে—

হাঁপাতে লাগল সে। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললে—এই নেউলে আর ওই ময়ূরেরা আমাকে। ছিঁড়ে ফেলবে গো! তা ছাড়া এখানকার বাতাসে কি রয়েছে—আমার দম বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে।

শিরবৈদ্য এবার চিনলে। বুকে তার কন্যের শোক, চোখে তার ওই কালো মেয়েটার রূপের ছটায় ধাধা—তবু সে চিনতে পারলে। কালো মেয়ের দাঁত কি মিহি, কি ঝকঝকে, আর মুখ। থেকে কি কটু বাস বেরিয়ে আসছে! বিষবৈদ্যের কাছে কতক্ষণ লুকানো থাকবে কালকূটের গন্ধ?

দু পা পিছিয়ে এল শিরবৈদ্য।

–সর্বনাশী-কালনাগিনী! পালা, পালা, তুই পালা, নইলে তোর পরান যাবে আমার হাতে। ওই মোহিনী কন্যেমূর্তি না ধরে এলে এতক্ষণে তা যেত।

তখন মেয়েটা এলিয়ে পড়ে গিয়েছে ধুলোর উপর। অন্ধকার রাত্রে একছড়া কালে মানিকের হারের মত পড়ে আছে, আকাশের বিদ্যুৎচমকের মধ্যে ঝিকমিক করে উঠছে।

শিরবেদে মহাদেব কাহিনী বলতে বলতে থেমে যায় এইখানে। একটুখানি হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে। মাথা নেড়ে অসহায়তা জানিয়ে আবার বলে—দেবতার সহায় নেয়ত, নেয়তের হাতে মানুষ হল পুতুলনাচের পুতুল বাবা। যেমন নাচায় তেমিন নাচি।

চাঁদো বেনের সঙ্গে বিষহরির লড়াইয়ে নিয়তি বিষহরির সহায়। শিবের ভক্ত চাঁদ, মহাজ্ঞানের অধিকারী চাঁদ নাচলে পুতুলের মত। লখিন্দর জন্মল বাবা, নিয়তি তার কপালে নেখন নিখলে। তাকে এড়িয়ে যাবে শিরবৈদ্য—সে সাধ্যি তার কোথায়? হয়ত সাধ্যি হত যদি থাকত গুরুবল––ধন্বন্তরি থাকতেন বেঁচে। এই ছলনায় ছলবার তরে নিয়তি আগে থেকে ছক সাজিয়ে রেখেছে। কন্যে দিয়েছিল, সেই কন্যেকে কচিকালে কেড়ে নিয়েছে, বুকের মধ্যে তেষ্টা জাগিয়ে রেখেছে, তারপরেতে কালনাগিনীকে ছোট মেয়েটি সাজিয়ে এই কাল রজনীতে তার ছামুনে দাঁড় করিয়েছে। তবু শিরবৈদ্য আপন গুরুবলে বিদ্যেবলে তাকে চিনতে পেরে দু পা এল পিছায়ে। তখন, বাবা মোক্ষম ছলনা এল।

শিরবৈদ্য দেখতে পেলে আরও একটি মূর্তি। ছায়ার মতন। ওই নেতিয়ে-পড়া কালনাগিনীর শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা, সে হল সাক্ষাৎ নিয়তি, মহামায়ার মায়া! একেবারে শিরবৈদ্যের সেই মরা কন্যে। এবারে শুধু শিরবৈদ্যই ভুললে না বাবা, সাক্ষাৎ নিয়তির ছল, তাতে ভুলল সবাই, ময়ূরেরা ভুলল, নেউলেরা ভুলল, সাঁতালী পাহাড়ের মন্তরপড়া মাটি, সেও ভুলল। সবাই স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ছায়ার মত মূর্তিটির দিকে। সেই কন্যে, শিরবৈদ্যের দুলালী, যে ময়ূরদের সঙ্গে নাচত, নেউলেরা যার পায়ে মাথা ঘষত, যার পায়ের মলের ঝমঝমানিতে সাঁতালী পাহাড়ের মন্তরপড়া মাটি তালে তালে দুলে উঠত,–সেই কন্যে।

অবিকল! তিল থুতে তফাত নাই। সেই—সেই!

সে মেয়ে এবার ডাকলে—বাবা!

শিরবৈদ্য এবার হা-হা করে কেঁদে উঠে দুহাত মেলে দিয়ে বললে—আয়, আয় ওরে আমার হারানিধি, ওরে আমার কন্যে, আয় মা, আমার বুকে আয়।

কন্যেমূর্তি ধরে নিয়তি বললে—কি করে যার বাবা! এ যে আমার ছায় মূর্তি! নূতন মূর্তিতে তোমার বুক জুড়াব বলে এলাম কিন্তু তুমি যে আমাকে নিলে না বাবা।

শিরবৈদ্যের চোখ দিয়ে জল গড়াল, ময়ূরেরা বিলাপ করে ঠল, নেউলেরা ফেঁসানি ছেড়ে কুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, গাছের পাতাপল্লব থেকে টপটপ করে ঝর,ত লাগল শিশিরের ফোটা।

কন্যে বললে—নতুন জন্মে আমি নাগকুলে জন্ম নিয়েছি বাবা। এই তো আমার নতুন কায়া, ওই তো পড়ে রয়েছে সে কায়া, সাঁতালীর সীমানায় কালো রত্নহারের মত। তুমি যদি বুকে নাও তবেই এই কায়ায় থাকতে পাব, নইলে আবার মরতে হবে।

বলতে বলতে ছায়ামূর্তি যেন এলিয়ে গলে মিলিয়ে গেল—ওই কালো মেয়ের অচেতন দেহের মধ্যে। মানুষের ছলা, মানুষের মায়া—এ হেঁড়া যায়, কাটা যায়; দেবমায়াও বুঝা যায় বাবা। নিয়তির মায়া—সে বুঝবার সাধ্যি এক আছে শিবের, আর কারুর নাই।

শিরবৈদ্য ভুলল; সে পাগলের মত ছুটে গিয়ে তুলে নিলে কালনাগিনীর কন্যেমূর্তি-ধরা দেহখানি। মনে হল, বুক যেন জুড়িয়ে গেল। নাগিনীর অঙ্গের পরশ বড় শীতল যে! বিষবৈদ্যের দেহে তেমনি জ্বালা। বিষ খেয়ে সে ঝিমোয়, সারা অঙ্গে মাখে বিষহরা ওষুধের রস, গলায় হাতে তার জড়িবুটি; তেল মাখা বারণ; দেহ তার আগুনের মত তপ্ত। নাগিনীর শীতল পরশে দেহ জুড়াল, মনে হল বুকও যেন জুড়িয়ে গেল। শিরবৈদ্য আরও জোরে বুকে জড়িয়ে ধরল কন্যের দেহখানি। কথায় আছে—মরে মানুষ জ্বালা জুড়ায়। তা বাবা নাগিনীর দেহ অঙ্গে জড়ালে ভাবতে হয়—মরণ ঠাণ্ডা বেশি, না, নাগিনী শীতল বেশি?

–তারপর?

প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে হাসে গঙ্গার চরের সাঁতালীর শিরবেদে, ঘাড় নাড়ে গৃঢ় রহস্যোপলব্ধির আনন্দে নিবাসক্তের মত। বলে-তারপর, যা হবার তাই হল, কন্যের মুখে চোখে দিলে মন্ত্রপড়া জল, ওষুধের গন্ধ সহ্য করবার মত ওষুধও দিলে দুধের সঙ্গে। ময়ূরদের বললে—যা যা, চলে যা। হুস—ধা! নেউলদের বললে—যা, তোরাও যা বলে শিস মেরে দিলে ইশারা।

মেয়ে চোখ মেললে। বললে—তুমি আমার বাপ!

শিরবৈদ্য বললে–হ্যাঁ মা, হ্যাঁ। তারপর বললে কিন্তু আমাকে কথা দে মা, আমাকে কখনও ছেড়ে যাবি না।

না না না। তিন সত্যি করলে কালোকন্যে। বললে—তোমার ঘরে আমি চিরকাল থাকব থাকব থাকব। তোমার ঘরে ঝাপিতে থাকব নাগিনী হয়ে, তোমাদের বংশে জন্মাব আমি কন্যে হয়ে। তুমি বাঁশি বাজিয়ে আমাকে নাচাবে আমি নাচব।

শিরবৈদ্য বললে—আকাশে সাক্ষী রইল দেবতারা, মর্তে সাক্ষী রইল নেউলরা ময়ূরেরা আর সাঁতালীর গাছপালা। যদি চলে যাস তবে আমার বাণে হবে তোর মরণ।

–হ্যাঁ, তাই।

এইবার শিরবৈদ্য তাকে পরিয়ে দিলে তার সেই মরা-মেয়ের অলঙ্কারগুলি। পায়ে দিলে মল, গলায় দিলে লাল পলার মালা, হাতে দিলে শঙ্খের কঙ্কণ, তারপর তুলে নিলে তার বশি। বাঁশের বাঁশি নয়, অন্য বাঁশি নয়, এই তুমড়ি-বাঁশি। তার সেই মেয়ে নাচলে নাচন—দুলে দুলে পাক দিয়ে, সে নাচন বিষবৈদ্যের মেয়ে আর নাগকন্যে ছাড়া আর কেউ জানে না। নাচতে নাচতে এসে শিরবৈদ্যের গলা জড়িয়ে ধরে দুলতে লাগল। তার নিশ্বাস পড়তে লাগল শিরবৈদ্যের নাকের কাছে। নাগিনীর নিশ্বাস অন্যের কাছে বিষ, কিন্তু বিষবৈদ্যের কাছে দুঃখহরা চিন্তাহরা আসব। আমরা, বাবা, সাপের বিষ খেয়ে নেশা করে যে সুখ পাই হোক না কেন হাজার কড়া মদ, সে সুখ পাই না। শিরবৈদ্য বুক ভরে নিশ্বাস টানতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতের তুড়ি-বাঁশির সুর এলিয়ে পড়তে লাগল, চোখ দুটি তুলতে লাগল, সারা গা টলতে লাগল, পায়ের তলার মাটি দুলতে লাগল, শেষ খসে পড়ল হাতের বাঁশি।

এবার নাগিনী গান ধরলে গুনগুনিয়ে ঘুমপাড়ানি গানের মত বিষছড়ানি গান।

বাসুকী দোলায় মাথা দোলে চরাচর রে—
তুই ঢল্‌ ঢলে পড়া রে!
সমুদ্রমন্থনে দোলে ও সাত সাগর রে–
তুই ঢল্ ঢলে পড়া রে!
অনন্ত উগারেন সুধা তাই হলাহল রে–
ও তুই ঢল্ ঢলে পড়া রে!
সে সুধা ধরেন কণ্ঠে ভোলা মহেশ্বর রে–
তুই ঢল্‌ ঢলে পড়া রে!
ভোলার চক্ষু ঢুলুঢুলু অঙ্গ টলমল রে–
তুই ঢল্‌ ঢলে পড়া রে!
অনন্ত শয্যায় শুয়ে ঘুমান ঈশ্বর রে—
তুই ঢ ঢলে পড়া রে!

বাবা, অমন ঘুমের ওষুধ আর নাই। ভোলানাথ মহেশ্বর হলেন মিত্যুঞ্জয়, মিত্যুকে জয় করলে কি ঘুম তার কাছে আসে? আসে না। মিত্যুর হেঁয়া হল ঘুম। তোমার আমার অঙ্গের যেমন হেঁয়াতে তোমার আমারই আকার পেকার মিত্যুর হেঁয়াতেও তাই তারই ছোঁয়াচ। নিথর করে দেবে, সব ভুলিয়ে দেবে। তা মিত্যুর হেঁয়া ঘুম মিত্যুঞ্জয়ের চোখে কি পেকারে আসবে বল? আসে না। মিত্যুও নাই, ঘুমও নাই। সদাই জেগে আছেন শিব। কিন্তু ওই নিশ্বাসের নেশায়। সদাই আধঘুমে ঢুলুঢুলু করছেন-মনে কিছুই নাই, সব আছেন ভুলে। আবার দেখ বাবা, ঈশ্বর—তিনি পাতেন অনন্ত-শয্যা ক্ষীরোদসাগরে। অনন্ত নাগের শয্যা ভিন ঘুম আসে না। ঈশ্বরকে ঘুম পাড়ায়, বাবা, ঐ নিশ্বাস। সেই নিশ্বাসে ঢলে ঘুমিয়ে পড়ল শিঃবৈদ্য। শুধু সে কেন? গোটা সাঁতালী পাহাড়। ময়ূরের পাখা হল নিথর, নেউলের দেহ পড়ল নেতিয়ে, সাঁতালীর লতাপাতা ঝিম হয়ে রইল। তখন বের হল সেই ছোট কালো মেয়ে। খুলে ফেললে শিরবৈদ্যের দেওয়া গয়নাগুলি। নিঃশব্দে চলল এগিয়ে। নিঃশব্দে, কিন্তু তীরের মত বেগে। বাসরঘরের লোহার দেওয়ালে কামিলে রেখেছিল ছিদ্ৰ—সেখানে গিয়ে ধরলে নিজের মূর্তি। দাঁড়াল ফণা ধরে, কলক করে খেলতে লাগল জিভ, নিশ্বাসে ছিদ্র বড় হতে লাগল—কয়লার গুড়ো খসে। পড়ল। ছিদ্র বন্ধ ছিল কয়লার গুঁড়ো দিয়ে।

–তারপর?

—তারপর তো তোমরা সব জান গো। জানতে না শুধু বিষবৈদ্যের এই কথা কটি। কি করে জানবে বল? ঘটল রাত্তিরের অ্যাঁধারে। সাক্ষী তো কেউ ছিল না। আর বিশ্বাসই বা কে করবে বল? সকালে বেহুলার কান্না শুনে চাদসদাগর ছুটে এল ডাঙশ-খাওয়া হাতির মত, এসে দেখলে–সোনার লখিন্দর নাই। কাঁদছে বেহুলা, পড়ে আছে নাগিনীর লেজের একটা টুকরো। তখন সর্বাগ্রে সে ছুটে এসেছিল বিষবৈদ্যদের পাড়ায় শিরবৈদ্যের আঙনেতে। তখনও সে ঘুমে অচেতন।

লাথি মারলে চাঁদ। হিন্তালের লাঠি দিয়ে দিলে ফেঁচা। শিরবৈদ্য জাগতেই তাকে বললে–তুই নেমকহারাম। তুই বিশ্বাসঘাতী। তুই পাপী। তুই সাহায্য না করলে, তুই পথ না দিলে পথ। পায় কি করে নাগিনী?

শিরবৈদ্য স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল বণিক মহাশয়ের মুখের দিকে। শুধু একবার দেখে নিলে। চারিপাশ। কোথায় কালো মেয়ে? কেউ কোথাও নাই, শুধু কখানা অলঙ্কার পড়ে রয়েছে চারিদিকে ছড়িয়ে।

মায়া! ছলনা! নিয়তি!

মাথা হেঁট করলে সে দণ্ড নেবার জন্যে।

চাঁদো বেনে শাপান্ত করলে।

–বাক্য দিয়ে বা লঙ্ন করেছিস, বিশ্বাস করেছিলাম সে বিশ্বাসকে হনন করেছিল। তুই, তোর জাত, বাক্যহন্তা, বিশ্বাসহন্তা। যে বাক্ দিয়ে বা রাখে না, তার জাত থাকে না। বিশ্বাস করলে যে বিশ্বাসকে হনন করে তার দণ্ড নির্বাসন। সাঁতালী পাহাড়ে যে নিষ্কর সনদ দিয়েছিলাম সে হল বাতিল; এই পাহাড় থেকে এই সমাজ থেকে এই দেশ থেকে তাদের ঠাঁই আমি কেড়ে নিলাম। শিবের আজ্ঞায় রাজা নিলেন কেড়ে। তোদের বাস গেল, জাত গেল, মান গেল, লক্ষ্মী গেল। শিবের আজ্ঞা, আমার শাপান্ত। তোদের কেউ ছোবে না, ছোওয়া জিনিস নেবে না, বসতির মধ্যে ঠাঁই দেবে না।

চলে গেল সদাগর। সাত পুত্রের শোক বুকে নিয়ে সে তখন পাথর; তার সে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে শিরবৈদ্যের সাহস হল না যে বলে সদাগর, তোমার সাতটি গিয়ে বুক যেমন খালি হয়েছে, আমার একটি গিয়েই তেমনি বুক খালি হয়েছে। বিশ্বাস যদি না কর তো তোমার বুকে হাত দিয়ে আমার বুকে হাত দাও,তাপ সমান কি না দেখ। কিন্তু সে বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ওদিকে তখন চম্পাই নগরে, হায়-হায় উঠেছে। দুয়ারে দুয়ারে লোক জমেছে, নদীর ঘাটে কলার মাঞ্জাস বাধা হচ্ছে; লখিন্দরের দেহ নিয়ে বেহুলা জলে ভাসবেন; মরা লখিন্দরের প্রাণ ফিরে পেলে তবেই ফিরবেন, নইলে এই ভাসা মরণলোকে ভাসা।

জলে ভেসে যায় রে সোনার কমলা।
হায় গ! হায় গ!
কঠিন নাগিনী তোর দয়া হল না!
হায় গ! হায় গ!

বিষবৈদ্যের জাতি ছিল, কুল ছিল, মান ছিল, খাতির ছিল; কিন্তু লক্ষ্মী ছিল না। চিরটা দিন বাঞ্জুলা বাউল, ওষুধের মূল্য নাই, মন্ত্রগুণের দক্ষিণা নাই। ভগবানের ছিষ্টি আর গুরুর দান–এ বিক্রি করে কি মূল্য নিতে আছে? না, এ দুয়ের মূল্য সোনায় রুপায় হতে পারে?-নিয়ম হল—বিষে জীবন যায় এ সংবাদ যদি কাকের মুখে পাও তো কাককে শুধাবে কোথায়, কার? তারপরে ঘরের চিড়ামুড়ি খুঁটে বেঁধে তৎক্ষণাৎ যাত্রা করবে সেই দিকে। পরান ফিরায়ে দিয়ে ফিরে আসবে ঘর। খালি হাতে যাত্রা, খালি হাতে ফেরা। তাদের ঘরে লক্ষ্মী হবে কোথা থেকে বল? চিরদিনই তারা গরিব। শুধু ছিল জাতি, কুল, মান—তাও গেল সমাজের শিরোমণি লক্ষ্মীশ্বর চাঁদোবেনের শাপে। ব্রহ্মার সৃষ্টির প্রথম থেকে সাঁতালী পাহাড়ে বসতের শাসন-পত্র, তাও হয়ে গেল দেবচক্রে নিয়তির ছলনায় বাতিল। বিষবৈদ্যদের রূপ ছিল সাধুসন্ন্যাসীর মত, তাদের অঙ্গের জড়িবুটি ওষুধের গন্ধ বিষধরের কাছে অসহ্য, কিন্তু মানুষের কাছে সে গন্ধ দিব্যগন্ধ বলে মনে হত। তাদের সে রূপে পড়ল কালি, দিব্যগন্ধ হয়ে উঠল দুৰ্গন্ধ চাঁদোরাজার শাপে। লজ্জায় মাথা হেঁট করে সাঁতালী ছেড়ে, জড়িবুটির বোঝা সাপের ঝাঁপি আর মাটির ভাঁড় সম্বল করে বেরিয়ে পড়ল তারা। সাঁতালীর সীমানা পার হয়ে যেখানে শিরবৈদ্য প্রথম দেখেছিল। সেই মায়াবিনী কালো-কন্যে মূর্তি-ধরা কালনাগিনীকে, সেইখানে এসে থমকে দাঁড়াল শিরবৈদ্য; মনে পড়ল সব। সে আক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠল—আঃ, মায়াবিনী রে! তোর ছলাতে সব হারালাম, তোকেও হারালাম? বাক্ দিয়ে বাভঙ্গ করলি সর্বনাশী।

কাঁধের বকে ঝুলানো ঝাঁপি থেকে শিস দিয়ে কে যেন বলে উঠল–বাবা, না। আমি আছি—তোমার সঙ্গেই আছি।

ঝাঁপি খুলতেই মাথা তুলে দুলে উঠল কালোমানিকের হাড়ের মত ঝলমলানো ছটা নিয়ে। কালনাগিনী কালো কন্যে। ছপাৎ করে ছোবল দেওয়ার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল শিরবৈদ্যের বুকের দিকে। শিরবৈদ্য তাকে জড়িয়ে নিল গলায়। নাগিনী মাথা তুলে দুলতে লাগল শিরবৈদ্যের কানের পাশে। ফোঁসফুসিয়ে কানে কানে বললে–নাগের বাক্যে দেববাক্যে তফাত নাই। বাক্ দিলে। সে বা ফেরে না। চাঁদের আজ্ঞায় তোমাদের বাসভূমি গিয়েছে, মা-বিষহরির আজ্ঞায় তোমরা পাবে নতুন বাসের ঠাঁই। গঙ্গার বুকে ভাসাও নৌকা; মা-গঙ্গা স্বর্গের কন্যে, পৃথিবীর বুকে বেয়ে গেলেও পৃথিবীর বাইরে। গঙ্গার জল যত দূর পর্যন্ত মাটি ঢেকে দেয়, তত দূর মা-গঙ্গার সীমানা। গঙ্গার ধারে পবিত্র পলি-পড়া চরের উপর যেখানে তোমার পছন্দ সেইখানেই ঘর বাঁধ। চাঁদের আজ্ঞা সেখানে খাটবে না। তোমাদের জাতি নিলে, কুল নিলে চাঁদ, মা-বিষহরি তোমাদের দিলেন নতুন জাত, নতুন কুল। তোমরা কারুর ভাত খাবে না; তোমাদের জল, তোমাদের ফুল মা-বিষহরি নেবেন মাথায়। এ জাত তোমার যাবে না। চাঁদের শাপে তোমাদের বর্ণ হয়ে গিয়েছে কালিবর্ণ, মায়ের ইচ্ছায় ওই কালিবর্ণে ফুটে উঠবে আমার বর্ণের ছটা। আমার মা দিয়েছেন ধন্বন্তরির বিদ্যার উপরে নতুন মন্ত্র, যে মন্ত্রে পৃথিবীর জন্তু-জানোয়ার সব বশ মানবে। নাগের দংশন সে যেমন হোক, যদি বিধির লেখা মৃত্যুদণ্ডের দংশন না হয়, তবে সে মন্ত্রে নাগের বিষ উড়ে যাবে কপূরের মত। আর মা দিলেন তোমাকে নতুন অধিকার, তুমি নিতে পাবে গৃহস্থের কাছে পেটের অন্নের জন্যে চাল, অঙ্গ ঢাকবার জন্য বস্ত্ৰ। আর দিয়েছেন অধিকার আমার বিষের উপর এই গেলে নিয়ে তুমি বিক্রি করবে বৈদ্যদের কাছে, তোমার হাতের গেলে নেওয়া বিষ তারা শোধন করে নিলে হবে অমৃত। সে অমৃত সূচ-পরিমাণ দিলে মরতে মরতে মানুষ বেঁচে উঠবে। বান্ধের বা ফুটবে, পঙ্গুর দেহে সাড় আসবে। আর বাবা, আমি যে হয়েছিলাম কাল তোমার কন্যে, চিরকাল তাই থাকব। ঝাপিতে থাকব নাগিনী মূর্তিতে, তুমি আমাকে নাচাবে আমি নাচব; তোমাদের ঘরে সত্যিকারের কন্যে হয়েও জন্মাব। তুমি শিরবেদে, তুমি আমাকে চিনতে পারবে আমার লক্ষণ দেখে। প্রথম লক্ষণ বাবা, পাঁচ বছরের আগে সে কন্যা বিধবা হবে, স্বামী মরবে নাগের বিষে। তারপর ষোল বছর পর্যন্ত সে কন্যের আর বিয়ে দেবে না, ষোল বছরের আগে ফুটবে নাগিনী-লক্ষণ। কাল রাত্রে আমার যেমন রূপ দেখেছ বাবা, ঠিক তেমনি রূপ। তার কপালে তুমি দেখতে পাবে চক্ৰচিহ্ন। সেই কন্যে নেবে তোমাদের বিষহরির পুজোর ভার। তোমাদের কল্যাণ করবে সে, তোমার আজ্ঞাধীন হবে, তোমাকে জানাবে মা-বিষহরির অভিপ্ৰায়ের কথা। চল বাবা, ভাসাও নৌকা; আমি দেখাই তোমাকে পথ।

গাঙ্গুড়ের জলে রাত্রির অন্ধকারে নৌকা ভাসল।
দিনে সকালে বেহুলার মাঞ্জাস ভেসে গিয়েছে।

সমস্ত দিন অরণ্যে মুখ ঢেকে থেকে রাত্রে বিষবেদেরা নৌকা ভাসাল—চলল চম্পাই নগর সাঁতালী পাহাড় দেশভূঁই ছেড়ে। গলুইয়ের উপর ফণা তুলে কালনাগিনী বলতে লাগল, এইবার বায়ে ভাঙ বাবা। এইবার ডাইনে। আকাশে মেঘ ওঠে, নাগিনী ফণা তুলে ধরে ছত্র। ওঠে ঝড়, নাগিনী বিষনিশ্বাসে দেয় উড়িয়ে। প্রভাত হয়, শিরবৈদ্য দেখে, সারিবন্দি নৌকার অর্ধেক নাই। নাগিনী বলে, ওরা তোমাকে ছাড়লে বাবা। পতিত হয়ে ওরা থেকে গেল, মাটিতে ঠাঁই রইল না, এখানকার নদীতেই নৌকায় নৌকায় ফিরবে ওরা।

পরের দিন সকালে যখন নৌকা পদ্মাবতীর মাঝামাঝি এল, তখন দেখলে, আরও অর্ধেক নৌকা নাই, রাত্রের অন্ধকারে অকূলে ভাসবার দুশ্চিন্তা সইতে না পেরে চুপিচুপি সঙ্গ ছেড়ে নৌকা বেঁধেছে কোনো ঘাটে। তারাও থাকল সেখানে।

শেষ তিনখানা নৌকা এসে পৌঁছল এই হিজল বিলের ধারে।

নাগিনী বললে—এইখানে আছে মা-বিষহরির আটন। এরই তলায় মা লুকিয়ে রেখেছিলেন। চাঁদোর সাতডিঙা মধুকর।

শিরবেদে বললে—তবে এইখানে ভুঁইয়ে ঘর বাঁধি?

মা-গঙ্গার চরের উপর যেখানে খুশি সেইখানেই বাঁধতে পার। বাঁধ, এইখানেই বাঁধ। হিজল বিলের বুক থেকে নালা-খালার অন্ত নাই। এইখানের মুখে হাঙরের বাস-এর নাম। হাঙরমুখী, ওর পাশে ওইটে হল কুমিরখানা, তার ওদিকে হাঁসখালি।

এ বিলের নালা-খালার অন্ত নাই; কৰ্কটির খাল, চিতির নালা, কাদুনে গড়ানি। হিজলের যে দিকটা লোকে চেনে, এটা সেদিক নয়, সেদিকে আছে আরও কত নালা-খালা।

আমরা এইখানেই ঢুকলাম নৌকা নিয়ে।

তিনখানি নৌকা ঘাটে বাঁধা রইল। ঘাসবনের ভিতর মাচান বেঁধে তুললাম। তিনখানি ঘরে নতুন সাঁতালী গাঁয়ের পত্তন হয়েছিল।

* * *

তিন ঘর থেকে তিরিশ ঘরের উপর বিষবেদের বসতি এখন সাঁতালীতে।

শরতের প্রথমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। মেঘের গায়ে পেঁজাতুলোর বর্ণ ও লাবণ্য দেখা দিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী। দশ দণ্ড রাত্রি পার হয়ে গিয়ে আকাশে কৃষ্ণাপঞ্চমীর চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত; বড় বড় সাদা মেঘের খানা ভেসে যাচ্ছে। নিচে হিজল বিলে পদ্মশালুক পানাড়ীর ফুল ঝলমল করছে। হিজলের ঘন সবুজ ঘাসবনে কাশফুল ফুটতে শুরু করেছে, এখনও ফুলে ফেঁপে দুধবরণ সাদা। হয়ে ওঠে নি। তারও উপর পড়েছে জ্যোৎস্না।

হাঙরমুখীর বাঁকে বাঁকে ঘুরে সাঁতালীর ঘাটে যদি কেউ এখন যেতে পারে, তবে দেখতে পাবে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশখানা নৌকা বাঁধা। নৌকায় নৌকায় আলো জ্বলছে—পিদিমের আলো, কিন্তু লোক নাই। দূরে শুনতে পাবে কোথাও বাজনা। ঘাটে পৌঁছবার আগে থেকেই শুনতে পাবে।

তুমড়ি-বাঁশির একঘেয়ে শব্দের সঙ্গে–বিষম-ঢাকি বাজছে। তার সঙ্গে উঠছে–ঝনাৎ–ঝন–ঝনাৎ-ঝন-বিচিত্র ধাতব ঝঙ্কার। শরীর মন কেমন করে উঠবে সে বাজনা শুনে। তারই সঙ্গে মধ্যে মধ্যে ঠিক তালে তালে সমবেত কণ্ঠের ধুয়া-গান শুনতে পাবে-অ-গ! অ-গ!

আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে শুনতে পাবে মোটা ভরাট গলার গান–

লাচোলাচো আমার কালনাগিনী কন্যে গ!
অগ!
দুঙ্কু আমার সোনা হইল তু মানিকের জন্যে গ!
অ-গ!
কদমতলায় বাজে বাঁশি রাধার মন উদাসী গ!
অ-গ!
কালীদহে কালনাগিনী উঠল জলে ভাসি গ!
অগ!
মোহন বংশীধারীর আমার লয়ন মন ভোলে গ!
অ-গ!
ঝাঁপ দিল কালো কানাই রাধা রাধা বলে গ!
অ-গ!
কালোবরণ কালনাগিনী কালো চাঁদের পাশে গ!
অগ!
কালীদহের জলে যুগল নীলকমল ভাসে গ!
অ-গ!

ঘাটে এসে বাঁধ নৌকা। সাবধানে নেম। অনেক বিপদ। সামনে পাবে এক-ফালি সরু পথ। দুপাশে ঘাস বন; এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাস্তাটি। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তা। আজই চেঁচেছুলে পরিষ্কার করেছে। রাস্তায় দাঁড়ালেই পাবে ধূপের মিষ্ট গন্ধ। ধূপের সঙ্গে ওরা দেবদারুর আঠা আর মুথা ঘাসের গোড়া শুকিয়ে গুঁড়ো করে মেশায়। বাজনা এবার উচ্চ হয়ে উঠেছে, একঘেয়ে সুরে বেজেই চলেছে।

ঝনাৎ-ঝন ঝনাৎ-ঝন ঝনাৎ-ঝন।
চিমটের মাথায় কড়া বাজাচ্ছে। বাজছে মন্দিরার মত তালে তালে—ঝনাৎ-ঝন।
ধুম-ধুম, ধুম-ধুম, ধুম-ধুম।
বিষম-ঢাকি বাজছে।
বিচিত্ৰ তুড়ি-বাঁশি বাজছে—পুঁ-উ-উ-পুঁ-উ-উ-পুঁ-উ-উ।

আজ ভদ্রের শেষ নাগপঞ্চমী। বিষহরির আরাধনা করছে বিষবেদেরা। আজ ওদের শ্রেষ্ঠ উৎসব। উৎসব হচ্ছে বিষহরির আঙনেতে। পূজা হয়ে গিয়েছে দিনে, এখন হচ্ছে গান। গোটা পাড়া গানের আসরে এসে বসেছে, সবাই গাইছে গান। মেয়ে পুরুষ সবাই। শ্রোতা নাই। এগিয়ে চল, এবার শুনতে পাবে নারীকণ্ঠ। একা একটি মেয়ে গান গাইছে—

ও আমার সাত জন্মের বাপ গ—তোরে দিচ্ছি বাক্‌ গ!

সমবেত নারীকন্ঠে এবার সেই ধুয়া ধ্বনিত হয়ে উঠবে—অ-গ!

তোরে ছেড়্যা যাইলে আমার মুণ্ডে পড়বে বাজ গ!
অগ!
এ ঘোর সঙ্কটে তুমি রাখলে আমার মান্যে গ!
অ-গ!
জন্ম জন্ম তোমার ঘরে হইব আমি কন্যে গ!
অ-গ!
তোমার বাঁশির তালে তালে নাচব হেল্যা-দুল্যা গ!
অগ!
আমার গরল হইবে সুধা তুমি বাবা ছুল্যে গ!
অ-গ!

এ গান গাইছে ওদের নাগিনী কন্যা।

কালনাগিনী ওদের ঝাঁপির মধ্যে থাকে, আবার ওদের ঘরে কন্যা হয়েও জন্মায়। বা দিয়েছিল কালনাগিনী:

তোমার বংশ তোমার অ্যাঁপি হইল আমার ঘর গ!
অ-গ!
তুমি না করিলে পর হইব না মুই পর গ!
—অ-মরি-মরি-মরি গ; অ-মরি-মরি গ!

আজও সে বাক্যের অন্যথা হয় নাই। পাঁচ বৎসর বয়সের আগে সর্পাঘাতে বিধবা হয় যে কন্যে, তার দিকে সকল বেদের চোখ গিয়ে পড়ে। বেদের ঘরে মেয়ের বিয়ের কাল হয় অন্নপ্রাশনের পরই। ছমাস থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। বেদের ছেলে সাপ নিয়ে খেলা করে; বেদেদের সাপ নিয়ে কারবার। মনসার কথায় আছে–নরে নাগে বাসা হয় না। সাঁতালী গাঁয়ে সেই নরে-নাগে বাস। সেবার মধ্যে অপরাধ হয়, নাগ দংশন করে; বিষহরির বরে—সে বিষ মন্ত্রবলে ওষুধের গুণে নেমে যায়। কিন্তু নিয়তির লেখায় যে দংশন হয় তার উপায় নাই। মৃত্যু এসে নাগের দন্তে আসন পেতে বসে; নাগের বিষের মধ্যে মিশিয়ে দেয় নিজের শক্তিকে। নৌকার মাঝি মরে জলে, কাঠুরে মরে গাছ থেকে ডাল ভেঙে পড়ে, যুদ্ধ যার পেশা সে মরে অস্ত্রাঘাতে।

শিরবেদে বলে—মৃত্যু বহুরূপী বাবা। মানুষের ছেষ্ট কামনার দব্য অন্নজল, তার মধ্যে দিয়েও সে আসে। বেদের মিত্যু সাপের মুখের মধ্যে দিয়ে আসবে, তাতে আর আশ্চর্যি কি! তাই যারা মরে সাপের দংশনে, তাদের বউয়েরা সবাই কিছু নাগিনী কন্যে হয় না। যে হয় ধীরে ধীরে তার অঙ্গে লক্ষণ ফুটে ওঠে। বেদের জাতে বিধবার বিয়ে হয়, আবার ছাড়-বিচারও আছে। কিন্তু এই সব কন্যের সাঙা ষোল বছরের আগে হয় না। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত চোখ থাকে এই কন্যেদের ওপর।

নতুন নাগিনী কন্যে দেখা দিলেই পুরনো নাগিনী কন্যেকে সরতে হয়। গাঁয়ের ধারের ছোট একখানি ঘরে গিয়ে আর-জন্মের ভাগ্যের জন্যে মা-বিষহরিকে ধেয়ায়।

একজন শিরবেদের আমলে দু-তিন জন নাগিনী কন্যার আসন পার হয়ে যায়।

কতজন শিরবেদের কাল চলে গেল, সে জানেন কালপুরুষ। সে কি, মনে রাখার সাধ্য মানুষের? তবে মূল শিরবেদে ছিল বিশ্বম্ভর। তার নামটাই মনে আছে বেদেদের, বলেআদিপুরুষ বিশ্বম্ভর। বেদেকুলে জন্ম নিয়েছিলেন স্বয়ং শিব।

নিজে বিষ খেয়ে বিশ্বম্ভর পৃথিবীকে দেন অমৃত। ঢুলুঢুলু করে তাঁর চোখ। শিরবেদে বিশ্বম্ভরের সঙ্গে তাঁর মিল অবিকল। এই বিশ্বম্ভরই জাতি কুল ঘর দুয়ার নিয়ে সাঁতালী গাঁয়ের পত্তন করেছিল। মায়ের অজ্ঞাতে আবার বিয়ে করেছিল বুড়া বয়সে। সন্তান হল, কালো মেঘে ঢাকা চাঁদের মত সন্তান। কিন্তু কই? কালনাগিনী যে বলেছিল, সে আসবে বেদেকুলে কন্যে হয়ে—সে এল কই? কন্যে না হয়ে এ যে হল পুত্তুসন্তান! শিরবেদে বিশ্বম্ভর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে; কিন্তু বেদেদের বিধাতা হাসলেন। বিশ্বম্ভরের ছেলে, বার বছর বয়স তখন, দেখে মনে হয় ষোল বছরের জোয়ান ছেলে। সাপ ধরে মাছের মত। গাছের উপর চড়ে তেড়ে ধরে বাঁদর। তেমনি তার ভেলকিবাজিতে হাত-সাফাই। তাকে পাশে নিয়ে শিরবেদ একদিন বসে ওই কথাই ভাবছে, এমন সময় এল কালো পাতলা এক তিন বছরের মেয়ে গামছা পরে ঘোমটা দিয়ে বউ সেজেছে; এসে দাঁড়াল সামনে, বিশ্বম্ভর হেসে বললে—কে গো? তুমি কাদের বউ? মেয়েটি পড়শীর মেয়ে, নাম দধিমুখী, সে ঘোমটা খুলে বিশ্বম্ভরের ছেলেকে দেখিয়ে বললে—উর বউ আমি। উকে বিয়ে করব; বিশ্বম্ভরের ভাবনা ভেসে গেল আনন্দের ঢেউয়ে। বললে—সেই ভাল। তুই হবি আমার বেটার বউ। বিশ্বম্ভরের যে কথা, সেই কাজ। ধুমধাম করে বিয়ে দিলে ছেলের। কিন্তু সাত দিন যেতে না যেতে নাগদংশনে মরল সে ছেলে। বিশ্বম্ভর চমকে উঠল। বেটার জন্যে কদল না, চোখ রাখলে দধিমুখীর উপর। ষোল বছর যখন ওই বিধবা কন্যটির বয়স হল, কন্যেটির মা-বাপে আবার বিয়ে দেবার উদ্যোগ করছে, তখন একদিন, এমনি বিষহরির পূজার দিনে শিরবেদে চিৎকার করে উঠল—জয় বিষহরি!

তার ঢুলুঢ়ুল চোখের দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছে ওই কন্যের কপালে নাগচক্র। তার মুখখানাকে দু হাতে ধরে একদৃষ্টে দেখে বলল। হঁ। হঁ। হঁ।

—কি?

–না-গ-চ-ক্ক।

–কই?

–কন্যের ললাটে।

বারবার ঘাড় নেড়ে বলে উঠেছিল—এইজন্যে এইজন্যে এই একে দিবে বলেই মা মোর বলি নিয়েছে কালাচাঁদকে।

তারপর চেঁচিয়ে উঠল—বাজা বাজা বাঁশি বাজা, বিষম-ঢাকি বাজা, চিমটে বাজা। ধূপ আর ধুনা আন, পিদিম আনু, দুধ আনু, কলা আন্, মা-বিষহরির বারি তো আটনে। আল্ছে আছে, যে বাক্ দিয়েছিল, সে আছে।

পাড়ায় তখন তিন ঘর বেদে। সে সেই প্রথম সাঁতালী পত্তনের কালের কথা।

তারপর কত শিরবেদের আমল গেল, সে ওদের মনে নাই। বলে—সে জানেন এক কালপুরুষ।

মনে আছে তিনজন শিরবেদের কথা।

* * *

শিবরাম কবিরাজ বলেন—মহাদেব শিরবেদেকে প্রথম দেখেছিলাম গুরু ধূর্জটি কবিরাজের সঙ্গে সাঁতালীতে গিয়ে। তারপর ওরা এল গুরুর আয়ুর্বেদভবনে। ওখানে ওরা আসত আশ্বিনের প্রথমে। গঙ্গার ঘাটে বেদেদের নৌকা এসে লাগত। ওদের রুখু কালো চুল, চিকন কালো দেহবর্ণ, গলায় মাদুলি—তার সঙ্গে পাথর জড়িবুটি, ওদের মেয়েদের বিচিত্র রূপ, ওদের গায়ের গন্ধ বলে দিত ওরা বিষবেদে। ওদের নৌকার গড়ন, নৌকায় বোঝাই সাপের ঝাঁপির থাক্‌, এক পাশে বাধা ছাগল, মইয়ের মাথায় খুঁটিতে বাঁধা বাঁদর–-এসব দেখলেই গঙ্গার তীরভূমির পথিকেরা থমকে দাঁড়াত। বলত–বেদে। বিষবেদের নৌকা।

ধূর্জটি কবিরাজ মহাশয়ের আয়ুর্বেদভবনে গম্ভীর গলায় জয় বিষহরি হাঁক দিয়ে এসে দাঁড়াত বেদেরা। সকলের আগে থাকত মহাদেব।

জয় বিষহরি হাঁক দিয়েই আবার হক দিতজয় বাবা ধন্বন্তরি। তারপরই হাতের বিষম ঢাকিতে টোকা মেরে শব্দ তুলত—ধুন-ধুন! তুমড়ি—বাঁশিতে ফুঁ দিত–পুঁ-উঁ-উঁ! পুঁ-উঁ-উঁ-উঁ! চিমটের কড়া বেজে উঠত ঝনাৎ-ঝন!

সৌম্যমূৰ্তি আচার্য বেরিয়ে এসে দাঁড়াতেন প্রসন্ন মুখে; স্মিতহাসি ফুটে উঠত অধরে, সমাদর করেই তিনি বলতেন—এসেছ!

হাত জোড় করে মহাদেব বলত–যজমানের ঘর, অন্নদাতার আঙুনে, প্রভু ধন্বন্তরি বাবার আটন, এখানে না এস্যা যাব কোথা? অন্ন দিবে কে? বাবা ধন্বন্তরি, আপনার পাথরের খল ছাড়া এ গরলই বা ফেলাব কোথা? একে সুধা করবে কে শোধন করে? জলে ফেলি তো জীবনাশ, মাটিতে ফেলি তো নরলোকের সব্বনাশ। আপুনি ছাড়া গতি কোথা, বলেন!

* * *

মহাদেব শিরবেদে যেন এক ঘন অরণ্যের ভিতরের অটুট একটা পাথরের দেউল। কোন্ পুরাকালে কোন সাধক তার ইষ্টদেবতার মন্দির গড়েছিল,–বড় বড় পাথরের চাইয়ে গড়া মন্দির, কারুকার্য নাই, পলস্তারা নাই, এবড়োখেবড়ো গড়ন–যুগযুগান্তরের বর্ষায় গায়ে। শ্যাওলা ধরেছে, তার উপর গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদ পড়ে শ্যাওলার সবুজে সাদা খড়ির দাগ পড়েছে, আরও পড়েছে গাছের পল্লব থেকে শুকনো পাতার গুঁড়ো—শুকনো ফুলের রেণু। বাতাসে বনের তলার ধুলো উড়িয়েও তাকে ধূলিধূসর করে তুলেছে। গলায় হাতে জড়িবুটি মালা দেখে মনে হয় যেন দেউলের গায়ে উঠেছে বুনো লতার জাল। মাথায় অ্যাঁকড়া চুল দেখে মনে হয়, দেউলটার মাথায় বর্ষায় যে ঘাস গজিয়েছিল–সেগুলো এখন শুকিয়ে শক্ত সাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শিবরাম ওকে প্রথম দেখেছিলেন–হিজল বিলের ধারে সাঁতালী গাঁয়ে গিয়ে। গুরুর সঙ্গে নৌকা করে গিয়েছিলেন বিষ কিনতে। দেখে এসেছিলেন ওদের গ্রাম, ওদের ঘর, মা-বিষহরির আটন, হিজলের বিল, ওদের নাগিনীকন্যা শবলাকে। শুনে এসেছিলেন ওদের ভাসান-গান, ওদের বাজনা। নাগিনী কন্যের দুলে দুলে পাক দিয়ে নাচন, বারি মাথায় করে ভরণ–দেখে এসেছিলেন। আর দেখে এসেছিলেন কত রকমের সাপ। কত চিত্ৰবিচিত্র দেহ, কত রকমের বর্ণ, কত রকমের মুখ! তুলতে পারেন নাই। বিশেষ করে ওই কালো কন্যে আর ওই খাড়া সোজা পাথরের দেউলের মত বৃদ্ধকে।

আবার হঠাৎ আশ্বিনের শেষে একদিন দেখলেন।

শিবরাম কিবরাজই এই কাহিনীর বক্তা। প্রাচীন সৌম্যদর্শন মানুষটি বলে যান এই কাহিনী। বিষবৈদ্যদের এ কাহিনী অমৃত-সমান নয়, বিষ-বেদনায় সকরুণ।

আশ্বিনের শেষ। শরতের শুভ্র রৌদ্র হেমন্ত-সমাগমে ঈষৎ পীতাভ হয়েছে। শিবরাম কবিরাজ বলে যান।

শহরে গুরুর ঔষধালয়ে রোগীর ভিড় জমেছে, বসে আছে সব! রাস্তার উপর গরুর গাড়ি, ড়ুলি-পালকির ভিড়, দূর-দূরান্তর থেকে রোগী এসেছে। ঘরের মধ্যে বসে গুরু চোখ বুজে একে একে নাড়ি পরীক্ষা করছেন, উপসর্গের কথা শুনছেন, ব্যবস্থা দিচ্ছেন, আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ বাইরে ঝনাৎ-ঝন ঝনাৎ-ঝন শব্দ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভারী গলায় কেউ বললে জয় মা-বিষহরি! পেন্নাম বাবা ধন্বন্তরি। তার কথা শেষ হতে না-হতে বেজে উঠল বিষম-ঢাকি ধুমধুম-ধুমধুম! তারই সঙ্গে বেজে উঠল একঘেয়ে সরু সুরে তুমড়ি-বাঁশি-পুঁ-উঁ-উঁ–উঁ-উঁ-উঁ!

গুরু বারেকের জন্যে চোখ খুলে বললে—মহাদেবের দল এসেছে, অপেক্ষা করতে বল।

বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, কাঁধে সাপের ঝাঁপির ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁতালী গাঁয়ের বেদের দল। তাদের সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খাড়া সোজা শক্ত পেশিবাধা-দেহ বুড়ো মহাদেব শিরবেদে। আর তার পাশে সেই আশ্চর্য কালো বেদের মেয়ে—শবলা। নাগিনী কন্যে। আশ্বিন মাসের সকালবেলার রোদ, বার মাসের মধ্যে উজ্জ্বল রোদ, দু-মাস বর্ষার ধারায় স্নান করে কিরণের অঙ্গে তখন যেন জ্যোতি ফোটে, সেই রোদের ছটা ওই কালো মেয়ের অঙ্গে পড়েছে—তার অঙ্গ থেকেও কালো ছটা ঝিলিক মারছে। শুধু মাথার চুল রুখু—সকালবেলার বাতাসে এলোমেলো হয়ে গোছা গোছা উড়ছে। পরনে তার টকটকে রাঙা শাড়ি, গাছকোমর বেঁধে পরা।

বললাম—বস নোমরা, কবিরাজ মশায় আসছেন।

মহাদেব বললে তুমারে চিনি-চিনি লাগছে যেন বাবা? কুথা দেখলম গ তুমাকে?

শবলা হেসে বললে—লজর তুর খাটো হছে বুড়া। মানুষ চিনতে দেরি লাগছে। উটি সেই বাবার সাথে আমাদের গাঁয়ে গেছিল, বাবার সাকরে বটে, কচি-ধন্বন্তরি।

শিবরাম বলেন—বেদের মেয়ের বাক্যে যত বিষ তত মধু, শবলা আমার নাম দিয়েছিল কচি-ধন্বন্তরি।

খিলখিল করে হেসে শবলা বলেছিল মহাদেবকে নামটি কেমন দিলম রে বুড়া? অ্যাঁ? মহাদেব রূঢ় হয়ে উঠল, বললে—হুঁ!

* * *

ভদ্রের শেষে শেষ নাগপঞ্চমীতে মা-বিষহরির পুজো শেষ করে ওদের সফর শুরু হয়। সাঁওতালেরা যেমন বসন্তকালে শালগাছে কচি পাতা বের হলে শিকারে বের হয়, সেকালে শরৎকালে বিজয়া দশমী দশেরা সেরে যেমন রাজারা দিগ্বিজয়ে বের হতেন, বণিকেরা যেমন বের হতেন ডিঙার বহর ভাসিয়ে বাণিজ্যে, আজও যেমন গাড়িবোঝাই করে ছোট দোকানিরা মেলা ফিরতে বের হয়, তেমনি বিষবেদেরাও বের হয়–তাদের কুল-ব্যবসায়ে। হাঙরমুখী, কুমিরখালা, হাঁসখালি বেয়ে সারি সারি বিষবেদেদের নৌকা এসে পড়ে মা-গঙ্গার জলে। নৌকাতে সাপের কাঁপি, রান্নার হাড়ি, খেলা-দেখাবার বদর-ছাগল আর মানুষ। শুধু বিষবেদেরাই নয়—অন্য অন্য যারা জাতবেদে তারাও বের হয়। কতক নৌকায়, কতক হাঁটাপথের কাঁধে। এই সফর ওদের কুলপ্রথা, জাতিধর্ম। বর্ষা গিয়েছে, কত পাহাড় বন ভাসিয়ে কত জল বয়ে গিয়ে পড়েছে সাগরে, কত দেশ ভেসেছে, কত দেশের কত সাপ, কত গাছ, কত গাছের বীজ, কত জন্তু, কত মানুষ ভেসেছে তার সঙ্গে, তার কতক বলি নিয়েছেন মহাসাগর, কতক ভেসে কূল নিয়েছে—ডাঙায় উঠেছে। গাছের বীজ আগামী বারের বর্ষার অপেক্ষা করে আছে, সেই বর্ষায় ফেটে অঙ্কুর হয়ে মাথা তুলবে। সাপ গর্তে বাসা নিয়েছে, সে অপেক্ষা করে আছে কবে কোন সাপিনীর অঙ্গের কাঁঠালীচাপার সুবাস পাবে। সাপিনী অপেক্ষা করে আছে—তার অঙ্গে বাস কবে বের হবে, সে সুবাসের আকর্ষণে আসবে কোন্ সাপ! সেই সব সাপ-সাপিনী মাঠে মাঠে বা নদী-নালার কূলের গর্তে গর্তে সন্ধান করে ধরতে বের হয়। দেশ-দেশান্তর ঘোরে, বাধা কবিরাজ মোয়দের ঘর আছে, সেইখানে গিয়ে তাদের চোখের সামনে কালনাগিনীর বিষ গেলে বিক্রি করে; গ্রামে গ্রামে গৃহস্থদের ঘরে ঘরে খেলা দেখায় সাপের নাচন, ছাগল-বদরের খেলা। দেখিয়ে দেখিয়ে চলে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম, এক জেলা থেকে আর এক জেলা-মাসের পর মাস কেটে যায়, তারপর একদিন আবার ঘরের দিকে ফেরে। বিষবেদেরা চলে নৌকায়—জলে জলে, গঙ্গা থেকে ঢেকে অন্য নদীতে, চলে আসে। কলকাতা শহর পর্যন্ত, সেখানে সাহেবান লোকের নতুন শহর গড়ে উঠেছে, বড় বড় আমীর বাস। করে, অনেক কবিরাজও আছেন। সেখানেও বিষ বিক্রি করে, তারপর শীত বেশ গাঢ় হয়ে পড়তেই ফেরে। গাঙের জল কমে আসছে, হিজল বিলের ধারে জল শুকিয়ে পাক জেগেছে। চারিপাশে এর পর কুমিরখালায় হাঙরমুখীতে জল মরে শুকিয়ে আসবে, তখন আর নৌকা নিয়ে সাঁতালী গাঁয়ের ঘাটে গিয়ে ওঠা যাবে না। তার ওপর শীতে নাগ-নাগিনী কাতর হয়েছে, জর-জর হয়েছে হিমেল দেহখানি, চোখ হয়েছে ঘোলা, মাথা তোলার শক্তি নাই, আর শিস মেরে মাথা তুলে নাচতে পারে না। খোঁচা দিলে অল্প ফোঁস শব্দ করে একটু পাক খেয়ে নিথর হয়ে যায়। বিষবেদের মন কাতর হয়—মা-বিষহরির সন্তান, তাদের মেরে ফেলতে ওরা চায়। না, ওরা তাদের ছেড়ে দেয় নদীর নির্জন কূলে, অথবা পতিত প্রান্তরে, বনে কিংবা জঙ্গলে। বলে দেয়—স্বস্থানে যা। মা তোকে রক্ষে করুন। সাপদের মুক্তি দিয়ে খালি ঝাঁপি নিয়ে শহরে বাজারে কিনে-কেটে ফেরে সাঁতালীতে। শুধু তো খালে-বিলে জলই শুকায় নাই, গাঙের চরে, বিলের চারিপাশে কাশবনে ঘাস পেকেছে। সেই ঘাস কাটতে হবে, শুকুতে হবে, ঘরগুলি ছাইতে হবে কাশ দিয়ে। তা ছাড়া, হিজলের চারিপাশে এতদিনে চাষীরা এসে গিয়েছে। লাঙল দিয়ে চষে বুনে দিয়েছে গম যব ছোলা মসুর মটর সরষে। সবুজ হয়ে উঠেছে চারিধার। হিজলের চারিপাশে বার মাসই সবুজ, কিন্তু এ সুবজ যেন আলাদা সবুজ। এ সবুজে শুধু রঙ নাই, রঙে রসে একাকার। ফসল তোলার সময় ফসল কুড়িয়ে ওরা ঘরে তুলবে। তা ছাড়া, মাঘ মাস থেকে পড়বে সব সাদি-সাঙার হিড়িক। সাঁতালীতে ছ মাস জল, ছ মাস স্থল। স্থল না জাগলে সাদিসাঙা হয় কি করে? তা ছাড়া, ঝাঁকে ঝাঁকে এসেছে হাজার হাঁস। তারা আকাশে উড়ছে আর ডাকছে–প্যাঁক-প্যাক-কাও-ক্যাও—কিচ কিচক-কল্‌-কল্‌-কল্।

তারা ওদের ডাক পাঠায়।

শীতের শুরুতে নায়ের মাথায় বুনো হাঁস পাক খেয়ে ডাক মেরে গেলেই শিরবেদের হুকুম হয়—ঘুরায়ে দে লায়ের মুখ। চল্ সাঁতালী। সাঁতালী!

নাগপঞ্চমীতে সাঁতালী থেকে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মহাদেবের দল এসে লা বেঁধেছে। শহরে। প্রথমেই ধন্বন্তরি বাবার বাড়িতে বিষ না দিয়ে ওরা আর কোনোখানে বিষ বেচে না। ধূর্জটি কবিরাজের খ্যাতি তার প্রধান কারণ তো বটেই, কিন্তু আরও কারণ আছে। বাবার মত আদর ওদের কেউ করে না। বাবার মত সাপ চিনতে ওস্তাদ ওদের চোখে পড়ে নাই।

লা—অর্থাৎ নৌকাগুলি বেঁধেছে শহরের প্রান্তে। গঙ্গার কূলে বেশ একটি পরিষ্কার পতিত জায়গা, তার উপর গুটি তিনেক বড় বড় গাছ। সেই গাছগুলির শিকড় কূলের ভাঙনের মধ্যে আঁকাবাঁকা হয়ে বেরিয়ে আছে, তাতেই বেঁধেছে নৌকার দড়ি। বটগাছের তলাগুলি যথাসাধ্য পরিষ্কার করে নিয়ে পেতেছে গৃহস্থালি। ডালে ঝুলিয়েছে শিকে-তাতে রয়েছে রান্নার হাড়ি। তার পাশেই শিকেতে ঝুলছে সাপের কাঁপি; তলায় পেতেছে উনান, তার পাশে খেজুরের চাটাই বিছিয়ে দিয়েছে, ঘাসের উপর শুকাচ্ছে ভিজে কাপড়, শিকড়ে বেঁধেছে ছাগল আর বাঁদর। বাচ্চারা ধুলোয় হামা দিয়ে বেড়াচ্ছে নগ্নদেহে, নাকে পেঁটা গড়িয়ে এসেছে—মুঠোবন্দি মাটি নিয়ে খাচ্ছে, মুখে মাখছে। অপেক্ষাকৃত বড়রা গায়ে ধুলো মেখে ছুটে বেড়াচ্ছে; তার চেয়ে বড়রা শুকনো কাঠ-কুটা কুড়িয়ে ঘুরছে—কেউবা গাছের ডালে উঠে দোল খাচ্ছে। সবল বেদেরা বেরিয়েছে তাদের পসরা নিয়ে। সঙ্গে তাদের যুবতী বেদিনীর দল।

ধূর্জটি কবিরাজ এসে দাঁড়ালেন। হাস্যপ্রসন্ন মুখে স্নেহস্মিতকণ্ঠে সমাদর জানিয়ে বললেন এসেছ মহাদেব!

হাত জোড় করে মহাদেব বললে—এলম বাবা। যজমানের ঘর, অন্নদাতার আঙন, ধন্বন্তরির আটন, হেথাকে না এস্যা যাব কুথাকে বাবা? বিষবেদের সম্বল বাবা, লাগের বিষ মানুষের রক্তে এক ফোটা লাগলে মিত্যু; হলাহল—গরল, এ বস্তু এক শিব ধারণ করেছেন গলায়, আর ধারণ করতে পারে বাবা ধন্বন্তরির পাথরের খল। আপনকার খল ছাড়া এ ফেলব কুথা গো? জলে ফেললেজলের জীব মরে, থলে ফেললে নরলোকের হয় সৰ্ব্বনাশ! এক আপুনিই তো পারেন এরে শোধন করে সুধা করতে।

এগুলি পুরুষানুক্রমিক বাধা বুলি ওদের।

কবিরাজের উদ্দেশে সকলেই মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেপেনাম বাবা।

কবিরাজ হেসে সকলেরই কুশল জিজ্ঞাসা করেন।

তারপর প্রশ্ন করেন–মায়ী শবলা, তুই এত চুপচাপ কেন রে বেটি?

দাঁত বের করে তিক্তস্বরে মহাদেব কুটিল হয়ে উঠল একমুহূর্তে, বললে—তাই শুধান বাবা, তাই শুধান। আমারে কয় কি জানেন? কয়—বুড়া হছিস, তুর লজর গেছে। কানে খাটো হছি, চেঁচায়ে গোল না করলে চুপচাপ ভাবিস; ভাবান্তর দেখিস। লাগিনী জরেছে বাবা, খোলস ছাড়বে।

কালনাগিনী চকিতের জন্য যেমন ফণা তোলে তেমনিভাবেই শবলাও একবার সোজা হয়ে উঠল। মনে হল, ছোবল মারার, মত বুড়াকে আক্রমণ করে কিছু বলবে; কিন্তু পরক্ষণেই একটু হেসে শান্ত হয়ে মাথা নামালে, বললে—বাবা গো, লাগিনী যখন শিশু থাকে, তখন কিলবিল কর্যা ঘুরে বেড়ায়; ঘাসের বনে বাতাস বইলে পর, তা শুনেও হিস কর্যা ফণা তুলে দাঁড়ায়। বয়স বাড়ে বাবা, পিথিমীর সব বুঝতে পারে, সাবধান হয়। মানুষ দেখলি, জন্তু দেখলি সি তখন ফোঁস করা মাথা তুলে না বাবা চুপিসাড়ে পলায়ে যেতে চায়। নেহাত দায়ে পড়লি পর তবে ফণা তুলে বাবা। তখন আক্কেল হয় যি, মানুষ সামানি লয়। মানুষকে কামড়ালি পরে লাগের বিষে মানুষ মরে, কিন্তু মানুষ তারে ছাড়ে না, লাঠির ঘায়ে মারে; মারতে না পারলি বেদে ডাকে। বেদে তারে বন্দি করে, বিষৰ্দাত ভাঙেনাচায়। সে মরণের বাড়া। তার উপর বেদের হাতের জ্বালা বড় জ্বালা বাবা! তাই বোধ হছে বাবাবেদের ঝাঁপির লাগিনী, অঙ্গের জ্বালায় জরেছি; ওই হল মরণ-জরা।

শবলা হাসলে। কথাগুলির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ ছিল যেমন, তেমনি ছিল আরও কিছু। বুঝতে ঠিক পারলাম না, শুধু অ্যাঁচ পেলাম।—শিবরাম বললেন। গুরু রোগী দেখেন যেমন করে তেমনি করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শবলার মুখের দিকে। তারপর বললেন—শবলা বেটি আমার সাক্ষাৎ নাগিনী কন্যা।

মহাদেব বলে উঠল–হঁ বাবা। গর্তের মধ্যি থাকে, খোঁচা খেলে ফেঁসায় না, পথের পাশে লুকায়ে থাকে, মানুষ তো মানুষ, বেদের বাপের সাধ্য নাই যে ঠাওর করে। ফাঁক খোঁজে কখন দংশাবে, রাগ চেপে রোষ চেপে পড়ে পড়ে ফাঁক খোঁজে।

তার পাকা দাড়ি-গোঁফের মধ্যে থেকে আবার বের হল দুপাটি বড় বড় দাত; হাসলে মহাদেবকে ভয়ঙ্কর দেখায়;—বয়সের জন্য বড় বড় দাঁতগুলি মাড়ি থেকে ঠেলে উঠে আরও বড়। দেখায়, লাল-কালো ছোপ-ধরা বড় বড় দাত; তার মধ্যে দু-তিনটে না থাকার জন্য ভয়ঙ্কর দেখায় বেশি।

–হঁ রে বুড়া ঘঁ। সব অপরাধ লাগিনীর। সে তো জনমদোষিনী রে! মানুষের আয়ু ফুরায়ে। যায়, নেয়তের লিখন থাকে, যম লাগিনীরে কয়—তুর বিষে মরণ দিলাম মিশায়ে, যা তু উরে ডংশায় আয়; লাগিনী যমের কেনাদাসী; আজ্ঞে লঙ্ন করতে পারে, ডংশায়, মানুষটা মরে, অপরাধ হয় লাগিনীর। পথে ঘাটে বনে বাদাড়ে হতভাগিনীরা ঘুরে বেড়ায়, মানুষ মাথায় দেয়। পা, পুচ্ছে দেয় পা, লাগিনী কখনও রাগের বশে, কখনও পরানের দায়ে, কখনও পরানের ডরে তারে ডংশায়। অপরাধ হয় লাগিনীর!

হাসলে শবলা, সেই বিচিত্ৰ হাসি, যে হাসি সে এর আগেও একবার হেসেছিল। তারপরে বললে—লে লে বুড়া, কথার প্যাচ গুয়ে বাবারে সাপগুলান দেখা। বাবার অনেক কাজ। তুর আমার খেল, এ আর উনি কি দেখবেন? তু আমারে খোঁচা দিলে আমি তুরে ছোবল মারব, দাঁত ভাঙবি, ফের গজাবে সে দাঁত। কুনোদিন যদি তুর অঙ্গে বিধে, আর নিয়ত যদি লিখে থাকে যি—ওই বিষেই তুর মরণ হবে, তবে তু মরবি। লয় তো মুই মরব তুর হাতের পিরশের জ্বালায়, তুর লাঠির খোঁচায়, তুর জড়িবুটির গন্ধে। লে, এখন সাপগুলান দেখা, বিষ গেলে দে, দিয়া চল্ ফিরে চন্।

ধূর্জটি কবিরাজ বললেন—সেই ভাল। তুমি শিরবেদে, তুমি বাপ শবলা নাগিনী কন্যে, তোমার বেটি, বাপ-বেটির ঝগড়া তোমাদের মিটিয়ে নিয়ো।

সাপের বিষ গেলে নেওয়া দেখেছ?

আজকাল বিজ্ঞানের যুগে নানা কৌশল হয়েছে। কাচের নলের মধ্যে বিষ গেলে জমা করা। হয়, চমৎকার সে কৌশল। কিন্তু বেদেদের সেই আদি কাল থেকে এক কৌশল। তার আর অদলবদল হয় না। বদলের কথা বললে হাসে।

তালের পাতা আর ঝিনুকের খোলা। যে ঝিনুক পুকুরে মেলে সেই ঝিনুক। তালের পাতা ধনুকের ছিলার মত ঝিনুকের গায়ে টান করে বেঁধে ধরে একজন, আর একজন সাপের চোয়াল টিপে হাঁ করিয়ে ধরে। ঝিনুকটা দেয় মুখের মধ্যে পুরে, বিষদাঁত দুটি বিঁধে যায় ওই তালপাতার বাঁধনে। তালপ তার ধারালো করকরে প্রান্তভাগের চাপ পড়ে বিষের থলিতে, ওদিকে বিষদাঁত বিঁধে থাকার স্বাভাবিক ক্রিয়ায় পাঁতের নালী বেয়ে বিষ টপটপ করে পড়ে ওই ঝিনুকের খোলায়। এমনই কৌশল ওদের যে বিষের শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত ঝরে পড়বে। তারপর সাপটা যায় ঝাপিতে, ঝিনুকের বিষ যায় সরষের তেলে ভরা কবিরাজের পাত্রে। জলের উপর তেলের মত, তেলের উপর বিষ ছড়িয়ে পড়ে ভাসে। না হলে বাতাসের সংস্পর্শে জমে যায় বাবা।

শিবরাম গল্প বলে যান—আমার সম্মুখেই আমাদের বিষ নেওয়ার পাত্র। বেদের দলের সামনে বসে মহাদেব, তার পাশে বাঁ-দিকে শবলা—শিরবেদে আর নাগিনী কন্যা, পিছনে বেদেরা। বেদেরা হাঁড়ি এগিয়ে দেয়—মহাদেব হাঁড়ির মুখের সরা খুলে সাপ বের করে। জেলেরা যেমন মাছ ধরে, সে ধরা তেমনিভাবে ধরা বাবা। এক হাতে মাথা, এক হাতে লেজ ধরে প্রথমটা গুরুকে দেখাচ্ছিল, গুরু লক্ষণ দেখে সাপ চিনে নিচ্ছিলেন। কালো রঙ হলেই হয়। না, কালো সাপের মধ্যেই কত জাত। কালো সাপের গায়ের দিকে চাইলে দেখতে পাবে, তার। মধ্যে সুচের ডগায় আঁকা বিন্দুর মত সাদা ফুটকি। ফণার নিচে গলায় কারও বা একটি, কারও বা দুটি, কারও বা তিনটি মালার মত সাদা-কালো বেড়। কারও বা মধ্যের দাগটি চাপা ফুলের। রঙ। ফণায় চক্ৰচিহ্ন, তাও কত রকমের। কারও চক্র শঙ্খের মত, কারও বা পদ্মের কুঁড়ির মত, কারও বা মাথায় ঠিক একটি চরণচিহ্ন। কারও কালো রঙ একটু ফিকে, কারও রঙের উপর রোদের ছটা পড়লে অন্য একটা রঙ ঝিলিক দেয়।

গুরু বলেছিলেন-কালনাগিনী হবে শুধু কালো। সুকেশী মেয়ের তৈলাক্ত বেণির মত কালো মাথায় থাকবে নিখুঁত চরণ-চিহ্নটি। বাকি যা দেখ বাবাও সব হল বর্ণ সঙ্কর। কালনাগিনীর নাগ নাই, শঙ্খনাগ সন্ততি দিয়েছে, তার মাথায় শঙ্খচিহ্ন; পদ্মনাগ দিয়েছে পদ্মকলি চিহ্ন আপন আপন কুলের ছাপ রেখে গেছে বাবা। ওই ছাপ যেখানে দেখবে সেখানে বুঝবে, ওর স্বভাবে ওর বিষেসবেই আছে পিতৃকুলের ধারা। সাবধান হবে বাবা। এদের বিয়ে ঠিক কাজ হয় না।

থাক, ওসব কথা থাক। ওসব আমাদের জাতিবিদ্যার কথা।

এক টিপ নস্য নিয়ে নাক মুখে শিবরাম বলেন—মহাদেবের ধূর্জটি কবিরাজকে না-জানা। নয়, তবু ওর জাতি-স্বভাবগত বোলচাল দিতে ছাড়লে না। এক-একটি সাপ ধরে তাঁর সামনে দেখাতে লাগল।

এই দেখেন বাবা! গড়নটা দেখেন আর বরনটা দেখেন। চিকচিকে কালো। এই দেখেন চক্কটি দেখেন। লেজটি দেখেন।

উঁহুঁ। ওটা চলবে না মহাদেব। ওটা রাখ।

–কেনে বাবা? ই তো খাঁটি জাত।

–না ওটা রাখ তুমি।

শবলা বলছিলরা বুড়া রাখ। ইখানে তু জাতিস্বভাবটা ছাড়। কারে কি বুলছিস?

মহাদেব রাখলে সে সাপ, কিন্তু অগ্নিদৃষ্টি হেনে শবলাকে বললে—তু থাম্।

শবলা হাসলে।

ধূর্জটি কবিরাজ দেখেশুনে বেছে দিলেন পাঁচটি কালো সাপ; মহাদেব এবার বসলসে সাপের মুখ ধরবে, আর তালপাতার বেড় দেওয়া ঝিনুক মুখে পরিয়ে ধরবে নাগিনী কন্যা শবলা।

ঈষৎ বাঁকা সাদা দাঁত দুটির দিকে তাকিয়ে শিবরাম যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। ওই বাঁকা ওই এতটুকু একটি কাটার মত দাঁত, ওর প্রান্তভাগে ওই ক্ষুদ্র এক তরল বিন্দু, ওর কোথায়। রয়েছে মৃত্যু? কিন্তু আছে, ওরই মধ্যে সে আছে, এতে সন্দেহ নাই। সাপের চোখে পলক নাই, পলকহীন দৃষ্টিতে তার সম্মোহনী আছে; সাপের চোখে চোখ রেখে মানুষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা শিবরাম শুনেছেন, কিন্তু ওই বিষবিন্দুঝরা দাঁতের দিকে চেয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কথা তিনি শুনেন নাই। তবু তিনি যেন পঙ্গু হয়েই গেলেন।

ধূর্জটি কবিরাজ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন—সেবার তোমাদের গ্রামে যখন গিয়েছিলাম, তখন শবলা মায়ী যে সাপটি দিয়েছিল মহাদেব, সে জাত কিন্তু আর পেলাম না।

মহাদেব হাসলে। তিক্ত এবং কঠিন সে হাসি। নাকের ডগাটা ফুলে উঠল; হাসিতে ঠোঁট দুটি বিস্কুরিত হল না, ধনুকের মত বেঁকে গেল। তারপর বললে—ধন্বন্তরি বাবার তো অজানা কিছুই নাই গ! কি বলব বলেন?

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে শবলার দিকে মুহূর্তের জন্য ফিরে তাকালে। তাকিয়ে বললেই জাতটার নেকনের ফল, রীতিচরিতের দোষ। এই এর মতি দেখেন কেনে! সে আঙুল দিয়ে দেখালে শবলাকে।

সঙ্গে সঙ্গে গুরুর শঙ্কিত সতর্ক কণ্ঠস্বরে শিবরাম চমকে উঠলেন, সাপের দাঁত দেখে মোহে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন, সে মোহ তার ছুটে গেল।

ধূর্জটি কবিরাজ শঙ্কিত সতর্ক কণ্ঠস্বরে ঘেঁকে উঠলেন-হাঁ শবলা!

শবলা হাসলে, হেসে উত্তর দিলে—দেখছি বাবা। হাত মুই সরায়ে নিইছি ঠিক সময়ে।

ধূর্জটি কবিরাজ বললেন সাবধান হও বাবা মহাদেব। কি হত বল তো?

সত্যই কি হত ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলেন শিবরাম। সর্বনাশ হয়ে যেত। মহাদেব দুই আঙুলে টিপে ধরেছিল সাপটার চোয়াল, ঝিনুক ধরেছিল শবলা। উত্তেজিত হয়ে মহাদেব শবলার দিকে চোখ ফিরিয়ে মুক্ত হাতটির আঙুল দিয়ে শবলাকে যে মুহূর্তে দেখাতে গিয়েছে, সেই মুহূর্তে তার সাপ-ধরা হাতটি ঈষৎ বেঁকে গিয়েছে, সাপটার মাথা হেলে পড়েছে, তালপাতায় বেঁধা একটা পাত তালপাতা থেকে খুলে গিয়েছে। শবলা যদি মহাদেবের কথায় বা আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রতিক্রিয়ায় মুহূর্তের জন্য চঞ্চল হয়ে চকিতের জন্যও চোখ তুলত, তাকাত মহাদেবের দিকে, তবে ঐ বক্র তীক্ষ্ণ দাতটি সেই মুহূর্তেই বসে যেত শবলার আঙুলে।

ধূর্জটি কবিরাজ তিরস্কারের সুরেই বললেন–সাবধানে বাবা মহাদেব। কি হত বল তো?

অবজ্ঞার হাসি হাসলে মহাদেব।–কি আর হত বাবা?

সুরে সুর মিলিয়ে শবলা বললে–তা বৈকি বাবা! কি আর হত বলেন। নিজের বিষেই জরে মরত নাগিনী। নরদেহের যন্ত্রণা থেকে খালাস পেত।

খিলখিল করে হেসে উঠল বিচিত্র বেদের মেয়ে। সে হাসিতে ব্যঙ্গ যেন শতধারে ঝরে পড়ল।

মহাদেবের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠল। এর পর নীরবে অতি সতর্কতার সঙ্গে চলতে লাগল। বিষ-গালার কাজ।

বিষ-গালা শেষ হল। শবলা বললে—বাবাঠাকুরের ছামুতে তু মিটায়ে দে যার যা পাওনা। বাবা, আপুনি দেন গ হিসাব করে।

মহাদেব কঠিন দৃষ্টিতে তাকালে শবলার দিকে।—কেনে?

—কেনে আবার কি? বাবা হিসাব করে দেবেন এক কলমে, মুখে মুখে হিসাব করতে তুদের সারাদিন কেটে যাবে। কি গ, বল না কেনে তুরা? মুখে যে সব মাটি লেপে দিলি! অ্যাঁ?

একজন বেদে বললে–হ্যাঁ, তা, হ্যাঁ সেই তো ভাল। না, কি গ? সকলের মুখের দিকে চাইলে সে।

হ্যাঁ। হ্যাঁ।—সকলেই বললে। কেউ বা মুখ ফুটে বললে, কেউ সম্মতি জানালে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ হ্যাঁ।

* * * *

শিবরাম চমকে উঠলেন, একটি সুরেলা মিষ্টি গলার বিচিত্র মধুর ডাক শুনেকচি-ধন্বন্তরি! জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন শিবরাম, এ সেই বেদের মেয়েটি। বেলা তখন তৃতীয় প্রহরে শেষ পাদ। ছাত্রদের প্রায় তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত যায় বৈদ্যভবনের কাজে; তারপর খানিকটা বিশ্রাম। রোগীরা চলে যায়, বৈদ্যভবনের দুয়ারগুলি বন্ধ হয়, ছাত্রেরা আহার করে, স্নানের নিয়ম প্রাতঃস্নান-ওটা হয়ে থাকে, গুরুর বিশ্রাম তখনও হয় না, তাকে বের হতে হয় সম্পন্ন ব্যক্তিদের বাড়ি রোগী দেখতে অনেক ক্ষেত্রে যে সব রোগীকে নাড়াচাড়া করা চলে না সে সব বাড়িতেও যেতে হয়—এমনি সময় তখন। আঙিনাটা জনশূন্য, গুরু বেরিয়েছেন, তখনও ফেরেন নি; সঙ্গে গিয়েছে অন্য শিষ্য, শিবরামের সেদিন বিশ্রাম। এক দিকের কোণের একটা ছোট ঘরে শুয়ে আছেন, পাশে খোলা পড়ে আছে একখানা বিষশাস্ত্রের পুঁথি। বেদেরা যাওয়ার পর ওই পুঁথিখানাই। বের করে খুলে বসেছিলেন। কিন্তু সে পড়তে ভাল লাগছিল না। ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে ভাবছিলেন বোধহয় ওই বেদেদের কথাই, ওই আশ্চর্য কৌশল, ওই অদ্ভুত সাহস, ওদের বিচিত্ৰ দ্ৰব্যগুণবিদ্যা আর সর্বাপেক্ষা রহস্যময় মন্ত্রবিদ্যা শিখবার একটা আগ্রহ নেশার মত আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

* * * *

বিষের দাম মিটিয়ে যখন নেয় বেদেরা তখন শিবরাম মহাদেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন। যার যা প্রাপ্য হিসেব করে নিচ্ছিল বেদেরা, মহাদেব নিশৃহের মত বসে ছিল একদিকে। শিবরাম তাকে ডেকে বলেছিলেন—আমায় শেখাবে? কিছু বিদ্যা দেবে? আমি দক্ষিণা দোব।

মহাদেব বলেছিল–দক্ষিণা দিবে তো বুঝলাম। কিন্তুক বিদ্যা কি একদিন দুদিনে শিখা যায়? বলেন না আপুনি?

—তা যায় না। তবে কতকগুলো জিনিস তো শেখা যায় দু-একবার দেখে। তা ছাড়া, তোমরা বলবে আমি লিখে নেব। আমি তো সাপ ধরা শিখতে চাই না, আমি সাপ চিনতে চাই। লক্ষণ পড়েছি আমাদের শাস্ত্রে, সেই লক্ষণ মিলিয়ে সাপ দেখিয়ে চিনিয়ে দেবে। জড়ি শিকড় চিনিয়ে দেবে, নাম বলে দেবে। আমি লিখে নেব।

—কি দিবা বল দক্ষিণা?

–কি চাও বল?

–পাঁচ কুড়ি টাকা দিবা। আর ষোল আনা মা-বিষহরির প্রণামী।

অর্থাৎ এক শো এক টাকা।

এক শো এক টাকা কোথায় পাবেন ছাত্র শিবরাম? গুরুগৃহে বাস, গুরুর অন্নে দিনযাপন। প্রায় পুরাকালের শিক্ষাব্যবস্থার ধারা।

শেষে বলেছিলেন–পাঁচটি টাকা আমি দেব, বিদ্যা শেখাতে হবে না, সাপ চিনিয়ে দিয়ে।

রাজি হয়েছিল মহাদেব। বলেছিল—শহরের হুই দক্ষিণে এক্কেরে সিধা চলি যাবা গাঙের কূলে কূলে। আধকোশ-টাক গিয়া পাবা আমবাগান, আর গাঙের কূলে তিনটা বটগাছ। দেখবা, বেদেদের লা বাধা রইছে; সেই পাড়ের উপর আমাদের আস্তানা।

* * * *

শিবরাম সেই কথাগুলিই ভাবছিলেন।

হঠাৎ কানে এল এই সুরেলা উচ্চারণে মিহি গলার ডাক–কচি-ধন্বন্তরি!

জানালার ওপাশে সেই বিচিত্র বেদের মেয়ের মুখ।

ঠোঁটে একমুখ হাসি, চোখে চঞ্চল তারায় সস্মিত আহ্বান—সে তাকেই ডাকছে।

শিবরাম বললেন—আমাকে বলছ?

–হাঁ গ। তুমাকে ছাড়া আর কাকে? তুমি ধন্বন্তরিও বট, কচিও বট। তাই তো কইলাম কচি-ধন্বন্তরি! শুন।

—কি?

–বাইরে এস গ। আমি বাইরে রইলাম দাঁড়ায়ে–তুমি ঘর থেক্যা কইছ–কি? কেমন তুমি?

অপ্রতিভ হয়ে বাইরে এলেন শিবরাম।

–ধন্বন্তরি বাবা কই? এবার তার চোখে তীব্ৰ দীপ্তি ফুটে উঠল।

–গুরু তো ডাকে বেরিয়েছেন।

–ঘরে নাই?

–না।

মেয়েটা গুম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার পর উঠে পড়ল, বললে–চললাম। চলে গেল। কিছুক্ষণ পরই ফিরল ধূর্জটি কবিরাজের পালকি। পালকির সঙ্গে ফিরল শবলা। পথে দেখা হয়েছে।

কবিরাজ পালকি থেকে নেমে বললেনকি? মহাদেবের সঙ্গে বনছে না? সেই মীমাংসা করতে হবে?

—না বাবা। যা দেবতার অসাধ্য, তার লেগে মুই বাবার কাছে আসি নাই।

–তবে?

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শবলা। কোনো কথা বললে না। কোনো একটা কথা বলতে যেন সে পারছে না।

—বল, আমার এখনও আহার হয়নি বেটি।

শবলা বলে উঠল—হেই মা গ! তবে এখুন না। সে এখুন থাক্। আপুনি গিয়া সেবা করেন। বাবা। হেই মা গ!

বলে প্রায় ছুটেই চলে গেল।

–শবলা! শোন। বলে যা।

–না না। তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সে ছুটে পালাচ্ছে।

বিচিত্র মেয়ে। কেনই বা এসেছিল, কেনই বা এমন করে ছুটে চলে গেল শিবরাম বুঝতে পারলেন না। ধূর্জটি কবিরাজ একটু হাসলেন। বিষণ্ণ সস্নেহ হাসি। তারপর চলে গেলেন। ভিতরে। এই তৃতীয় প্রহরে আবার তিনি স্নান করবেন, তারপর আহার।

পরের দিন কিন্তু ধন্বন্তরি ধূর্জটি কবিরাজের কাছে শবলা আর এল না। না এলেও শিবরামের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।

গুরু তাকে পাঠিয়েছিলেন এক রোগীর বাড়ি। ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ির রোগী। তরুণ গৃহস্বামীর দুর্ভাগিনী পিতামহীর অসুখ। দুর্ভাগিনী বৃদ্ধা স্বামীপুত্র হারিয়ে পৌত্রের আমলে সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত। বড় ঘরে, বড় খাটে পড়ে আছেন, চাকরে টানাপাখাও টানে, কিন্তু এক কন্যা ছাড়া কেউ দেখে না। মৃত্যুরোগ নয়, যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধি, তারই ওষুধ দিয়ে পাঠালেন শিবরামকে, ওষুধগুলি অন্তঃপুরে গিয়ে বৃদ্ধার কন্যার হাতে দিয়ে সেবন-বিধি বুঝিয়ে দিয়ে আসতে। নইলে ওষুধ হয়ত বাইরেই পড়ে থাকবে। অথবা এ চাকর দেবে তার হাতে, সে দেবে। এক ঝিয়ের হাতে, ঝি কখন একসময় গিয়ে কোন কুলুঙ্গিতে রেখে চলে আসবে। বলেও আসবে না যে, ওষুধ রইল। সমস্ত বুঝেই কবিরাজ অনুপানগুলি পর্যন্ত সংগ্রহ করে শিবরামকে পাঠালেন।

এই বাড়ির অন্তঃপুরের উঠানে সেদিন শিবরাম দেখলেন শবলাকে।

শবলা! কিন্তু এ কি সেই শবলা? এ যেন আর একজন। হাতে তার দড়িতে বাধা দুটো বাঁদর আর একটা ছাগল। কাঁধে ঝুলিতে সাপের ঝাপি। চোখে চকিত চপল দৃষ্টি। অঙ্গের হিল্লোলে, কথার সুরে, কৌতুক-রসিকতা যেন ঢেউ খেলে চলেছে।

এটা ওদের আর একটা ব্যবসা।

নদীর কূলে নৌকা বেঁধে পাড়ের উপর আস্তানা ফেলে মেয়েরা বেরিয়ে পড়ে। সাপ বদর ছাগল ড়ুগড়ুগি বিষম-ঢাকি নিয়ে অন্দরের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ডাক দেয়—বেদেনীর খেলা দ্যাখেন গ মা বাড়ির গিনি, রাজার রানী, স্বামী-সোহাগী, সোনা-কপালী চাঁদের মা। কালনাগিনীর দোলন নাচন হীরেমনের খেল—

বিচিত্র সুর, খাজে খাজে সুরেলা টানে ওঠে-নামে। বাড়ির মেয়েরা এ সুর চেনে, ছুটে এসে দরজায় দাঁড়ায়। বেদের মেয়ে এসেছে। আশ্চর্য কালো মেয়ে। আশ্চর্য ভাষা। আশ্চর্য ভূষা!

—বেদেনী এসেছিস! ওরে, সব আয় রে! বেদেনী—বেদেনী এসেছে।

–হ্যাঁ গ মা-লক্ষ্মী, বেদেনী আছে। অর্থাৎ এসেছে। বেদেনী আছে মা, পোড়ারমুখী আছে তুমাদের দুয়ারের কাঙালিনী আছে, সব্বনাশী-মায়াবিনী আছে খেল্ দেখাতে, ভিখ মাঙতে, দুয়ারে এস্যা হাত পেতে দাঁড়াছে।

মেয়েরা হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে। না এসে পারে না। এই কালো মেয়েগুলি রহস্যময়ী মেয়ে, ওরা সত্যিই বোধহয় জাদু জানে। কথায় জাদু আছে, খেলায় জাদু আছে, হাসিতে জাদু আছে। কোনো কোনো গিন্নি বলেন-ঢের হয়েছে, আজ যা এখন। সব্বনাশীরা কাজ পণ্ড করার যাশু; হাতের কাজ পড়ে আছে আমাদের। পালা বলছি।

ওরা খিলখিল করে হাসে। বলে—তা মাজনুনী, সোনামুখী, তুমি বলেছ ঠিক। বেদেনী দুয়ারে এস্যা হাঁক দিলি পর হাতের কাজ মাটি। বেদেনী মায়াবিনী গ—আমাদের মন্তর রইছে। যে ঠাকরুণ! এখুন বিদায় কর আপদেরে, জয় জয় দিতি দিতি মুই পথ ধরি; তোমাদের ঘেঁড়া কাজ আবার জোড়া লাগুক; ভাণ্ডার ভরা উঠুক; মা-বিষহরি কল্যেণ করেন, নীলকণ্ঠের আশীর্বাদে তুমার ঘরের সকল বিষ হর্যা যাক। জয় মা-বিষহরি, জয় বাবা নীলকণ্ঠ, জয় আমার গিন্নিমা, এই ঝুলি পাতলাম, দাও ভিখ দাও, বিদায় কর।

দাবি ওদের কিন্তু সামান্য নয়। দাবি অনেক।

বড় একটা বিষধরকে গলায় জড়িয়ে তার মুখটা হাতে ধরে মুখের সামনে এনে বলে শিগগিরি বেনারসী শাড়ি আনেন ঠাকরণ-বরের সাথে বেদেনীর শুভদৃষ্টি হবে। আনেন ঠাকরণ, আনেন, মাথার পরে ঢেকা দ্যান, ত্বরিৎ করেন, বর মোর গলায় পাক দিচ্ছে। কাপড় না পেলে বেদেনী সাপের পাকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে যাবার ভান করে। এ ভানের কথা লোকে জানে; কিন্তু এত ভয়ঙ্কর এ ভান যে, ভান বুঝেও চোখে দেখতে পারে না।

কখনও পোশ বদরটাকে বলে হীরেমন, ধৰ্ব মা-গিনির চরণে ধর। বল, ওই পরনের শাড়িখানা ছেড়া দ্যান, লইলি পর চরণ ছাড়ব নাই।

বাঁদরটা এমন কথা বুঝতে পারে যে, ঠিক এসে গিন্নির পা দুখানি দু িহাত দিয়ে জড়িয়ে বসে পড়ে। গিনি শিউরে ওঠেন ছাড় ছাড়। বেদেনী হাসে, বলে কিছু করবে নাই মা, কিছু করবে নাই। তবে কাপড়খানি না পেলে ও ছাড়বে না। মুই কি করব বলেন? ই আজ্ঞে ওস্তাদের আজ্ঞে।

দর্শক পুরুষ হলে তো কথাই নাই।

বাঁদর নাচাতে নাচাতে, সাপ নাচাতে নাচাতে গানের সঙ্গেই তার অফুরন্ত দাবি জানিয়ে যায়–

যেমন বাবুর চাঁদো মুখ
তেমনি বিদায় পাব গ।
বেনারসীর শাড়ি পর‍্যা
লেচে লেচে যাব গ!
প্রভু রাঙা হাত ঝাড়িলে
আমার পাহাড় হয় গ!
মাথায় নিয়া সোনার পাহাড়
দিব প্রভুর জয় গ!

মেয়েদের মজলিসে বেদের মেয়ের শুধু বাক্যের মোহ সম্বল; পুরুষদের মহলে বাক্যের। মোহের সঙ্গে তার দৃষ্টি এবং হিল্লোলিত দেহও মোহ বিস্তার করে। সাপের নাচ বাঁদরের খেলা দেখিয়ে সব শেষে সে বলে—এই বারে প্রভু বেদেনীর লাচন দেখেন। লাগিনী লেচেছে হেলে দুলে, এই বারে লাচবে দেখেন বেদের কন্যে। বলতে বলতেই কথা হয়ে ওঠে সুরেলা, টানা সুরে ছড়ার মতই বলে যায়—লা-লা লো মায়াবিনী, লাচ দিকিনি, হেলে দুলে পাকে পাকে; বেউলা সতীর যে লাচ দেখে ভুলেছিল বুড়া শিবের মন। আবার সুরেলা ছড়া কাটা বন্ধ করে বলে যায়—শিবের আজ্ঞায় বিষহরি ফির্যায়ে দিছিল সতীর মরা পতিকে, সেই আচ লাচবি। বাবুদের রাঙা মন ভুলায়ে ভিক্ষার ঝুলিতে ভরে লিবি, গরবিনী সাজবি। বাবুর হাতের আংটি লিবি, নয়তো লিবি সোনার মোহর—তবে ফির্যা দিবি সেই রাঙা মন।

কথা শেষ করেই গান ধরে, নাচ শুরু করে। এক হাত থাকে মাথার উপর, এক হাত রাখে কঁকালে, পা দুটি জোড় করে সাপের পাকের মত পাকে পাকে দুলিয়ে নাচে, সে পাক পা থেকে। ঠিক যেন সাপের পাকের মতই দেহের উপর দিয়ে উঠে যায়।

উরর হায় হায়, লাজে মরি,
আমার মরণ ক্যানে হয় না হরি!
আমার পতির মরণ সাপের বিষে
আমার মরণ কিসে গ!
মদন-পোড়া চিতের ছাইয়ের
কে দেবে হায় দিশে গ!
অঙ্গে মেখে সেই পোড়া ছাই।
ধৈর্য মুই ধরি গ ধৈর্য মুই ধরি—উর্‌র্‌, হায় গ!

বেহুলা-পালার গান এটি। ওদের নিজস্ব পালাওদের কোনো পদকর্তা অর্থাৎ বিষবেদে কবি রচনা করেছে। ওরাই গায়। এ গান গাইবার সময় বেহুলার মত চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসার কথা; বেহুলা যখন দেবসভায় মৃত লখিন্দরকে স্মরণ করে নেচেছিল, তখন চোখের জলে তার বুক ভেসেছিল। কিন্তু মায়াবিনী বেদের কন্যে যখন গান গেয়ে নাচে, তখন তার চোখ থেকে জলের ধারা নামে না, ওদের সরু অথচ লম্বা চোখ ও ভুরু দুটি কটাক্ষভঙ্গির টানে বেঁকে। হয়ে ওঠে গুণ-টানা ধনুকের মত। লাস্যের তূণীর খালি করে সম্মোহন বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করে স্থানটার আকাশবাতাস যেন আচ্ছন্ন করে দেয়। দর্শকেরা সত্যই সম্মোহনে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

বুড়ো শিব বেহুলা সতীর নৃত্য দেখে মোহিত হয়ে কন্যা বিষহরিকে আজ্ঞা দিয়েছিলেন লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে; বেদের কন্যে বাবুদের মোহিত করে বিদায় চায়, টাকা চায়, টাকা চায় দু হাত ভরে।

ধনীর বাড়িতে বারান্দায় বসে ছিলেন তরুণ গৃহস্বামী আর তার সঙ্গীরা। সামনে বাগানে নাচছিল শবলা। অন্দর থেকে ফিরে শিবরাম থমকে দাঁড়ালেন।

গৃহস্বামী তাকে দেখেও দেখলেন না। দেখবার তখন অবকাশ ছিল না তার। বেদের মেয়েও তার দিকে ফিরে তাকাল না। তারই বা অবকাশ কোথায়? দেবসভায় অপ্সরাত্যের কথা শিবরামের মনে পড়ে গেল। দেবতারাও মোহগ্ৰস্ত, নৃত্যপরা অন্সরা নৃত্যলাস্যে মোহবিস্তার করতে গিয়ে নিজেও হয়েছে মোহগ্রস্ত। শবলার চোখেও নেশার ছটা লেগেছে। সে রূপবান তরুণ গৃহস্বামীর কাছে হাত পেতেছে, বলছে—মুই বেদের কন্যে, কালনাগিনীর পারা কালো অ্যাঁধার, রাঙা। হাত মুই কোথাকে পাব? কিন্তুক লাজ নাই বেদেনীর, লাজের মাথা খেয়ে তবে তো দেখাতে পেরেছি। লাচন। তাই বাবু মোর সোনার লখিন্দর, বাবুর ছামনে পাতলাম কালো অ্যাঁধার হাত।

হেসে বাবু বললেন—কি চাই ব?

–দাও, রাঙাবরন শাড়ি দাও; দেখ, কি কাপড় পরে রইছি দেখ!

সঙ্গে সঙ্গে হুকুম হয়ে গেল। নতুন লালরঙের শাড়ি এখুনি এনে দাও দোকান থেকে। জলদি।

লোক ছুটল সঙ্গে সঙ্গে।

—আর একটা টাকা দাও একে।

বেদেনী বলে উঠল—উই উই, টাকা কি লিব? টাকা লিব না মুই। সোনা লিব-তুমার সোনার বরন অঙ্গে কত সোনা রইছে, দুই হাতে অতগুলান অঙ্গুরি, গলায় হার, হাতে তাগা–ওরই এক টুকরা লিবে কালামুখী কালোবরনী কালনাগিনী বেদের কন্যে!

দুটো চোখ থেমে মুহুর্মুহুঃ কটাক্ষ হানছিল সে।

তরুণ গৃহস্বামী তৎক্ষণাৎ হাত থেকে একটি আংটি খুলে বললেন–নে।

এবার বেদেনী খিলখিল করে হেসে উঠে খানিকটা পিছিয়ে গেল।–ইরে বাবা রে!

–কি? কি হল?

শবলা হেসে বলে–ই বাবা গ! সব্বনাশ সব্বনাশ! উ লিলি পর আমার পরান যাবে, আপনার মান্যি যাবে। বেদে বুড়া দেখলি পর টুঁটি টিপে ধরবে, লয় তো বুকে বিন্ধে দিবে লোহার শলা। আর গিন্নিমা দেখলি পর মোর মাথায় মারবেন ঝাঁটা। আপনার খালি আঙ্গুল দেখ্যা গোসা করা ঘরে গিয়া খিল দিবেন, কি চলা যাবেন বাপের ঘর।

হেসে তরুণ গৃহস্বামী আংটিটা আবার আঙুলে পরলেন, বললেন—তবে চাইলি কেন?

—দেখলাম আমার সোনার লখিন্দরের কালনাগিনীর পরে ভালবাসাটা টি, না মেকি!

–কি দেখলি?

-খাঁটি, খাঁটি। হঠাৎ মুখে কাপড় দিয়ে হেসে উঠল, বললেখাঁটিই হয় গো সোনার লখিন্দর। তাতেই তো লাগের বিষে মরে না লখিন্দর লাগিনীর বিষে মরে।

ঠিক এই সময়েই বাজার থেকে লোক ফিরে এল লালরঙের চন্দ্রকোণা শাড়ি নিয়ে। টকটকে লালঙের শাড়ি, তারও চেয়ে গাঢ় লালরঙের পাড়। চকচক করে উঠল বেদেনীর চোখ।

কাপড়খানা গায়ে জড়িয়ে নতুন কাপড়ের গন্ধ নাকে শুকে সে বললে—আঃ!

–পছন্দ হয়েছে?

–হবে না? চাঁদের পারা বদন তুমার, তুমার দেওয়া জিনিস কি অপছন্দ হয়? এখন–বিদায় কর।

—আর কি চাই বল? আংটি চাইলি, দিতে গেলাম, নিলি নে।

—দাও। যখুন দিবার তরে মন উঠেছে, পোড়াকপালী বেদের বেটির কপাল ফিরেছে, তখুন দাও, আংটির দাম পাঁচটা টাকা দিবার হুকুম কর। তুমি হাত ঝাড়লে আমাদের তাই পব্বত। দিয়া দাও পাঁচটি টাকা।

তাও হুকুম হল দিতে।

পাওনা নিয়েই ছুটতে শুরু করলে সে। বেদের মেয়েটার চলন কি দ্রুত! মাঠের মধ্যে সাপের পিছনে তাড়া করে সাপের নাগাল নেয়,বেদের মেয়েদের চলনই খর, বলনও খর, চাওনিও খর। শবলা আবার তাদের মধ্যে অদ্বিতীয়া, বিচিত্র মেয়েদের মধ্যে ও আবার আরও বিচিত্র।

বাবু হাঁকলেন—দাঁড়া দাঁড়া। এই বেদেনী, এই!

দাঁড়াল শবলা। এরই মধ্যে সে অনেকটা চলে গেছে। ফিরে পাঁড়িয়ে অতি মধুর এবং অতি চতুর হাসি হাসলে সে। বললে—আজ আর লয় সোনার লখিন্দর, উই তাকায়ে দ্যাখেন পছিম আকাশ বাগে—বেলা হিলে গেছে, সুয্যি দেবতার লালি ধরেছে; সঁঝ আসছে নেমে। যাব সেই কত পথ। শিয়াল ডাকবার আগে ঘরকে যেতে না পারলি ঘরে লিবে না, জাতে ঠেলবে। বলেই হেসে সুর করে বলে—

শিয়াল ডাকিলি পরে, বেদেরা না লিবে ঘরে
অভাগিনীর যাবে জাতিকুল।

তারপর ছড়া ছেড়ে সহজ করে বললে—বেশ চুপিচুপি বলার ভঙ্গিতে–তুমি জান না সোনার লখিন্দর, তুমি বেদের কন্যেরে জান না। বেদের কন্যের লাজ নাই শরম নাই, বেদের কন্যের ধরম নাই, বেদের কন্যের ঘরের মায়া নাই; বেদের কন্যে বেদিনী অবিশ্বাসিনী। রীতচরিত তার আগের কন্যে লাগিনীর মতন। রাত লাগলি, অ্যাঁধার নামলি চোখে নেশা লাগে, বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে, লাগিনীর মতন সনসনিয়ে চলে, ফণা তুলে লাচে। সে লাচন যে দেখে সে সংসার ভুলে যায়।

চোখ দুটো তার ঝকঝক করে উঠল একবার।

বললে–সে পাঁচন তুমাকে দেখাবার উপায় নাই সোনার লখিন্দর।

তারপর সে আবার ছুটল। সত্য সত্যই সে ছুটতে শুরু করল। ওদিকে সূর্য প্রায় দিগন্তের কোলে নেমেছে, রঙ তার লাল হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হতে খুব দেরি নাই। শবলা মিথ্যে বলে নাই, শিবরাম জানেন, শুনেছেন, ওই যেবার গিয়েছিলেন হিজল বিলের ধারে সাতালী গায়ে, সেবারই শুনে এসেছিলেন, সন্ধ্যার শিবারবের পর যে বেদের মেয়ে গাঁয়ের বা আস্তানার বাইরে রইল, তার আর ঘরে প্রবেশাধিকার রইল না। অন্তত সে রাত্রির মত রইল না। পরের দিন সকালে তাকে সাক্ষীসাবুদ নিয়ে শিরবেদের সম্মুখে এসে দাঁড়াতে হবে, প্রমাণ করতে হবে–সে সন্ধের সময় পর্যন্ত কোনোমতেই ঘর পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পারে নাই এবং সন্ধের সময়েই সে আশ্রয় নিয়েছিল কোনো সৎগৃহস্থের ঘরে, কোনো অপরাধে সে অপরাধিনী নয়। তবে সে পায় ঘরে ঢুকতে। প্রমাণে এতটুকু খুঁত বের হলে দিতে হয় জরিমানা। এর উপর খেতে হয়। বেদের প্রহার।

শবলা নাগিনী কন্যা, পাঁচ বছর আগে নিজের স্বামীকে খেয়ে প্রায় চিরকুমারী, কিন্তু আস্তানায় বা ঘরে তার প্রতীক্ষায় বসে থাকে স্বয়ং শিরবেদে। নাগিনী কন্যাকে যদি স্পর্শ করে ব্যভিচারের অপরাধ, তবে গোটা বেদে-সমাজের মুখে কালি পড়বে, মা-বিষহরি তার হাতে পূজা নেবেন না। পরকালে পিতৃ-পুরুষদের অধোগতি হবে। সন্ধ্যার শিবাধ্বনি কানে ঢুকবামাত্র। শিরবেদে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে মা-বিষহরির নাম নিয়ে প্রণাম করবে।জয় মাবিষহরি, জয় মা-মনসা!

কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করেই হাঁকবে–কন্যে!

হাঁ গ, সন্ঝার প্রদীপ জ্বালছি গ।–উত্তর দিতে হবে নাগিনী কন্যাকে।

ছুটে চলল শবলা।

গঙ্গার ঘাটের দিকে চলল, তারপর সেখান থেকে গঙ্গার কুলের পথ ধরে তাকে হাঁটতে হবে। অনেকটা। তার আকর্ষণে ছাগলটা এবং বদর দুটোও ছুটছে।

দর্শকদের সঙ্গে শিবরামও দাঁড়িয়ে রইলেন তার দিকে চেয়ে। মেয়েটার ছুটে চলাও বিচিত্র, সজাগ হয়েই ছুটে চলেছে বোধহয় মেয়েটা। দর্শকেরা যে তার পিছনে তারই দিকে চেয়ে রয়েছে, একথা সে মুহূর্তের জন্যও ভুলছে না। ছুটে চলার মধ্যেও তার তন্বী দেহের হিল্লোল অটুট। রেখে ছুটে চলেছে। নাচতে নাচতেই যেন ছুটেছে মেয়েটা।

শিবরামের মনে হল মেয়েটার মুখে হাসির রেশ ফুটে রয়েছে। সে নিশ্চয় করে জানে যে, দর্শকেরা মোহগ্ৰস্তের মত এখনও তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

দেখতে দেখতে গঙ্গার কূলের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল বেদের মেয়ে।

* * * *

পরের দিন সকালেই মহাদেব এসে দাঁড়াল ধূর্জটি কবিরাজের উঠানে। চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি, কাঁধে সাপের বাঁক নাই, হাতে ডমরুর মত আকারের বাদ্যযন্ত্রটা নাই, তুমড়ি বাঁশিও নাই; হাতে শুধু লোহার ডাণ্ডাটাই আছে।

-বাবা!

তখনও প্রায় ভোরবেলা। ধূর্জটি কবিরাজ চিরটাকাল রাত্রির শেষ প্রহরে শয্যাত্যাগ করে প্ৰাতঃকৃত্য সেরে স্নান করতেন ঠিক উদয়-মুহূর্তে। সূর্যোদয় না হলে দিবাগণনা হয় না বলেই অপেক্ষা করে থাকতেন—স্তবপাঠ ইত্যাদি করতেন। দিনের দেবতার উদয় হলেই গঙ্গাস্নান করে ফিরে পূজায় বসতেন। কবিরাজ সবে স্নান সেরে বাড়ি ঢুকছেন, ওদিক থেকে ব্যস্ত হয়ে এসে উপস্থিত হল মহাদেব।

—কি মহাদেব? এই ভোরে?

তার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে দেখে বললেন—এই ভাবে? কি ব্যাপার?

শহরে এসে মধ্যে মধ্যে ওরা মহামারীতে আক্রান্ত হয়। নগদ পয়সা হাতে পেয়ে শহরের খাদ্য-অখাদ্য খায় আকণ্ঠ পুরে। দিনে দুপুরে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। তৃষ্ণা পায়, সে তৃষ্ণা মেটাতে যে-কোনো স্থানের জল গ্রহণে ওদের দ্বিধা নাই, সুতরাং মহামারী আর আশ্চর্য কি?

মহাদেব বললে—বিপদ হল বাবা, ছুটে এলম! হেতা তুমি ছাড়া আমাদের আর কে রয়েছে। কও?

—কি হল?

–একটা ছোঁড়া মরিছে কাল রাতে!

–মরেছে? কি হয়েছিল?

–কি হবে বাবা? বেদের মিত্যু লাগের মুখে। সপ্যাঘাত হইছে।

–সর্পাঘাত?

–হাঁ বাবা। সাক্ষাৎ কাল। এক আকামা রাজগোখুরা। কি করে ঝাঁপি খুলল, কে জানে? ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে পেলে ছোঁড়াকে ছামুতে, ছোঁড়া পিছা ফিরা বসে ছিল—পিঠের উপর মাথা ঠুকে দিলেক ছোবল। এক্কেরে এক খামচ মাস তুলে নিলে। কিছুতে কিছু হয় নাই—দণ্ড দুইয়ের ভিতর শ্যাষ হয়ে গেল। এখুন বাবা ইটা হল শহর বাজার ঠাঁই, অপঘাত মিত্যুর নাকি তদন্ত হবে থানাতে। আপনি একটা চিরকুট লিখে দাও বাবা দারোগাকে।

—বস।

হাত জোড় করে মহাদেব বললে—অভয় পাই তো একটি কথা বলি বাবা ধন্বন্তরি।

—বল।

–চিরকুট লিখ্য এই বাবাঠাকুরের হাত দিয়া ইয়ারে মোর সাথে দাও। দারোগার সাথে কথা কি বলতি কি বুলব বাবা–

সুরে ভঙ্গিমায় অসমাপ্ত থেকে গেল মহাদেবের কথা বলতে পারলে না-হয়ত জানে না বাক্যের রীতি, অথবা সাহস করলে না অনুরোধ পুনরাবৃত্তি করতে।

আচার্য ভাবছিলেন। ভাবছিলেন আয়ুর্বেদ-ভবনের সুবিধা-অসুবিধার কথা, শিষ্যের অসুবিধার কথাও মনে হচ্ছিল।

হাত জোড় করে মহাদেব বললে—বাবা, কাল নিয়ে খেলা করি, মরি বাঁচি ডর করি না, কিন্তুক থানা-পুলিশ যমের বাড়া, উরা বাবা সাক্ষাৎ বাঘ। দেখলি পরেই পরানটা চাছাড়া হয়্যা যায় গ।

এবার হেসে ফেললেন ধূর্জটি কবিরাজ। শিবরামের দিকে তাকিয়ে বললেন—তোমার হয়ত একটু কষ্ট হবে শিবরাম, তবে এদের জন্য কষ্ট করলে পুণ্য আছে, তুমি যাও একবার। দারোগাকে আমার নাম করে বোলো—অযথা কোনো কষ্ট যেন না দেন! তুমি না গেলে হয়ত হয়রানির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করবে। বুঝেছ?

শিবরাম উঠলেন। বললেন–আমি যাচ্ছি।

জোয়ান বেদের ছেলে। মৃতদেহটা দেখে মনে হচ্ছিল, কালো কষ্টিপাথরে গড়া একটা মূৰ্তি, সুন্দর সবল চেহারা। শুইয়ে রেখেছিল বেদেদের আস্তানার ঠিক মাঝখানে। মাথার শিয়রে কাঁদছিল তার মা। চারিদিকে আপন আপন আস্তানায় বেদেরা যেন অসাড় হয়ে বসে আছে। ছোট ছোট ছেলেগুলো শুধু দল বেঁধে চঞ্চল হবার চেষ্টা করছে; কিন্তু তাও ঠিক পেরে উঠছে না চঞ্চল হতে, বড় মানুষদের স্তম্ভিত ভাবের প্রভাব তাদেরও যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

শবলা দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের ডাল ধরে; যেন ডালটা অবলম্বন করে তবে দাঁড়াতে পেরেছে। অদ্ভূত চেহারা হয়েছে চঞ্চলা চপলা মেয়েটার। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওই মরা মানুষটার দিকে; কিন্তু তাকে সে দেখছে না, মনের ভিতরটা যেন বাইরে এসে ওই মরা মানুষটার উপরে শবাসনে বসে আছে। চোখের উপরে ভ্র দুটির মাঝখানে দুটি রেখা স্পষ্ট দাঁড়িয়ে উঠেছে।

দারোগা-পুলিশের তদন্ত অল্পেই মিটে গেল।

কি-ই বা আছে তদন্তের! সাপের ওঝার মৃত্যু সাধারণত সাপের বিষেই হয়ে থাকে। কাল নিয়ে খেলা করতে গেলে দশ দিন খেলোয়াড়ের, একদিন কালের। তার উপর বিখ্যাত ধূর্জটি কবিরাজের অনুরোধ নিয়ে তাঁর শিষ্য শিবরাম উপস্থিত। নইলে এমন ক্ষেত্রে অল্পস্বল্পও কিছু আদায় করে পুলিশ। দারোগা শব-সৎকারের অনুমতি দিয়ে চলে গেলেন।

মহাদেব দেখালে সমস্ত। সাপটা দেখালে। প্ৰকাণ্ড একটা দুধে-গোখুরো। সাদা রঙের গোখুরো খুব বিরল। কদাচিৎ পাওয়া যায়। বেদেরা বলে-রাজার ভিটে ছাড়া দুধে-গোখুরো বাস করে না। রাজবংশের ভাগ্যপ্রতিষ্ঠা যখন হয়, বংশের লক্ষ্মী যখন রাজলক্ষ্মীর মর্যাদা পান, তখনই হয় ওর আবির্ভাব। লক্ষ্মীর মাথার উপর ছত্র ধরে সে-ই তাকে দেয় ওই গৌরব। তারপর রাজবংশের ভাগ্য ভাঙে, বংশ শেষ হয়ে যায়, রাজপুরী ভেঙে পড়ে, লক্ষ্মী অন্তৰ্হিতা হন, চলে যান স্বস্থানে—একেই রেখে যান ভাঙা পুরী পাহারা দেবার জন্যে। ভাঙা পুরীর খিলানে খিলানে, ফাটলে ফাটলে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়ায়। অনধিকারী মন্দ অভিপ্ৰায়ে এই ভাঙা পুরীতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে দণ্ড ধরে অর্থাৎ ফণা তুলে দাঁড়ায়। মন্দ অভিপ্ৰায় না থাকলে তুমি যাও, ও সাড়া দেবে না; তুমি ঘুরেফিরে দেখবেও তোমাকে দেখবে, নিজের অস্তিত্ব জানতে দেবে না, পাছে তুমি ভয় পাও। তুমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে হয়ত বড়জোর ও-ও নিশ্বাস ফেলবে। হঠাৎ যদি তোমার প্রবেশমুখে ও বাইরেই থাকে, চোখে পড়ে তোমার, তবে তৎক্ষণাৎ ও দ্রুতবেগে চলে যাবে কোন অন্ধকারে, লুকিয়ে পড়বে। মুখে ওর ভাষা নাই, ভাষা থাকলে শুনতে পেতে ও বলছে—ভয় নাইভয় নাই। এস, দেখ।

–মালদহে দেখেছিলাম বাবা। মহাদেব বললে তখন মুই ভর্তি জোয়ান। মোর বাপ শঙ্কর শিরবেদে বেঁচ্যা। অরণ্যে-ভরা ভাঙা ভগ্ন পুরী, ঘুরা ঘুর্যা দেখছি। আর বিধাতারে বুলছি—হায় বিধেতা, হায় রে! এ কি তোর খেলা! এই গড়াই বা ক্যানে—আর গড়লি তবে ভাঙাই বা ক্যানে! ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, এই এত বড় রাজবাড়ি, কুথা আছে ইয়ার তোষাখানা? সিখানে কি সোনা-দানা-হীরে-মানিকের কিছুই নাই পড়ে? কি বুলব বাবা, মাথার উপর উঠল। গর্জন—ফেঁ-ফো-ফেঁ। শুন্যা পরানটা উড়ে গেল। এক্কেরে মাথার উপরে যে, ফিরে তাকাবার সময় নাই। শিরে হৈলে সপ্যাঘাত, তাগা বাঁধব কুথা! তবে বেদের বেটা-ভয় তো করি না। বুদ্ধি করে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লাম ঝপ করে। তা বাদে মাথা তুলে উপর বাগে তাকালাম। দেখি, খিলানের ফাটল থেক্য এই হাত খানেক দেহখানা বার করে দণ্ড ধরে গরজাইছে। এই কুলার মতন ফণা, এই সোনার বরন চক্ক, দুধের মতন দেহের রঙ। মরি মরি মরি! কি বলব বাবা, মন মোহিত হয়ে গেল। বেদের কুলে জন্ম নিছি, হিজল বিলের ধারে সাতালী গাঁয়ে বাস পাতালে লাগলোকে যত লাগ, সাঁতালীর ঘাসবনে গাছের কোটরেও তত লাগ। কিন্তু এমনটি তো দেখি নাই। মনটা নেচ্যা উঠল বাবা। ভাবলাম, ইয়ারে যদি ধরতে না পারি তো কিসের বেদে মুই? খানিক পিছিয়ে এলম, দাঁড়ালম বাবা খুঁট লিয়ে। আয়, তু আয়। মনে মনে ডাকলাম মা-বিষহরিকে, ডাকলাম কালনাগিনী বেটিকে। হাকতে লাগলাম মন্তর। সেও থির, মুইও থির। কে জেতে, কে হারে! ভাবলাম, ফস বানায়ে মারব ছুঁড়ে শেষ পর্যন্ত। পিছন থেকে মোর বাপ হাঁক দিলেক খবরদার! মুখ ফিরাবার জো নাই বাবা, আমি ফিরাব চোখ তো উ মারবে ছোবল, উ নামাবে মাথা তো মুই দেব ছো। মুখ না ফিরায়ে মুই বাপকে কইলাম—এস তুমি আগায়ে এস; মুই ঠিক আছি। ধর তুমি। বাপ কইলনা, পিছায়ে আয় পায়ে পায়ে। উনি হলেন রাজগোখুর, এ পুরীর আগলদার সাক্ষাৎ কাল। ওরে ধরে কেউ বাঁচে না। পিছায়ে আয়। বাপের হুকুম শিরবেদের আদেশ বাবা, দুপা পিছায়ে গেলম। সেও খানিক দেহ গুটায়ে ঢুকায়ে নিলে, ফণাটা খানিক ছোট হল। বাবা কইলে—সব্বনাশ করেছিলি। ওরে ধরতে নাই। বেদের বেটা, ধরতে হয়ত পারবি, কিন্তুক মুখে রক্ত উঠ্যা মরে যাবিনয়ত যেতে হবে ওই ওর বিষে। তা উনি এমুন দণ্ড ধরে দাঁড়ালেন ক্যানে? ওরে তেড়েছিলি? না, মনে মনে পাপ ভাবনা ভেবেছিলি? গুপ্তধন খুঁজতে গিয়েছিলি? বললম—কি করে জানলা গ? বাবা কইল বৃত্তান্ত। কইল-পাপ বাসনা মুছে ফেল্ ভুলে যা। দেবতারে পেনাম করা আস্তানায় চ। নইলে নিস্তার পাবি নাই। মনের বাসনা মনে ড়ুবালম, মুছে দিলম। বুললম–দেবতা, তুমি ক্ষমা কর। বাস্। বাবা, নিমিখ। ফেলতে দেখি, আর নাই তিনি। ঢুকে গেছেন। ফিরে এলম। তার পরে গিয়েছি বাবা সেই ভিটেতে, মনে মনে বলেছি–ক্ষমা কর দেবতা, কোনো বাসনা নিয়ে আসি নাই, এসেছি দেখতে, নয়ন সাথক করতে। আর কোনোদিন দেখা পাই নাই।

নিজের গল্প শেষ করে মহাদেব বললে কাল, বাবা, দেখি, ই ছোঁড়া ধরে এনেছে সেই এক রাজগোক্ষুর, সাক্ষাৎ কাল। বাবা শিবের বরন হল দুধের মতন, তার অঙ্গের পরশ ছাড়া ই বরন উ পাবে কুথা? বেদের ছেলে, ই কথা না-জানা লয়, মুই কতবার ই কাহিনী বুলেছি। জানে। ভালমতে। কিন্তু ওর নেয়ত। ওর রীতচরিতটা খারাপ ছিল—এমুনি হবে মুই জানতম। জোয়ান বয়স কার না হয় বাবা! ই ঘোড়ার জোয়ান বয়স হল—যেন সাপের পাঁচ পা দেখলে। রক্তের তেজে ধরাখানা হল সরা। যত কিছু মানা আছে বেদের কুলে—তাই করতে ছিল উয়ার ঝোঁক। লইলে বাবা

হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল মহাদেবের মুখ, কণ্ঠস্বরে বেজে উঠল যেন বিষম-ঢাকির সুর, সে প্রায় গর্জন করে উঠল, ফেটে পড়ল, সে বললে লইলে বাবা, লাগিনী কন্যে বেদের কুলের কন্যেলক্ষ্মী, তার দিকে দিষ্টি পড়ে বাবা?

–এই উয়ার নিয়ত। এই উয়ার নিয়ত। মাথা ঝুঁকি দিয়ে উঠল মহাদেব, কাঁকড়া চুল দুলে উঠল। পাপ কথা উচ্চারণ করে সম্ভাবত প্ৰায়শ্চিত্তের জন্য দেবতার নাম স্মরণ করলে সে—জয় বাবা মহাদেব, জয় মা-বিষহরি, জয়-চণ্ডী, ক্ষমা কর মা, ক্ষমা কর।

সমস্ত স্থানটা থমথম করছিল। গঙ্গার ওপারের তটভূমিতে তখনও শোনা যাচ্ছিল মহাদেবের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। আর উঠছিল গঙ্গার স্রোতের কুলকুল শব্দ এবং উত্তর বাতাসে অশ্বত্থ ও বটগাছের পাতায় মৃদু সরসর ধ্বনি, মধ্যে মধ্যে দুটো-একটা পাতা ঝরে ঘুরতে ঘুরতে মাটির উপর এসে পড়ছিল। বেদেদের সকলে স্তব্ধ, ছেলেগুলো পর্যন্ত ভয় পেয়ে চুপ করে গিয়েছে, সভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহাদেবের ক্রুদ্ধ মুখের দিকে। শবলা শুধু একবার ফিরে তাকালে মহাদেবের দিকে, তারপর আবার যেমন স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।

মহাদেব মনের আবেগে বলেই যাচ্ছিল, বলে কথা যেন শেষ করতে পারছে না। সে আবার বললে—আমি জানতম। আমি জানতম। এমন হবে আমি জানতম। কন্যে চান করে বিলের ঘাটে, ছোটা লুকায়ে দেখে। আমি সাবধান করে দিছি, ফুলের মুঠা ধরে মারছি, তবু উয়ার লালস মিটল না। আর ওই কন্যেটা! ওই যে লাগিনীর জাত, উ একদিন, বাবা, কন্যের রূপ ধরে চলেছিল গোটা বেদের জাতটারে। জনমে জনমে উ ছলনা করে বাবা। ঘোড়ার নেয়ত! ছোঁড়া কাল গেছিল হুই মা-গঙ্গার হুই পাড়েভাঙা লালবাড়ির জঙ্গলের দিকে। সেখানে ছিলেন এই দেবতা। এসে বুললে শবলারে। শবলা বুললে—বেদের বেটা লাগ দেখ্যা ছেড়া দিয়া এলিকি রকম বেদের বেটা তু? যা, ধ্যা নিয়ে আয়। জোয়ান বেদের বেটা, তার উপর শবলা বুলেছে, আর রক্ষা আছে বাবা! নিয়া এল ধরে, আমি দেখলম, দেখ্যা শিউরে উঠলম। বললম—ছেড়া। দে, লইলে মরবি। কিছুতে রাজি হয় না; শ্যাষ কেড়ে নিলম বাবা। সঁঝ হয়ে গেছিল, কাঁপিতে ভর্যা রেখে দিলম, ভাবলমকাল সকালে ছেড়া দিয়া আসব স্বস্থানে। কিন্তুক ওর নেয়ত, আমি কি করব, বলেন? রাতের বেলা ঝাঁপি ঠেল্যা বেরিয়েছে সাক্ষাৎ কাল; ইদিকে ছোঁড়া গাঙের ধারে গিয়া বস্যা কি করছিল কে জানে? পিছা থেকে সাপটা গিয়া এক্কেরে পিঠের মেরুদণ্ডের পরে দিছে ছোবল। ছোঁড়া ঘুরা দেখে কাল। বেদের বেটা, হাতে ছিল লোহার ডাণ্ডা, সেও দিলেক পিটায়ে। দুটাতেই মরল।

প্রকাণ্ড দুধে-গোখুরাটার নির্জীব দেহটা খানিকটা দূরে একটা ঝুড়ির নিচে ঢাকা ছিল। পাছে কাক চিল বা অন্য কোনো মৃতমাংসলোভী পাখি ওটাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে, সেই ভয়েই ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ঝুড়িটা তুলে মহাদেব বললে—দেখেন, নিজের পাপে নিজে মরেছে ছেড়া, আবার মরণের কালে ই কি পাপ করে গেল, দেখেনঃ কি দেবতার মতন দেহ দেখেন। কি সোনার ছাতার মত চক্ক দেখেন! ই পাপ অৰ্ণাবে বেদে-গুষ্টির উপর।

এতক্ষণে কথা বললে শবলা, শবদেহটার উপর থেকে দৃষ্টি তার ফিরে আবদ্ধ হয়েছিল মহাদেবের উপর। কখন যে ফিরেছিল কেউ লক্ষ্য করে নাই। উত্তেজিত মহাদেবের কথা শুনে লোকে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল, তারপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে ছিল সাপটার উপর! সত্যই সাপটার দেহবৰ্ণ অপরূপ, এমন দুধের মত সাদা গোখুরা সাপ দেখা যায় না। এরই মধ্যে শবলা কখন দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকিয়েছিল মহাদেবের দিকে। সে বলে উঠল-ই পাপ অৰ্ণাবে তুকে। বেদে-গুষ্টির পাপ ইতে নাই। পাপ তুর।

চমকে উঠল মহাদেব।

তিক্ত কুটিল হাসিতে শবলার ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়েছে, নাকের ডগাটা ফুলে ফুলে উঠছে। চোখের দৃষ্টিতে আক্রোশ যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কোনো অগ্নিকুণ্ডের ছাইয়ের আবরণ যেন অকস্মাৎ একটা দমকা বাতাসে উড়ে গিয়ে বাতাসের স্পর্শে মুহূর্তে মুহূর্তে দীপ্যমান হয়ে উঠছে। মহাদেবের কোন্ কথা যে দমকা বাতাসের কাজ করলে, শবলার চোখের দৃষ্টি থেকে উদাসীনতার স্তিমিত ভাবের ছাইয়ের আবরণ উড়িয়ে দিলে, সে কথা জানে ওই শবলাই।

মহাদেব তার কথা শুনে চমকে উঠেছিল, তার দিকে তাকিয়ে যেন থমকে গেল।

শবলার মুখের তিক্ত হাসি আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল, আরও একটু বেশি টান পড়ল তার দুই ঠোঁটের কোণে। মহাদেবের চমক দেখে এবং তাকে থকে যেতে দেখে সে যেন খুশি হয়ে উঠেছে; মহাদেবের স্তম্ভিত ভাবের অবসরে সে নিজের কথাটা আরও দৃঢ় করে বলে উঠল—শুধু ওই রাজলাগের মরণের পাপই লয় বুড়ো, ওই বেদের ছাওয়াল মরল, তার পাপও বটে। দুই পাপই তুর।

রোষ এবং বিস্ময় মিশিয়ে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠছিল মহাদেবের মুখে, কিন্তু সে যেন নিজেকে ঠিক প্রকাশ করতে পারছিল না,শুকনো বারুদ ঠিকই আছে, কিন্তু আগুনের স্পর্শ পাচ্ছিল না। সে শুধু বললে—আমার পাপ?

–হাঁ। তুর। তুর। বুড়া, তুর। বল্ ক্যানে। উপরে রইছেন মাথার পরে দিনের ঠাকুর দিনমণি, পায়ের তলায় তুর মা-বসুমতী, তাকে মাথায় ধরে রইছেন মা-বিষহরির সহোদর বাসুকী। তুর ছামুতে রইছে মায়ের বারি—তু বব বুড়া, পাপ কার?

এবার ফেটে পড়ল মহাদেব। চিৎকার করে উঠল—শবলা!

সে হক যেন মানুষের হাঁক নয়—সে যেন আত্মা চিৎকার করে উঠল। সে আওয়াজে বেদেরা যে বেদেরা, যারা মহাদেবের সঙ্গে আজীবন বাস করে আসছে, তারাও চমকে উঠল। শিবরাম চমকে উঠলেন। বেদেদের আস্তানায় গাছের ডালে বাধা বদরগুলি চিকচিক করে এডাল থেকে ওডালে লাফিয়ে পড়ল, ছাগলগুলি শুয়ে ছিল, সভয় শব্দ করে উঠে দাঁড়াল, গাছের মাথায় পাখি যারা বসে ছিল, উড়ে পালাল; শব্দটা গঙ্গার বুকের জল ঘেঁষে দু দিকে ছুটে চলে অ্যাঁকেবাকে ধাক্কা মেরে প্রতিধ্বনি তুললে—

শবলা!

শবলা!

শবলা!

ক্রমশ দূরে-দূরান্তরে গিয়ে শব্দটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। তখনও সকলে স্তম্ভিত হয়ে রয়েছে। শুধু শবলা গাছের ডালটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর অতি মৃদু কণ্ঠে অল্প একটু হেসে বলল—তুই বিচার কর্যা দেখ। পাঁচজন রইছে, পঞ্চজনেও বিচার করুক। এই রইছেন ধন্বন্তরি বাবার শিষ্য, ওরেও শুধা। বল্ রে বুড়া, তু যে লাগকে দেখে চিনলি রাজলাগ বলে, তু জানলি যে ইয়ারে ধরলে মিত্যু থেকে নিস্তার নাই। মুকে তু বললি সি কথা, ঘোড়াটার কাছ থেকে কেড়েও লিলি। কিন্তু ছেড়ে দিলি নাই ক্যানে? গাঙ পার কর্যা দেবগকে ছেড়া দিয়া যদি মেগে লিতিস তার মাৰ্জ্জনা, তবে বল্ রে বুড়া, মরত ওই বেদের ছাওয়াল, না মরত ওই দেবলগ? ইবার বিচার করে দেখ—পাঁচজনতে দেখুক কার পাপ?

মহাদেব কথার উত্তর খুঁজে পেলে না।

শবলা শিবরামের দিকে তাকিয়ে বললে—কই, বল তো তুমি ধন্বন্তরি-বাবার শিষ্য কচিধন্বন্তরি। বিচার কর তো তুমি।

শিবরামকে বলতে হলহ্যাঁ, সাপটা তুমি সন্ধেতেই যদি ছেড়ে দিয়ে আসতে, মহাদেব। ভুল তোমার হয়েছে।

মহাদেব একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, বললে,-হ্যাঁ, তা বুলতে পার গ। তবে? ভুল তো এক রকমের লয়, ভুল দু রকমের; এক ভুল মানুষ করে নিজের বুদ্ধির দোষে, আর এক ভুল-সে ভুল লয় বাবা ভের-নেয়ত—অদেষ্ট মানুষকে ভেরস্ করায়। এ সেই আদেষ্টের খেলা, নেয়ত ভেরস্ করিয়ে দিলে।

আবার মহাদেব হঠাৎ উগ্র হয়ে উঠল—বললে—একবার বাবা, শিরবেদে বিশ্বম্ভরকে ছলেছিল অদেষ্ট। নিয়তি কন্যেমূর্তি ধরে এসে কালনাগিনীকে বুকে ধরিয়েছিলভেরমে ফেলে বুঝিয়েছিল, সে-ই তার মরা কন্যে। এও তাই বাবা। ওই পাপিনী লাগিনী কন্যের ছলনা। ওই কন্যেটার পাপ ঢুকেছে বাবা-মহাপাপ। মা-বিষহরির সেবায় মন নাই, মন টলেছে কন্যের। লাগিনীর মন মেতেছে বয়সের নেশায়। ওই ছেড়াটারে উ ভুলায়েছিল। কাঁচা বয়স ছাওয়ালটার, তার উপর মরদ হয়্যা উঠেছিল ভারি জবর। আধারের মধ্যে যমকে দেখলে, তার পিছা-পিছা ছুটে যেত। ছোঁড়া সেই গরমে এতবড় ধরাকে দেখলে সরাখানা! লাগিনীর কালো বরনের চিকচিকি আর চোখের ঝিঝিকিতে মেতে গেল। বেদের ছাওয়াল, মানলে না বেদেদের কুলশাসন, বুঝলে না নাগিনী হল বেদেকুলের কন্যে, ও কন্যে মায়াবিনী, মায়াতে ভুলায়ে আপন বাসনা মিটায়ে লিয়ে ওই ওরে ডংশন করবে। ততটা দূর ঘটনাটা এগোয় নাই বাবা, যদি ততদূর যেত তবে ওই লাগিনীই ওরে ডংশন করত। বেদের সহায় মা-বিষহরি, বেদেদের সে পাপ থেক্যা রক্ষা করেছেন। তিনিই রাজগোখুরারে পাঠায়ে দিছেন, ওরে মোহিত করেছেন। ওই সব্বনাশী

শবলাকে দেখিয়ে মহাদেব বললে—সব্বনাশী মায়ের ছলনা বুঝে নাই বাবা, বুঝলে ঘোড়াটারে বারণ করত। কুলতনা, ধরিস না, উ সাক্ষাৎ কাল, মা তুকে-আমাকে ছলতে পাঠায়েছেন ওই কালকে।

হাসলে মহাদেবদেব-ছলনা বুঝা যায় না বাবা। মায়াবিনীই ছোঁড়ারে বুলেছিল—নিয়ে আয় ধরে। হোক দুধবরন সাপ। মায়াবিনী রাজগোখুরা চিনত নাই, চোখে দেখে নাই। ওরই কথাতে আনল ছোঁড়া ধর্যা। দেবতার ইচ্ছা, বুঝতে পারি বাবা, লইলে রাজগোখুরার শুধু তো ছোঁড়াটারে খাবার কথা লয়, পাপী-পাপিনী দুজনারে খাবার কথা, তা হল নাই, শুধু ঘোড়াটাই গেল।

তারপর শবলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেওই কন্যেটার কপালে অনেক দুঃখ আছে বাবা। অনেক দুঃখ পেয়ে মরবে।

****

পরের দিন শিবরাম আবার গিয়েছিলেন বেদেদের আস্তানায়।

যার জন্য মহাদেব একদিন পাঁচ কুড়ি এক টাকা অর্থাৎ একশো এক টাকা চেয়েছিল, তাই সে দিতে চেয়েছে বিনা দক্ষিণায়। ওই দিনের পুলিশ-তদন্তের সময় শিবরাম উপস্থিত ছিল–সেই কৃতজ্ঞতায় মহাদেব বলেছিল—আপনি যা করলে বাবা, তা কেউ করে না। বাবা ধন্বন্তরির দয়া আমাদের পরে আছে। এই শহরে এই মানুষটিই আমাদের আপনজন, তার কথাতেই আপনি এসেছ তা ঠিক; কিন্তুক বাবা, এসেছ তো তুমি! আপনজনের মতন কথা তো বুলেছ! আপনকার চরণে কাটা বিধলি পর পাঁতে কন্যা তুলে দিব আমি। কি দিব তুমাকে কবা, এই দুটি টাকা পেনামী–

শিবরাম বলেছিলেন না না না। টাকা দিতে হবে না মহাদেব। টাকা আমি নেব না। যদি দেবেই কিছু তবে আমাকে সাপ চিনিয়ে দিয়ে। আমি তোমাকে বলেছিলাম, মনে আছে?

–হঁ হঁ, আছে। দিব, তাই দিব। কাল আসিও আপনি। টাকা লাগবে না, কিছু লাগবে না। দিব, চিনায়ে দিব।

কিন্তু আশ্চর্য!

পরের দিন মহাদেব আর এক মহাদেব।

বসে ছিল সে আচ্ছন্নের মত। নেশা করেছে। গাঁজার সঙ্গে সাপের বিষ মিশিয়ে খেয়েছে। তার সঙ্গে খেয়েছে মদ। নেশায় ঘোরালো চোখ দুটো মেলে সে শিবরামের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললে—কি? কি বটে? কি চাই?

শিবরাম আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি কোনো কথা বলবার পূর্বেই মহাদেব বলে উঠল–বেদের মেয়ের লোভে আসছ? আ! বলে দুপাটি বড় বড় অপরিচ্ছন্ন দাঁত বের করলে হিংস্ৰ। জানোয়ারের মত।

শিবরাম শিউরে উঠলেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন রক্তস্রোত শনশন করে বয়ে গেল। আত্মসংবরণ করতে পারলেন না তিনি। বলে উঠলেন—কি বলছ তুমি?

ঠিক বুলছি। মহাদেবের চোখ আবার তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কণ্ঠস্বর মাদকের জড়তায় জড়িয়ে এসেছে।

না। কাল তুমি নিজে আসতে বলেছিলে তাই এসেছি। টাকা দিতে এসেছিলে; আমি নিই নি, বলেছিলাম

–অ। আবার চোখ দুটো বিস্ফারিত করে মহাদেব তার দিকে তাকিয়ে বললে—অ। কবিরাজ ঠাকুর! অ। আমি তুমারে চিনতে লেরেছি বাবা। নেশা করেছি, নেশা। তা—

আবার ঢুলতে লাগল সে। বিড়বিড় করে বললে—এখুন লারব বাবা। এখন হবে না। উঁহুঁ। উঁহুঁ। সে ধুলোর উপরেই শুয়ে পড়ল।

আর একজন বেদে এসে বললে—আপনি এখুন ফিরে যাও বাবা। বুড়ার এখুন হুঁশ নাই।

শিবরাম ক্ষুণ্ণ মনেই ফিরলেন। কিন্তু দোষ দেবেন কাকে? ওদের জীবনের এই ধারা। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

পরের দিন ঠিক দুপুরবেলা—এল শবলা।

আরও একদিন সে যে-সময়ে এসেছিল-ধূর্জটি কবিরাজ ছিলেন না, ঠিক তেমনি সময়ে। এসে সেই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ডাকলে—কচি-ধন্বন্তরি! ছোট কবিরাজ গ!

বেরিয়ে এলেন শিবরাম।

—কি? কবিরাজ মশাই তো এ সময়ে বাড়িতে থাকেন না। সেদিন তো বলেছি তোমাকে। শবলা হেসে বললে–সে জেনেই তো আসছি গ। কাজ তো মোর তুমার সাথে।

—আমার সঙ্গে? বিস্মিত হলেন শিবরাম। মেয়েটার লাস্যময়ী রূপ তিনি সেদিন জমিদার বাড়িতে দেখেছেন। কালো ক্ষীণাঙ্গী বেদের মেয়ে লাস্যময়ী রূপ যখন ধরে তখন তাকে যেন আসব-সরোবরে সদ্যস্নাতার মত মনে হয়। সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন মদিরার ধারা বেয়ে নামে। মানুষ আত্মহারা হয়। ওই নির্জন দ্বিপ্রহরে ধূর্জটি কবিরাজ অনুপস্থিত জেনে মোহময়ী নাগিনী কন্যা কোন ছলনায় তাকে ছলতে এল! বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড তাঁর সঘন স্পন্দনে স্পন্দিত হতে শুরু করেছে তখন; মুখের সরসতা শুকিয়ে আসছে। চোখ দুটিতে বোধহয় শঙ্কা এবং মোহ দুই-ই একসঙ্গে ফুটতে শুরু করেছে। শুকণ্ঠে তিনি বললেন কেন, আমার সঙ্গে কি কাজ?

শবলা বললে ভয় নাই গ ছোট কবিরাজ। তুমার সাথে দুপুরবেলা রঙ্গ করতে আসি নাই। বদন তুমার প্রসন্ন কর।

খিলখিল করে হেসে উঠল সে।

সাপের ঝাঁপি নামিয়ে চেপে বসল শবলা। বললে—কাল তুমি গেছিলা বুড়ার কাছে। কত টাকা দিছ বুড়ারে?

–টাকা?

–হ্যাঁ। টাকা। পরশু–

–অ। হ্যাঁ। পরশু যখন পুলিশে চলে গেল তখন বুড়ো আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি তো টাকা নিই নাই।

–হুঁ। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল শবলা। তারপরে বললে—ঘুষ দিবারে চেয়েছিল, লাও নাই, ধরমদেব তুমারে রক্ষা করেছেন গ। লিলে তুমারে নরহত্যের পাপের ভাগী হতে হত। বুড়া জোয়ান বেদেটারে খুন করেছে।

চমকে উঠলেন শিবরাম।—খুন? খুন করেছে?

—হাঁ গ। খুন। বুড়া রাজ-গোখুরাটারে কেড়ে লিলে, রাখলে ঝাঁপিতে ভর্যা। মনে মনে মতলব করাই ভরা রেখেছিল। লইলে তো তখুনি যদি ছেড়ে দিত গাঙের ধারে—তবে তো ই বিপদ ঘটত না। মতলব করেছিল, রাতের বেলা ওই জোয়ানটা যখন আড ছেড়া চুপিসাড়ে বেরিয়ে যাবে আমার সন্ধানে, তখুনি পিছা পিছা গিয়া সাপটারে খোঁচা দিয়া দিবে পিছন থেকে ছেড়া। রাজগোখুরা তারে আমারে দুজনারেই খাবে। ঘোড়াটারে আমি বুলেছিলম গ। বারে বারে বুলেছিলম। কিন্তুক–

দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে শবলা। কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলে। বললে—আমি লাগিনী কন্যে। আমার দিকে পুরুষকে তাকাতে নাই। বেদের পুরুষের তো নাই-ই। তার মোরে ভাল লেগেছিল—সে মোর পিছা পিছা ঘুরছে বছর কালেরও বেশি! বুলেছিল, যা থাকে মোর ললাটে তাই হবে, তবু তুর কামনা আমি ছাড়তে লারবলারব, আরব, লারব। আমি তারে কত বুঝ বুঝাইছি, তবু সে মানে নাই, নিতুই রাতে গায়ের ধারে, নয়তো গাঙের ধারে গিয়া বসে থাকত। আমি যেতম না, তবু সে বসে থাকত। বলত আসতে তুকে হবেই একদিন। যতদিন না আসবি, ততদিন বসে থাকব। বুড়া হব, সে দিন পর্যন্ত বসে থাকব; বুড়া জানত। বুড়াও তাই চেয়েছিল। আমার সাথে বুড়ার আর বনছে না। এই শহরে এসে মোর দেহেও কি হল কবরেজ! আমিও আর থাকতে পারলাম। আজ তিন দিন গাঙের ধারে তার সাথে দেখা আমিও করছিলম। মা-বিষহরির নাম নিয়া বুলছি কবরেজ, পাপ করি নাই, ধরম ছাড়ি নাই। শুধু গাঙের ধারে বস্যা বস্যা মা-বিষহরিরে ডেকেছি আর কেঁদেছি। কেঁদেছি আর বুলেছি–মা গ, দয়া কর, আমার জীবনটা লাও, আমারে তুমি মুক্তি দাও। জোয়ানটাও পাপ করে নাই কবিরাজ, মোর অঙ্গে হাত দেয় নাই, শুধু বুলেছে—শবলা, ই সব মিছা কথা রে, সব মিছা কথা, মানুষ লাগিনী হয় না। চল, আমরা দুজনাতে পালাই; পালাই চল্ হুই দেশান্তরে। দেশান্তরে গিয়া দুজনাতে ঘর বাঁধি। খাঁটি, খাই, ঘরকন্না করি। আমি শুম আর ভাবতম। ভাবতম আর কখুনও বা হাসতম, কখনও বা কাদতম। কখুনও মনে হত—সে যা বুলেছে সেই সত্যি, যাই তার সাথেই চলে যাই, বিদেশে গিয়ে ঘর বাঁধি, সুখে থাকি। কখনও বা মা-বিষহরির ভয়ে শিউরে উঠতম, বুকটা কেঁপ্যা উঠত, কদম আর বুলতমনা রে, না। নাওরে না না না। সাথে সাথে ডাকতম মা-বিষহরিক, বুলতম ক্ষমা কর গ মা, দয়া কর গ মা, দয়া কর। দণ্ড যদি দিবা মা, তবে আমারে দাও। আমার জীবনটা তুমি লাও, বিষের জ্বালায় জর-জর করা আমার জীবনটা লাও। জোয়ান ছেলে, মরদ মানুষ তারে কিছু বুলো না, তারে তুমি মাৰ্জ্জনা কর, দয়া কর, ক্ষমা কর।

বলতে বলতে চুপ করে গেল শবলা, অকস্মাৎ উদাস হয়ে গেল-কথা বন্ধ করে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। কার্তিকের মধ্যাহ্নের আকাশ। শরতের নীলের গাঢ়তা তখনও আকাশে ঝলমল করছে। কয়েক টুকরো সাদা মেঘও ভেসে যাচ্ছিল। বাতাসে শীতের স্পর্শ জেগেছে; গঙ্গার ওপারের মাঠে আউস ন কাটা হয়ে গেছে, হৈমন্তী ধানের মাঠেলঘু ধানে হলুদ রঙ ধরে আসছে, মোটা ধানের ক্ষেত সবুজ, শিষগুলি নুয়ে পড়েছে। রাস্তায় লোকজন নেই। মধ্যে মধ্যে গঙ্গার স্রোত বেয়ে দু-একখানা নৌকা চলেছে ভেসে।

সে দিনের স্মৃতি শিবরামের মনে এমন ছাপ রেখে গেছে যে, সে কখনো পুরনো হল না। কালো মেয়ে শবলা, কালের ছোপের মধ্যে সে মিলিয়ে যাবার নয়; সে কোনো দিনই যাবে না; কিন্তু সে দিনের আকাশ, মাঠ, গঙ্গা, দুপুরের রোদ-সব যেন তার বৃদ্ধ বয়সের জরাচ্ছন্ন চোখের সামনেও সদ্য আঁকা ছবির মত টকটক করছে।

অনেকক্ষণ পর শবলা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলে কথা বলেছিল—তা মা ক্ষমা করলে না। মায়ের ইচ্ছে ছাড়া তো কাজ হয় না কবরাজ; তাই বুলছি এ কথা। নইলে।

ঝকমক করে উঠল শবলার চোখ। সাদা দাতগুলি ঝিকমিক করে উঠল—নিক কালো নরম দুটি পাতলা ঠোঁটের ঘেরের মধ্যে। কণ্ঠস্বরের উদাসীনতা কেটে গেল, জ্বালা ধরে গেল কণ্ঠস্বরে, বললে—ওই–ওই বুড়ো রাক্ষস উয়াকে খুন করেছে। অন্ধকারে চুপিচুপি গিয়া ছেড়ে দিলে রাজ-গোখুরাকে। ঝাঁপিটাকে ঝাঁকি দিলে, লাগটারে রাগায়ে দিয়া ঝটিপার দড়ি টেনে ঢাকনাটা দিলে খুলে। সাপের আক্কোশ জান না কবরাজ-বড় আক্কোশ। সে ছামুতে পেলে ছেলেটাকে। বুড়া ভেবেছিল, আমি সমেত আছি—খাবে, আমারে উয়ারে দুজনারেই শ্যাষ করবে লাগ। তা—

নিজের কপালে হাত দিয়ে শবলা বললে তা আমার ললাটে এখুনও দুঙ্কু আছে, ভোগান্তি আছে, আমার জীবন যাবে ক্যানে!

ম্লান হাসি ফুটে উঠল তার মুখে, তারই মধ্যে ঢেকে গেল তার চোখের ঝকমকানির উগ্রতা। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল।

শিবরাম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

মেয়েটার চোখের কয় ফোঁটা জলে যেন সব ভিজিয়ে দিয়েছিল। কার্তিকের দুপুরটা যেন মেঘলা হয়ে গিয়েছে মনের মধ্যে। মানুষের গভীর দুঃখ যখন স্বচ্ছন্দ প্রকাশের পথ পায় না, বুকের মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘোরে, তখন তার সংস্পর্শে এলে এমনিই হয়। কি বলবেন শিবরাম! চোরের মা যখন ছেলের জন্য ঘরের কোণে কি নির্জনে লুকিয়ে মৃদুগুঞ্জনে কঁদে তখন যে শোনে তার অন্তর শুধু বেদনায় বোবা হয়ে যায়, সান্ত্বনাও দিতে পারা যায় না, অবজ্ঞা করে তিরস্কারও করা যায় না। হতভাগিনী মেয়েটা ওদের সমাজধৰ্ম কুলধৰ্ম পালন করতে গিয়ে যে দুঃখ পাচ্ছে সে দুঃখকে অস্বীকার তো করা যায় না। আবার ওই কুলধৰ্ম অন্যায় মিথ্যে এ কথাই বা বলবেন কি করে শিবরাম? ওই যে ছেলেটা, তার ওই যৌবনধর্মের আবেগে ওই নাগিনী কন্যাটির প্রতি আসক্ত হয়েছিল, তাই বা কি করে সমর্থন করবেন? কিন্তু ছেলেটার মৃতদেহ মনে পড়ে এ কথাও মনে উঁকি মারতে ছাড়ছিল না যে, ওই কষ্টিপাথরকেটে-গড়া মূর্তির মত ওই ছেলেটার পাশে এই নিকষকালো মেয়েটাকে মানাত বড় ভাল।

আচার্য ধূর্জটি কবিরাজকে লোকে বলে সাক্ষাৎ ধূর্জটি; পবিত্রচিত্ত কবিরাজ শিবের মতই কোমল; পরের দুঃখে বিগলিত হন এক মুহূর্তে; আবার অন্যায় অধর্মের বিরুদ্ধে তিনি সাক্ষাৎ রুদ্র। তারই শিষ্য শিবরাম। শবলাকে তিনি সান্ত্বনাও দিতে পারলেন না, তার দুঃখবেদনাকে অস্বীকার করতে পারলেন না। রোগযন্ত্রণায় অসহায় রুগৃণের দিকে যে বিচিত্র দৃষ্টিতে বিজ্ঞ চিকিৎসক তাকিয়ে থাকেন, সেই দৃষ্টিতে তিনি শবলার মুখের দিকে তাকিলে রইলেন।

শবলা কিন্তু অতি বিচিত্র। অকস্মাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সব যেন ঝেড়ে ফেলে দিলে এক মুহূর্তে। বললে—দেখ, নিজের কথাই পাঁচ কাহন করে বুলছি। যার লেগে এলম, সে ভুলেই গেলাম। এখন পড়ার কাছে কাল আবার কেন গেছিলা বল দেখি?

–সাপ চিনবার জন্যে। বুড়া বলেছিল সাপ চিনিয়ে দেবে।

–কত টাকা দিলা? বুড়া তুমাকে কত টাকা ঠকায়ে নিলে?

–টাকা?

–হাঁ গ। কত টাকা দিছ উয়াকে?

–টাকা কিসের? কি বলছ তুমি?

হেসে উঠল বেদের মেয়ে। ঠকে ঠকেছ—সে কথা জানাজানি করতে শরমে বাঁধছে কচিধন্বন্তরি? আঃ, হায় হায় কচি-ধন্বন্তরি, ঠকলে, ঠকলে, বুড়ার কাছে ঠকলে গ? আমার মতুন কালো সুন্দরীর হাতে ঠকলে যি দুস্কু থাকত না।

শঙ্কিত হয়ে উঠলেন শিবরাম। আবার মনে পড়ে গেল বেদের মেয়ের সেই জমিদার বাড়িতে লাস্যময়ী রূপ। বললেনো না। কি যা-তা বলছ তুমি?

বিদ্যে শেখার জন্যে টাকা দাও নাই তুমি? বুড়া তোমার কাছে পাঁচ কুড়ি টাকা চায় নাই? মিছা বলছ আমার কাছে? দাও নাই?

হঠাৎ মেয়েটার চেহারা একেবারে পালটে গেল। লাস্য না, হাস্য না, কঠিন ঋজু হয়ে দাঁড়াল কালো মেয়ে, চোখের দৃষ্টি স্থির, সর্ব অবয়বে ফণা-ধরে দাঁড়ানো সাপিনীর দৃপ্ত ভঙ্গি। শিবরাম শুনেছিল, নিয়তির আদেশ মাথায় নিয়ে দণ্ড ধরে সাপেরা দাঁড়ায় দণ্ডিত মানুষের শিয়রে, প্রতীক্ষা। করে, কখন দণ্ডিত মানুষটির আয়ুর শেষক্ষণটি আসবে, সঙ্গে সঙ্গে সে মারবে ছোবল। মনে মনে এরই একটি কল্পনার ছবি তাঁর আঁকা ছিল। তারই সঙ্গে যেন মিলে গেল। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে ধীরে মৃদুস্বরে শবলা বললে রাজার পাপে রাজ্য নাশ, কত্তার পাপে গেরস্তের দুগগতি, বাপের পাপে ছাওয়াল করে দণ্ডভোগ। বুড়ার পাপে গোটা বেদেগুষ্টির ললাটে দুঃখভোগ হবে, বুড়ার পাপের ভাগ নিতে হবে, দুর্নামের ভাগী হতে হবে। তাই আমি ছুটে এলম আজ তুমার কাছে। তুমি কবরাজ; বেদেদের বিষের ঠাঁই তুমাদের পাথরের খলে। আমাদের যজমান তুমরা। তুমার কাছে টাকা লিলে, লিয়ে তুমার বিদ্যে দিলে না। অধৰ্ম্ম হল না? ই পাপ মা-বিষহরি সইবেন। ক্যানে গ? বিদ্যের তরে টাকা লিয়া বিদ্যে না দিলে বিদ্যে যে অফলা হয়ে যাবে। বুড়া করলে পাপ, আমি লাগিনী কন্যে, আমি এলম ছুটে—পেরামিত্তি করতে। যতদিন লাগিনী কন্যা রইছি তত দিন করতে হবে আমাকে বুড়ার পাপের পেরাচিত্তি।

হাঁপাতে লাগল শবলা। চোখ দুটোতে সেই স্থির দৃষ্টি। সে যেন সত্যি সত্যিই নাগিনী কন্যা হয়ে উঠেছে, শিবরাম সে নাগিনীকে শবলার মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন।

বেদেনীর বিচিত্র ধর্মজ্ঞান এবং দায়িত্ববোধ দেখে শিবরাম অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেয় নি মহাদেব।

–সত্যি বুলছ?

–সত্যি বলছি। কেন আমি মিথ্যে বলব তোমার কাছে?

–তুমাকে বিনি টাকাতে বিদ্যে দিবে বলেছিল?

শিবরাম বললেন পরশু যখন পুলিশের সঙ্গে গিয়েছিলাম, তখন তো ছিলে তুমি শবলা! মনে নেই, পুলিশ চলে গেলে মহাদেবের সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছিল?

ঘাড় নেড়ে বললে শবলা—না। শেষ বেলাটা আমার শ ছিল না কবরাজ। পুলিশ চলে গেল। বুঝলাম জোয়ানটার দেহ এইবার গাঙের জলে ভাসায়ে দিবে। ভেসে যাবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে, কোথা চলে যাবে কোন দেশে দেশে। মনটাও যেন আমার ভেসে গেল। কানে কিছু শুনলম না আর, চোখে কিছু দেখলম না।

শিবরাম বললেন–পুলিশ চলে গেলে মহাদেব আমাকে দু টাকা প্রণামী দিতে এসেছিল, আমি তা নিই নি। বলেছিলাম, টাকা আমি নেব না। সত্যিই যদি কিছু দিতে চাও, তবে আমাকে সাপ চিনিয়ে দিয়ে। বলেছিল—দেব। তাই গিয়েছিলাম। তুমি তো দেখেছ, একেবারে নেশায় অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। কি করব! ফিরে এলাম।

–মিছা, মিছা, সব মিছা কচি-ধন্বন্তরি সব মিছা। নেশা উ করেছে। কিন্তু বেদের মরদের। নেশা হয় কবরাজ? সাপের বিষ গিলে ফেলবার ঠাঁই না পেলে গাঁজার সাথে খাবার তরে রেখে দেয়। এমন বেদেও আছে ধন্বন্তরি, মুখের দাঁতের গোড়ায় ঘা না থাকলে বিষ চেটেই খেয়ে ফেলায়। উ তুমাকে বুলেছিল—বিদ্যে দিব, বিনা পয়সায় দিব। কিন্তুক বলে আফসোস হল, বিনা টাকায় বিদ্যে দিতে মন চাইল না, তাথেই অমুনি ভান করলে গ! জান, তুমি চলে এলে খানিক পরেই বুড়া উঠে দাঁড়াল, তারপরে সে কি হা-হা হাসি! তোমারে ঠকায়েছে কিনা তাথেই খুশি, তাথেই আলাদ। দেহটা মোর যেন আগুনের হেঁকায় শিউরে উঠল ধন্বন্তরি; মনে মনে মাবিষহরিকে ডাকলম। বললম মা, তুমি রক্ষে কর অধৰ্ম্ম থেকে। বেদেকুলের যেন অকল্যেণ না হয়। তাথেই এলম তুমার কাছে। বুলি, বুড়ো করলে পাপ, আমি তার খণ্ডন কর্যা আসি। কবরাজকে বিদ্যা দিয়া আসি।

শিবরাম বললেন—কি নেবে তুমি বল?

—কি নিব? বেদে বুড়া তুমাকে বাক্ দিছে, আমি সেই বাক্ রাখতে এসেছি। টাকা তো মুই চাই নাই কবরাজ। লাও, বস। লাগ চিনায়ে দিই তুমাকে।

বেদেদের পুরুষ-পুরুষানুক্রমিক রহস্যময় সর্পবিদ্যা। ওই আশ্চর্য কালো মেয়েটির সব যেন জন্মগুণে আয়ত্ত। রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বোধ হয়।

নাগ দেখালে, নাগিনী দেখালে। নপুংসক সাপ দেখালে। আকার-প্রকারের পার্থক্য দেখিয়ে দিলে। ফণার গড়নে চোখের দৃষ্টিতে প্রভেদ দেখালে।–এই দেখ কচি-ধন্বন্তরি, দেখছ–ইটাতে ইটাতে তফাত?

শিবরাম দেখতে ঠিক পাচ্ছিলেন না। যমজ সন্তানের মায়ের চোখে ধরা পড়ে যে পার্থক্য, যে প্রভেদ, সে কি অন্য কারুর চোখে ধরা পড়ে? তিনি ধরতে ঠিক পারছিলেন না, শুধু অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন। সে কি অপরূপ বর্ণনা! মেয়েটা কিন্তু প্রভেদগুলি স্পষ্ট, অত্যন্ত স্পষ্টরূপে চোখে দেখছে, আর বলে যাচ্ছে নাগ-নাগিনীর দেহবৈশিষ্ট্যের কথা। আচার্য ধূর্জটি কবিরাজ যেমন ধ্যানময় আনন্দের সঙ্গে অসংকোচে নর-নারীর দেহগঠনতত্ত্ব বর্ণনা করে যান, ছবি এঁকে বুঝিয়ে দেন, ঠিক তেমনিভাবে শবলাও সাপকে উলটেপালটে তার প্রতিটি অঙ্গ দেখিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলে।

বললে–কবরাজ, আমি যদি মাথায় পাগড়ি বেঁধে মরদ সাজি, তবু কি তুমি আমাকে দেখ্যা কন্যে বলে চিনবে না! ঠিক চিনবে। আমার মুখের মিঠা মিঠা ভাব দেখ্যাই চিনবে। সন্দেহ হলি পর বুকের পানে চাইলিই ধরা পড়বে। বুকের কাপড় যত শক্ত করাই বাঁধি, মেয়ের বুক তো লুকানো যায় না। তেমনি কবরাজ, নাগিনীর নরম নরম গড়ন, বরনের চিকচিকে শোভা দেখলেই ধরা পড়বেক।

শিবরাম বললে–হ্যাঁ।

তিনি যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছেন।

শবলা বললেবল, আর কি দেখবা।

—কি দেখব আর কোনো প্রশ্ন আর শিবরাম খুঁজে পেলেন না।

শবলা খিলখিল করে হেসে উঠল। রহস্যময়ী কালো মেয়েটা মুহূর্তে লাস্যময়ী হয়ে উঠল আবার, কটাক্ষ হেনে বলল—তবে ইবার আমাকে দেখ খানিক। সাপের চোখে ভাল লাগে। সাপিনী, তুমারও ভাল লাগবে বেদেদের লাগিনী কন্যে। লাগবে না?

শিবরামের বুকের ভিতরটায় যেন ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল। ধাক্কা দিয়ে সব যেন ভেঙেচুরে দিতে চাইলে, চোখ দুটির দৃষ্টিতে বুঝতে পারা গেল সে কথা। চোখের দৃষ্টি যেন ঝড়ের তাড়নায় জানলার মত কাঁপছে।

মেয়েটা আবার উঠল হেসে বললে—কবরাজ মনের ঘরে খিল আঁটো গ, খিল আঁটো।

শিবরাম মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠলেন। নিজেকে সংযত করেও হেসেই বললেন–খিল আঁটলেও তো রক্ষে হয় না শবলা; লোহার বাসরঘরে সোনার লখিন্দর সাতটা কুলুপ এঁটে শুয়েও রক্ষে পায় নি, নাগিনীর নিশ্বাসে সরষেপ্রমাণ ছিদ্র বড় হয়ে নাগিনীকে পথ দিয়েছিল। আমি খিল আঁটব না। তোমার সঙ্গে মনসা-কথার বেনেবেটি আর মহানাগের মত সম্বন্ধ পাতাব। জান তো সে কথা?

—জানি না? নাগলোকে থাকে নাগেরা, নরলোকে থাকে নরেরা, বিধেতার বিধান নরে নাগে বাস হয় না। কি করা হবে? নাগের মুখে মিত্যুবিষ, মানুষের হাতে অস্তর। এরে দেখলে ও ভাবেআমার মিত্যুদূত, ওরে দেখলে এ ভাবে আমার মিত্যুদূত। কখনও মরে মানুষ, কখনও মরে নাগ। বিধির বিধান–নরে নাগে বাস হয় না।

হাসল শবলা, বললে—মত্তে থাকে বণিক বুড়া, যত ধনী তত কৃপণ। বাড়িতে আছে গিনি, বেটা আর বেটার বউ। আর আছে সিন্দুকে ধন, খামারে ধান, ক্ষেতে ফসল, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গাই। শ্যামলী ধবলী বুধি মঙ্গলার পাল। সেই পাল চরায় পাড়ার বাউরিছেলে বণিক বুড়োর রাখাল ছোঁড়া। কৃপণ বণিক বুডোর ঘরে রাধুনি নাই, বেটার বউকে ভাত রান্না করতে হয়। যেমন সুন্দরী তেমনি লক্ষ্মী, কিন্তু শিশুকালে মা বাপ হারিয়েছে, বাপকুলে কেউ নাই। নাই বলেই বণিক-বুডোর চাপ বউয়ের উপর বেশি। তাকে দিয়েই করায় রাধুনির কাজ, ঝিয়ের কাজ। বউ ব্রাঁধেন, শ্বশুরকে স্বামীকে খাওয়ান, নিজে খান, রাখাল ছোঁড়ার ভাত নিয়ে বসে থাকেন।

রাখাল ছোঁড়া গরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে, গরুগুলি চরে বেড়ায়, সে কখনও গাছতলায়। বসে বাঁশি বাজায়, কখনও বা গাছের ডালে দোল খায়, কখনও ঘুমায়, কখনও আম জাম কুল পেড়ে আঁচল ভর্তি করে নিয়ে আসে। একদিন গাছের তলায় দেখে দুটি ডিম। ভারি সুন্দর ডিম। রাখালের সাধ হল, ডিম দুটি পুড়িয়ে খাবে। ডিম দুটি খুঁটে বেঁধে নিয়ে এল, বণিক-বউকে দিলে-বউ গ বউঠাকরণ, ডিম দুটি আমাকে পুড়ায়ে দিয়ে।

বউঠাকরুণ ডিম দুটি হাতে নিয়ে পোড়াতে গিয়েও পোড়াতে পারলে না। ভারি ভাল লাগল। আহা, কোন্ জীবের ডিম, এর মধ্যে আছে তাদের সন্তান, আহা! ডিম দুটি সে এক কোণে একটি টুকুই ঢাকা দিয়ে রেখে দিলে। তার বদলে দুটি কাঠাল বিচি পুড়িয়ে রাখালকে দিলেন—লে, খা।

রাখাল ছোঁড়া কাঠালবিচি-পোড়া খেয়েই খুব খুশি।

বউও খুব খুশি, কেষ্টর জীব দুটি বাঁচব।

দিন যায়, মাস যায়। রাখাল ঘেঁড়া গরু-চরায়। বউঠাকরুণ ভাত রাধে, বাসন মাজে, ঘরসংসারের কাজ করে। ডিম দুটি টুকুই চাপা পড়েই থাকে। বউঠাকরুণ ভুলেই যান, মনেই থাকে না। হঠাৎ একদিন দেখেন, টুকুইটি নড়ছে। বউয়ের মনে পড়ে গেল, হরপরশ হয়ে টুকুই তুলতেই দেখেন, দুটি নাগের বাচ্চা। লিকলিক করছে, ফণা তুলে দুলছে, মাথার চক্র দুটিতে পদ্মপুষ্পের মত শোভা।

বউয়ের প্রথমটা ভয় হল। তার পরে মায়া হল। আহা, তার যতনেই ডিম দুটি বেঁচেছে, ডিম ফুটে ওরা বেরিয়েছে। ওদের কি করে মারবেন? ভগবানকে স্মরণ করলেন, নাগের বাচ্চা দুটিকে বললেন—তোদের ধম্ম তোদের ঠাঁই, আমার ধৰ্ম্ম আমার কাছে, সে ধম্মকে আমি লঘন করব না।

বলে ছোট একটি মাটির সরাতে দুধ এনে নামিয়ে দিলেন। নাগ দুটি মুখ ড়ুবিয়ে চুচুক করে খেলে। আবার টুকুই ঢাকা দিলেন।

রোজ দুধ দেন, তারা খায় আর বাড়ে।

বণিক-বউয়ের মায়া বাড়ে।

ঘরে আম আসে, আমের রস করে তাদের দেন। কাঁঠাল এলে কাঁঠালের কোয়া চটকে তাও দেন। নাগ দুটি দিনে দিনে বাড়ে লাউ-কুমড়ার লতার ডগার মত। বেশ খানিকটা বড় হল–তখন আর তারা থাকবে কেন টুকুই-চাপা বেরিয়ে পড়ল; ঘুরতে লাগল ঘরের ভিতর, তারপরে বাইরে, ওই বণিক-বউয়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

বণিক-বুড়ো বণিক-বুড়ি দুজনে ভয়ে শিউরে ওঠেন। ও মা-এ কি! এ কি কাণ্ড! এ কি। বেদের কন্যে, না, নাগিনী? এ কে? মার, মার, নাগের বাচ্চা দুটোকে মার।

বাচ্চা দুটিকে কপকপ করে কুড়িয়ে অ্যাঁচলে ভরে বেনে-বউ পালিয়ে গেলেন বাড়ির পদাড়ে। নাগ দুটিকে ছেড়ে দিয়ে বললেন—ভাই রে তোমরা তোমাদের স্বস্থানে যাও, আমি শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ঘর করি, তাতেই গঞ্জনা সইতে পারি না। তোমাদের জন্যে মনে দুঃখু আমার হবে ডিম থেকে এত বড়টি করলাম। কিন্তু কি করব? উপায় নাই।

নাগ দুটি স্বস্থানে গিয়ে মা-বিষহরিকে বললেমা, ভাগ্যে বণিক-বেটি ছিল তাই বেঁচেছি, নইলে বাতাম না। সে আমাদের ভাই বলেছে, আমরা, তাকে দিদি বলেছি। সে তোমার কন্যে মা। তাকে একবার আনতে হবে আমাদের এই নাগলোকে। মা বললেন–বাবা, না। তা হয় না। নরে-নাগে বাস হয় না। বিধাতার নিষেধ। আমি বরং তাকে বর দেব এইখান থেকে, ধনে-ধানে সুখে স্বচ্ছন্দে স্বামী-পুত্রে তার ঘর ভরে উঠুক।

নাগেরা বললে–না মা, তা হবে না। তা হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নাগেদের বলবে নেমকহারাম।

মা বললেন—তবে আন।

নাগেরা নরের রূপ ধরলেন, বণিক-বউয়ের যমজ মাসতুতো ভাই সাজলেন, সেজে এসে দোরে দাঁড়ালেন মাউই গো, তাউই গো, ঘরে আছ? সঙ্গে ভার-ভারোটায় নানান দ্রব্য।

—কে? কে তোমরা?

—তোমাদের বেটার বাউয়ের মাসতুতো ভাই। দূর দেশে থাকতাম। দেশে এসে খোঁজ নিয়ে দিদিকে একবার নিতে এলাম।

–ও মাগো! বাপকুলে পিসি নাই মা-কুলে মাসি নাই শুনেছিলাম, হঠাৎ মাসতুতো ভাই এল কোথা থেকে?

–বললাম তো, দূর দেশে বাণিজ্য করতাম, ছেলেবয়স থেকে দেশ ছাড়া, তাই জান না।

বলে নামিয়ে দিলেন ভার-ভারোটায় হাজারো দ্রব্য। কাপড়চোপড় আভরণ গন্ধ–নানান দ্রব্য। মণিমুক্তার হার পর্যন্ত।

এবার চুপ করলে বুড়োবুড়ি। কেউ যদি না হবে তবে এত দ্রব্য দেবে কেন? জিনিস তো সামান্য নয়! এ যে অনেক! আর তাও যেমন-তেমন জিনিস নয়—এ যে মণি মুক্তো সোনা রুপো।

নাগেরা বললেন—আমরা কিন্তু দিদিকে একবার নিয়ে যাব।

–নিয়ে যাবে? না বাবু, তা হবে না।

–হতেই হবে। ওদিকে বণিক-বধূ কাঁদতে লাগলেন–আমি যাবই।

শেষে বুড়োবুড়িকে রাজি হতে হল। নগেরা বেহারা ভাড়া করলে, পাকি ভাড়া করলে, বণিক-বউকে পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে চলল। কিছু দূরে এসে বেহারাদের বললে—এই কাছে আমাদের গ্রাম, ওই আমাদের বাড়ি। আর আমাদের নিয়ম হল–কন্যা হোক বউ হোক, এইখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ঢুকতে হবে।

ভাল করে বিয়ে করলেন। দেখিয়ে দিলেন কাছের গ্রামের রাজবাড়ি। বেহারারা খুশি হয়ে চলে গেল।

তখন নগেরা বললেন–দিদি, আমরা তোমার মাসতুতো ভাইও নই, মানুষও নই। আমরা হলাম সেই দুটি নাগ, যাদের তুমি বাঁচিয়েছিলে। বড় করেছিলে। মা-বিষহরি তোমার বৃত্তান্ত শুনে খুশি হয়েছেন। তোমাকে নাগলোকে নিয়ে যেতে বলেছেন, আমরা তোমাকে সেইখানে নিয়ে যাব। মায়ের বরে তুমি বঁটুলের মত ছোটটি হবে, তুলোর মতন হালকা হবে, আমাদের ফণার উপর ভর করবে, আমরা তোমাকে আকাশ-পথে নিয়ে যাব নাগলোকে। তুমি চোখ বোজ।

মনে হল আকাশ-পথে উড়ছেন। তারপর মনে হল, কোথাও যেন নামলেন। নাগরা বললে—এইবার চোখ খোল।

চোখ খুললেন। সামনে দেখলেন, মা-বিষহরি পদ্মফুলের দলের মধ্যে শতদলের মত বসে। আছেন। অঙ্গে পদ্মগন্ধ, পদ্মের বরন। মুখে তেমনি দয়া।

মা বললেন মা, নাগলোকে এলে, থাক, দুধ নাড় দুধ চাড়, সহস্ৰ নাগের সেবা কর। সব দিক পানে চেয়ো মা, শুধু দক্ষিণ দিক পানে চেয়ো না।

নির্জনে দ্বিপ্রহরে গল্প বলতে বলতে বেদের মেয়েটার মনে ও চোখে যেন স্বপ্নের ছায়া নেমে এসেছিল। ওই ব্ৰতকথা গল্পের ওই স্বজনহীনা কন্যাটির বিষধরকে আপনজন জ্ঞানে অ্যাঁকড়ে ধরার মত এই মেয়েটিও যেন শিবরামকে অ্যাঁকড়ে ধরার কল্পনায় বিভোর হয়ে উঠেছে।

শিবরামের মনেও সে স্বপ্নের ছোঁয়া লাগল। তিনি বললেন হ্যাঁ, শবলা। ওই বেনেবেটি আর নাগেরা যেমন ভাই-বোন হয়েছিল, আমরাও তেমনি ভাই-বোন হলাম।

শুনে শবলা হাসলে। এ হাসি শবলার মুখে কল্পনা করা যায় না। মনে হল শবলা বুঝি কাদবে এইবার।

সে কিন্তু কদল না, কাদলেন শিবরাম, গোপনে চোখের জল মুছে বললেন—তা হলে কিন্তু তোমাকে আমি যা দেব নিতে হবে।

–কি?

শিবরাম বের করলেন দুটি টাকা। বললেন—বেশি দেবার তো সাধ্য আমার নাই। দুটি টাকা তুমি নাও! তুমি আমাকে বিদ্যাদান করলে, এ হল দক্ষিণা। গুরুদক্ষিণা দিতে হয়।

গুরু-দক্ষিণা কথাটা শুনে চপলা মেয়েটার সরস কৌতুকে হেসে গড়িয়ে পড়ার কথা। শিবরাম তাই প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রত্যাশা করেছিলেন হেসে গড়িয়ে পড়ে শবলা বলবেও মা গ! মুই তুমার গুরু হলাম। দাও—তবে দাও। দক্ষিণে দাও।

শিবরামের অনুমান কিন্তু পূর্ণ হল না। এ কথা শুনেও সেয়েটা হাসলে না। স্থিরদৃষ্টিতে একবার তাকালে শিবরামের দিকে, তারপর তাকালে টাকা দুটির দিকে। শিবরামের মনে হল, চোখের দৃষ্টিতে রুপোর টাকা দুটোর ছটা বেড়েছে, সেই ছটায় দৃষ্টি ঝকমক করছে। তবু সে স্থির হয়ে রইল। নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে বললে–না। লিতে লারব ধরমভাই। লিলে বেদেকুলের ধরম যাবে। তুমাকে ভাই বুলেছি, ভাই বলা মিছা হবে। উ লিতে লারব। টাকা তুমি রাখ।

শিবরাম বললেন-আমি তোমাকে খুশি হয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া, ভাই কি বোনকে টাকা দেয় না?

–দেয়! ইয়ার বাদে যখুন দেখা হবে দিয়ো তুমি। মুই লিব। সকল জনাকে গরব করা দেখিয়ে বেড়াব, বুলব—দে গো দেখু, মোর ধরমভাই দিছে দে।

তারপর বললে—বেদের কন্যে কালনাগিনী বইন তুমার আমি। আমি তুমারে ভুলতে লারব, কিন্তুক ধন্বন্তরি, তুমি তো ভুল্যা যাবা। দাম দিয়া জিনিস লিয়া দোকানিরে কে মনে রাখে কও? জিনিসটা থাকে, দোকানিটারে ভুল্যা যায় লোকে। আমি তোমারে বিনা দক্ষিণায় বিদ্যা দিলম, এই বিদ্যার সাথে মুইও থাকলম তুমার মনে। দাঁড়াও তুমাকে মুই আর একটি দব্য দিব।

মেয়েটা অকস্মাৎ ভাবোচ্ছ্বাসে উথলে উঠেছে বর্ষাকালের হিজল বিলের নদীনালার মত। অ্যাঁটসট করে বাধা তার বুকের কাপড়ের তলা থেকে টেনে বের করলে তার গলার লাল সুতোর জড়ি-পাথর-মাদুলির বোঝা। তার থেকে এক টুকরো শিকড় খুলে শিবরামকে বললে—ধর। হাত পাত ভাই। পাত হাত।

শিবরাম হাত পাতলেন। শিকড়ের টুকরাটা তার হাতে দিয়ে বেদের মেয়ে বললে ইয়ার থেকে বড় ওষুদ বেদের কুলের আর নাই ধন্বন্তরি। লাগের বিষের অম্রোে, মা-বিষহরির দান।

—কি এ জড়ি? কিসের মূল?

বেদের মেয়ে হাসলে একবার। বললে—সি কইতে তো বারণ আছে ধরমভাই। বেদেকুলের গুপ্ত বিদ্যা-এ তো পেকাশ করতে নিষেধ আছে।

মেয়েটা একটু চুপ করে থেকে বললে—যদি বিশ্বাস কর ধরমভাই, তবে বুলি শোন। এ যে কি গাছ তার নাম আমরাও জানি না। বেদেরা বলে—সেই যখন সাঁতালী পাহাড় থেকে বেদেরা ভাসল নৌকাতে, তখুন ওই কালনাগিনী কন্যে যে আভরণ অঙ্গে পর্যা নেচেছিল, তাথেই এক টুকরা মূল ছিল লেগে। সাঁতালী ছাড়ল বেদেরা, সঙ্গে সঙ্গে ধন্বন্তরির বিদ্যা চাঁদো বেনের শাপে হল বিস্মরণ। লতুন বিদ্যা দিলেন মা-বিষহরি। এখুন ধন্বন্তরির বিদ্যার ওই মূলটুকুই কন্যের আভরণে লেগে সঙ্গে এল, তাই পুঁতলে শিরবেদে নতুন সাঁতালী গাঁয়ে হিজল বিলের কূলে। গাছ আছে, শিকড় নিয়া ওষুদ করি। কিন্তু নাম তো জানি না ধরমভাই। আর ই গাছ সাঁতালী ছাড়াও তো আর কুথাও নাই পিথিমীতে। তা হলে তুমাকে নাম বলব, কি গাছ চিনায়ে দিব কি করা কও? এইটি তুমি রাখ, লাগ যদি ডংশন করে আর সি ডংশনের পিছাতে যদি দেবরোষ কি ব্ৰহ্মরোষ না থাকে ধন্বন্তরি—তবে ইয়ার এক রতি জলে বেট্যা গোলমরিচের সাথে খাওয়াই দিবা, পরানা যদি তিল-পরিমাণও থাকে, তবে সে পরানকে ফিরতে হবে, এক পহরের মধ্যে মড়ার মত মনিষ্যি চোখ মেলে চাইবে।

আর একটি শিকড়ও সে দিয়েছিল শিবরামকে। তীব্র তার গন্ধ।

এতকাল পরেও বৃদ্ধ শিবরাম বলেন-বাবা, সে গন্ধে নাক জ্বালা করে, নিশ্বাসের সঙ্গে বুকের মধ্যে গিয়ে সে যেন আত্মার শ্বাসরোধ করে।

শবলা সেদিন এই শিকড় তার হাতে দিয়ে বলেছিল—এই ওষুদ হাতে নিয়া তুমি রাজগোখুরার ছামনে গিয়া দাঁড়াইবা, তাকে মাথা নিচু কর্যা পথ থেকে সর্যা দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমাকে দেখায়ে দিই পরখ কর্যা।

খুলে দিলে সে একটা সাপের কাঁপি। কালো কেউটে একটা মুহূর্তে ফণা তুলে উঠে দাঁড়াল। সদ্য-ধরা সাপ বোধ হয়। শিবরাম পিছিয়ে এলেন।

হেসে বেদেনী বললে ভয় নাই, বিষদাঁত ভেঙে দিছি, বিষ গেলে নিছি। এসো এসো, তুমি জড়িটা হাতে নিয়া আগায়ে এসো।

বিষদাঁত ভাঙা, বিষও গেলে নেওয়া হয়েছে সবই সত্যি; কিন্তু শিবরাম কি করে কোন সাহসে এগিয়ে যাবেন! দাঁতের গোড়ায় যদি থাকে একটা ভাঙা কণা? যদি থলিতে থাকে সুচের ডগাটিকে সিক্ত করতে লাগে যতটুকু বিষ ততটুকু? কিংবা বিষ গেলে নেওয়ার পর এরই মধ্যে যদি আবার সঞ্চিত হয়ে থাকে? সে আর কতটুকু? ওই দাঁতের ভাঙা কণার মুখটুকু ভিজিয়ে দিতে কতটুকু তরল পদার্থের দরকার হবেপুরো এক বিন্দুরও প্রয়োজন হবে না। এক বিন্দুর ভগ্নাংশ।

বেদের মেয়ে শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে হেসে বললে—ডর লাগছে? দাও, জড়িটা আমাকে দাও। জড়িটা নিয়ে সে হাতখানা এগিয়ে নিয়ে গেল।

আশ্চর্য! সাপটার ফণা সংকুচিত হয়ে গেল, দেখতে দেখতে সাপটা যেন শিথিলদেহ হয়ে। ঝাঁপির ভিতর নেতিয়ে পড়ে গেল। মানুষ যেমন অজ্ঞান হয়ে যায় তেমনি, ঠিক তেমনিভাবে।

–ধর, ইবার তুমি ধর।

শিবরামের হাতে শিকড়টা দিয়ে এবার শবলা যা করলে শিবরাম তা কল্পনাও করতে পারেন। নি। আর একটা ঝাঁপি খুলে এক উদ্যতফণা সাপ ধরে হঠাৎ শিবরামের হাতের উপর চাপিয়ে দিলে।

সাপের শীতল স্পর্শ। স্পর্শটা শুধু ঠাণ্ডাই নয়, ওর সঙ্গে আরও কিছু আছে। সাপের ত্বকের মসৃণতার একটা ক্রিয়া আছে। শিবরাম নিজেও যেন সাপটার মত শিথিলদেহ হয়ে যাচ্ছিলেন। তবু প্রাণপণে আত্মসংবরণ করলেন। শবলা ছেড়ে দিলে সাপটাকে; সেটা ঝুলতে লাগল। শিবরামের হাতের উপর নিপ্ৰাণ ফুলের মালার মত।

আশ্চর্য!

শিবরাম বলেন—সে এক বিস্ময়কর ভেষজ বাবা। সমস্ত জীবনটা এই ওষুধ কত খুঁজেছি, পাই নি। বেদেদের জিজ্ঞাসা করেছি—তারা বলে নি। তারা বলে—কোথা পাবেন বাবা এমন ওষুধ? আপনাকে কে মিথ্যে কথা বলেছে। শিবরাম শবলার নাম বলতে পারেন নি। বারণ করেছিল শবলা।

বলেছিল–ই ওষুদ তুমি কখুনও বেদেকুলের ছামনে বার করিও না। তারা জানলি পর আমার জীবনটা যাবে। পঞ্চায়েত বসবে, বিচার করে বুলবে—বেটিটা বিশ্বাস ভেঙেছে, বেদেদের লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে পরকে দিয়েছে। এই জড়ি যদি অন্যে পায় তবে আর বেদের রইল কি? বেদের ছামনে সাপ মাথা নামায়, তিল পরিমাণ পরান থাকলে বেদের ওষুদে ফিরে, সেই জন্যেই মান্যি বেদের। নইলে আর কিসের মানি! কুলের লক্ষ্মীকে যে বিয়ে দেয়, মরণ হল তার সাজা। মেরে ফেলাবে আমাকে।

শিবরাম কোনো বেদের কাছে আজও নাম করেন নি শবলার। কখনও দেখান নি সেই জড়ি।

ওদিকে বেলা পড়ে আসছিল; গঙ্গার পশ্চিম কূলে ঘন জঙ্গলের মাথার মধ্যে সূর্য হেলে পড়েছে। দ্বিপ্রহর শেষ ঘোষণা করে দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ পাখিরা কলকল করে ডেকে উঠল; গাছের ঘনপল্লবের ভিতর থেকে কাকগুলো রাস্তায় নামছে। শিবরাম চঞ্চল হয়ে উঠলেন। আচার্য ফিরবেন এইবার।

—তুমি এমন করছ ক্যানে? এমন চঞ্চল হল্যা ক্যানে গ?

—তুমি এবার যাও শবলা, কবিরাজ মশাই এবার ফিরবেন। কবিরাজ বারণ করে দিয়েছেন। শিষ্যদের সাবধান বাবা, বেদেদের মেয়েদের সম্পর্কে তোমরা সাবধান। ওরা সাক্ষাৎ মায়াবিনী।

শবলা ঝাঁপি গুটিয়ে নিয়ে উঠল। চলে গেল বেরিয়ে। কিন্তু আবার ফিরে এল।

—কি শবলা?

–একটি জিনিস দিবা ভাই?

–কি বল?

শবলা ইতস্তত করে মৃদুস্বরে প্রার্থিত দ্রব্যের নাম করলে।

চমকে উঠলেন শিবরাম। সর্বনাশ! ঐ সর্বনাশী বলে কি?

শিবরাম শিউরে বলে উঠলেন নানা-না। সে পারব না। সে পারব না। সে আমি—

মিথ্যে কথাটা মুখ দিয়ে বের হল না তাঁর। বলতে গেলেন—সে আমি জানি না। কিন্তু জানি না কথাটা উচ্চারণ করতে পারলেন না।

শবলা তাঁর কাছে নরহত্যার বিষ চেয়েছে ওষুধের নামে। মাতৃকুক্ষিতে সদ্যসমাগত সন্তান-হত্যার ভেষজ চেয়েছে সে। যে চোখে স্বপ্ন দেখা মানা, সে চোখে অবাধ্য স্বপ্ন এসে যদি নামে, সে স্বপ্নকে মুছে দেবার অস্ত্র চায় সে। সে ওষুধ সে অস্ত্র তাদেরও আছে; কিন্তু তাতে তো শুধু স্বপ্নই নষ্ট হয় না, যে-চোখে স্বপ্ন নামে সে চোখও যায়। তাই সে ধন্বন্তরির কাছে এমন ওষুধ চায়, এমন সূক্ষ্মধার শাণিত অস্ত্ৰ চায়, যাতে ওই চোখে-নামা স্বপ্নটাকেই বোটা-খসা ফুলের মত ঝরিয়ে দেওয়া যায়। যেন চোখ জানতে না পারে, স্বপ্ন ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে মিশে গেল।

শিবরাম জানেন বেদের মেয়েদের অনেক গোপন ব্যবসার কথা। এটাও কি তারই মধ্যে একটা? বশীকরণ করে তারা। কত হতভাগিনী গৃহস্থবধূ স্বামীবশ করবার আকুলতায় এদের ওষুধ। ব্যবহার করে স্বামীঘাতিনী হয়েছে, সে শিবরামের অজানা নয়।

কি চতুরা মায়াবিনী এই বেদের মেয়েটা! শিবরামের টাকা না নেওয়ার সততার ভান করে, তার সঙ্গে ভাই সম্বন্ধ পাতিয়ে, তাকে কেমন করে বেঁধেছে পাকে পাকে! ঠিক নাগিনীর বন্ধন।

বেদের মেয়ে মায়াবিনী, বেদের মেয়ে ছলনাময়ী, বেদের মেয়ে সর্বনাশী, বেদের মেয়ে পোড়ারমুখী! পোড়ামুখ নিয়ে ওরা হাসে, নির্লজ্জা, পাপিনী।

শবলা শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শিবরামের মুখ দেখে, তার আর্ত কণ্ঠস্বর শুনে সে যেন মাটির পুতুল হয়ে গিয়েছিল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। কয়েক মুহূর্ত পরেই তার ঘোর কাটল। মাটির পুতুল যেন জীবন ফিরে পেলে। সে জীবন-সঞ্চারের প্রথম লক্ষণ একটি দীর্ঘশ্বাস। তারপর ঠোঁটে দেখা দিল ক্ষীণরেখায় এক টুকরা হাসি।

অতি ক্ষীণ বিষণ্ণ হাসি হেসে সে বললে—যদি দিবারে পারতে ধরমভাই, তবে বইনটা তুমার বাঁচত।

শিবরাম বুঝতে পারলেন না শবলার কথা। কি বলছে সে?

শবলা সঙ্গে সঙ্গেই আবার বললে—সি ওষুদ যদি না জান ধরমভাই, যদি দিতে না পার, তুমার ধরমে লাগে–তবে অঙ্গের জ্বালা জুড়ানোর কোনো ওষুদ দিতে পার? অঙ্গটা মোর জ্বল্যা যেছে গ, জ্বলা যেছে। মনে হছে হিজল বিলে, কি, মা-গঙ্গার বুকের পরে অঙ্গটা এলায়ে দিয়া ঘুমায়ে পড়ি। কিংবা লাগগুলাকে বিছায়ে তারই শয্যে পেতে তারই পরে শুয়ে ঘুমায়ে যাই। কিন্তু তাতেও তো যায় না মোর ভিতরের জ্বালা। সেই ভিতরের জ্বালা জুড়াবার কিছু ওষুদ দিতে পার?

ওদিকে রাস্তায় উঠল বেহারার হক। আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের পালকি আসছে।

শিবরাম স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন। গুরুর পালকির বেহারাদের হাঁকেও তার চেতনা ফিরল না। বেদের মেয়ে কিন্তু আশ্চর্য! মানুষের সাড়া পেয়ে সাপিনী যেমন চকিতে সচেতন হয়ে উঠে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়, তেমনিভাবেই ক্ষিপ্ৰ লঘু পদক্ষেপে আচার্যের বাড়ির পাশের একটি গলিপথ ধরে বেরিয়ে চলে গেল।

আচার্যের পালকি এসে ঢুকল উঠানে। আচার্য নামলেন। শিবরামের তবু মনের অসাড়তা কাটল না। হাতের মুঠোয় জড়ি দুটি চেপে ধরে তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন।

কয়েক মুহূর্ত পরেই শিবরামের কানে এল—কোন দূর থেকে চপল মিষ্টি কণ্ঠের সুরেলা কথা।

–জয় হোক গ রানীমা, সোনাকপালী, চাদবদনী, স্বামীসোহাগী, রাজার রানী, রাজজনী, রাজার মা! ভিখারিনী পোড়াকপালী কাঙালিনী বেদের কন্যে তুমার দুয়ারে এসে হাত পেতে দাঁড়াছে। লাগলাগিনীর লাচন দেখ। কালামুখী বেদেনীর লাচন দেখ। মা–গ!

সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল হাতের ডম্বরুর বাদ্যযন্ত্রটি।
পরের দিন শিবরাম নিজেই গেলেন বেদেদের আস্তানায়। শহর পার হয়ে সেই গঙ্গার নির্জন তীরভূমিতে বট-অশ্বথের ছায়ায় ঘেরা স্থানটিতে।

কে কোথায়? কেউ নাই। পড়ে আছে কয়েকটা ভাঙা উনোন, দু-একটা ভাঙা হাড়ি, কিছু কুচো হাড়—বোধহয় পাখির হাড় ছড়িয়ে পড়ে আছে। বেদেরা চলে গিয়েছে। গঙ্গার জলের ধারে পলিমাটিতে অনেকগুলি পায়ের ছাপ জেগে রয়েছে। কতকগুলো কাক মাটির উপর বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, কুঁচো হাড়গুলো ঠোকরাচ্ছে। শহরের দুটো পথের কুকুর বসে আছে গাছতলায়। ওরা বোধহয় বেদেদের উচ্ছিষ্টের লোভে শহর থেকে এখানে এসে কয়েকদিনের জন্য বাসা গেড়েছিল। বেদেরা চলে গিয়েছে, সে কথা ওরা এখনও ঠিক বুঝতে পারে নাই। ভাবছে—গেছে। কোথাও, আবার এখুনি আসবে।

শিবরামও একটু বিস্মিত হলেন। এমনিভাবেই বেদেরা চলে যায় ওরা থাকতে আসে না, এই ওদের ধারা। এ কথা তিনি ভাল করেই জানেন, তবুও বিস্মিত হলেন। কই, কাল দুপুরবেলা শবলা তো কিছু বলে নাই! তার কথাগুলি এখনও তাঁর কানে বাজছে।

–ধরমভাই, ধন্বন্তরি ভাই, বেদের বেটি কাললাগিনী বইন। লরে লাগে বাস হয় না চিরকালের কথা। হয়েছিল বণিককন্যে আর পদ্মগের দুটি ছাওয়ালের ভালবাসার জোরে, ভাইফোঁটার কল্যাণে, বিষহরির কৃপায়। এবারে হল তুমাতে আমাতে। তুমি মোরে বইন কইলা, মুই কইলাম ভাই।

আরও কানে বাজছে—যদি দিবারে পারতে ধরমভাই, তবে বইনটা তুমার বাঁচত।

সেদিন শিবরাম সারাটা রাত্রি ঘুমাতে পারেন নাই। ওই কথাগুলিই তার মাথার মধ্যে বহু বিচিত্র প্রশ্ন তুলে অবিরাম ঘুরেছিল এবং সেই কথাই তিনি আজ জানতে এসেছিলেন শবলার কাছে। জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলেন—এ কথা কেন বললি আমাকে খুলে বল্ শবলা বোন, আমাকে খুলে বল।

নিস্তব্ধ হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন জনহীন নদীকূলে।

***

এক বৎসর পর আবার এল বেদের দল।

এর মধ্যে শিবরাম কত বার কামনা করেছেন—আঃ, কোনোক্রমে যদি এবারও সূচিকাভরণের পাত্রটি মাটিতে পড়ে ভেঙে যায় তা হলে গুরু আবার যাবেন সাঁতালী গাঁয়ে। ঘাসবনের মধ্যে থেকে হাঙরমুখী খালের বাঁকে বেরিয়ে আসবে কালনাগিনী বেদের মেয়ে। নিকষকালো সুকুমার মুখখানির মধ্যে, তার চোখের দৃষ্টিতে, ঠোঁটের হাসিতে আলোর শিখা জ্বলে উঠবে।

কিন্তু সে কি হয়?

আচার্য ধূর্জটি কবিরাজ যে শিবরামের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারবেন। সূচিকাভরণের পাত্রটি দৈবাৎ মাটিতে পড়ে চূর্ণ হয় নি, হয়েছে। শিবরাম শিউরে উঠেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুঠি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।

যাক সে কথা। বেদেরা এসেছে। এক বৎসরেরও বেশি সময় চলে গিয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ বেশি। অন্য হিসেবে আরও বেশি। এ বৎসর পর্ব-পার্বণগুলি অপেক্ষাকৃত এগিয়ে এসেছে। মলমাস এবার দুর্গাপূজারও পরে। নাগপঞ্চমী গিয়েছে ভদ্রের প্রথম পক্ষে। শারদীয়া পূজা গেছে আশ্বিনের প্রথমে, সে হিসাবে ওদের আরও অনেক আগে আসা উচিত ছিল।

বাইরে চিমটের কড়া বাজল—ঝনাৎ ঝন–ঝনাৎ ঝন–ঝনাৎ ঝন!

তুমড়ী-বাঁশি বাজছে—একঘেয়ে মিহিসুরে। সঙ্গে বাজছে বিষম্যাকিটা ধুম-ধুম! ধুম-ধুম!

ভারী কণ্ঠস্বরে বিচিত্র উচ্চারণে হাকছে-জয় মা-বিষহরি! জয় বাবা ধন্বন্তরি! জয়জয়কার হোক–তুমার জয়জয়কার হোক।

শিবরাম ঘরের মধ্যে বসে ওষুধ তৈরি করছিলেন। ধূর্জটি কবিরাজ আজ বাইরেই আছেন। একটি বিচিত্র রোগী এসেছে দূরান্তর থেকে, পরিপূর্ণ আলোর মধ্যে আচার্য রোগীটিকে দেখছেন। শিবরাম চঞ্চল হয়ে উঠলেন বেদেদের কণ্ঠস্বর শুনে। গুরুর বিনা আহ্বানে নিজের কাজ ছেড়ে বাইরে যেতে তার সাহস হল না।

ওদিকে বাইরে বেদের কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগল—পেনাম বাবা ধন্বন্তরি। জয়জয়কার হোক। ধন্বন্তরির আটন আমাদের যজমানের ঘর, ধনে-পুত্ৰে উথলি উঠুক। তুমার দয়ায় আমাদের প্যাটের জ্বালা ঘুচুক।

ভারী গলায় আচার্যের কথা শুনতে পেলেন শিবরাম।—কি, মহাদেব কই? বুড়ো? সে!

–বুড়া শয়ন নিছে বাবা। বুড়া নাই।

—মহাদেব নাই? গত হয়েছে? শান্ত কণ্ঠস্বরেই বললেন আচার্য। মানুষের মৃত্যুসংবাদে আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের তো বিস্ময় নাই। ক্ষীণ বেদনার একটু আভাস শুধু ভারী কণ্ঠস্বরকে একটু সিক্ত করে দেয় মাত্র। আবার বললেন কি হয়েছিল? নাগদংশন?

–লাগিনী বাবা, লাগিনী! কাললাগিনী–শবলা—তাকে নিয়েছে।

এবার শিবরাম আর থাকতে পারলেন না, কাজ ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন, সেই অর্ধ-উলঙ্গ রুক্ষ ধূলিধূসরমূর্তি পুরুষের দল, কালোপাথরকেটে-গড়া মূর্তির মত মানুষ উঠানে সারি দিয়ে বসেছে। পিছনে কালো ক্ষীণদেহ দীর্ঘাঙ্গী মেয়ের দল। কিন্তু কই–শবলা কই?

আচার্য আবার একবার মুখ তুলে তাকালেন ওদের দিকে। বললেন গতবারের ঝগড়া তা হলে মেটে নাই? আমি বুঝেছিলাম, বিষ গালতে গিয়ে মহাদেবের হাতটা বেঁকে গেল—সেই দেখেই বুঝেছিলাম। তা হলে দুজনেই গিয়েছে?

অর্থাৎ শবলার প্রাণ নিয়েছে মহাদেব, মহাদেবের প্রাণ নিয়েছে শবলা?

নূতন সর্দার সবে পৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছে। মহাদেবের মতই জোয়ান। তার দেহখানায় বহুকালের পুরনো মন্দিরের গায়ে শ্যাওলার দাগের মত দাগ পড়ে নাই, এত ধূলিধূসর হয়ে ওঠে নাই। সে মাথা হেঁট করে বললে না বাবা, সে পাপিনী কাললাগিনীর জানটা নিতে পারি নাই আমরা। লোহার বাসরঘরে লখিন্দরকে খেয়ে লাগিনী পলায়েছিল, বেহুলা তার পুচ্ছটা কেটে লিয়েছিল; আমরা তাও লেরেছি। বুডোর বুকের পাঁজরে লাগদন্ত বসায়ে দিয়া পড়ল গাঙের বুকে ঝাঁপায়ে ড়ুবল, মিলায়ে গেল। শেষ রাতের গাঙ, চারিপাশ আকাশের বুক থেক্যা গাঙের বুক পর্যন্ত অ্যাঁধার দেখতে পেলম না কুন্ দিকে গেল। রাতের অ্যাঁধারে কালো মেয়েটা যেন মিশায়ে গেল।

* * *

নতুন সর্দারের নাম গঙ্গারাম।

গঙ্গারাম মহাদেবের ভাইপো। গঙ্গারাম বেদেকুলে বিচিত্র মানুষ। সে এরই মধ্যে বার তিনেক জেল খেটেছে। অদ্ভুত জাদুবিদ্যা জানে সে। ওই জেলখানাতেই জাদুবিদ্যায় দীক্ষা নিয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়েও সে বড় একটা গ্রামে থাকত না। এখান ওখান করে বেড়াত, ভোজবিদ্যা জাদুবিদ্যা দেখাত, দেশে দেশে ঘুরত। এবার ওকে বাধ্য হয়ে সর্দারি নিতে হয়েছে। মহাদেবের ছেলে নাই। সে মরেছে অনেক দিন। বিধবা পুত্রবধূ শবলা—নাগিনী কন্যা মহাদেবকে নাগদন্তে দংশন করিয়ে তাকে হত্যা করে পালিয়েছে। এই মাত্র এক পক্ষ আগে। সাঁতালী থেকে বেরিয়েছে ওরা যথাসময়ে; হাঙরমুখীর খাল বেয়ে নৌকার সারি এসে গাঙে পড়ল; মহাদেব বললে–বাঁধ নৌকা রাতের মতুন।

ভাদ্রের শেষ, ভরা গঙ্গা। গঙ্গার জল ভাঙনের গায়ে ছলাৎ-ছল ছলাৎ-ছল শব্দে ঢেউ মারছে। মধ্যের বালুচর যেটা প্রায় সাত-আট মাস জেগে থাকে সেটার চিহ্ন দেখা যায় না। ভাঙা গাঙের পাড় থেকে মধ্যে মধ্যে ঝুপঝাপ শব্দে মাটি খসে পড়ছে। মধ্যে মধ্যে পড়ছে। বড় বড় চাঙর। বিপুল শব্দ উঠছে। দুলে দুলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে এপার থেকে ওপার পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।

মাথার উপরে কটা গগনভেরী পাখি কর-কর কর-কর শব্দ তুলে উড়ছিল। দূরে, বোধহয় আধ ক্রোশ তফাতে, ঝাউবনে ফেউ ডাকছিল। বাঘ বেরিয়েছে। হাঁসখালির মোহনার কাছাকাছিঘাসবনে বিশ্রী তীক্ষ্ণ ক্রুদ্ধ চিৎকার উঠছে, দুটো জানোয়ার চেঁচাচ্ছে। দুটো বুনো দাতাল শুয়োরে লড়াই লেগেছে। আশপাশে মধ্যে মধ্যে কোনো জলচর জল তোলপাড় করে ফিরছে। কোনো কুমির হবে। নৌকাগুলি এরই মধ্যে ঢেউয়ে দুলছিল। ছইয়ের মধ্যে প্রায় সবগুলি ডিবিয়ার আলোই নিবে গিয়েছে। ছইয়ের মাথায় জনচারেক জোয়ান বেদে বসে পাহারা দিচ্ছিল। কুমিরটা কাছে এলে হইহই করে উঠবে। তা ছাড়া, পাহারা দিচ্ছিল বেদের মেয়েরা, কেউ না এ-নৌকা থেকে ও-নৌকায় যায়।

এরই মধ্যে মহাদেবের নৌকা থেকে উঠল মর্মান্তিক চিৎকার। নৌকাখানা যেন প্ৰচণ্ড আলোড়নে উল্টে যায়-যায় হল। কি হল?

–কি হইছে? সর্দার? দাঁড়িয়ে উঠল বেদে পাহারাদারেরা ছইয়ের উপর। আবার হাঁকলে–সর্দার।

সর্দার সাড়া দিলে না। একটা কালো উলঙ্গ মূর্তি বেরিয়ে পড়ল সর্দারের ছই থেকে, মুহূর্তে ঝপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল গঙ্গার জলে। দূরে জলচর জীবটাও একবার উথল মেরে নিজের অস্তিত্ব। জানিয়ে দিলে। আরও বার দুই উথল মারলে, তারপর আর মারলে কি না দেখার কারও অবকাশ ছিল না।

সর্দারের চিৎকার তখনও উঠছে। গোঙাচ্ছে সে।

নৌকায় নৌকায় আলো জ্বলল। সর্দারের পাঁজরায় একটা লোহার কাটা বিঁধে ছিল। দেখে শিউরে উঠল সকলে।

নাগিনী কন্যের নাগন্ত। কন্যেদের নিজস্ব অস্ত্ৰ। বিষমাখা লোহার কাটা। এ যে কি বিষ, তা কেউ জানে না। নাগিনী কন্যেরাও জানে না। বিষের একটি চুঙিআদি বিষকন্যে থেকে হাতে হাতে চলে আসছে। ওই কাটাটা থাকে এই চুঙিতে বন্ধ। অহরহ বিষে সিক্ত হয়ে। এ সেই কাটা। সর্দারের চোখ দুটি আতঙ্কে যেন বিস্ফারিত হয়ে উঠছে।

গঙ্গারাম ডাকলে—কাকা! কাকা!

সর্দার কথা বললে না। হতাশায় ঘাড় নাড়লে শুধু। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তারপর বললে—জল।

জল খেয়ে হতাশভাবে ঘাড় নেড়ে বললে—শুধু আমার পরানটাই লিলে না লাগিনী, আমাকে লরকে ড়ুবায়ে গেল। অন্ধকারে মুই ভাবলম-এল বুঝি দধিমুখী, মুই–

হতাশায় মাথা নাড়লে, যেন মাথা ঠুকতে চাইলে মহাদেব।

শিউরে উঠল সকলে।

দধিমুখী মহাদেবের প্রণয়িনী, সমস্ত বেদে-পল্লীর মধ্যে এ প্রণয়ের কথা সকলেই জানে।

মেঝের উপর শবলার পরিত্যক্ত কাপড়খানা পড়ে রয়েছে। সর্বনাশী নাগিনী কন্যা এসেছিল। নিঃশব্দে। নৌকার দোলায় জেগে উঠল মহাদেব, সে ভাবলে—দধিমুখী এল বুঝি। সর্বনাশী বুড়ার আলিঙ্গনের মধ্যে ধরা দিয়ে তার বুকে বসিয়ে দিয়েছে নগদন্ত। শুধু তাকে হত্যা করবার অভিপ্রায় ছিল না তার, তাকে ধর্মে পতিত করে-পরকালে তার অনন্ত নরকের পথ প্রশস্ত করে। দিয়ে উলঙ্গিনী মূর্তিতে ঝাঁপ খেয়েছে গঙ্গায়।

গঙ্গারাম বললে—এ সব তো বাবার কাছে লতুন কথা লয়। ই সব তো আপুনি জানেন। কন্যেটার এ মতি অ্যানেক দিন থেক্যাই হয়েছিল বাবা-অ্যানেক দিন থেক্যা। ওই কন্যেগুলানেরই ওই ধারা।

****

কন্যাগুলির এই ধারাই বটে।

চকিতে শিবরামের মনে পড়ল শবলা তাকে বলেছিল-সে ওষুধ যদি না জান ধরমভাই, যদি দিতে না পার, তবে অঙ্গের জ্বালা জুড়াবার ওষুধ দাও। হিজল বিলের জলে ড়ুবি, মা-গঙ্গার জলে ভাসি, বাহির জুড়ায় ভিতর জুড়ায় না। তেমনি কোনো ওষুধ দাও, আমার সব জুড়ায়ে যাক।

গঙ্গারাম বললেওই নাগিনী কন্যেরা চিরটা কাল ওই করে আসছে। ওই উয়াদের ললাট, ওই উয়াদের স্বভাব। বিধেতার নির্দেশ। বেহুলা সতীর অভিশাপ।

সতীর পতিকে দংশন করলে কালনাগিনী।

সতীর দীর্ঘশ্বাসে কালনাগিনী কালনাগেরাও শেষ হয়ে গেল। বেহুলা সতী মরা পতি কোলে নিয়ে কলার মাঞ্জাসে অকূলে ভাসলে। দিন গেল, রাত্রি গেল, গেল কত বর্ষা, কত ঝড়, কত বজ্ৰাঘাত, এল কত পাপী, কত রাক্ষস, কত হাঙ্গর, কত কুম্ভীর, সে সবকে সহ্য করে উপেক্ষা করে সতী মরা পতির প্রাণ ফিরিয়ে আনলে; মা-বিষহরি মধামে নিজের পূজা পেলেন, চাদসাধুকে ফিরিয়ে দিলেন হারানো ছয় পুত, হারানো সপ্তডিঙা মধুকর; কিন্তু ভুলে গেলেন, হতভাগিনী কালনাগিনীর কথা। সতীর অভিশাপে যে কালনাগ সৃষ্টি থেকে বিলুপ্ত হল, তারা আর ফিরল না। কালনাগিনী নরকুলে জন্মায়, কিন্তু কালনাগিনীর ভাগ্য নিয়েই জন্মায়। তার স্বামী নাই; তাই যে বেদের ছেলের সঙ্গে তার শাদি হয়, শিশুকালে নাগদংশনে তার প্রাণটা যায়। তারপর নাগিনী কন্যার লক্ষণ ফোটে তার অঙ্গে। তখন সে পায় মা-মনসার বারি, পায় তাঁর পূজার ভারও; কিন্তু পতি পায় না, ঘর পায় না, পুত্র পায় না হতভাগিনী। তারপর নাগিনী স্বভাব বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎ বাধে তার সর্দারের সঙ্গে কলহ।

গঙ্গারাম বললে-বাবা, ওইটি হল পেথম লক্ষণ। বুঝলে না! বাপের উপর পড়ে আক্রোশ। বাপের ঘরে ধরে অরুচি।

****

গতবার মহাদেব এই ধন্বন্তরি বাবার উঠানে বিষ গালতে বসে এই কথাই বলেছিল; বলতে গিয়ে এমন উত্তেজিত হয়েছিল যে, হঠাৎ তার সাপের মুখধরা হাতখানা চঞ্চল হয়ে বেঁকে গিয়েছিল। তীক্ষ্ণদৃষ্টি বেদের মেয়ে শবলা ঠিক মুহূর্তে তার হাত সরিয়ে নিয়েছিল, তাই রক্ষা পেয়েছিল, নইলে সেদিন শবলাই যেত। মহাদেব বলেছিল—মেয়েটার রীতিচরিত্র বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মনে তার পাপ ঢুকেছে। সে আরও সেদিন বলেছিল, জাতের স্বভাব যাবে কোথা বাবা, ও-জাতের ওই স্বভাবওই ধারা। মুহূর্তের জন্য নাগিনী কন্যা শবলার চোখ জ্বলে উঠেছিল, সে জ্বলে-ওঠা এক-আধ জনের চোখে পড়েছিল, অধিকাংশ মানুষের চোখেই পড়ে নাই–তাদের দৃষ্টি ছিল মহাদেবের মুখের দিকে। শিবরাম দেখেছিলেন। বোধ করি তারুণ্যধর্মের অমোঘ নিয়মে তার দৃষ্টি ওই মোহময়ী কালো বেদের মেয়ের মুখের উপরই নিবদ্ধ ছিল, তাই চোখে পড়েছিল। না হলে তিনিও দেখতে পেতেন না; কারণ মুহূর্ত মধ্যেই সে দীপ্তি নিবে। গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, মেয়েটার নারীরূপের ছদ্মবেশ ভেদ করে মুহূর্তের জন্য তার নাগিনী। রূপ ফণা ধরে মুখ বের করেই আবার আত্মগোপন করলে।

আচার্য বলেছিলেন–শিরবেদে আর বিষহরির কন্যে—বাপ আর বেটি। বাপ-বেটির ঝগড়া মিটিয়ে নিয়ো।

বাপের উপর আক্রোশ পড়েছিল নাগিনী কন্যের।

পড়বে না? কত সহ্য করবে শবলা? কেন সহ্য করবে? সাধে বাপের উপর আক্রোশ পড়ে কন্যের কম দুঃখে পড়ে?

সাপের বিষকে পৃথিবীতে বলেহলাহল। মানুষের রক্তে এক ফোঁটা পড়লে মানুষের মৃত্যু হয়; দুর্গম পাহাড়ের মাথায় ঘন অরণ্যের ভিতর যাও দেখবে পাথর ফাটিয়ে গাছ জন্মেছে, সে গাছ আকাশ ছুঁতে চলেছে; জন্মেছে লোহার শিকলের মত মোটা লতা, একটি গাছ জড়িয়ে মাথার উপর উঠে সে গাছ ছাড়িয়ে গাছের মাথায় মাথায় লতার ভাল তৈরি করেছে; দেখবে পাহাড়ের বুক ছেয়ে বিচিত্র ঘাসের বন; তারই মধ্যে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে দেখবে স্থানে স্থানে জেগে রয়েছে এক-একখানা পাথরঘাস না, শ্যাওলা না, কঠিন কালো তার রূপ। ভাল করে দেখলে দেখতে পাবে, তার চারিপাশে জমে রয়েছে মাটির গুড়োর মত কিছু; মাটির গুড়ো নয়, পিঁপড়ে জাতীয় কীট। তোমরা জান না, বেদেরা জানে, ও পাথর বিষশৈল—বিষপাথরে পরিণত হয়েছে। এই পাহাড়ের মাথায় ঘন বনে বাস করে শঙ্খচূড় নাগ। সাত-আট হাত লম্বা কালো রঙের ভীষণ বিষধর। তারা রাত্রে এসে দংশন করে বিষ ঢালে ওই পাথরের উপর। পাথরটা মরে গিয়েছে, গাছ তো গাছ, ওতে শ্যাওলা ধরবে না কখনও। সাপের বিষের এক ফোঁটায় মানুষ মরে, এক ফোঁটা পাথরের বুকে পড়লে পাথরের বুকও জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় চিরদিনের মত। পিঁপড়েগুলো ওই পাথরের বুকে চটচটে বিষকে রস মনে করে দল বেঁধে ছেয়ে ধরেছিল, বিষে জরে ধুলো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে ভীষণ হল এক টুকরো রুপো—এক বিন্দু সোনা। তারও চেয়ে ভীষণ হল আটন গো আটন।

নাগিনী কন্যার আটনে বসে মা-বিষহরির বারিতে ফুল জল দিয়ে কি করে সে সহ্য করবে বুড়ার অনাচার?

গতবার যখন এই ধন্বন্তরি বাবার এইখানেই তারা এল বিষ বিক্রি করবার জন্য, তখন কি সকলে শবলাকে বলে নি, বলে নিকন্যে, তু বুল সদ্দারকে—যার যা পাওনা সব এই ঠাঁইয়েই মিটিয়ে দিক? লইলে—

নোটন যে নোটন—মহাদেবের অতি অনুগত লোক—সেই নোটনও বলেছিল—গেল বারের হিসাবটা, সেও মিল না ই বছর তাকাত।

সেই কথাতে বিবাদ। নাগিনী কন্যা বিষহরির পূজারিণী, বেদেকুলের কল্যাণ করাই তার কাজ; সেই তার ধর্ম—এ কথা সে না বললে বলবে কে? এই বলতে গিয়েই তো বিপদ। ঝগড়ার শুরু। সে সবারই অধরম দেখে বেড়াবে, কিন্তু সে নিজে অধরম করবে তাতে কেউ কিছু বললে সে-ই হবে বজ্জাত!

বিষহরি পূজার প্রণামী-পূজার সামগ্ৰী ভাগও করবে নাগিনী কন্যা। কন্যের এক ভাগ, শিরবেদের এক ভাগ, বাকি দু ভাগ সকল বেদের। কন্যের ভাগ আবার হয় দু-ভাগ পুরনো নাগিনী কন্যে পায়, যে বেদের ঘরে বেদে নাই সে ঘরের মেয়েরা পায়। এই সব ভাগ নিয়ে বিবাদ। সমস্ত ভাল সামগ্রীর উপর দাবি ওই সর্দারের। হবে না-হবে না বিবাদ!

এ বিবাদ চিরকালের। চিরকাল এ বিবাদ হয়ে আসছে। কখনও জেতে শিরবেদে, কখনও জেতে কন্যে। কন্যে জেতে কম; জিতলেও সে জয় শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় পরাজয়ে। মা-বিষহরির পূজারিণী এই কন্যে, ও যে অন্তরে অন্তরে নাগিনী, ওকে দংশন করেই পালাতে হয়; না পারলে ঘটে মরণ। তা ছাড়া বেহুলার অভিশাপ ওদের ললাটে, হঠাৎ একদিন সেই অভিশাপের ফল। ফলে। দেহে মনে ধরে জ্বালা। রাত্রে ঘুম আসে না চোখে, মাটির উপর পড়ে অকারণে কঁদে। হঠাৎ মনে হয় যেন কে কোথায় শিস দিচ্ছে।

শিবরামের সঙ্গে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, সেই দিন রাত্রে শবলা তাদের আড্ডায় শুয়ে ছিল বিনিদ্র চোখে। ঘুম আসছিল না চোখে। মধ্যরাত্রের শেয়াল ডেকে গেল। গঙ্গার কূলের বড়। বড় গাছ থেকে বাদুড়েরা কালো ডানা মেলে উড়ে গেল এপার থেকে ওপার, এল ওপার থেকে এপার; গাছে গাছে পেঁচা ডেকে উঠল। বেদেনীর মাথার উপরে গাছের ডালে ঝুলানো ঝাঁপির মধ্যে বন্দি সাপগুলো যুঁসিয়ে উঠল। বেদেনীর অন্তরটাও যেন কেমন করে উঠল। গভীর রাত্রে ডাইনীর বুকের ভিতর খলবল করে ওঠে, শ্মশানে কালীসাধক মা-মা বলে ডেকে ওঠে, চোরডাকাতের ঘুম ভেঙে যায় শেয়ালের ডাকে, বিছানায় ঘুমন্ত রোগীও একবার ছটফট করে উঠবে। এই ক্ষণটিতে, ঠিক এই ক্ষণটিতে নাগিনী কন্যার অন্তরের মধ্যে কালনাগিনী স্বরূপ নিয়ে জেগে ওঠে; নিত্যই ওঠে। কিন্তু বিছানার খুঁট ধরে দাঁতে দাঁত টিপে নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকতে হয়। নাগিনী কন্যাকে। এই নিয়ম। কিছুক্ষণ পর বন্ধকরা নিশ্বাস যখন বুকের পাঁজরা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসবে মনে হয়—তখন ছাড়তে হয় নিশ্বাস। তারপর যখন হাপরের মত হাঁপায় বুকের। ভিতরটা তখন উঠে বসতে হয়। চুল এলিয়ে থাকলে চুল বেঁধে নিতে হয়, এঁটেসেঁটে নতুন করে কষে কাপড় পরতে হয়। বিষহরির নাম জপ করতে হয়। তারপর আবার শোয়। নাগিনী কন্যের অন্তরের নাগিনী তখন চোয়াল-টিপে-ধরা নাগিনীর মত হারমানে, তখন সে খোঁজে কাঁপি, অন্তরের ঝাপিতে ঢুকে নিস্তেজ হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে। তা না করে যদি নাগিনী কন্যে বিছানা ছেড়ে ওঠে, বাইরে বেরিয়ে আসে তবে তার সর্বনাশ হয়।

রাতের অ্যাঁধার তার চোখে-মনে নিশির নেশা ধরিয়ে দেয়।

নিশির নেশা–নিশির ডাকের চেয়েও ভয়ঙ্কর। নিশির ডাক মানুষ জীবনে শোনে কালেকস্মিনে। নিশির নেশা রোজ নিত্য-নিয়মিত ডাকে মানুষকে। ওই হিজল বনের চারিপাশে জ্বলে আলেয়ার আলো। ঘন বনের মধ্যে বাজে বাঁশের বশি। হিজলের ঘাসবনে এখানে ডাকে বাঘ, ওখানে ডাকে বাঘিনী। বিলের এ-মাথায় ডাকে চকা, ও-মাথায় ডাকে চকী। বনকুকী পাখিরা পাখিনীদের ডাকে–পাখিনীরা সাড়া দেয়–

–কুক!

–কুক!

–কুক!

–কুক!

নাগিনীও পাগল হয়ে যায়। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ভুলে যায়। ভুলে যায় মা-বিষহরির নির্দেশ, ভুলে যায় বেহুলার অভিশাপের কাহিনী, ভুলে যায় তার নিজের শপথের কথা। বেদের শিরবেদের শাসন ভুলে যায়, মানসম্মান পাপ-পুণ্য সব ভুলে যায়; ভুলে গিয়ে সে ঘর ছেড়ে নামে পথে। তারপর ওই ঘন ঘাসবনের ভিতর দিয়ে চলে—শনশন করে কালনাগিনীর মতই চলে। সমস্ত রাত্রি উদ্ভ্রান্তের মত ঘোরে; ঘাসবনের ভিতর দিয়ে, কুমিরখালার কিনারায় কিনারায়, হিজলের চারিপাশে ঘুরে বেড়ায়।

বাঁশি! কে বাঁশি বাজায় গ! কোথায় গ!

রাত্রির পর রাত্রি ঘোরে নাগিনী কন্যা। একদিন বেরিয়ে এলে আর নিস্তার নাই। রোজ রাত্রে নিশির নেশা ধরবে, যেন চুলের মুঠো ধরে টেনে নিয়ে যাবে।

এক নাগিনী কন্যেকে ধরেছিল এই নেশা তার প্রাণ গিয়েছিল বাঘের মুখে। এক নাগিনী কন্যের দেহ পাওয়া গিয়েছিল বিলের জলে। এক কন্যের উদ্দেশ মেলে নাই। হাঙরমুখী খালে পাওয়া গিয়েছিল তার লাল কাপড়ের ছেড়া খানিকটা অংশ। কুমিরের পেটে গিয়েছিল সে।

জন দুই-তিন পাগল হয়ে গিয়েছিল। হিজল বিলের ধারে সর্বাঙ্গে কাদা মেখে বসে ছিল, চোখ দুটি হয়েছিল কুঁচের মত লাল। কেউ কেবলই কেঁদেছে, কেউ কেবলই হেসেছে।

জন চারেকের হয়েছে চরম সর্বনাশ। সর্বনাশীরা ফিরেছে—ধৰ্ম বিসর্জন দিয়ে। কিছুদিন পরই অঙ্গে দেখা দিয়েছে মাতৃত্বের লক্ষণ। তখন ওই সন্তানকে নষ্ট করতে গিয়ে নিজে মরেছে। কেউ পালাতে চেয়েছে। কেউ পালিয়েছে। কিন্তু পালিয়েও তো রক্ষা পায় নি তারা। রক্ষা পায় না। হয় মরেছে বেদে-সমাজের মন্ত্ৰপূত বাণের আঘাতে নয়তো নাগিনী-ধর্মের অমোঘ নির্দেশে প্রসবের পরই নখ দিয়ে টুঁটি টিপে সন্তানকে হত্যা করেছে। ডিম ফুটে সন্তান বের হবামাত্র নাগিনী সন্তান খায়-নাগিনী কন্যাকেও সেই ধর্ম পালন করতেই হবে। নিষ্কৃতি কোথায়? ধর্ম ঘাড়ে ধরে করাবে যে!

নিশির নেশা—নাগিনী কন্যের মৃত্যুযোগ। রাত্রি দ্বিপ্রহর ঘোষণার লগ্নে চোখ বন্ধ করে, শ্বাস রুদ্ধ করে, দতে দত টিপে দু হাতে খুঁট অ্যাঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে নাগিনী কন্যে।

গঙ্গার কূলে বটগাছের তলায় খেজুর-চাটাইয়ের খুঁট চেপে ধরতে গিয়েও সেদিন শবলা তা ধরলে না। কি হবে ও? কি হবে? কি হবে? এত বড় জোয়ানটাই তার জন্যে প্রাণটা দিয়েছে। না হয় সেও প্রাণটা দেবে। তার প্রেতাত্মা যদি ওই গঙ্গার ধারে এসে থাকে? বুকের ভিতরটা তার হুহু করে উঠল। উঠে বসল সে খেজুর-চাটাইয়ের উপর।

আকাশ থেকে মাটির বুক পর্যন্ত থমথম করছে অন্ধকার। আকাশে সাতভাই তারা ঘুরপাক। খেয়ে হেলে পড়বার উদ্যোগ করছে। চারিদিকটায় দুপহর ঘোষণার ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। নিশির ডাক এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল। শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, ধক-ধক-ধক-ধক। চোখে তার আর পলক পড়ছে না।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে রয়েছে। গাছপালা মিশে গিয়েছে অন্ধকারের সঙ্গে, শহর ঢেকে। গিয়েছে অন্ধকারের মধ্যে, ঘাট মাঠ ক্ষেত খামার বন বসতি বাজার হাট মানুষ জন—সব-সবসব অন্ধকারের মধ্যে মিশে গিয়েছে। যেন কিছুই নাই কোথাও; আছে শুধু অন্ধকার–জগৎজোড়া এক কালো পাথা—র–

সে উঠল; এগিয়ে চলল। এগিয়ে চলল গঙ্গার দিকে। গঙ্গার উঁচু পাড় ভেঙে সে নেমে গিয়ে বসল—সেইখানটিতে, যেখানটিতে সেদিন সেই জোয়ান ছেলেটা তার জন্যে বসে ছিল। একটানা ছলছল ছলছল শব্দ উঠছে গঙ্গার স্রোতে, মধ্যে মধ্যে গঙ্গার স্রোত পাড়ের উপর। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে। পাশেই একটু দূরে তাদের নৌকাগুলি দোল খাচ্ছে। ভিজে। মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে সে কাঁদতে লাগল।

ইচ্ছে হল, সেও ঝাঁপ দেয় গঙ্গার জলে।

মা-গঙ্গা! মোর অঙ্গের জ্বালা তুমি জুড়িয়ে দিয়ে, মুছিয়ে দিয়ে। মা গঙ্গা! আমার জন্যে শুধু আমার জন্যে সে দিলে তার পরানটা! হায় রে! হায় রে!

তার বুকে জ্বালাও তো কম নয়। জ্বালা কি শুধু বুকে? জ্বালা যে সর্বাঙ্গে।

হঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজে চমকে উঠল সে। চিনতে পারল সে, এ কার গলার আওয়াজ। বুড়ার! বুড়া ঠিক জেগেছে। ঠিক বুঝতে পেরেছে। দেখেছে, শবলার বিছানায় শবলা নাই।

মুহূর্তে শবলা নেমে পড়ল গঙ্গার জলে। একটু পাশেই তাদের নৌকাগুলি গাঙের ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে। সে সেই নৌকাগুলির ধারে ধারে ঘুরে একটি নৌকায় উঠে পড়ল। এটি তারই নৌকা। লাগিনী কন্যের লা। মা-বিষহরির বারি আছে এই নৌকায়। উপুড় হয়ে সে পড়ে রইল বারির সামনে। রক্ষা কর মা, রক্ষা কর। বুড়ার হাত থেকে রক্ষা কর। নিশির নেশা থেকে শবলারে তুমি বাঁচাও। বেদেকুলের পুণ্যি যেন শবলা থেকে নষ্ট না হয়। জোয়ানটার প্রাণ গিয়েছে—তুমি যদি নিয়েছ মা, তবে শবলার বলবার কিছু নাই। কিন্তু মা গ, জননী গ, যদি মানুষে ষড়যন্ত্র করে নিয়ে থাকে তবে তুমি তার বিচার কোরো। সূক্ষ্ম বিচার তোমার মা–সেই বিচারে দণ্ড দিয়ে।

-–তুমি তার বিচার করো মা বিচার কোরো।

কখন যে সে চিৎকার করে উঠেছিল, সে নিজেই জানে না। কিন্তু সে চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল নৌকার পাহারাদারদের। তারা সভয়ে সন্তৰ্পণে এসে দেখলে শবলা পড়ে আছে বিষহরির বারির সম্মুখে। চিৎকার করছে—বিচার কোরো। বেদের ছেলেরা জানে, নাগিনী কন্যার আত্মা–সে মানুষের আত্মা নয়, নাগকুলের নাগ-আত্মা। বিষহরি তার হাতে পুজো নেবেন বলে তাকে পাঠান বেদেকুলে জন্ম নিতে। তার ভর হয়। চোখ রাঙা হয়ে ওঠে—চুল এলিয়ে পড়ে—সে তখন আর আপনার মধ্যে আত্মস্থ থাকে না। সাক্ষাৎ দেবতার সঙ্গে তার তখন যোগাযোগ হয়। বেদেকুলের পাপপুণ্যের পট খুলে যায় তার লাল চোখের সামনে। সে অনর্গল বলে যায়—এই পাপ, এই পাপ। হবে না–এমন হবে না?

বেদের ছেলেরা শিউরে উঠল ভয়ে। ভিজে কাপড়ে ভিজে চুলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নাগিনী কন্যে। হাত জোড় করে চিৎকার করছে—বিচার কোরো।

তারা নৌকাতে উঠছে নৌকা দুলছে—তবু হুঁশ নাই। এ নিশ্চয় ভর। এই নিশীথ রাত্রি এই চিৎকার, উঃ! চিৎকারে অন্ধকারটা যেন চিরে যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে ঘুমন্ত বেদেরা জেগে উঠল। এসে ভিড় করে দাঁড়াল গঙ্গার কূলে। হাত জোড় করে সমবেত স্বরে চিৎকার করে উঠলরক্ষা কর মা, রক্ষা কর।

কিন্তু সর্দার কই? সর্দার? বুড়া? বুড়া কই?

ভাদু বেদে কলে–সর্দার! অ–গ! কই? কই?

কোথায় বুড়া? বুড়া নাই।

ভাদু শবলার কাকা। ভাদু বললে শবলার মাকে। প্রৌঢ়া সুরধুনী বেদেনীকে বললে—ভাজ বউ গ, তুমি দেখ একবার। কন্যেটারে ডাক।

বেদেনী ঘাড় নাড়লেনা দেওর, লারব। ওরে কি এখুন ছোঁয়া যায়?

–তবে?

–তবে সবাই মিল্যা একজোট হয়ে চিল্লায়ে ডাক দাও। দেখ কি হয়?

—সেই ভাল। লে গ,–সবাই মিল্যা একসাথে লে। হে—মা–

সকলে সুর মিশিয়ে দিলে একসঙ্গে।—হে মা-বিষহরি গ! স্তব্ধ নিশীথ রাত্রির সুষুপ্ত সৃষ্টি চকিত হয়ে উঠল। ধ্বনির প্রতিধ্বনি উঠল গঙ্গার কূলে ও-পাশের ঘন বৃক্ষসন্নিবেশে, ছুটে গেল এ পারের প্রান্তরে, ছড়িয়ে পড়ল দিগন্তরে। শবলার চেতনা ফিরে এল। সে মাথা তুললে।—কি?

পরমুহূর্তেই সে সব বুঝতে পারলে। তার ভর এসেছিল। দেবতা তার পরান পুতলির মাথার উপর হাত রেখেছিলেন। শরীরটা এখনও তার ঝিমঝিম করছে। তবু সে উঠে। বসল।

উঠিছে, উঠে বসিছে, কন্যে উঠে বসিছে গ!–বললে জটাধারী বেদে।

বেদেরা আবার ধ্বনি দিলে—জয় মা-বিষহরি!

টলতে টলতে বেরিয়ে এল শবলা।

—ধর গ। ভাজবউ, কন্যেরে ধর। টলিছে।

সুরধুনী বেদেনী এবার জলে নামল।

–কি হছিল কন্যে? বেটি?

শবলা বললে–মা দেখা দিলেন গ। পরশ দিলেন।

—কি কইলেন?

–কইলেন? চোখ দুটো ঝকমক করে উঠল তার। সে বললে—সূক্ষ্ম বিচার করবেন না। সুতার ধারে সূক্ষ্ম বিচার।

ঠিক এই সময় তটভূমির উপর কুকুরের চিৎকার শোনা গেল। সকলে চমকে উঠল।

কি সে গলার আওয়াজ কুকুরের! একসঙ্গে দু-তিনটে চিৎকার করে ছুটে আসছে। কাউকে যেন তাড়া করে আসছে।

ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়াল দৈত্যের মত একটা মানুষ।

সর্দার! শিরবেদে!

তার পিছনে ছুটে আসছে দুটো মুখ-থ্যাবড়া সাদা কুকুর।

লাঠি! ভাদু লোটন, লাঠি! খেয়ে ফেলবে, ছিঁড়ে ফেলাবে!

সঙ্গে সতে ই এল লাঠি লোহার ডাণ্ডা। চিৎকার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে মহাদেবকে।

–হুই বড় বাড়িটার পোষা বিলাতি কুকুর! হুই!

মহাদেব গিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে ভিতরে লাফিয়ে পড়বামাত্র তাড়া করেছিল। পাঁচিল ডিঙিয়েই সে পালিয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে তারাও এসেছে। সারাটা পথ মধ্যে মধ্যে দাঁড়িয়ে ঢেলা ছুঁড়ে রুখতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নাই। ঢেলা তারা মানে নাই। হাতে একটা লোহার ডাণ্ডা ছিল। লাফ দিয়ে পড়বার আগে সে পঁচিল থেকে ডাণ্ডাটা ভিতরে ছুঁড়ে ফেলেছিল সেটা আর কুঁড়িয়ে নেবার অবকাশ হয় নাই। তার আগেই কুকুর দুটো এসে পড়েছিল।

–কিন্তুক হোথাকে গেছিলি ক্যানে তু?

–ক্যানে? মহাদেবের ইচ্ছে হল শবলার টুঁটিটা হাতের নখে বিঁধে ঝাজরা করে দেয়। সে তাকাল শবলার দিকে।

শবলার চোখ দুটি ফুঁ-দেওয়া আঙরার মত ধকধক করে উঠল। সে বললে কুকুরের কামড়ে মরবি না তু। মরবি তু লাগিনীর পাঁতে। মা বুলেছে আমাকে। আজ তার সাথে আমার বাত হল্ছে। সূক্ষ্ম বিচার করবেন জননী।

মহাদেব চিৎকার করে উঠল—পাপিনী!

মুহূর্তে তার হাত চেপে ধরে ভাদু প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল—সর্দার!

মহাদেবও চিৎকার করে উঠল—অ্যাই! হাত ছাড়া পাপিনীরে আমি–

—আঃ! মুখ খ্যা যাবে তুর। সারা বেদেপাড়া দেখেছি—কন্যের পরে আজ জননীর ভর হছিল। উ সব বুলিস না তু। তু দেখলি না—তুর ভাগ্যি।

শবলা হেসে বললে—উ গেলছিল আমাকে খুঁজতে। সে দিনে আমি উ-বাড়ির রাজাবাবুকে লাচন দেখছি, গায়েন শোনাল্ছি; বাবু আমাকে টকটকে রাঙারবন শাড়ি দিছে, তাই উ রেতে আমাকে বিছানাতে না দেখে গেছিল আমার সন্ধানে হোথাকে। ভেবেছিল আমি পাপ করতে গেছি। ইয়ার বিচার হবে। মা আমাকে কইলেন বিচার হবে, সূক্ষ্ম বিচার হবে।

স্তব্ধ হয়ে রইল গোটা দলটা। শঙ্কা যেন চোখে মুখে থমথম করছে।

স্থিরদৃষ্টিতে মহাদেব তাকিয়ে রইল শবলার মুখের দিকে। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন উঠল, সত্যিই শবলা মা-বিষহরির বারির পায়ের তলায় ধ্যান করছিল? মা তাকে ডেকেছিলেন? হাতপায়ের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে, কিন্তু মহাদেবের তাতে গ্রাহ্য নাই। পায়ের ক্ষতটাই বেশি। খানিকটা মাংস যেন তুলে নিয়েছে। তার ক্ৰক্ষেপ নাই। সে ভাবছে। শবলা বললে রক্তগুলান ধুয়ে ফেল বুড়া, আমার মুখের দিকে তাকায় থেক্য কি করব? কি হবেক? লে, ধুয়ে ফেল, খানিক রেড়ির তেল লাগায়ে লে। বিলাতি কুকুরের বিষ নাই, কুকুরের মতুন ঘেউ ঘেউ করা চেঁচায়ে ত মরবি না। উ কামড়ে মরণ নাই তুর ললাটে, কিন্তুক উঁটুরে উঠে পাকলি পর কষ্ট পাবি। আর–

ভাদুর মুখের দিকে চেয়ে বললে—আর মরা কুকুর দুটারে লায়ে করে নিয়া মাঝগাঙে ভাসায়ে দে। সকালেই বাবুর বাড়িতে কুকুরের খোঁজ হবেক। চারিদিকে লোক ছুটবেক। দেখতে পেলে মরণ হবে গোটা দলের। বুঝলা না? ভাসায়ে দিয়া আয়। আর শুন। ভোর হতে হতে আস্তানা গুটায় লে। লায়ে লায়ে তল্যা দে চিজবিজ। ইখানে আর লয়।

মহাদেব স্তব্ধ হয়েই রইল। কোনো কথা সে বললে না। কিন্তু রাত দুপ্রহরেই সেই। ঘোরালো লগনটিতে-পেঁচার ডাকে শিবাদের হাঁকে, গাছের সাড়ায় বাদুড়ের পাখার ঝাপটানিতে, ঠিক নিশি যখন জাগল-ইশারা পাঠালে পরানে পরানে ঠিক তখনই সেই মুহূর্তটিতেই যে তারও ঘুম ভেঙেছিল। নিত্যই যে ভাঙে। শিরবেদের ঘুম ভাঙে মা-বিষহরির। আজ্ঞায়, শিরবেদে উঠে তার লোহার ডাণ্ডা হাতে–দণ্ডধরের মত বেদেকুলের ধমের পথ রক্ষা। করে। লগনটি পার হয়তখন মহাদেব ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় দধিমুখী বেদেনীর ঘরের ধারে। দধিমুখীও জাগে, সেও বেরিয়ে আসে। তখন শিরবেদে আর দণ্ডধর নয়। সে তখন সাধারণ মনিষ্যি।

এখানেও আজ কদিন এসেছে। মহাদেবের ঠিক লগনে ঘুম ভেঙেছে ঘুম ভেঙেছে নয়, মহাদেব এ লগনের আগে এখানে ঘুমায় নাই। সে সতর্ক হয়ে লক্ষ্য রেখেছিল—ওই জোয়ানটার। দিকে। পাপিনী কন্যের দিকে তো বটেই। জোয়ানটা গিয়েছে। মা-বিষহরির আজ্ঞায় সে ছেড়েছিল ওই রাজ গোখরাটাকে। বলেছিলপাপীর পরান তু লিবি ত লাককুলের রাজপুর বিচারের ভার তোরে দিলাম। জোয়ানটার পিছনে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। বাঁশের চোঙায় পুরে দড়ি টেনে খুলে দিয়েছিল চোঙার মুখের ন্যাকড়াটা।

পাপী জোয়ানটা গিয়েছে। কিন্তু–। সে ভেবেছিল, একসঙ্গে দুজনে যাবে। পাপী-পাপিনী দুজনে। কিন্তু জোয়ানটা একা গেল।

আজ সেই লগনে উঠে সে স্পষ্ট দেখেছে, নাগিনী উঠল—কালনাগিনী—বটগাছটাকে বেড় দিয়ে ওপাশে গেল। সেও সন্তৰ্পণে তার পিছনে পিছনে বটগাছটার এপাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চোখে পড়েছিল অন্ধকারের মধ্যে বড় বাড়িটার মাথায় জ্বলজ্বলে আলোটা। মনে পড়েছিল, ওই বাড়িতে শবলা রাঙা শাড়ি, ষোল আনা বকশিশ পেয়েছে—সেই কথা, রাঙাবরন সোনার রাজপুত্রের কথা অন্য বেদেনীদের কাছে শবলাকে বলতেও সে নিজের কানে শুনেছে। পাপিনীর চোখে নিশির নেশার ঘোরের মত ঘোর জমতে দেখেছে।

পাপিনী নাগিনী কন্যের বুকে তা হলে কাঠালীচাপার বাসের ঘোর জেগেছে! সেই ঘোরে। দিশা হারিয়ে সে নিশ্চয় গিয়েছে ওই বড় বাড়ির পথে—সেই সোনার বরন রাজপুত্রের টানে টানে। স্থিরদৃষ্টিতে শিরবেদে তাকিয়ে রইল ওই পথের দিকে। কত দূরে চলেছে সে পাপিনী! হঠাৎ এক সময় মনে হল—এই যে, সাদা কাপড় পরা কালো পাতলা মেয়েটা লঘুপায়ে ছুটে চলে যাচ্ছে! শনশন করে চলে যাচ্ছে কালনাগিনীর মত। ওই যে! সেও ছুটল।

কোনোদিকে সে চোখ ফেরায় নি। সাদা কাপড় পরা কালো পাতলা মেয়েটাকেসে যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে চলতে দেখেছে। নাগিনীর পায়ে পাখা গজায়-এই লগে; সে হাঁটে না, উড়ে চলে। ঠিক তাই। পিছনে সাধ্যমত দ্রুত পায়ে মহাদেব তাকে অনুসরণ করেছে, সে ছুটেছে। ওই পাচিলের কোল পর্যন্ত আসতে ঠিক দেখেছে।

পঁচিলের এপারে তাকে দেখতে না পেয়ে সে পাচিলের উপর উঠে বসেছিল। কুকুরে করেছিল তাড়া। পালিয়ে আসতে সে বাধ্য হয়েছিল।

তবে? তবে এ কি হল? সেই কন্যে এখানে মা মনসার বারির সামনে কেমন করে এল?

যেমন করেই আসুক, বেদেদের কাছে তার মাথা হেঁট হয়ে গেল। নাগিনী তার সে হেঁট। মাথার উপর ফণা তুলে দুলছে। যে-কোনো মুহূর্তে ওকে দংশন করতে পারে।

উঠ বুড়া, উঠ। লা ছাড়বে।–বললে শবলা।

ভোর হতে না হতে বেদেদের নৌকা ভাসল মাঝ-গঙ্গায়।

দক্ষিণে–দক্ষিণে। স্রোতের টানে ভাসবে লা। দক্ষিণে।
এ কথাগুলি শিবরামের নয়। এ কথা পিঙলা অর্থাৎ পিঙ্গলার; পিঙলাই হল শবলার পরে সাঁতালী গাঁয়ের বেদেকুলের নতুন নাগিনী কন্যা। এই পিঙলাই শিবরামকে শবলার এই কাহিনী বলেছিল।

বলতে বলতেই পিঙলা বলে–মায়ের লীলা। বেদেকুলের মা বলতে বিষহরি, বেদেদের অন্য মা নাই। কালী না, দুর্গা না—কেউ না। বেদেদের বাপ বলতে শিব। শিবের মানস থেকে মা-বিষহরির জনম গ। পদ্মবনের মধ্যে শিবের মনের থেকে জন্ম নিয়া পদ্মপাতের মধ্যে ধীরে ধীরে মা বড় হয়্যা উঠলেন। মায়ের আমার পদ্মবনে বাস-অঙ্গের বরন পদ্মফুলের মত। শিবঠাকুরের মধুপান কর্যা নেশা হয় না, তাই শিবের কন্যা পদ্মবনে পদ্মমধু পান করলেন, সেই কন্যের কণ্ঠে–অমৃতের থেকা মধু হইল; তখন সেই মধু খাইলেন শিব। সেই মধুতে তার কণ্ঠ। হল নীল বরন, মধুর পিপাসা মিট্যা গেল চিরদিনের তরে; চক্ষু দুটি আনন্দে হল ঢুলুঢুলু! শিবের কন্যে পদ্মাবতী পদ্মের মত দেহের বরন, তেমনি তার অঙ্গের সৌরভ, মা হলেন চিরযুবতী।

এই মায়ের পূজার ভার যার উপরে, তার কি বুড়ো হইবার উপায় আছে গ? যুবতী মায়ের পূজা করবে যুবতী কন্যে। তবে সে কালনাগিনী বলে তার অঙ্গের বরন হবে কালো। চিকন চিকচিকে কালো মনোহরণ করা কালোবরন। সেই কারণে এক নাগিনী কন্যে বর্তমানেই নতুন নাগিনী কন্যের আবির্ভাব হয়। সেই আবির্ভাব শিরবেদের চক্ষে ধরা পড়ে। কন্যে অনাচার করে, কন্যে বুড়ি হয়—কত কারণ ঘটে; তখন শিরবেদে মনে মনে মায়েরে ডাকে। অ্যাঁধার বর্ষার রাত্রে কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে আকাশে ঘনঘটা করে মেঘ ওঠে; থমথম করে চারিদিক, শিরবেদে আকাশপানে তাকায়। মিলিয়ে নেয় যে রাত্রে বেদেদের সর্বনাশ হয়েছিল সেই রাত্রির সঙ্গে। ওগো, যে রাত্রে লোহার বাসর ঘরে লখিন্দরকে কালনাগিনী দংশন করেছিল—সেই রাত্রের সঙ্গে গ! মেঘের ঘনঘটার মধ্যে মা-বিষহরির দরবার বসে। সামনে আসছে বর্ষা; পঞ্চমীতে পঞ্চমীতে নাগজননীর পূজা; মা দরবার করে খবর নেন—নতুন কালের পৃথিবীতে কে আছে চাঁদ সদাগরের মত অবিশ্বাসী! কোথায় কোন ভক্তিমতী বেনেবেটির হল আবির্ভাব। তেমনি কৃষ্ণাপঞ্চমীর রাত্রি পেলে শিরবেদে বসবে মায়ের পূজায়। ঘরে কপাট দিয়ে পূজায় বসবে! মাকে ডাকবে মামা-মা-মা! প্ৰদীপ জ্বালবে, ধূপ পুড়াবে, ধূপের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে। ধারালো ছুরি দিয়ে বুকের চামড়া চিরে রক্ত নিয়ে সেই রক্ত নিবেদন করবে মাকে। তখন মেঘলোকে মাবিষহরির আটন একটু টলে উঠবে মায়ের মুকুটের রাজগোখুরা ফণা দুলায়ে হিসহিস করবে। মা বলবেন তার সহচরীকে দেখ তো বহিন নেতা, আসন কেন টলে, মুকুট কেন নড়ে? নেতা খড়ি পাতবে, গুনে দেখবে, দেখে বলবে—সাঁতালী গাঁয়ে শিরবেদে তোমাকে পূজা দিতেছে, স্মরণ করতেছে; তার হয়েছে সংকট; নাগিনী কন্যে অবিশ্বাসিনী হয়েছে। হয়ত বলবেকন্যের চুলে ধরেছে পাক, দত হয়েছে নডোেবড়ো, এখন নতুন কন্যে চাই। মা তখন বলবেন ভয় নাই। অভয় দিবেন, সঙ্গে সঙ্গে নাগিনী কন্যের নাগমাহাত্ম্য হরণ করে লিবেন আর ওদিকে নতুন কন্যের মধ্যে সঞ্চার করে দিবেন সেই মাহাত্ম্য। কন্যের অন্তরে অঙ্গে সেই মাহাত্ম্য ফুটে উঠবে।

পিঙলা বলে—সেবার শহরে কন্যে শবলা বললে, মা-বিষহরি সূক্ষ্ম বিচার করবে। কন্যের উপর ভর হল মায়ের।

মহাদেব শিরবেদে কুকুরের কামড় খেলে। সবার সামনে তার মাথা হেঁট হল। কথা বলতে পারলে না।

শবলা বললে চল, এই ভোরেই ভাসায় দে লায়েব সারি। কুকুর দুটার খোঁজে এসে যদি বাবুরা বুঝতে পারে কি, এটা বেদেদের কারুর কাম, তবে আর কারুর রক্ষে থাকবে না। মা-গঙ্গার স্রোতের টানে নৌকা ছেড়ে দে, তার সঙ্গে ধর দাড়, পাঁচদিনের পথ একদিনের পায়ে যাবি।

মহাদেব নায়ের ভিতর পাথর হয়ে পড়ে রইল।

মনে মনে কইলে–মাগো! শ্যাষে অপরাধ হইল আমার? আমি শিরবেদে—তুর চরণের দাস, আমি যে তুর চরণ ছাড়া ভজি নাই, তিন সন্ধ্যা তুকে ডাকতে কোনো দিন ভুলি নাই আমার দোষ নিলি মা-জনুনী?

****

শেষত্রে অন্ধকারের মধ্যে বড়নগরের রানীভবানীর বাড়ি-মন্দির পড়ে রইল পিছনে নৌকা বালুচর আজিমগঞ্জের শেঠদের সোনার নগর ছাড়িয়ে গেল, তারপর নসীপুরে ভাঙা জগৎশেঠের বাড়ি। সে সব পার হয়ে লালবাগের নবাবমহল। ওপারে খোশবাগ। হিরাঝিলের জঙ্গল। ওই—এইখানেই রাজগোখুরা ধরেছিল শবলার ভালবাসার মানুষ।

পিঙলা বলে—যাই বলা থাকুক শবলা, সে তার ভালবাসার মানুষই ছিল গ কবিরাজ মশাই। ভালবাসার মানুষ, পরানের বঁধু। তোক নাগিনী কন্যে, তবু তো দেহটা মনটা তার মানুষের কন্যের! মানুষের কন্যে ছেলেবয়সে ভালবাসে তার বাপকে মাকে। লাগিনীর সন্তান হয়, ডিম ফোটে, ভেঁকা বার হয়, পুরাণে আছে প্রবাদে আছে-লাগিনী আপন সন্তানের যতটারে পায় মুখের কাছে—খেয়ে ফেলায়। বড় সাপে ঘোট সাপ খায়—দেখেছ কি না জানি না, আমরা দেখেছি খায়। লাগিনী সেখানে নিজের সন্তান খাবে তার আর আশ্চর্য কি গ! সেই লাগিনী মানুষের গভ্যে জনম নেয়—মনুষ্য-ধরম নিয়া, সেই ধরম সে পালন করে। মা-বাপেরে ভালবাসে তাদের না-হলে তার চলে না। তাপরেতে কেরুমে কেরমে বড় হয়, দেহে যৌবন। আসে তখন পরান চায় ভালবাসার মানুষ। লাগিনীর নারী ধরমের কাল আসে তার অঙ্গ থেকে কাঁঠালীচাপার বাস বাহির হয়, সেই বাস ছড়ায়ে পড়ে চারিপাশে। লাগ সেই গন্ধের টানে এসে হাজির হয়। দুজনে মিলন হয়, খেলা হয়, জীবধরমের অভিলাষ মেটে। লগ-লাগিনী অভিলাষ মিটায়ে চলে যায় আপন আপন স্থানে। ভালবাসা তো নাই সেখানে। কিন্তু নাগিনী কন্যে যখন মানুষের রূপ ধরে, মানুষের মন পায়—তখন দেহের অভিলাষ মিটলেই মনের তিয়াস মিটে না, মন চায় ভালবাসা। সে তো ভাল না বেসে পারে না। সেই ভালবাসাই সে বেসেছিল ওই জোয়ানটাকে। তারে চুঁতে সে পারে নাই, ভয় তার তখনও ভাঙে নাই, ভাঙলে পরে সে কিছু মানত না, গাঙের ধারে রাতের অ্যাঁধারে সস্নিয়ে গিয়ে ঝাপায়ে পড়ত তার বুকে, গলাটা ধরত জড়ায়ে, লাগিনী যেমন লাগেরে পাকে পাকে জড়ায় তেমনি করা জড়ায়ে লেগে যেত তার অঙ্গে অঙ্গে।

হিরাঝিলের ধারে এস্যা শবলা আপন লায়ে মায়ের ছামনে আবার আছড়ে পড়ল। কি করলি মা গ! তোর শাসনই যদি নিয়া এসেছিল রাজগোখুরা, তবে আমার বুকে কেনে ছোবল দিলে না?

****

নাগিনীর মতই গর্জন করে ওঠে পিঙলা। সে বলে—শবলা আমাকে বলেছিল। বলেছিল পিঙলা, বহিন, চিরজনমটা বুকের কথা মুখে আনতে পারলাম না, বুকটা আমার জ্বল্যা পুড়া শাক হয়ে গেল। দোষ দিব কারে? কারেও দিব না দোষ। অদেষ্ট না, ললাট না, বিষহরিকে না, দোষ ওই বুড়ার, আর দোষ আমার। মুই নিজেকে নিজে ছলনা করলাম চিরজীবন। পরান ভালবাসলে, মোর সকল অঙ্গ ভালবাসলে, আমার মন বললে—নানা-না, ও-কথা বলতে নাই। ও পাপ–মহাপাপ। মুছে ফেল্ মুছে ফেল, বিষহরির কন্যে, ও অভিলাষ তু মন থেক্য মুছে ফেল।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রাঙা চোখ দুটো মেলে কালো কেশের মত অ্যাঁধার রাতের দিকে চেয়ে থাকত আর ওই কথা বলত। শবলার অঙ্গে অঙ্গে তখন যেন কালো রূপের বান ডেকেছে। সে যেন তখন বান-থইথই কালিন্দী নদীর কলাদহের মত পাথার হয়ে উঠেছে। কদমতলায় কানাই। নাই, তবু সেথায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে উথালপাতাল করে আছাড় খেয়ে পড়ছে। কন্যে যদি সত্যিই নাগিনী হয়, তবে অঙ্গে ফোটে চাপার সুবাস। শবলার অঙ্গ ভরে তখন চাপার সুবাস ফুটেছে।

****

শিবরাম সেবার গুরুর আশ্রম থেকে শিক্ষা শেষ করে বিদায় নিয়েছিলেন, সেইবার পিঙলা ওই কথাগুলি বলেছিল। তখন পিঙলার সর্বাঙ্গ ভরে যৌবন দেখা দিয়েছে। প্রথম যেবার শবলার অন্তর্ধানের পর সে এসেছিল, তখন সে ছিল সবুজ-ডাঁটা একটি কচি লতার মত। অল্প বাতাসে দোলে, অল্প উত্তাপে ম্লান হয়, বর্ষণের স্বল্প প্রাবল্যেই তার ডাঁটা পাতা মাটির বুকে কাদায় বসে যায়। এখন সে পূৰ্ণ যুবতী, সবল সতেজ লতার ঝাড়। যেন উদ্যত ফণা নাগ-নাগিনীর মত নিজের কমনীয় প্রান্তভাগগুলি শূন্যলোকে বিস্তার করে রয়েছে, ঝড় বর্ষণ তাকে আর ধুলায় লুটিয়ে দিতে পারে না, বৈশাখী দ্বিপ্রহরে তার পল্লবগুলি ম্লান হয় না। শান্ত স্বল্পভাষিণী কিশোরী মেয়েটি তখন মুখরা যুবতী। সে সলজ্জা নয় আর, এখন সে দৃপ্তা।

শবলা শিবরামের নামকরণ করেছিল—কচি-ধন্বন্তরি। বর্বরা উল্লাসিনী বেদের মেয়েরা তাকে সেই নামেই ডাকত। তারা যেন তঁকে বেশ একটি প্রীতির চোখেই দেখত। শবলাকে জেনে, চিনে, তার অন্তরের পরিচয় পেয়ে শিবরামও এদের স্নেহ করতেন। কিন্তু কিশোরী পিঙলার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় হয়ে ওঠে নি এতদিন।

এবার গুরু সুযোগ করে দিলেন। বললেন—আমার শিষ্য শিবরাম এবার থেকে স্বাধীনভাবে কবিরাজি করবেন। এঁকে তোমাদের যজমান করে নাও।

শিরবেদে, নাগিনী কন্যা নূতন যজমানকে বরণ করে। প্রণাম করে হাত জোড় করে বলে–কখনও তোমাকে প্রতারণা করব না। যে গরল অমৃত হয় শোধনে, সেই গরল ছাড়া অন্য গরল দেব না। মা-বিষহরির শপথ। হে যজমান, তুমি আমাকে দেবে ন্যায্য মূল্য, আর সে মুদ্ৰা যেন মেকি না হয়।

সেইদিন অপরাত্নে পিঙলা এল একাকিনী। বললে—তুমার কাছে এলম কচি-ধন্বন্তরি। আজ চার বছর একটা কথা বলবার তরে শপথে বাধা আছি। কিন্তুক বুলতে লেরেছি। আজ বুলতে এসেছি। শবলাদিদির কাছে শপথ করেছিলাম মায়ের নাম নিয়া।

শিবরাম তার মুখের দিকে চাইলেন। এ মেয়ে আর এক জাতের। শব ছিল উচ্ছলা, সে যেন ছিল মেঘলা আকাশ-ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎচকিত হত, ঝলকে উঠত বজ্ৰবহি; আবার পর মুহূর্তেই বৰ্ষণ ও উতলা বায়ুর চপল কৌতুকে লুটোপুটি খেত। আর এ মেয়ে যেন বৈশাখের দ্বিপ্রহর। যেন অহরহ জ্বলছে।

সমস্ত কথাগুলি বলে সে বললে—শবলাদিদি আমার কাছে লুকায় নাই। তার অঙ্গে চাপার বাস ফুটল, পাপ তার হল। মনের বাসনারে যদি লাগিনী কন্যে আপন বিষে জরায়ে দিতে না পারে, তবে সে বাসনা চাপার ফুল হয়্যা পরান-বক্ষে ফুটা উঠা বাস ছড়ায়। তখন হয় কন্যের পাপ। মা-বিষহরি হরণ করেন তার লাগিনীমাহাত্ম্য। অন্য কন্যেকে দান করেন। শবলার মাহাত্মি হরণ করে মা আমারে দিলেন মাহাত্মি। তাতে শবলা রাগলে না। আমার উপর আক্রোশ। হল না।

শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে তার মনের প্রশ্ন অনুমান করেই সে বললে—বুঝল না? নাগিনী কন্যের দুর্ভাগ্য যত, ভাগ্যি যে তার থেক্যা অনেক বেশি গ। সি যি সাক্ষাৎ দেবতা। শিরবেদের চেয়ে তো কম লয়। তাতেই লতুন লাগিনী কন্যে যখন দেখা দেয়তখুন পুরনো লাগিনী কন্যে উঠে ক্ষেপে। তারে পরানে সে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু শবলা তা করে নাই। আমায় সে ভালবেসেছিল—আপন বহিনের মত। বুলেছিল—দোষ আমার আর শিরবেদের; তুর দোষ নাই। সে আমাকে সব শিখায়ে গিয়েছে। লাগিনী কন্যের সব মাহাত্মি—সব বিদ্যা দিয়েছে। মনের কথা বুলেছে। শুধু বুলে নাই যি, মহাদেব শিবেদের ধরম নিয়া জীবন নিয়া, অকূলে সে ঝাঁপ খাবে।

বেদেরা এখুন ধরম বাঁচাবার লেগ্যা বলে শবলার মাথা খারাপ হছিল। মিছা কথা। এখুন আমি সব বুঝছি। আমার লেগা গঙ্গারাম শিরবেদে এখুন কি বুলে জান? বুলে—তুরও মগজটা শবলার মত বিগড়াবে দেখছি।

পিঙলা গঙ্গারাম শিরবেদেকে মুখের উপর বলেছিল—আমার মাথা খারাপ হবে না, সে তুকে বল্য রাখলাম, সে তু শুন্যা রাখ। পিঙলা কন্যে শবলা নয়। শবলা আমাকে বলে গিয়েছে–পিঙলা, বহিন, এই কালে কালে হয়্যা আসছে লাগিনী কন্যের কপালে; মুই তুরে সকল কথা খুল্যা বলে গেলম; তু যেন আমাদের মত পড়া পড়া মার খাস না; শিরবেদেকে ডরাস না। মুই তুকে ডরাব না।

নতুন নাগিনী কন্যা পিঙলা আর শিরবেদে গঙ্গারামের মধ্যে চিরকালের বিবাদ ঘনিয়ে উঠেছে। যা হয়েছিল শবলা আর মহাদেবের মধ্যে, তাই। মহাদেব মরেছে আজ সাত বছরের ওপর। পিঙলা নাগিনী কন্যা হয়েছিল যখন, তখন তার বয়স পনের পার হয়েছে, ষোল পূর্ণ হয় নাই। পিঙলা এখন পূৰ্ণ যুবতী। কালো মেয়ে পিঙলার চোখ দুটো পিঙ্গলাভ; সে চোখের দৃষ্টি আশ্চর্য রকমের স্থির। মানুষের দিকে সে নিম্পলক হয়ে তাকিয়ে থাকে, পলক ফেলে না; মনে হয় একেবারে ভিতরের ভিতরে থাকে যে আঙুল-প্রমাণ আত্মা, সে-ই যেন চোখ দুটার দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তার তো ভয় নাই, ডরও নাই। তা ছাড়া, পিঙলার ওই চোখ দুটা অন্ধকারের মধ্যে বনবিড়ালের চোখের মত জ্বলে। যে অন্ধকারে অন্য মানুষের দৃষ্টি চলে না, পিঙলা সেই অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পায়। পিঙলার চোখের দিকে চাইলেও ভয় পায় সকলে। গঙ্গারাম যে গঙ্গারাম, সেও ভয় পায়। যখন এমনি স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকায়, গঙ্গারাম তখন দুপা। পিছন হটে দাঁড়ায়। পিঙলা তাতে কৌতুক বোধ করে না, তার ঠোঁট দুটো বেঁকে যায়, সে বাঁকের এক দিকে ঝরে পড়ে আক্রোশ, অন্য দিকে ঝরে ঘৃণা।

গঙ্গারামও ভীষণ।

মহাদেবের মত সে ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু সে ভীষণ। পাথরের পুরনো মন্দিরের মত কঠিন নয়, কিন্তু সে কুটিল। সমস্ত সাঁতালীর বেদেরা তাকে ভয় করে ডোমন-করেতের মত। মহাদেব ছিল শঙ্খচূড়—সে তেড়ে এসে ছোবলে ছোবলে ক্ষতবিক্ষত করে দিত, প্রাণটা চলে যেত সঙ্গে সঙ্গে। হার মেনে অঙ্গের বেশবাস ফেলে দিয়ে পাশ কাটিয়ে পালালে সে সেই বেশবাসকে ছিঁড়েখুঁড়ে আক্রোশ মিটিয়ে নিরস্ত হত। ডোমন-করেতের কাছে সে নিস্তারও নাই। সে অন্ধকার রাত্রের সঙ্গে তার নীলচে দেহটা মিশিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে তোমার অনুসরণ করে লুকিয়ে থাকবে। দিনের। আলোতে অনুসরণ করতে যদি না-ই পারে, তবে আক্রোশ পোষণ করে অপেক্ষা করে থাকবে। আসবে সে ঠিক খুঁজে খুঁজে। তারপর করবে দংশন। সে দংশনে নিস্তার নাই। ব্রাহ্মণেরা বলে–খেলে ডোমনা, ডাক বানা। অর্থাৎ ডোমন-করেতের দংশন যখন, তখন বিষবৈদ্য ডেক না, মিথ্যা চিকিৎসা করতে যেয়ো না-শ্মশানে শব নিয়ে যাবার জন্য ব্রাহ্মণ ডাক। সৎকারের আয়োজন কর।

ডোমন-করেতের মতই বাইরে দেখতে ধীর আর নিরীহ গঙ্গারাম। দেহের শক্তি তার অনেকের চেয়ে কম, কিন্তু সে কামরূপের বিদ্যা জানে, জাদুবিদ্যা জানে। তিরিশ বছর আগে ওই শহরে থেকেই সে মহাদেবের সঙ্গে ঝগড়া করে, নিরুদ্দেশ হয়েছিল; দোষ মহাদেবের ছিল না, দোষ ছিল গঙ্গারামের। জোয়ান হয়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মতিগতি অতি মাত্রায় খারাপ হয়েছিল। শহরে এসে সে একা একা ঘুরে বেড়াত। মদ খেয়ে রাস্তায় লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে ফিরত। গলায় একটা গোখুরা সাপ জড়িয়ে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়। গোখুরাটাকে সে খুব বশ করেছিল। গলায় জড়ালে সেটা মালার মতই ঝুলত, মুখটা নিয়ে কখনও কাঁধে, কখনও কানের কাছে, কখনও বুকের উপর অল্প ঘুরত। এর জন্যে লোক তাকে ভয় করত। গায়ে হাত তুলতে সাহস করত না। একদিন কিন্তু ভিড়ের মধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ভিড়ের মধ্যে একজন। হঠাৎ তার ঠিক সামনেই গঙ্গারামের গলায় সাপটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে গঙ্গারামকে ঠেলে দিতে গিয়েছিল, ভয় পেয়ে সাপটাও তাকে কামড়ে দিয়েছিল। একেবারে ঠিক বুকের মাঝখানে খানিকটা মাংস খাবলে তুলে নিয়েছিল। তারপর সে এক ভীষণ কাণ্ড। যত নির্যাতন গঙ্গারামের তত লাঞ্ছনা সমস্ত বেদেকুলের। পুলিশ এসে বেদেদের নৌকা আটক করেছিল। মহাদেবকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল।

গঙ্গারাম অনেক বলেছিল—কিছু হবে না হুজুর, মুই বিষহরির কিরা খায়্যা বলছি, উয়ার বিষ নাই। উয়ার দাঁত, বিষের থলি—সব মুই কেটে তুলে দিছি। মানুষটার যদি কিছু হয়, তবে দিবেন–দিবেন আমাকে ফাঁসি।

সে গোখুরার মুখটাকে নিজের মুখের মধ্যে পুরে চকচক শব্দ তুলে চুষে দেখিয়েছিল—বিষ নাই। মুখ থেকে সাপটাকে বের করার পর সেটা গঙ্গারামকেও কয়েকটা কামড় দিয়েছিল।

মহাদেব শপথ করে গঙ্গারামের কথা সমর্থন করেছিল। কিন্তু তবু এ লাঞ্ছনা-অপমান থেকে পরিত্রাণ পায় নাই। প্ৰায় চব্বিশ ঘণ্টা আটক রেখেছিল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেও যখন লোকটির দেহে কোন বিষক্রিয়া হল না, যখন ডাক্তারেরা বললেন না, আর কোনো ভয় নাই, তখন পরিত্রাণ পেয়েছিল তারা। সেই নিয়ে বিবাদ হল মহাদেবের সঙ্গে। একা মহাদেব কেন, বেদেদের সকলের সঙ্গেই ঝগড়া হয়েছিল গঙ্গারামের। দারুণ প্রহার করেছিল মহাদেব। দুদিন পরে গঙ্গারাম একটু সুস্থ হয়ে উঠেই দল ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল।

মহাদেব বলেছিল—যাক, পাপ গেছে, মঙ্গল হল্‌ছে। যাক।

গঙ্গারাম গেলে মঙ্গল হবে—এ কথায় কারুর সংশয় ছিল না, কিন্তু মহাদেবের পরে শিরবেদে হবে কে?

মহাদেব বলেছিল—মুই পুষ্যি লিব।

হঠাৎ দীর্ঘ তের চোদ্দ বৎসর পর গঙ্গারাম এসে হাজির হল। সে বললেকঁউর-কামিক্ষে থেকে কত দ্যাশে দ্যাশে ঘুরলম, জেহেলেও ছিলম বছর চারেক। তাপরেতে এলম, বলি, দেখ্যা। আসি, সাঁতালীর খবরটা নিয়া আসি।

বেদেদের আসরে সে তার জাদুবিদ্যা দেখালে।

কত খেলা, বিচিত্র খেলা! জিভ কেটে জোড়া দেয়। কাঠের পাখি হুকুম শোনে, জলে। ডোবে, ওঠে। পাথরের গুলি থেকে পাখি বের হয়; সে পাখিকে ঢাকা দেয়, পাখি উড়ে যায়; বাতাস থেকে মুঠো বেঁধে এনে মুঠো খোলে টাকা বের হয়। আরও কত!

বেদেরা সম্মোহিত হয়ে গেল। সন্ধ্যায় বসে সে গল্প করত দেশ-দেশান্তরের। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই শবলা আর মহাদেবের মধ্যে বিবাদের মীমাংসা হয়ে গেল। মহাদেবের বুকে বিষকাটা বসিয়ে দিয়ে শবলা ভেসে গেল গঙ্গার বানে। গঙ্গারাম হল শিরবেদে।

পিঙলা বলে—পাপী–উ লোকটা মহাপাপী।

আবার তখনই হেসে বলে—উয়ার দোষ কি? পুরুষ জাতটাই এমুনি। ভোলা মহেশ্বরের কন্যে হলেন মা-বিষহরি। ভোলা ভাঙড় চণ্ডীরে ঘুম পাড়ায়ে এলেন মত্ত্যধামে। বিষহরিরে দেখ্যা কামের পীড়াতে লাজ হারালেন, বললেন—কন্যে, আমার বাসনা পূর্ণ কর। মা-বিষহরি তখন রোষ করে বিষদৃষ্টিতে তাকালেন পিতার পানে, শিব ঢলে পড়লেন। দোষ শুধু লাগিনী কন্যেরই নাই। শাবলার নামে দোষটা দিলি কি—সে শিরবেদের ধরম নিয়া, কাটা বুকে বিঁধে দিয়া পালালছে; কিন্তু দোষটা শিরবেদেরও আছে। ওই গঙ্গারাম শিরবেদেকে দেখ।

নেশায় চক্ষু লাল করে গঙ্গারাম ঘুরে বেড়ায় সাঁতালীর বাড়ি বাড়ি। রসিকতা করে বেদেনীদের সঙ্গে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে সাহস করে না। গঙ্গারাম ডাকিনী বিদ্যা জানে। মানুষকে সে বাণ মেরে খোঁড়া করে রেখে দেয়; শুধু তাই নয়, প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে গঙ্গারাম। ডাকিনী-সিদ্ধ গঙ্গারামের ধর্ম নাই, অধর্ম নাই। কিছু মানে না সে।

গঙ্গারাম ভয় করে শুধু পিঙলাকে।

পিঙলাও ভয় করে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে সে যেন ক্ষেপে ওঠে।

ফাল্গুনের তখন শেষ। ফাল্গুনেও গঙ্গাতীরে ঘাসবনের ভিতর পলিমাটিতে বর্ষার জলের ভিজে আমেজ থাকে। পাকা ঘাস শুকিয়ে যায়, কাশঝাড় আগেই কেটে নিয়েছে বেদেরা। এই সময় একদিন ঘাসবন ধোঁয়াতে শুরু করে। শুকনো ঘাসে আগুন দেয় বেদেরা। শুকনো ঘাস পুড়ে যাবে, তলার মাটি আগুনের অ্যাঁচ পাবে, তারপর পাবে সূর্যের তাপ, সাঁতালীর বসুন্ধরা নব কলেবর ধরবেন। চৈত্রের পর বৈশাখে আসবে কালবৈশাখী ঝড় জল হবে, সেই জলে মাটি ভিজবে, সঙ্গে সঙ্গে ওই পুড়িয়ে দেওয়া ঘাসের মুড়ো অর্থাৎ মূল থেকে আবার সবুজ ঘাস বের হতে আরম্ভ হবে। বর্ষা আসতে আসতে একটা ঘন চাপ-বধা সবুজ বন হয়ে উঠবে। গঙ্গার জলকে রুখবে। সাঁতালী গাঁয়ের বেদেদের বাঁশ আর কাশের ঘরগুলি ছাওয়ার কাশের সংস্থান হবে।

এদিকে পৌষ মাস পর্যন্ত সফর সেরে সাঁতালীতে ফিরবার পথে শীতে জরজর-অঙ্গ নাগ-নাগিনীদের মুক্তি দিয়ে এসেছে; বিষহরির পুত্র-কন্যা সব, বেদের ঝাঁপিতে তাদের মৃত্যু হলে বেদের জীবনে পাপ অৰ্ণাবে। মাঘ থেকে ফাল্গুন-চৈত্র পর্যন্ত বেদেদের ঝাপিতে সাপ নাই। সতেজ নাগ, শীতে যাকে কাবু করতে পারবে না—তেমনি দুটো-একটা থাকে। ফারুনের শেষে ঘাস পুড়িয়ে দিলে আগুনের অ্যাঁচে, রোদের তাপে মাটি শুকালে, নাগেরা মাটির নিচে তাপের স্পর্শে শীতের ঘুম থেকে জেগে উঠবে। আশ্বিনের শেষ থেকে কার্তিকের শেষ পর্যন্ত নাগেরা রাত্রে ভোলা মাঠে নিথর হয়ে পড়ে থাকে, বেদেরা বলে—শিশির নেয় অঙ্গে। ওই শিশির অঙ্গে নিয়ে শীত শুরু হতেই তারা মাটির নিচে কালঘুমে ঢলে পড়ে। লোকে বলে সাপেরা মুদ নেয়। এই কালঘুমই বল, আর মুদই বল, এ ভাঙে ফাল্গুন-চৈত্রে। বেদে যেখানে নাই, সেখানে ঘুম ভাঙায় কাল। যেখানে বেদে আছে, সেখানে এ ঘুম ভাঙানোর ভার বেদেদের। ঘুম ভাঙানোর পর শুরু হবে নতুন করে নাগ ঘরে আনার পালা।

এই আগুন দেওয়ার ক্ষণ ঘোষণা করে হিজল বিলের পাখিরা। সাপদের মুদ নেবার কাল হলেই পাখিরা কোন দেশান্তর থেকে আকাশ ছেয়ে কলকল শব্দ তুলে এসে হাজির হয় হিজল বিলে। সকলের আগে গগনভেরী পাখি। আকাশে যেন নাকাড়া বাজে।

গরুড় পাখির বংশধর। নাগকুলের জননী আর গরুড় পক্ষীর জননী-দুই সতীন। সভাইদের বংশে বংশে কালশত্ৰুতা সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে। সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত চলবে। তাই এ মীমাংসা হয়ত দেবকুলের করে দেওয়া মীমাংসা। শীতের কয়েক মাস পৃথিবীতে অধিকার গরুড়-বংশের। তারা আকাশ ছেয়ে ভেরী বাজিয়ে এসে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে–বিলে নদীতে পুকুরে; ধানভরা মাঠে ধান খাবে। তারপর ফাল্গুন যাবে, চৈত্রের প্রথমে গরমের আমেজ-ভরা বাতাস আসবে দক্ষিণ দিক থেকে; মাঠের ফসল শেষ হবে; তখন তারা আবার উড়বে—গগনভেরী পাখিরা নাকাড়া বাজিয়ে চলবে আগে আগে! তখন আবার পড়বে নাগেদের কাল।

যে দিন ওই গগনভেরীরা উড়বে, উড়ে গিয়ে আর ফিরবে না, সে দিন থেকে তিন দিন পরে এই আগুন লাগানো হবে ঘাসবনে।

***

সাঁতালীর চরে ঘাসবনে সেই আগুন লাগানো হয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে আকাশে। ঘাসের উঁটা আগুনের অ্যাঁচে পটপট শব্দে ফাটছে, আকাশে উঠছে কাকফিঙের দল। ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা মাকড় উড়ে পালাচ্ছে। পালম্বা গঙ্গাফড়িঙের দল লাফিয়ে উঠছে। আগুন চলছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। দনে বাতাস বইতে শুরু করেছে। বইবেই তো, গগনভেরী পাখিরা গুরুড়ের বংশধর, তারা দক্ষিণ থেকে উত্তর দেশে চলেছে—তাদের পাখসাটে পবনদেবকেও মুখ ফেরাতে হয়েছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে।

বিলের ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল পিঙলা। দেহ-মন তার ভাল নাই। দুনিয়া যেন বিষ হয়ে উঠেছে। সাঁতালী, বিষহরি, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড—সব বিষ হয়ে গিয়েছে। সে নাগিনী কন্যে—তাই বোধ হয় এত বিষ তার সহ্য হয়, অন্য কেউ হলে পাথরে মাথা ঠুকে মরত, গলায় দড়ি দিত, নয়ত কাপড়ে আগুন লাগাত।

বিলের দক্ষিণ দিকে সদ্য-জল-থেকে-ওঠা জমিতে চাষীরা চাষ করছে। এর পর লাগাবে বোরো ধান। তার উপরে তিল-ফসলে বেগুনে রঙের ফুল দেখা দিয়েছে। বড় বড় শিমুলগাছগুলোয় রাঙা শিমুল ফুল ফুটেছে। ওই ওদিকে এসেছে ঘোষেরা। মাঠান দেশে ঘাসের অভাব হয়েছে। সামনে আসছে গ্রীষ্মকাল, তারা তাদের গরু মহিষ নিয়ে এসেছে হিজলের কূলে। হিজলের কূলে ঘাসের অভাব নাই। তা ছাড়া আছে হাজারে হাজারে বাবলা গাছ। বাবলার শুটি, বাবলার পাতা খাওয়াবে।

কিছুদিন পরেই আসবে দুঃসাহসী একদল জেলে। মাছ ধরবে হিজল বিলে। বর্ষার একটা হিজল বিল এখন শুকিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আরও যাবে। তখন এই মাছ ধরার পালা। মূল পদ্মার বিল অর্থাৎ মা-মনসার আইন মাঝের বিল বাদ দিয়ে বাকি সব বিলে মাছ ধরবে।

অকস্মাৎ একটা বন্য জন্তুর চিৎকারে পিঙলা চমকে উঠল।

ওদিকে হইহই শব্দ করে উঠল বেদেরা। গুলবাঘা-গুলবাঘা!

আগুনের আঁচে, ধোঁয়ায়, গাছপা-পোড়ার গন্ধে, কোথায় কোন ঝোপে ছিল বাঘা সে বেরিয়ে পড়েছে। কালো ছাপওয়ালা হলদে জানোয়ারটা ছুটছে। কাউকে বোধ হয় জখম করেছে। কিন্তু বাঘা আজ মরবে। সে যাবে কোথায়? পুবে গঙ্গা, উত্তরে বেদেরা, তারা ছুটে আসছে পিছনে পিছনে, দক্ষিণে মহিষের পাল নিয়ে রয়েছে ঘোষেরা। সেখানে মহিষের শিঙ, ঘোষেদের লাঠি। পশ্চিমে হিজলের জল, যাবার পথ নাই। বাঘা আজ মরবে।

পিঙলার মনের অবসাদ কেটে গেল এই উত্তেজনায়। সে হিজলের ঘাট থেকেই মাথা তুলে। দেখতে লাগল। কিন্তু কই? কোথায় গেল বাঘা? এদিকের ঘাসের বন আড়াল দিয়ে গঙ্গার গর্ভে নামল নাকি? পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে মাথা তুললে সে। ওই ছুটেছে বেদেরাওই! হইগই শব্দ করছে। উল্লাসে যেন ফেটে পড়ছে। পিঙলার ইচ্ছে হল ছুটে যায়। কিন্তু উপায় নাই। তাকে থাকতে হবে এই হিজল বিলের বিষহরির ঘাটে। ওদিকে বনে আগুন লাগানো হয়েছে। নাগিনী কন্যা এসে বসে আছে বিষহরির ঘাটে। তাকে ধ্যান করতে হবে মায়ের। মায়ের ঘুম ভাঙাতে হবে, বলতে হবে–মা গো, নাগকুলের জ্ঞাতিশত্রু–গরুড় পক্ষীর বংশের গগনভেরীরা নাকাড়া বাজিয়ে উত্তরে চলে গেল; নাগেদের দখলে কাল এল। উত্তরে দক্ষিণ-মুখো বাতাস–দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী হয়েছে; নাগ-চাপার গাছে কলি ধরেছে। তুমি এইবার নয়ন মেল; মা গো, তুমি জাগ।

ওদিকে বন পোড়ানো শেষ করে বেদেরা আসবে; শিরবেদে থাকবে সর্বাগ্রে; এসে ঘাটের অদূরে হাত জোড় করে দাঁড়াবে। শিরবেদে ডাকবে-কন্যে গ, কন্যে!

হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে কন্যে বসে থাকবে ধ্যানে। উত্তর দেবে না। আবার ডাকবে শিরবেদে। বার বার তিনবার। তারপর কন্যে সাড়া দেবো–হাঁ গ!

–মা জাগল? ঘুম ভাঙিছে জননীর?

–হাঁ, জাগিছে মা-জননী।

তখন নাকাড়া বেজে উঠবে, জয়ধ্বনি দেবে বেদেরা। পূজা হবে। হাঁস বলি হবে, বন-পায়রা বলি হবে। তারপর তারা গ্রামে ফিরবে। ফিরবার আগে চর খুঁজে বিলের কূল খুঁজে একটিও অন্তত নাগ ধরতে হবে।

বিলের ঘাটে সেই জন্যই একা এসেছে সে। কিন্তু এসে অবধি কোনো প্রার্থনা, কোনো ধ্যানই করে নাই। চুপচাপ পাঁড়িয়ে ছিল। ইচ্ছা হয় নাই, দেহও যেন ভাল মনে হচ্ছিল না। যেন ঘুম আসছিল। হঠাৎ উত্তেজনায় সে চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু উপায় নাই। যাবার তার উপায় নাই। সে উদ্গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। বাঘা মরবে। আঃ, বাঘা তুই যদি গঙ্গারাম শিরবেদেকে জখম করে মরিস, তবে পিঙলা তোকে প্রাণ খুলে আশীৰ্বাদ করবে। তোর মরণে বুক ভাসিয়ে কাঁদবে। তোর নখ পিতল দিয়ে বাঁধিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখবে। তোর পাঁজরার ছোট হাড়খানি নিয়ে সে সযত্নে রেখে দেবে, সৌভাগ্যের সম্পদ হবে সেখানি।

ওই থমকে দাঁড়িয়েছে বেদের দল। কোন দিকে বাঘা গিয়েছেঠাওর পাচ্ছে না। পরমুহূর্তেই তার সর্বাঙ্গে একটা বিদ্যুৎ শিরেন বয়ে গেল। সামনে হাত-পনের দূরে ঘাসের জঙ্গল ঠেলে বেরিয়েছে একটা হলুদ রঙের গোল হাঁড়ির মত মুখ, তাতে দুটো নিষ্পক গোল চোখ লম্বা দুটো কালো রেখার মত তারা দুটো যেন ঝলসে উঠছে। চোখে চোখ পড়তেই দাঁত বের করে ফাঁস শব্দ করে উঠল; গুঁড়ি মেরে দেহটাকে যথাসাধ্য খাটো করে সে আত্মগোপন করে এইদিকে চলে এসেছে।

সাঁতালী গাঁয়ের চারিপাশে ঘাসবনের ফালিপথ বেয়ে বেড়ায় যে বেদের কন্যে, যার গায়ের গন্ধে ঘাসের বনে মুখ লুকিয়ে কুণ্ডলী পাকায় বিষধর সাপ, সেই কন্যে পিঙলা। যে কন্যেরা জীবনে দু-চার বার বঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে নিরাপদে গ্রামে ফিরেছে, সেই কন্যের কন্যে পিঙলা। কুমিরখালার খালেকুমিরের মুখে প্রতি বছরই যে বেদের মেয়েদের দু-একজন যায়—সেই বেদের মেয়ে পিঙলা। পিঙলার পিসির একটা পা নাই। কুমিরে ধরেছিল। পিঙলার পিসি গাছের ডাল অ্যাঁকড়ে ধরে চিৎকার করছিল। বেদেরা ছুটে এসে খোঁচা মেরে, বাঁশ মেরে কুমিরটাকে ভাগিয়েছিল। কুমিরটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু একখানা পায়ের নিচের দিকটা রাখে নি। খোঁড়া। পিসি তার আজও বেঁচে আছে। পিঙলার সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎশিহরন খেলে গেল, কিন্তু সে বিবশ হয়ে গেল না।

ওরে বাঘা! ওরে চতুর। ওরে শঠ শয়তান। ওরে গঙ্গারাম।

এক পা, দু পা, তিন পা, চার পা পিছন হটে সে অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েই ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। হিজলের বিলে।–জয় বিষহরি!

ঘাটে লম্বা দড়িতে বাঁধা তালগাছের ডোঙাটা ভাসছে খানিকটা দূরে। সাঁতরে গিয়ে সেটার উপর উঠে বসল সে। বাঘাটা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেজ আছড়াচ্ছে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে পিঙলার দিকে।

পিঙলার মুখে দাঁতগুলি ঝলসে উঠল। ইশারা করে সে ডাকলে বাঘাকে আয়। আয়। আয়। সাঁতার তো জানিস। আয় না রে!

বাঘাটা এবার বেরিয়ে এল ঘাসবন থেকে। ঘাটের মাথায় এসে দাঁড়াল। কোলাহল ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে, চতুর বাঘা সেটুকু বুঝে নিরাপদ আশ্রয় এবং আহারের প্রত্যাশায় ভেঁকে দাঁড়িয়েছে ঘাটের মাথায়। ওরে মুখপোড়া, তুই মা-বিষহরির জামাই হবার সাধ করেছিস নাকি? কন্যাকে নিয়ে যাবি মুখে তুলে, বনের ভিতর ঘর-সংসার পিতবি? বাঘিনীর দলে লাগিনী কন্যে? আয় না ভাই, আয় না; গলায় তের মালা দিব, গলা জড়ায়ে চুমা খাব আয় না; বিলের জলের তলে মা-বিষহরির সাতমহলা পুরী–মোর মায়ের বাড়ি—আয় শাশুড়ির বাড়ি যাবি। আয়।

কথাগুলি পিঙলা বাঘটিকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছিল। একেবারে কথা কয়েছিল। বাঘটা দাঁত বের করে ফাঁসফাঁস করছে। হঠাৎ সেটা উপরের দিকে মুখ তুলে ডাক দিয়ে উঠল—আঁ–উ। লেজটা আছড়ালে মাটির উপর।

এবার খিলখিল করে হেসে উঠল পিঙলা।

হিজল বিলের চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ল সে হাসি।

ওদিকে বাঘার পিছনে—ঘাসবন পুড়িয়ে আগুন এগিয়ে আসছে। বাঘা এমন নিরস্ত্র নিরীহ শিকারের সুযোগ কিছুতে পরিত্যাগ করতে পারছে না। নইলে সে পালাত। পালাত দক্ষিণ মুখে, যেদিকে ওই চাষীরা চাষ করছে, ঘোষেরা গরু মহিষের বাথান দিয়ে বসে আছে। মহিষের শিঙে, ঘোষদের লাঠিতে, দাওয়ের কোপে বাঘা মরত।

সরস কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল পিঙলা। ডোঙার উপর বসে সে মৃদুস্বরে গান ধরে দিলে—ঠিক যেন বাঘটার সঙ্গে প্ৰেমালাপ করছে গান গেয়ে।

বঁধু তুমি, আইলা যোগীর ব্যাশে।
হায়–অবশ্যাষে!
মরণ আমার হায় গ—মরণ
লয়ন-জলে থোয়াই চরণ
সযতনে মুছায়ে দি আমার কালো ক্যাশে।
যদি আইলা অবশ্যাষে—হে!
হায়-হায় গ! আইলা যোগীর ব্যাশে।
চাচর চুলে জট বাছি লয়ানে নেই কাজল–
অধরে নাই হাসির ছটা–চক্ষে ঝরে বাদল!

গানের সুর তার উত্তেজনায় উঁচু হয়ে উঠল। বাতাসে জোর ধরেছে। আগুন দ্রুত এগিয়ে আসছে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া এই দিকে আসছে এবার; বাতাস ঘুরছে। আগুনের সঙ্গে বাতাসের বড় ভাব। ইনি এলেই—উনি একেবারে ধেয়ে আসবেন। বাঘা পড়ল ফাঁদে। হায় রে বন্ধু। আমার, হায় রে! এইবার ফঁদে পড়লা! গান থামিয়ে আবার সে খিলখিল করে হেসে উঠল।

বন্ধু এবার বুঝেছে।

একেবারে রাগে আগুন হয়্যা আয়ান ঘোষ আসছে হে! এইবারে ঠেলা সামলাও! বাঘা এবার ফিরল, আগুন দেখে সচকিত হয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল দক্ষিণ মুখে। ও-দিক ছাড়া পথ নাই। কিন্তু ওই পথেও তোমার কাটা বন্ধু! হায় বন্ধু!

চেঁচিয়েই কথাগুলি বলছিল পিঙলা। তার আজ মাতন লেগেছে। সেও হাতে জল কেটে ডোঙাটাকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে চলেছিল। কিন্তু হঠাৎ কি হল? বাঘটা একটা প্রচণ্ড হুঙ্কার ছেড়ে থমকে দাঁড়াল; দু পা পিছিয়ে এল। সেই প্রচণ্ড চিৎকারে পিঙলার হাত থেমে গেল, মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। বাঘের হুঙ্কার সমস্ত চরটাকেই যেন চকিত করে দিলে।

আহায় হায় হায়! উল্লাসে উত্তেজনায় যেন থরোথরো কাপন বয়ে গেল পিঙলার সর্বদেহ-মনে। সে চিৎকার করে উঠল—আ!

বাঘার সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে—মস্ত এক পদ্মনাগ।

আ—! হায়—হায়–হায়, মরি—মরি—মরি রে!

ওদিকে আগুনের অ্যাঁচ পেয়ে বেরিয়েছে পদ্মনাগ। সেও পালাচ্ছিল, এও পালাচ্ছিল, হঠাৎ দুজনে পড়েছে সামনাসামনি। নাগে বাঘে লাগল লড়াই-হায় হায় হায়!

সে ডোঙাটাকে নিয়ে চলল তীরের দিকে। ভাল করে দেখতে হবে। মরি মরি মরি, কি বাহারের খেলা রে! সোজা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে দুলছে পদ্মনাগ। চোখে তার স্থিরদৃষ্টি। কালো দুটি মটরের মত চোখ। তাতে কোনো ভাব নাই, কিন্তু বিষমাখা তীরের মত তীক্ষ্ণ এবং সোজা। বাঘা যে দিকে ফিরবে, সে চোখও সেই দিকে ঘুরবে তার ফণার সঙ্গে। মরি-মরি-মরি! পদ্মফুলের মত চক্রটির কি বাহার! লিকলিক করে চেরা জিভ মুহুর্মুহুঃ বের হচ্ছে আগুনের শিখার মত। বাঘাও হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো যেন জ্বলছে—লম্বা কালো কাঠির মত তারা দুটো চওড়া হয়ে উঠেছে। গোঁফগুলো হয়ে উঠেছে খাড়া সোজা; হিংস্র দুপাটি দাঁত বের করে সে গর্জাচ্ছে; গায়ের ব্লোয়া যেন ফুলছে—লেজটা আছড়ে আছড়ে পড়ছে মাটির উপর। কিন্তু তার নড়বার উপায় নাই। নড়লেই ছোবল মারবে পদ্মনাগ! নাগও নড়ছে না, সুযোগ পেলেই বাঘা মারবে তার থাবা নাগের মাথার উপর। বাঘা মধ্যে মধ্যে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে—সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে পিছিয়ে আসছে। মাটির উপর ছোবল পড়েছে নাগের। বাঘা সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পড়তে চায়নাগের উপর; কিন্তু তা পারছে না; লাফ দেবার উদ্যোগ করতে করতে নাগ যেন বিদ্যুতের মত উঠে দাঁড়াচ্ছে। তখন যদি বাঘা লাফ দেয়, তবে রক্ষা থাকবে না-একেবারে ললাটে দংশন করবে না। সেটা বুঝেছে বাঘা। তাই লাফ না দিয়ে ব্যর্থ ক্রোধে উঁচু দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠছে।

ডোঙার উপর উঠে দাঁড়াল পিঙলা।

আ—! আ—মরি মরি রে! আ—

চারিদিকের এক দিকে গঙ্গা–এক দিকে বিল। আর দুদিক থেকে ছুটে এল বেদেরা, ঘোসেরা, চাষীরা। বিলের দিকে ডোঙার উপর দাঁড়িয়ে নাগিনী কন্যা পিঙলা।

গঙ্গারাম দাঁড়িয়েছে বাঘটার ঠিক ওদিকে। তারও চোখ জ্বলছে। তার হাতে সড়কি দুলছে। সে মারবে বাঘটাকে।

–না। চিৎকার করে উঠল পিঙলা।

থমকে গেল গঙ্গারাম। সে তাকালে পিঙলার দিকে। বাঘটার মতই দাঁত বার করে বললে লাগ মরবে বাঘার হাতে।

—কে কার হাতে মরে দেখ ক্যানে!

–তা’পরেতে? লাগ যদি মরে—

–বাঘাকে রেখ্যা যাবে না!

—না। বিষহরির দাস আমরা। বলতে বলতে হাতের সড়কিটা দুলে উঠল। পিঙলা মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল জলে। সড়কিটা সঁ করে ডোঙাটির উপরের শূন্যলোক দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে পড়ল বিলের জলে। পিঙলার বুঝতে ভুল হয় নাই। বাঘাকে বিধবে তো পিঙলার চোখে চোখ কেন গঙ্গারামের? পরমুহূর্তেই আর একটা সড়কি বিধল বাঘটাকে। গর্জন করে লাফিয়ে উঠল। বাঘটা। যে মুহূর্তে সে পড়ল মাটিতে, সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে পদ্মনাগ তাকে মারলে ছোবল। আহত বাঘটা থাবা তুলতে তুলতে সে এঁকেবেঁকে তীব্র গতিতে গিয়ে পড়ল বিলের জলে। মুখ ড়ুবিয়ে এখন সে চলেছে সোজা তীরের মত, তার নিশ্বাসে পিচকারির ধারার মত জল উৎক্ষিপ্ত করে চলেছে। কিন্তু জলে রয়েছে নাগিনী কন্যা। এক বুক জলে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্য করছিল। ডোঙার উপর উঠে বসল সে। খপ করে চেপে ধরল নাগের মাথায়। অন্য হাত লেজে। নাগ বন্দি হল।

বেদেরা ধ্বনি দিয়ে উঠল।

গঙ্গারাম ঘাটে এসে দাঁড়াল। ডোঙাটা ঘাটে এসে লাগতেই সে বললে–ঘাটে ধেয়ান না কর্যা তু ডোঙায় বস্যা থাকলি? খ্যানত কলি?

পিঙলা হেসে বললে–ইটা লাগিনী গ বাবা। বাঘটা লাগিনীর হাতে মরিছে।

চিৎকার করে উঠল গঙ্গারাম—খ্যানত ক্যানে করলি? ঘাটে বস্যা ধেয়ান না কর‍্যা ইটা কি হইল?

পিঙলা স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। এ তার বিচিত্র দৃষ্টি। মনে হয় ওর প্রাণটাই যেন আগুনে জ্বলতে জ্বলতে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

ভাদু এবার এগিয়ে এসে বললে–ইটা তুই কি কইছিল গঙ্গারাম? বাঘের মুখে পরানটা যেত না?

পিঙলা হেসে বললে—সে ভালই হইত রে ভাদু মামা। লাগিনীর হাত হইতে বাঘটা কেঁচা যেত।

তারপর বললে—লে, নাকাড়া বাজা, পূজা আন। মা তো জাগিছেন রে। চাক্ষুষ পেমাণ তো মোর হাতেই রইছে। পদ্মলাগিনী। অরে হাবু, লে তো–সড়কিটা জলে পড়িছে—তুল্যা আন তো। দে, শিরবেদেকে ফিরায়ে দে। আঃ, কি রকম সড়কি ছুড়িস তু শিরবেদে হয়্যা–ছি-ছি-ছি! ভাম হয়ে দাঁড়ায়ে ক্যানে গ? লে লে, পূজা আন্। বাঘাটার চামড়াটা ছাড়ায়ে লিবি তোলে। আর দাঁড়ায়ে থাকিস না। বেলা দুপহর চলে গেল তিন পহর হয়-হয়। জমুনীর ঘুম ভাঙিছে, খিদা লাগে না। বাজা গ, তুরা বাজা।

বাজতে লাগল নাকাড়া।

গঙ্গারাম যাই বলুক, বেদেপাড়ার লোক এবার খুব খুশি! এবার শিকার হয়েছে প্রচুর। খরগোশ, সজারু, তিতির অনেক পাওয়া গিয়েছে। তার উপর হাঁস বলি হবে। হিজল বিলের ধারে সাতালী গ্রাম, সেখানে মাংস দুর্লভ নয়। ফাঁদ পাতলেই সরালি হাস, জলমুরগি পাওয়া যায়; কাদাখোঁচা, হাঁড়িচাচা, শামকল দল বেঁধে বিলের ধারে ধারে লম্বা পা ফেলে ঘুরছে। বাঁটুল মেরে তীর ছুঁড়ে তাও মারা যায় অনায়াসে। কিন্তু তা বলে আজকের খাওয়ার সঙ্গে সে খাওয়ার তুলনা হয়! আজিকার এই দিনটির জন্য আজ দু-তিন মাস ধরে আয়োজন করছে, সংগ্রহ করছে। কার্তিক মাসে হিজল বিলের পশ্চিমের মাঠ রবি-ফসলে সবুজ হয়ে ওঠে। গম, যব, ছোলা, মসুরি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন—হরেক রকম ফসল। ফসল পাকলে বেদেরা সেই ফসল কুড়িয়ে সংগ্রহ করে, চুরি করে সংগ্রহ করে। পেঁয়াজ, রসুন, মসুরি তারা সযত্নে রেখে দেয় এই দিনটির জন্যে। পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা মরিচ দিয়ে পরিপাটি করে রান্না করবে মাংস; আজ খাবে পেট ভরে; কালপরশুর জন্য বাসি করে রেখে দেবে। বাসি মাংস রাঁধবে মসুরি কলাই মিশিয়ে। এমন অপরূপ খাদ্য কি হয়! কাজেই আজ শিকার বেশি হওয়ায় সকলেই খুশি। তার উপর মা-বিষহরির মহিমায় নাগ মেরেছে। বাঘ। বাঘের চামড়াটা ছাড়ানো হচ্ছে। ওটাকে নুন মাখিয়ে শুকিয়ে নিয়ে মায়ের খানের আসন হবে। জয় জয় বিষহরি! পদ্মাবতী! জয় জয় বেদেকুলের জনী!

জয় বিষহরি গ! জয় বিষহরি গ!
সকল দুস্ক হইতে মোরা তুমার কৃপায় তরি গ!
অ–গ।

উৎসব আরম্ভ হয়ে গেল। বাজতে লাগল নাকাড়া, বিষম্যাকি। বাজতে লাগল তুমড়ী বশি, চিমটের কড়া। পিঙলা বসেছে মাঝখানে—ছেড়ে দিয়েছে সদ্য-ধরা পদ্মনাগিনীকে। অবশ্য এরই মধ্যে তার বিষদাঁত ভেঙে তাকে কামিয়ে নিয়েছে। সদ্য-ধরা নাগিনী, বন্দিনীদশার ক্ষোভে, মুখের ক্ষতের যন্ত্রণায় অধীর হয়ে মাথা তুলে ক্রমাগত ছোবল মারছে। পিঙলা হাতের মুঠা ঘুরিয়ে, হাঁটু দুলিয়ে, তাকে বলছে—নে, দংশা, দংশা না দেখি! ঠিক ছোবলের সময় হাঁটু বা হাত এমনভাবে সরে যাচ্ছে যে, নাগিনী মুখ আছড়ে পড়ছে মাটিতে। পিঙলা গাইছে–

নাগিনী তুই ফুঁসিস না।
ও কালামুখী নাগিনী লো—এমন করা যুঁসিস না।
ও দেখলে তারে পাগল হবিতাও কি লো তুই বুঝিস না!
এমন কর‍্যা ফুঁসিস না।

ওদিকে গঙ্গারাম বসেছে মদের আসর পেতে। চোখ দুটো রাঙা কুঁচের মত লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে আজ গম্ভীর। অন্য কেউ লক্ষ্য না করলেও ভাদু সেটা লক্ষ্য করেছে। গঙ্গারামকে ভাদু ভাল চোখে দেখে না। ভাদু বেদের দেহখানা যেমন প্ৰকাণ্ড, সাহসও তেমনি প্রচণ্ড। সাপ ধরতে, সাপ চিনতেও সে তেমনি ওস্তাদ। গঙ্গারাম ডাকিনী-সিদ্ধ; হোক ডাকিনীসিদ্ধ, কিন্তু বিষবিদ্যায় ভাদুর কাছে সে লাগে না। মহাদেবের কাছে সে বিদ্যাগুলি শিখে নিয়েছে। পিঙলার মামা ভাদু। মা-বাপ-মরা কন্যেটিকে সে-ই মানুষ করেছিল। তাকে নাগিনী-কন্যারূপে আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে করেছিল ভাদু। শবলার সঙ্গে যখন মহাদেবের বিবাদ চরমে উঠেছিল, যখন মহাদেব মা-বিষহরিকে ডাকছিলমা গগা, জননী গো নতুন কন্যে পাঠাও। বেদেকুলের জাতধরম বাঁচাও। পুরনো কন্যের মতি মলিন হল মা, সর্বনাশীর পরানে। সর্বনাশের তুফান উঠিছে। সৰ্বনাশ হবে। তুমি বাঁচাও। নতুন কন্যে পাঠাও। তখন দুই বলেছিল-পিঙলার পানে তাকায়ে দেখিছ ওস্তাদ? দেখো দেখি ভাল করে! কেমন-কেমন লাগে যেন আমার।

—কেমন লাগে?

–ললাটে লাগচক্ক দেখবার দিষ্টি মুই কোথা পাব? তবে ইদিকের লক্ষণ দেখা যেন মনে লাগে—লতুন কন্যে আসিছে, ফুটিছে কন্যেটির অঙ্গের লক্ষণে।

এই জাগরণের দিনে—এই আগুনের অ্যাঁচে যেদিন নাগরা ঘুম থেকে জাগে, এই দিনের উৎসবেই ভাদু পিঙলার হাত ধরে মহাদেবের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছিল—দেখ দেখি ভাল কর‍্যা।

–হঁ!হঁ!হঁ!

চিৎকার করে উঠেছিল মহাদেব–জয় মা-বিষহরি। লাগচক্ক! লাগচক্ক! কন্যের ললাটে লাগচক্ক! এলেন—এলেন। লতুন কন্যে এলেন।

পিঙলা হল নতুন নাগিনী কন্যা। ভাদু হল মহাদেবের ডান হাত। শবলা পিঙলাকে বলেছিল—তুর ভয় নাই পিঙলা! তুর অনিষ্ট মুই করব না। তুরে মুই সব শিখিয়ে যাব, বল্যা যাব গোপন কথা। ভাদুকে কিন্তু সাবধান। তুর মামা হলি কি হয়,–শিরবেদের মন রেখে তুরে নাগিনী কন্যে করে দিলে। শিরবেদের পরে উই হবে শিরবেদে। উকে সাবধান। নাগিনী কন্যে আর শিরবেদে–সাপ আর নেউল। ই বিবাদ চিরদিনের। উরে সাবধান!

গঙ্গারাম ফিরে না এলে ভাদুই হতে শিরবেদে। ভাদুর মন্দকপালের জন্যই গঙ্গারাম ফিরল। প্রথম প্রথম গঙ্গারাম ভাদুর কথা শুনেই চলত। কিন্তু ডাকিনী-সিদ্ধ গঙ্গারাম কিছুদিনের মধ্যেই ভাদুকে ঝেড়ে ফেলে দিলে। ভাদুও বিষবিদ্যা ওস্তাদ, সেও তো সামান্য জন নয়, ঝেড়ে ফেলতে গেলেই কি ফেলা যায়? সে-বিদ্যার জোরে নিজের আসন রেখেছে, সেই আসনে বসে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে গঙ্গারামের উপর।

গঙ্গারাম আজ গম্ভীর, সেটা ভাদু লক্ষ্য করেছে। সে জিজ্ঞাসা করলে—কি ভাবিছ গ শিরবেদে?

—অ্যাঁ? কি ভাবিব?

–তবে? আনন্দ কর–আনন্দের দিন। দিন গেল্যা—তো চলাই গেল। হাস খানিক।

–হাসিব কি? তু কইলি—খ্যানত হয় নাই। কিন্তু আমার মনে তা লিছে না। কন্যাটা খ্যানত করিছে। উটা হইছে সাক্ষাৎ পাপ।

—তবে মায়েরে ডাক। লতুন কন্যে দিবেন জনী। পাপ বিদায় হবে। লয় তো–। হাসলে ভাদু।

–হাসিলি যে? লয় তো কি, না বলা চুপ করলি? বল, কথাটা শ্যাম কর।

কথা শেষ হবার অবকাশ হল না। এসে দাঁড়াল দুজন বেদে।–লোক আসিছে গ!

—লোক?

–হঁ। লোক আসিছে ডাক নিয়া।

–ডাক নিয়া?

অর্থাৎ আহ্বান এসেছে বিষবৈদ্যের। কোথাও নাগ-আক্রমণ হয়েছে। মানুষ শরণ মেগেছে। বিষহরির সন্তানদের সঙ্গে সঙ্গে যেতে হবে–এই নিয়ম।

দংশন হয়েছে বড় জমিদার-বাড়িতে। সাঁতালী থেকে ক্রোশ তিনেক পশ্চিমে; পুরনো জমিদার-বাড়িতে গত বৎসর থেকেই নাগের উপদ্রব হয়েছে। গত বৎসর বর্ষায় সাতাশটা গোখুরার বাচ্চা বেরিয়েছিল। বাড়ির দরজায় উঠানে, আশপাশে ঘরের মেঝেতে পর্যন্ত। বাবুরা ডেকেছিলেন—মেটেল বেদেদের। ওখানে ক্ৰোশখানেকের মধ্যেই আছে মেটেল বেদে। মেটেল বেদেরা বিষহরির সন্তান নয়। ওরা সাধারণ বেদে। ওরা জলকে এড়িয়ে চলে। মাটিতে কারবার। হাঁটা-পথে ওরা ঘুরে বেড়ায়। ওরা সাপ বিক্রি করে। ওরা চাষ করে, লাঙল ধরে। সাঁতালীর বিষবেদেদের সঙ্গে ওদের অনেক তফাত।

ওরা অবশ্য বলে—তফাত আবার কিসের?

সাঁতালীর বেদেরা হাসে। তফাত কি? নিয়ে এস মাটির সরায় জীবের তাজা রক্ত। ফেলে দাও গোখুর কি কালনাগিনীর এক ফোঁটা বিষ। কি হবে? বিষের ফোঁটা পড়বামাত্র রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠবে, আগুনের অ্যাঁচে ফুটন্ত জলের মত। তারপর খানা খানা হয়ে ছানার মত কেটে যাবে। খানিকটা জল টলটল করবে তার উপর ভাসবে জলের উপর তেলের মত নাগ-গরল! তারপর? আয় রে মেটেল বেদে! নিয়ে আয় রে জড়িবুটি-শিকড়-পাথর-মন্ত্ৰ-তন্ত্র। নে, ওই জমাটবাঁধা রক্তকে কর আবার তাজা রক্ত। নাই, নাই সে বিদ্যে তোদের নাই। সে বিদ্যা আছে সাঁতালীর বিষবেদেদের। তারা পারে—তারা পারে। তাদের সাঁতালীতে এখনও আছে। সাঁতালী পাহাড় থেকে আনা এক টুকরা মূল্যের লতা। সেই লতার রস, তাজা লতার রস ফেলে দেবে সেই জমাটবাঁধা রক্তে; হকবেমা-বিষহরিকে স্মরণ করে তাদের মন্ত্র। দেখবি, তেলের মত সাপের বিষ মিলিয়ে যেতে থাকবে, জমাটবাঁধা রক্তের ঢেলা আর জল মিশে যাবে। মনে হবে, গলে গেল আগুনের অ্যাঁচে ননীর মত।

ঝাঁপান খেলা দেখে যাস সাঁতালীর বিষবেদেদের। তাদের সঙ্গে তোদর তুলনা! হা-হা করে হাসে বিষবেদেরা।

গত বছর সেই মেটেল বেদেদের ডাক দিয়েছিলেন বাবুরা। তারা এসে হাত চালিয়ে গুনে বলেছিল—এ উপদ্রব ঘরের নয়, বাইরের। বাড়ির বাইরে কোথাও নাগের বংশবৃদ্ধি হয়েছে; সেই। বংশের কাচ্চাবাচ্চারা বড় বাড়ির শুকনো ভকতকে মেঝেতে ঘর খুঁজতে এসেছে। তারা জড়ি দিয়ে, বিষহরির পুষ্প দিয়ে, মন্ত্ৰ পড়ে বাড়ির চারিপাশে গণ্ডি টেনে দিয়েছিল, গৃহবন্ধন করে দিয়েছিল; বাবুরাও বিলাতি ওষুধ ব্যবহার করেছিলেন। ওদিকে আশ্বিন শেষ হতেই কার্তিকে নাগেরা কালঘুমে মুদ নিয়েছিল। এবার এই ফাল্গুন মাসেই নাগ দেখা দিয়েছেন তিন দিন। বাড়ির পুরনো মহলে রান্নাবাড়ি ভাড়ার ঘর; সেই ভঁড়ারে গিনি দুদিন দেখেছেন নাগকে। প্ৰকাণ্ড গোখুরা। ভোররাত্রে পাঁচক ব্রাহ্মণ উঠেছিল বাইরে; ঘর থেকে বাইরে দু পা দিতেই তাকে দংশন করেছে। মেটেল বেদেদের ডাকা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বিষবেদেদের কাছেও লোক এসেছে। যেতে হবে।

ভাদু উঠে দাঁড়াল। কানে নাকে হাত দিয়ে মাকে স্মরণ করে বললে–গঙ্গারাম!

–হাঁ।

গঙ্গারাম জননীকে স্মরণ করে উঠেই চলে গেল নাচ-গানের আসরে।

আজিকার দিন, কন্যাকেও সঙ্গে যেতে হবে। কন্যা নইলে মা-বিষহরির পুষ্প দিয়ে গৃহবন্ধন করবে কে?

সাঁতালী গ্রামের বেদে-বেদেনীরা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এমন শুভ লক্ষণ পঞ্চাশ বছরে হয়। নাই। জাগরণের দিনে এসেছে এমন বড় একটা ডাক।

নিয়ে আয় কাঁপিবুলি, তাগা, শিকড়, বিশল্যকরণী, ঈশের মূল, সাঁতালী পাহাড়ের সেই লতার পাতা, পাতা যদি না দেখা দিয়ে থাকে তবে এক টুকরো মূল। মূল খুঁজে না পাস, নিয়ে আয় ওখানকার খানিকটা মাটি। বিষহরির পুষ্প সঙ্গে নে, আর নে বিষপাথর। ঝাঁপি নে খালি কাঁপি, আর খন্তা নিয়ে চল।

সাঁতালী পাহাড়ের মূল থেকে পাতা আজও গজায় নাই। নতুন বছরের জল না পেলে গজায় না। মূলও তার পুরনো হয়েছে। তার উপর কেটে কেটে মূলও হয়ে পড়েছে দুর্লভ।

ভাদু বললেওতেই হবে। মানুষটা বাঁচবে বলে মনে লাগছে না। ভোররাত্রের কামড় সাক্ষাৎ কালের কামড়। ওতে বাঁচে না। যদি পরানটা থাকেও এতক্ষণ, তবুও ফিরবে না। তবে জমিদার-বাড়ির লাগ-বন্দি করলে শিরোপা মিলবে।

পিঙলা বললে তুরা যা, মই যাব না।

–ক্যানে?

–না। অধরমের শিরোপা নিয়া মোর কাজ নাই।

–কন্যে! গম্ভীর স্বরে শাসন করে উঠল গঙ্গারাম।

সঙ্গে সঙ্গে ভাদুও যোগ দিলে—পিঙলা!

পিঙলা হাসলে বিচিত্ৰ হাসি। বাবুদের বাড়ির তোক দুটি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, তারা বললে—গিনি-মা বারবার করে বলে দিয়েছেন, ওদের কন্যেকে আসতে বলবি। বিষহরির পূজা করাব।

কি বলবে পিঙলা এদের সামনে? কি করে বলবে?

ভাদু বললেহোথাকে বিষ লহমায় এক যোজন ছুটছে কন্যে—নরের রক্তে নাগের বিষ পাথার হত্যা উঠছে। সে পাথারে পরান-পুতুল ড়ুব্যা গেলে আর শিবের সাধ্যি হবে নাই। চল্‌—চল্‌। দেরি করলে অধরম হবে।

–অধরম? হাসলে পিঙলা।—মুই অধরম করছি?

–হাঁ, করছিল।

—তবে চল্‌। তোর ধরম তোর ঠাঁই। তোর ললাটও তোর ঠাঁই। মই কিন্তুক সাবধান করা দিছি তুকে। তু সাবধান হয়্যা লাগ-বন্দি করিস।

তির্যক দৃষ্টিতে চাইলে তার দিকে–ভাদু গঙ্গারাম দুজনেই।

তাতেও ভয় পেল না পিঙলা। বললে—মহিষের শিঙ দুটা বাঁকা, ইটা ইদিকে যায় তো উটা উদিকে যায়। কিন্তু কাজের বেলায়—যুঁজবার বেলা দুটার মুখই এক দিকে!

গঙ্গারাম উত্তর দিলে না। ভাদু হাসলে। বললে—কন্যের আমাদের বড় খর দিষ্টি গ। দিষ্টিতে এড়ায় না কিছু।

গামছাটা কোমরে ভাল করা জড়ায়ে লে গ।

গঙ্গারাম চমকে উঠল।

ভাদু বললে অঃ, খুব বলেছিস গ কন্যে। বেঁচ্যা থাক্ গ বিটি। বেঁচ্যা থাক্।

ললাট করবার লেগ্যা? তা মুই বাঁচিব অনেক কাল। বুঝলা না মামা, বাঁচিব মুই অনেক কাল। আজ যখন সড়কিটা বাঘ না বিঁধ্যা, বাতাস বিঁধ্যা জলে পড়িছে, তখুন বাঁচিব মুই অনেক কাল।

হেসে উঠল সে।

গঙ্গারাম পিছিয়ে পড়েছিল। সে কাপড় সেঁটে, গামছা কোমরে ভাল করে বেঁধে নিচ্ছিল। এগিয়ে এসে সঙ্গ নিয়ে সে বললে—কি? হাসিটা কিসের গ?

সড়কির কথা বুলছে কন্যে।

হুঁ–।

মুইও বুঝতে পারি কি করে ফসকায়ে গেল।

–কাকে রে? বাঘটাকে না পাপিনীটাকে?

–কি বুলছিস ত গ?

—বুলছি, চাল সিদ্ধ করলি পর ভাত হয়। এমুন আশ্চয্য কথা শুনেছিস কখুনও? সে আবার হেসে উঠল।
জনহীন হিজলের পশ্চিম কূল তার হাসিতে যেন শিউরে উঠল। ঘন গাছপালার মধ্য থেকে একটা। কোকিল পিকপিক শব্দ করে উড়ে চলে গেল; এক ঝাক শালিক বসে ছিল মাঠের মধ্যে, তারা কিচমিচ কলরব করে, পাখায় ঝরঝর শব্দ তুলে উড়ল আকাশে। সে হাসি যেন পাতলা লোহার কতকগুলো ছুরি কি পাত ঝনঝনিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

গঙ্গারাম আবার তার দিকে ফিরে চাইলে। ভাদুও তাকালে আবার।

আবারও হেসে উঠল পিঙলা।

গঙ্গারাম এবার বললে হাসিস না তুকে বলছি মুই।

ভাদু মৃদুস্বরে বললে—সাথে লোক রইছে গ কন্যে। ছিঃ! ঘরের কথা লিয়ে পরের ছামুতে—না, ইটা করিস না।

পিঙলা তখন খানিকটা পরিতৃপ্ত হয়েছে। অনেক কাল হেসে এমন সুখ সে পায় নাই। এবার তার খেয়াল হল, সঙ্গে বাবুদের বাড়ির লোক রয়েছে। তাদের সামনে এ কথার আলোচনা সঙ্গত। হবে না। মনে পড়ল মা-মনসা ও বেনেবেটির কাহিনীর কথা। মা বেনেবেটিকে বলেছিলেন কন্যে, সব দিক পানে চেয়ো, কেবল দক্ষিণ দিক পানে চেয়ো না। বেনেবেটির অদৃষ্ট, আর নরে নাগে বাস হয় না। একদিন সে নাগেদের দুধ জ্বাল না দিয়ে পড়ল ঘুমিয়ে। নগেরা গিয়েছিল। বিচরণ করতে। পাহাড়ে অরণ্যে সমুদ্রে নদীতে বিচরণ করে তারা ফিরল। ফিরে তারা দুধ খায়—দুধের জন্য এল। এসে দেখে, বেনে বোন ঘুমুচ্ছে—তারা কেউ তার হাত চাটলে, কেউ গা চাটলে, কেউ পা চাটলে, কেউ ফেঁসফুসিয়ে বললেও বেনে বোন, খিদে পেয়েছে, তুই ঘুমুবি কত? বেনেবেটির ঘুম ভাঙল, লজ্জা হল, ধড়মড়িয়ে উঠে বললে—এই ভাইয়েরা, একটু সবুর কর, এখুনি দিচ্ছি। হুড়মুড়িয়ে খড় তালপাতা নিয়ে উনুন জ্বাললেন, দুড়দুড়িয়ে জ্বাল দিলেন, টগরগিয়ে দুধ ফুটল; বেনেবেটি কড়া নামালেন। তারপর হাতায় দুধ মেপে কাউকে দিলেন বাটিতে, কাউকে গেলাসে, কাউকে খোরায়, কাউকে পাথরের কটোরায়, কাউকে কিছুতে অর্থাৎ হাতের কাছে যা পেলেন তাতেই দুধ পরিবেশন করে বললেন-খাও ভাই।

আগুনের মত গরম দুধ, সে দুধে মুখ দিয়ে কারুর ঠোঁট পুড়ল, কারুর জিভ, কারুর গলা, কারুর বা বিষের থলি পুড়ে গেল। যন্ত্রণায় সহস্র নাগ গর্জে উঠল। তারা বললে—আজ বেনেকন্যেকে খাব।

মা-মনসার টনক নড়ল, আসন টলল, তিনি এলেন ছুটে। বললেন—থাম্‌ থাম্।

না, খাব আজ বেনে-কন্যেকে। সহস্ৰ নাগের বিষে মরুক জ্বলে—আমরা জ্বালায় মরে গেলাম।

মা বললেন—দশ দিনের সেবা মনে কর, এক দিনের অপরাধ ক্ষমা কর্। দশ দিন সেবা করতে গেলে একদিন ভুলচুক হয়—অপরাধ ঘটে। ক্ষমা করতে হয়।

নাগেরা ক্ষান্ত হল সেদিন, বললে—আর একদিন হলে ক্ষমা করব না কিন্তু।

মা বললেন—তার দরকার নাই বাবা। কন্যেকে স্বস্থানে রেখে এস গিয়ে। নরে নাগে বাস। হয় না। আমি বলছি, রেখে এস।

বেনে-কন্যে মর্তে স্বস্থানে আসবেন। উদ্যোগ হল, আয়োজন হল। বেনে-কন্যে ভাবলেন—এই তো যাব, আর তো আসব না। তা সব দিক দেখেছি, কেবল দক্ষিণ দিক দেখি নাই। মায়ের বারণ ছিল। এবার দেখে যাই দক্ষিণ দিক।

ঘরের বন্ধ-করা দক্ষিণের দুয়ার খুললেন। খুলেই শিউরে উঠলেন। সামনেই মা-বিষহরি। বিষবিভোর রূপ ধরে বসে আছেন, যে রূপ দেখে স্বয়ং শিব অভিভূত হয়ে ঢলে পড়েছিলেন। নাগ-আসনে বসেছেন, নাগ-আভরণে সেজেছেন, বিষের পাথার গষে পান করছেন আবার উগরে দিচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সে পাথার সহস্র গুণ বিশাল হয়ে উথলে উঠছে। সে বিষপাথারের স্পৰ্শ লেগে নীল আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে, বাতাস বিষের গন্ধে ভরে উঠেছে, সে বাতাস অঙ্গে লাগলে জ্বলে যায়, নিশ্বাসে নিলে জ্ঞান বিলুপ্ত হয়। এই রূপ দেখেই ঢলে পড়ে গেলেন। বেনে-কন্যা। ওদিকে অন্তর্যামিনী মা জানতে পেরেছেন, তিনি বিষহরির বিষময়ী মূর্তি সংবরণ করে অমৃতময়ী রূপ ধরে এসে তার গায়ে অমৃত স্পৰ্শ বুলিয়ে দিলেন, জিজ্ঞাসা করলেন-ও বেনেবেটি, কি দেখলি বল?

—না মা, আমি কিছু দেখি নাই।

–ও বেনেবেটি, কে দেখলি বল্‌?

–না মা, আমি কিছু দেখি নাই।

—ও বেনেবেটি, কি দেখলি বল?

–না মা, আমি কিছু দেখি নাই।

মা তখন প্রসন্ন হয়ে বলেছিলেন—তুই আমার গোপন কথা ঢাকলি স্বর্গে—তোর কথা আমি ঢাকব মর্তে। গোপন কথা ঢাকতে হয়, যে ঢাকে তার মহাপুণ্য। সেই মহাণ্য হবে তোর। স্বৰ্গ অমৃতের রাজ্য, সেখানে মা বিষ পান করেন বিষ উদার করেন—সে যে দেবসমাজে কলঙ্কের কথা। মায়ের এই মূর্তির কথা বেনেবেটি স্বীকার করলে, স্বর্গে প্রকাশ পেলে, মায়ের কলঙ্ক রটত।

মোর ঢাকলি স্বর্গে, তোর ঢাকব মর্ত্যে মা-বিষহরির কথা।

থাক গঙ্গারামের গোপন কথা—দশের সামনে ঢাকাই থা। পিঙলা নীরব হল। প্রসন্ন। অন্তরেই পথ চলতে লাগল।

দ্রুতপদে হেঁটে চলল।

হিজলের পশ্চিম কূলের মাঠের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে পথ। পথে একটু ধুলো। গঙ্গার পলিমাটি-মিহি ফাগের মত নরম। ফাগুনের তিন পহর বেলায় পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, পায়ের তলায় ধুলো তেতে উঠেছে, বাতাসে গরমের অ্যাঁচ লেগেছে। এ বাতাসে পিঙলার সর্বদেহে যেন একটা নেশার জ্বালা ধরে যাচ্ছে। মাঠে তিল-ফসলে বেগুনি রঙের ফুল ফুটেছে। একেবারে যখন চাপ হয়ে ফুল ফুটবে তখন কি শোভাই হবে! কতকগুলি ফুল তুলে সে খোপায়

জলে।

গঙ্গারাম বললে—তিলফুল তুল্যা খোঁপায় দিলি-তিলশুনা হবে তুকে। চৈতলক্ষ্মীর কথা জানিস?

–জানি। তিলশুনা তো খেটেই যেছি অমনিতে, যাবার সময় তুকে দিয়া যাব গজমতির হার। চৈতলক্ষ্মীর কথা যখন জানিস, তখন মা-লক্ষ্মী যাবার কালে বেরাহ্মণীকে গজমতির হার দিয়া গেছিল—সে কথাও তো জানি।

গজমতির হার–অজগর সাপ।

ব্ৰতকথায় আছে, ব্রাহ্মণী ছদ্মবেশিনী লক্ষ্মীকে হতশ্রদ্ধা করতেন, অপমান করতেন। কিন্তু লক্ষ্মী যখন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে বৈকুণ্ঠে যাবার জন্য রথে চড়ছেন, তখন প্রলুব্ধা ব্রাহ্মণী ছুটে গিয়ে বললে,-মা, একজনকে এত দিলে, আমাকে কি দেবে দিয়ে যাও।

তখন মা হেসে বললেন—তোমার জন্য হুড়কোকোটরে আছে গজমতির হার।

ব্রাহ্মণী ছুটে এসে হাত পুরলেন হুড়কোকোটরে। সেখানে ছিল এক অজগর, সে তাকে দংশন করলে।

গঙ্গারাম হাসলে। এ কথা সে জানে। পিঙলার মনের বিদ্বেষের কথাও সে জানে। আজ সত্যই তাকে লক্ষ্য করেই সে সড়কিটা ছুঁড়েছিল। কিন্তু পিঙলা জাত-কালনাগিনী। নাগিনী মুহূর্তে অদৃশ্য হয়। ওই নাগিনী-এই কথা বলে চোখের পলক ফেল, দেখবে কই, কোথায়?… নাই নাগিনী। ব্যাধের উদ্যত বাণ ছাড়া পেতে পেতে সে মায়াবিনীর মত মিলিয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবেই পিঙলা আজ ডোঙার উপর থেকে অদৃশ্য হয়েছিল। লক্ষ্য করা পর্যন্ত পিঙলা তার সড়কির ফলার ঠিক সামনে ছিল। সড়কি ছাড়লে গঙ্গারাম ব্যস, নাই। তখন ডোঙার উপর শূন্য, হিজল বিলের জল তখন দুলছে, পিঙলা তখন জলের তলায়। গঙ্গারাম হাজার বাহবা দিয়েছে মনে মনে।

বাহাবাহাবাহ! পিঙলা চলছে—যেন হেলেদুলে চলছে। দেখে বুকের রক্ত চলকে ওঠে। গঙ্গারামের চোখে আগুন জ্বলে।

গঙ্গারামগঙ্গারাম। সে দুনিয়ার কিছু মানে না। সব ভেলকিবাজি, সব ঝুট। সব ঝুট। কন্যে? হিহি করে হাসতে ইচ্ছে করে গঙ্গারামের।

ভাদু পথে চলছে আর মন্ত্র পড়ছে, মধ্যে মধ্যে একটা দড়িতে গিঠ বাঁধছে। এখান থেকেই সে মন্ত্ৰ পড়ে গিঠ দিয়ে বাঁধন দিচ্ছে, রোগীর দেহে বিষ যেন আর রক্তে না ছড়ায়। যেখানে রয়েছিস গরল, সেইখানেই থির হয়ে দাঁড়া; এক চুল এগুলো তোকে লাগে মা-বিষহরির কিরা। নীলকণ্ঠের কণ্ঠে যেমন গরল থির হয়ে আছে—তেমুনি থির হয়ে থাক্। দোহাই মহাদেবের নীলকণ্ঠের! দোহাই আস্তিকের! মা-বিষহরির বেটার!

পৃথিবীতে নাগ-নাগিনীকে বলে মায়াবী। যে ক্ষণে তারা মানুষের চোখে পড়ে, যে ক্ষণে মানুষ চঞ্চল হয়, বলেওই সাপ!—সেই ক্ষণেই নাগ-নাগিনী লোকচক্ষুর অগোচর হয়। মিলিয়ে তো যায় না, লুকিয়ে পড়ে। মায়াটা কথার কথা মিলিয়ে যাবার শক্তি ওদের নাই, ওরা চতুর; যত চতুর তত ত্বরিত ওদের গতি, তাই লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তার চাতুরী বেদের চক্ষে ছাপি থাকে না। সাপের চেয়েও বেদে চতুর, তার চাতুরী সে ধরে ফেলে। লুকিয়ে পড়েও বেদের হাত থেকে রেহাই পায় না। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে।

পিঙলা বলে—কিন্তু একজনের কাছে কোনো চাতুরীই খাটে না রে। বাবা গ! ইন্দ্ররাজার হাজার চোখ-ধরমদেবের হাজার চোখ নাই, একটি চোখ মাঝ-ললাটে—সে চোখের পলক নাই, তার দৃষ্টিতে কিছু লুকানো যায় না, কোনো চাতুরী খাটে না।

বারবার সেই কথা বলে পিঙলা সাবধান করে দিলে গঙ্গারামকে।–চাতুরী খেলতে যাস না, চাতুরী খেলতে যায় না।

গঙ্গারাম দাঁত বার করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে। কোমরের কাপড়টা সেঁটে বাঁধছিল সে। বললে-চুপ কর তু। গঙ্গারাম ভাদু দুজনেই কোমরে কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে দুটো গোখুরা। রাজবাড়িতে নাগ যদি থাকে তো ভালই, একটা থাকলে তিনটে বের হবে। দুটো থাকলে চারটে বের হবে। না থাকলে, দুটো পাওয়া যাবেই। সাপ থাকে ঘরের অন্ধকার কোণে। সেখানে গর্ত দেখে গর্তটা খুঁড়বার সময়-চতুর বেদে সুকৌশলে কোমরে বাধা সাপ দুটোকে ছেড়ে দিয়ে ধরে আনবে, বলবে—এই দেখেন সাপ!

মোটা শিরোপা মিলবেই। পিঙলার এটা ভাল লাগল না। অধর্ম করবে সাঁতালীর বেদেরা? মেটেল বেদেরা করে, ইসলামী বেদেরা করে—তাদের সাজে। সে সাবধানে করে দিলে। কিন্তু গঙ্গারাম দাঁত বার করে ঘাড় বেঁকিয়ে বললে—চুপ কর তু।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিঙলা বললে—বেশ, তাই চুপ করলাম, তোদের ধরম তোদের ঠাঁই!

বাবুদের পাঁচক বামুন বাঁচে নাই। সে মরে গিয়েছিল। তারা আসবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেটেল বেদে, ডাক্তার, অন্য জাতের ওঝা-কেউ কিছু করতে পারে নাই।

পরের দিন সকালে সাপ ধরার পালা। বাইরে নয়, ঘরেই আছে সাপ।

প্রকাণ্ড বড় বাড়ি। পাকা ইটের গাঁথনি। চারিপাশ ঘুরে গণ্ডি টেনে দিয়ে এল। তার পর ভিতরে বাহিরমহল থেকে পুরনো মহলে ঢুকল। ওই মহলেই পাঁচক বামুনকে সর্পাঘাতে মরতে হয়েছে।

উঠানে বসে খাড়ি দিয়ে ঘরের ছক এঁকে মাটিতে হাত রেখে বসল ভাদু। হাত গিয়ে ঢুকল ছকের ভঁড়ার-ঘরে। এবার বেদেরাও উঠান থেকে গিয়ে ঢুকল ভাড়ার-ঘরে। অন্ধকার ঘর। তাদের নাকে একটা গন্ধ এসে ঢুকল। আছে। এই ঘরেই আছে। আলো চাই। আনুন আলো।

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিঙলা সকলের পিছনে। দেখছে সে।

গঙ্গারাম হাঁকলে—আলো আনেন, হাঁড়ি আনেন। দু-তিনটা ঘঁড়ি আনেন। লাগ একটা লয় বাবা-দুটো-তিনটা। একটা পদ্মলাগ মনে লিচ্ছে। ধরব, বন্দি করব। শিরোপা লিব। আনেন।

—সবুর। হাঁক উঠল পিছন থেকে। ভারী গলায় কে হাঁকলে।

চমকে উঠল পিঙলা। গঙ্গারাম ফিরে তাকালে। ভাদু চোখ তুললে।

একজন অপরূপ জোয়ান লোক, মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়িগোঁফ, হাতে তাবিজ, গলায় পৈতে, গৌরবর্ণ রঙ, সবল দেহ, চোখে পাগলের দৃষ্টি–লোকটি এসে দাঁড়াল সামনে। তার সে পাগলা চোখ গঙ্গারামের কোমরের কাপড়ের দিকে। চোখের চাউনি দেখে পিঙলা মুহূর্তে সব বুঝতে পারলে। কেঁপে উঠল সে। কি হবে? সাঁতালীর বিষবেদেকুলের মানমর্যাদা এই রাজবাড়িতে উঠানের ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে যেতে হবে?

মা-বিষহরি গ! বাবা মহাদেব গ! উপায় কর। মান্য বচাও। যে সাঁতালীর বিষবেদের মন্ত্রের হাঁকে একদিন গর্ত থেকে নাগ বেরিয়ে এসে ফণা ধরে দাঁড়াত সেই সাঁতালীর বিষবেদেরা আজ চোর সেজে মাথা হেঁট করে ফিরবে? মেটেল বেদেরা আসবে, টিটকারি দেবে; এতবড় রাজার বাড়িতে নাগবন্দি দেখতে এসেছে কত লোক, মান্যগণ্য মানুষ তারা। বিষবেদেদের চোর। অপবাদ পথের দুপাশে ছড়াতে ছড়াতে তারা চলে যাবে। উপায় কর মা-বিষহরি।

লোকটি গম্ভীরস্বরে বললে—বেরিয়ে আয় আগে।

–আজ্ঞা?

–আগে তোদের তল্লাস করব। দেখব তোদের কাছে সাপ আছে কি না! দু হাত উপরে তুলে দাঁড়াল গঙ্গারাম। চোখ তার জ্বলে উঠল। কোমরে তার কাপড়-জড়ানো অবস্থায় বাঁধা রয়েছে সেই কালকের ধরা পদ্মনাগ। মরিয়া বেদের ইচ্ছা—কাপড় খুলে পদ্মনাথ বের করতে গিয়ে নাগ যদি ওকে কামড়ায় তো কামড়াক। ভাদুর কোমরেও আছে একটা গোখুরা। সে তার কোমরে হাত দিচ্ছে, খুলে ছুঁড়ে দেবে কোণের অন্ধকার দিয়ে। কিন্তু সতর্ক পাগলাটার চোখ নেউলের মত তীক্ষ্ণ। সে বললে খবরদার! সাঁড়া, উঠে দাঁড়া। দাঁড়া।

সে গলার আওয়াজ কি! বুকটা যেন গুরগুর করে কেঁপে উঠছে।

–চল, বাইরে চল্‌।

—ঠাকুর! সামনে এসে দাঁড়াল নাগিনী কন্যা পিঙলা। সঙ্গে সঙ্গে একটানে খুলে ফেললে তার পরনের একমাত্র লাল রঙের খাটো কাপড়খানা, পূর্ণ উলঙ্গিনী হয়ে দাঁড়াল সবার সামনে। চোখ তার জ্বলছে—সে চোখ তার নিম্পলক। দুরন্ত ক্ষোভে উত্তেজনায় নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে, নিশ্বাসের বেগে দেহ দুলছে। বললে—দেখ ঠাকুর, দেখ। নাগ নাই, নাগিনী নাই, কিছু নাই; এই দেখ।

সমস্ত জনতা বিস্ময়ে স্তম্ভিত নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল উলঙ্গিনী মেয়েটার দিকে।

পরমুহূর্তেই মেয়েটা তুলে নিলে কাপড়খানা।

কাপড় পরে গাছকোমর বেঁধে সে গঙ্গারামের হাত থেকে টেনে নিলে শাবলখানা। বললে–মুই ধরব সাপ। আনেন আলো, আনেন হাঁড়ি। থাক্ গ, তোরা হোথাই দাঁড়িয়ে থাক্। মুই ধরব। সাপ—সাঁতালীর বেদের গায়ে হাত দিবেন না। অপমান করবেন না।

****

শাবল দিয়ে ঠুকলে সে পাকা মেঝের উপর। নিরেট জমাট ইট-চুনের মেঝেঠং—ঠং শব্দ উঠতে লাগল। কোণে কোণে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে চলল বেদের মেয়ে। তার পিছনে সেই লোকটি।

হাতের আলো তুলে ধরে পিঙলা দেখলে। লাল ধুলোর মতওই ওখানে কি? একেবারে ওই প্রান্তে একটা বন্ধ দরজার নিচে জল-নিকাশের নালার মুখে? জোরে নিশ্বাস নিলে সে। ক্ষীণ একটা গন্ধ যেন আসছে। দ্রুপদে এগিয়ে গেল। হাতের আলোটা রেখে সেই ঝুরো ধুলো তুলে নিয়ে শুকলে। মুখ ফিরিয়ে ডাকলে সেই ঠাকুরকে।

–আসেন ঠাকুর, দেখেন। –

-পেয়েছিস?

–হাঁ। শাবল দিয়ে সে ঠুকলে। ঠং করে শব্দ উঠল।

–কই? ও তো নিরেট মেঝে।

–আছে। ওই দেখ ফাপা। সে আবার ঠুকলে এক কোণে। এবার শব্দটা খানিকটা অন্য। রকম। আরও জোরে সে টুকলে। –দেখ।

—গর্ত কই?

–চৌকাঠের নিচে, জল যাবার নালির ভিতর।

–খোঁড় তবে।

পাকা মেঝের উপর শাবল পড়তে লাগল।

দুয়ারের ওপার থেকে ভাদু বললে—সবুর রে বেটি, হুঁশিয়ার মা-জননী।

–ক্যানে?

–দাঁড়া, মুই যাই। দেখি একবার।

—না রে বাবা, মুই লতাদের নাগিনী কন্যে, ভরসা রাখু আমার পরে। সজ্জনকে দেখায়ে। দিই সাঁতালীর বিষবেদের কন্যের বাহাদুরি। কি বুলছিস তু বল, হোথা থেকেই বল্।

ভাদু বললে গর্তের মুখ কোথাকে?

—দুয়ারের চৌকাঠের নালাতে, ঠিক মাঝ চৌকাঠে।

–খুঁড়ছিস কোথা?

–ডাহিনের কোণ।

–বাঁয়ের কোণ দেখেছিস ঠুক্যা? পরখ করেছিস?

চমকে উঠল পিঙলা। তাই তো। উত্তেজনায় সে করেছে কি?

ভাদু বললে—মনে লাগছে চাতর হবে। গত বর্ষায় দেড় কুড়ি ভেঁকা বেরালছে। দেখু, ঠুকা দেখ আগে।

এবার পিঙলা বায়ের কোণে শাবল ঠুকলে। হাঁ। আবার ঠুকলে। হাঁ-হাঁ।

ভাদু বললে—এক কাম কর কন্যে।

হাঁ, হাঁ। আর বুলতে হবে নাই গ বাবা! আগে গর্তের মুখ খুল্যা এক মুখ বন্ধ করি দিব।

—হাঁ। ভাদু সানন্দে বলে উঠল—বলিহারি মোর বিষহরির নন্দিনী, মোর বেদেকুলের কন্যে! ঠিক বলেছিস মা! হাঁ। তারপরেতে এক এক কর্যা খোড়, এক এক কোণ। সাবধান, হুঁশিয়ারি করে।

শাবল পড়তে লাগল।

লাল কাপড়ে গাছকোমর বাধা কালো তন্বী মেয়েটার অনাবৃত বাহু দুটো উঠছে নামছে, আলোর ছটাও ঝিকঝিক করে উঠছে নামছে। ঘেমে উঠছে কালো মেয়ে। হাঁটু গেড়ে বসেছে সে। বুকের ভিতর উত্তেজনায় থরথর করছে। মান রক্ষে করেছেন আজ বিহরি। তার জীবন আজ ধন্য হয়েছে, সে সাঁতালী বিষবেদেকুলের মান রক্ষে করতে পেরেছে। উলঙ্গিনী হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল—তার জন্য কোনো লজ্জা নাই, কোনো ক্ষোভ নাই তাঁর মনে।

মাঝখানের গর্তের মুখ খানিকটা খুললে সে। লম্বা একটা নালা চলে গেছে এদিক থেকে ওদিক। ডাইনে বসবাসের প্রশস্ত গর্ত, বায়েও তাই, মধ্যে নালাটা নাগ-নাগিনীর রাজপথ। সদর-অন্দরের রাস্তাঘর। খোয়া দিয়ে ঠুকে বন্ধ করে দিলে সে বাঁ দিকের মুখ। তারপর শাবল চালালে ডাইনের গর্তের উপর। জমাট খোয়া উঠে গেল। খোয়ার নিচে মাটি, তার উপর ঘা মেরে বিস্মিত হয়ে গেল পিঙলা। কোনো সাড়া নাই।

আবার মারলে ঘা। কই? কোনো সাড়া নাই। তা হলে ওপাশে চলে গেছে? তবু সে খুঁড়লে। প্রশস্ত মসৃণ একটি কাটা হাড়ির মত গর্ত—এই তো চাতর। তাতে এক রাশি সাদা ডিম। এবার সে বাঁ দিকে মারলে শাবল।

নাঃ, আবার তার ভুল হচ্ছে। এবার সে বন্ধ-করা নালার মুখ খুলে দিলে। তারপর আঘাত করলে গর্তে।

ঠুং ঠং ঠুং-ঠুং ঠুং-ঠুং।

গোঁ–! গোঁ–গো! গৰ্জন উঠতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে। উত্তেজনায় নেচে উঠল বেদেনীর মন।

আঃ, মাথার চুল এসে পড়ছে মুখে।

শাবল ছেড়ে দিয়ে—চুল এলিয়ে গেছে—আবার চুল বেঁধে নিলে শক্ত করে। তারপর মারলে শাবল। শাবলটা ঢুকে গেল ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে সে সতর্ক হয়ে বসল। হাঁ, এবার আয় রে আয়নাগ-নাগিনী আয়। পিঙলা তৈরি। স্থিরদৃষ্টি, উদ্যত হাত, বসল বেদেনী এক হাঁটুর উপর ভর দিয়ে। বা হাতে শাবলখানা আরও একটু বসিয়ে দিলে চেপে। এবার গর্জন করে বেরিয়ে এল এক প্রকাণ্ড গোখরা। মুহূর্তে বেদের মেয়ে ধরলে তার মাথা।

–আ!

সঙ্গে সঙ্গে আর একটা। হাঁ–দুটো, দুটোই ছিল। নাগ আর নাগিনী।

–হুঁশিয়ার বেদেনী। চেঁচিয়ে উঠল পিছনের সেই পাগল ঠাকুর।

—থাম ঠাকুর।–গর্জন করে উঠল বেদের কন্যে। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়াল। বিচিত্র হয়ে উঠেছে সে নারীমূর্তি, দুই হাতে দুটো সাপের মাথা ধরে আছে। সাদা সাপ দুটো তার কালো নধর কোমল হাত দুখানায় পাকে পাকে জড়িয়ে। ধরেছে। তাকে পিষছে। কালো মেয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁকলে–জয় বিষহরি!

তারপর ডাকলে—ধর্‌ গ, খুল্যা দে–কালের পাক খুল্যা দে। শুনছিস গ!

ছুটে এল ভাদু। গঙ্গারামকে ডাকলে–-গঙ্গারাম!

কিন্তু তার আগেই ওই পাগলা ঠাকুর তার বিচিত্র কৌশলে পাক খুলে টেনে নিলে নাগ দুটোকে, হাঁড়ির মধ্যে পুরে দিলে। পিঙলা উঠানে পা ছড়িয়ে বসে হপাতে লাগল আর অবাক হয়ে দেখতে লাগল ঠাকুরের কাজ। এ ঠাকুর তো সামান্য নয়! ঠাকুরকেই সে হাত জোড় করে বললে, আমাকে জল দিবেন এক ঘটি?

ঠাকুরই এল জলের ঘটি নিয়ে। বললে—সাবাস রে কন্যে! সাবাস! কিন্তু এক ঢোকের বেশি জল খাবি না। তোকে আমি প্রসাদী কারণ দোব। কারণ খাবি। মহাদেবের প্রসাদ। ওরে কন্যে, আমি নাগু ঠাকুর।

নাগু ঠাকুর। রাঢ় দেশের নাগের ওঝা নাগেশ্বর ঠাকুর! সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি! ভূমিষ্ঠ হয়ে লুটিয়ে পড়ল পিঙলা তার পায়ে।

নাগু ঠাকুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে—সাবাস, সাবাস! হাঁ, তু সাক্ষাৎ নাগিনী কন্যে!

ভাদু গঙ্গারাম—তারাও ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল—নাগু ঠাকুর, ওরে বাপ রে!

পাগল নাগু ঠাকুরের শ্মশানে-মশানে বাস, সে কোথা থেকে এল। পিঙলা নিজের জীবনকে ধন্য মানলে; নাগু ঠাকুরকে সে দেখতে পেয়েছে। শিবের মত রঙ, তারই মত চোখ। পাগলপাগল ভাব নাগু ঠাকুরের।
জয় বিষহরি মা গ পদ্মাবতী, জয়, তোমার জয়!

অরণ্যে, পৰ্বতে, দরিদ্রের ভাঙা ঘরে, রাত্রির অন্ধকারে তুমি গৃহস্থকে রক্ষা কর মা। বেদেকুলকে দাও পেটের অন্ন, পরনের কাপড়। সাঁতালীর বিষবেদেদের নাগিনী কন্যের ধর্মকে রক্ষা কর মা। বেদেকুলের ধর্মকে মাথায় করে রাখুক—বেদের মেয়ে অবিশ্বাসিনী, বেদের মেয়ে ছলনাময়ী, বেদের মেয়ে কালামুখী; তাদের অধৰ্ম, তাদের পাপ বেদেকুলকে স্পর্শ করে না ওই নাগিনী কন্যার মহিমায়, ওই কন্যার পুণ্যে।

কন্যার পুণ্য অনেক। মহিমা অনেক।

ভাদু শতমুখ হয়ে উঠেছে। কন্যের অঙ্গ ছুঁয়ে বলেছে—জনুনী, আমার চোখ খুলিছে। তুমার অঙ্গ ছুঁয়্যা–মা-বিষহরির নাম লিয়া বুলছি—আমরার চোখ খুলিছে। হাঁ, অনেক কাল পর এমন মহিমে দেখলম কন্যের। আমার চোখ খুলিছে।

ভাদু দশের মজলিক্ষে বর্ণনা করেছে সেই ঘটনার কথা।

বলেছে, সে স্বচক্ষে দেখেছে কন্যের মধ্যে নাগিনী রূপ। বলেছে—আবছা অন্ধকার ঘর, বাইরে কাতার বেঁধে লোক দাঁড়িয়ে দেখতে এসেছে—সাঁতালীর বিষবেদেরা নাগ-বন্দি করবে। ঘরের মধ্যে তিনজন বেদে আর দরজার মুখে সেই ঠাকুর, মাথায় রুখু কালো লম্বা চুল, মুখে গোঁফ দাড়ি, বড় বড় চোখে চিলের মত দৃষ্টি। সাক্ষাৎ চাঁদ সদাগরের বন্ধু ল্ফির গারুড়ী। রাঢ় দেশের নাগু ঠাকুর। নাগেশ্বর ঠাকুর। সাঁতালীর বেদের বিদ্যার পরখ করতে নিজের পরিচয় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠাকুর। তার চোখ কি এড়ানো যায়? গঙ্গারামের কোমরে জড়ানো পদ্মনাগ, ঠিক ধরেছিল সে।

ভাদু বলে—মুই ছিলম বসে, খড়ি পেতে হাত চালায়ে দেখছিলাম। আমার কোমরেও। সাপ—তাও ঠাকুরের দিষ্টি এড়ায়ে যাবে কোথা? মারলে হক-সবুর। সে যেন গর্জে উঠল। অরুণ্যের বাঘ। মনে হল, আজ আর রক্ষা নাই। গেল, মান গেল, ইজ্জত গেল, দুশমনের মুখ। হাসল, কালি পড়ল সাঁতালীর বেদের কালোবরন মুখে, উপরে বুঝি কেঁদ্যা উঠল পিতিপুরুষেরা।

ভাদুর মনে পড়েছিল, সেই সর্বনাশা রাত্রির কথা। যে রাত্রে লোহার বাসরঘরে কালনাগিনী দংশন করেছিল লখিন্দরকে। সেদিন দেবছলনায় কালনাগিনী নিরাপদে বেদেদের ছলনা করে তাদের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিল অপবাদের বোঝা।

ভাদু বলেছে—ঠিক এই সময় বাঘের ডাকের উত্তরে যেন ফোঁস করে গর্জে উঠল। কালনাগিনী পিঙলা। সেদিন জাগরণের দিনে হিজল বিলে মা-বিষহরির ঘাটের উপরে যেমন দেখেছিল বাঘের সামনে উদ্যতফণা পদ্মনাগিনীকে যেমন শুনেছিল তাদের গর্জন ঠিক তেমনি। মনে হল। পরমুহূর্তে পিঙলা খুলে ফেলে দিলে তার কালো তনু অনাবৃত করে রক্তবস্ত্ৰখানা দাঁড়াল পলকহীন চোখে চেয়ে। উত্তেজনায় মৃদু মৃদু দুলছিল নাগিনী কন্যা-ভাদুর মনে হল সাঁতালীর বেদেকুলের কুলগৌরব বিপন্ন দেখে, কন্যা বসনের সঙ্গে নরদেহের খোলসটাও ফেলে দিয়ে স্বরূপে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। ঠিক নাগলোকের নাগিনী। চোখে তার আগুন দেখেছে সে, নিশ্বাসে তার ঝড়ের শব্দ শুনেছে সে; তার অনাবৃত দেহে নারী রূপ সে দেখে নিদেখেছে নাগিনী রূপ।

জয় বিষহরি!

আগে বিষহরির জয়ধ্বনি দিলে তারপর কন্যার জয়ধ্বনিতে ভরিয়ে দিলে হিজলের কূল, সাঁতালীর আকাশ। কলিকালে দেবতার মাহাত্ম্য যখন ক্ষয় হয়ে আসছে, হিজলের ঘাসবনের আড়াল দিয়েও যখন কুটিল কলির প্রবেশপথ রোধ করা যাচ্ছে না, তখনই একদা এমনইভাবে কন্যার মাহাত্ম্য-মহিমা প্রকাশিত হওয়ার কাহিনী শুনে সাঁতালীর মানুষেরা আশ্বাসে উল্লাসে আশ্বস্ত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

ভাদু শপথ করে বলে—সে প্রত্যক্ষ দেখেছে কন্যার নাগিনী রূপ।

পিঙলার নিজেরও মনে হয় তাই। সেই ক্ষণটির স্মৃতি তার অস্পষ্ট। অনেক ভেবে তার মনে পড়ে, চোখের দৃষ্টিতে আগুন ছুটেছিল, বুকের নিশ্বাসে বোধহয় বিষ ঝরেছিল, সে দুলেছিল নাগিনীর মতই; ইচ্ছে হয়েছিল ছোবল দেওয়ার মতই ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করে না। ঠাকুরকে। তাও সে করত, নাগু ঠাকুর যদি আর এক পা এগিয়ে আসত—তবে সে বিষকাটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার উপর। মা-বিষহরিকে স্মরণ করে যখন কাপড়খানা খুলে ফেলে দিয়েছিল, তখন এতগুলো পুরুষকে পুরুষ বলে মনে হয় নাই তার।

সত্যিই সেদিন নাগিনীর রূপ প্রকাশ পেয়েছিল তার মধ্যে। ভাদু ভুল দেখে নাই। ঠিক দেখেছে সে। ঠিক দেখেছে।

একদিন কালনাগিনী সাঁতালী পাহাড়ের বিষবৈদ্যদের মায়ায় আচ্ছন্ন করে বিষহরির মান রাখতে গিয়ে বৈদ্যদের অনিষ্ট করেছিল, তারা তাকে কন্যে বলে বুকে ধরেছিল, নাগিনী। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, বৈদ্যদের জাতি কুল বাস সব গিয়েছিল। তারপর এতদিন যুগের পর যুগ গিয়েছে নাগিনী বেদেদের ঘরে কন্যে হয়ে জন্ম নিয়েছে, বিষহরির পূজা করেছে, নিজের বিষে নিজে জ্বলেছে; কিন্তু এমন করে ঋণ শোধের সুযোগ পায় নি। এবার পেয়েছে। তার জীবনটা ধন্য হয়ে গিয়েছে। জয় বিষহরি। কন্যের উপর তুমি দয়া কর।

হিজলের ঘাটে সকাল সন্ধ্যা পিঙলা হাত জোড় করে নতজানু হয়ে বসে মাকে প্রণাম করে। মধ্যে মধ্যে তার ভয় হয়। মা-বিষহরি তার মাথায় ভর করেন। চোখ রাঙা হয়ে ওঠে, চুল এলিয়ে পড়ে, ঘন ঘন মাথা নাড়ে সে। বিড়বিড় করে বকে।

ধূপধূনা নিয়ে ছুটে আসে সাঁতালীর বেদে-বেদেনীরা। হাত জোড় করে চিৎকার করে কি হল মা, আদেশ কর।

–আদেশ কর মা, আদেশ কর।

ভাদু মুখের সামনে বসে আদেশ শুনতে চেষ্টা করে।

গঙ্গারাম স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বসে থাকে। চোখে তার প্রসন্ন বিমুগ্ধ দৃষ্টি। পিঙলার মহিমায়। জটিলচরিত্র গঙ্গারাম যেন বশীভূত হয়েছে। মধ্যে মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে পিঙলা। সেদিন বেদেকুলের শিরবেদে হিসাবে সে-ই তার শিথিল দেহ কোলে তুলে নিয়ে কন্যার ঘরে শুইয়ে দেয়। দেবতাশ্রিত অবস্থায় কন্যাকে স্পর্শ করার অধিকার সে ছাড়া আর কারও নাই। গঙ্গারামই সেবা করে, বেদেরা উদ্গ্রীব উৎকণ্ঠায় দরজায় বসে থাকে।

চেতনা ফিরলেই তারা জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে। গর্তে-খোঁচা-খাওয়া সাপের মতই পিঙলা তাড়াতাড়ি উঠে বসে; অঙ্গের কাপড় সস্তৃত করে নিয়ে তীব্র কণ্ঠে বলে—যা, যা তু বাহিরে যা। গঙ্গারামকে পিঙলা সহ্য করতে পারে না। গঙ্গারামের চোখের দৃষ্টিতে অতি তীক্ষ্ণ কিছু আছে যেন; সহ্য করতে পারে না পিঙলা।

***

এই সময়েই শিবরাম কবিরাজ দীর্ঘকাল পরে একদিন সাঁতালীতে গিয়েছিলেন। ওদিকে তখন আচার্য ধূর্জটি করিরাজ মহাপ্রয়াণ করেছেন, শিবরাম তখন রাঢ়ের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে আয়ুর্বেদ ভবন খুলে বসেছেন, সঙ্গে একটি টোলও আছে।

কাহিনী বলতে বলতে শিবরাম বলেন প্রারম্ভেই বলি নি, এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের জমিদারবাড়িতে ডাকাতির কথা? সেই গ্রামে তখন চিকিৎসা করি। গুরুই আমাকে ওখানে পরিচিত করে দিয়েছিলেন। গুরু যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন সূচিকাভরণ গুরুর আয়ুর্বেদ ভবন থেকেই আনতাম। গুরু চলে গেলেন, আমি প্রথম সূচিকাভরণ প্রস্তুত করব সেবার। মুর্শিদাবাদ জেলা হলেও, রাঢ়ভূমি গঙ্গা খানিকটা দূর; এ অঞ্চলে বিষবেদেরা আসে না, আমার ঠিকানাও জানে না। মেটেল বেদের অঞ্চল এটা। মেটেল বেদেরা খাঁটি কালনাগিনী চেনে না। সৰ্পজাতির মধ্যে ওরা দুর্লভ। তাই নিজেই গেলাম সাঁতালী। স্বচক্ষে দেখলাম পিঙলাকে। দেখলাম সাঁতালীর অবস্থা।

পিঙলাকে দেখলাম শীর্ণ, চোখে তার অস্বাভাবিক দীপ্তি।

সেদিনও ছিল ওদের একটা উৎসব।

ধূপে ধূনায় বলিতে নৈবেদ্যে সমারোহ। বাজনা বাজছিল—বিষম-ঢাকি, তুমড়ী বাঁশি, চিমটে। মুহুর্মুহুঃ জয়ধ্বনি উঠেছিল। সমারোহের সবই যেন এবার বেশি বেশি। সাঁতালীর বেদেরা যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ভাদু প্রণাম করে বললে—কন্যে জাগিছেন বাবা, আমাদের ললাট বুঝি ইবারে ফিরল। মা-বিষহরি মূর্তি ধর্যা কন্যাকে দেখা দিবেন মোর মনে লিছে।

চুপি চুপি আবার বললে—এতদিন দেখা দিতেন গ। শুধু ওই পাপীটার লেগ্যা-ওই শিরবেদের পাপের তরে দেখা দিছেন নাই। দেখিছেন? দেখেন, হিজল বিল পানে তাকান।

—কি?

—দেখেন ইবারে পদ্মফুলের বহর। মা-পদ্মাবতীর ইশারা ইটা গ!

হিজলের বিল পদ্মলতায় সত্যসত্যই এবার ভরে উঠেছে। সচরাচর অমন পদ্মলতার প্রাচুর্য। দেখা যায় না। বৈশাখের মধ্যকাল, এরই মধ্যে দুটো-চারটে ফুল ফুটেছে, কুঁড়িও উঠেছে কয়েকটা।

—তা বাদে ইদিকে দেখেন। দেখেন ওই বাঘছালটা। পদ্মনাগিনী ইবারে বাঘ বধ করেছে জাগরণের দিনে।

শিবরাম বলেন—সাঁতালী গ্রামের নিস্তেজ অরণ্য-জীবন ওইটুকুকে আশ্রয় করে আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। বিলের পদ্মফুলের প্রাচুর্যে, নাগদংশনে বাঘটার জীবনান্ত হওয়ায়, এমনকি হিজলের ঘাসবনের সবুজ রঙের গাঢ়তায়, তাদের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী আদিম আরণ্যক মন স্কৃতি পেয়েছে, সমস্ত কিছুর মধ্যে এক অসম্ভব সংঘটনের প্রকাশ দেখতে তারা উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে।

ভাদুই এখানকার এখন বড় সর্পবিদ্যাবিশারদ। তারই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। গভীর বিশ্বাসে, অসম্ভব প্রত্যাশায় লোকটার সত্যই পরিবর্তন হয়েছে। সে এখন অতি প্রাচীনকালের অতি সরল অতি ভয়ঙ্কর বর্বর সাঁতালীর বেদের জীবন ফিরে পেয়েছে।

নাকে নস্য দিয়ে শিবরাম বলেন-আচার্য ধূর্জটি কবিরাজ শুধু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেই পারঙ্গম ছিলেন না। সৃষ্টিতত্ত্ব, জীবন-রহস্য, সব ছিল তার নখদর্পণে। লোকে যে বলত-ধূর্জটি ধূর্জটি-সাক্ষাৎসে তারা শুধু শুধু বলত না। কষ্টিপাথর যাচাই না করে হরিদ্রাবর্ণের ধাতুমাত্রকেই স্বর্ণ বলে মানুষ কখনও গ্রহণ করে না। মানুষের মন বড় সন্ধিগ্ধ বাবা। তা ছাড়া, মানুষ হয়ে আর একজন মানুষকে দেবতাখ্যা দিয়ে তার পায়ে নতি জানাতে অন্তর তীর দগ্ধ হয়ে যায়। তিনি আমার আচার্যদের ধূর্জটি-সাক্ষাৎ ধূর্জটি কবিরাজ আমাকে বলেছিলেন–শিবরাম, বেদেদের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করি কেন জান? আর আমার মমতাই বা অত গাঢ় কেন জান? ওরা হল ভূতকালের মানুষ। পৃথিবীতে সৃষ্টিকাল থেকে কত মন্বন্তর হল, এক-একটা আপৎকাল এল, পৃথিবীতে ধর্ম বিপন্ন হল, মাৎস্যন্যায়ে ভরে গেল, আপদ্ধর্মে বিপ্লব হয়ে গেল, এক মনুর কাল গেল, নতুন মনু এলেন—নতুন বিধান নতুন ধর্মবর্তিকা হাতে নিয়ে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে, আচারে-ব্যবহারে, রীতিতে-নীতিতে, পানে-ভোজনে, বাক্যে-ভঙ্গিতে, পরিচ্ছদে–প্রসাধনে কত পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু যারা নাকি আরণ্যক, তারা প্রতিবারই প্রতিটি বিপ্লবের সময়েই গভীরতর অরণ্যের মধ্যে গিয়ে তাদের আরণ্যক প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখলে। সেই কারণেই এরা সেই ভূতকালের মানুষই থেকে গিয়েছে। মনু বলেন, শাস্ত্ৰ পুরাণ বলে, এদের জন্মগত অর্থাৎ ধাতু এবং রক্তের প্রকৃতিই স্বতন্ত্র এবং সেইটেই এর কারণ। এই ধাতু এবং রক্তে গঠিত দেহের মধ্যে যে আত্মা বাস করেন, তিনি মানবাত্ম হলেও ওই পতিত দূষিত আবাসে বাস করার জন্যেই তিনিও পতিত এবং বিকৃত হয়ে এই ধর্মে আত্মপ্রকাশ করেন। এই বিকৃতিই ওদের স্বধর্ম। আবার এর মধ্যে পরমাশ্চর্য কি জান? শাস্ত্ৰে পুরাণে এই ধর্ম পালন করেই ওরা চরম মুক্তি লাভ করেছে, এর নজিরও আছে। মহাভারতে পাবে ধর্মব্যাধ নিজের আচরণবলে পরমতত্ত্বকে জ্ঞাত হয়েছিলেন। এক জিজ্ঞাসু ব্ৰাহ্মণকুমার তাঁর কাছে সেই তত্ত্ব জানতে গিয়ে তাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল। সেই আরণ্যক মানুষের বর্বর জীবন, অন্ধকার ঘর, চারিদিকে মৃত পশু, মাংস-মেদ-মজ্জার গন্ধ, শুষ্ক চর্মের আসন-শয্যা, কৃষ্ণবর্ণ রূঢ় মুখমণ্ডল, রক্তবর্ণ গোলাকৃতি চোখ, মুখে মদ্যগন্ধ দেখে তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এ কেমন করে চরম মুক্তি পেতে পারে? ব্যাধ বুঝেছিলেন ব্রাহ্মণকুমারের মনোভাব। তিনি তাকে সম্ভাষণ আবাহন করে বসিয়ে বলেছিলেন—এই আমার স্বধর্ম। এই স্বধর্ম পালনের মধ্যেই আমি সত্যকে মস্তকে ধারণ করে পরম তত্ত্ব অবগত হয়েছি। আমি যদি স্বধর্মকে পরিত্যাগ করতাম, তবে তোমাদের পরিচ্ছন্নতা সদাচরণ অনুকরণ করে তাকে আয়ত্ত করতে গিয়ে সদাচরণের পরিচ্ছন্নতার শান্তিতে সুখেই আমি তৃপ্ত হয়ে তত্ত্ব আয়ত্তের সাধনায় ক্ষান্ত হতাম। এই আচরণের মধ্যেই আমাদের জীবনের স্ফূর্তি। এর মধ্যেই আমাদের মুক্তি।

আচার্য চিন্তাকুল নেত্রে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন কিছুক্ষণ। যেন ওই অনন্ত আকাশপটের নীলাভ অনুরঞ্জনের মধ্যে তাঁর চিন্তার অভিধান অদৃশ্য অক্ষরে লিখিত রয়েছে। তিনি তাই পাঠ করছেন। পাঠ করতে করতেই বলতেন—এদের মধ্যে ভাল মানুষ অনেক আছে, কিন্তু শূচিতা ওদের ধর্ম নয়। ওতে ওদের দেহ-আত্মা পীড়িত হয় না। আমাদের হয়। তাই সাবধান করি।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে ওই অভিধান পাঠ করে নিজের অস্পষ্ট চিন্তার অন্বয় করে অর্থ জ্ঞাত হয়ে বলতেন—তবে আমার উপলব্ধির কথা আমি বলি শোন। ধর্মব্যাধের কথা মিথ্যে নয়। এই বিশ্ব-রহস্যের মধ্যে ওই আচার-আচরণই বল আর আমাদের এই আচরণই বল—দুয়ের মধ্যে আসল জীবন-মূল্যের পার্থক্য সত্যই নাই। জীবনের পক্ষে আচার-আচরণের প্রাথমিক মূল্য আয়ু এবং স্বাস্থ্য এই দুয়ের পরিমাণ নির্ণয়ে। তার পরের মূল্য বুদ্ধি এবং জ্ঞান বিকাশের আনুকূল্যে। প্রথম মূল্য ওরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়েছে ওই ধর্মে। দ্বিতীয়টা পায় নি। কিন্তু শাস্ত্র যে বলে ওদের ওই পতিত এবং দূষিত ধাতু ও শোণিতে গঠিত দেহবাসী আত্মার পক্ষে এই আর্য-আচরণ অনধিগম্য, এটাতে ওদের অধিকারও নাই, এবং অনধিকার চর্চায় ওদের অনিষ্ট হবে, এইটি আমার জীবনবোধিতে আমি যতদূর বুঝেছি শিবরাম, তাতে এ ধারণা ভ্রান্ত, অসত্য। আমি আজীবন চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করলাম, বহু আচারের বহু ধর্মের মানুষের চিকিৎসা করলাম, বহু পরীক্ষায় বহু বিচার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, ধাতু বা শোণিত যদি রোগদূষিত না হয়, তবে এক জীবনধর্ম থেকে আর এক জীবনধর্মে আসতে কোনো বাধা বিশেষ নাই। যেটুকু বাধা, সে নগণ্য। অতি নগণ্য।

হেসে বলতেন—আমাদের বরং ওদের ধর্মে যেতে গেলে বাধা বেশি। খানিকটা মারাত্মকও বটে। ময়লা চীরখও কোমরে পরতে লজ্জার বাধা যদিবা জয় করা যায়, তবে চর্মরোগের আক্রমণ হবে অসহনীয়। তারপর খাদ্যের দিক; স্বাদের কথা বাদ দিয়ে উদরাময়ের ভয় আছে। সেটা অসহনীয় থেকেও গুরুতর মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শীতাতপের প্রভাব আছে। সেও সহনীয় করে তোলা আমাদের পক্ষে সহজ নয়। কিন্তু ওরা জামাকাপড় পরে গ্রীষ্মকালে কথঞ্চিৎ কাতরতা করলেও শীতে বেশ আরামই অনুভব করবে। আসল কথা ওরা আমাদের জীবনে আসে নি, আসতে চায় নি—সে যে কারণেই হোক। হয়ত আমাদের জটিল জীবনাচরণের প্রতি ওদের ভীতি আছে–সংস্কারের ভীতি, জটিলতার ভীতি, আমরা যে আচরণ করি তার ভীতি। আমরা কেউ আহ্বান করি নি, আমরা দূরে থেকেছি, রেখেছি ঘৃণা করে। ওদের নাড়ি ওদের দেহলক্ষণ বিচার করে আমাদের সঙ্গে কোনো পার্থক্য তো পাই নি। ধাতু এবং শোণিত যদি বিশ্লেষণ করে পরীক্ষার উপায় জানতাম, তবে সঠিক তথ্যটা বুঝতে পারতাম।

বলে আবার চেয়ে থাকতেন আকাশের দিকে।

ভাদুকে দেখে গুরুর কথাই সেদিন মনে পড়েছিল।

ভূতকালের মানুষ, ভূতকালের মানসিক পরিবেশের পুনরুজ্জীবনে নতুন বল পেয়েছে, অভিনব স্কৃর্তি পেয়েছে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি যেন অমাবস্যার নাগাল পেয়েছে। গোটা গ্রামখানির মানুষের জীবনে এ স্ফূৰ্তি এসেছে। বেশভূষায় আচারে-অনুষ্ঠানে তার পরিচয় সাঁতালীতে প্রবেশ করা মাত্রই শিবরামের চোখে পড়ল।

ভাদুর চকচকে কালো বিশাল দেহখানি ধূসর হয়ে উঠেছে। একালে ওরা তেল ব্যবহার করত, ভাদু তেলমাখা ছেড়েছে। রুক্ষ কালো কাঁকড়া চুলের জটা বেঁধেছে, তার উপর বেঁধেছে এক টুকরো ছেড়া গামছা। আগে নাকি এই গামছা বাধার প্রচলন ছিল। গলায় হাতে মালাতাবিজ-তাগার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করে তুলেছে। গায়ের গন্ধ উগ্রতর হয়ে উঠেছে। মদ্যপান বেড়েছে। গোটা সাঁতালীর বেদেরা গিরিমাটিতে কাপড় ছুপিয়ে গেরুয়া পরতে শুরু করেছে।

পিঙলা যেন তপঃশীর্ণা শর্বরী। শীর্ণ দেহ, এলায়িত কালো তৈলহীন বিশৃঙ্খল একরাশি চুল ফুলে ফেঁপে তার বিশীর্ণ মুখখানা ঘিরে ফেলেছে, চোখে অস্বাভাবিক দ্যুতি, সর্ব অবয়ব ঘিরে একটা যেন উদাসীনতা।

ভাদু তাকে দেখিয়ে বললে—দেখেন কেনে কন্যের রূপ! সেই পিঙলা কি হইছে দেখেন।

চুপিচুপি বললে।

শিবরাম স্থিরদৃষ্টিতে পিঙলার দিকে চেয়ে রইলেন। ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য তিনি, তার বুঝতে বিলম্ব হল না যে, পিঙলার এ লক্ষণগুলি কোনো দৈব প্রভাব বা দেবভাবের লক্ষণ নয়। এগুলি নিশ্চিতরূপে ব্যাধির লক্ষণ। মূৰ্ছারোগের লক্ষণ। ব্যাধি আক্রমণ করেছে মেয়েটিকে।

পিঙলা তাঁকে দেখে ঈষৎ প্রসন্ন হয়ে উঠল। সে যেন জীবন-চাঞ্চল্যে সচেতন হয়ে উঠল। হেসে বললে—আসেন গ ধন্বন্তরি ঠাকুর, বসেন। দে গ, বসতে দে।

একটা কাঠের চৌকি পেতে দিলে একজন বেদে। শিবরাম বসলেন।

পিঙলা বললে—শবলা দিদির কচি-ধন্বন্তরি তুমি-তুমি আমার ধন্বন্তরি ঠাকুর। কালনাগিনীর তরে আসছেন।

–হ্যাঁ। না এসে উপায় কি? গুরু দেহ রেখেছেন।–

–আঃ, হায় হায় হায়! আমাদের বাপের বাড়া ছিল গ! আঃ—আঃ–আঃ!

স্তব্ধ হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করা যায় না এর উত্তরে। শিবরামের চোখে জল এল, মন উদাস হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর আত্মসংবরণ করে শিবরাম বললেন—এতদিন সূচিকাভরণ গুরুর কাছ থেকে নিয়ে যেতাম, এবার নিজেই তৈরি করব। সেইজন্য এসেছি। কালনাগিনীর খাঁটি জাত তোমরা, তোমরা ছাড়া কারুর কাছে পাব না বলেই আমি এসেছি।

পিঙলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আর হয়ত পাবেই না ধন্বন্তরি ঠাকুর। আসল হয়ত আর মিলবেই না।

—মিলবে না? কেন? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন শিবরাম।

–বিষহরির ইশারা এসেছে। আদেশ এখুনও আসে নাই, তবে আসবেক, দেরি নাই। তার কালনাগিনীকে নাগলোকে ফিরতে হবেক। বুঝিছ? তার অভিশাপের মোচন হবেক।

কথাটা ঠিক বুঝলেন না শিবরাম। মুখের দিকে চেয়ে রইলেন, সবিস্ময় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতেই পিঙলার মুখের দিকে তাকালেন।

প্রশ্ন বুঝতে পারলে পিঙলা; তার প্রখরদৃষ্টি চোখ দুটি প্রখরতর হয়ে উঠল, যেন জ্বলন্ত অঙ্গারগর্ভ চুল্লিতে বাতাস লাগল; সে বললে তুমি শুন নাই? মুই ঋণ শোধ করেছি। ইবারে বিষহরির হুকুম আসিবে। বিষহরিমনে লাগিছে—বিধেতা-পুরুষের দরবারে হিসাব খতায়ে দেখিয়েছেন, তাঁকে বলিছেন—দেনা তো শোধ করিছে কন্যে, ইবারে মুই কন্যেরে ফিরা আসিতে হুকুম দিতে পারি কিনা কও? বিধেতার মত না নিয়া তো তিনি হুকুম দিবেন না।

শিবরাম বললেনদেখি, তোর হাতটা দেখি, দে।

–হাত? কি দেখিবে?

–আমি হাত দেখে গুনে বলতে পারি যে!

–পার? দেখ, তবে দেখ।

প্রসারিত করে ধরলে তার করতল। হাতের রেখা পরীক্ষা করে দেখবার ছল করে তিনি তার মণিবন্ধ নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তার নাড়ি পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে তিনি স্পন্দনের গতি এবং প্রকৃতি নির্ণয় করতে চেষ্টা করলেন।

—কি দেখিছ গ ধন্বন্তরি ঠাকুর? ইবারে মুক্তি মিলিবে?

উত্তর দিলেন না। সে অবকাশই ছিল না তার। নাড়ির গতিপ্রকৃতি এবং অবস্থা বিচিত্র। উপবাসে দুর্বল, কিন্তু বায়ুর প্রকোপে চলছে যেন বলগাছেড়া উদ্দামগতি উদ্ভ্রান্ত ঘোড়ার মত, মধ্যে মধ্যে যেন টলছে। মুখের দিকে চাইলেন। চোখের প্রখর শুভ্রচ্ছদ আচ্ছন্ন করে অতি সূক্ষ্ম শিরাজালগুলি রক্তাভ হয়ে ফুটে উঠেছে। মূৰ্ছা রোগের অধিষ্ঠান তিনি অনুভব করতে পারলেন নাড়ির মধ্যে।

হতভাগিনী পিঙলা! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।

–ধন্বন্তরি! কি দেখিলে কও? ব্যর্থ হয়ে সে তাকিয়ে রইল শিবরামের মুখের দিকে।–এমন কর্যা তুমি নিশ্বাস ফেললা কেনে গ?

শিবরাম ভাবছিলেন-হতভাগিনী উন্মাদ পাগল হয়ে উঠবে একদিন, ওদিকে নতুন নাগিনী কন্যার আবির্ভাব হবে, দেবতা-অপবাদে স্বজন-পরিত্যক্ত উন্মাদিনীর দুর্দশার কি আর অন্ত থাকবে? অথচ সহজে তো মৃত্যু হবে না। এই তো ওর বয়স! কত হবে? বড় জোর পঁচিশ! জীবন যে অনেক দীর্ঘ। বিশেষত ওদের এই আরণ্যক মানুষের জীবন!

আবার পিঙলা প্রশ্ন করলে–মুক্তি হবে না? লিখনে নাই?

শিবরাম বললেন–দেরি আছে পিঙলা।

–দেরি আছে?

হ্যাঁ। একটু ভেবে নিয়ে বললেন মা তো তোকে নিয়ে যেতে চান, কিন্তু নিয়ে যাবেন কি করে? তোর দেহে যে বায়ুর প্রকোপ হয়েছে। দেবলোকে কি রোগ নিয়ে কেউ যেতে পারে?

স্থিরদৃষ্টিতে কবিরাজের মুখের দিকে সে চেয়ে বসে রইল। মনে মনে খতিয়ে দেখছে সে কথাগুলি। কয়েক মুহূর্ত পরে তার দুই চোখ বেয়ে নেমে এল অনর্গল অঞর ধারা। তারপর মা। বলে একটা করুণ ডাক ছেড়ে ঢলে পড়ে গেল মাটির উপর। একটা নিদারুণ যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গে আক্ষেপ বয়ে যেতে লাগল। পৃথিবীর মাটি যেন তার হারিয়ে যাচ্ছে, দু হাতে খামচে মাটির বুক সে অ্যাঁকড়ে ধরতে চাইছে; মুখ ঘষছে নিদারুণ আতঙ্কে, যেন মাটির বুকে মা ধরিত্রীর বুকে মুখ লুকাতে চাইছে।

ওদিকে বেদেরা কোলাহল করে উঠল।

–ধূপ আন্ ধুনা আন, বিষম-ঢাকি বাজা।

শিবরাম বললেন—থাম্‌, তোরা থাম্‌। কন্যার রোগ হয়েছে।

মুহূর্তে ভাদু উগ্র হয়ে উঠল।—কি কইলা? যা জান না কবিরাজ, তা নিয়া কথা বলিয়ো না। খবরদার! মায়ের ভর হইছে। যাও তুমি যাও। কন্যেরে ছুঁয়ো না এখুন। যাও।

গঙ্গারাম নীরবে বসে সব দেখলে। কবিরাজর দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি মিলতেই সে একটু হাসলে। আশ্চর্য হয়ে গেলেন শিবরাম, গঙ্গারাম সমস্ত বেদেদের মধ্যে স্বতন্ত্র পৃথক হয়ে রয়েছে। এ সবের কোনো প্রভাব তাকে স্পর্শ করে নাই।

শিবরাম উঠে এলেন।

***

শিবরাম দাঁড়িয়ে ছিলেন হিজলবিলের ঘাটে।

ভাদু তাকে ভরসা দিয়েছে। বলেছে—কন্যে বলিছে বটে, কালনাগিনীরা চলি গেল নাগলোকে মায়ের ঘরে স্বস্থানে; সিটা বেশি বলিছে। আর দেনা শোধ হল—জনুনীর আদেশ আসিবে বলিছে আমরাও ধেয়াইছি কি , তবে আমাদের সেই জাত ফির্যা দাও, মান্যি ফির্যা দাও, সাঁতালী পাহাড়ের বাস ফির্যা দাও। বিধের হিসেব সূক্ষ্ম হিসেব কবিরাজ, বিঁধে কি করা বিষহরিকে বলিবে কি-হাঁ, ঋণটা শোধ-বোধ হইছে! তবে হ্যাঁ, বিষহরি দরবার জানাইছেন বিধেতার কাছে ইহা হতি পারে।

শিবরাম চুপ করে শোনেন, কি উত্তর দিবে এ সব কথার?

অরণ্যের মানুষ অরণ্যের ভাষা বুঝতে পারে, তাদের বিশ্বাস, তাদের সংস্কার সম্পর্কে ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্যের অবিশ্বাস নাই। কিন্তু ভ্রম সংসারে আছে। পিঙলার অবস্থা সম্পর্কে ওদের যে ভ্রম হয়েছে এতে তার একবিন্দু সন্দেহ নাই। অরণ্যের মানুষ পত্রপল্লবের মর্মরধ্বনি শুনে, তাদের শিহরন দেখে মেঘ-ঝড়ের সম্ভাবনা বুঝতে পারে, আবার পত্রপল্লবের অন্তরাল। থেকে মানুষ কথা বললে দৈববাণী বলে ভ্রমও করে সহজেই।

অন্তরে অন্তরে বেদনা অনুভব করছেন শিবরাম। শবলার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সূত্রে তার পরবর্তিনী পিঙলাও তার স্নেহভাগিনী হয়ে উঠেছে। শবলার একটা কথা তার মনে অক্ষয় হয়ে আছে। তাঁর সঙ্গে ভাই-বোন সম্পর্ক পাবার সময় সে মনসার উপাখ্যানের বেনেবেটির কথা বলে বলেছিল—নরে নাগে বাস হয় না, নর নাগের বন্ধু নয়, নাগ নরের বন্ধু নয়। কিন্তু বেনেবেটি ভাই বলে ভালবেসেছিল দুটি নাগশিশুকে। তারাও তাকে দিদি বলে চিরদিন তার সকল সুখের সকল দুঃখের ভাগ নিয়েছিল। হেসে শবলা বলেছিল—একালে তুমি ভাই, মুই বহিন; তুমি কচিধন্বন্তরি, মুই বেদেকুলের সর্বনাশী নাগিনী কন্যে; কালনাগিনী কন্যের রূপ ধরে রইছি গ, লইলে দেখতে আমার ফণার দোলন, শুনতে আমার গর্জন!! বলে তার দিকে কটাক্ষ হেনে হেসেছিল। একটু হাসলেন শিবরাম। বিচিত্র জাত! অরণ্যের রীতি আর নগরের রীতি তো এক নয়!

ভাই-বোন, বাপ-বেটিযে-কোনো সম্পর্ক হোক, নর আর নারী সম্পর্কের সেই আদি ব্যাখ্যাটাই অসংকোচ প্রকাশে সহজ ছন্দে এখানে নিজেদের সমাজ-শৃঙ্খলাকে মেনেও আত্মপ্রকাশ করে। হাস্য-পরিহাসে সরস কৌতুকে পাতানো ভাইয়ের প্রতি কটাক্ষ হেনেছিল শবলা—তাতে আর আশ্চর্য কি?

শবলা মহাদেবকে হত্যা করে গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে—সে আজ আট-দশ বছর হয়ে গেল। শবলার পর পিঙলা নাগিনী কন্যা হয়েছে। শবলা পিঙলাকে তার জীবনের সকল কথাই বলে গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তার ধন্বন্তরি ভাইয়ের কথাও বলে গিয়েছে। বলে গিয়েছে—আমার ভাই তো নয়, সে হইল নাগিনী কন্যের ভাই। তু তার চরণের ধুলা লিস, তারে ভাই বলিস।

পিঙলাও তাই বলে। শিবরামও তাকে স্নেহ করেন। ঠিক সেই কারণেই এই তেজস্বিনী আবেগময়ী মেয়েটিকে এমন বেদনাদায়ক পীড়ায় পীড়িত দেখে অন্তরে অন্তরে বিষণ্ণতা অনুভব না করে পারলেন না তিনি। ভাদু তাকে আশ্বাস দিয়েছে, আসল কৃষ্ণসপী ধরে দেবেই। অন্যথায় তিনি চলে যেতেন। হাঙরমুখীর খালে নৌকা বেঁধে তিনি ভাদুরই প্রতীক্ষা করে রয়েছেন।

জৈষ্ঠ্যের প্রথম। অপরাবেলা। হিজলবিলের কালো জল ধীরে ধীরে যেন একটা রহস্যে ঘনায়িত হয়ে উঠছে। কালো জল ক্রমশ ঘন কৃষ্ণ হয়ে আসছে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য একখানা কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে। পশ্চিম দিক থেকে ছায়া ছুটে চলেছে পূর্ব দিকে হিজলবিল ঢেকে, ঘাসবনের কোমল সবুজে গাঢ়তা মাখিয়ে দিয়ে, গঙ্গার বালুচরের বালুরাশির জ্বালা জুড়িয়ে, গঙ্গার শান্ত জলধারায় অবগাহন করে, ওপারের শস্যক্ষেত্র এবং গ্রামবনশোভার মাথা পার হয়ে চলে। যাচ্ছে। শিবরামের কল্পনানেত্রের দৃষ্টিতে সে ছায়া বিস্তীৰ্ণ প্রসারিত হয়ে চলেছে—বহু দূর দূরান্তরে। দেশ থেকে দেশান্তরে।

ছায়া নেমেছে, কিন্তু শীতলতা আসে নাই এখনও রৌদ্রের জ্বালাটা মুছে গিয়েছে, কিন্তু উত্তাপ গাঢ় হয়ে উঠেছে। মাটির নিচে গরম এইবার অসহ্য হয়ে উঠবে। এইবার হিজলের সজল তটভূমি হয়ে উঠবে সৰ্পসঙ্কুল। সাপেরা বেরিয়ে পড়বে। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন হিজলের জলজ পুষ্পশোভার দিকে। চারিপাশে সবুজের ঘের, মাঝখানে কালো জল, কলমি-সুষনেপানাড়ি-শালুক-পদ্মদামের সবুজ সমারোহ নবীনতার কোমল লাবণ্যে মরকতের মত। নয়নাভিরাম। তারই মাঝখানে হিজলের জল যেন সুমসৃণ চিকুণ একখানি নীলা। এই শোভাতেই তিনি তন্ময় হয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি কীটদংশনে বিচলিত হয়ে দৃষ্টি ফেরালেন। দেখলেন, তাঁর পায়ের কাছেই লাল পিঁপড়ার সারি চলেছে, একটু দূরে একটা গর্ত থেকে তারা পিলপিল করে বেরিয়ে পড়ছে।

হেসে একটু সরে দাঁড়ালেন তিনি। এদেরও বিষ আছে। মানুষের বিষ বোধহয় দেহকোষ থেকে নির্বাসিত হয়ে মনকোষে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সাপের চেয়েও মানুষ কুটিল।

–ধন্বন্তরি ভাই!

চমকে ফিরে তাকালেন শিবরাম। কাঁধে গামছা নিয়ে ঘাটের মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে পিঙলা। একটি অতিক্রান্ত স্নিগ্ধ হাস্যরেখায় তার বিশীর্ণ মুখখানি ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। কোমল স্নিগ্ধকণ্ঠে সে বললে—জনুনীর দরবারের শোভা দেখিছ? এমনভাবে সে কথাগুলি বললে যে, শিবরাম যেন তার কোনো স্নেহাস্পদ বয়োকনিষ্ঠ; তিনি লুব্ধ হয়েছেন এই মনোহারী সজ্জায়; আর এই সমস্ত কিছুর সে অধিকারিণী; বয়োজ্যেষ্ঠা, তার মুগ্ধতা এবং লুব্ধতা দেখে প্রশ্ন করছে–দেখছ এই অপরূপ শোভা? ভাল লেগেছে তোমার? কি নেবে বল তো?

শিবরাম বললে–হ্যাঁ। এবার হিজল সেজেছে বড় ভাল। তুমি স্নান করবে?

–হ্যাঁ। স্নান করব। আপন বিষে মুই জ্বল্যা মলাম ধন্বন্তরি ভাই। অঙ্গে যত জ্বালা মাথায় মনে তত জ্বালা। জান, শবলা কইছিল–নাগিনী কন্যা মিছা কথা, কন্যে আবার নাগিনী হয়। কই, বোঝলম না তো কিছু! কিন্তুক–

একটু চুপ করে থেকে সে মৃদু ঘাড় নাড়লে। কিছু অস্বীকার করলে। অস্বীকার করলে শবলার কথা। মৃদুস্বরে বললে—মুই বোঝলম যে! পরানে-পরানে বোঝলম। চোখ মুদলি দেখি মুই, মোর আত্মারাম এই ফণা বিছায়ে দুলছে—দুলছে—দুলছে। সকলক করিছে জিভ, ধকধক করিছে চোখ দুটো, আর গর্জাইছে।

শিবরাম চিকিৎসকের গাম্ভীর্যে গম্ভীর হয়ে ধীরকণ্ঠে বললেন—তোমার অসুখ করেছে পিঙলা। তুমি নিজের দেহের একটু শুশ্ৰুষা কর। ওষুধ খাও। স্নান কর দু বেলা—ভালই কর, কিন্তু এমন রুখু স্নান না করে মাথায় একটু তেল দিয়ে। বললে না মাথায় জ্বালা, দেহে জ্বালা! তেল ব্যবহার করলে ওগুলো যাবে। তুমি সুস্থ হবে।

স্থিরদৃষ্টিতে পিঙলা শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে রইল। প্রখর হয়ে উঠছে তার দৃষ্টি। একটু শঙ্কিত হলেন শিবরাম। এইবার উদ্মাদিনী হয়ত চিৎকার করে উঠবে। কিন্তু সে-সব কিছু করলে না পিঙলা, হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে ঘন মেঘের দিকে চেয়ে রইল। কিছু যেন ভাবতে লাগল।

কালো মেঘ পুঞ্জিত হয়ে ফুলছে। তারই ছায়া পড়ল পিঙলার কালো মুখে। অতি মৃদু সঞ্চরণে বাতাস উঠছে। বিলের ধারের জলজ ঘাসবনের বাঁকা নমনীয় ডগাগুলি কাঁপছে; সাঁতালীর চরের একটু উঁচু কচি ঘাসবনে মৃদু সাড়া জেগেছে; ঝাউগাছের শাখায় কাণ্ডে গান জাগছে; হিজলের কালো জলে কম্পন ধরেছে; পিঙলার তৈলহীন রুক্ষ ফাঁপা চুল দুলছে–উড়ছে। পিঙলা একদৃষ্টে মেঘের দিকে চেয়ে ভাবছে, খতিয়ে দেখছে ধন্বন্তরিভাইয়ের কথা। অন্য কেউ এ কথা বললে সে অপমান বোধ করত, তীব্র প্রতিবাদ করে নাগিনীর মতই ফুঁসে উঠত। কিন্তু ধন্বন্তরি-ই তো সাধারণ মানুষ নয়, সে যে হাতের নাড়ি ধরে রোগের সন্ধান করতে পারে, দেহের মধ্যে কোথায় কোন্ রোগের নাম কি নাগিনী এসে বাসা বাঁধল, নাড়ি ধরে তিনি বেদেদের হাত চালিয়ে ঘরের সাপ-সন্ধানের মতই সন্ধান করতে পারেন। কিন্তু সে ঘাড় নাড়লে। তা তো নয়।

শিবরামের ইচ্ছা হল তিনি বলেন—তুই শেষ পর্যন্ত উন্মাদ পাগল হয়ে যাবি পিঙলা। ওরে, তার চেয়ে শোচনীয় পরিণাম মানুষের আর হয় না। তাদের বিশ্বাস মিথ্যে আমি বলছি নে। তবে দেবতাই হোক, আর যক্ষ-রক্ষ-নাগ-কিন্নরই হোক, মানুষ হয়ে জন্মালে মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। নাগিনী যদি হোস তুই তবুও তুই মানুষ। মানুষের দেহ তোর, তোর সঁতে বিষ নাই, থাকে তো বুকে আছে। ওসব তুই ভুলে যা। ওই ভাবনাতেই তুই পাগল হয়ে যাবি।

কিন্তু বলতে ভরসা পেলেন না।

পিঙলা তখনও ঘাড় নাড়ছিল; ঘাড় নেড়েই বললে—না ধন্বন্তরিভাই, তা নয়। তুমার ভুল হইছে গ। আমার ভিতরের নাগিনীটা জাগিছে। বিষ ঢালছে—আর সেই বিষ আবার গিলছে। তুমাকে তবে বলি শুন। ই কথা কারুকে বলি নাই। গুহ্য কথা। নারীমানুষের লাজের কথা। রাতে আমার ঘুম হয় না। বেদেপাড়ায় ঘুম নেমা আসে—আর আমার অঙ্গ থেক্যা চাপাফুলের বাস বাহির হয়। সি বাসে মুই নিজে পাগল হয়া যাই গ। মনে হয়, দরজা খুল্যা ছুট্যা বাহির হয়া যাই চরের ঘাসবনে, নয়ত ঝাঁপিয়ে পড়ি হিজলের জলে। আর পরান দিয়ে ডাকি কালো কানাইয়ে। কালো কানাই না আসে তো—আসুক আমার নাগ-নাগর—হেলে দুলে ফণা নাচায় আসুক।

কণ্ঠস্বর মৃদু হয়ে এল পিঙলার, চোখ দুটি নিম্পলক হয়ে উঠল, তাতে ফুটে উঠল শঙ্কাপূর্ণ স্বপ্ন দেখার আতঙ্কিত দৃষ্টি। বললে—আসে, সে আসে ধন্বন্তরিভাই। নাগ আসে। তুমার কাছে। আমার পরানের গোপন কথা কইতে যখন মুখ খুলেছি, তখুনি কিছু লুকাব না। বলি শুন।

শিবরাম বলেন–পিঙলার কাছে শোনা কাহিনী।

ফাল্গুনে ওই জমিদার-বাড়িতে সাপ ধরে আনার পর। চৈত্র মাস তখন। পিঙলার ভাদুমামা আর এক মানুষ হয়ে ফিরে এল। কিন্তু গঙ্গারাম সেই গঙ্গারাম। বাবুরা কন্যেকে বিদায় করেছিলেন দু হাত ভরে। দশ টাকা বকশিশ, নতুন লালপেড়ে শাড়ি, গিন্নিমা নিজের কান থেকে মাকড়ি খুলে দিয়েছিলেন।

নাগু ঠাকুর তাঁর প্রসাদী কারণ দিয়েছিলেন, আর দিয়েছিলেন অষ্টধাতুর একটা আংটি। নিজে কড়ে আঙুল থেকে খুলে পিঙলার হাতে দিয়ে বলেছিলেন—নে। নাগু ঠাকুরের হাতের আংটি। আমার থাকলে, তোকে আমি হীরের আংটি দিতাম। কামরূপে মা-কামাখ্যার মন্দিরে শোধন করে এ আংটি পরেছিলাম আমি। এ আংটি হাতে রাখলে মনে মনে যা চাইবি তা-ই পাবি।

রাঢ়ের সে আমলের টাকু মোড়ল আর এ আমলে নাগু ঠাকুর—এই দুই বড় ওস্তাদ। টাকু মোড়ল ছিল কামরূপের ডাকিনী-মন্ত্ৰসিদ্ধ। টাকু মোড়ল নিজের ছেলেকে টুকরো টুকরো করে কেটে বড় একটি ঝুড়ি ঢাকা দিত। মন্ত্র পড়ে ডাক দিত ছেলের নাম ধরে। ঝুড়ি ঠেলে বেরিয়ে ছেলে আসত জীবন্ত হয়ে। আজও রাঢ়ের বাজিকরেরা জাদুবিদ্যার খেলা দেখাবার সময় টাকু মোড়লের দোহাই নিয়ে তবে খেলা দেখায়—দোহাই গুরুর, দোহাই টাকু মোড়লের।

নাগু ঠাকুর হালের ওস্তাদ। ডাকিনী-মন্ত্ৰ জানে, কিন্তু ও-মন্ত্রে সে সাধনা করে নাই। নাগু ঠাকুর সাধনা করেছে ভৈরবী—তন্ত্রে। লোকে তাই বলে। তবে ডাকিনী বিদ্যা, সাপের বিদ্যা, ভূত বিদ্যাসবই নাকি জানে নাগু ঠাকুর। ঠাকুরের জাত নাই, ধৰ্ম নাই, কোনো কিছুতে অরুচি নাই, সব জাতির ঘরে যায়, সব কিছু খায়, পৃথিবীতে মানে না কিছুকে, ভয়ও করে না। কাউকে। এই লম্বা মানুষ, গোরা রঙ, রুখু লম্বা চুল, মোটা নাক, বড় বড় চোখ, হা হা শব্দ তুলে হাসে, সে হাসির শব্দে মানুষ তো মানুষ গাছপালা শিউরে ওঠে। গঙ্গারাম ডাকিনী-মন্ত্ৰ জানে শুনে তার সঙ্গে এক হাত বাণ কাটাকাটি খেলতে চেয়েছিল। গঙ্গারাম খেলে নাই। বলেছিল–গুরুর বারণ আছে বেরাহ্মণের সঙ্গে, সনেসীর সঙ্গে খেলবি না।

নাগু ঠাকুর হা-হা করে হেসে বলেছিল—আমার জাত নাই রে বেটা নিয়ে চল্ তোদর গায়ে, থাকব সেখানে, তোদের ভাত খাব আর সাধন করব। এমনি একটা কন্যে দিস, ভৈরবী করব।

চৈত্র মাসের তখন মাঝামাঝি।

হিজলের চরে পোড়ানো ঘাসের কলচে রঙের উপর সবুজ ছোপ পড়েছে। কচি কচি সবুজ ঘাসের ডগাগুলি দেখা দিয়েছে। গাছে গাছে লালচে সবুজ কচি পাতা ধরেছে। বিলের জলের উপর পদ্মের পাতা দেখা দিয়েছে। কোকিল, চোখ-গেল, পাপিয়া পাখিগুলোর গলার ধরা-ধরা ভাব কেটেছে, পাখিগুলো মাতোয়ারা হয়ে ডাকতে শুরু করেছে। ওদিকে হিজলের দক্ষিণপশ্চিম মাঠ তিল-ফসলের বেগুনি রঙের ফুলে হয়ে উঠেছে রূপসরোবর। এদিকে বেদেপাড়ায় হলুদ আর লাল রঙের ঢেউ খেলছে। বেদেপাড়ায় বিয়ে শাদি সাঙার কাল এসেছে; সকল ঘরেই ছেলে-মেয়ে আছে, ধুম লেগেছে সকল ঘরেই।

বাতাসে আউচফুলের গন্ধ, আউচফুল ফুটেছে বিলের চারিপাশে অষ্টাবক্ৰ মুনির মত। আঁকাবাঁকা খাটো গাছগুলি থোলো থোলা সাদা ফুলের গুচ্ছে ভরে গিয়েছে। মাঠময় পাতাঝরা বাঁকাচোরা বাবলা গাছগুলির ডগায় ডগায় সবুজ টোপার মত নতুন পল্লব সবে দেখা দিয়েছে।

সেদিন নোটনের কন্যে আর গোকুলের পুত্র, হীরে আর নবীনের বিয়ে। তিন বছরের হীরে, নবীনের বয়স দশ। গায়ে হলুদ মাখছে বেদে এয়ারা, রঙ খেলছে, উলু পড়ছে; ঢোল কাসি বাজাচ্ছে পাশের গায়ের বায়েনরা, মরদেরা মদ তুলছে, মদের গন্ধে যত কাক আর শালিকের দল এসে পড়া ছেয়ে গাছের ডালে বসেছে। বেলা তখন দুপুরের কাছাকাছি, পাড়ায় শোরগোল উঠল।

নাগু ঠাকুর আসিছে। নাও ঠাকুর।

পিঙলা বসে ছিল একা নিজের দাওয়ায়।

সে চমকে উঠল। বুকের ভিতরটা কেমন যেন গুরগুর করে উঠল। মনে পড়লনাগু ঠাকুরের সে মোটা ভরাট দরাজ কণ্ঠস্বর, তার সেই মূৰ্তি, লম্বা মানুষ, গোরা রঙ, মোটা নাক, বড় বড় চোখ, প্রশস্ত বুক, গলায় রুদ্ৰাক্ষ আর পৈতে। সেই হা-হা করে হাসি। গগনভেরী পাখির ডাকে আকাশে নাকাড়া বাজে, নুগু ঠাকুরের হাসিতে বুকের মধ্যে নাকাড়া বাজে।

নাগু ঠাকুর আসিছে। নাগু ঠাকুর!

উত্তেজনায় পিঙলার অবসাদ কেটে গেল। সে উঠে দাঁড়াল।

যেমন অদ্ভুত নাগু ঠাকুরতেমনি আসাও তার অদ্ভুত। কালো একটা মহিষের পিঠে চড়ে এসে সাঁতালীতে ঢুকল। সঙ্গে হিজলের ঘাসচরের বাথানের এক গোপ। ঠাকুরের কাছে প্রকাণ্ড এক ঝোলা। মহিষের পিঠ থেকে নেমে হা-হা করে হেসে বললে—পথে ঘোষেদের মহিষটা পেলাম, চড়ে চলে এলাম। নে রে ঘোষ, তোর মোষ নে।

তারপর বললে—বসব কোথা? দে, বসতে দে।

তাড়াতাড়ি ভাদু নিয়ে এল একটা কাঠের চৌকি।-বসেন, বাবা বসেন।

বসল নাগু ঠাকুর। বললে—ভাত খাব। কন্যে, তোর হাতেই খাব।

হাতের চিমটো মাটিতে বসিয়ে দিলে। পিঙলা বিচিত্র বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে যত আতঙ্ক, তত বিস্ময়। লাল কাপড় পরনে, গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, উগ্ৰ আয়ত চক্ষু, মোটা নাক-নাগু ঠাকুর যেন দাতাল হাতি। না, নাগু ঠাকুর যেন রাজগোখুরা। কথা বলছে আর দুলছে, সঙ্গে সঙ্গে দুলছে তার বুকের উপর রুদ্ৰাক্ষের মালা। কপালে। ডগডগ করছে সিঁদুরের ফোঁটা, ঝকমক করছে রাঙা চোখ। পিঙলার বুকের ভিতরটা গুরগুর করে। কাঁপিছে নাগু ঠাকুরের ভারি ভরাট কণ্ঠস্বরে।

ভাদু বললেকন্যে, পেনাম কর গ। পিঙলা!

—অ্যাঁ? প্রশ্ন করলে পিঙলা; ভাদুর কথা তার কানেই যায় নাই; সে মগ্ন হয়ে রয়েছে নিজের অন্তরের গভীরে।

ভাদু আবার বললে—পেনাম কর গ ঠাকুরকে।

ঠাকুর নিজের পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বললে—পেনাম কর। তোর জন্যেই আসা। মাবিষহরির হুকুম এনেছি। তোর ছুটির হুকুম হয়েছে।

ছুটির হুকুম হইছে?

চমকে উঠল পিঙলা, চমকে উঠল সাঁতালীর বেদেপাড়া।

নাগু ঠাকুর দাড়িতে হাত বুলিয়ে মাথা ঝুঁকি দিয়ে বললে—নাগু ঠাকুর শাক দিয়ে মাছ ঢাকে না। মিছে কথা বলে না। এই কন্যেটাকে দেখে আমার মন বললেওকে না হলে জীবনই মিছে। বুকটা পুড়তে লাগল। কিন্তু কন্যে যেখানে বিষহরির আদেশে বাবদ্ধ হয়ে সাঁতালীতে রয়েছে, তখন সে কন্যেকে পাই কি করে? শেষ গেলাম মায়ের কাছে ধরনা দিতে চম্পাইনগররাঙামাটি। পথে দেখা হল এক ইসলামী বেদে-বেদেনীর সঙ্গে। তোক ইসলামী বেদিনী, সাক্ষাৎ বিষহরির দেবাশিনী। সে-ই বলে দিলে আমাকে কন্যের দেনা এবারে শোধ হয়েছে, কন্যের এবারে ছুটি। নিয়ে যাও এই নাগ, এই নাগ দেখিয়ো। বোলো—এই নাগ বার্তা এনেছে বিষহরির কাছ থেকে। কন্যের মুক্তি, কন্যের ছুটি।

প্রকাণ্ড ঝুলির ভিতর থেকে নাগু ঠাকুর বার করলে একটা বড় ঝাপি। পাহাড়ে চিতি রাখা ঝাঁপির মত বড়। খুলে দিলে সে ঝাপিটা। মুহূর্তে শিস দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল নাগ; নাগ নয় মহানাগ। রাত্রির মত কালো, বিশাল ফণা মেলে সে বুকের উপর দাঁড়িয়ে উঠল,–ছোবল মারলে মানুষের বুকে ছোবল পড়বে, বসে থাকলে ছোবল পড়বে মাথায়। ছয় হাত লম্বা কালো কেউটে। কালো মটর-কলাইয়ের মত নিম্পলক চোখ, ভীষণ দুটি চেরা জিত।

মাথা তুলে দাঁড়াতেই নাগু ঠাকুর হেঁকে উঠল সাপটাকেই হাঁক দিয়ে সাবধান করে দিলে, না-হয় উত্তেজনার আতিশয্যে হক মেরে নাগটাকে যুদ্ধে আহ্বান জানালে। সে হেঁকে উঠল—এ–ই!

সাপটা ছোবল দিয়ে পড়ল। সাধারণ গোখুরা কেউটের ছোবল দেওয়ার সঙ্গে তফাত আছে—অনেক তফাত। তারা মুখ দিয়ে আক্রমণ করে, এ আক্রমণ করে বুক দিয়ে। আড়াই হাত তিন হাত উদ্যত দেহের ঊর্ধ্বাংশটা একেবারে আছাড় খেয়ে পড়ছে। মানুষের উপর পড়বার সুযোগ পেলে দেহের ভারে এবং আঘাতে তাকে পেড়ে ফেলবে; বুকের উপর পড়লে চিত হয়ে পড়ে যাবে মানুষ। তখন সে তার বুকের উপর চেপে দুলবে আর কামড়াবে। সাতালীর বেদেরাও এ নাগ দেখে বারেকের জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল।

পিঙলা চিৎকার করে ছুটে এল—ঠাকুর। তার হাতও উদ্যত হয়ে উঠেছে। সে ধরবে ওর কণ্ঠনালী চেপে। সমস্ত দেহখান নিয়ে ঠাকুরের বুকের উপর আছাড় খেয়ে পড়বার আগেই ধরবে।

নাগু ঠাকুর কিন্তু রাঢ়ের নাগেশ্বর ঠাকুর! দুৰ্দান্ত সাহস, প্রচণ্ড শক্তি, সে তার লোহার চিমটেখানা শক্ত হাতে তুলে ধরেছে। কণ্ঠনালীতে ঠেকা দিয়ে তাকে আটকেই শুধু দিলে না, সাপাকে উলটে ফেলে দিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে কৌতুকে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল।

ওদিকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল গঙ্গারাম। সে সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠল—শঙ্খচূড়! ই তুমি কোথা পেল্যা ঠাকুর? মুই দেখেছি, কামাখ্যামায়ের থান যি দ্যাশে, সেই দ্যাশে আছে এই নাগ। আরেঃ, বাবা!

নাগু ঠাকুর বললে—সে আমি জানি না। আমি জানি, এ হল নাগলোকের নাগ। বিষহরির বাৰ্তা নিয়ে এসেছে। নাগিনীর মুক্তি হয়েছে, তার ঋণ সে শোধ করেছে। বলেছে আমাকে বিষহরি দেবাংশিনী, সে এক সিদ্ধ যোগিনী। মায়ের সঙ্গে তার কথা হয়। তার সঙ্গের যে বেদে সে আমাকে বললে—তুমি মিছে কথা ভেব না ঠাকুর। এ মেয়ে সামান্য লয়। মা-গঙ্গার জলে কন্যে ভেসে এসেছে। আমার ভাগ্যি, আমার পায়ের গায়ে আটকে ছিল, আমি তুললম যত্ন করে সেবা করে চেতনা ফেরালম, কন্যে জ্ঞান পেয়ে প্রথম কইল কি জান? কইলমা-বিষহরি, কি করলে জনুনী, এই তোমার মনে ছিল? সাক্ষাৎ নাগলোকের কন্যে ও মেয়ে। মা-বিষহরির সঙ্গে ওর কথা হয়।

নাগু ঠাকুর বললে আমার রাঢ় দেশে বাড়ি শুনে আমাকে বললে, রাঢ়ে তোমার বাড়ি, তবে গো তুমি তো হিজল বিল জান? মা-মনসার আটন যে হিজলে—সেই হিজল! বিষবিদ্যা জান বলছ, তা গিয়েছ কখনও সেখানে? সাঁতালী জান? সাঁতালীর বিষবেদেদের জান? আমি অবাক হয়ে গেলাম। শুধালাম—তুমি জানলে কি করে? সে কন্যের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। বললে—ঠাকুর, নাগলোকের কালনাগিনীর এক মায়ের পেটের অনেক কন্যের একএকজনাকে যে এক এক জন্মে সেখানে ঋণশোধ করতে জন্ম নিতে হয়। আমিও এক জন্মে সেখানে জন্ম নিয়েছিলম। বড় দুঃখ, বড় যাতনা, বড় বঞ্চনা, বড় তাপ পেয়ে জন্ম শেষে মায়ের থানে গেলম, বললম তুমি মুক্তি দাও। আর দুঃখ তাপ দিয়ো না। মা আমাকে ফের পাঠায়ে দিলেন নরলোকে, বললেন যা তবে সেই তপস্যা কর গে যা। সেই তপ করছি ঠাকুর। মায়ের বিধান মানতে পারি নাই, তার জন্যে শাস্তি পেলম ইসলামী বেদের লায়ে এসে উঠলম। তার অন্ন খেলম। তবে মানুষটা ভাল। ভারি ভাল। তাতেই তো ওর সঙ্গে ঘর বেঁধেছি। ঘর না ছাইমা-মনসার আটনে ঘুরে বেড়াই; মায়ের থানে পূজা করি তার আদেশ মাগি। বলিমাগো, মুক্তি দাও। দেনা শোধ কর। আমাকে শুধালে—তা তুমি কেন এমন করে বাঞ্জুলা বাউলের মত ঘুরছ। ঠাকুর? ব্যাহ্মণের ছেলে, কি তোমার চাই? আমি তাকে বললাম-কন্যে, তোর মত, তোরই মত এক কন্যে, সেও নাগলোকের কন্যে, জন্মেছে নরলোকে, তার জন্যে আমার সবকিছুতে অরুচি, তাকে না পেলে আমি মরব; তারই জন্যে ঘুরছি এমন করে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না, কালো মেয়ে, তার দুই হাতে দুই গোখুরা, আঃ, সে রূপ আমি ভুলতে পারছি না! সে হল ওই সাঁতালী গাঁয়ের নাগিনী কন্যে তার নাম পিঙলা। আজ এক মাস ঘর থেকে বেরিয়েছি। যাব চম্পাইনগর-রাঙামাটিমা-বিষহরির দরবারে; ধরনা দোব। হয় মা আমাকে কন্যেকে দিক নয় তো নিক আমার জীবন, নিক বিষহরি। সে কন্যে পলকহীন চোখে চেয়ে রইল; আকাশবাতাস, গাছ-পালা, নদী-পাহাড় পার হয়ে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল আমি দেখলাম। গুরুর নাম দিয়ে বলছি—সে আমি দেখলাম। চলে গেল-অ্যাঁধার রাত্রে আলো যেমন চলে তেমনি করে চলে গেল। না, পাহাড়ে গাছপালায় আলো ঠেকা খায়, সে দৃষ্টি তাও খায় না। সে চলে। তার দৃষ্টি চলল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে হঠাৎ বললে—পিঙলা, পিঙলা, পিঙলা কন্যে। সাঁতালী গাঁয়ের বিষহরির দেবাশিনী, নাগিনী কন্যে। কালনাগিনীর মত কালো লম্বা দীঘল দেহ, টানা চোখ, টিকালো নাক, মেঘের মত কালো এক পিঠ চুল, বড় মনের যাতনা তার, দারুণ পরানটার দাহ। কন্যে কাঁদে গ। কন্যে কাঁদে, বুকের মধ্যে একগাছ চাপার কলি, কিন্তু সে ফুটতে পায় না। বুকের আগুনে ঝরে যায়।

গোটা সাঁতালীর বেদেরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে শুনছিল নাপ্ত ঠাকুরের অলৌকিক কাহিনী। শঙ্কায় তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বড় ঝাপিটার ভিতর মধ্যে মধ্যে গর্জাচ্ছে সেই মহানগটা। আর শোনা যাচ্ছে জনতার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। বিয়েবাড়ির বাজনা থেমে গিয়েছে। ভাদুর চোখ দুটো বড় হয়ে উঠেছে, জ্বলছে। গঙ্গারামের চোখের দৃষ্টি ছুরির মত ঝলকাচ্ছে। বেদের মেয়ে অবিশ্বাসিনী, বেদের মেয়ে পোড়ারমুখী, মুখ পুড়িয়ে তার আনন্দ; বেদেদের পাড়ায় পাড়ায় অনেক গোপন খেলা;—তার জন্য অনেক বিধান; সন্ধ্যার পর মেয়ে বাড়ি ফিরলে, সে বাড়ি ঢুকতে পায় না;–শিয়াল ডাকিলে পরে বেদেরা লিবে না ঘরে, বেদেনীর যাবে জাতি কুল। সে সব পাপ খণ্ডন হয় ওই এক বিষহরির কন্যার তপস্যায়, তার পুণ্যে। নাগু ঠাকুরের কথার মধ্যে যদি দেবতার কথার আদেশের প্রতিধ্বনি না থাকত তবে নাগু ঠাকুরকে তারা সড়কিতে বিঁধে ঝাজরা করে দিত। আরও আশ্চর্য নাগু ঠাকুর; সে সব জানে, তবু তার ভয় নাই। কেন সে ভয় করবে? এ তো তার কথা নয়, দেবতার কথা। বিষহরির এক কন্যার কথা। সে সশরীরে এসেছে নাগলোক থেকে, তপস্যা করছে জীবনভোর। যে তপস্বিনী যোগিনী-কন্যার সঙ্গে মা বিষহরির কথা হয় তারই কথা সে বলছে।

বিস্ময়ে বিচিত্র ভাবোপলব্ধিতে পিঙলা যেন পাথরের মূর্তি। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ঠাকুরের দিকে। বড় বড় চোখ, মোটা নাক, গৌরবর্ণ দেহ, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, মাথায় বড় বড় রুক্ষ কালো চুলের রাশি, মুখে দাড়ি গোঁফ। গমগম করছে তার ভরাট গলার আওয়াজ। বলছে সেই কাহিনী। বলছে পিঙলার বুকের ভিতরের চাপাগাছে ভরে আছে চাপার কলি। কিন্তু ঝরে যায়, বুকের আগুনে ঝলসে সব ঝরে পড়ে যায়। একটাও কোনো দিন ফোটে না।

পিঙলা অকস্মাৎ মাটির উপর পড়ে গেল, মাটির পুতুলের মত।

নাগু ঠাকুর তার গৌরবর্ণ গোলালো দুখানা হাত দিয়ে কালো মেয়েটিকে তুলে নিতে গেল। এমন যে নাগু ঠাকুর, যার গলার আওয়াজ শুনে মনে হয় শিঙা বাজছে বুঝি, সেই মানুষের গলায় এবার যেন শানাই বেজে উঠল, সে ডাকলে—পিঙলা! পিঙলা!

তার আওয়াজকে ঢেকে দিলে এবার গঙ্গারামের চিৎকার, সে চিৎকার করে উঠল–খবরদার! সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পড়ল নাগু ঠাকুর আর পিঙলার মাঝখানে। নাগু ঠাকুরের বাড়ানো দুখানা হাতে দুহাত চেপে ধরলে। চোখে তার আগুন জ্বলছে। গঙ্গারাম ডোমন করেত, সে ফণা তোলে না, তার চোখ স্থির কুটিল, আজ কিন্তু গঙ্গারাম গোখুরা হয়ে উঠেছে। সে বললে—খবরদার ঠাকুর! কন্যেরে ছুঁইবা না। হও তুমি বেরাহ্মণ, হও তুমি দেবতা, সাঁতালীর বিষবেদের বিষহরির কন্যের অঙ্গ পরশের হুকুম নাই।

এবার ভাদু গর্জন করে সায় দিয়ে উঠল! হঁ! অর্থাৎ ঠিক কথা, এই কথাটাই তারও কথা, গোটা সাঁতালীর বেদেজাতের কুলের কথা।

ভাদুর সঙ্গে সঙ্গে গোটা বেদেপাড়াই সায় দিয়ে উঠল–হঁ।

নাগু ঠাকুর সোজা মানুষ, বুকের কপাট তার পাথরে গড়া কপাটের মত শক্ত, সে কখনও নোয়ায় না, সে আরও সোজা হয়ে দাঁড়াল। বড় বড় চোখে দৃষ্টি ধকধক করে উঠল। সে চিৎকার করে উঠল, শিঙা হেঁকে উঠল—বিষহরির হুকুম! মা কামাখ্যার আদেশ।

গঙ্গারাম বললে—মিছা কথা।

ভাদু বললে—পেমাণ কি?

নাগু ঠাকুর এবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য আকর্ষণ করে বললে–হাত ছাড়।

–না।

নাগু ঠাকুর যেন দাতাল হাতি, এক টানে লোহার শিকল ঝনঝন শব্দ করে ছিঁড়ে টুকরো। টুকরো হয়ে যায়। নাগু ঠাকুরের এক ঝকিতে গঙ্গারামের হাত দুখানা মুচড়ে গেল, সেমোড়ের যন্ত্রণায় তার হাতের মুঠি খুলে গেল এক মুহূর্তে। হা-হা শব্দে হেসে উঠল নাগু ঠাকুর। নাগু ঠাকুরের ভয় নাই। চারিপাশে তার হিজলের ঝাউবন ঘাসবনের চিতাবাঘের মত বেদের দল; তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে সে হা-হা করে হেসে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে পড়ল মুগুরের মত হাতের একটা কিল। অতর্কিতে মেরেছে গঙ্গারাম। একটা শব্দ করে নাগু ঠাকুর টলতে লাগল, চোখের তারা দুটো ট্যারা হয়ে গেল, টলতে টলতে সে পড়ে গেল কাটা গাছের মত।

গঙ্গারাম বললে—বাঁধ্‌ শালাকে। রাখ্‌ বেঁধ্যা। তাপরেতে—

ভাদু সভয়ে বললে–না। বেরাহ্মণ। গঙ্গারাম–

–কচু। উ শালার কুনো জাত নাই। শালা বেদের কন্যে নিয়া ঘর বাঁধিবে, উর আর জাত কিসের?

—ওরে, সিদ্ধপুরুষের জাত থাকে না।

হা-হা করে হেসে উঠল গঙ্গারাম। বললে—অ্যানেক সিদ্ধপুরুষ মুই দেখিছি রে। সব ভেলকি, সব ভেলকি। হিহি হি হি করে হাসতে লাগল গঙ্গারাম।
পিঙলা বলে যাচ্ছিল তার কাহিনী। হিজল বিলের বিষহরির ঘাটের উপর বসে ছিল দুজনে পিঙলা আর শিবরাম। মাথার উপর ঝড় উঠেছে, হুহু করে বয়ে চলেছে, মেঘ উড়ে চলেছে। মধ্যে মধ্যে নীল বিদ্যুতের আঁকাবাকা সর্পিলরেখায় চিড় খাচ্ছে কালো মেঘের আবর্তিত পুঞ্জ। কড়কড় করে বাজ ডেকে উঠছে।

পিঙলার ভ্রূক্ষেপ নাই। তার বিশ্বাস, হিজলের আশপাশে বজ্ৰাঘাত হয় না। তার বিশ্বাস, সে যখন মায়ের চরণে প্রার্থনা জানিয়ে মন্ত্ৰ পড়ে হিজল বিলের সীমানার শান্তি ভঙ্গ না করে দূরান্তরে চলে যেতে মেঘকে ঝড়কে আদেশ করেছে, তখন তাই যেতে সে বাধ্য এবং তাই যাবে।

শিবরাম বলেন-ভাল করে কি ঝড় লক্ষ্য করেছ তোমরা বাবা? হয়ত কেতবে পড়েছ, কিন্তু আমরা সেকালের মানুষ-এ সব পাঠ গ্রহণ করেছি প্রকৃতির লীলা থেকে। ঝড়টা সেদিনের ছিল শুকনো ঝড় এবং উপর-আকাশের ঝড়। অনেক উপরে ঊনপঞ্চাশ পবনের, তাণ্ডব চলছিল, নিচে তার কেবল অ্যাঁচটা লাগছিল। এমন ঝড় হয়। সেদিনের ঝড়টা ছিল সেই ঝড়। সেদিনের ঝড়টা যদি পৃথিবীর বুকে নেমে বয়ে যেত, তবে হিজলের চরের ঝাউবন বাবলাবন শুয়ে পড়ত মাটিতে, হিজল বিলের জল চলকে পড়ত চরের উপর, গঙ্গার বুকের নৌকা যেত উড়ে। সাঁতালী বেদেদের কাশে-ছাওয়া খড়ের চাল ঝড়ের নদীতে নোঙর-ঘেঁড়া পানসির মত ঘুরতে ঘুরতে চলে যেত উধাও হয়ে, পিঙলা আর আমি নাগিনী কন্যা আর ধন্বন্তরিভাই চলে যেতাম শূন্যলোকে ভেসে।

হেসে শিবরাম বললেন—তাই যদি যেতাম বা, তা হলে উড়ে যেতে যেতে পিঙলা নিশ্চয় খিলখিল করে হেসে উঠত, বলত—ধন্বন্তরিভাই, মনে কর, মা-মনসার ব্ৰতর কথা; নাগলোকের ভাইয়েরা বেনে কন্যাকে বলেছিল—বহিন, দেহকে বঁটুলের মত গুটিয়ে নাও, তুলোর চেয়ে হালকা হও, আমার স্কন্ধে ভর কর, চক্ষু দুটি বন্ধ কর। দেখবে শের্শে করে নিয়ে গিয়ে তুলব নাগলোকে। তেমনি করে ধন্বন্তরি আজ ভাই, আমার কাঁধের উপর ভর কর, ভয় কোরো না।

পিঙলার তখন বাস্তববোধ বোধহয় একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কের বায়ু সেটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, আর বায়ুকে আশ্রয় করে মেঘের মত পুঞ্জিত হচ্ছে আবর্তিত হচ্ছে ওই। অলৌকিক বিশ্বাস। ঊন্মাদ রোগের ওই লক্ষণ। একটা মনোবেদনা বা অন্ধ বিশ্বাস নিরন্তর মানুষের মন এবং দেহের মধ্যে সৃষ্টি করে গুমোটের, যে ভাবনা প্রকাশ করতে পারে না মানুষ, সেই নিরুদ্ধ অপ্রকাশিত ভাবনা বায়ুকে কুপিত করে তোলে। তারপর প্রকৃতির নিয়মে কুপিত বায়ু ঝড়ের মত প্রবাহিত হয়। তখন এই বেদনা বা বিশ্বাস মেঘের মস্তিষ্ককে আচ্ছন করে দুর্যোগের সৃষ্টি করে।

পিঙলা সে দিনও আকাশের উৰ্ব্বলোকে প্রবাহিত ঝড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে হেসে বললে—দেখিছ ধন্বন্তরিভাই, অনুনীর মহিমা!

শিবরাম বলেন—একটা গভীর মমতা আমার ছিল—গোড়া থেকেই ছিল। এমনই যারা বন্য যাদের প্রকৃতির মধ্যে মানব-প্রকৃতির শৈশব-মাধুর্যের অবিমিশ্র আস্বাদ মেলে, রূপ ও গন্ধের পরিচয় মেলে, তাদের উপর এই মমতা স্বাভাবিক, তোমরা এদের সংসর্গে আস নাই–তাই এই আকর্ষণের গাঢ়তা জান না। আমার ভাগ্য, আমি পেয়েছি। সেই আকর্ষণের উপরে সে দিন আর এক আকর্ষণ সংযুক্ত হয়ে সবলতর প্রবলতর করে তুলেছিল আমার আকর্ষণকে। সে হল—রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আকর্ষণ। আমি পিঙলার আচরণের মধ্যে রোগের উপসর্গের প্রকাশ-বৈচিত্র্য দেখছিলাম। ভাবছিলাম, রোগেরও অন্তরালে লুক্কায়িত রয়েছেন যে বিচিত্র রহস্যময়ী, তিনি কিভাবে পিঙলাকে গ্রাস করবেন? রোগের অন্তরালে কোন রহস্যময়ী থাকেন, বোঝ তো?-মৃত্যু। তা ছাড়া, পিঙলার কাহিনী ভালও লাগছিল।

পিঙলা ওই পর্যন্ত বলে খানিকটা চুপ করেছিল। নাগু ঠাকুর বুকের উপর অতর্কিত প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে পড়ে গেল—সে ছবি শিবরামের চোখের উপর ভাসতে লাগল। এতগুলি কৃষ্ণকায় মানুষের মধ্যে গৌরবর্ণ রক্তাম্বর-পরা ওই বিশালদেহ অসমসাহসী মানুষটা টলতে টলতে পড়ে গেল। পিঙলা বলে চুপ করলে। উদাস দৃষ্টিতে আকাশের ঘন আবর্তিত মেঘের দিকে চেয়ে রইল। তারপর দূরে একটা বজ্ৰপাতে সচেতন হয়ে আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললে—দেখেছ ধন্বন্তরিভাই, জনুনীর মহিমা!

–ঠাকুর আসিবে। সে-ই আনিবে আমার ছাড়পত্তর-বিধেতার দরবারে হিসাবনিকাশে কন্যের ফারখতের হুকুম। বেদেকুলের বন্দন থেক্যা মুক্তির আদেশ আনিতে গেছে ঠাকুর। আমিই তারে সেদিন হাতপায়ের বাঁধন খুল্যা ছেড়া দিলম; না-হলি ওই পাপী শিরবেদেটা তারে জ্যান্ত রাখিত না। খুন কর্যা ভাসায় দিত হাঙরমুখীর খালে। হাঙরে কুম্ভীরে খেয়ে ফেলাত ঠাকুরের গোরা দাঁতাল-হাতির পারা দেহখানা।

শিউরে ওঠে পিঙলা।

–ভাগ্য ভাল, ভাদু মামারে সেইদিন থেকা সুমতি দিলে মা-বিষহরি। সে-ই এস্যা আমাকে কইলেকন্যে তুমি কও, মায়ের চরণে মতি রেখ্যা বেয়ান কর্যা বল, বেরাহ্মণের লোহু সাঁতালীর মাটিতে পড়িবে কি না-পড়িবে। গঙ্গারাম বলিছে—উকে খুন কর্যা ফেলে দিবে, হাঙরমুখীর খালে। বলিছে—ছো যদি দিস তবে উ ঠাকুর সব্বনাশ করা দিবে।

সেই যে চেতনা হারিয়ে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিল পিঙলা, অনেকক্ষণই তার জ্ঞান হয় নাই। তারপর জ্ঞান ফিরল যখন, তখন সে তার দাওয়ায় শুয়ে, আর তার মাথার কাছে বসে ভাদুর মেয়ে তার মামাতো বোন চিতি। বাড়ির সামনে যেখানে সে দেখেছিল নাপ্ত ঠাকুরকে আর সাঁতালীর বেদেদের—সেখানটা শূন্য। দূরে বিয়েবাড়িতে লোকজন বসে রয়েছে। জটলা করছে। বাজনদারেরা ছুটে পালিয়েছে। নাগু ঠাকুরকে বুকে কিল মেরেছে—নাগু ঠাকুর যখন উঠবে, তখন সাঁতালীতে বিপর্যয় ঘটবে। মৌমাছি বোলতা ভিমরুলে ভরে যাবে সাঁতালীর আকাশ। কিংবা জ্বলে উঠবে সাঁতালীর কাশে-ছাওয়া ঘরবাড়ি। কিংবা প্রচণ্ড ঝড়ই আসবে—যা হোক একটা ভীষণ বিপর্যয় ঘটবে।

পিঙলাকে সমস্ত বিবরণ বললে চিতি।

বললে—আহা, দিদি গ, মানুষ তো নয়, সাক্ষাৎ মহাদেব গ। পাথরের কপাটের মতন বুকের পাটা, গোরা রঙ, বীর মানুষ, পড়ল ধড়াস করে।

ভাদু ছুটে এল এই সময়ে। ওই প্রশ্ন করলে—বেরাহ্মণের লোহু সাঁতালীর মাটিতে পড়িবে কি না-পড়িবে।

পিঙলা বললে—কি হল আমার, সে কথা তুমাকে বলতে পারব ধন্বন্তরিভাই। হা ঠিক যেমন হছিল—সেই বাবুদের বাড়িতে, ওই নাগু ঠাকুরের হাঁক শুন্যা, বেদেকুলের মান্য যায়যায় দেখ্যা যেমনি হছিল, ঠিক তেমুনি হল। পরানটা আকুলি হয়ে উঠল। মনে মনে পরানটা ফাটায়ে ডাকিলম মা-বিষহরিকে। বলিব কি ভাই, চোখে দেখিলম যেন মায়ের রূপ। ওই আকাশের ম্যাঘে যেমন চিকুর হেন্যা মিলায়ে যেতিছে বিদ্যুতের চমক, তেমুনি চকিতে দেখিলম—চকিতে মিলায়ে গেল। পিথিমীটা যেন দুল্যা উঠল, ছামুতে হেই হিজল বিল উথলায়ে উঠল। গাছ দুলিলপাতা দুলিল।

পিঙলা আবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিল। এবার কিন্তু গতবারের মত নয়। এবার তার উপর হল বিষহরির ভর। মূৰ্ছার মধ্যেই মাথা তার দুলতে লাগল, মাথার সে আন্দোলনে রুখু চুলের রাশ চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে সে বললে—ছেড়া দে, সিদ্ধ পুরুষকে তোরা ছেড়া দে, বীরপুরুষকে তোরা ছেড়া দে। কন্যে থাকিবে না, কন্যে থাকিবে না। মা কহিছে, কন্যে থাকিবে না।

পিঙলা বলে—সেই বিচিত্র বিস্ময়কর ক্ষণে বিষহরি মাকে (খে দেখেছিল। ওই চকিতে দেখা দিয়ে মা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যেন কি। পিঙা দেখলে ধরাশায়ী মদমত্ত শ্বেতহস্তীর মত নাগু ঠাকুরকে। বুকে তার রুদ্রাক্ষের মালা নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে দুলছে, হাত-পা বাধা, কিন্তু চোখে তার নির্ভয় দৃষ্টি। নাগু ঠাকুরের শিঙার মত কণ্ঠস্বর কানের কাছে বেজে উঠল—কন্যা থাকিবে না। বিষহরির হুকুম আমি শুনেছি। আমি ওই কন্যেকে নিতে এসেছি।

এদিকে কন্যার ভর দেখে ভাদু চিৎকার করে উঠেছিলমা জাগিছেন, কন্যের ভর হইছে। ভর হইছে। ধূপ-ধুনা-বিষমটকি! নিয়ে আয়, নিয়ে আয়।

ধূপধুনার গন্ধে, ধোঁয়ায়, বিষমটাকির বাদ্যে সে যেন নূতন পর্বদিন এসেছিল সাঁতালী গাঁয়ে।

—কি আদেশ কও মা!

পিঙলার সেই এক কথা।—সিদ্ধপুরুষ ছেড়ে দে, ছেড়ে দে। কন্যা থাকিবে না। কন্যা থাকিবে না।

বলতে বলতে নির্জীব হয়ে পড়েছিল পিঙলা। যেন নিথর হয়ে গিয়েছিল। সে জেগেছিল দীর্ঘক্ষণ পর। তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে গঙ্গারাম, চোখে তার ক্রূর দৃষ্টি। ডোমন-করেতের দৃষ্টি মেলে তার দিকে চেয়ে ছিল।

কিছুক্ষণ পর পিঙলা টলতে টলতে উঠল, ডাকলে–ভাদুমামা গ!

—জনুনী!

–ধর আমাকে।

–কোথা যাবে গ, ই দেহ নিয়া?

—যাব। ঠাকুর কোথাকে আছে, নিয়া চল আমাকে। বিষহরির আদেশে কইছি মুই। নিয়া চল।

আশ্চর্য আদেশের সুর ফুটে উঠেছিল পিঙলার কণ্ঠস্বরে। সে সুর লঙ্ঘনের সাহস বেদেদের কোনোকালে নাই।

হাতে পায়ে বেঁধে ফেলে রেখেছিল নাগু ঠাকুরকে।

আশ্চর্য, নাগু ঠাকুর চুপ করে শুয়ে ছিল—যেন আরাম শয্যায় শুয়ে আছে। পিঙলার ধ্যানকল্পনার দেখা ছবির সঙ্গে আশ্চর্য মিল।

পিঙলা প্রথমেই তাকে প্রণাম করলে, তারপর নিজের হাতে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে হাত জোড় করে বললে—বেদেকুলের অপরাধ মাৰ্জ্জনা করি যাও ঠাকুর। তুমি ঘর যাও।

নাগু ঠাকুর উঠে দাঁড়িয়ে একবার গম্ভীরকণ্ঠে ডাকলে পরমেশ্বরী মা! তারপর বললে–প্রমাণ চেয়েছিস তোরা? ভাল, প্রমাণ আমি আনব। এনে, শোন, কন্যে, প্রমাণ দিয়েই তোকে আমি নিয়ে যাব। তোকে নইলে আমার জীবনটাই মিছে।

–ছি ঠাকুর, তুমি বেরাহ্মণ-–

–জাত আমি মানি না কন্যে, এ সাধনপথে জাত নাই। থাকলেও তোর জন্যে সে জাত আমি দিতে পারতাম। তোর জন্যে রাজসিংহাসনে থাকলে তাও দিতে পারতাম। নাগু ঠাকুরের লজ্জা নাই, মিছে কথা সে বলে না।

কথা বলতে বলতে নাগু ঠাকুর যেন আর একজন হয়ে গেল। ধন্বন্তরি, শিঙা যেন শানাই হল, তাতে যেন সুরে এক মধুর গান বেজে উঠল। মুখে চোখে গোরা রঙে যেন আবীরের ছটা ফুটল।

—সর্‌, সরে যা। দুটারে, দুটারেই খুন করব মুই।

বেদেদের ঠেলে এগিয়ে এল গঙ্গারাম।

হা-হা করে হেসে উঠল নাগু ঠাকুর। এবার আর সে অপ্রস্তুত নয়। হাতের লোহার ত্রিশূলটা তুলে বললে—আয়। শুধু হাতে যদি চাস তো তাই আয়। হয়ে যাক, আজই হয়ে যাক।

তীক্ষ্মস্বরে চিকার করে উঠল পিঙলাখবরদার! ঠাকুর যা বলিছে সে আপন কথা বলিছে! মুই যাই নাই। যতক্ষণ মায়ের আদেশ না মিলবে মুই যাব না। বেরাহ্মণকে পথ দে।

গঙ্গারাম নাণ্ড ঠাকুরের হাতে ত্রিশূল দেখে, অথবা পিঙলার আদেশে, কে জানে, থমকে দাঁড়াল।

নাগু ঠাকুর বেরিয়ে গেল বেদেপাড়া থেকে। যাবার সময় গঙ্গারামের সামনে দাঁড়িয়ে বললে প্রমাণ যেদিন আনব, সেদিন এই কিলের শোধ আমি নোব। বুকটাকে লোহাতে বাঁধিয়ে রাখিস, এক কিল সেদিন আমি মারব তোর বুকে। না, দু কিল—এক কিল আসল, এক কিল সুদ। হা-হা করে হেসে উঠল নাগু ঠাকুর।

ওই হাসি হাসতে হাসতেই চলে গেল সে।

গোটা বেদেপাড়াটা স্তম্ভিত হয়ে রইল।

পিঙলা বললে—ধন্বন্তরিভাই, তুমার কাছে মুই কিছু গোপন করব না, পরানের কথাগুলান বুকের ভিতরে গুমুরা গুমুর্যা কেঁদ্যা সারা হল। দুঃখের ভাগী আপন জনার কাছে না-বলা শান্তি নাই। তুমারে সকল কথাই কই, শুন। হও তুমি মরদ মানুষ তবু তুমি আমার ধরম-ভাই। মনে লাগে, যেন কত জনমের আপন থেক্যাও আপনজনা। বলি শুন ভাই। মানুষটা চল্যা গেল, এ হতভাগীর নয়ন দুটা আপনা থেক্যাই ফিরল তার পানে। সে চলে গেল, কিন্তু পথ থেকে নয়ন। দুটা আর ফিরল না। লোকে পাঁচ কথা কইলে। কিন্তু কি করব কও? ধন্বন্তরিভাই, সুয্যমুখী পুষ্প সূরযঠাকুরের পানে তাকায়ে থাকে, দেবতার রথ চলে, পুব থেকা পচি মুখে-নয়নে তার পলক পড়ে না, নয়ন তার ফেরে না। নাগু ঠাকুর আমার সূরযঠাকুর। তেমুনি বরন তেমুনি ছটা–ঠাকুর আমার বন্ধন-মোচনের আদেশ নিয়া আসিল, কইল-ওই কন্যের লইলে পরানটা মিছা, পিথিমীটা মিছা, বিদ্যা মিছা, সিদ্ধি মিছা; তার লাগি সে জাত মানে না, কুল মানে না, স্বগ্‌গ মানে না। এই কালো কন্যে-কালনাগিনী—এরে নিয়া ঘর বাঁধিবে, বুকে ধরিবে, হেন পুরুষ ই পিথিমীতে কে? কোথায় আছে? আছে ওই নাগবিদ্যায় সিদ্ধ নাগু ঠাকুর। নাগলোকে নর গেলে পরে পরান নিয়া ফেরে না। নাগলোকের বাতাসে বিষ মানুষ ঢল্যা পড়ে যায়, নাগলোকের দংশনে পরান যায়। কিন্তু বীরপুরুষের যায় না। পাণ্ডব অর্জুন নাগরাজার কন্যেকে দেখেছিলমা-গঙ্গার জলে, কনেকে পাবার তরে হাত বাড়ালে, কন্যে হেসে ড়ুব দিলে জলে। বীরপুরুষও ড়ুবল। এস্যা উঠল নাগলোকে। বিষ-বাতাসে সে ঢল্যা পড়ল না, সে বাতাসে তার পরানে মধুর মদের নেশা ধরায়ে দিলে। নাগলোক এল হাঁ-হাঁ করে, বীরপুরুষ যুদ্ধ করে। কন্যেকে জয় করে লিলে। নাগু ঠাকুর আমার তাই। সে চলে গেল, আমার নয়ন দুটি তার পথের পানে নাফির্যা থাকে কি করে কও? তাকায়ে ছিলম তার পথের পানে। রাঢ়ের পথ, মা-গঙ্গার কূল থেকে চল্যা গিয়াছে পচি মুখে। দুই ধারে তালগাছের সারিও চলা গিয়াছে—আঁকাবঁকা পথের দুই ধারে এঁকেবেঁক। সুযিঠাকুর তখুন পাটে বসেছে, তার লাল ছটা সেই তালগাছের সারির মাথায় মাথায় রঙের ছোপ বুলায়ে দিয়েছে; চিকন পাতায় পাতায় সে পিছলে পিছলে। পড়িছে। মাটির ধুলোতে তার আভা পড়িছে। ওদিকে মাঠে তিল ফুলের বেগুনে রঙের উপর পড়িছে লাল আলোর রঙ। নাগু ঠাকুর সেই পথ ধরা চল্যা গেল। মুই অভাগিনী রইলম খালি পথের পানে তাকায়ে। বাঁশ আমার ছিল না। শ হল, কে যেন ঘাড়ে ধরে দিলেক ঝকি!

ঝুঁকি দিলে গঙ্গারাম।

কুৎসিত হাসি হেসে সে বললে–চাঁপার ফুল ফুটল লাগিছে! অ্যাঁ!

চাঁপার ফুলের অর্থ, ধন্বন্তরিভাই জানে কি না প্রশ্ন করলে পিঙলা। শিবরাম হাসলেন। মৃদুস্বরে বললেন–-জানি।

শিবরাম জানবেন বৈকি। তিনি যে আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য। তিনি গ্রামের মানুষ, শুধু গ্রামের মানুষ নন, গ্রামের যে মানুষ ভূমিকে জানে, নদীকে জানে, বৃক্ষকে জানে, লতাকে জানে, ফল ফুল ফসলকে জানে, কীট-পতঙ্গ জীব-জীবনকে জানে—সেই মানুষ। তিনি জানেন, নাগমিলন-তৃষাতুরা নাগিনীর অঙ্গসৌরভ ওই চাপার গন্ধ। প্রকৃতির নিয়মে অভিসারিকা নাগিনীর অঙ্গখানি সৌরভে ভরে উঠবে, চম্পকগন্ধা তার প্রেমের আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দেবে-অন্ধকার লোকের দিকে দিকে।

পিঙলা বলেনা না। হল না। তুমি জান না ধন্বন্তরিভাই। সে বলে—অভিসারিকা নাগিনী চম্পকগন্ধা বটে, এ কথাটা ঠিক। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম না কি বললে না? ও কথাটার অর্থ কি সে তা জানে না, তবে মূল তথ্যটা তা নয়। কালো কানাই গো, কালো কানাই, কালিন্দীর কূলে ব্ৰজধাম, সেখানের মাটিতে উদয় হয়েছিল—কালোর্চাদের। সেই কানাইয়ের কারণ। শোন, গান শোন।

বিচিত্র বেদের মেয়ে, মাথার উপরে ঝড়ো আকাশ, বাতাসের একটানা শেশো শব্দ, তারই সঙ্গে যেন সুর মিলিয়েই গান ধরে দিলে—

কালীদহের কূলে বসে, সাজে ও কার ঝিয়ারী?
ও তো লয় কো গৌরবরনী রাধা বধূ শ্যামপিয়ারী।
ও কার ঝিয়ারী?

সাজছে যে তার দেহের বর্ণ কালো। কালো কানাইয়ের বর্ণের আলো আছে, কানাই কালোভুবন আলো করে; এ মেয়ের কালো রঙে আলো নাই কিন্তু চিকন বটে! ও হল কালীয়নাগনন্দিনী, কালীদহের কূলে মনোহর সজ্জায় সেজে কালো কানাইয়ের আশায় বসে আছে। অঙ্গে তার চম্পকসজ্জা।

খোঁপায় পরেছে চাঁপা ফুল, গলায় পরেছে চাপার মালা। বাহুতে চপার বাজুবন্ধ, হাতে চাপার বালা, কোমরে চাপার সাতনরী! কালীদহের কূলে বসে কদম্বতলার দিকে চেয়ে গুনগুন করে সে গান গাইছে–

ওরে ও নিচুর কালিয়া,
কি অগ্নি জ্বালালি বুকে–কি বিষমো জ্বালা!
সে জ্বালায় মোর বুকের বিষ–জ্বলা জ্বলা জ্বলা হইল মধু!
আমার মুখের বিষের পাত্রে, মধু আমার খাইয়া যাও রে বঁধু!

ধূর্জটি কবিরাজের শ্ৰীমদ্ভাগবতে মহাভারতে হরিবংশে আছে শ্রীকৃষ্ণের কালীয়নাগ দমনের কথা। পিঙলার সাঁতালী গাঁয়ের বেদেদের আছে আরও খানিকটা। ওরা বলে—আরও আছে। বলে—যুদ্ধে নাগ হার মানেন নাই। বিষম যুদ্ধের পর নাগ বললেন–আমি মরব, তবু হার মানব না। হার মানতে পারি এক শর্তে। সে শর্ত হল, তোমাকে আমার জামাই হতে হবে। আমার কন্যাকে বিয়ে করতে হবে। বল, তা হলে হার মানব। কুটিল কানাই তাতেই রাজি হলেন। কালীদহের জলের তলায় বেজে উঠল বিয়ের বাদ্যি। কালীয়নাগ হার মেনে মাথা নোয়াল, অস্ত্র সমর্পণ করলে। কালীয়নাগের বিষ-মাখানো অস্ত্রগুলি নিয়ে, মাথার মণি নিয়ে কানাই এই আসি বলে চলে গেলেন—আর এলেন না। চলে গেলেন মথুরা। সেখান থেকে দ্বারকা। ওরা বলে–সেই অবধি সন্ধ্যাকালে কালীদহের কূলে দেখা যেত এক কালো মেয়েকে। পরনে তার রাঙা শাড়ি, চোখে তার নিষ্পলক দৃষ্টি, দেহে তার লতার মত কমনীয় গঠন-লাবণ্য, সর্বাঙ্গে চম্পাভরণ। সে কাঁদত। নিত্য কাঁদত। আর ওই গান গাইত—ওরে ও নিঠুর কালিয়া!

এই কাহিনী ওদের গানে আছে, মুখে মুখে গল্পে আছে।

সন্ধ্যাবেলা এই কাহিনী শুনে, স্মরণ করে সাঁতালীর নাগিনী কন্যেরা চিরকাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। বিরলে বসে গুনগুন করে অথবা নির্জন প্রান্তরপথে উচ্চকণ্ঠে সকরুণ সুরে ওই গান চিরকাল গেয়ে আসছে–

আমার বুকের বিষ জ্বল্যা জ্বল্যা জ্বল্যা হইল মধু।

কালীদহের কূলে কৃষ্ণাভিলাষিনী ব্যর্থ-অভিসারিকা কালীয়নাগনন্দিনীর চম্পকসজ্জার সৌরভ একদা বিচিত্র রহস্যে তার দেহসৌরভে পরিণত হয়েছিল। সেই চম্পকগন্ধযুক্তা বেদনাতুরা কুমারীকে দেখে নাকি অন্য সব পতিগরবিনী সোহাগিনী নাগকন্যারা হেসে ব্যঙ্গ করেছিল। সেই ব্যঙ্গে বেদনার উপর বেদনা পেয়ে কৃষ্ণাভিলাষিনী চম্পকগন্ধা কুমারী অভিশাপ দিয়েছিল, বলেছিল—এ কামনা কার না আছে সৃষ্টিতে? আমার সে কামনা দেহগন্ধে প্রকাশ পেয়েছে বলে যেমন ব্যঙ্গ করলি তোরা, তেমনি আমার অভিশাপে নাগিনী কুলে যার অন্তরে যখন এই কামনা জাগবে, তখনই তার অঙ্গ থেকে নির্গত হবে এই গন্ধ। আমি কৃষ্ণাভিলাষিনী, আমার তো লজ্জা নাই, কিন্তু তোরা লজ্জা পাবিশাশুড়ি-নন্দ-শ্বশুর-ভাসুরের সংসারে, সংসারের বাইরে নাগপ্রধানদের সমাজে।

শিবরাম বলেন-ওদের পুরাণকথা ওরাই সৃষ্টি করেছে। আমাদের পুরাণ সত্য হলেও ওদের পুরাণকথাও সত্য; কিন্তু থাক্ সে কথা। পিঙলার কথাই বলি শোন।

পিঙলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় কালীয়নাগকুমারীর বেদনার কথা স্মরণ করে। বেদনা অনুভব করছিল। বোধহয় নিজের বেদনার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিল।

শিবরাম বলেন–পিঙলার চোখে সেইদিন প্রথম জল দেখলাম। পিঙলার শীর্ণ কালো গাল দুটি বেয়ে নেমে এল দুটি জলের ধারা। তিনি বললেন—আজ থাক্ রে বহিন। আজ তুই স্নান করে বাড়ি যা। এইবার বৃষ্টি আসবে।

পিঙলা আকাশের দিকে তাকালে।

মোটা মোটা ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু হল। মোটা ফোটা কিন্তু ধারাতে ঘন নয়, একটু দূরে দূরে পড়ছে, যেমন বৃষ্টি নামার শুরুতে অনেক সময় হয়। হিজলের জলে মোটা ফোঁটাগুলি সশব্দে আছড়ে পড়ে ঠিক যেন খই ফোটাচ্ছে, যেন পালিশ-করা কালো পাথরের মেঝের উপর অনেকগুলো ছেনি-হাতুড়ির ঘা পড়ছে। পিঙলা কথার উত্তর না দিয়ে মুখ উচু করে সেই বৃষ্টি মুখে নিতে লাগল।

শিবরাম উঠেছিলেন। পিঙলা মুখ নামালে, বললে–নাগ ভাই, বস। ই জল হবে না। উড়ে চলেছে মেঘ, দু ফোঁটা দিয়া ধরম রেখ্যা গেল নিজের, আর আমার চোখের জল ধুয়্যা দিয়া গেল। বস, শুন। আমার কথা শুন্যা যাও।

—জান ভাই ধন্বন্তরি, একনার অমৃতি, অন্যজনের বিষ। গরল পান করা শিব মৃত্যুঞ্জয়, দেবতারা অমর হন সুধা পান করা। রাম-সীতের কথায় আছে, রামের বাবা দশরথকে অন্ধক মুনি শাপ দিলে, কি, পুত্যশোকে মরণ হবে। শাপ শুন্যা রাজা নাচতে লাগল। কেনে? নাচিস কেনে রাজা? রাজা কয়-ই যে আমার আশীর্বাদ, আমার পুত্তু নাই, আগে পুত্ত্ব হোক, তবে তো পুভুশোকে পরানটা যাবে! কালীনাগের জন্যে কানাইগরবিনী শাপ দিলেকসে শাপ নাগিনীদের লাজের কারণ হইল, কিন্তু তাতেই নাগিনী হইল মোহিনী। তাদের অঙ্গগন্ধে নাগে হইল পাগল। আর সাঁতালীর নাগিনী কন্যের ওই হইল সধ্বনাশের হেতু, পরানের ঘরের আগুন, সে আগুন ঘরে লাগলে ঘরের সাথে নিজে সমেত পুড়া ছারখার হয়া যায়। নাগিনী কন্যের অঙ্গে চাপার বাস ফুটলে হয় কন্যে আত্মঘাতী হয়, লয়তো কুলে কালি দিয়া বেদেকুলে পাপ চাপায়ে অকূলে ভাসে। জান তো শবলার কথা। নাগিনী কন্যের অঙ্গে চাপার বাস। অভিসম্পাত, এর চেয়ে বড় গাল আর হয় না। বেদেঘরের বউ কি কন্যের সকল পাপ জরিমানায় মাপ হয়, রাত কাটায়ে সকালে বেদের বউ কন্যে ঘরকে ফিরলে বেদের মরদ তার অঙ্গটা হেঁচা দেয় ঠেঙার বাড়ি দিয়া, কিন্তু ছাড়-বিড় নাই, জরিমানা দিয়া দিল্যাই সব মাজ্জনা; যদি গেরস্ত কেউ সাক্ষী। দেয়, কি, রাতে তার বাড়িতে তার আশ্চয়ে ছিল, তবে জরিমানাও লাগে না। কিন্তু লাগিনী কন্যের বেলা তা লয়। তার সাজাপরানটা দিতে হয়। তাই ওই পাপীটা, ওই শিরবেদেটা যখন কইল—কি, চাপার ফুল ফুটল লাগিছে! অ্যাঁ? তখুন আমার পায়ের নখ থেক্যা মাথার চুল পয্যন্ত বিদ্যুৎ খেলে গেল।

এর পর মুহূর্তে পিঙলার রূপ পালটে গিয়েছিল।

সে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন! স্থির বিস্ফারিত দৃষ্টি নিষ্কম্প দেহ, এক মুহূর্তে কন্যা যেন সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে। হিজলবিল, সাঁতালীর ঘাসবন, সামনের বেদেরা—কেউ নাই, কিছু নাই।

বুকের ভিতর কোথায় ফুটন্ত চাপার ফুল! ফুটেছে চাপার ফুল! কই? কোথায়? কোথায়?

না। মিছে কথা। পিঙলা চিৎকার করে উঠেছিল। আপনার মন তনুতন্ন করে অনুসন্ধান করে দেখে সে কিছুতেই নিজেকে অপরাধিনী মনে করতে পারে নাই। কই? নাগু ঠাকুরের ওই গৌরবর্ণ বীরের মত দেহখান দেখে তার তো বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বার কামনা হয় নাই! ওই তো নাগু ঠাকুর চলে গেল—কই, তার তো ইচ্ছে হয় নাই সাঁতালীর আটন ছেড়ে, সাঁতালীর বেদেদের জাতিকুল ছেড়ে ঠাকুরের সঙ্গে ওই তালগাছ-ঘেরা পথ দিয়ে চলে যায় নিরুদ্দেশে! তার চলে যাওয়া পথের পানে তাকিয়ে সে ছিল, এ কথা সত্য; কিন্তু এমন যে বীরপুরুষতার পথের পানে কে না তাকায়? সীতা সতীর স্বয়ম্বরে ধনুকভাঙার পণ ছিল। মহাদেবের ধনুক। রামচন্দ্র যখন ধনুক ভাঙবার জন্য সভায় ঢুকলেন, তখন সীতা সতী রাজবাড়ির ছাদের উপর। থেকে তাকে দেখে কি তার পানে তাকায়ে থাকে নাই? মনে মনে শিবঠাকুরকে ডেকে বলে নাই—হে শিব, তুমি দয়া করো, তোমার ধনুককে তুমি পাখির পালকের মত হালকা করে দিয়ে, কাশের কাঠির মত পলকা করে দিয়ো—যেন রামচন্দ্রের হাতে ধনুকখানা ভেঙে যায়! মনে মনে বলে নাই—মা মঙ্গলচণ্ডী, রামচন্দ্রের হাতে দিয়ে বাসুকী নাগের হাজার ফণার বল, যে বলে সে পৃথিবীকে ধরে থাকে মাথায়—সেই বল; আর বুকে দিয়ে অনন্ত নাগের সাহস, যে সাহসে প্রলয়ের অন্ধকারে সারা সৃষ্টি দিগ্বিদিক ড়ুবে গেলে মুছে গেলে একা ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কাল সমুদুরের মাঝখানে—সেই সাহস। তাতে কি অপরাধিনী হয়েছিলেন সীতা সতী? রামচন্দ্রকে চোখে পরানে ভাল লেগেছিল তাই কথাগুলি কয়েছিলেন-ভগবানও কান পেতে সে কথা শুনেছিলেন। ধনুক ভাঙার আগে তো সীতা ফুলের মালাগাছাটা রামের গলায় পরায়ে দেন। নাই! পিঙলাও দেয় নাই। সে শুধু তার পানে চেয়ে বলেছে—ভগবান, ঠাকুরের প্রতিজ্ঞা পূরণ কর, সে যেন এই অভাগিনী বন্দিনী কন্যার মুক্তির আদেশ নিয়ে ফিরে আসে। বিধাতার শিলমোহর করা মা-বিষহরির হাতের লেখা ছাড়পত্র সে যেন আনতে পারে।

চোখের ভাল লাগা, মনের ভাল লাগা—এর উপরে হাত নাই; কিন্তু সে ভাললাগাকে সে তো কুলধর্মের চেয়ে বড় করে নাই, তাকে সে লঙ্ন করে নাই! সে এক জিনিস, আর বুকের মধ্যে চাপা ফুল ফোটা আর এক জিনিস। সে ফুল যখন ফোটে, তখন বুকের গঙ্গায় বান ডাকে; সাদা ফটিকের মত জল-ঘোলা ঘোরালো হয়; ছলছল ডাক, কলকল রব তোলে, কুল মানে না, বাঁধ মানে না, সব ভেঙ্গেচুরে ভাসিয়ে চলে যায়। স্বর্গের কন্যে মর্ত্যে নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাত সমুদ্রের নোনা জলে।

তবে?

না, মিছে কথা। সে চিৎকার করে উঠেছিলনা না না।

শিবরাম বলেন-আমি মনশ্চক্ষে দেখলাম, সঙ্গে সঙ্গে পিঙলার সমস্ত দেহ পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল; কালবৈশাখীর ঝড়ে আন্দোলিত ঝাউগাছের মত প্রবল অস্বীকৃতির দোলায় দুলে উঠল। তারই ঝাপটায় তার মাথার চুলের রাশি খুলে এলিয়ে পড়ল। চোখ দুটো হয়ে উঠল প্রখরতার মধ্যে ফুটে উঠল উন্মাদ ক্রোধের ছটা।

উন্মাদ রোগ তখন পিঙলাকে আক্রমণ করেছে।

পিঙলা বললে—ধন্বন্তরিভাই, মুখে কইলম, মনে কইলম, ডাকলম বিষহরিকে। সেদিন তারে ডেক্যা কইলম-জননী, তুমার বিধান যদি মুই লঙ্ন কর্যা থাকি, বুকের চাপার গাছে জল ঢেল্যা যদি চাপার ফুল ফুটায়ে থাকি, তবে তুমি কও। তুমার বিচার তুমি কর। হোক সেই বিচার। সে পাগলের মত ছুটল। নাগু ঠাকুরকে যে-ঘরে বেঁধে রেখেছিল, সেই ঘরের দিকে।

নাগু ঠাকুরের বাঁধন সে-ই নিজের হাতে খুলে দিয়েছিল। তার চোখের সামনে দিয়ে নাগু ঠাকুর চলে গিয়েছে। কিন্তু তার সেই মহানাগের ঝাঁপি সে নিয়ে যায় নাই, সেটা পড়ে আছে। সেই ঘরে!

বেদের দল এ কথা বুঝতে পারে নাই; তারা বিস্মিত হয়ে ভাবছিল-ওদিকে কোথায় চলেছে কন্যা?

পিঙলা তুলে নিয়ে এল সেই কাঁপি। বিষহরির আটনের সামনে ঝাপিটা নামিয়ে চিৎকার করে উঠল—বিচার কর মা-বিষহরি অনুনী, তুমি বিচার কর।

সমস্ত সাঁতালী আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল—কন্যা, এ কি করলে? কিন্তু উপায় নাই। আটনের সামনে এনে যখন নাগের ঝাঁপি পেতে বিচার চেয়েছে, তখন উপায় নাই। সমবেত মেয়েরা অস্ফুট শব্দ করে উঠেছিল—ও মা গ!

সুরধুনী চেঁচিয়ে উঠেছিল, কন্যে!

পুরুষেরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে এ ওর মুখের দিকে চেয়েছিল। গঙ্গারামও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে কি যেন একটা খেলে যাচ্ছিল। যেন হিজল বিলের গভীর জলের তলায় কোনো জলচর নড়ে নড়ে উঠছে। ভাদু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে যেন আগুন লেগেছে। সমস্ত শরীর তার শক্ত হয়ে উঠেছে–হাতে কপালে শিরাগুলো মোটা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে।

পিঙলা হাঁপাচ্ছিল, চোখে তার পাগলের চাউনি। বার বার মাথার এলানো চুল মুখে এসে পড়ছিল। সে হাত দিয়ে সরায় নি সে চুল, মাথা ঝুঁকি দিয়ে সরিয়ে পিঠে ফেলছিল। খুলে দিয়েছিল ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড়, আঁচলখানা লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। তারপর সে ক্ষিপ্ৰ হাতে খুলে দিলে সেই মহানাগের কাঁপি। কামাখ্যা-পাহাড়ের শঙ্খচূড়। বল হাঁটু গেড়ে তারই সামনে নগ্ন বক্ষ পেতে।

নাগিনী কন্যা যদি চম্পকগন্ধা হয়ে থাকে, যদি তার অঙ্গে নাগ-সাহচর্য-কামনা জেগে থাকে, তবে ওই নাগ তাকে সাদরে বেষ্টন করে ধরবে পাকে পাকে কন্যার অঙ্গ বেষ্টন করে মাথার পাশে তুলবে ফণা। না হলে নাগ তার স্বভাবধর্মে মারবে তাকে ছোবল; ওই অনাবৃত বক্ষে করবে তাকে দংশন।

নাগু ঠাকুরের নাগ—তার বিষ আছে কি গালা হয়েছে সে জানে নাগু ঠাকুর।

মুহূর্তে মাথা তুলে দাঁড়াল হিংস্ৰ শঙ্খচূড়।

সামনে পিঙলা বসেছে বুক পেতে। সাপটার ফণা তার মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। সেটা পিছন দিকে হেলছে, জিভ দুটো লকলক করছে, স্থির কালো দুটো চোখ পিঙলার মুখের দিকে নিবদ্ধ। হেলছে পিছনের দিকে, বুকটা চিতিয়ে উঠছে, মারবে ছোবল। বেদেদের চোখ মুহূর্তে ধরে নিয়েছে। সাপের অভিপ্রায়। কন্যাকে জড়িয়ে ধরতে চায় না, দংশনই করতে চায়। পিঙলার চোখে। বিজয়িনীর দৃষ্টি—তাতে উন্মাদ আনন্দ ফুটে উঠেছে। সে চিৎকার করে উঠল—আয়। পড়ল নাগ। ছোবল দিয়ে। অসমসাহসিনীর দুই হাত মুহূর্তে উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হল নাগটার ফণা লক্ষ্য করে। অব্যর্থ লক্ষ্যে লুফে নেওয়ার মত গ্রহণ করবে। কিন্তু তার আগেই সাঁতালীর বিষবেদেদের অগ্রগণ্য। ওস্তাদ ভাদু তার হাতের লাঠিটা দিয়ে আঘাত করেছে সাপটার ঠিক গলার নিচে; সে আঘাত এমনি ক্ষিপ্র, এমনি নিপুণ, এমনি অব্যৰ্থ যে সাপটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ল পিঙলার পাশে মাটির উপর। শুধু তাই নয়, ধরাশায়ী সাপটার গলার উপর কঠিন চাপে চেপে বসল ভাদুর সেই লাঠি।

বেদেরা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।

সুরধুনী পিঙলার স্থলিত আঁচলখানা তুলে তার অঙ্গ আবৃত করে দিয়ে বাঁকা দৃষ্টিতে গঙ্গারামের দিকে তাকিয়ে বললে-পাপী! পাপী কুথাকার।

গঙ্গারাম শিরবেদে, সাঁতালীর একচ্ছত্র মালিক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; তার ভয় নাই। সে ঘাড়। নাড়তে নাড়তে চলে গেল।
পিঙলা শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছিল তার কাহিনী বলতে বলতে। একটা ছেদ পেয়ে সে থামলে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আঃ মা—

শিবরাম বলেন-কুপিত বায়ু ঝড়ের রূপে উড়িয়ে নিয়ে চলে মেঘের পুঞ্জ, ভেঙে দিয়ে যায় বনস্পতির মাথা। তারপর এক সময় আসে তার প্রতিক্রিয়া। সে শ্রান্ত হয়ে যেন মন্থর হয়ে পড়ে। শীতল হয়ে আসে। পিঙলারও সে সময়ের অবস্থা ঠিক তাই হয়েছিল। অবসাদে সে ভেঙে পড়ল। যেন। উত্তেজনার উপাদান তার ফুরিয়ে গিয়েছে।

একটু থেমে সেদিনের স্মৃতিপটের দিকে তাকিয়ে ভাল করে স্মরণ করে শিবরাম বলেন– বিশ্বপ্রকৃতিও যেন সেদিন পিঙলার কাহিনীর সঙ্গে বিচিত্রভাবে সাম্য রেখে অপরূপ পটভূমি রচনা। করেছিল।

ঊর্ধ্বাকাশে যে ঝড় চলছিল, সে ঝড় হিজল বিল পার হয়ে চলে গেল। গঙ্গার পশ্চিম কূলকে পিছনে রেখে গঙ্গা পার হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেল। কালো মেঘের পুঞ্জ আবর্তিত হতে হতে প্রকৃতির কোন বিচিত্র প্রক্রিয়ায়—টুকরো টুকরো হয়ে দূরে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল ছিন্নপক্ষ জটায়ুর মত; কালো মেঘস্তরেরও পিছনে ছিল একটা সাদা মেঘের স্তর, তারই বুকে ভাসতে লাগল; এদিকে পশ্চিম দিগন্ত থেকে আবার একটা মেঘস্তর উঠে এগিয়ে আসছে। এ স্তরটা শূন্যমণ্ডলের নিচে নেমে এসেছে। ধূসর মন্থর একটি মেঘস্তর পশ্চিম থেকে আসছে, বিস্তীর্ণ হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণে যেন জটায়ু দম্পতির কোনো অজ্ঞাতনামা সহোদর। সে তার বিশাল পক্ষ দুখানিকে। উত্তর এবং দক্ষিণে দিগন্ত পর্যন্ত আবৃত করে বেদনার্ত বুকে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলেছে—ছিন্নপক্ষ জটায়ুর সন্ধানে। পাখার বাতাসে বাজছে তার শোকার্ত স্নায়ুমণ্ডলীর ধ্বনি, তার স্পর্শে রয়েছে শোকার্ত হৃদয়ের সরল আভাস, সজল শীতল মন্থর বাতাসে ভেসে আসছে ধূসর মেঘস্তরখানি। অতি মৃদু রিমিঝিমি বর্ষণ করে আসছে। কুয়াশার মত সে বৃষ্টি।

হিজলের সর্বত্র এই পরিবর্তিত রূপের প্রতিফলন জেগে উঠল। কিছুকাল পূর্বের ঝড়ের রুদ্রতাওবে জলে স্থলে ঝাউবনে ঘাসবনে মেশানো এই বিচিত্ৰ ভূমিখণ্ডের সর্বাঙ্গে—অকাল রাত্রির আসন্নতার মত যে কুটিল কৃষ্ণ ছায়া নেমেছিল, যে প্রচণ্ড আক্ষেপ জেগেছিল—ক্ষণিকে তার রূপান্তর হয়ে গেল।

শিবরামের মনে পড়ল মনসার ব্ৰতকথা।

কাহিনীর বণিক-কন্যা দক্ষিণ দুয়ার খুলে আতঙ্কে বিষনিশ্বাসে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল; সে দেখল বিষহরির বিষম্ভরী রূপ–নাগাসনা, নাগভূষণা, বিষপানে কুটিলনো নাগকেশী—রুদ্ররূপ–বিষসমুদ্র উথলিত হচ্ছে। পড়ল সে ঢলে। মুহূর্তে মায়ের রূপের পরিবর্তন হল। দেবী এলেন শান্ত রূপে, সস্নেহ স্পৰ্শ বুলিয়ে জুড়িয়ে দিলেন বিষ বাতাসের জ্বালা।

হিজলবিলের জলে ঢেউ উঠেছিল। তার রঙ হয়েছিল বিষের মত নীল।

এখন সেখানে ঢেউ থেমে গিয়েছে, থরথর করে কাঁপছে, রঙ হয়েছে ধূসর, যেন কোনো তপস্বিনীর তৈলহীন রুক্ষ কোঁকড়ানো একরাশি চুলতার শোভায় উদাস বিষণ্ণতা। ঝাউবনের ঘাসবনের মাথাগুলি আর প্রবল আন্দোলনে আছড়ে পড়ছে না, স্থির হয়েছে, কাঁপছে, মন্থর শেশো শব্দ উঠছে বিষ দীর্ঘনিশ্বাসের মত।

পিঙলা ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়ল ঘাসবনের উপর। মুখে তার ফিনফিনে বৃষ্টির ধারা ঝরে। পড়ছিল। সে চোখ বুজে বললে—আঃ, দেহখানা জুড়াল গ।

সত্যই দেহ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। জ্যৈষ্ঠের সারাদিনের প্রচণ্ড উত্তাপের পর এই ঠাণ্ডা বাতাসে ও ফিনফিনে বৃষ্টিতে শিবরামও আরামে চোখ বুজলেন। এ বর্ষণসিঞ্চনে যেন একটি মাধুরীর স্পর্শ আছে।

—এইবারে দুখিনী বহিনের, মন্দভাগিনী বেদের কন্যের, গোপন দুখটা শুন আমার ধরম ভাই; শবলাদিদি গঙ্গার কূলে দাঁড়ায়ে বিষহরিরে সাক্ষী রেখ্যা তুমার সাথে ভাইবহিন সম্বন্ধ পাতালছে। আমাকে বল্যা গেছে, যে-দুখের কথা কারুকে বুলতে আরবি, সে কথা বুলিস ওই ভাইকে। বুকের আঙার বুকে রাখিলি বুক পোড়ায়, অন্যেরে দিলি পরে ওই আঙার তুর ঘরে গিয়া তুকেই পুড়ায়ে মারে। ই আঙার দিবার এক ঠাঁই হল বিষহরির চরণ। তা বিষহরি নিদয়া হছেন, দেখা যায় না। আর ঠাঁই! মই অ্যানেক ছুঁড়ে ছুঁড়ে এই ঠাঁই পেয়েছি রে পিঙলা, ওই ধরম-ভাইয়ের ঠাঁই;এই আঙার তারে দিস, তুর পুরানটা জুড়াবে, কিন্তুক অনিষ্ট হবে নাই। আমার বুকের আঙার তুমি লাও, ধর ভাই।

পিঙলার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। চোখের কোণে কোণে জল টলমল করে উঠল। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। আবেগে সে আর বলতে পারছিল না।

অপেক্ষা করে রইলেন শিবরাম। অন্তরে অন্তরে শিউরে উঠলেন। কি বলবে পিঙলা? সে কি তবে দেহ-প্রবৃত্তির তাড়নায় নাগিনী কন্যের ধর্ম বিসর্জন দিলে—?

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, শবলা তাকে একদিন বলেছিল-নাগিনী কন্যাদের প্রবৃত্তি যখন উগ্র হয়ে ওঠে, তখন তারা উন্মাদিনীর মত নিশীথ রাত্রে ঘুরে বেড়ায় হিজলের ঘাসবনে। কখনও বাঘের হাতে জীবন যায়, আর কখনও হাঙরমুখীর খালে শিকার প্রতীক্ষণ কুমির অতর্কিতে পায়ে ধরে টেনে নেয়; নিশীথ রাত্রে হিজলের কূলে শুধু একটা আর্ত চিৎকার জেগে ওঠে। পরের দিন থেকে নাগিনী কন্যাদের সন্ধান মেলে না। আবার কোনো নাগিনী কন্যা শোনে বশির সুর। দূরে হিজলের মাঠে চাষীরা কুঁড়ে বেঁধে থাকে, মহিষগরুর বাথান দিয়ে থাকে শেখেরা ঘোষেরা, তারাই বাঁশি বাজায়। সে বাঁশি শুনে নাগিনী কন্যা এগিয়ে যায়, সুরের পথ ধরে।

শবলা বলেছিল—তার থেক্যা বড় সৰ্ব্বনাশ আর য় না ধরম-ভাই। সেই হইল মাবিষহরির অভিশাপ! তাতে হয় পরানটা যায়—লয় ধরম যায়, জাতি যায়, কুল যায়।

পিঙলা আত্মসংবরণ করে চোখের জল মুছলে, তারপর অতি মৃদুস্বরে বললে; এখানে এই জনহীন হিজল বিলের বিষহরির ঘাটে স্বর মৃদু করবার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু পিঙলার বোধহয় কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, গাছপাতাকেও ভয়, তাই বোধহয় মৃদুস্বরে বললে—কিন্তুক ভাই, এইবার যে আমার বুকে চাপা ফুল ফুটল।

চমকে উঠলেন শিবরাম।

পিঙলা বললে—আমার ঘরে, রাত্রি দুপহরে, চঁপার ফুলের বাস ওঠে। ঘরটা যেন ভরা যায় ভাই। মুই থরথর করা কাঁপতে থাকি। পেথম যেদিন ঘানটা নাকে ঢুকল ভাই, সেদিন মুই যেন পাগল হয়্যা গেলছিলম। ঠিক তখুন রাত দুপহর। হিজলের মাঠে শিয়ালগুলান ডেক্যা উঠিল, সাঁতালীর পশ্চিম দিকে রাঢ়ের পথটার দুধারের তালগাছের মাথায় মাথায় পেঁচা ডেকে ই গাছ থেক্যা উ গাছে গিয়া বসিল। সাঁতালীর উত্তরে হুইখানে আছে বাদুড়ঝুলির বটগাছ, শ দরুনে বাদুড় সেথা দিনরাত্রি ঝুলে, চা-চঁ্যা রবে চিল্লায়, সেগুলান জোরে চোচায়ে রব তুল্যা, একবার পাখা ঝটপট কর্যা আকাশে পাক খেলে। ঘরের মধ্যে ঝাপিতে সাপগুলান বারকয়েক ফুঁসায়ে উঠল। মুই পোড়াকপালী, আমার চোখে ঘুম বড় আসে না ধরম-ভাই। সেই যে বাবুদের বাড়ি থেক্যা ফিরলম—মোর মধ্যে কালনাগিনীর জাগরণ হইল, সেই থেক্যাই ঘুম আমার নাই। তারপরেতে ঠাকুর এল, বল্যা গেল—আমার খালাস নিয়া আসবেক; তখন থেক্যা বিদায় দিছি ঘুমেরে; ঘরে পড়া থাকি, পহর গুনি, কান পেত্যা শুনি কত দূরে উঠিছে পায়ের ধ্বনি। সেদিনে আপনমনে জেগ্যা জেগাই ওই ভাবনা ভাবছিলম। দুপহর এল, মনে মনে পেনাম করলম বিষহরিরে। এমন সময়, ধরমভাই

আবার কাঁপতে লাগল পিঙলার ঠোঁট। সকরুণ সজল দৃষ্টিতে সে শিবরামের দিকে তাকিয়ে রইল। তেজস্বিনী মেয়েটি যেন তেজশক্তি সব হারিয়ে ফেলে একান্ত অসহায়ভাবে শিবরামের কাছে আশ্বাস ভিক্ষা করছে—সাহস প্রার্থনা করছে।

ঠিক সেই মধ্যরাত্রির লগ্নটিতে নাগিনী কন্যা যদি জেগে থাকে, তবে তাকে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে মনে মনে বিষহরিকে ডাকতে হয়। ওই লগ্ন নাগিনী কন্যার বুকে নিশির নেশা জাগিয়ে তোলে। কুহকমায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে—এই বেদেদের বিশ্বাস।

খাঁচায় বন্দি বাঘকে দেখেছ মধ্যরাত্রে? এই লগ্নে? রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে নিশিঘোষণা বেজে ওঠে দিকে দিকে, খাঁচার ঘুমন্ত বাঘ চকিত হয়ে জেগে ওঠে, ঘাড় তুলে রাত্রির অন্ধকারের দিকে তাকায়, আকাশের দিকে তাকায়, সে দৃষ্টি স্থির অথচ উত্তেজনায় অধীর। মুহূৰ্তে মুহূর্তে চোখের তারা বিস্ফারিত হয়, আবার সঙ্কুচিত হয়।

ঠিক তেমনি নিশির মায়ার উত্তেজনায় নাগিনী কন্যাও আত্মহারা হয়। সাঁতালীর বিষবেদেদের কুলশাসনের বিধিবিধানে বারবার করে কন্যাকে বলেছে—এই লগ্নে, হে কন্যা, তুমি সাবধান। যদি জেগে থাক, তবে মাটি অ্যাঁকড়ে পড়ে থাকবে, মনে মনে মাকে স্মরণ করবে।—কদাচ উঠো না, কদাচ উঠো না।

রাত্রির দ্বিপ্রহর এল সেদিন। রোজই আসে। ঘুম তো নাই পিঙলার চোখে। অনন্ত ভাবনা তার মনে। সে ভাবে-নাগিনী কন্যার ঋণের কথা, সে হিসাব করে জন্ম জন্ম ধরে কত নাগিনী কন্যা সাঁতালীর বেদেকুলে জন্ম নিয়ে কত পূজা বিষহরিকে দিয়েছে, আজন্ম পতি-পুত্র ঘর-সংসারে বঞ্চিত থেকে ব্ৰত তপস্যা করে বেদেকুলের মায়াবিনী কুহকিনী কন্যা-বধূদের সকল স্থলনের পাপ ধুয়ে মুছে দিয়েছে। বেদেকুলের মান-মর্যাদা রেখেছে। তবু কি শোধ হয় নাই দেনা?

শোধের সংবাদ নিয়ে আসবে নাগু ঠাকুর। শোধ না হলে তো তার ফিরবার পথ নাই।

কাহিনীতে আছে নদীর জলে ভেসে যায় সোনার চাপা ফুল। রাজা পণ করেছেন, ওই চাপার গাছ তাকে যে এনে দেবে তাকেই দেবেন তার নন্দিনীকে। রাজনন্দিনীকে রেখেছেন সাতমহলার শেষ মহলায়, মহলায় মহলায় পাহারা দেয় হাজার প্রহরী। রাজপুত্ররা আসেতারা কন্যাকে দেখে, তারপর চলে যায় তারা নদীর কূলে কূলে; কোথায় কোন কূলে আছে সোনার চাপার গাছ; চলে চলে—তারপর তারা হারিয়ে যায়, পিছনের পথ মুছে যায়। সোনার চাপার গাছ যে পাবে খুঁজে, সে-ই পাবে ফিরবার পথ। পিঙলার কাহিনীও যে ঠিক সেই রকম।

ঠাকুর কি ফিরবার পথ পাবে?

এমন সময় এল ওই মধ্যরাত্রির ক্ষণ। পিঙলা চকিত হয়ে উপুড় হয়ে শুল। মনে মনে স্মরণ করলে বিষহরিকে। সঙ্গে সঙ্গে বললে—মুক্তি দাও মা, দেনা শোধ কর জননী।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সে।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। এ কি? এ কিসের গন্ধ?

দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে একটি মিষ্ট মধুর গন্ধে তার বুক ভরে গেল। শ্বাস আর বিষণ্ণ আক্ষেপে সে ফেলতে পারলে না; শ্বাসরুদ্ধ করে সে চমকে মাথা তুললে। ফুলের গন্ধ! চাপার গন্ধ! কোথা থেকে এল? নিশ্বাস ফেলে সে আবার শ্বাস গ্রহণ করলে। আবার মধুর গন্ধে বুক ভরে গেল।

ধড়মড় করে সে উঠে বসল।

কোথা থেকে আসছে এ গন্ধ? তবে কি? সে বার বার এঁকে দেখলে নিজের দেহ। গন্ধ আসছে, কিন্তু সে কি তার দেহ থেকে? না তো!

সে তাড়াতাড়ি আলো জ্বাললে। চকমকি ঠুকে খড়ের নুটিতে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বলে নিমফল-পেষা তেলের পিদিম জ্বেলে চারিদিকে চেয়ে দেখলে। ধোঁয়ার গন্ধে ভরে উঠেছে খুপরি ঘরখানা, কিন্তু তার মধ্যেও উঠছে সেই মিষ্ট সুবাস।

কোথায় ফুটল চাপার ফুল?

সাঁতালীর কোথাও তো নাই চাপার গাছ। তবে?

তাড়াতাড়ি সে একটা ঝাপির উপর ঝুঁকে তঁকে দেখলে। ঝাঁপিটায় আছে একটা সাপিনী। কাঁপিতে বন্দি সাপিনীর অঙ্গে বাস বড় একটা ওঠে না; নাগিনীর মিলনের কালও এটা নয়; সে কাল আরম্ভ হবে বর্ষার শুরুতে; অম্বুবাচিতে মা-বসুমতী হবেন পুষ্পবতী, কামরূপে পাহাড়ের মাথায় মা-কামাখ্যা এলোচুলে বসবেন, আকাশ ঘিরে আসবে সাত সমুদ্রের জল নিয়ে সম্বর পুষ্কর মেঘের দল; মাকে স্নান করাবে। নদীতে নদীতে তার ঢেউ উঠবে। কেয়া গাছের কচি পাতার ঘেরের মধ্যে ফুলের কুঁড়ির মুখ উঁকি মারবে। সাপিনীর অঙ্গে অঙ্গে জাগবে আনন্দ। সে আনন্দ সুবাস হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। চাপার গন্ধ! নাগকুল উল্লসিত হয়ে উঠবে।

সে কালও তো এ নয়। এ তে সবে চৈত্রের শেষ

গাজনের ঢাক বাজছে রাঢ়ের গায়ে গায়ে। শেষরাতে আজও বাতাস হিমেল হয়ে ওঠে; নাগ-নাগিনীর অঙ্গের জরার জড়তা আজও কাটে নাই। রাত্রির শেষ প্রহরে আজও তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শিব উঠবেন গাজনে, তার অঙ্গের বিভূতির পরশ পেয়ে নাগ-নাগিনীর নবকলেবর হবে। নূতন বছর পড়বে; বৈশাখ আসবে, সাপ-সাপিনীর হবে নবযৌবন।

তবু সে ঝুঁকে পড়ে শুকলে সাপিনীর ঝাঁপিটা।

কোথায়? কই?—সেই চিরকেলে সাপের কটু গন্ধ উঠছে।

তবে এ গন্ধ কোথা থেকে আসছে? প্রদীপের সলতে উসকে দিয়ে আলোর শিখাকে উজ্জ্বলতর করে তুলে শঙ্কাতুর মনে দৃষ্টি বিস্ফারিত করে বসে রইল সে।

হঠাৎ একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। আজই সন্ধ্যায় গঙ্গারাম কথাটা তাকে বলেছিল। তখন পিঙলা মুখ বেঁকিয়ে ঘেন্নার দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, গঙ্গারাম বলেছিল—দু দিন ছিলম না, ইয়ার মধ্যে এ কি হল?

দুদিন আগে গঙ্গারাম গিয়েছিল শহরে। কামাখ্যা মায়ের ডাকিনীর কাছে গঙ্গারাম শুধু জাদুবিদ্যা মোহিনীবিদ্যা বাণবিদ্যাই শিখে আসে নি, চিকিৎসাবিদ্যাও জানে সে। বেদেদের চিকিৎসাবিদ্যা আছে, সে বিদ্যা জানে ভাদু নটবর নবীন। সাঁতালীর আশপাশের গাছ-গাছড়া নিয়ে সে চিকিৎসা। জন্তু-জানোয়ার তেল-হাড় নিয়ে সে চিকিৎসা। নাগিনী কন্যার কাছে আছে। জড়ি আর বিষহরির প্রসাদ নির্মাল্য, তাই দিয়ে কবচ মাদুলি নিয়ে সে চিকিৎসা। গঙ্গারামের চিকিৎসা অন্য রকম। ওষুধের মশলা সংগ্রহ করে আনে সে শহর-বাজারের দোকান থেকে। ধন্বন্তরিভাইদের কবিরাজি ওষুধের মত পচন বড়ি দেয়। বিশেষ করে জ্বর-জ্বালায় গঙ্গারামের ওষুধ খুব খাটে। সেই মশলা আনতে সে মধ্যে-মাঝে শহরে যায়। নিয়ে যায় শুশুকের তেল, বাঘের চর্বি, বাঘের পজর নখ, কুমিরের দাত, শজারুর কাটা আর নিয়ে যায় মা-মনসার অব্যর্থ ঘায়ের প্রলেপ মলম। নিয়ে আসে ওষুধের মশলা আর সঙ্গে চুড়ি, ফিতে, মাদুলীর খোল, পুঁতির মালা, সূচ-সুতো, বড়শি, ছুরি, কাটারি, কাঁকুই—হরেক রকম জিনিস। গঙ্গারাম শিরবেদে সাঁতালী গাঁয়ে নতুন নিয়ম প্রবর্তন করেছে—শিরবেদে হয়ে বেনেী বৃত্তি নিয়েছে।

ওই ব্যবসায়ে সে দুদিন আগে গিয়েছিল শহরে। ফিরেছে আজই সন্ধ্যায়। তখন মায়ের আটনের সামনে বেদেরা এসে জমেছে। হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাদু বাজাচ্ছে চিমটে, নটবর বাজাচ্ছে বিষম-ঢাকি;পিঙলা করছিল আরতি। গঙ্গারাম ফিরেই ধুলোপায়ে মায়ের থানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের আরতি শেষ করে সেই প্রদীপ নিয়ে বেদেদের দিকে ফিরিয়ে পিঙলা বার কয়েক ঘুরিয়ে নামিয়ে দিলে। বেদেরা একে একে সেই প্রদীপের শিখার তাপে হাতের তালু তাতিয়ে নিয়ে কপালে স্পর্শ নেবে। গঙ্গারামের প্রথম অধিকার। সে এসে যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল, ভুরু কুঁচকে বার দুয়েক ঘ্রাণ নেওয়ার মত ঘনঘন শ্বাস টেনে উঃ শব্দ করেছিল, তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেছিল—এ কি? কিসের বাস উঠছে লাগছে যেন?

পিঙলার ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়েছিল এই কুটিল লোকটির প্রতি অবজ্ঞায়। চাপা রাগে নাকের ডগাটা ফুলে উঠেছিল, চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল ঘেন্না; সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তাকে কিছু বলতে হয় নাই; গঙ্গারামের পর অধিকার ভাদুর, সে এসে তাকে ঠেলা দিয়ে বলেছিল–বাস উঠছে তুর নাসায়। বাস উঠছে! আছিস শহর থেক্যা, পাকীমদ খেয়েছি তারই বাস তুর নাসাতে বাসা বেঁধে রইছে। লে, সর। ঢং করি না। পিদিম নিভিয়ে যাবে। দাঁড়ায়ে আছে গোটা পাড়ার মানুষ।

গঙ্গারাম ভাদুর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে ফিরে চেয়ে প্রদীপের তাপ কপালে ঠেকিয়ে সরে গিয়েছিল। তার পর পিঙলা লক্ষ্য করেছিল—সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত শ্বাস টেনে কিসের গন্ধ নিচ্ছে।

যাবার সময় পিঙলার দিকে তাকিয়ে একটু যেন ঘাড় দুলিয়ে কিছু বলে গিয়েছে। শাসন, সন্দেহ, তার সঙ্গে যেন আরও কিছু ছিল।

পিঙলার ঠোঁট দুটি আবার বেঁকে গিয়েছিল।

এই নিশীথ রাত্রে এই ক্ষণটিতে হঠাৎ সেই কথা পিঙলার মনে পড়ে গেল। তবে কি তখন গঙ্গারাম এই গন্ধের আভাস পেয়েছিল? গঙ্গারাম পাপী, সে ভ্ৰষ্ট, সে ব্যভিচারী। জটিল তার চরিত্র, কুটিল তার প্রকৃতি। সে ডোমন-করেত। বেদেপাড়ায় সে অবাধে চালিয়ে চলেছে তার পাপ। কিন্তু এক ভাদু ছাড়া বেদেদের আর কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস করে না। আর পারে পিঙলা। আজ দীর্ঘ দশ বছর সে তার সঙ্গে লড়াই করে আসছে। কিন্তু এতদিন কিছু করতে পারে নাই। এইবার তার জাগরণের পরে আশা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বেদেপাড়াতেও খানিকটা সাহস দেখা দিয়েছে। তার জাগরণের ছোঁয়ায় তারাও যেন জেগেছে। ভাদুর সঙ্গে তারা দু-তিনবার গঙ্গারামের কথার উপর কথা বলেছে। কিন্তু গঙ্গারামের বাঁধন বড় জটিল। বেদেপাড়াকে সে শুধু শাসনের দড়িতে বাধে নাই, তার সঙ্গে বেঁধেছে পয়সার দড়িতে কিনেছে ধারের কড়িতে। গঙ্গারাম টাকা-পয়সা ধার দেয়। সুদ আদায় করে। মহাদেব শিরবেদেকে পিঙলার মনে আছে। সে কথায় কথায় টুঁটি টিপে ধরত। গঙ্গারাম তা ধরে না। গঙ্গারাম মানুষের ঘাড় নুইয়ে ধারের পাথর চাপিয়ে দেয়। মানুষ মাটির দিক ছাড়া মুখের দিকে চোখ তুলতে পারে না। এই সুযোগে গঙ্গারাম বেদেদের ঘরে ঘরে অবাধে চালিয়ে যায় তার ব্যভিচার। এ আচার বেদেদের মধ্যে চিরকাল আছে। বেদের কন্যে অবিশ্বাসিনী, বেদের কন্যে মিথ্যাবাদিনী, বেদের কন্যে পোড়াকপালী, পোড়ারমুখী, তার রঙ কালো; কিন্তু তারও উপর সে কালামুখী। বেদের কন্যে কুহকিনী। বেদের কন্যের আচার মন্দ; সে বিচারভ্রষ্টা। বেদের পুরুষও তাই। তবু এমন ছিল না কোনো কালে। সাঁতালীর পাপের বোঝা সকল পাপ চিরকাল নাগিনী কন্যের দুঃখের দহনে। পুড়ে ছাই হয়েছে; তার চোখের জলে সকল কালি ধুয়ে গিয়েছে। এবার গঙ্গারামের পাপের বোঝা হয়ে উঠেছে পাহাড়, তাই তার জীবনে এত জ্বালা। এত জ্বালাতেও কিন্তু সে পাপের পাহাড় পুড়ে শেষ হচ্ছে না। তাই সময় সময় পাগলের মত হয়ে সে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বুকের নাগিনী তার মুখ দিয়ে বলে—বিচার কর মা, বিচার কর। মুক্তি দাও। বলে—আমার মুক্তি হোক বা না হোক, ওই পাপীকে শেষ কর। কত দিন মনে মনে সংকল্প করেছে—শেষ পর্যন্ত নিজে সে মরবে, কিন্তু ওই পাপীকে সে শেষ করবে।

সেই পাপী গঙ্গারাম, সে কি সন্ধান পেয়েছিল এই গন্ধের?

পাপী হলেও সে শিরবেদে। শিরবেদের আসনের গুণে পেয়েছিল হয়ত। ভোজরাজার আসন। ছিল, সে আসনে যে বসত সে-ই তখন হয়ে উঠত রাজার মত গুণী। তার উপর গঙ্গারাম ডাকিনীবিদ্যা জানে।

সে জেনেছে, সে বুঝেছে, সে এ গন্ধের আভাস পেয়েছে সব চেয়ে আগে। তার অঙ্গে গন্ধের সন্ধান সে নিজেও পায় নাই—শিরবেদেই পেয়েছে তার আসনের গুণে।

সমস্ত রাত্রি সে আলো জ্বলে বসে রইল। সকালবেলা আবার একবার তনুতন্ন করে খুঁজলে ঘর। কিসের গন্ধ! কোথা থেকে আসছে গন্ধ! গন্ধ রয়েছে ঘরে, কিন্তু কোথা থেকে উঠছে বা আসছে বুঝতে পারলে না। ঘর বন্ধ করে ছুটে এসে পড়ল বিলের জলে। সর্বাঙ্গ ধুয়ে সে ঘরে ফিরল। ঘরে তখনও গন্ধ উঠছে। তবে ক্ষীণ হয়ে এসেছে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঘরের দাওয়ার উপর শুয়ে অঙ্গ এলিয়ে দিলে। ঘুমিয়ে পড়ল।

আবার।

পরদিন মধ্যরাত্রিতে আবার উঠল গন্ধ।

পিঙলা ধড়মড় করে উঠে বসল। আলো জ্বাললে। মদির গন্ধে ঘর ভরে উঠেছে। তার নিশ্বাস যেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। চাপা ফুল কোথায় ফুটেছে? তার বুকে? নইলে এই লগ্নে কেন উঠছে সে গন্ধ?

উন্মাদিনীর মত সে নিজেই নিজের দেহগন্ধের শ্বাস টানতে লাগল। কিছু বুঝতে পারলে না, কিন্তু আছাড় খেয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে ডাকলে দেবতাকে।

আমার পাপ তুমি হরণ কর জননী, কন্যের শরম তুমি ঢাক মা। ঢেক্যা দাও! মুখ রাখ।

—মনে মনে শুধু জনীরেই ডাকি নাই ধন্বন্তরিভাই। তারেও ডাকি।

শীর্ণ মুখ তার চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল। শিবরামের চোখেও জল এসেছিল। বায়ুরোগপীড়িতা মেয়েটির কষ্টের যে অন্ত নাই, মস্তিষ্ক থেকে হৃদপিণ্ড পর্যন্ত অহরহ এই যন্ত্রণায় নিপীড়িত হচ্ছে, সে তথ্য ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্যটির অনুমান করতে ভুল হয় নাই এবং সে যন্ত্রণার পরিমাণও তিনি অনুভব করতে পারছিলেন। সেই অনুভূতির জন্যই চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠেছিল তার।

চোখের জলে অভিষিক্ত বেদনার্ত শীর্ণ মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। পিঙলা বললে—তারে ডাকি। গু ঠাকুরকে। সে যদি মুক্তির আদেশ আনে, তবে তো মুই বাঁচলাম। লইলে মরণ। আমার বুকে চাপ ফুল ফুটিছে, ই লাজের কথা দশে জানার আগে মুই মরব। কিন্তুক আগুন জ্বালায়ে যাব। আগুন জ্বালাব নিজের অঙ্গে, সেই আগুনে–

পিঙলার দু পাটি দাঁত সেই মেঘছায়াচ্ছন্ন অপরাহ্রে কালো মুখের মধ্যে বিদ্যুতের মত ঝলকে উঠল। শিবরাম আশঙ্কা করলেন, এইবার হয়ত চিৎকার করে উঠবে পিঙলা। কিন্তু তা করলে না সে। উদাস নেতে চেয়ে রইল সম্মুখের মেঘমেদুর আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ পর সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠল। বললে—দুখিনী বহিনের কথা শুনলা ভাই; যদি শুন, বহিন মরেছে তবে অভাগিনীর তরে কাঁদিও। আর যদি মুক্তি আসে–

একটি প্রসন্ন হাসিতে তার শীর্ণ মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বললে—দেখা করিব। তুমার সাথে দেখা করিব। মুক্তি আসিলে তোমার সাথে দেখা করিব। এখুন যাও ভাই, আপন লায়ে। মুই জলে নামিব।

এতক্ষণ অভিভূতের মতই বসে ছিলেন শিবরাম। চিকিৎসকের কৌতুহল আর ওই বন্য আদিম মানুষের একটি কন্যার অন্ধ-সংস্কারাচ্ছন্ন জীবন-কাহিনীর বৈচিত্র্য তাকে প্রায় মুগ্ধ করে রেখেছিল। শেষ হতেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি উঠলেন।

একদিন সে দিনের খুব দেরি নাই—পিঙলার মস্তিষ্কের কুপিত বায়ু হতভাগিনীকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলবে। সর্বত্র এবং অহরহ সে অনুভব করবে চাপার গন্ধ। শঙ্কিত ত্রস্ত হয়ে সে গভীর নির্জনে লুকিয়ে থাকবে। হয়ত ওই কল্পিত গন্ধ ঢাকবার জন্য দুর্গন্ধময় পঙ্ককে মাখবে চন্দনের মত আগ্ৰহে।

ভাই। অ ধন্বন্তরিভাই! পিছন থেকে ডাকলে পিঙলা। কণ্ঠস্বরে তার উত্তেজনা—উল্লাস।

ফিরলেন শিবরাম। দেখলেন, দ্রুতপদে প্রায় ছুটে চলেছে পিঙলা। পিঙলা আবার একবার মুহূর্তের জন্য মুখ ফিরিয়ে বললে—যাইও না। দাঁড়াও।

সে একটা ঘন জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। শিবরাম ভ্রূ কুঞ্চিত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি হল? মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তাকেও পাগল করে তুলবে?

কিছুক্ষণ পর পিঙলা আবার বেরিয়ে এল জঙ্গলের আড়াল থেকে। তার হাতে ঝুলছে একটি কালো সাপ-সত্যকারের লক্ষণযুক্ত কৃষ্ণসর্প।

–মিলেছে ভাই; মা-বিষহরি আমার কথা শুনিছেন। মিলিবে—আরও মিলিবে।

পিঙলা নামল জলে। শিবরাম ফিরলেন বেদেপাড়ায়।

বেদেপাড়ায় তখন কোলাহল উঠছে। গঙ্গায় শুশুক পেয়েছে দুটো। গঙ্গারাম তার হলদে। দাঁতগুলি বার করে বললে—যাত্যা তুমার ভাল কবিরাজ। শুশুকের ত্যাল, কালোসাপ অ্যানেক। মিলিল এক যাত্যায়।

বিদায়ের সময় পিঙলা ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে জল টলমল করছিল, ঠোঁট দুটি কাঁপছিল। তারই মধ্যে ফুটেছিল এক টুকরা হাসি।

শিবরাম বললেন–এবার কিন্তু আমার ওখানে যাবে তোমরা! যেমন যেতে গুরুর ওখানে। আমাকে বিষ দিয়ে আসবে।

গঙ্গারাম বললে—উ কন্যে তো আর যাবে নাই ধন্বন্তরি, উয়ার তো মুক্তি আসিছে। হুই। রাঢ়ের পথ দিয়া ঠাকুর গেলছে মুক্তি আনিতে। না, কি গ কন্যে?

পিঙলা লেজ-মাড়ানো সাপিনীর মত ঘুরে দাঁড়াল।

গঙ্গারাম কিন্তু চঞ্চল হল না, সে হেসে বললে আসিছে, সে আসিছে। চাপা ফুলের মালা গলায় পর্যা সে আসিছে। মুই তার বাস পাই যেন!

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল পিঙলা।

শিবরামের নৌকা মোড় ফিরল, হাঙরমুখীর খাল থেকে কুমিরখালার নালায় গিয়ে পড়ল। সোত এখানে অগভীর-সন্তৰ্পণে চলল নৌকা। শিবরাম ছইয়ের পরে বসে ছিলেন। পিঙলাকে আর দেখা গেল না। শিবরাম একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পিঙলার সঙ্গে আর দেখা হবে না। হয়ত মাস কয়েকের মধ্যেই রুদ্ধ কুপিত বায়ু কালবৈশাখীর ঝড়ের মত বেগে আলোড়ন তুলবে, জীবনটাকে তার বিপর্যস্ত করে দেবে। উন্মাদ পাগল হয়ে যাবে হতভাগিনী।

শিবরামের ভুল হয় নাই। পিঙলার সঙ্গে আর তার দেখা হয় নাই। কিন্তু আশ্চর্য, তার চিকিৎসকের অনুমান ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। পিঙলা পাগল হয় নাই।
–বেদের কন্যে সহজে পাগল হয় না। ধন্বন্তরিভাই; বেদের কন্যের পরান যখন ছাড়-ছাড় কর্যা উঠে, তখুন পরানটারেই ছেড়া দেয় হাসি মুখে বাসিফুলের মালার মতুন; লয়ত-বাধন ছিড়া আগুন জ্বালায়ে নাচিতে নাচিতে চলা যায়, যা পেলে পরান বাঁচে তার পথে। আপন মনেরে সে শুধায়—মন, কি চাস তা বল, খয়ে দেখ্যা ব। যদি ধরমে সুখ তো ধরম মাথায় লিয়া মর্যা যা; দে কুনও কালনাগের মুখে হাত বাড়ায়ে দে। দিয়া ভরপেট মদ খেয়ে ঘুমায়ে যা। আর তা যদি না চাস, যদি বাঁচিতে চাস, ধরমেকরমে-জাতিতে-কুলে-ঘরে গেরামে-পরানে আগুনের জ্বালা ধরায়ে দিয়া জ্বালায়ে দিয়া চল্যা যা তু আপন পথে।

মা-বিষহরির দয়ায় কন্যে পাগল হয় না ধন্বন্তরি!

কথাগুলি শিবরামকে বলেছিল পিঙলা নয়, শবলা। বিচিত্র বিস্ময়ের কথা বলার সঙ্গে শিবরামের আবার দেখা হয়েছিল, সে ফিরে এসেছিল।

শবলা বলেছিল—মুই গেছিলম। মহাদেব শিরবেদের সব্বনাশ করা-ঝাপ দিয়া পড়ছিলম গঙ্গার জলে। মরি মরব, বাঁচি বাঁচব, বাঁচিলে পিথিমীর মাটিতে পরানের ভালবাসা ঢেল্যা মাখায়ে তাতেই ঘর বেঁধ্যা, পরানের সাধ মিটার। ঘরের দুধারে দুই চাপার গাছ পঁত্যা, ফুলের মালা গলায় পর্যা, পরানের ধনে মালা পরায়ে—বাঁচব, পরান ভরায়ে বাঁচব। তা মরি নাই বেঁচেছি। দেখ চোখে দেখ, তোমার ধরম-বহিন—বেদের কন্যে, পোড়াকপালী, মন্দভাগিনী, কালামুখী, কুহকিনী নিলাজ শবলা তুমার ছামনে দাঁড়ায়ে—দুশমনের হাড়ে-গড়া দাঁতে ঝিকিমিকি করা হেসে সারা হতেছে। পেতনী নই, জ্যান্ত শবলা, দেখ, হুঁলি পর যদি চান। করতে হয় তো কাজ নাই; লইলে এই আমার হাতখানা পরশ করা দেখ, মই সেই শবলা। ধন্বন্তরি ভাই, বেদের কন্যের মনে বায়ু যখন ঝড় তুলে, তখন পরানের ঘরের দুয়ার ভেঙে ফেলায়।

হেসে ওঠে শবলা—খিলখিল করে হেসে ওঠে, যে হাসিতে মানুষের আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না, ভাবে-নির্লজ্জ ভাবে এমন হাসি কি করে মানুষ হাসে–সেই হাসি হেসে বলা বললে—কি কইলম? পরানের দুয়ার ভেঙে ফেলায়? আ আমার কপাল, বেদের জাতের পরানের ঘরে আবার দুয়ার! দুয়ার লয় গো—আগড়। কোনোমতে ঠেকা দিয়া পরানের দুখ ঢেক্যা রাখা। ঝড় উঠলে সে কি থাকে? উড়ে যায়। ভিতরের গুমোট বাইরে এসে আকাশে বাতাসে ছড়ায়ে যায়। বায়ুতে বেদের জন্যে পাগল হয় না ধন্বন্তরিভাই। মুই পাগল হই নাই। পিঙলাসেও পাগল হয় নাই। মা-বিষহরির দয়া।

মাস চারেক পর। সে তখন কার্তিকের প্রথম। শিবরামের সঙ্গে শবলার দেখা হল। তার নতুন ঠিকানায়, আয়ুর্বেদ-ভবনের সামনে এসে চিমটে বাজিয়ে হাঁক তুলে দাঁড়াল।

জয় মা-বিষহরি! জয় ধন্বন্তরি! তুমার হাতে পাথরের খলে বিষ অমৃতি হোক; ধনে পুত্যে লক্ষ্মীলাভ হোক। যজমানের কল্যাণ কর, ভোলা মহেশ্বর।

শিবরাম জানতেন, বেদেরা আবার তার এখানে আসবে। ঠিকানা তিনি দিয়ে এসেছিলেন। নারীকন্ঠের ডাক শুনে ভেবেছিলেন–পিঙলা। একটু বিস্মিত হয়েছিলেন, পিঙলা পাগল হয় নাই? কিসে আরোগ্য হল? দেবকৃপা? বিষহরির পূজারিণীর ব্যাধি বিষহরির কৃপায় প্রশমিত হয়েছে? রসায়নের ক্রিয়া যেমন দুই আর দুই যোগ করলে চারের মত স্থিরনিশ্চয়, দেহের অভ্যন্তরে ব্যাধির প্রক্রিয়াও তেমনি সুনিশ্চিত; ব্যাধিতে তাই ঔষধের রসায়ন প্রয়োগে দুই শক্তিতে বাধে দ্বন্দ্ব, কোথাও জেতে ঔষধ, কোথাও জেতে ব্যাধি। ঔষধ প্রয়োগ না করলে ব্যাধির গতিরোধ হয়। না, হবার নয়। এ সত্যকে তিনি মানেন। আয়ুর্বেদ-পঞ্চমবেদ, বেদ মিথ্যা নয়। কিন্তু তার পরেও কিছু আছে, অদৃশ্য শক্তি, দৈব-অভিপ্ৰায়, দেবতার কৃপা! দৈববলের তুল্য বল নাই। আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য হয়ে তিনি কি তা অবিশ্বাস করতে পারেন? রহস্য উপলব্ধির একটু প্রসন্ন হাসিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিস্ময় কেটে গেল। বেরিয়ে এলেন তিনি।

বেরিয়ে এসে কিন্তু তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

সামনে দাঁড়িয়ে পিঙলা নয়—শবলা।

পিঙলা দীর্ঘাঙ্গী; শবলা বালিকার মত মাথায় খাটো। আজও তাকে পনের-ষোল বছরের। মেয়েটির মত মনে হচ্ছে।

পিঙলা দীর্ঘকেশী; শবলার চুল কুঞ্চিত কোঁকড়ানো, একপিঠ খাটো চুল।

শবলার চোখ আয়ত ডাগর; পিঙলার চোখ ছোট নয়, কিন্তু টানা–লম্বা।

শবলাকে পিঙলা বলে ভুল হবার নয়।

শবলার পিছনে সাঁতালীর কজন অল্পবয়সী বেদে, বয়স্ক লোকের মধ্যে নটবর আর নবীন।

শিবরাম বুঝতে পারছিলেন না কিছু। শবলা?

শবলা ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে বললে—পেনাম ধন্বন্তরিভাই! তুমার আঙ্গিনায় আমাদের জনম জনম পেট ভরুক, আমাদের নাগের গরল তুমার খলে তুমার বিদ্যায় অমৃতি হোক, তুমার জয়জয়কার হোক।

প্ৰণাম সেরে উঠে নতজানু হয়ে বসেই বললে—আমাকে চিনতে লারছ ভাই?

এতক্ষণে বিস্ময় এবং স্নেহভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শিবরাম–শবলা!

–হাঁ গ। শবলা।

–আর সব? পিঙলা? গঙ্গারাম? ভাদু?—এরা? পিঙলা পাগল হয়ে গেছে, না?

শবলা তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শিবরাম বুঝলেন, শবলা প্রশ্ন করছে—জানলে কি। করে? শিবরাম বিষণ্ণ হেসে বললেন—তার দেহে বায়ুরোগের লক্ষণ আমি দেখে এসেছিলাম। মানসিক দৈহিক পীড়ন সে নিজেই অত্যন্ত কঠোর করে তুলেছিল। বায়ু কুপিত হয়ে উঠল স্বাভাবিক ভাবে। আমি বলেছিলাম তাকে ওষুধ ব্যবহার করতে। কিন্তু–

–বায়ুরোগ? বায়ুর কোপ!

হাসলে শবলা। বললে—বেদের কন্যে সহজে পাগল হয় না ধন্বন্তরিভাই। পিঙলার মনে যে ঝড় উঠিল ভাই, সে ঝড়ে পেলয় হয়ে গেল সাঁতালীতে। মন্বন্তর হয়ে গেছে সাঁতালীতে। নাগিনী কন্যের মুক্তি হলছে।

***

সে এক বিচিত্র বিস্ময়কর ঘটনা।

শবলা বলে গেল, শিবরাম শুনে গেলেন।

শুনতে শুনতে মনে পড়ল আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের কথা। একদিন তুলসীর পাতা তুলতে তুলতে বলেছিলেন, তুলসীর গন্ধ তৃপ্তিদায়ক কিন্তু পুষ্পগন্ধের মত মধুর নয়। স্বাদেও সে কটু। আমি যেন ওর মধ্যে অরণ্যের বন্য জীবনের গন্ধ পাই। তুলসীর জন্ম বৃত্তান্ত জান তো? সমুদ্রগর্ভে বা সমুদ্রতটে থাকত যে দৈত্যজাতি, তাদের রাজা জলন্ধর বা শঙ্খচূড়ের পত্নী তুলসীর তপস্যায় শঙ্খচূড় ছিল অজেয়। সে তো সব জান তোমরা। বিষ্ণু প্রতারণা করে তার তপস্যা ভঙ্গ করলেন; স্বামীর অমরত্ব লাভ ঘটল না, জলন্ধর বা শঙ্খচূড় নিহত হলেন। কিন্তু তুলসী মানবজীবনের মহাকল্যাণ নিয়ে, বিষ্ণুর মস্তকে স্থানলাভের অধিকার নিয়ে পুনর্জন্ম লাভে সার্থক হলেন। ওর গন্ধের মধ্যে আমি যেন সেই সমুদ্রতটের দৈত্যনারীর গাত্রগন্ধ পাই।

পিঙলাও কি কোনো নূতন বিষনাশিনী লতা হবে না নূতন জন্মে?

মহাদেব বেদের বুকে বিষের কাঁটা বসিয়ে দিয়ে প্রত্যুষে কুহক-আলোকের মত আবছা আলো আবছা-অন্ধকারের মধ্যে নগ্নিকা শবলা ভরা গঙ্গায় ঝাঁপ খেয়ে পড়েছিল। সে প্রতিশোধ নিয়েছিল। সে তখন প্রায় উন্মাদিনী।

বন্য আদিম নারীজীবন; চারিদিকে নিজেদের সমাজে অবাধ উদ্দাম জীবন-লীলা; তার প্রভাবে এবং স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে তার জীবনেও কামনা জেগেছিল, উদ্দাম হয়ে উঠেছিল—সে কথা শবলা গোপন করে নাই, অস্বীকার করে নাই। অনেক কাল পূর্বে প্রথম পরিচয়ে ভাই-বোন সম্বন্ধ পাতিয়েও সে পাতানো-ভাইয়ের কাছে চেয়েছিল অসামাজিক অবৈধ ভেষজ। সন্তানঘাতিনী হতেও সে প্রস্তুত ছিল, সে কথা বলতেও লজ্জা বোধ করে নাই। সে স্বীকার করেছিল, এক বীর্যবান বেদে তরুণকে সে ভালবেসেছিল, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে ভয় তার তখনও ছিল, পারে নাই স্পর্শ করতে। তাকে সুকৌশলে মহাদেব শিরবেদে সর্পাঘাত করিয়ে খুন করেছিল। তারপরই সে উন্মত্ত হয়ে উঠল।

শবলা বললে—আমার চন্ধু দুটা তুলি দিয়া ঢাকা ছিল ধরমভাই, খুল্যা ফেলালম মনের জ্বালায়—টেন্যা ছিড়া দিলম। চন্ধুতে আমার সর পড়িলরাতিরে দেখলম রাতি, দিনেরে দেখলম দিন। শিরবেদের স্বরূপ দেখ্যা পরানটায় আমার আগুন জ্বল্যা উঠল। হয়ত উয়ারও দোষ নাই; কি করিবে? বেদেকুলের দেবতা দুটি—একটি শিব, আরটি বিষহরি। শিব নিজে ধরমভেরষ্ট হয়্যা কুচনীপাড়ায় ঘুরে আপন কন্যের রূপে মোহিত হয়। বেদেকুলের কপাল।

শিবরাম ম্লান হেসে বলেনওদের দেবতা হওয়া সাধারণ কথা নয়। ওই শিবই পারেন। ওদের দেবতা হতে। ওদের পূজা নিতে দেবতাটি অম্লানমুখে গ্রহণ করেছেন উচ্ছঙ্খলতার অপবাদ, ধরেছেন বর্বর নেশাপরায়ণের রূপ, আরও অনেক কিছু। নিজেদের সমাজপতির শ্রেষ্ঠ শক্তিমানের জীবনের প্রতিফলনে প্রতিফলিত হয়েছেন রুদ্রদেবতা। বল্লাহীন জৈবিক জীবন স্বেচ্ছাচারে যা চায়, যা করে, তার দেবতাও তাই করেন। তারা বলে—দেবতা করে, তারই প্রভাব পড়ে মানুষের উপর। উপায় নাই, পরিত্রাণ নাই। প্রাণপণ চেষ্টা হয়ত করে, তবু অন্তরের অন্তস্থলে স্বেচ্ছাচারের কামনা কুটিলপথে আত্মপ্রকাশ করে।

মহাদেব শিরবেদের মধ্যেও সেই উদ্দাম ভ্ৰষ্ট জীবনের নিরুদ্ধ কামনা শবলা আবিষ্কার করেছিল। সে বলে—শিরবেদেদের উপরে শিবই চাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর সেই ভ্ৰষ্ট জীবনের কামনার অতৃপ্তি। সবসবসকল শিরবেদের মধ্যেই তা প্রকাশ পায়। বেদেরা তা ধরতে পারে না, দেখতে পায় না, দু-একজন পেলেও তারা চোখ ফিরিয়ে থাকে। মহাদেবের দৃষ্টিও নাকি পড়েছিল শবলার উপর। চোখে দেখা যেত না, শবলা তা অন্তরে অন্তরে অনুভব করেছিল।

কিন্তু শবলা নাগিনী কন্যা হলেও তার তো বিষহরির মত নাগভূষায় ভূষিতা, গরলনীল, বিসরী মূর্তি ধরবার শক্তি ছিল না। তাই সে সেদিন শেষরাত্রে অসহ্য জীবনজ্বালায় উন্মাদিনী হয়ে তার নৌকায় গিয়ে উঠেছিল জলচারিণী সরীসৃপের মত। জলে ভিজে কাপড়খানা ভারী হয়ে উঠেছিল, শব্দ তুলেছিল প্রতি পদক্ষেপে, গতিকেও ব্যাহত করছিল; তাই সে খুলে ফেলে দিলে কাপড়খানা। উন্মাদিনী গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে।

শিবরাম সে সব জানেন। শুনেছিলেন। বিস্মিত হন নাই। যে আগুন দেখেছিলেন তিনি। শবলার চোখে, তার যে উত্তাপ তিনি অনুভব করেছিলেন—তাতে শবলার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। সব শুনতে প্রস্তুত ছিলেন। শিবরাম বললেন—সে সব আমি জানি শবলা।

–জান? শবলা কঠিন দৃষ্টিতে শিবরামের দিকে তাকিয়ে বললে—কি জান তুমি? মুই তার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলম, সে আমারে দধিমুখী ভেবেছিল–

ঠোঁট বেঁকিয়ে বিচিত্ৰ হাসি হেসে সে বললে—এক কুড়ি চার বছর তখন আমার বয়স দধিমুখী দু কড়ি পারাল্ছে। আমাকে মনে ভেবেছিল দধিমুখী! মুই তখন সাঁতালী পাহাড়ের কালনাগিনীর পারা ভয়ঙ্করী। চোখে আগুন, নিশ্বাসে বিষ, ছামনে পড়ছে যে ঘাসবন সে ঝলসে কালো হয়ে যেতেছে। ওদিকে আকাশে ম্যাঘের ঘটাপটার মাঝখানে জেগা রইছেন বিষহরি চোখে তার পলক নাই, হাতে তাঁর দণ্ড; ইদিকে ঘুরছে হিন্তালের লাঠি হাতে চাঁদো বেনে—তার নয়নে নিদ্যে নাই, নাগিনীর অঙ্গে বিষের জ্বালা—বিষহরি তারে খাওয়াছেন বিষের পাথার। ঠিক তেমুনি আমার দশা তখুন। জ্ঞান নাই, গমি নাই, মরণে ভয় নাই, ধরমে ডর নাই, বুকে আমার সাতটা চিতার আগুন, সর্ব অঙ্গে আমার মরণ-জ্বরের তাপ। ভোর হতেছে তখন, চারিদিকে কুহকমায়ার আলো, সেই আলোতে সব দেখাইছিল ছায়াবাজির পারা। গাছ-পালা গাঁ-লা—আমার চোখে মুই তাও দেখি নাই; মুই দেখেছিলম অন্ধকার, সাত সমুদুরের পাথারের মত অন্ধকার থইথই করছিল আমার চোখের ছামনে। ঝাঁপ দিব হারায়ে যাব। আমার তখুন কারে ডর? কিসের ডর? মই যাব লরলে—উকে লিয়া যাব না? বুকের উপর নিজেরে দিলাম। ঢেল্যা। তাপরে দিলম পাপীর ঠিক কলিজার উপর কাটাটা বিধ্যা, লোহার সরু কটা, সুচের মত মুখ, ভিতরটা পাতাতে ভরা থাকে বিষ। সে বিষের ওষুদ নাই।

তারপর সে ছুটে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভদ্রের দুকূল-পাথার গঙ্গার বুকে। কলকল-কলকল শব্দ, প্রচণ্ড একটা টান—মধ্যে মধ্যে শ্বাসকষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল নইলে ভেসে চলেছে, যেন দোলায় দুলে চলেছে, আকাশ নাই, মৃত্তিকা নাই, চন্দ্ৰ নাই, সূর্য নাই, বাতাস নাই। শবলা বললে—বাস্, মনে হল হারায়ে গেলম। মুছে গেল সব। মনে হল খুব উঁচু ডাল থেক্যা পড়েছি, পড়ছি পড়ছি পড়ছি। তাপরেতে তাও নাই। কিন্তু হারায়ে গেলম না। চেতন হল—তখুন দেখি মুই একখানা লায়ের উপর শুয়ে রইছি।

—সে লা এক মুসলমান মাঝির লা। ইসলামী বেদে। বেদের কন্যেরে দেখেই সে চিনেছিল। চিহ্ন আমার ছিল। শবলা হাসলে।

শবলা শক্ত করে এলোখোপা বেঁধেছিল সেদিন। খোপায় খুঁজে নিতে হয়েছিল ওই বিষকাটা; আর এলোখোপার পাকানো চুলের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিল পদ্ম-গে খুরার একটা বাচ্চা। প্রয়োজন হলে ওকেও ব্যবহার করবার অভিপ্রায় ছিল।

—শুনলুম যখন ভাই, কি সে ইসলামী বেদে, তখুন হাসল ম। বুঝলম, মা আমাকে সাজা দিছেন। এই ভাদর মাসের দুকূল-পাথার গাঙের লালবরন জলের পরতে পরতে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তির পরশ; মহাপাপীর হাড়ের টুকরা কাকে চিলে ঠোঁটে কর্যা নিয়া যায়, যদি কোনো রকমে পড়ে মা-গঙ্গার জলে, তবে বরকের পথ থেক্যা স্বরগের রথ এস্যা তারে চাপায়ে ডক্কা বাজায়ে নিয়া যায়। আমার করমদোষ ছাড়া আর কি কইব? পাথার গাঙে কঁপায়ে পড়লম, বুক ফেট্যা গেল বাতাসের তরে, চেতনা হর্যা গেল, আর মুছা গেল, জুড়ায়ে গেল জ্বালা, ভুলে গেলম মনিষ্যি-জীবনের সকল কথা। বুলব কি ভাই, চুলে জড়ানো নাগের ছানা, যে নাগ ছটা মাস মাটির তলে থাকে, সে নাগটাও মরে গেছিল কিন্তু আমার মরণ হয় নাই। বুঝতে আমার বাকি রইল না, বিষহরি আমাকে ফিরায়ে দিছেন; জাতি নিয়া, কুল নিয়া ফিরায়ে পাঠায়ে দিছেন নরলোকে এক ইসলামী বেদের ঘরে দুঃখভোগের তরে।

কণ্ঠস্বর হঠাৎ দৃঢ় হয়ে উঠল শবলার। সে বললে, উপরের দিকে মুখ তুলে তাদের দেবী বষিহরিকে উদ্দেশ্য করে বললে কথাগুলি তা পাঠাও তুমি। একদিন তুমি নিজে বাদ করলা চাপদা বেনের সাথে, সে বাদে জীবন দিলেক নাগেরা; তুমি রইল্যা নিজের আটনে বস্যা, কালনাগিনীরে পাঠাইলা সোনার লখিন্দরকে দংশন করতে। কি পাপ—কি দোষ করেছিল লখিন্দর-বেহুলা? ছলতে হল বিষবেদের প্রেধানকে। তুমি পেলে পূজা, কালনাগিনী বেদেকুলে জনম নিয়া জনমে জনমে–তিলসুনা খাঁটিছে। আমাকে ফিরা পাঠাইলা নরলোকে দুঃখ ভোগের তরে বিধর্মীর ঘরে। ভাল। দুখের বদলে সুখই করিব মুই। যাক ধরম। স্বামী নিব, ঘর গড়িব, দুয়ার গড়িব, হাসিব নাচিব গাহিব, পুত্যকন্যায় সাজাইব আমার সংসার, তাপরেতে মরিব, তখুনি নরকে যাই যাইব। যমদণ্ডের ঘায়ে যদি আঙুলপেমান-পরান-পুতুলি আছাড়িপিছাড়ি করে, তবু তুমারে ডাকিব না।

–কিন্তু তা লারলম। দিলে না বিষহরি, দিলে না ওই ইসলামী বেদে। ওই বেদেরেই মুই পতি বলা বরণ করিছিলম। ইসলামী হলি কি হয়—দেবতা তো বেদের বিষহরি! তারে তো সি ভুলে নাই। সাঁতালীর বেদেকুলের যারা সাঁতালী থেক্য গাঙুলের জলে না ভাসায়ে আসিবার পথে সঙ্গ ছাড়িছিল, থেক্যা গেছিল পদ্মাবতীর চরে—তারাই তো হইছে ইসলামী বেদে। ভুলিবে কি কর্যা? সে কইল-বেদের কন্যে, ঘর বাঁধিবার আগে মায়েরে পেসন্ন কর। লইলে মায়ের কোপে, চাঁদো বেনের দশা হইবে। ঝড়ে বা ড়ুবিবে, পুত্যকন্যা নাগদংশনে পরান দিবে; সুখের আশায় ঘর বাঁধিব, দুখের আগুনে জ্বল্যা ছারখার হয়া যাবে। মায়েরে পেসন্ন কর। মনে কর কন্যে-নাগিনী কন্যের অদেষ্ট, পেথম সন্তানটিরে তারে।

শিউরে উঠল শবলা।

প্ৰবাদ আছে নাগিনী কন্যা যদি ভ্ৰষ্ট হয়ে পালিয়ে গিয়ে বাচে, সে যদি ঘর-সংসার বাঁধে, সে যদি তার জাতি-ধর্ম সব ত্যাগ করে, তবে মা-বিষহরির অভিশাপ গিয়ে পড়ে তার মাতৃত্বের উপর। সন্তান কোলে এলেই তার নাগিনী-স্বভাব জেগে ওঠে। নাগিনী যেমন নিজের সন্তান ভক্ষণ করে, নাগিনী কন্যা তেমনই সন্তান হত্যা করে।

আত্মসংবরণ করে শবলা উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।

কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আর হল না ঘরবাধা। জমি পেলম, বাঁশ খড় দড়ি সবের ব্যবস্থাই করলম মনে মনে, পুঁজিরও অভাব ছিল নাই; কিন্তু তবু হল নাই। পচি আকাশের দিকে তাকিয়ে-কালো মেঘের কথা মনে পড়িল, বিদ্যুতের আলো মনে হইল, কড় কড় ডাক যেন মাথার মধ্যে ডেক্যা উঠল। ঘর বাঁধা হল নাই। পথে পথে ঘুরতে লাগলম। যোগিনী সাজলম, সাঁতালীর বিল বাদ দিয়া মা-বিষহরির আটনে আটনে ঘুর্যা বেড়ায়ে ধরনা দিলম। শুধু আমার তরে লয় ভাই, যোগিনী সেজ্যা তপ যখুন করছি, তখুন নাগিনী কন্যের তরেও খালাস চাইলম। বললম-জনী গ, শুধু আমাকে লয়, তুমি কন্যেরে এই বন্ধন থেকা খালাস দাও-খালাস দাও-খালাস দাও। কামরূপ গেলাম। মা-চণ্ডী মা-কামিক্ষেকে বললম–মা, আমারে খালাস দাও কন্যেরে খালাস দাও।পথে দেখা ঠাকুরের সাথে।

–কার সঙ্গে?

—নাগু ঠাকুর গ! মাথায় রুখু চুল, বড় বড় চোখ, খ্যাপাখ্যাপা চাউনি; সোনার পাতে মোড়া লোহার কপাটের মতুন এই বুক, তাতে দুলছে রুদ্দারিক্ষির মালা, অরুণ্যের দাঁতাল হাতির মতুন চলন-ঠাকুরকে দেখ্যা মনে হইল মহাদেব। দেখে তারে ডেকে কইলম-তুমি ঠাকুর কে বটে, তা কও? ঠাকুর কইল—আমার নাম নাগু ঠাকুর—মুই চলেছি মা-কামিথ্যের আদেশের তরে, মা-বিষহরির আদেশের তরে।

শিবরাম সবিস্ময়ে বললেন—তুমিই সেই যোগিনী?

—হুঁ, শবলা পোড়াকপালীই সেই যোগিনী।

শবলা বললে—ধন্বন্তরিভাই, ঠাকুরের কথা শুনা পিঙলার ভাগ্যের পরে আমার হিংসা হচ্ছিল। হায় রে হায়, রাজনন্দিনীর এমন ভাগ্যি হয় না; বেদের কন্যে মন্দভাগিনীর সেই ভাগ্যি!

শিবরাম বলেন—সত্যিই ঈর্ষার কথা। এমন বীরের মত গৌরবর্ণ পুরুষ, গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীসে ওই বেদের মেয়ের জন্য জাতি ধর্ম সন্ন্যাস ইহকাল পরকাল সব জলাঞ্জলি দিয়ে। বনে পাহাড়ে দুর্গম পথে চলেছে, তাকে না পেলে তার জীবনই বৃথা, ওই বন্দিনী কন্যাটির মুক্তিই হল তপস্যা-এ ভাগ্যের চেয়ে কোন উত্তম ভাগ্য হয় নারীজীবনে? এ দেখে কোন নারীর না সাধ হয়–হায়, আমার জন্য যদি এমনি করে কেউ ফিরত!

বিপুলবিস্তার কোনো নদী, বোধহয় ব্রহ্মপুত্রের তীরে—ঘন বনের মধ্যে শবলার সঙ্গে নাগু ঠাকুরের দেখা হয়েছিল। বীরবপু নির্ভীক নাগু ঠাকুর মনের বাসনায় একা থ চলছিল। মধ্যে মধ্যে ডাকছিল—শঙ্করী! শঙ্করী। বিষহরি! শিবনন্দিনী!

হাতে ত্রিশূল দণ্ড; কখনও কখনও অরণ্যের গাঢ় নির্জনতার মধ্যে ছেলেমানুষের মত হক মেরে প্রতিধ্বনি তুলে কৌতুক অনুভব করেছিল—এ–প!

চার দিক থেকে প্রতিধ্বনি উঠছিল—এ–প! এ—প! এ–প!

সে প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতে আবার হেঁকে উঠছিল—এ—প!

শবলা বিস্মিত মুগ্ধ হয়ে নবীন সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিচয় করেছিল।

নাগুর কথা শুনে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠেছিল শবলার। সাঁতালী মনে পড়েছিল। পিঙলাকে মনে পড়েছিল। হিজলের বিল মনে পড়েছিল।

শবলার উত্তেজনার সীমা ছিল না। প্রথমেই সে সেই উত্তেজনায় ঠাকুরকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিল—ঠাকুর, কেমন পুরুষ তুমি? এক কন্যেরে তোমার ভাল লেগেছে, তার তরে তুমার পিথিমী শূন্য মনে হচ্ছে, অথচ তুমি তারে কেড়ে লিতে পার না? এমুন বীর চেহারা তুমার, এমুন সাহস, বাঘেরে ডরাও না, সাপেরে ডরাও না, পাহাড় মান না, নদী মান না, আর কয়টা বেদের সাথে লড়াই করা কন্যেটাকে কো লিতে পার না?

নাগু ঠাকুর বলেছিল-পারি। নাগু ঠাকুর পারে না-তাই কি হয়? নাগু ঠাকুরের নামে রাঢ়ের মাটিতে মাটি খুঁড়ে ওঠে তার সাকরেদ শিষ্যের দল। মেটেল বেদে, বাজিকর, ওস্তাদ, গুণীন—এরাই শুধু নয়, নাগু ঠাকুর কুস্তিগীর, নাগু ঠাকুর লাঠিয়াল। নাগু সব পারে। সব পারে বলেই তা করব না। কন্যেকে কেড়ে আনলে তো কন্যে হবে ডাকাতির মাল। তাকে মুক্তি দিয়ে জয় করতে হবে। পিঙলা কন্যে লম্বা কালো মেয়ে, টানা দুটি চোখে আষাঢ়ের কালো মেঘ, কখনও বিদ্যুতের ছটা, কখনও সন্ধের অ্যাঁধারের মত ছায়া, পিঠে একপিঠ রুখু কালো চুল—সে হাসিমুখে লজ্জায় মাটির দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে এসে আমার হাত ধরবে, তবে তো তাকে পাব আমি।

—আঃ–ধন্বন্তরিভাই, পরানটা আমার জুড়ায়ে গেল; পরানের পরতে পরতে মনে হল। রামধনু উঠেছে দশ-বিশটা।

–মায়েরে সেদিন পরান ভরা ডাকলাম। মনেও লিলে, কি, পিঙলা যখুন এমুন করা বেদেকুলের মান রেখেছে, আর নাগু ঠাকুরের মতুন এমন যোগী মানুষ যখুন মুক্তি যুঁজিতে আসিছে—তখুন মুক্তি ইবার হবে। রাতে সে দিনে স্বপন পেলম মুই। স্বপনে দেখলম পিঙলারে, হাতে তার পদ্মফুল—বিষহরির পুষ্প; সে আমাকে হেস্যা কইল—মুক্তি দিলে জননী, নাগিনী কন্যের খালাস মিলল গ শবলা দিদি। ধড়মড় করা উঠা বসলম। শেষত, সনসন করছে, ঝিঝি পোকার ডাকে মনে হচ্ছে অরুণিতে গীত উঠিছে, আমার বেদে ঘুমে নিথর; নাগু ঠাকুর ছিল একটা পাথরের উপর চিত হয়্যা, বুকে দুটা হাত, নাক ডাকিছে যেন শিঙা বাজিছে, শুধু জ্যো রইছে। মাথার কাছে ঝাঁপির ভিতর একটা নাগ-মহানাগ শঙ্খচূড়, ঠাকুরের নাক ডাকার সাথে পাল্লা দিয়া গর্জাইছে। সে-ই শুধু আমার স্বপনের সাক্ষী। ঠাকুরকে ডেক্যা তুল্যা কইলাম বিবরণ। কইলাম সাঁতালীতে গিয়া বলিয়ো তুমি, মুক্তি হইছে কন্যের, দেনা শোধ হইছে। এই নাগ তার সাক্ষী।

–কিন্তু সাঁতালীর বেদেরা মানলে নাই সে কথা। গঙ্গারাম শয়তানের দোসর, সে নাগু ঠাকুরের বুকে মারিল আচমকা কিল। নাগ দিল না সাক্ষী। নাগু ঠাকুর তো সে স্বপন নিজে দেখে নাই; তাই নিজে সেই আদেশের তরে চলা এল। পিঙলারে কইল—মুই আনিব, পেমান আনিব। মুক্তি হইছে।

কন্যা কইল—

শিবরাম সে কথা জানেন। পিঙলা দুই পাশে তালগাছের সারি দেওয়া রাঢ়ের সেই আঁকাবাকা মাটির পথের দিকে চেয়ে থাকে। আসবে নাগু ঠাকুরমহিষ কি বলদ কিছুর উপর চড়ে। কবে, কখন আসবে?

—রাঢ়ে আছে আর এক চম্পাইনগর, জান? আছে, আছে। বেহুলা নদীর ধারে চম্পাইনগরে বিষহরির আটন। নাগপঞ্চমীতে বিষহরির পূজার দিন-আজও গ্রামের বন্ধুরা শ্বশুরবাড়িতে থাকে। না, সেদিন তাদের বাপের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা। চম্পাইয়ের বধুরা বেহুলার বাসরের কথা স্মরণ। করে সেদিন চম্পাইনগর ছেড়ে চলে যায়। বাপের বাড়িতে গিয়ে মনসার উপবাস করে, চম্পাইনগরে বিষহরির দরবারে পূজা পাঠায়। সেই চম্পাইনগরে গিয়েছিল নাপ্ত ঠাকুর। সামনে আসছে নাগপঞ্চমী। চারদিক থেকে আসবে দেশান্তরের সাপের ওস্তাদেরা।

নাগু ঠাকুর সেখানে দিলে ধনা, মনে মনে বললে—যোগিনীকে দিলে যে আদেশ, সেই আদেশ আমাকে দাও বিষহরি। আদেশ না পেলে উঠব না। অন্ন জল গ্রহণ করব না।

এইখানে আবার দেখা হল শবলার সঙ্গে। শবলাও ওখানে এসেই তার ব্ৰত শেষ করবে। মুক্তি মিলেছে। তীর্থ-পরিক্রমায় দুটি তীর্থ বাকি। বেহুলা নদীর উপর চম্পাইনগর আর হিজলে সাঁতালী গাঁয়ে মা-বিষহরির জলময় পদ্মালয়, যেখানে লুকানো ছিল চাদসদাগরের সপ্তডিঙা মধুকর।

চম্পাইনগরে সাতালীর বিষবেদেরা যায় না। সে এ চম্পাইনগরই হোক, আর রাঙা মাটি চম্পাইনগরই হোক। মূল সাঁতালীর চিহ্ন নাই, কি দেখতে যাবে? আর কোন মুখেই বা যাবে? কিন্তু শবলা গেল। তার মুক্তি হয়েছে, আর সে তো তখন সাঁতালীর বেদেনী নয়।

নাগু ঠাকুরের সেই বীরের মত দেহের লাবণ্য শুকিয়ে এসেছে উপবাসে। কিন্তু চোখ দুটো হয়েছে ঝকমকে দুটো স্ফটিকের মত। বুকের উপর হাত রেখে পাথরে মাথা দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে উপরের দিকে চেয়ে ঠাকুর শুয়ে ছিল। একটা বড় কাঁকড়া বটগাছের তলায় শুয়ে ধরনা দিয়েছিল।

শবলা তাকে দেখে সবিস্ময়ে বললে–ঠাকুর।

ঠাকুর চমকে উঠল—যোগিনী।

—কই? পিঙলা কই? পিঙলা বহিন? ভাগ্যবতী?

–পিঙলাকে এখনও পাই নাই। প্রমাণ চাই।

–প্রমাণ?

–হ্যাঁ, প্রমাণ। প্রমাণ নিয়ে যাব, গঙ্গারামের বুকে কিল মারব, তারপর। হাসলে নাগু ঠাকুর, বললে—তারপর পিঙলাকে নিয়ে নাপ্ত ঠাকুর-ভৈরব আর ভৈরবী—বাধবে ডেরা, নতুন আশ্রম।

–নাগ? নাগ দিলে না সাক্ষী?

–না।

–কি সাজা দিছ তারে? চোখ জ্বলে উঠল শবলার।

—সেটাকে ফেলে এসেছি সাঁতালীতে। তাকে সাজা দেওয়া উচিত ছিল। টুঁটিটা টিপে টেনে ছিঁড়ে দিতে হত। কিন্তু মনের ভুল–মনেই পড়ে নাই।

–পিঙলা কি কইল?

–পিঙলা আমার পথ চেয়ে থাকবে। বলেছে—মুক্তির আদেশের প্রমাণ নিয়ে তুমি এস; আমি থাকলাম পথ চেয়ে।

—কি করিছ ঠাকুর? আঃ, কি করিছ তুমি? সাঁতালীর নাগিনী কন্যে বলিল-তুমার পথ চাহি থাকিবে; আর তুমি তারে সেথা ফেল্যা রেখ্যা আসিলে? আঃ, হায় অভাগিনী কন্যে!

–কেন? কি বলছ তুমি?

–তার পরানটা তারা রাখিবে না।

–না না। তুমি জান না। আর সেদিন নাই। পিঙলাকে তারা দেবতার মত দেখে।

–মুই জানি না, তুমি জান ঠাকুরঃ মুই কে জান, মুই শবলা-পাপিনী নাগিনী কন্যা। শবলা ছুটে গিয়ে বিষহরির সামনে উপুড় হয়ে পড়ল। বললে—আদেশ কর মা, তুমি আদেশ কর ঠাকুরকে। রক্ষে কর মা, কন্যেকে তুমি রক্ষে কর। রক্ষে কর পিঙলাকে।

কি জানে না ঠাকুর? শবলা যে জানে। দেবতার আদেশ হলেও কি সাঁতালীর বেদেরা মুক্তি দিতে চাইবে কন্যাকে? তাদের জীবনের সকল অনাচারের পাপের উচ্ছঙ্খলতার মধ্যে ওই তপস্বিনী কন্যার পুণ্য তাদের সম্বল; অনায়াস নির্ভাবনায় তারা মিথ্যাচরণ করে চলে, ওই অক্ষয় সত্যের ভরসায়। তারা কি পারে তাকে মুক্তি দিতে? দেবতার মত ভক্তি করে? হুঁ, করে হয়ত। পিঙলা হয়ত সে ভক্তি পেয়েছে। কিন্তু যে দেবতা পরিত্যাগ করে যাবে, কি, যেতে চায় তাকে তারা যে বাঁধবে, মন্দিরের দুয়ার গেঁথে দিয়ে চলে যাবার পথ বন্ধ করবে। কি জানে নাগু ঠাকুর।

মা-বিষহরি! আদেশ দাও।

দীর্ঘকাল পরে শবলার মনে হল, সে যেন সেই নাগিনী কন্যা–সম্মুখে বিষহরি, পৃথিবী দুলছে, বিষহরির বারিতে সাপের ফণাগুলি মিলিয়ে গিয়ে জেগে উঠছে মায়ের মুখ; বাতাস ভারী হয়ে আসছে, চারিদিক ঝাপসা হচ্ছে, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে, তার ভর আসছে। সে চিৎকার করতে লাগল—বাঁচা আমার কন্যেরে বাঁচা, মুক্তি দে, খালাস কর। থরথর করে কাঁপতে লাগল শবলা। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। সেই মুহূর্তে নাগু ঠাকুর উঠল লাফ দিয়ে, ধরনা ছেড়ে–আদেশ পেয়েছে সে। এই তো আদেশ!

****

সমারোহ করে এর পর নাগু ঠাকুর রওনা হল সাঁতালী।

সঙ্গে তার বিশজন জোয়ান, হাতে লাঠি সড়কি। নিজে চেপেছিল একটা ঘোড়ায়। সঙ্গে একটা বলদের গাড়ি। জন চারেক বায়েন—তাদের কাঁধে নাকাড়া শিঙা। নাগু ঠাকুরের মাথায় লাল রেশমি চাদরের পাগড়ি, গলায় ফুলের মালা। সঙ্গে সাকরেদরা পথের ধারের গাছ থেকে ফুল তুলে নিত্য নূতন মালা গেঁথে পরায়। শবলাও সঙ্গে চলেছে। সে তাকে রহস্য করছে। সে যে পিঙলার বোন, শ্যালিকা।

এবার না বিয়ে করতে চলেছে। সমারোহ হবে না?

সম্মুখে নাগপঞ্চমী।

নাগপঞ্চমীর পূজা শেষ করেই সাঁতালীর বেদেরা নৌকা সাজিয়ে বেরিয়ে পড়বে। দেশদেশান্তরে নৌকায় নৌকায় ফিরবে। নাগের বিষ, শুশুকের তেল, বাঘের চর্বি, শজারুর কাটা। লিবা গো! লিবা!

তার আগে–তার আগে যেতে হবে।

জন্মাষ্টমী চলে গিয়েছে কবে, অমাবস্যা গিয়েছে, আকাশে সন্ধ্যায় দ্বিতীয়ার চাঁদ উঠেছে। চারিপাশে ধান-থইথই মাঠ। আকাশে মেঘের ঘোরাফেরা চলছে। পথে মধ্যে মধ্যে বরযাত্রীর দল থামে। নাগু ঠাকুর হক দেয়—থাম্ বেটারা, ভাদ্র মাসে বিয়ে, নাগু ঠাকুরের বিয়ে, ভৈরব চলেছে—বন্দিনী নাগকন্যাকে উদ্ধার করে আনতে। এ কি সাধারণ বিয়ে রে! লে বেটারা, খাওয়াদাওয়া কর্।

গাড়ি থেকে নামে চাল ডাল শুকনো কাঠ। নামে বোতল বোতল মদ।-খা সব ভৈরবের সঙ্গীরা দত্যি-দানার দল! বাজা নাকাড়া শিঙে। নান্‌ সব্‌, নাচ্‌।

কাল নাগপঞ্চমী।

চতুর্থীর সকালে—ধানভরা মাঠের বাকে, তালগাছের সারির ফাঁক দিয়ে দেখা গেল সাঁতালী গ্রাম। ওই আকাশে উড়ছে হাজারে হাজারে সরালির দল! গগনভেরীরা, বড় বড় হাঁসেরা আজও আসে নাই। ওই দেখা যাচ্ছে ঝাউবন। তার কোলে বাতাসে দুলছে সাঁতালীর ঘাসবন। সবুজ সমুদ্রে ঢেউ খেলছে। মাঠের বুকে আঁকাবাকা বাবলা গাছে হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে। মধ্যে মধ্যে শণের চাষ করেছে চাষীরা। হলুদ ফুলে আলো করে তুলেছে সবুজ মাঠ।

সবুজ আকাশে–হলুদ তারা-ফুল ফুটেছে।

–বাজা নাকাড়া শিঙা।

কড়কড় শব্দে বেজে উঠল নাকাড়া। বিচিত্র উচ্চ সুরে শিঙা।

—দে রে বেটারা, হাঁক দে।

বিশ-চব্বিশ জন জোয়ান হেঁকে উঠল—আ-বা-বা-বা-বা!

–জয়–বাবাঠাকুরের জয়!

ঢুকল বরযাত্রীর দল সাঁতালীর মুখে। পথ এখানে সংকীর্ণ।

কিন্তু শবলার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

আজ চতুর্থী কাল পঞ্চমী, বিষহরির পূজা। কই, বিষম-ঢাকি বাজে কই! চিমটা কড়া বাজে কই! তুমড়ী-বাশি বাজে কই!

নাকাড়ার শব্দ শুনে বেদেরা বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু—উল্লাস কই?

নাগু ঠাকুর হাঁকলে পিঙলা! কন্যে, আমি এসেছি। এনেছি হুকুম। এনেছি প্রমাণ। দে রে বেটারা, প্রমাণ দে।

বিশ জোয়ান কুক দিয়ে পড়ল।–আ—বা–বা-বা–বা! আ—

হুঙ্কার ছড়িয়ে গেল দিকে দিগন্তরে গঙ্গার কুল পর্যন্ত দিগন্তবিস্তৃত মাঠ জুড়ে।

–হিজল বিলে ঢেউ উঠল, পাখির ঝাক কলরব করে হাজার হাজার পাখায় ঝরঝর শব্দ তুলে উড়ল আকাশে।

বেদের দল সামনে এসে দাঁড়াল। সর্বাগ্রে ভাদু। হাতে তাদের চিমটে।

নাগু লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে বললে প্রমাণ এনেছি। কই, পিঙলা কই?

ভাদুর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল–নাই। পিঙলা নাই।

–পিঙলা নাই?

—না। চলে গেল। তুমি এনেছিলে কালনাগ, তারই বিষে মাত্র চার দিন আগে নাগপক্ষের প্রথম দিনে। প্রতিপদের প্রভাতে কন্যা পিঙলা এসে দাঁড়িয়েছিল বিশীর্ণা তপস্বিনীর মত। বললে—ডাক সব বেদেদের।

বেদেরা এল। কি আদেশ করবে কন্যা কে জানে? তপস্বিনীর মত কন্যাটির মধ্যে তারা। সাক্ষাৎ নাগিনী কন্যাকে প্রত্যক্ষ করেছিল।

কন্যা বললে—শিরবেদে কই?

গঙ্গারাম তখনও রাত্রির নেশার ঘোরে ঢুলছে। সে বললে—যাব নাই, যা।

কন্যা বললে—বেশ চল, মই যাই তার হোথাকে।

গঙ্গারাম জনতা দেখে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। পিঙলা কিছু বলবার আগেই সে বললে ভাল হইছে তুমরা আসিছ। মুই ডাকতম তুমাদিগে। এই কন্যেটার অঙ্গে চঁপাফুলের গন্ধ উঠে গভীর রাতে। মুই অ্যানেক দিন থেকাই গন্ধ পাই। কাল রাতে মুই গন্ধ কুথা উঠে দেখতে গিয়া দেখেছি—কন্যের ঘর থেকে উঠে গন্ধ। শুধাও কন্যেরে। কি রে কন্যে, বল্।

স্তব্ধ হয়ে রইল বেদেরা। তারা তাকালে পিঙলার দিকে প্রবাদ সবাই শুনে এসেছে যে, সর্বনাশিনী নাগিনী কন্যা চম্পকগন্ধা হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা এমন ঘটনার কথা জানে না। তারা প্রতীক্ষা করে রইল পিঙলার মুখ থেকে প্রতিবাদ শোনবার জন্যে। পিঙলা বললে–হাঁ, ওঠে। দুপহর রাতে বাস উঠে আমার অঙ্গ থেক্যা।

চোখ থেকে তার গড়িয়ে এল দুটি জলের ধারা।

—মুই বুঝতে পারি। মুই জানি না, ক্যানে এমুন হয়। তবে হয়। সিবারে যখুন বুলেছিল। শিরবেদে, তখুন উঠত না। এখন উঠে। মুই আর পারছি না। ঠাকুর বুলেছিল সে মুক্তির আদেশ আনিবে। আসিল না আদেশ। কাল রাতে আমার ঘরের পাশে কে পা পিছলে পড়া গেল। মুই তখুন কাঁদছি। মায়েরে বুছি—আমার ই লাজ তুমি ঢাক জননী! শব্দ শুন্যা দুয়ার খুল্যা দেখলম শিরবেদে। আমার লাজের কথা আর গোপন নাই। ঠাকুর আসিবার কথা, এল নাই। তুমরা এবার বিহিত কর, আমারে বিদায় দাও, মুই চল্যা যাই। বলেই সে নীরবে ফিরে এল নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকেই দরজা দুটি বন্ধ করে দিলে।

গঙ্গারাম এতক্ষণে এল ছুটে। তার যেন হঠাৎ চৈতন্য হল।

–কন্যে পিঙলা! কন্যে!

ভাদুও এল ছুটে, সেও সমস্ত ব্যাপারটা বুঝেছে।

হাঁ, ঠিক তাই, ঘরের মধ্যে তখন নাগের গৰ্জনে যেন ঝড় উঠেছে এবং পিঙলা বেদনাকাতর স্বরে প্রার্থনা করছে—খালাস দে জননী,–খালাস! মা গ!

ভাদু লাথি মেরে ভেঙে ফেলে দিলে দরজা।

ঘরের মেঝের উপর পড়ে আছে পিঙলা। আর তার বুকের উপর পড়ে ছোবলের পর ছোবল মারছে ওই শঙ্খচূড়। পিঙলা বললে–হুঁশ করে ভাদুমামা। উরে আমি কামাই নাই ইবার।

পিছিয়ে এল গঙ্গারাম।

ভাদু চিমটের মুখে সাপটার মাথাটা চেপে ধরে বার করে আনলে। পিঙলা হাসলে। দুর্ধর্ষ ভাদু-চিমটের আঘাতেই সাপটাকে শেষ করলে। পিঙলাও চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল ঠাকুর মিছা শোনে নাই, মিছা বলে নাই। মুক্তির হুকুম আসিছিল, ওই লাগটাই ছিল ছাড়পত্ত।

তারপর? তারপর আর কি? সাঁতালী দিবসে অন্ধকার।

নাগপক্ষে নিরানন্দ পুরী।…

নতুন নাগিনী কন্যার আর্বিভাব হয় নাই। সাক্ষাৎ দেবতার মত পিঙলা কন্যা নাই। তাই চিমটে বাজছে না, বিষম-ঢাকি বাজছে না, তুমড়ী-বাঁশি বাজছে না। আকাশে বাতাসে ফিরিছে। হায় হায় ধ্বনি।

শুন—ঐ ঝাউয়ের বাতাস, শুন ওই হিজল বিলের কলকলানি–হায় হায়।

অকস্মাৎ দানবের মত চিকার করে উঠল নাগু ঠাকুর–আ—

দু হাতে বুক চাপতে লাগল।

ছোট একটা ছেলে ছুটে এল—উ গ, শিরবেদে ছুটিছে গ। পালাইছে–হুই খালের পানে।

–অ্যাঁ! পলাল! বুক চাপড়ানো বন্ধ করে তে দাঁত টিপে দাঁড়াল নাগু ঠাকুর। তারপর চিৎকার করে উঠল—আমার কিল!

ছুটল নাগু ঠাকুর। সঙ্গে সঙ্গে কজন সাগরেদ।

ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে গঙ্গারাম। প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে।

পিছনে উন্মত্তের মত ছুটছে নাগু ঠাকুর। হাত বাড়িয়ে, চিৎকার করে।

হাঙরমুখী খালের ধারে একটা বিকট চিৎকার করে নাগু ঠাকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল গঙ্গারামের উপর। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে পড়ল নরম মাটির উপর।

গঙ্গারাম ধূর্ত চতুর; কিন্তু নাগু ঠাকুর উন্মত্ত ভীম।

বার কয়েক উলোট-পালটের পর বুকের উপর চড়ে বসে মারলে কিল। গঙ্গারাম একটা শব্দ করলে। বাক্ রোধ হয়ে গেল।

কিন্তু তাতেও নিষ্কৃতি দিলে না নাণ্ড ঠাকুর। বুকে মারলে আর এক কিল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে এল সাঁতালীর বিষহরির আটনের সামনে। তখন গঙ্গারামের মুখ দিয়ে ঝলক দিয়ে রক্ত উঠছে। গড়িয়ে পড়ছে কষ বেয়ে। ফেলে দিলে সবার সামনে। তারপর কাঁদতে লাগল।

সমস্ত দিন কাঁদলে নাগু ঠাকুর। ছেলেমানুষের মত কাঁদলে।

সন্ধের পর মদ খেয়ে চিৎকার করতে লাগল। ঘুরে বেড়াতে লাগল গঙ্গার ধারে ধারে। কন্যে! কন্যে! পিঙলা! কন্যে!

শবলা এতক্ষণে কাঁদলে। বললে–সন্ধ্যার খানিক আগে–গঙ্গারাম মরিল। কি কিল মারছিল ঠাকুর, উয়ার কলিজাটা বুঝি ফেট্যা গেছিল। যেমন পাপ তেমুনি সাজা। ভাদুরে শ্যামকালে বুলেছিল–হাঁ, আমার সাজাটা উচিত সাজাই হছে ভাদু। কন্যেটার মরণের পর থেকা এই ভয়ই আমার ছিল। মরণকালে আমার পাপের কথাটা তুরে বলে যাই।

পিঙলাকে সে আয়ত্ত করতে চেয়েছিল। মহাপাপের বাসনায় পিঙলাকে জালে জড়াতে চেয়েছিল জাদুর জালে।

গঙ্গারাম চতুর ডোমন-করেত। জাদুবিদ্যা-ডাকিনীসিদ্ধ গঙ্গারামের বুদ্ধি কল্পনাতীত কুটিল। শিবরাম বলেন–শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কবিরাজ, আমি পিঙলার। ওই চম্পকগন্ধের কথা শুনে ভেবেছিলাম—এটা তার বায়ুকুপিত মস্তিষ্কের ভ্রান্তি, মানসিক বিশ্বাসের বিকার। কিন্তু তা নয়। জাদুবিদ্যা শিখেছিল গঙ্গারাম। আর অতি কুটিল ছিল তার বুদ্ধি। প্রকৃতিতে ছিল ব্যভিচারী। তার পাপ দৃষ্টি পড়েছিল পিঙলার উপর। কোনোক্রমে তাকে আয়ত্ত করতে না পেরে সে এক জটিল পন্থার আবিষ্কার করেছিল। কন্যাটির মনে সে বিশ্বাস জন্মাতে চেয়েছিল। তার অঙ্গে চাপার গন্ধ ওঠে। কল্পনা করেছিল, এই বিশ্বাসে শেষ পর্যন্ত উদ্ভ্রান্ত হয়ে পিঙলা একদিন রাতে বের হবে, নয়ত পালাতে চাইবে। পালালে সে তাকে নিয়ে পালাত। মুরশিদাবাদে সে যেত ওষুধের উপকরণ আনতে। সেখান থেকে সে এনেছিল চম্পকগন্ধ। নিত্য মধ্যরাত্রে সে এসে পিঙলার ঘরের পাশে দাঁড়ায়ে সেই গন্ধের আরক ছিটিয়ে দিত। বিচিত্র হেসে ঘাড় নেড়ে শবলা বললে–হায় রে!

পিঙলার মন বুঝবার শক্তি গঙ্গারামের ছিল না। সাধ্য কি?

আবার ঘাড় নেড়ে বলে—তাকেই দুষব কি ধরমভাই, বল?

দৈত্যকন্যা জলন্ধর-পত্নীকে ছলনা করবার সময় দেবতারও ভ্রম হয়েছিল! গঙ্গারামের কি দোষ

মৃত্যুকালে গঙ্গারাম সব পাপ স্বীকার করেছিল—শেষ বলেছিল—ঠাকুর ঠিক সংবাদ আনিছিল, কন্যে ঠিক করেছিল। আমাদের পাপে রোষ করা বিষহরি কন্যারে মুক্তি দিয়াছেন। পিঙলা যেমুন করে চলে গেল, তাপরে আর কি কন্যে আসে? কন্যে আর আসবেন নাই, কন্যে আর আসবেন নাই।

শবলা বললে—সব চেয়ে দুখ ভাই–

সবচেয়ে দুঃখ–মধ্যরাত্রে নাও ঠাকুরের শিষ্যরা মদ খেয়ে উন্মত্ত হয়ে সাঁতালীতে আগুন জ্বালিয়ে চরম অত্যাচার করে এসেছে। মনসার বারি কেড়ে নিয়ে এসেছে।

ভাদু নোটন তারা একদল সাঁতালী ছেড়ে চলে গিয়েছে কোন জঙ্গলের দিকে নিরুদ্দেশ। সাঁতালী পুড়ে গিয়েছে, মনসার বারি নাই, আর কি নিয়ে থাকবে সাঁতালীতে? গভীর অরণ্যে গিয়ে তারা বাস করবে।

আর একদল—এই এদের নিয়ে শবলা বেরিয়েছে রাঢ়ের পথে। আজ এসে দাঁড়িয়েছে শিবরামের চিকিৎসালয়ের সামনে।

আর সাঁতালীতে নয়,–অন্যত্র এদের নিয়ে বসতি স্থাপন করবে। মানুষের বসতির কাছে–গ্রামে তারা স্থান খুঁজছে।

নাগিনী কন্যা আর আসবে না, মুক্তি পেয়েছে, আর তো সাঁতালীতে থাকবার অধিকার নাই। সাঁতালীর কথা শেষ, নাগিনী কন্যের কাহিনী শেষ।–যে শুনিবা সি যেন দু ফোঁটা চোখের জল ফেলিও!

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত