মায়াবিনী

মায়াবিনী

মায়াবিনী
প্রথম খণ্ড – নারী না পরী

প্রথম পরিচ্ছেদ – নূতন সংবাদ

একদিন অতি প্রত্যুষে দেবেন্দ্রবিজয় স্থানীয় থানায় আসিয়া ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবুর সহিত দেখা করিলেন।
যাঁহারা আমার “মনোরমা” নামক উপন্যাস পাঠ করিয়া আমাকে অনুগৃহীত করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে দেবেন্দ্রবিজয় মিত্রের পরিচয় আর নূতন করিয়া দিতে হইবে না। যে সময়কার ঘটনা বলিতেছি, তখনকার ইনি একজন সুপ্রসিদ্ধ, সুদক্ষ ও শ্রেষ্ঠ ডিটেক্‌টিভ। তাঁহার ভয়ে তখন অনেক চোর চুরি ছাড়িয়াছিল, অনেক ডাকাত ডাকাতি ছাড়িয়াছিল, অনেক জালিয়াৎ জালিয়াতী ছাড়িয়াছিল; স্ব স্ব ব্যবসায়ে এরূপ একটা অপরিহার্য্য ব্যাঘাত ঘটায় সকলে কায়মনোবাক্যে অহর্নিশ ইষ্টদেবতার নিকটে দেবেন্দ্রবিজয়ের মরণ আকাঙ্খা করিত। সকলেই ভয় করিত; ভয় করিত না—গর্বিত জুমেলিয়া। সে ইষ্টদেবতার নিস্ফলসহায়তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া, সেই সময়ে স্বহস্তে দেবেন্দ্রবিজয়কে খুন করিবার জন্য ‘মরিয়া’ হইয়া উঠিয়াছিল। সে তাঁহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিত। দেবেন্দ্রবিজয় যদি তেমন একজন ক্ষমতাবান, বুদ্ধিমান লোক না হইয়া একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা হইতেন, তাহা হইলে সে তাঁহাকে পদতলে দলিত করিয়া মনের সাধ মিটাইতে পারিত। তা’ না হইয়। দেবেন্দ্র কি না প্রতিবারেই তাহাকে হতদর্প করিল—ছিঃ—ছিঃ—ধিক্ ধিক্‌; এই সব ভাবিয়া জুমেলিয়া আরও আকুল হইয়া উঠিত। এই বর্তমান আখ্যায়িকা পাঠ করিবার পূৰ্ব্বে পাঠকের ‘মনোরমা’ নামক পুস্তকখানি পাঠ করিলে ভাল হয়; এখানিকে মনোরমা পুস্তকের পরিশিষ্ট বলিলেও চলে।
যখন দেবেন্দ্রবিজয় রামকৃষ্ণ বাবুর সহিত দেখা করিলেন, তখন তিনি নিশ্চিন্তমনে বাঁশের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ন্যায় একটি চুরুট দন্তে চাপিয়া ধুমপান করিতেছিলেন; তেমনি পরম নিশ্চিন্তমনে দেখিতেছিলেন, সেই ধূমগুলি কেমন কুণ্ডলীকৃত হইয়া, উন্মুক্ত বাতায়ন পথ দিয়া, দল বাধিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল। তেমন প্রত্যুষে দেবেন্দ্রবিজয়কে সহস৷ সেই কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া তিনি কিছু বিস্মিত হইলেন। সসম্মানে তাহাকে নিজের পার্শ্বস্থিত চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন, “কি হে, ব্যাপার কি? আমাকে দরকার না কি? এত সকালে যে?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ব্যাপার বড় আশ্চৰ্য্য; শুনলেই বুঝতে পারবে, ব্যাপারটা কতদূর অলৌকিক; তেমন অলৌকিক ঘটনা কেউ কখনও দেখে নাই—শুনে নাই।”
রাম। এমন কি ঘটনা হে?
দেবেন্দ্র। বড়ই অলৌকিক—একেবারে ভৌতিক-কাণ্ড–তুমি শুনলে তোমারও বিস্ময়ের সীমা থাকবে না।
রাম। বেশ, আমিও বিস্মিত হইতে চাই। প্রায় দশ বৎসরের মধ্যে আমি একবারও বিস্ময়ান্বিত হইয়াছি কি না সন্দেহ; তোমার কথায় যদি এখন তা ঘটে, সে বিস্ময়টায় কিছু-না-কিছু নূতনত্ব আছেই।
দেবেন্দ্র। ফুলসাহেবকে তোমার স্মরণ আছে?
রাম। বিলক্ষণ!
দেবেন্দ্র। জুমেলিয়াকে? যে এতদিন জাল-মনোরমা সেজে নিজের বাহাদুরী দেখাইতেছিল, শেষে হাজরার বাগান-বাড়ীতে আত্মহত্য করে, তাকে স্মরণ আছে কি?
রাম। হা, সেই পিশাচী ত?
দেবেন্দ্র। সত্যই সে পিশাচী বটে!
রাম। তার কি হয়েছে?
দেবেন্দ্র। তার মৃত্যুর বিবরণটা কি এখন তোমার বেশ স্মরণ আছে?
রাম। বেশ আছে!
দে। জুমেলিয়ার দেহ যতক্ষণ না কবরস্থ করা হয়েছিল, ততক্ষণ আমি তৎপ্রতি সতর্ক-দৃষ্টি রেখেছিলাম ব’লে, তুমি আর কালীঘাটের থানার ইনস্পেক্টর হেসেই অস্থির।
রাম। শুধু কবরস্থ নয়—সেই শবদেহ কবরস্থ ক’রে কবর-স্মৃত্তিক পূর্ণ করা পৰ্য্যন্ত তোমার সতর্ক দৃষ্টি সমভাবে ছিল। ইহা ত হাসিবারই কথা, দেবেন্দ্র বাবু! [ হাস্য ]
দেবেন্দ্র। এখন সেই ঘটনা, আমার সে সতর্কতা যে বৃথা নয়, তা’ প্রমাণ করেছে। তবু যতদুর সতর্ক হওয়া আবশ্যক, তা আমি হ’তে পারি নি; আরও কিছুদিন সেই কবরের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখাই আমার উচিত ছিল।
রা। অ্যাঁ—বল কি হে! তোমার মাথাটা নিতান্ত বিগড়াইয়। গিয়াছে দেখছি। কবরের উপর এত সাবধানত কেন? তার পর তুমি জুমেলিয়ার কবরের উপর আর পাহারী দিয়াছিলে কি?
লে। হ্যাঁ, এক সপ্তাহ।
রা। যে লোক ম’রে গেছে—যাকে পাঁচ হাত মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়েছে—তার উপর তুমি এক সপ্তাহ নজর রেখেছ; এখনও আবার বল্‌ছ যে, আরও কিছুদিন নজর রাখতে পারলে ভাল হ’ত, –এ সব কথার অর্থ কি? মাটির নীচে—এক সপ্তাহ—তবু যে কোন মানুষ বাঁচতে পারে, তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
দে। তা’ মিথ্যা বল নাই, এরূপ স্থলে সাধারণ লোকের পক্ষে জীবিত থাকা অসম্ভব।
রা। দেবেন্দ্র বাবু, মৃত্যুর কাছে আবার সাধারণ আর অসাধারণ কি?
দে। তুমি কি আরবদেশের ফকিরদিগের এরূপ পুনরুখান সংক্রান্ত কোন ঘটনার কথা কখনও শোন নাই?
রা। অনেক সময়ে অনেক শুনেছি।
দে। তারা কি করে জান?
রা। হ্যাঁ, কিছু কিছু।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “আরবদেশের ফকিরের দ্রব্যগুণ প্রক্রিয়ায় আপনাদিগকে এমন নিম্পন্দন নিশ্চেতন করে যে, বড় বড় ডাক্তারের বিশেষ পরীক্ষায় জীবনের কোন চিহ্নই বাহির করিতে পারে না। তার পর সকলের সম্মুখে সেই ফকিরকে সমাধিস্থ করা হয়। ফকির ইতিপূৰ্ব্বে এমন একজন চেলা ঠিক ক’রে রাখে যে, ফকিরের স্থিরীকৃত দিবসাবধি—সম্ভবতঃ একমাস সেই কবরের উপর সতত দৃষ্টি রাগে। তার পর নির্দিষ্ট দিনে ফকিরের পুনরুত্থান হয়। পরক্ষণেই সেই ফকিরের মৃতকল্প দেহে চৈতন্তচিহ্ন প্রকাশ পায়; তার পর সে ওঠে, বসে, কথা কহে, স্বচ্ছন্দচিত্তে এদিকে ওদিকে বেড়াইতে পারে; মোট কথা—সে পূৰ্ব্বে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই হইয় উঠে।”
রা। [ সহাস্তে ] যাদের সমক্ষে এ কাও হয়, তারা গাধা।
দে। আমাকেও কি ‘গাধা’ ব’লে তোমার বিবেচনা হয়?
রা। না |
দে। না কেন? আমিই স্বচক্ষে এমন কাগু অনেক দেখেছি; আমি এ ঘটনা অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি; এ ঘটনা অসম্ভব নয়।
রা। বেশ, এখন ব্যাপার কি বল? তোমার সুদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিক যে আর ফুরায় না!
দে। ডাক্তার ফুলসাহেব অনেক দিন আরবদেশে ছিল; তার পর কামরূপ ঘুরে আসে। সে নানা প্রকার দ্রব্যগুণ ও মন্ত্রাদি জানত— তার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল।
র: তা’ সে সকলকে প্রচুর পরিমাণে দেখিয়ে মরেছে।
দে। জুমেলিয়া তারই ছাত্রী—শুধু ছাত্রী নয়, স্ত্রী।
রা। হ্যাঁ জানি, জুমেলিয়া বড় সহজ মেয়ে ছিল না।
দে। শিক্ষকের চেয়ে ছাত্রীর শিক্ষা আরও বেশি।
রা। হ’তে পারে, কি হয়েছে তা’?
দে। জুমেলিয়া—সেই নারী-পিশাচী এখনও মরে নি।
রা। [ সবিস্ময়ে ] বল কি হে!
দে। আমি সেই কথাই তোমাকে বলতে এসেছি। যদি সে বেঁচে থাকে, অবশ্যই তুমি শীঘ্রই তা জানতে পারবে। সে বড় সহজ স্ত্রীলোক নয়, নিজের হাতে সে অসংখ্য নরহত্যা করেছে। সে এখন জীবিত কি মৃত, তুমি তার কবর খুঁড়ে দেখলেই জানতে পারবে।
রা। কতদিন তাকে গোর দেওয়া হয়েছে?
দে। আজ বৈকালে ঠিক উনচল্লিশ দিন পূর্ণ হবে।
রা। না না; যে মৃতদেহ এতদিন গোরের ভিতর রয়েছে—তা’ আবার টেনে বের করা যুক্তিসিদ্ধ ব’লে বিবেচনা করি না।
দে। মৃতদেহ! মৃতদেহ পাবে কোথায় তুমি? দেখবে কবর শূন্য প’ড়ে আছে।
রা। এ খেয়াল বোধ হয়, তোমার সম্প্রতি হ’য়ে থাকবে।
দে। হ্যাঁ, সম্প্রতি।
রা। দেবেন্দ্র বাবু, ব্যাপারটা কি হয়েছে বল দেখি?
দে ৷ শ্ৰীশচন্দ্র নামে একটি চতুর ছোকরা আমার কাছে শিক্ষানবীশ আছে। “১৭—ক” পুলিন্দার কেসে সে আমার অনেক সহায়তা করেছে। যে গোরস্থানে” জুমেলিয়াকে গোর দেওয়া হয়েছে, সেই গোরস্থানে কাল শ্ৰীশচন্দ্র বেড়াতে যায়। ফিরে আসার সময়ে জুমেলিয়ার কবর দেখতে যায়। জুমেলিয়া তাকে যেরূপ বিপদে ফেলেছিল, তাতে সে জুমেলিয়াকে কখনও ভুলতে পারবে বলে বোধ হয় না। শ্ৰীশচন্দ্রের যদিও বয়স বেশি নয়, বেশ চতুর বটে—আর দৃষ্টিটাও যে বেশ তীক্ষ্ণ আছে, এ কথা স্বীকার করা যায়। জুমেলিয়ার কবরটার উপরকার মার্টিগুলো আলগা আলগা দেখে তার মনে কেমন একটা সন্দেহ হয়; তার পর সে এক টুক্‌রা কাগজ সেইখানে কুড়িয়ে পায়; তাতে তার সেই সন্দেহ বদ্ধমূল হয়। সেই কাগজ টুক্‌রায় জুমেলিয়ার, নাম লেখা ছিল। তার পর সে অপর টুকরাগুলির সন্ধান করতে লাগল; সেইরূপ ছোট ছোট টুক্‌রা কাগজ চারিদিকে অনেক ছড়ান রয়েছে দেখতে পেলে। সেদিন সে কেবল সেই কাগজ টুকরাগুলি বেছে বেছে সংগ্ৰহ ক’রে বাড়ী ফিরে আসে। সে আমাকেও সকল কথা তখন কিছুই বলে নাই, নিজেই সে সেই ছোট ছোট কাগজগুলি ঠিক ক’রে সাজিয়ে আর একখানা কাগজে গদ দিয়ে জুড়ে রাখে।
রা। শ্ৰীশচন্দ্র টুক্‌রা কাগজগুলো ঠিক সাজাতে পেরেছিল?
দে। পেরেছিল।
রা। কেমন লোকের ছাত্ৰ! ভাল, তার পর?
দে। কাল রাত্রে আমার হাতে সে সেই পত্ৰখানা এনে দেয়, তেমন আশ্চৰ্য্য পত্র আমি কখনও দেখি নাই।
রা। কিরূপ আশ্চৰ্য্য শুনতে পাই না কি?
দে। আমার কাছেই আছে, শ্ৰীশ সেই ছিন্নপত্ৰখানা বেশ পাঠোপযোগী ক’রেই আমার হাতে দিয়েছে। আগেকার টুকরাগুলি পাওয়ার যায় নাই; মধ্যেরও দু-এক টুকরা পাওয়া যায় নাই। শ্ৰীশ নিজে সেই-সেইখানে কথার ভাবে আন্দাজ ক’রে ঠিক কথাগুলিই বসিয়েছে; প’ড়ে দেখ। [ পত্র প্রদান ]

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অভিনব পত্র

পত্রে লেখা ছিল;–
——হইল না। অপেক্ষা করিবার সময় নাই, থাকিলে করিতাম–কি করিব, দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার সহিত দেখা হইল না। আমি কোন বিশেষ প্রয়োজনে বালিগঞ্জের দিকে চলিলাম। হয় ত সেখানে আমি ধরা পড়িতে পারি। যদি ধরা পড়ি, আমি সেইরূপে আত্মহত্যা করিব; তুমি তা জান। আমার মৃত্যুর দিন হইতে ত্রিশ দিন পৰ্য্যন্ত আমি কবরের মধ্যেও জীবিত থাকিব; সেই সময়ের মধ্যে তুমি আমায় উদ্ধার করিবে। যদি আমাকে উদ্ধার করিতে তোমার আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের এক রাত্রি পূৰ্ব্বে বরং চেষ্টা পাইবে, যেন নির্দিষ্ট সময়ের এক রীত্রি পরে চেষ্টা না পাও; তাহা হইলে চেষ্টা বিফল হইবে।
কবর হইতে আমাকে বাহির করিয়া যদি দেখ, দাতকপাট লাগিয়াছে, তবে জোর করিয়া ছাড়াইবে। তাহার পর সেই শিশি হইতে আট ফোট ঔষধ আমার মুখে দিবে। যেন আট ফোটার এক ফোটা কম কি বেশি না হয়, খুব সাবধান।
তাহার পর আর কিছুই করিতে হইবে না, কেবল আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করিবে। তুমি যদি আমার এই সকল অনুরোধ উপেক্ষা না কর, আধ ঘণ্টার পর আমি তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পারিব। তুমি বলিয়াছ, আমাকে প্রাণের সহিত ভালবাস। এমন কি, যদি আমি তোমার স্ত্রী হই, তুমি আমার আগেকার অসংখ্য পাপ—যে সকল আমি স্বহস্তে করিয়াছি, তুমি গ্রাহ্যই করিবে না।
বাঁচাও—আমায় রক্ষা কর; আমি তোমারই হইব। স্মরণ থাকে যেন—পুর্ণমাত্রায় ত্রিশ দিন—এক মুহূৰ্ত্ত উত্তীর্ণ হইয়া গেলে আর তুমি আমায় কিছুতেই বাঁচাইতে পরিবে না—আমি মরিব।
তুমি আমার জীবন দান কর—এ জীবন চিরকাল তোমারই অধিকারে থাকিবে।
তোমার প্রেমাকাঙ্খিণী
জুমেলা।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বন্দোবস্ত

রামকৃষ্ণ বাবু সবিস্ময়ে বলিলেন, “একি অদ্ভুত কাণ্ড! দেবেন্দ্র বাবু, সত্যই সে কবর থেকে উঠে গেছে না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার ত তাহাই বিশ্বাস।”
“কখনও তা’ হ’তে পারে?”
“হ’তে পারে কি? হয়েছে।”
“শ্রীশচন্দ্র একটা বড় ভুল করেছে, যার নামে পত্র লেখা হয়েছে, তার নামটা যদি সেই সকল টুকরা কাগজগুলা থেকে কোন রকমে বেছে বের করতে পারত—বড়ই ভাল হ’ত।”
“সন্ধান করেছিল, পায় নি। এখন এক কথা হচ্ছে, রামকৃষ্ণ বাবু।”
“কি?”
“এস, আমরা জুমেলিয়ার কবরটা আগে খুড়ে দেখি, ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে; তার পর অন্ত কথা।”
“বেশ, আমি প্রস্তুত আছি।”
“আজই বৈকালে।”
“হাঁ।”
“বেল তিনটার সময়ে এখানেই হ’ক, কি সেখানেই হ’ক, আমাদের দেখা হ’বে।”
“এখানে তুমি ঠিক বেলা দু’টার সময়ে অতি অবশ্য আসবে; যাবার সময়ে গঙ্গাধরকে সঙ্গে নেওয়া যাবে। পথে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে তার বাড়ী হ’তে গাড়ীতে তুলে নেব, তার পর সকলে মিলে গোরস্থানে যাওয়া যাবে।”
“আমার গাড়ী আমি নিয়ে আসব, সেজন্য তোমাকে ভাবতে হবে না; আমি ঠিক সময়েই আসব। পারি যদি শচীন্দ্রকে সঙ্গে আনব। তুমি
তমধ্যে ঠিক বন্দোবস্ত ক’রে ফেল।”
“এদিককার যোগাড় আমি সব ঠিক ক’রে রাখব।”
“দেখে, আমার কথা যেন স্মরণ থাকে; নিশ্চয়ই কবর-গহবর শূন্য প’ড়ে আছে, দেখতে পাবে।”
“বেশ বেশ, দেখা যাবে, দেবেন্দ্র বাবু।”
“জুমেলিয়া তার মৃত্যুর পরেও যে আমার অনুসরণ করবে ব’লে ভয় দেখিয়েছিল—সে কথা কি আমি তোমায় আগে বলি নাই?”
“কই না।”
“তার কবর সম্বন্ধে আমার সতর্ক থাকার এই এক কারণ; এই জন্যই আমি তার কবরের উপর বিশেষ নজর রেখেছিলাম। এখন আমি তার সেই ভয়-প্রদর্শনের প্রকৃত কারণ বুঝতে পারছি; এইজন্যই সে বলেছিল, তার মৃত্যুর পরেও সে তার প্রতিজ্ঞ পুর্ণ করবে।”
“তখন বুঝি, তোমার মনে এ ধারণা হয় নাই? এখন তুমি তার মনের অভিপ্রায় বেশ বুঝতে পেরেছ?”

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সমাধিক্ষেত্র

ঠিক বেলা দুইটার সময়ে পূৰ্ব্বোল্লিখিত থানার সম্মুখে একখানি গাড়ী আসিয়া দাঁড়াইল; তন্মধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় ও তাঁহার ভাগিনেয় শচীন্দ্র বসিয়াছিলেন।
তখন রামকৃষ্ণ বাবু সাদাসিধে পরিচ্ছদে এবং গঙ্গাধর বাবু [অন্য একজন ইনস্পেক্টর] পুলিশের ইউনিফৰ্ম্মে দেবেন্দ্রবিজয়ের গাড়ীতে গিয়া উঠিলেন। কোচ ম্যান গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। পথে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে গাড়ীতে তুলিয়া লওয়া হইল।

যথা সময়ে সকলে সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। যথায় নারী-পিশাচী ডাকিনী জুমেলিয়াকে প্রোথিত করা হইয়াছিল, তথায় সকলে উপস্থিত হইলেন।
তথায় দুইজন ধাঙ্গড় তাহাদের কোদাল, সাবল ইত্যাদি যন্ত্র লইয়া উপস্থিত ছিল।
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট অনুমতি করিলে তাহারা জুমেলিয়ার কবর খননে প্রবৃত্ত হইল।
যখন কবর হইতে শবাধার উত্তেলিত ও উন্মুক্ত হইবে, তখন তাহাদিগের সম্মুখে কি যে একটা অভিনব দৃপ্ত প্রদর্শিত হইবে, তাহাই তখন সেই পুলিশ-কৰ্ম্মচারিত্রয় ও গোয়েন্দাদ্বয় ভাবিতেছিলেন। আগ্রহপূর্ণলোচনে উদ্‌গ্ৰীব হইয়া প্রত্যেকেই নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভূগর্ভ হইতে শবাধার বহিষ্কৃত হইল – শবাধার অত্যন্ত ভারযুক্ত; তদনুভবে তথাকার সকলেই বুঝিতে পারিলেন, তাহা শূন্য নহে, সেই শবাধার মধ্যে জুমেলিয়ার মৃতদেহ আছে। দেবেন্দ্রবিজয় যথেষ্ট অপ্রতিভ ও চিন্তাযুক্ত হইলেন। সত্যই কি তাহাকে তাহাদের নিকট অপমানিত হইতে হইল? ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া, পরিহাসব্যঞ্জক ভ্রভঙ্গি করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় অনুমানে এই রহস্তের ভাব এখন অনেকটা বুঝিয়া লইতে পারিলেন। পরক্ষণে যখন সেই শবাধারের আচ্ছাদন উন্মুক্ত করা হইল, তখন দেবেন্দ্রবিজয়ের স্নান মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল—সকলেরই কণ্ঠ হইতে এক প্রকার বিস্ময়স্থচক শব্দ নিঃস্থত হইল। সকলেই চমকিতচিত্তে, বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে শবাধারের প্রতি চাহিয়া রছিলেন। তাঁহারা সেই শবাধারে শব দেখিতে পাইলেন বটে, কিন্তু সে শব ত জুমেলিয়ার নহে-স্ত্রীলোকের নহে–পুরুষের ভদ্রোচিত পরিচ্ছদধারী কোন সুন্দর যুবকের—এ কি হইল!
দেবেন্দ্রবিজর ভিন্ন আর সকলেই এককালে স্তম্ভিত ও প্রায় বিলুপ্তচৈতন্ত্য হইয়া পড়িলেন।
অনেকক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু প্রকৃতিস্থ হইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসিলেন, “দেবেন্দ্র বাবু, এ কি ব্যাপার হে! কিছু বুঝতে পার কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কছিলেন, “যা’ ঘটেছে, তা সহজেই আমি বুঝতে পেরেছি।”
রা। তা’ তুমি পার; এখন আমাদের বুঝা ও দেখি; আমার ত বোধ হচ্ছে, আমি এখন স্বপ্ন দেখছি।
দে। [ মৃতদেহ নির্দেশে ] এই লোকটাকেই জুমেলিয়া নিশ্চয়ই সেই পত্ৰখানা লিখে থাকবে; এই লোকটারই সে স্ত্রী হ’তে চেয়েছিল। তার কথামত এই যুবক কাজ করে। জুমেলিয়া একে যেমন যেমন ব’লে দিয়েছিল, এ লোকটি সেই সেই উপায়ে জুমেলিয়াকে উদ্ধার ক’রে থাকবে। তার পর সেই পিশাচী তার এই উদ্ধারকতাঁকে হত্যা করেছে; নিজের শবাধারে এই মৃতদেহ পুর্ণ ক’রে নিজেরই কবর-গহবরে প্রোথিত ক’রে শেষে পলায়ন করেছে। আমার বিশ্বাস, জুমেলিয়া এখন এই দেশেই আছে; তার কারণ এই যে, এ ব্যক্তিই জুমেলিয়াকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছিল, এ তার এই গুপ্তরহস্য ও তাহার জীবিত থাকার কথা অবগত ছিল; পাছে এই লোকটা পরে সেই সকল কথা অন্তের কাছে প্রকাশ করে, এই ভয়ে জুমেলিয়া ইহাকে হত্যা করেছে। মনে করেছে সে, সে এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ হ’তে পেরেছে; সকলেই এখন বুঝবে, জুমেলিয়ার মৃত্যু হয়েছে, এখন আর কেহ তার সন্ধানে ফিরবে না।
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় সেখানকার সকলেই অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন।
রামকৃষ্ণ বাবু বলিলেন, “দেবেন্দ্র বাবু, তোমার সেই পত্রের সঙ্গে একটা বিষয় ঠিক মিলছে না; তোমার সেই পত্রের হিসাবে যদি ধরা যায়, তা’ হ’লে এই লোকটার মৃতদেহ পাঁচদিন এইখানে আছে, কেমন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হঁ৷ ”
বুামকৃষ্ণ বাবু কহিলেন, “এ মৃতদেহ পাঁচদিনের বলে কিছুতেই বোধ হয় না; বেশ টাটুকা রয়েছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “এর দুটী কারণ আছে।”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট জিজ্ঞাসিলেন, “পাঁচদিনের মড়া এমন টাট্‌কা থাকবার কারণ কি, বলুন দেখি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “প্রথম কারণ, লোকটাকে হঠাৎ হত্য করা হয়েছে, শরীরের সমস্ত রক্ত বাহির হইতে পারে নাই। দ্বিতীয় কারণ, মৃত্যুর পরেই বিনা-বিলম্বে কবরস্থ করায় বাহিরের বাতাস অধিকক্ষণ এ মৃতদেহে সঞ্চালিত হ’তে পারে নাই।”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বলিলেন, “তা যেন হ’ল, কিন্তু এখন এ খুনটার তদন্ত করা বিশেষ আবশ্যক। জুমেলিয়ার দ্বারা কি প্রকারে এ খুন হ’তে পারে? তাকে যখন কবর দেওয়া হয়, সঙ্গে কোন অস্ত্র-শস্ত্র দেওয়া হয়েছিল কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিল্লেন, “স্বীকার করি, ছিল না; কিন্তু এই হতভাগ্য যখন জুমেলিয়াকে উদ্ধার করতে আসে, তখন যে এর কাছে কোন প্রকার সাংঘাতিক অস্ত্র ছিল না—এ কথা সম্ভব নয়। ডাকিনী নিজ অভীষ্টসিদ্ধ করবে ব’লে কোন ছলে ইহারই সেই অস্ত্র গ্রহণ ক’রে থাকবে।
ইনস্পেক্টর রামকৃষ্ণ বাবু কহিলেন, “এস, এখন দেখা যাক, লোকটা কে। সে সন্ধান আগে ক’রে তার পর কিরূপে খুন হয়েছে, সে বিষয়ের মীমাংস হবে।
শবাধার হইতে শবদেহ বাহির করা হইল; শচীন্দ্র তৎ-পরীক্ষার্থে নিযুক্ত হইল; অন্তান্ত সকলে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
মৃতব্যক্তির পরিধানে সূক্ষ্ম দেশীবস্ত্র, ফুলদার মোগল-আস্তিন জামা, সাঁচ্চাজরীর কাজ করা টুপী, দক্ষিণ হস্তের অনামিকা ও মধ্যমাঙ্গুলিতে দুইটা হীরকাঙ্গুরী, জামার বুক পকেটে সোণার ঘড়ী ও চেইন। ভিতর কার পকেটে একখানি কলম-কাটা ছুরি, একটা রীংএ এক গোছা চাবী, বিশ টাকার একখানি নোট, চারিট টাকা, দুইটা সিকি, তিনটা দ্রুয়ানী, দুখানি রেশমী ( একখানি রংদার—একখানি সাদা ) রুমাল, একটা ক্ষুদ্র পিস্তল ও কয়েকখানি পত্র।
পত্রগুলি অন্তান্ত বিষয়-সম্বন্ধে লিখিত। সকলগুলির শিরোনাম ‘সেখ কবীরুদিন, সাং খিদিরপুর, মেটেবুরুজ * নং * * * লেন, লিখিত রহিয়াছে।
সেই মৃত ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা সম্বন্ধে আর কাহারও কোন সন্দেহ রহিল না। দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “রামকৃষ্ণ বাবু, জুমেলিয়াকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে, তা আমি অনুমানে কতকটা বুঝেছি।”
রামকৃষ্ণ বাবু জিজ্ঞাসিলেন, “কোথায়?”
দেবেন্দ্র। থিরোজা বিবির বাড়ীতে ঐ ঠিকানায় থিরোজা বিবির বাড়ী। রামকৃষ্ণ বাবু, এখন ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে, সব বুঝতে পেরেছ কি?
রাম। বড়ই অদ্ভূত, আমি হতবুদ্ধি হ’য়ে গেছি!
দে। জুমেলিয়াকে এখন কি বোধ কর? এমন অদ্ভূত স্ত্রীলোক আর কোথায়ও দেখেছ কি?
রা। না, পরেও যে কখন দেখতে পাব—বিশ্বাস হয় না। দেবেন্দ্র বাবু, তুমিও তাকে কিছু না-কিছু ভয় কর; কেমন কি না?
দে। তার বিক্রম আর বাহাদুরীকে আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, আর আমার স্ত্রীর উপরে তার যেরূপ গুঢ় অভিসন্ধি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে; কিন্তু ভয়? ‘ভয়’ কাকে বলে, তা আমি জানি না— ভয়’ শব্দটি সুমাৱ জন্মপত্রিকায় লেখা নাই।
রা। এখন তুমি কি করবে?
দে। তার সন্ধানে যাব।
রা। সন্ধান পাবে কি?
দে। সম্ভব—ন পেতে পারি; কিন্তু তা’ হ’লে এই আমার জীবনে প্রথম অকৃতকাৰ্য্যতা।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
থিরোজা বিবি

পরদিন বেলা দশটার সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় বুদ্ধ, মুসলমান-বেশে মেটেবুরুজে থিরোজা বাইএর বাটীতে উপস্থিত হইলেন—হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ।
দ্বারে বারদ্বয় করাঘাত করিবামাত্র একটী সুন্দরী স্ত্রীলোক দ্বারোদঘাটন করিয়া বাহিরে দেখা দিল। তাহার বয়স ছাবিবশ-সাতাশ বৎসর হইবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠনপ্রণালী পরিপাটি ও সুন্দর। রমণী সুন্দরী। কৃষ্ণতার নয়নের নিম্নপ্রান্তে অতি স্বল্প কজ্জলরেখা তাহার প্রচুরায়ত নয়ন যুগলের সমধিক শোভাবৰ্দ্ধন করিতেছে। পরিধানে প্রশস্ত সাচ্চাজরীর কাজ করা, সাঁচ্চা সন্মা-চুমকী বসান, ঘন নীলরঙ্গের পেশোয়াজ। উন্নত ও সুঠাম বক্ষোদেশে সবুজ রংএর সাটিনের কাঞ্চলী। তাহার উপরে হরিদ্বর্ণের সূক্ষ্ম ওড়না। টিকল নাসিকায় একটি ক্ষুদ্র নর্থ, একগাছি সরু রেশম দিয়া নথ হইতে কর্ণে টানা-বাধা। রমণী চম্পকবরণী, তাহাতে আবার নীলবসন; তাহার অনন্তরূপে সৌন্দৰ্য্যরাশি উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছে। এই সুন্দরীর নাম থিরোজা বাই।

ছদ্মবেশী দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখীন হইয়া থিরোজা বাই জিজ্ঞাসিল, “কে আপনি মহাশয়? কাহাকে খুঁজেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখানে কবীরুদ্দীন নামে কেহ থাকে?”
থিরোজা। হা মহাশয়, থাকে বটে।
দেবেন্দ্র। তার সঙ্গে কি এখন আমার সাক্ষাৎ হ’তে পারে?
থি। না, তিনি আজ তিন-চারিদিন কোথায় গেছেন, এখনও ফিরিয়া আসেন নাই। তাঁহার চলিয়া যাইবার পরে তাঁহার এক ভগিনী আসিয়াছেন; তিনিও তাঁহার দাদার সহিত দেখা করিবার জন্য এখনও অপেক্ষা করিতেছেন।
দে। কোন দিন কবীর ফিরবে, তা কি তাহার ভগিনী জানে?
থি। বলিতে পারি না।
দে। তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ দেখি?
থি। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেছি।
দে। কোথায়, কোন ঘরে কবীর থাকে?
থি। ত্রিতলের একটা বড় ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন।
দে। কবীরের ভগিনী আমার পর নয়, আমি তার কাকা হই; তার সঙ্গে দেখা করতে উপরে যেতে আমার বাধা কি? তুমিও আমার সঙ্গে এস।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
ছদ্মবেশে

থিরোজ বাই দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া ত্রিতলে উঠিল; তথায় যে কক্ষ কবীরুদ্দীনের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহা দেখাইয়া বাহিরে দণ্ডায়মান রহিল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন, তন্মধ্যে কেহ নাই। একপার্শ্বে একখানা টেবিল—নিকটেই একখানা চেয়ার পড়িয়া রহিয়াছে। দেবেন্দ্রবিজয় টেবিলের উপর দুইখানি পত্র পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন। থিরোজাকে ডাকিয়া বলিলেন, “কই, কেহ নাই ত!”
“চ’লে গেছেন–কখন গেলেন! কি আশ্চৰ্য্য, একি কথা! আমাকে কিছু বলে যান নি ত।” এই বলিয়া থিরোজ বাই সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল; বলিল, “তিনি ত বলিয়াছিলেন, তাহার দাদার সঙ্গে দেখা না ক’রে যাইবেন না।”
কক্ষমধ্যে টেবিলের উপর যে দুইখানি পত্র পড়িয়া ছিল, তাহার একখানি থিরোজ বাইএর, অপরখানি ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নামে।
“দুইখানি পত্র রেখে গেছে—একখানি ত আমার দেখছি; অপরখানি বুঝি তোমার—এই লও,” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় একখানি নিজে লইয়া অপরখানি থিরোজার হাতে দিলেন।
থিরোজ বাই বলিল, “তাই ত, আপনার জন্যও একখান লিখে গেছেন; আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, এ ইচ্ছা বোধ হয়, তার নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কবীরের না থাকতে পারে; কিন্তু তার ভগিনী আমার ভয়ে পালাবে কেন? কবীর যে পালাবে, তা আমি জানি। কবীর ভারি বখাট্‌, যতদূর ফিচেল ছোকরা হতে হয়—ছোঁড়াটা আমাকে চিরকাল জ্বালিয়ে মারলে!”
থিরোজা বাই তখনই তাহার পত্ৰখানি আপন-মনে পাঠ করিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় নিজের পত্ৰখানি নিজের চোখের সম্মুথে ধরিলেন বটে, কিন্তু দৃষ্টি রাখিলেন–থিরোজার পত্রের উপর। থিরোজার পত্রে বড় বেশি কিছু লেখা ছিল না, কেবল দুই-একটা বাজে কথামাত্র।
“তাই ত, স্ত্রীলোকটি এখন কিছুদিনের জন্য এখান থেকে চ’লে গেলেন। ব্যাপার কি, কিছু ত বুঝতে পারলেম না। লিখছেন, তার ভাই কবীর এখন আর ফিরবেন না।” গিরোজ বই এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কোথায় গেল, ত’ কিছু তোমার ত্রে লিখে নাই?”
“না, কই আমার পত্রে ত তা’ কিছু লেখেন নাই—আপনার পত্রে?”
“কিছু না—কিছু না।”
“কি জানি, তাদের মনের কথা কি?”
“আমার ভয়েই তা’র পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
“কেন, আপনাকে তাদের এত ভয় কেন?”
“আছে, একটা মস্ত ভয়ের কাজ কবীর ক’রে ফেলেছে।”
“কি রকম! কি রকম?”
“ইদানীং সে কি বড় ভাবত, বড় খিটখিটে মেজাজ হ’য়ে পড়েছিল?”
“হাঁ, তা কতকটা হয়েছিল বটে।”
“মুখখানা শুকিয়ে আমসী হ’য়ে গেছল কি না, বল দেখি?”
“হাঁ, মুখখান কেমন এক রকম ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে দেখাত।”
“বড় একটা কারও সঙ্গে কথাবার্তা, কি কোন বিষয়ে গল্প-সল্প করত না?”
“না, একেবারেই তিনি মুখ বন্ধ করেছিলেন।”
“কতদিন তুমি তাকে এ রকম দেখে আসছ?”
“প্রায় সপ্তাহ তিনেক।”
“এর ভিতর অনেক কথা আছে—শোন ত, বুঝতে পারবে।”
“বলুন।”
“হাঁ, তিন সপ্তাহ হবে, কবীর অন্ত আর একজনের নামে একখানা দলিলে জাল সই করেছে।”
“জাল!”
“হাঁ, জাল; এখন সেই কথা আদালতে উঠিবার উপক্রম হয়েছে—
সব প্রকাশ পেয়েছে।”
“অ্যাঁ, তবে ত বড় সৰ্ব্বনেশে কথা!”
“হাঁ, তবে একটা উপায় আছে।”
“কি?”
“সে যে নাম সহি করেছে, সে আমারই নাম।”
“তার পর?”
“তাই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম; এখন আমি তার সকল অপরাধ মার্জন করতে প্রস্তুত আছি; তার এ কলঙ্কের কথা ভুলে যেতে প্রস্তুত আছি; তার জন্য—তার এই বিপত্নদ্ধারের জন্য আমি শতাবধি টাকা সঙ্গেও এনেছি; মনে করেছিলাম, তাকে সেইগুলো দিয়ে যাতে ভবিষ্যতে আর এমন বদখেয়ালীতে হাত না দেয়, তা বুঝিয়ে বলব।”
“আপনি বড়ই সদাশয়, বড়ই দয়ালু আপনি।”
“দয়ালু হ’লে কি হবে? সে যে পাজীর পা-ঝাড়া—সে কি আমার দয়া চায়—না আমাকে মানে? বেকুব –বেকুব – বড়ই বেকুব বড় দুঃখের বিষয়, আমি তাকে কত ভালবাসি, সে একদিনও মনে বুঝে দেখলে না। যাই হ’ক, তুমি একটু অনুগ্রহ—”
[বাধা দিয়া] “কি বলুন, অনুগ্রহ আবার কি?”
“সে কিংবা তার সেই ভগিনী, আবার এখানে ফিরে আসতে পারে।”
“আমার তা’ ত বিশ্বাস হয় না।”
“চিঠি-পত্ৰও তোমাকে লিখতে পারে।”
“তা’ লিখতে পারেন, সম্ভব।”
“তা সে লিখ বেই লিখবে।”
“বেশ বেশ, তা’ হ’লে আমি তাকে পত্রদ্বারা আপনার কথা জানাব।”
“না, থিরোজা বিবি, তা হ’লে বড় মুস্কিল বেধে যাবে; সে ভারি একগুঁয়ে—ভারি বেয়াড় বদ্‌স্বভাব তার, আমার কথা এখন তার কাছে কিছুতে প্রকাশ ক’রে না—তাকে এখন কিছু ব’লে না—সে কোথায় থাকে, কেবল তাই তুমি গোপনে আমাকে পত্র লিখে জানাবে, তা’ হ’লেই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারব। আমার জন্য যে পত্ৰখানা রেখে গেছে, সে পত্রের কথা যদি জিজ্ঞাসা করে, তুমি ‘জানি না’ ব’লে একেবারে উডিয়ে দিয়ে। দাও, তোমার পত্রের একপাশে আমার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যাই।” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় থিরোজার হস্তস্থিত পত্ৰখানি লইয়া তাহার একপার্শ্বে উডেনপেন্সিলে অপ্রকৃত নামে নিজের ঠিকানা লিখিয়ু দিলেন। বলিলেন, “এখন তবে আসি—সেলাম।”
“সেলাম।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ
জুমেলিয়ার পত্র
“মায়াবিনী জুমেলিয়া, যথার্থই মায়াবিনী।” দেবেন্দ্রবিজয় থিরোজার বাটী ত্যাগ করিয়া যখন পথে বহির্গত হইলেন; আপনা-আপনি অনুচ্চস্বরে বলিলেন।
কবর অনুসন্ধান করা হইয়াছে এবং সে যে জীবিত আছে, এ কথা তিনি অবগত হইয়াছেন, তাহ জুমেলিয়া যে জানিতে পারিয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় অনুভবে তাহা বুঝিয়া লইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় গিরোজা বাইএর বাটীতে যে পত্ৰখানি পাইয়াছিলেন, তাহাতে তিনি সে বিষয়ের যথাসম্ভব প্রমাণও প্রাপ্ত হইলেন। কবীরের বাসায় তাহার ভগিনী বলিয়া যে সপ্তাহাধিককাল অবস্থিতি করিতেছিল, সে যে জুমেলিয়া ছাড়া আর কেহই নয়, তাহা বুঝিতে দেবেন্দ্রবিজয়ের বড় বিলম্ব হইল না।
পত্ৰখানি নূতন ধরণের—অতিশয় অলৌকিক! তাহার প্রতি ছত্রে জুমেলিয়ার সেই পৈশাচিক হৃদয় এবং কল্পনার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, আমরা তাহ অবিকল লিপিবদ্ধ করিলাম; —
“শ্ৰীল শ্রীযুক্ত মরণাপন্ন গোয়েন্দা
দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র
আমার হতগৰ্ব্ব প্রতিদ্বন্দী
মহাশয় সমীপেযু;—
আবার আমরা উভয়ে সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ। এইবার তোমার প্রতি আমার ভীষণ আক্রমণ অনিবাৰ্য্য। এ পর্য্যন্ত আমি ধীরে ধীরে, একটির পর একটি করিয়া, এক-একটি কাজ সমাধা করিয়া আসিতেছিলাম; এবার এখন হইতে তোমার বিরুদ্ধজনক আমার সকল উদ্যম অতি দ্রুত স্বসম্পন্ন হইবে।
তুমি কিছুই জানবে না—শুনবে না—জানতেও পারবে না, এমন ভাবে হঠাৎ আমি তোমাকে নিহত করিব। থাম—পত্রপাঠ অল্পক্ষণের নিমিত্ত একবার বন্ধ ক’রে আগে মনে মনে ভাল ক’রে ভেবে দেখ দেখি, আমি তোমাকে কত ঘৃণা করি! কেমন মেয়ে আমি!
আমি ভাবিয়াছিলাম, আঁধারে আঁধারে—গোপনে আমার এই কাৰ্য্য সিদ্ধ করিব; তাহ হইল না। আমি জীবিত আছি, তাহা তুমি জানিতে পারিয়াছ। পারিয়াছ? ক্ষতি কি?
আমি ভয় পাইবার—জুজু দেখিয়া আঁৎকে উঠিবার মেয়ে নহি! এ জুমেলিয়া! তোমাকে এক নিমেষে সাত-সমুদ্র তের-নদীর জল আস্বাদন করাইয়া আনিতে পারে।
গোয়েন্দা মহাশয় গো, এ বড় শক্ত মেয়ের পাল্লা—বড় শক্ত! বুঝিয়া-সুঝিয়া সুবিধা মত কাজে হাত দিলে ভাল করিতে। তুমি কি করিবে? তোমার পত্নীর বৈধব্য যে অবশ্যম্ভাবী।
জুমেলিয়া কেমন তোমাকে কাণে ধরিয়া ঘুরপাক খাওয়াইতেছে, বুঝিতে পারিতেছ কি? তা কি আর পার নাই!
আর বেশি দিন ঘুরিতে হইবে ন!—শীঘ্রই মরিবে—যমপুরী আলো করিবে। কেন বাপু, প্রাণটি খোয়াইতে জুমেলিয়ার সঙ্গে লাগিয়াছিলে? এই বেলা উইল-পত্র যাহা করিতে হয়, করিয়া ফেল। চিত্রগুপ্তের তালিকা-বহিতে তোমার নাম উঠিয়াছে।
যখন তুমি আর তোমার দুই-চারিজন বন্ধু আমার গোর খুড়ে শবাধার বহিরু কর, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ আমি সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত হই; গোপনে তোমাদের সকল কাৰ্য্যই দেখিয়াছি—সকল কথাই শুনিয়াছি।
কেমন করিয়া তুমি আমার এ গুপ্তচক্র ভেদ করিতে পারিলে— কেমন করিয়া তুমি গুপ্তসংবাদ জানিতে পারিয়াছিলে, তাহা আমি জানি না; কিন্তু বুঝিতে পারিয়াছিলাম, থিরোজ বিবির বাড়ীর ঠিকানা অনুসন্ধানে তোমরা পাইবে, এবং তাতে আমি কোথায় থাকিব, তাহী বুঝিয়া লইতে পারিবে।
দেবেন, তুমি ধূৰ্ত্ত বটে! বুদ্ধিমান বটে! যদি তুমি সৎপথাবলম্বী ন হইতে, যদি তুমি বুদ্ধিমান হইয়া এমন নিৰ্ব্বোধ না হইতে, আমি তোমাকে সত্য বলছি, তোমার এই তীক্ষবুদ্ধির জন্য আমি তোমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসতেম।
ডাক্তার ফুলসাহেব ছাড়া আমার সমকক্ষ হইতে পারে, এ পর্য্যন্ত আর কাহাকেও দেখি নাই; কেবল তোমাকেই এক্ষণে দেখিতেছি; তা’ বলিয়া তোমাকে আমি ভয় করিয়া চলি না—চলিবও না। আমি ত পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, জুমেলিয়া ভয় পাইবার মেয়ে নয়।
ফুলসাহেব বয়সে বড় ছিলেন; তুমি যুবা বটে, কিন্তু বড় ধৰ্ম্মভীরু। কি ভ্রম, তোমাকে ভালবাসিতে আমার প্রাণ চায়; চাহিলে হইবে কি, তুমি যা’ চাহিবে, তা আমি জানি; তুমি যে আমাকে ভালবাসিবে না—তা আমি জানি, তাই ত তোমার উপরে আমার এত ঘৃণা।
জুমেলিয়া শুধু ঘৃণা করিতে জানে না—জুমেলিয়া শুধু হিংসা করিতে জানে না—জুমেলিয়া শুধু শঠতা করিতে জানে না—জুমেলিয়া প্রাণ দিয়া ভালবাসিতেও জানে। যদি তুমি আমার প্রতি একবার প্রেম-কটাক্ষপাত করিতে, তাহা হইলে জানিতে পারিতে, জুমেলিয়া কেমন প্রাণ সঁপিয়া ভালবাসিতে জানে, কেমন সোহাগ করিতে জানে, কেমন আদর করিতে জানে, কেমন স্বৰ্গীয় সুখসাগরে প্রেমিককে ভাসাইতে জানে; বুঝিতে পারিতে, জুমেলিয়ার মুখচুম্বনে কত সুখ পাওয়া যায়! জুমেলিয়ার বুকে বুক বাখিলে কেমন তৃপ্তি হয়।
তুমি আমাকে মনোরমার বিষয়-সম্পত্তির অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়াছ, সেইজন্য আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি—তোমার স্ত্রীকে ঘৃণা করি—শচীন্দ্রকে ঘৃণা করি—শ্ৰীশচন্দ্রকে ঘৃণা করি—মনোরমাকে ঘৃণা করি—আরও দুই-চালিজনকে ঘৃণা করি।
তুমি আমাকে ভাল রকমে জান, আমি কোন অভিপ্রারে এত কথা লিখিতেছি, মনে মনে বুঝিয়া দেখিয়ো।
যাহাদের আমি ঘৃণা করি, তাহারা শীঘ্রই মরিবে।
আমি আমার বাসনা পূর্ণ করিবার নিমিত্ত বেশ একটা সদ্বপায় স্থির করিয়া রাখিয়াছি; যে সময়ে তোমাকে এই পত্র দ্বারা সতর্ক করা হইতেছে, সেই সময়ের মধ্যেই জুমেলিয়ার কাছে তুমি পরাজিত হইলে। সদা সাবধান থাকিয়ো।
আমি তোমার নারী-অরি
জুমেলা।”

নবম পরিচ্ছেদ
কুসংবাদ

পত্রের একস্থানে লিখিত আছে, জুমেলিয়ার প্রাগুক্ত পত্রপাঠ-সময়ের মধ্যেই দেবেন্দ্রবিজয় তাহার নিকটে পরাজিত হইয়াছেন। জুমেলিয়া যদিও মানবী—কিন্তু তাহার কল্পনায়—তাহার অভিরুচিতে—তাহার আচরণে—সে পিশাচী অপেক্ষা ও ভয়ঙ্করী।
দেবেন্দ্রবিজয় নিজের জন্য ভীত নহেন, তাহার স্নেহাম্পদগণের জন্য তিনি চিন্তিত ও উৎকন্তিত।
কে জানে, জুমেলিয়া এক্ষণে কাহাকে প্রথম আক্রমণ করিবে? কাহাকে সে প্রথম লক্ষ্য করিবে? দেবেন্দ্রবিজয় পকেটে পত্ৰখানি রাখিয়া গৃহাভিমুণে দ্রুতবেগে গমন করিলেন।

বাটীর সদর দরজায় শ্ৰীশচন্দ্র দণ্ডায়মান ছিল, দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া তাহার নয়নদ্বয় আনন্দোদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহা দেখিতে পাইলেন; জিজ্ঞাসিলেন, “শ্ৰীশ! তুমি এখানে? ব্যাপার কি?”
শ্ৰীশচন্দ্র উত্তরে কহিল, “যাই হ’ক , আপনাকে দেখে এখন ভরসা হ’ল, মাষ্টীর মশাই, বড়ই ভাবনা হচ্ছিল; মনে করেছিলাম না জানি, কি সৰ্ব্বনাশ হয়েছে!”
দেবেন্দ্র। কেন, এ কথা বলিতেছ কেন? কি হইয়াছে?
শ্ৰীশ। শুনলেম, আপনাকে না কি কে বিষ খাইয়েছে—আপনার জীবনের আশা নাই।
দে। কে এ সংবাদ দিল? কতক্ষণ এ সংবাদ পেয়েছ?
শ্ৰী। কেন? প্রায় দুইঘণ্টা হবে।
দে। কে এ সংবাদ দিয়েছে?
শ্ৰী। একজন পাহারা ওয়ালা।
দে। সংবাদটা কি?
শ্ৰী। পাহারাওয়ালাট এসে বললে, কে একট। মেয়ে মানুষ আপনাকে বিষ খাইয়েছে; আপনি অজ্ঞান হ’য়ে থানায় পড়ে আছেন; আপনার তাতে জীবনসংশয় ভেবে সেখানকার সকলেই ভয় পেয়েছে, সেইজন্য সে তাড়াতাড়ি মামী-মাকে* নিয়ে যেতে
এসেছিল।
দে। কোথায় যেতে হবে?
শ্ৰী। থানায়।
দে। তার সঙ্গে তিনি গেছেন? ত্র। না।
দে। ধন্য ঈশ্বর।
শ্ৰী। মামী-ম। তখনই তার সঙ্গে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে শচী দাদা এসে পড়েন।
দে। ঠিক সেই সময়ে?
শ্ৰী। হাঁ।
দে। ভাল, তার পর?
শ্ৰী। শচী দাদা এসে বললেন, তিনিই আপনাকে দেখতে যাবেন। মামী-মা তার সঙ্গে যেতে চাইলেন।
দে। তার পর?
শ্ৰী। তিনি মামী-মার কথায় কাণ দিলেন না।
দে। [ সহৰ্ষে ] শচীন্দ্র ভাল করেছে—বুদ্ধিমান ছোকরা—বুদ্ধির কাজই করেছে।
শ্ৰী। তিনি বললেন, ‘আমি আগে যাই, তাতে যদি মামা-বাবু আপনাকে নিয়ে যেতে বলেন, আমি খবর পাঠাব’। এ কথা মামী-ম। কিছুতেই শুনিবেন না; শেষে শচী দাদা অনেক ক’রে বুঝিয়ে রেখে একাই চ’লে গেলেন।
দে। যা হউক, বিপদটা ভালয় ভালয় কেটে গেছে; তোমার মামীমাকে গিয়ে বল, আমি এসেছি।
শ্রী। কই, এখনও মামী-মা ফিরে আসেন নি।
দে। [ সবিস্ময়ে ] ফিরে আসেন নি কি!
শ্ৰী। না, মাষ্টার মহাশয়।
দে। কোথায় গেলেন তিনি?
শ্রী। আপনাকে দেখতে।
দে। আমাকে দেখতে! এই না তুমি আমাকে বললে, শচীন্দ্রের নিকট হ’তে কোন খবর না এলে তিনি যাবেন না?
শ্ৰী। হাঁ তা’ত বললেম।
দে। [ ব্যগ্রভাবে ] তবে আবার তুমি এ কি বলছ?
শ্ৰী। শচী দাদা ত লোক পাঠিয়েছিলেন।
দে। [ সাশ্চর্য্যে ] অ্যাঁ!
শ্ৰী। তিনি ত মামী-মাকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন।
দে। কতক্ষণ?
শ্ৰী। প্রায় একঘণ্টা হ’ল।
দে। [ উদ্বেগে ] অ্যাঁ। তার পর—তার পর? শ্ৰীশ, বল—বল, শীঘ্র বল—যা’ জান তুমি শীঘ্র বল—কে এসেছিল? খবর নিয়ে কে আবার এসেছিল।
শ্ৰী। পাহারাওয়ালা।
দে। যে আগে এসেছিল সে-ই?
শ্ৰী। হাঁ, সে-ই।
দে। তুমি জান তাকে?
শ্ৰী। না।
দে। কি লোক সে?
শ্ৰী। মুসলমান।
দে। সে ফিরে এসে কি বললে?
শ্ৰী। কি বলবে? কিছুই না।
দে। ভাল, তার পর?
শ্ৰী। একখানা চিঠি এনেছিল।
দে। শচীন্দ্রের নিকট হ’তে?
শ্ৰী। হাঁ।
দে। তুমি সে চিঠি দেখেছ?
শ্ৰী। আমার কাছে সেখানা আছে।
দে। কই, কই দাও দেখি।
শ্ৰী। এই নিন। [ পত্র প্রদান ]
দেবেন্দ্রবিজয় সেই কাগজের টুকরাখানি লইয়া তখনই পাঠ করিলেন। তাহাতে লিখিত ছিল —
“মামী-মা! পত্র পাইবামাত্র আসিবেন; আপনার জন্য একখানা গাড়ী পাঠাইলাম—মামা-বাবুর অবস্থা বড় মন্দ।
শচীন্দ্র ”

—————-
[* শ্ৰীশচন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের পত্নী রেবতীকে শচীন্দ্রের ন্যায় মামী-মা বলিয়া ডাকিত।]

দশম পরিচ্ছেদ
“৩৫”

দেবেন্দ্রবিজয় হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন; বিস্ময়, ক্রোধ ও আশঙ্কা যুগপৎ তাঁহার হৃদয় অধিকার করিল; এখনকার মত যন্ত্রণাময়, ভীষণ অবস্থা তিনি
জীবনে আর কখনও ভোগ করেন নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় কিঞ্চিৎ চিন্তার পর কহিলেন, “শ্ৰীশ, সে গাড়ীখান তুমি দেখেছ?”
শ্ৰীশচন্দ্র কহিল, “হাঁ, দেখেছি, গাড়ীখানা একেবারে বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ায়।”
“শচীন্দ্র প্রায় দুই ঘণ্টা গেছে?”
“হাঁ, দুই ঘণ্টা বেশ হবে।”
“তোমার মামী-মা একঘণ্টা গেছেন?”
“হাঁ।”
“কোথায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তিনি জানতেন?
“থানায়।”
“যেখানে শচীন্দ্র গেছে?”
“আজ্ঞে, হাঁ।”
“শচীন্দ্র কি যাবার সময় গাড়ীতে গিয়াছিল?”
“না, মহাশয়।”
“শচীন্দ্র যখন যায়, তখন পাহারাওয়ালা সঙ্গে গাড়ী আনে নাই?”
“না, গাড়ী দেখি নাই।”
“তবে হাটিয়া গিয়াছে?”
“হাঁ, তিনি দৌড়ে আপনাকে দেখতে গেলেন।”
“সে পাহারাওয়ালাও তখনই সঙ্গে ফিরে গিয়েছিল কি?”
“আজ্ঞে, গিয়েছিল।”
“শচীন্দ্রের সঙ্গে গিয়েছিল?”
“না মাষ্টার মহাশয়, পাহারাওয়ালা অন্ত পথ দিয়ে ছুটে গেল।”
“তুমি সে পাহারাওয়ালার কত নম্বর, জান?”
“জানি, ৩৫I”
“এখন যদি তুমি সে লোকটাকে দেখ, চিনতে পার?”
“আজ্ঞে হাঁ৷ ”
“তবে তুমি এখনই থানায় যাও, আমার নাম ক’রে রামকৃষ্ণ বাবুকে বল যে, আমি এখনই পয়ত্রিশ নম্বরের পাহারাওয়ালাকে চাই। তিনি তোমার সঙ্গে যেন তাকে পাঠান।”
তখনই শ্ৰীশচন্দ্র ঊর্দ্ধশ্বাসে থানার দিকে ছুটিল। দেবেন্দ্রবিজয় বহিৰ্ব্বাটীতে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।

এমন সম্মুখীন ভীষণ বিপদে হঠাৎ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে কাৰ্য্য সফল হওয়া দুরে থাক, বরং ইষ্ট করিতে বিষময় ফল প্রসব করিবে, তাহা দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন।
এখন তাঁহাকে ধীর ও সংযতচিত্তে একটির পর একটি করিয়া অনেকগুলি কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। রেবতীকে যে জুমেলিয়া অপহরণ করিয়াছে, তদ্বিয়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না।
এইজন্যই কি জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে পত্রে জানাইয়াছিল যে, তাহার পত্রপাঠ সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে তিনি পরাজিত হইলেন? রেবতী গোয়েন্দা-পত্নী—তাঁহাকে গৃহের বাহির করা বড় সহজ ব্যাপার নহে— সুবলীলায় সমাধা হইবারও নহে, জুমেলিয়া প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়াছে—অতি কৌশলপূৰ্ণ চাতুরীর খেলা খেলিয়াছে।

দ্বিতীয় খণ্ড – শঠে শাট্যং সমাচরেৎ

প্রথম পরিচ্ছেদ
সন্ধানে

রেবতী যতই কেন বুদ্ধিমতী হউন না, জুমেলিয়ার প্রতারণ-জলে ছিন্ন করা তাহার সাধ্যাতীত। যে লোক সংবাদ আনিয়াছিল, সে পাহারাওয়াল-পুলিশের লোক—বিশেষতঃ সেখানকার থানার ও রামকৃষ্ণ বাবুর তাঁবের; তাহাকে রেবতী কি প্রকারে সন্দেহ করিবেন? যদি সন্দেহের কিছু পাকিত, শচীন্দ্র পূৰ্ব্বেই চুটিয়া আসিয়া তাহাকে প্রকৃত সংবাদ জানাইত; কিন্তু তাহা না করিয়া সেই শচীন্দ্রই যখন তাঁহাকে যাইবার জন্য পত্র লিথিয়াছে, তখন আর রেবতীর অবিশ্বাসের
কারণ কোথায়?
আরও একটা বিশেষ চিন্ত দেবেন্দ্রবিজয়ের মস্তষ্ক একেবারে অস্থির করিয়া তুলিল; শচীন্দ্র এখনও ফিরিল না কেন, জুমেলিয়া কি প্রকারে তাহার প্রত্যাগমনে বাধা ঘটাইল?
পত্ৰখানি—যাহা শচীন্দ্রের লিখিত বলিয়া স্থিরীকৃত, সম্পূর্ণরূপে জাল; অবিকল শচীন্দ্রের হস্তলিপি, বেবতী তাহাতে সহজেই প্রবঞ্চিত হইয়াছেন। যাহাতে সামান্তমাত্র সন্দেহের সম্ভাবনা না থাকে, এইজন্য ষড়যন্ত্রকারীরা শচীন্দ্রের প্রস্থানের পর আরও একঘণ্টা সময় অপেক্ষা করিয়া, শচীন্দ্রের নামে জাল পত্র লিখিয়া আনিয়া রেবতীর হস্তে অর্পণ করিয়া থাকিবে।
কি ভয়ানক জটিল চাতুরী! এখন—এমন –সময়ে—এই বিপৎকালে দেবেন্দ্রবিজয় অপেক্ষা করিয়া থাকা ভিন্ন আর কি করিবেন? গায়ের জোরে রাস্তার ছুটিয়া বাহির হইলেই বা কি হইবে – কি উপকার দর্শিবে? কাহাকে উপায় জিজ্ঞাসিবেন? দেবেন্দ্রবিজয় অপেক্ষা আর কে এ
সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞাত আছে?
কাজেই তখন তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে এবং কি করিবেন, তাহাই ভাবিয়া ঠিক করিয়া লইতে হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিতে লাগিলেন, “অসম্ভব। শচীন্দ্রকে জুমেলিয়া এই দিনের বেলায় কখনই নিজের করায়ত্ত করিতে সক্ষম হয় নাই, অন্ত কোন কৌশলে তাকে মিথ্যানুসরণে দুরে ফেলেছে; তাই সে এখনও ফিরে নাই; পিশাচী জুমেলিয়া সহজে স্বকাৰ্য্য সমাধা করেছে; আপাততঃ কোন সুবিধার অপেক্ষায় থাকা আমার কর্তব্য।”
কিয়ৎক্ষণ পরে শ্ৰীশচন্দ্র ৩৫নং পাহারাওয়ালাকে সমভিব্যাহারে লইয়া উপস্থিত হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই পাহারাওয়ালাকে “তুমি এইখানে বস; এখনই আমি আসছি, বলিয়৷ শ্ৰীশচন্দ্রকে লইয়া কক্ষান্তরে গমন করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “শ্ৰীশ, কি বুঝলে?”
“এ সে লোক নয়।”
“আমিও তা জানি।”
“এর নাম আবদুল।”
“তুমি একে চেন কি ?”
“ভাল রকম চিনি, ছেলেবেলা থেকে ওকে দেখে আসছি।”
“চেষ্টা করলে তোমার উপরে কিছু চালাকি চালাতে পারে কি?”
“না।“
* * * * *
দেবেন্দ্রবিজয় বৈঠকখানাগৃহে তখনই ফিরিলেন। পাহারাওয়ালাকে জিজ্ঞাসিলেন, “আবদুল, আড়াইঘণ্টা পূৰ্ব্বে তুমি কোথায় ছিলে?”
পাহারাওয়ালা বলিল, “বাড়ীতে মশাই।”
“কোথায় তোমার বাড়ী?”
“এই রাজার বাগানে ৷”
“আজ কোন জিনিষ তুমি হারিয়েছ?”
“ই মহাশয়, আমার চাপ্‌রাসখানা।”
“কখন—কেমন ক’রে হারালে?”
“তখন আমি ঘুমুচ্ছিলেম, একজন লোক এসে আমার স্ত্রীর নিকটে চাপ্‌রাসখানা চায়, তাতে আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করে, কোন চাপ্‌রাস?”
“যেখানা পাহরাওয়ালা সাহেব মেরামত করতে দিবে বলেছিল।”
“তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন’, আমার স্ত্রী তাকে বলে।”
“তাতে সে বলে ‘আজ আমার হাত খালি আছে, চাপ্‌রাসথান ঠিকঠাক ক’রে ফেলব; এর পর পেরে উঠব না; আজ সন্ধ্যার পরেই অনেক কাজ আসবে; চাপ্‌রাস কি—একমাস আমি আর কোন কাজ হাতে করতে পারব না; যদি পার, খুঁজে বের করে এনে দাও, ছ’ঘণ্টার মধ্যে আমি ঠিক ক’রে দিয়ে যাব।’ আমার স্ত্রী তাকে তখন আমার চাপ্‌রাস খানা বের ক’রে দেয়।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ইহার মধ্যে তুমি কোন লোককে তোমার চাপ্‌রাস মেরামতের কথা বলেছিলে?”
পাহারাওয়ালা! হাঁ। এ বড় মজার কথা দেখছি।
দেবেন্দ্র। কি রকম?
পা। তার পর যখন আমার ঘুম ভাঙে, আমার স্ত্রী আমাকে সকল কথাই বললে। কিছুদিন হ’ল, আমি নীলু মিস্ত্রীকে আমার চাপ্‌রাসটা পালিস করে দিতে বলেছিলেম, তাতে ভাবলেম, নীলু মিস্ত্রীই চাপ্‌রাসখানা নিয়ে গেছে।
দে। ভাল, তার পর?
পা। আমি তখনই নীলু মিস্ত্রীর কাছে যাই, সে আমার কথা শুনে একেবারে আশ্চৰ্য্য হ’য়ে গেল; চাপরাসের কথা সে কিছুই জানে না।
দে। যে লোকটা তোমার স্ত্রীর কাছ থেকে চাপ্‌রাসখানা নিয়ে গিয়ে ছিল, তার চেহারা কেমন—তোমার স্ত্রী সে বিষয়ে কিছু বলতে পারে?
পা। তাই ত বলছি মশাই, বড়ই মজার কথা! আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে যে চেহারার কথা বললে, তাতে নীলু মিস্ত্রীকেই বেশ বুঝায়।
দে। তুমি এখন কি বুঝছ?
পা। বুঝব আর কি? আমি দশ বৎসর নীলু মিস্ত্রীকে দেখে আসছি, সে খুব ভাল লোক; সে যেকালে কালীর দোহাই দিয়ে, ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে বললে, সে আমার চাপ্‌রাসের কথা কিছুই জানে না, তাতে তার কথা আমি কি ক’রে অবিশ্বাস করি?
দে। তোমার স্ত্রীর নিকট হ’তে চাপ্‌রাসখানা কেউ ফাকি দিয়ে নিয়েছে ব’লে বোধ হয় কি?
পা। হাঁ, তাই এখন আমার বেশ বোধ হচ্ছে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শচীন্দ্রের প্রবেশ

দেবেন্দ্রবিজয় তখনই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার নিমিত্ত বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন; বুঝিলেন, শচীন্দ্রের অপেক্ষায় আর বিলম্ব করা শ্রেয়ঃ নহে। যখন তিনি আবশ্যক মত ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া গমনোদ্যত হইয়াছেন, বহির্দ্বারে বানাৎ করিয়া কি একটা শব্দ হইল; কে যেন সজোরে দ্বার উন্মুক্ত করিয়া ফেলিল—তৎপরে অতিদ্রুত পদশব্দ। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, সে পদশব্দ শচীন্দ্রের। তখন শচীন্দ্র অতিদ্রুত সোপানারোহণ করিতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় তাহার দুই হস্ত ধরিয়া টানিয়া লইয়া শয়নকক্ষে প্রবিষ্ট হইলেন; জিজ্ঞাসিলেন, “শচীন্দ্র, ব্যাপার কি! কি হয়েছিল তোমার?”
শচীন্দ্র। এতক্ষণ আমি অজ্ঞান হ’য়ে পড়েছিলাম; একটা লোক পিছন দিক থেকে আমায় লাঠী মারে।
দেবেন্দ্র। কখন, কোথায়?
শ। পদ্মপুকুরের বড় রাস্তা ছেড়ে যেমন জেলে-পাড়ার ভিতর ঢুকেছি।
দে। কোথায় লাঠী মেরেছে?
শ। মাথার উপরে। ,
দে। কে মেরেছে, জান?
শ। আমি তাকে দেখি নি, তখুন সেখানে যারা ছিল, তাদের মুখে শুনলেম, একজন মুসলমান।
দে। সে পালিয়েছে?
শ। হাঁ।
দে। কোথায় লাঠী মেরেছে দেখি, মাথা ফেটে যায় নাই ত?
শ। না, উপরকার একটু চামড়া কেটে গিয়ে খানিকট রক্ত বেরিয়ে গেছে। আঘাত সাঙ্ঘাতিক নয়—ব্রজেন্দ্র ডাক্তারের ডিস্পেন্সারীর সম্মুখে অজ্ঞান হ’য়ে পড়ি; ডাক্তার-বাবু তখন তথায় ছিলেন। আমাকে তখনই তার ডিস্পেন্সারীতে তুলে নিয়ে গিয়ে যেখানটা কেটে গিয়েছিল, সেখানটায় ঔষধ দিয়ে রক্ত বন্ধ ক’রে দিয়েছেন। ষা’ই হ’ক, মামী-মা’র জন্যই আমার সন্ধান নিতে যাওয়া —মামী-মা কোথায়? .
দে। নাই—বাড়ীতে নাই!
শ। সে কি!
দে। ষড়যন্ত্রকারীরা আবার লোক পাঠিয়েছিল; তোমার নাম জাল ক’রে একখানা পত্র লিখে পাঠায়।
শ। তবে মামী-মা কি আবার জুমেলিয়ার হাতে পড়েছে?
দে। জুমেলিয়া ভিন্ন কে আর এমন সাহস করবে? কার সাহস হবে? কে আর দেবেন্দ্রের উপর এমন চাতুরীর খেলা খেলতে পারে? আমি এখনই চললেম।
শ। কোথায়?
দে। রাজার বাগানে নীলু মিস্ত্রীর বাড়ীতে।
শ। সেখানে কেন, মামা-বাবু? কি হয়েছে—আমায় সব কথা ভেঙে বলুন।
দে। আবদুল পাহারাওয়ালার চাপ্‌রাস চুরি গেছে। নীলু মিস্ত্রীকে সে চাপ্‌রাস পালিস করতে দিব বলেছিল; তার অজ্ঞাতে তার স্ত্রীর কাছ থেকে নীলু মিস্ত্রী সে চাপ্‌রাস চেয়ে নিয়ে যায়; এখন অস্বীকার করছে—এখন আমাকে—
দেবেন্দ্রবিজয়ের কথা সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে সদর দরজায় আবার একটা উচ্চ শব্দে আঘাত হইল; তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া আসিয়া শ্ৰীশচন্দ্র একখানি পত্র হস্তে সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল, পত্ৰখানি সে দেবেন্দ্র বিজয়ের হাতে দিল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
জুমেলিয়ার দ্বিতীয় পত্র

দেবেন্দ্রবিজয় তখনই সেই পত্র পাঠ করিলেন;–
“দেবেন্দ্রবিজয়!
তোমার স্ত্রী এখন আমার হাতে পড়িয়াছে ৷ আমি তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারি কি না, তাহ এখন তোমার উপর নির্ভর করিতেছে। সে এখন আমার কোন ঔষধ—কোন দ্রব্যগুণে অচেতন হইয়া আছে; যদি যথাসময়ে ঠিক সেই ঔষধের কাটান ঔষধ দেওয়া যায়, তাহ হইলে তোমার স্ত্রীর কোন ক্ষতি হইবে না। তার জীবন ও মৃত্যু তোমার হাতে; তুমি জান—তুমি বলিতে পার, সে বাচিবে কি মরিবে।
যদি এখন আমি তাহাকে তাহার সেই অজ্ঞান অবস্থায় তোমার হাতে দিই; কোন ডাক্তার, কোন কবিরাজ, যত নামজাদা ভাল চিকিৎসক হউক না কেন, কেহই রক্ষা করিতে পরিবে না। সকলেই তাহাকে মৃত বলিয়াই বিবেচনা করিবে—কিন্তু সে জীবিত আছে।
তোমার নিকটে আমার এক প্রস্তাব আছে; আমি জানি, তোমার কথা তুমি ঠিক বজায় রাখিয়া থাক ও রাখিতে পার। প্রস্তাব কি—পরে জানিতে পারিবে; আমার প্রাণের ভিতরে এখন আশা ও নৈরাপ্ত উভয়ে মিলিয়া বড়ই উৎপাত করিতেছে।
অন্তরাত্রি ঠিক এগারটার পর বালিগঞ্জের বাগান-বাড়ীতে সাক্ষাৎ করিবে; লাহিড়ীদের বাগান, বাগানের পশ্চিম প্রান্তে যে কাঠের ঘর আছে, সেইখানে সাক্ষাৎ করিবে। আসিবার সময়ে সঙ্গে কোন অস্ত্রশস্ত্ৰ আনিয়ো না; আমার সঙ্গে দেখা হইলে বিনাবাক্যব্যয়ে আমার অনুসরণ করিবে; যেখানে আমি তোমাকে লইয়া যাইব, তোমাকে যাইতে হইবে; ইচ্ছা আছে, তোমার পত্নীকে মুক্তি দিবার জন্য একটা সুপরামর্শ ও সন্ধি স্থির করিব।
যদি তুমি অপর কাহাকেও সঙ্গে লইয়া এস, আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না—আমাকে দেখিতে পাইবে না; যদি তুমি আমাকে গ্রেপ্তার করিতে কি আমার কোন ক্ষতি করিতে চেষ্টা কর, তোমার স্ত্রী অসহায় অবস্থায় অতিশয় যন্ত্রণা • পাইরা দন্ধিয়া দন্ধিয়া মরিবে; কেহই তাহাকে বাঁচাইতে পারিবে না; ইতোমধ্যে যদি তুমি আমাকে হত্যা কর, তোমার স্ত্রীর মৃত্যু অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিবে—তুমি আমাকে জান।
যেখানে যখন সাক্ষাৎ করিতে লিখিলাম, আমি ঠিক সেই সময়ে তোমার সহিত একা আসিয়া দেখা করিব। তোমার নিকটে আমি যে প্রস্তাব করিব, তাহাতে যদি তুমি অসম্মত হও, শেষ ফল কি ঘটে, জানিতে পারিবে। আমি তোমার প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতেছি, তোমার কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অনিষ্ট ঘটিবে না। তুমি একাকী আসিয়ে, আশঙ্কা করিবার কোন কারণ নাই। আমার যাহা অনুরোধ, তোমার নিকটে বলা হইলে, তাহাতে তুমি সন্মত হও বা না হও, স্বচ্ছন্দে তোমার নিজের বাড়ীতে তুমি ফিরিবে। যতক্ষণ না তুমি বাড়ীতে ফিরিয়া যাও, ততক্ষণ জুমেলিয়া তোমার প্রতি শক্ৰতাচরণ করিবে না। তুমি গৃহে উপস্থিত হইলে—যেমন এখন আছ—তোমার যেমন অবস্থা হইতে তোমাকে আমি ডাকিতেছি, যতক্ষণ ঠিক তেমন অবস্থায় না ফিরিবে, ততক্ষণ জুমেলিয়া চুপ করিয়া থাকিবে—তোমার কোন অনিষ্ট করিবে না। এমন কি অপর কোন শক্র কর্তৃক যদি তোমার একটি কেশের অপচয় ঘটিবার কোন সম্ভাবনা দেখে, জুমেলিয়া প্রাণপণে তাহাও হইতে দিবে না।
তুমিই এখনও তোমার পত্নীর জীবন রক্ষা করিতে পার; কি প্রকারে পার, তাহা এখন বলিব না; রাত এগারটার পর দেখা করিলে বলিব।
স্মরণ থাকে যেন, তোমার স্ত্রী এখন বাইশ হাত জলে পড়িয়াছে।
তুমি আমাকে জান—
জুমেল।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
****

পত্রপাঠ সমাপ্তে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া গেল—মলিন মুখ আরও মলিন হইয়া পড়িল; শ্রীশচন্দ্রকে দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “শ্রীশ, এ পত্র তুমি কোথায় পাইলে?
শ্ৰীশ। বাড়ীর সামনে।
দেবেন্দ্র। কে দিয়েছে?
শ্ৰী। একটা ছোড়া।
দে। সে কোথায় পাইল, জিজ্ঞাসা করেছিলে?
শ্ৰী। ই, সে বললে, একটা বুড়ী এসে তার হাতে পত্ৰখানা দিয়ে আমাদের বাড়ী দেখিয়ে দেয়; বুড়ী তাকে একটা চকচকে টাকা দিয়ে গেছে।
দে। আচ্ছ, এখন তুমি যাও।
শ্ৰীশচন্দ্র প্রস্থান করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পত্ৰখানি পড়িয়া দেখ।”
শচীন্দ্র মনে মনে পত্ৰখানি আগাগোড়া পড়িয়া লইল। তৎপরে জিজ্ঞাসিল, “মামা-বাবু, আপনি কি তবে সেখানে যাবেন?”
“হাঁ, যাইতে হইবে বৈকি।”
“যাইয়া কি করিবেন?”
“না যাইয়াই বা করিব কি?”
“যাইয়াই বা করিবেন কি?”
“জুমেলিয়া পত্রে সত্যকথাই লিখেছে।”
“এ সত্য, তার অন্তান্ত সত্যের ন্যায়।”
“আমার বিশ্বাস, এবার সে পত্রে সত্যকথাই লিখেছে।”
“তবে আপনি যাইবেন?”
“হাঁ।”
“সে না প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, আপনাকে হত্যা করিবে?”
“হাঁ, তা? আমি জানি—মনে আছে।”
“শুধু আপনাকে নয়, মামী-মাকে, শ্ৰীশকে আর আমাকে ৷”
“হাঁ।”
“মামা-বাবু, এ আবার জুমেলিয়ার নূতন ফাঁদ; এ ফাঁদে মামী-মাকে আর আপনাকে সে আগে ফেলিতে চায়।”
“এ কথা আমি বিশ্বাস করি।”
“তথাপি আপনি যাইবেন?”
“তথাপি আমি যাইব।”
“আমাকে সঙ্গে লইবেন না?”
“না।”
“কেন?”
“তাহা হইলে আমার অভিপ্রায় পুর্ণ করিতে পারিব না।”
“সে অভিপ্রায় কি?”
“সময়ে সব জানিতে পারিবে, এখন এই যথেষ্ট; তবে এইটুকু জানিয়া রাখ, ডাকিনী আমাকে ডাকে নাই নিজের মৃত্যুকে ডাকিয়াছে—তার দিন ফুরাইয়াছে।”
“মামা-বাবু, আপনি তার প্রস্তাবে সম্মত হবেন?”
“কি তার প্রস্তাব, আগে জানি; তার পর সে বিষয়ের মীমাংসা হবে।”
“আমি এখন কি করিব?”
“কিছুই না।”
“বড় শক্ত কাজ!”
“তা আমি জানি; থাম—বলছি।”
“বলুন।”
“সন্ধ্যার একঘণ্টা পরে, তুমি ভিক্ষুকের বেশে ঐ বাগানের ভিতরে যাবে; যে কাঠের ঘরের কথা পত্রে আছে, সেই ঘরের কাছে কোন গাছের আড়ালে লুকাইয়া থাকিবে; দেখিবে, কে কি করে, কে কোথায় যায়। খুব সাবধান, কেউ যেন তোমায় দেখিতে না পায়। আমি রাত এগারটার সময় যাইব।”
“নিরস্ত্র অবস্থায় যাবেন কি?”
“অস্ত্রছাড়া তোমার মামা-বাবু কখনও বাড়ীর বাহির হন নাই— হবেনও না। আমি জুমেলিয়ার অনুসরণ করিব, তুমিও অলক্ষ্যে আমার অনুসরণ করিবে। কিন্তু দেখিয়ো—খুব সাবধান, যেন তোমাকে তখন সে দেখিতে না পায়। আমি যাইবার সময়ে পকেটে করিয়া কতকগুলি ধান লইয়া যাইব, যে পথে যাইব, সেই পথে আমি সেগুলি ছড়াইতে ছড়াইতে যাইব; সেগুলি ফেলিবার সময়ে বড় একটা শব্দ হ’বার সম্ভাবনা নাই; তুমি সেই ধানগুলির অনুসরণ করবে, তাহ হইলে আমার অনুসরণ করা হবে।”
“বেশ—বেশ।”
“জুমেলিয়া বড় সতর্ক—বড়ই চতুর; সে নিজের পথ আগে ভাল রকম পরিষ্কার না রেখে এ পথে পা দেয় নাই; আগে সে বুঝেছে, তার বিপদের কোন সম্ভাবনা নাই, তার পর আমাকে ডাকিয়ে পাঠিয়েছে। সে জানে, একবার আমার হাতে পড়িলে তাহার নিস্তার নাই; একবিন্দু দয়াও সে অামার কাছে আশা করিতে পারিবে না। তোমার এখন কাজ হইতেছে, তুমি দেখিবে, সে আত্মরক্ষার জন্য কিরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছে; কে এখন তার সহযোগী হইয়াছে। আমার কথামত ধান দেখিয়া আমার সন্ধান লইবে; যখন সন্ধান পাইবে—যেখানে আমি থাকিব, জানিতে পরিবে, তখন তথায় অপেক্ষণ করিবে; যতক্ষণ না আমি তোমাকে ইঙ্গিতে জানাই, ততক্ষণ অপেক্ষা করিবে।”
“কিরূপে ইঙ্গিত করিবেন?”
“যখন উপর্যুপরি দুইবার পিস্তলের আওয়াজ হইবে, তখনই তুমি আমার নিকটে উপস্থিত হইবে। যতক্ষণ পৰ্য্যন্ত তুমি পিস্তলের শব্দ শুনিতে না পাও, ততক্ষণ তোমাকে আর কিছু করিতে হইবে না, কেবল অপেক্ষায় থাকিবে।”
“বেশ, আমি আপনার আদেশমতই কাজ করিব।”
“শচী! আমাদের জীবনের এ বড় সহজ উদ্যম নয়; এ উদ্যম বিফল হ’লে আমাদের মৃত্যু অনিবাৰ্য্য। এ পর্য্যন্ত আমরা যত ভয়ঙ্কর কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সে সকলের অপেক্ষা এখন বেশি পরিশ্রম— বেশি বুদ্ধি—বেশি কৌশল আবশ্যক করে। তোমার মামী-মার জীবন ত এখন সঙ্কটাপন্ন; এমন কি আমার প্রাণও আজিকার রাত্রির কাৰ্য্যের উপর নির্ভর করিতেছে; প্রাণনাশের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। অথচ স্বেচ্ছায় সে কাৰ্য্য আমাদিগকে যে প্রকারে হউক, মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। আর শচী, যদি সে নারী-দানবী আমাকে পরাস্ত করে—আমার প্রাণনাশ করে, তুমি রহিলে, তুমি প্রাণপণে চেষ্টা পাইবে; তোমার হাতে তখন আমার সকল কৰ্ত্তব্য অর্পিত হইবে। যাও শচী, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও শচী, আমার কথাগুলি যেন বেশ স্মরণ থাকে; সেগুলি যেন ঠিক পালন করিতে পার, আর যদি তোমায় আমায় আর এ জীবনে সাক্ষাৎ না ঘটে, ভাল —সুৰ্ব্বশক্তিমান পরমেশ্বর আছেন, তিনি তোমায় রক্ষা করিবেন—তিনি তোমার সহায় হইবেন—তিনি তোমার মঙ্গল করিবেন—যাও, শচী।”
শচীন্দ্র স্নানমুখে—আর কোন কথা না বলিয়া—নয়নপ্রান্তের অশ্ররেখা মুছিয়া স্থান ত্যাগ করিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সাক্ষাতে

সেই দিবস রাত্রি সাড়ে দশটার পর দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে বাহির হইলেন। লাহিড়ীদের উদ্যানে উপস্থিত হইতে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা অতিবাহিত হইল। এগারটা বাজিতে আর বেশি বিলম্ব নাই। দেবেন্দ্রবিজয় উদ্যানের পশ্চিম-প্রান্তের নির্দিষ্ট ঘরের সান্নিধ্যে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কেহই তথায় নাই।
স্থানটি সম্পূর্ণরূপে নির্জন এবং নীরব। কেবল কদাচিৎমাত্র ভগ্নবিশ্রাম কোন বিহঙ্গের পক্ষস্পন্দনশব্দ—কোথায় ক্বচিৎ শুষ্কপত্রপাতশব্দ– অতি দুরস্থ কুক্কুররব। বায়ু বহিতেছিল—দেহস্নিগ্ধকর, অতিমন্দ নিঃশব্দবায়ুমাত্র। যামিনী মধুর, পূর্ণেন্দুবিভাসিত, একান্ত শব্দমাত্রবিহীনা। মাধবী ঘামিনীর পরিষ্কৃত সুনীলগগনে স্নিগ্ধকিরণময় সুধাংশু নীরবে, ধীরে ধীরে নীলাঙ্গরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি উত্তীর্ণ হইতেছিল।
বৃক্ষমূলপার্শ্বে শচীন্দ্র লুকাইয়া ছিল; দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টি সৰ্ব্বাগ্রে সেইদিকে পড়িল—শচীন্দ্রও তাহার মাতুল মহাশয়কে দেখিল। উভদে উভয়কে দেখিলেন, কেহ কোন কথা কহিলেন না, আবশ্যক বোধ করিলেন না।
কিয়ৎক্ষণপরে—ঠিক যখন রাত্রি এগারটা, দেবেন্দবিজয় জ্যোংস্নালোকে কিয়দ্দূরে এক রমণীমূৰ্ত্তি দেখিতে পাইলেন। সে মূর্তি তাঁহার দিকে অতি দ্রুতগতিতে আসিতেছে। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, সে মূৰ্ত্তি আর কাহারও নহে—সেই পিশাচী জুমেলিয়ার।

জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে দুর হইতে দেখিবামাত্র জিজ্ঞাসিল, “এই যে দেবেন্দ্ৰ! এসেছ তুমি?”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “হাঁ, এসেছি আমি।”
জুমেলিয়া। মনে কিছুমাত্র ভয় হয় নাই?
দে। না, কাহাকে ভয় করিব?
জু। কেন, আমাকে?
দে। তোমাকে? না।
জু। তোমার মনে কি এখন কোন ভয় হইতেছে না?
দে। না।
জু। তোমার নিজের কথা বলছি না; অন্ত কাহারও জন্য তোমার ভয় হ’তে পারে হয়েছে কি?
দে। জুমেলা, আমি তোমাকে ভয় করি না।
জু। সঙ্গে কোন অস্ত্র আছে কি?
দে। তুমি যে নিষেধ করিয়াছ।
জু। ঠিক উত্তর হইল না।
দে ৷ হইতে পারে।
জু। তুমি কি সশস্ত্র?
দে। তুমি?
জু। হাঁ।
দে। তবে আমাকেও তাহাই জানিবে।
জু। কই, তা হ’লে তুমি আমার কথামত কাজ কর নাই।
দে। তোমার কথামত আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি—অস্ত্র থাক বা না থাক, তোমার সে কথায় এখন প্রয়োজন কি? যখন আমার হাতে কোন অস্ত্র দেখিবে, তখন জিজ্ঞাসা করিয়ো।
জু। তুমি সঙ্গে অস্ত্ৰ আনিয়াছ কেন?
দে। আবশ্যক হইলে তাহার সদ্ব্যবহার হইবে বলিয়া।
জু। নিৰ্ব্বোধ!
দে। নির্ববুদ্ধিতা আমার কি দেখিলে?
জু। আমি কি পূৰ্ব্বে তোমায় বলি নাই—যদি তুমি আমার আদেশ মত কাৰ্য্য না কর, তোমার স্ত্রী মরিবে?
দে। হাঁ, বলেছিলে।
জু। তবে কেন তোমার এ মতিভ্রম হইল? আমি যদি এখন এখান হইতে চলিয়া যাই—তুমি আমার কি করিবে?
দে। মনে করিলেই এখন আর যাইতে পার না।
জু। কি করিবে?
দে! এক পা সরিলে তোমাকে আমি হত্যা করিব।
জু! নিৰ্ব্বোধ, আবার?
দে। আবার কি?
জু। তোমায় নিতান্ত মতিছন্ন ধরিয়াছে দেখিতেছি—আমাকে হত্য করিলে তুমি তোমার প্রিয়তম স্ত্রীকে হত্যা করিবে, স্মরণ আছে?
দে। তথাপি আমি তোমাকে হত্যা করিব।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বনভূমিতে

“কর, তোমার পদতলে—তোমার নিকটস্থ গুপ্ত অসির সম্মুখে এই বুক পাতিয়া দিতেছি; কোন অস্ত্র শাণিত কবিয়া আনিয়াছ—জুমেলিয়ার বুকে বসাইয়া দাও। নির্দয় দেবেন–নিষ্ঠুর দেবেন্‌! সুন্দর বক্ষ অস্ত্রে বিদ্ধ করিতে, একজন স্ত্রীলোকের বক্ষ অস্ত্রদীর্ণ করিতে যদি তুমি কিছুমাত্র কাতর না হও, তাহাতে যদি তোমার আনন্দ হয়—কর পার কর—এই তোমার সম্মুখে বুক পাতিয়া দিলাম!”
এই বলিয়া জুমেলিয়া বক্ষের বসন ও কাঞ্চলী খুলিয়া দুরে ফেলিয়া দিল। জানু পাতিয়া বসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সমক্ষে সেই স্নিগ্ধ শশাঙ্ককরে কামদেবের লীলাক্ষেত্রতুল্য পীনোন্নত বক্ষ পাতিয়া দিল।
পাঠক! একবার ভাবিয়া দেখুন, এ দৃশ্য কতদূর কল্পনাতীত! মাথার উপরে নীলানন্ত নিৰ্ম্মল গগনে থাকিয়া শশী অনন্তকিরণপ্লাবনে জগৎ ভাসাইয়া সুধাহাসি হাসিতেছিল; কাছে—দুরে—এখানে— ওখানে থাকিয়া নক্ষত্রগুলা ঝিকমিক্‌ করিয়া জলিতেছিল। বৃক্ষাবলীর অগ্রভাগারূঢ়পত্রগুলি ধীরে সমীরে হেলিতে-ফুলিতেছিল; নিম্নে—পার্শ্বে— পশ্চাতে—দুরে—অতিদূরে অনন্ত নিস্তব্ধতা; সেই ঘোর নীরবতার মধ্যে শশিকিরণে আভূমিপ্রণত শুামলতা নীরবে চলিতেছিল; নীরবে জ্ঞতা গুলুমধ্যে শ্বেত, পীত, লোহিত ফুল্লফুলদল বিকসিত ছিল। সেই নির্জন, নীরব উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় দণ্ডায়মান; তাঁহার সম্মুখে— দৃষ্টিতলে অদ্ধবিবস্ত্রভাবে জুমেলিয়া চন্দ্রকরোজ্জল অনাচ্ছাদিত পীনোন্নত পীবর বক্ষ পাতিয়া বসিয়া।
দেবেন্দ্রবিজয় বিচলিত হইলেন, বারেক সৰ্ব্বাঙ্গ কঁপিয়া উঠিল; প্রত্যেক ধমনীর শোণিত-প্রবাহে যেন একটা অনুভূতপূৰ্ব্ব বৈদ্যুতিক প্রবাহ মিশিয়া সৰ্ব্বাঙ্গে অতি দ্রুতবেগে সঞ্চালিত হইতে লাগিল। কি বলিবেন,-স্থির করিতে না পারিয়া দেবেন্দ্রবিজর নীরবে রহিলেন।

জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে নীরবে এবং কিছু বা স্তম্ভিতভাবে থাকিতে দেখিয়া কহিল, “কি দেবেন, নীরব কেন? অস্ত্র বাহির কর; হাত ওঠে না কেন? ওঃ! যতদুর তোমাকে আমি নিষ্ঠুর মনে করেছিলাম, এখন বুঝিতে পারিতেছি, ততদুর তুমি নও; তবে অস্ত্র সঙ্গে আনিয়াছ কেন?”
“সময়ে আবশ্যক হইলে সদ্ব্যবহার-করিব বলিয়া।”
“বেশ, আপততঃ তোমার নিকটে যে-কোন অস্ত্র আছে, আমার হাতে দিতে পার?”
“না।”
“তবে তোমার নিকটে আমার কোন প্রস্তাব নাই; তোমার সঙ্গে তবে আমার সন্ধি হইল না।”
“ক্ষতি কি?”
“তবে কি দেবেন, তুমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিবে?”
“না, আমার কার্য্যসিদ্ধ করিতে আসিয়াছি।”
দেবেন্দ্রবিজয় এই কথাগুলি স্থির ও গম্ভীরস্বরে বলিলেন। এ স্থৈর্য্য, এ গাম্ভীৰ্য্য ঝটিকাপূৰ্ব্বে প্রকৃতি যেমন স্থির ও গম্ভীরভাব ধারণ করে, তদনুরূপ।
জুমেলিয়া ইহা বিশদরূপে বুঝিতে পারিয়া মনে মনে অত্যন্ত অস্থির হইতে লাগিল; তাহার মনের ভাব তখন বাহিরে কিছু প্রকাশ পাইল না।

জুমেলিয়া বলিল, “থাম, আর এক কথা, এখন তুমি আমার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করিবে?”
“কি, বল?”
“তুমি আজ তোমার অস্ত্র ব্যবহার করিবে না?”
“যদি না করিতে হয়—করিব না।”
“কি জন্য তুমি অস্ত্র ব্যবহার করিবে, স্থির করিয়াছ?”
“তোমার পত্রে যে সকল কথা স্থিরীকৃত আছে, সেই সকলের মধ্যে যদি একটার ও কোন ব্যতিক্রম ঘটে।”
“এই জন্য?”
“হাঁ, আরও কারণ আছে।”
“কি, বল।”
“যদি আমার স্ত্রীর জীবনরক্ষার্থে অবশ্যক হয়।”
“আবশ্যক হইবে না, আমি বলিতেছি—কোন আবশ্যক হইবে না, তোমার অস্ত্র ব্যবহারে তোমার স্ত্রীর জীবনরক্ষার্থে তুমি কোন ফল পাইবে না।”
“তা হ’লে অস্ত্র ব্যবহার করিব না।”
“নিশ্চয়?”
“নিশ্চয়।”

সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভিক্ষুক-বেশী

জুমেলিয়া। দেবেন, কেহ তোমার সঙ্গে এসেছে?
দেবেন্দ্র। না, তোমার কথামত কাজই করা হয়েছে।
জু। শচীন্দ্র এ সকল বিষয়ের কিছু জানে না?
দে। তুমি ত জান সে শয্যাশায়ী হয়েছে।
জু। হঁ, জানি।
দে। তবে জিজ্ঞাসা করিতেছ, কেন?
জু। তুমি যে এখানে একাকী আসিয়াছ, এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।
দে। অবিশ্বাসের কারণ কি আছে? আমি একাকী আসিয়াছি।
জু। দেবেন, তুমি যতই সতর্ক হও—যতই বুদ্ধিমান হও, কিছুতেই জুমেলিয়াকে ছাপাইয়া উঠিতে পরিবে না; আমি চক্ষের নিমেষে তোমায় খুন করিতে পারি।
দে। পার যদি, করিতেছ না কেন? আমার প্রতি এত দয়া প্রকাশের হেতু কি?
জু। আপাততঃ আমার সে ইচ্ছা নাই, আমিও প্রস্তুত নহি।
দে। জুমেলিয়া, অনৰ্থক বিলম্বে তোমার অনর্থ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ৷
জু। [ সহাস্তে ] মাইরি!
দে। শোন—মিথ্যা আমরা সময় নষ্ট করিতেছি, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাইবে বলিয়া পত্র লিখিয়াছিলে না?
জু। হাঁ।
দে। কোথায়?
জু। এমন কোথাও নয়; এই ঘে– [অঙ্গুলি নির্দেশে] দোতলা বাড়ীখানা দেখিতে পাইতেছ, উহার মধ্যে—ঐখানে তোমার রেবতী আছে। দেখিবে?
দে। চল, দেখিব।
জু। আর একটা প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে।
দে। কি, বল?
জু। আমার বিনানুমতিতে এমন কি তুমি তোমার স্ত্রীকে স্পর্শও করিতে পারিবে না;
দে। তাহাই হইবে, সম্মত হ’লেম, চল।
জু। যথেষ্ট।
দে। তবে চল।
জু। এস।

* * * * *

দেবেন্দ্রবিজয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া উদ্যানভূমি অতিক্রম করিয়া জুমেলিয়া ক্রমশঃ সেই অট্টালিকাভিমুখে চলিল।
সে অট্টালিকা উদ্যানের বাহিরে নয়, উদ্যানমধ্যে—পুৰ্ব্বপ্রান্তে; বহুদিন মেরামত না ঘটায় অনেক স্থলে জীর্ণ ও ভগ্নোমুখ—অনেক স্থানে বালি খসিয়া ইট বাহির হইয়া পড়িয়াছে—কোন কোন স্থান ইট খসিয়া একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।

দেবেন্দ্রবিজয় ও জুমেলিয়া যখন ক্রমশঃ সেই অট্টালিকাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, তখন ভিক্ষুকবেশী শচীন্দ্র বৃক্ষান্তরাল হইতে বাহির হইল; কোন পথে তাঁহারা কোন দিক্ দিয়া যাইতেছেন, তাহ স্থিরদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল; এইরূপে প্রায় পাঁচ মিনিট কাটিল। শচীন্দ্র সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিল।
যখন শচীন্দ্র সেইদিকে যাইবার জন্য একপদ সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে, আর এক ব্যক্তিকে সে সেইদিকে আসিতে দেখিল; তখনই তাড়াতাড়ি নিজের ছিন্ন শতগ্রন্থিযুক্ত উত্তরীয় বৃক্ষতলে পাতিয়া শয়ন করিল; কৃত্রিম নিদ্রার ভানে চক্ষু নিমীলিত করিয়া নাসিকা-স্বর আরম্ভ করিয়া সেই নীরব উদ্যানের নিদ্রিত পক্ষিবৃন্দকে ক্ষণেকের জন্য অত্যন্ত চমকিত ও মুখরিত করিয়া তুলিল।
সে লোকটা অতি শীঘ্রই শচীন্দ্রের নিকটে আসিল; আসিয়া সজোরে তাহার স্কন্ধে একটা সোহাগের চপেটাঘাত করিল।
শচীন্দ্র নিমীলিত নেত্রে পার্শ্বপরিবর্তন করিল। আবার সেই চপেটাঘাত। নিমীলিতনেত্রেই ভিক্ষুক বেশী শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা তুমি, পথ দেখ না, বাবা।”
সোহাগের সেই চপেটাঘাতের শব্দটা পূৰ্ব্বাপেক্ষ এবার কিঞ্চিৎ পরিমাণে উচ্চে উঠিল। শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা, পাহারাওয়ালাজী নাকি? বাবা, গাছতলায় পড়ে একপাশে ঘুমাচ্ছি, তা’ তোমার কোমল প্রাণে বুঝি আর সইল না? আদর ক’রে যে গুরুগম্ভীর চপেটাঘাতগুলি আরম্ভ ক’রে দিয়েছ, তা আমার অপরাধটা দেখলে কি?”
আগন্তুক বলিল, “আরে না, আমি পাহারাওয়াল নই।”
শচীন্দ্র বলিল, “কে বাবা, তবে তুমি? উপদেবতা নাকি? কেন বাবা গরীব মানুষ একপাশে পড়ে আছি, ঘাটাও কেন, বাবা? ভদ্রলোকের ঘুমটা ভেঙে দিয়ে তোমার কি এমন চতুৰ্ব্বৰ্গ লাভ হবে?”
আগন্তুক বলিল, “আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করতে এসেছি।”
শচীন্দ্র বলিল, “আমাকে জিজ্ঞাসা কেন? আমার চেয়ে মাথায় বড়, ভারিক্কেদরের তালগাছ রয়েছে, কিছু জিজ্ঞাসা করবার থাকে, তাকে কর গে; এখান থেকে পথ দেখ না, চাঁদ ”
আগন্তুক। আমি এদিকে এসে পথটা ঠাওর করতে পারছি না; যদি তুমি বলে দাও, বড় উপকার হয়।
শচীন্দ্র ৷ পথ দেখ; সিধে লোক-সিধে পথ দেখ।
আ। আমি পদ্মপুকুরের দিকে যাব; কোন পথ জান কি?
শ। কি, শ্বেতপদ্মের না নীলপদ্মের? আবার কি রামরাজা এই ঘোর কলিতে দুর্গোৎসব আরম্ভ করেছে না কি?
আ। আমাকে পদ্মপুকুরের পথটা ব’লে দাও; আমি তোমাকে একটা পয়সা দিচ্ছি।
শ। কেন বাপু, এতদিনের পর দাতাকর্ণের নামটা আজ হঠাৎ লোপ করবে?
আ। পাগল না কি তুমি?
শ। পাঁচজনে মিলে আমাকে তাই করেছে, দাদা; আর খোঁয়াড়ি ধরলে পাগল ত পাগল, সকল দিকেই গোল লেগে যায়। তবে চললেম মশাই, নমস্কার; ব্রাহ্মণ হও যদি—প্রণাম।
আ। কোথায় যাচ্ছ, তুমি?
শ। আর কোথায় যাব, শুঁড়ি-মামার সন্দর্শনে।
শচীন্দ্র তথা হইতে প্রস্থান করিলে অপর দিক দিয়া আগন্তুক চলিয় গেল।

* * * * *

কিয়ৎপরে আবার উভয়ের উদ্যানের অপর পার্শ্বে সাক্ষাৎ ঘটিল।
আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিল, “কই, শুড়ি-মামার কাছে গেলে না?
শচীন্দ্র সবিস্ময়ে বলিল, “তাই ত হে কৰ্ত্তা, আবার যে তুমি! আবার ঘুরেফিরে তোমারই কাছে এসে পড়েছি যে, নিশ্চয়ই পৃথিবী বেটী গোলাকার; নইলে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক তোমার কাছে আবার এসে উপস্থিত হ’ব কেন? আসি মশাই, নমস্কার; ব্রাহ্মণ হও যদি—প্রণাম।”
উদ্যান হইতে বহির্গমনের পথ ধরির শচীন্দ্র তথা হইতে প্রস্থান করিল। আগন্তুক অতি তীব্রভৃষ্টিতে—যতক্ষণ তাহাকে দেখিতে পাওয়ার গেল—দেখিতে লাগিল। না, এ লোককে ভয় করার কোন কারণ নাই; মাতাল—আধ-পাগল; যাক, আগে ভেবেছিলাম, বুঝি গোয়েন্দার কোন চর-টর হবে।” এই বলিয়া যে পথ দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ও জুমেলিয়া গমন করিয়াছিল, সেই পথে গমন করিতে লাগিল—
লোকটা জুমেলিয়ার চর।
———– ———
তখন ভিক্ষুক-বেশী শচীন্দ্র বেশীদূরে যায় নাই। যতক্ষণ না আগন্তক একেবারে দৃষ্টিপথ অতিক্রম করিল, ততক্ষণ শচীন্দ্র নিকটস্থ একটি বৃক্ষপার্শ্বে লুকাইয়া রহিল; তাহার পর সুবিধা মত গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইল; যে পথ দিয়া আগন্তুক চলিয়া গিয়াছিল, সেই পথ ধরিয়া চলিল।
শচীন্দ্রের গমনকালে বারংবার হস্তস্থিত ঘষ্টি হস্তচু্যত হইয়া ভূতলে পড়িয়া যাইতে লাগিল; বারংবার সে তাহা ভূতল হইতে প্রসন্নচিত্তে হাস্তমুখে তুলিয়া লইতে লাগিল।
এ হাসির কারণ বুঝিয়াছেন কি? দেবেন্দ্রবিজয় যে সকল ধান ছড়াইয়া নিশান করিয়া গিয়াছিলেন, ‘শচীন্দ্র এক্ষণে যষ্টি উঠাইবার ছলে, সেই সকল ধান দেখিয়া গন্তব্যপথ ধরিয়া চলিয়াছে।

তৃতীয় খণ্ড – পিশাচীর প্রেম

প্রথম পরিচ্ছেদ
আর এক ভাব

অনতিবিলম্বে জুমেলিয়া এবং তাহার অনুবর্তী হইয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই অসংস্কৃত অন্ধকারময় নিভৃত অট্টালিকা-সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
জুমেলিয়া কহিল, “এই বাড়ীর ভিতরে তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।”
“স্বচ্ছন্দে,” দেবেন্দ্রবিজয় প্রত্যুত্তরে কহিলেন।
“রেবতী এখানে আছে।”
“বেশ, আমাকে তার কাছে লইয়া চল।”
“এখন নয়, সুবিধা মত; আগে তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলি কথা আছে, এস।”

উভয়ে সেই বাটিমধ্যে প্রবেশিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন অন্ধকারময় প্রাঙ্গণে পড়িলেন, অমনি বস্ত্রাভ্যন্তরস্থ গুপ্তলণ্ঠন বাহির করিলেন, চতুর্দিক আলোকিত হইল; জুমেলিয়া, একবার চমকিত হইয়া উঠিল—কিছু বলিল না।
তাহার পর উভয়ে উত্তরপার্শ্বস্থিত সোপানীতিক্রম করিয়া দ্বিতলে উঠিলেন; তথাকার একটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। জুমেলিয়া সেই প্রকোষ্ঠের এক কোণে একটি মোমের বাতি জালাইয়া রাখিল; রাখিয়া বলিল, “দেবেন্দ্রবিজয় জান কি, কেন আমি তোমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছি?”
“না—জানি না।”
“তুমি জান, আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তোমাকে হত্যা করিব?”
“জানি।”
“শুধু তোমাকে নয়—তোমার সংসর্গে যারা আছে, তাদেরও?”
“তাহাও জানি।”
“তুমি কি বিশ্বাস কর, আমি প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিতে পারিব?”
“যদি পার—পূর্ণ করিবে।”
“আমি পারি।”
“ক্ষতি কি?”
“কিন্তু এখন আমার সে ইচ্ছা নাই; আমি তোমার সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করিতে চাই।”
“বটে! কোন বিষয়ে?”
“তুমি সে বিষয়টা কিছু অভিনব, কিছু আশ্চৰ্য্য বোধ করিবে। আমি এখনই আমার প্রতিহিংসা হইতে তোমাকে—তোমার স্ত্রীকে — শচীন্দ্রকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত আছি।”
“বটে, এর ভিতরেও তোমার অবশ্যই কোন গুঢ় অভিপ্রায় আছে।” “ছ, যদি তুমি আমার কথা রাখ—আমাকে সাহায্য কর, আমি ইচ্ছা করিতেছি—যত পাপ কাজ-সমস্তই ত্যাগ করিব; এখন হইতে সৎস্বভাব হইব।”
“সে সময় এখন আর আছে কি, জুমেলা?”
“আছে, এখনও অনেক সময় আছে—শুধরাইবার অনেক সময় আছে।”
“বল।”
“দেখ দেবেন, তুমি মনে করিলে আমি যাদের প্রাণনাশ করিতে একান্ত ইচ্ছুক, সামান্ত উপায়ে তাদের তুমি আমার প্রতিহিংসা হইতে উদ্ধার করিতে পার। সে উপায় কি? তুমি আমার স্বভাবের গতি ফিরাও, আমার মতি ফিরাও—যাতে আমি এখন হইতে সচ্চরিত্ৰ হ’তে পারি—সেই পথে নিয়ে যাও। তুমি আমাকে সদা-সর্বদা ‘পিশাচী’ কখন বা ‘দানবী’ বলে থাক; সেই দানবীকে—সেই পিশাচীকে তুমি মনে করিলে দেবী করিতে পার।”
“জুমেল, তোমার এ সকল কথার অর্থ কি?”
“উত্তর দাও, দেবেন! আমার কথার ঠিক ঠিক উত্তর দাও। ঠিক ক’রে বল দেখি, আমি কি বড় সুন্দরী?” [মৃদুহাস্যে কটাক্ষ করিল]
“হাঁ, তুমি সুন্দরী, এ কথা কে অস্বীকার করিবে?”
“কেমন সুন্দরী?”
“যদি তোমার অন্তরের জঘন্ততা তোমার মুখে প্রতিফলিত না হইত, দেখিতাম, তুমি সুন্দরী—তোমার মত সুন্দরী আমি কখনও দেখিয়াছি কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকিত।”
“মনোরমার* চেয়ে সুন্দরী?”
“রেবতীর চেয়ে?”
“হাঁ।”
“তুমি কি সুন্দরীর সৌন্দৰ্য্য ভালবাস না?”
“প্রশংসা করি বটে!”
“যদি আমার অন্তর হতে সমস্ত পাপের কালি মুছে যায়, তা’ হ’লে আমি তোমার মনোমত সুন্দরী হ’ব কি, দেবেন?”
“না, আমি তোমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি।”
“যদি কোন স্থানে তোমার মন বাধা না থাকিত, তা হ’লে তুমি কি আজ আমাকে ভালবাসিতে পারিতে, দেবেন?”
“না।”
এই কথাটাই চূড়ান্ত হইল, জুমেলিয়ার হৃদয় দুর দুর করিতে লাগিল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি বন্ধ হইল, মুখমণ্ডল একবার মুহূর্তের জন্য আরক্তিম হইয়া পরক্ষণেই একেবারে কালিমাছন্ন হইয় গেল। কিয়ৎপরে প্রকৃতিস্থ হইয়া পূৰ্ব্বাপেক্ষী মৃদুস্বরে, জুমেলিয়া বলিল, “তা’ হ’লেও তুমি আমাকে ভালবাসিতে পারিতে না, দেবেন—তা’ হ’লেও না?”
“ন!—তা’ হ’লেও না।”
“দেবেন্দ্রবিজয়! আমার বয়স এখন ছত্রিশ বৎসর। এই ছত্রিশ বৎসরের মধ্যে আমাকে অনেকে ভালবেসেছে; কিন্তু সে সকল লোকের মধ্যে আমি এমন কাহাকেও দেখি নাই, যাহাকে আমি তার ভালবাসার প্রতিদানেও কিছু ভালবাসিতে পারি; কিন্তু তুমি—তুমি— তোমাকে দেখে আমার মন একেবারে ধৈর্য্যহীন হ’য়ে পড়েছে। তুমি আমাকে ভালবাস না—ভালবাসা ত বহুদুরের কথা—তুমি আমার শক্ৰ—পরম শত্রু; তথাপি আমার প্রাণ তোমার পায়ে আশ্রয় পাবার জন্য একান্ত ব্যাকুল। আমি পুৰ্ব্বেই জানতে পেরেছিলাম, আমার এ লালসা আশাহীন, তাই আমি তোমাকে হত্যা করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’য়েছিলাম; স্থির করেছিলাম, তোমাকে হত্যা করতে পারলে হয় ত ভবিষ্যতে এক-সময়ে-ন-এক-সময়ে তোমাকে ভুলে যেতে পারব; আজ তোমাকে কেন ডেকেছি জান, দেবেন? তোমার সঙ্গে আমি একট। বন্দোবস্ত করতে চাই।”
“কি, বল?”
“আশা করি, তুমি আমার কথা রাখবে।”
“হাঁ, তোমার কথা রাখতে যদি কোন ক্ষতি স্বীকার করতে না হয়, অবশ্যই রাখব।”
“তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালবাস?”
“হাঁ, ভালবাসি।”
“তুমি তার জীবন রক্ষা করতে ইচ্ছ। কর?”
“হাঁ, করি।”
“তার জীবন রক্ষা করতে তুমি কিছু ত্যাগ-স্বীকার করতে পার?”
“হাঁ, পারি।”
“তুমি তোমার ভালবাসা ত্যাগ করতে পার?”
“আমি তোমার কথা বুঝতে পারলেম না।”
“তুমি তোমার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পার?”
“তাকে আমি পরিত্যাগ করিব।”
“হাঁ, তাকে—তোমার স্ত্রীকে—তোমার সেই ভালবাসার সামগ্রীকে কেবল এক বৎসরের জন্য; এক বৎসর—বেশি দিন না—চিরকালের জন্য না;–তুমি তাকে মনে মনে যেমন ভাবেই রাখ, কিন্তু কেবল এক বৎসরের জন্য তুমি আমার হও। বৎসর ফুরালে তোমাকে আমি মুক্তি দিব; তখন অবাধে তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে পারবে। এক বৎসর– কেবল একটি মাত্র বৎসর; শেষে আমিও মরিব—তুমিও নিশ্চিন্ত হ’তে পারবে, আমি নিজের বিষে মরিব; তুমি তখন মুক্তি পাইবে. জুমেলিয়ার হাত হ’তে তুমি আজীবন মুক্ত থাকিবে।”
এই বলিয়া জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে একপদ অগ্রসর হইয়া, জানু পাতিয়া তাহার অতি নিকটে অতি দীনভাবে উপবেশন করিল— তখন সে প্রাণের আবেগে মহা উন্মাদিনী।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহার অভিনব অভিপ্রায় শুনিয়া চমকিত হইলেন। তাঁহার সৰ্ব্বাঙ্গ তখন প্রস্তর-প্রতিমুক্তির ন্যায় শীতল, নীরব ও নিশ্চল।

——————-
[* জুমেলিয়ার জটিল রহস্তপূর্ণ অন্যান্য ঘটনাবলী গ্রন্থকারের “মনোরমা” ও “মায়াবী” নামক পুস্তকে লিখিত হইল। প্রকাশক।]

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আবেগে

জুমেলিয়া বলিতে লাগিল,-“দেবেন, কত সুখ তাতে; মরি! মরি! মরি! আমার হও, আমার হও তুমি—এক বৎসরের জন্য। দেখ দেবেন, আমি প্রাণের মধ্যে–হৃদয়-পটে কেমন মুখের সুন্দর ছবি এঁকেছি। এ কথা মনে করতে আমার আনন্দের সীমা থাকছে না। তোমাকে ভালবাসতে হবে না—তুমি আমাকে ভালবাস কি না, সে কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই না; আমি জানি, আমি এত নিৰ্ব্বোধ নই, তুমি কখনই আমাকে ভালবাসবে না—ভালবাসতেও পারবে না। কিন্তু ছল—ছলনায় আমাকে বুঝায়ো, তুমি আমায় বড় ভালবাস; কেবল একটি বৎসরের জন্য। আমি সাধ ক’রে তোমার প্রতারণায় প্রতারিত হ’তে স্বীকার করছি—এ প্রতারণায়ও সুখ আছে। আমি জানি, আমি যা আশা করেছি, তা আশার অতীত। তুমি আমাকে ছলনায় ভুলায়ে যে, তুমি আমার ভালবাস, আর কিছু না, তাই যথেষ্ট। আমি নিজেকেই বুঝাব যে, তুমি প্রকৃতই আমাকে ভালবাস; তুমি আমার—আমার! রেবতী রক্ষা পাবে, সে তোমার বাড়ীতে নির্বিবঘ্নে পৌছিবে; সেখানে সে তোমার অপেক্ষায় থাকবে, সে কখনই জানতে পারবে না, তার জীবন-রক্ষার্থে তোমায়-আমার কি বন্দোবস্ত হয়েছে— সে তোমার এ বিষয়ের কোন প্রমাণই পাবে না। বৎসর শেষে তুমি স্বচ্ছন্দে তার কাছে ফিরে যেতে পারবে; তখন যা’ তোমার প্রাণ চায়— করিয়ো; ঘাতে তুমি সুখী হও—হইয়ো। কেবল একবার তুমি ক্ষণেকের জন্য স্বর্গের সুষমার আভাসটুকু আমায় দেখাও,—যা” আমি সারাজীবনে কখনও অনুভব করিতে পারি নাই। তোমার স্ত্রী কিছুই জানবে না, কেহই না; কেবল তুমি আর আমি। এক বৎসর পরে তুমি হাসতে হাসতে তার কাছে ফিরে যাবে; আমি মরিব, সত্যসত্যই মরিব; কেবল এ গুপ্তরহস্তা তোমারই জ্ঞাত থাকিবে—লোকের কাছে তোমাকে কলঙ্কের ভাগী হইতে হইবে না।” জুমেলিয়া উঠিল—আরও দুইপদ অগ্রসর হইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বাহুবেষ্টিত করিতে চেষ্টা করিল। দেবেন্দ্রবিজয় ঘৃণাভরে তাহাকে সরাইয়া দিলেন।
জুমেলিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় বলিতে লাগিল—“শোন দেবেন, আমি বুঝেছি, আমি মরিব; এ কথা তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না; আমি বৎসর ফুরালে তোমার সাক্ষাতে বিষপান করব। যখন আমি ম’রে যাব, কি সংজ্ঞাশুন্ত হ’য়ে পড়ব, তখন তুমি শতবার শাণিত ছুরিকা দিয়ে আমার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ ক’রো, তা’ হ’লে ত তখন তোমার অবিশ্বাসের আর কোন কারণ থাকবে না। এখন আমরা একদিকে—বহুদূরে চলে যাব; কেবল এই এক বৎসরের জন্য; আমরা কামরূপেই চলে যাব। আমি যে সকল দ্রব্যগুণ জানি, তোমাকে সকলগুলিই শিখাব; শিখালে সহজেই শিখতে পারবে; ত’তে তোমার উপকার বৈ অনুপকার হবে না। তুমি যে দেশ ছেড়ে চলে যাবে, সেজন্য একটা কোন ওজর করলেই চলবে। তোমার স্ত্রীকে সদা-সৰ্ব্বদা তোমার ইচ্ছামত পত্রাদি লিখতে পারবে; কিন্তু তুমি প্রাণান্তেও তোমার স্ত্রীর নাম আমার কাছে এই এক বৎসরের জন্য ক’রো না; যাতে আমার মনে এমন একটা ধারণ হ’তে পারে যে, তুমি আমাকে ভালবাস ন—এমন কিছু আমাকে দেখিয়ে না—জানতে দিয়ে না। আমি ত বলেছি, আমি নিজেকে নিজেই প্রতারিত ক’রে রাখব; তুমি আমার হৃদয়ের রাজ্য হবে – তুমি আমার প্রাণের ঈশ্বর—তুমি আমার সৰ্ব্বস্ব! তার পর এক বৎসর কেটে গেলে আমি নরকের দিকে চ’লে যাব। তোমাকে এক বৎসর পেয়ে, তোমার বৎসরেক প্রেমালাপে আমি যে সুখ লাভ করব, ত’তে আমি হাসিমুখেই নরকের দিকে চলে যাব। এই এক বৎসর আমার জয়জয়কার, দেবেন। দেবেন—প্রাণের দেবেন্‌! তুমি কি আমার মনের কথা—প্রাণের বেদন বুঝতে পার্ছ না—আমি তোমাকে কতমতে আরাধনা করছি? তুমি মুখে আমার ভালবাস, তাতেও আমি মুখী হ’ব-আমি জোর করে বিশ্বাস ক’রে লইব, তুমি আমায় প্রকৃত ভালবাস। আমার কথার উত্তর দাও; বল-—স্বীকার পাও—প্রতিজ্ঞ কর, আমি তোমাকে যা বললেম, তা’তে তোমার আর অমত নাই; আমি এখনি তোমাকে রেবতীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি—সে এখন মড়ার মত প’ড়ে আছে। যে ঔষধে তার জ্ঞান হবে, সে ঔষধ আমি তোমার হাতেই দিব, তুমি সেই ঔষধ তাকে খেতে দিয়ে; সেই মুহুর্তেই তা’র জ্ঞান হবে—শরীরের অবস্থা ফিরে যাবে; যেমন তাকে তুমি আগে দেখেছ, এখনও ঠিক তাকে তেমনি দেখ বে। অস্বীকার কর যদি, নিশ্চয় স্ত্রীর মৃত্যু হবে; ত’ হ’লে তোমার কাছে আমি যেমন সজলনয়নে দাঁড়িয়ে আছি—আর আমার সম্মুখে তুমি যেমন প্রস্তরপ্রতিমূৰ্ত্তির ন্যায়, নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া আছ, ইহা যেমন নিশ্চয়— তেমনই নিশ্চয় তা’র মৃত্যু জানবে। জগতের কোন বিজ্ঞান তা’র চৈতন্ত সম্পাদন করতে পারবে না—কোন চিকিৎসক তার জীবন দান করতে পারবে না। যে ঔষধের প্রক্রিয়ায় সে এখন অচেতন, আমিই কেবল-তার প্রতীকারের উপায় জানি। এমন লোক দেখি না, আমার সাহায্য বিনা তাকে বাঁচাইতে পারে। যদি তুমি আমার হাত পা লোহশূঙ্খলবদ্ধ কর, এখনই এখানে সুতপ্ত লৌহখণ্ড দিয়ে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ ঝলসিত কর, গোছায় গোছায় আমার মাথার চুলগুলি ছিড়িয়া ফেল, সাড়াশি দিয়ে এক-একটি ক’রে সকল দাত মূলোৎপাটিত কর, আমার কর্ণরন্ধে, সৰ্ব্বাঙ্গে গলিত সীসক ঢেলে দাও—ঘত প্রকার যন্ত্রণা আছে—যে সকল চিন্তার অতীত—আমাকে দাও, আমার মনের দৃঢ়তা কখনই তুমি নষ্ট করতে পারবে না; সে যাতে শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যুমুখে পড়ে, তা আমি করব; তাতে আমি জানব, আমার প্রতিহিংসা সফল হয়েছে; তাতে তোমার মনে যে যন্ত্রণা হবে, সে যন্ত্রণার কাছে আমার শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ বিবেচনা করব। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, বড় বেশি কিছু নয়—দেবেন, একটি বৎসর মাত্র; এই এক বৎসরের জন্য আমার হও—কেবল আমারই। তার পর তোমার সংসারে সানন্দে তুমি ফিরে যেয়ো—সুখী হ’য়ো। সম্মত হবে কি? তুমি ত বলিয়াছ, রেবতীর প্রাণরক্ষার্থ সকলই করিতে পার; কেবল এক বৎসরের জন্য আমি তোমার কাছে তোমাকেই চাহিতেছি। উত্তর দিবার আগে বেশ ক’রে ভেবে দেখ—দেবেন, বেশ ক’রে বিবেচনা ক’রে দেখ; আমার কথা আমি কিছুতেই লঙ্ঘন হ’তে দিই নাই; আমার অভিপ্লায়ের একবিন্দু পরিবর্তিত হবে
না।”
জুমেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে-সাশ্রনেত্ৰে— মানমুখে—স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
দেবেন্দ্রবিজয়ও সেইরূপ স্থিরভাবে রহিলেন। তাঁহার এখনকার মনের অতিশয় অধীরতা মুখে কিছুমাত্র প্রকাশ পাইল না।
জুমেলিয়া জিজ্ঞাসিল, “কি বল দেবেন, সন্মত আছ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “রেবতী কোথায়?”
জুমেলিয়া। এইখানেই আছে।
দেবেন্দ্র। তার কাছে আমাকে নিয়ে চল।
জু। কি জন্য?
দে। তোমাকে এখন কি উত্তর দিব? আমি তাকে দেখে সে সম্বন্ধে একটা বিবেচনা করতে পারব।
জু। আমি এখনি তার কাছে নিয়ে যেতে পারি।
দে | নিয়ে চল।
জু। তার পর তুমি আমার কথার উত্তর দিবে?
দে। হাঁ।
জু। তবে আমার সঙ্গে এস, দেবেন; তুমি অবশ্যই স্বীকার পাবে : তুমি যেরূপ তাহাকে ভালবাস, তাতে তাকে দেখলে—তার মুখ দেখলে কখনই তুমি আমার প্রস্তাবে অস্বীকার করতে পারবে না—এস।

* * * * *

জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া পার্শ্ববৰ্ত্তী কক্ষে গমন করিল। তথায় প্রকোষ্ঠতলে একথানি ছিন্ন গালিচার উপর মৃতপ্রায় রেবতী পড়িয়া।
রেবতীর মুখমণ্ডল অতিস্নান—ঠিক মৃতের মুখের ন্যায়। দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় হৃদয়ের মধ্যে একটা অননুভূতপূৰ্ব্ব, কম্পপ্রদ শৈত্য অনুভব করিলেন; তখনকার মত তাঁহার অৰ্দ্ধোন্মত্ত অবস্থা আর কখনও ঘটে নাই। তখন তাঁহার, প্রাণের ভিতরে যে কি অসহ যন্ত্রণা হইতেছিল, তাহার বর্ণনা হয় না; কিন্তু বাহিরে তাহার সকলই স্থির—প্রাণে যেন উদ্বেগের কোন কারণই নাই। অতি তীব্রভৃষ্টিতে বারেক জুমেলিয়ার মুখপানে চাহিলেন তার পর নিতান্ত রক্ষস্বরে বলিলেন, “জুমেলিয়া, আমার উত্তর, না।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
“মরে —মরিবে”

‘না’ এই শব্দমাত্রটাতে সম্ভব জুমেলিয়া খুব বিচলিত ও চমকিত হইয়া উঠিত; কিন্তু তখনকার ভাব জুমেলিয়া অতিকষ্টে দমন করিয়া ফেলিল; কেবল মৃদু হাসিয়া মৃদুগুঞ্জনে বলিল, “ব্যস্ত হ’রো না, দেবেন; বেশ ক’রে ভেবে দেখ।”
বাক্যশেষে তীক্ষকটাক্ষবিক্ষেপ।
“তেবে দেখেছি, না।”
“তুমি তবে স্বীকৃত হবে না?”
“না।”
“দেবেন, তুমি না বড় বুদ্ধিমান্‌! তোমার স্ত্রীর এই দশা দেখে তুমি কি এই উত্তর স্থির করলে, দেবেন?”
“হাঁ।”
“কি দেখে তুমি এমন ভরসা করছ?”
“আমার স্ত্রীর কিছুই হয় নাই, মুখমণ্ডল যদিও ম্লান, তা’ ব’লে কালিমাময় বা জ্যোতির্হীন নয়! জুমেলা, যতদূর কদৰ্য্যত ঘটতে পারে— তা তোমাতে ঘটেছে। যতই তুমি পাপলিপ্ত হও না কেন, পবিত্রতা যে কি জিনিষ, অবশ্যই তা তুমি জান। তুমি এখনও বলিতেছ, তুমি আমার ভালবাস?”
“হাঁ, ভালবাসি, দেবেন, এখনও বলছি, তোমার জন্য আমি পাগল হইয়াছি।”
“হ’তে পারে; কিন্তু আমি তোমাকে আন্তরিক ঘৃণা করি।”
“দেবেন, এই কি তোমার উত্তর? কঠিন!”
“আমি অন্যায় কিছু বলি নাই; তুমি আমার কথা ঠিক বুঝিবে কি, জানি না; যদি তুমি প্রকৃত রমণী হইতে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিতে; কিন্তু বিধাতা তোমাকে যদিও রমণী করিয়াছেন, রমণী-হৃদয় দিতে সম্পূর্ণ ভুল করিয়াছেন; আচ্ছ, তুমিই মনে কর, তুমি যেন রেবতী—”
[বাধা দিয়া] “বল – বল—দেবেন, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক; তোমার মুখে এ কথা শুনে আমার হৃদয়ে আনন্দ ধরছে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “তুমি যেন রেবতী, তোমার স্বামী তোমাকে অতিশয় ভালবাসেন, তুমি যেন কোন দুর্ঘটনায় ওখানে ঐরূপ মৃতপ্রায় পড়িয়া আছ, এমন সময়ে অন্য একটী স্ত্রীলোক তোমার এইরূপ অবস্থায় তোমার স্বামীর নিকটে এইরূপ একটা জঘন্ত অভিপ্রায় প্রকাশ করছে; অথচ তোমার সম্মুখে এখন বা যা ঘটছে, তুমি যেন তা মনে মনে জানতে পারছ; তুমি কি তখন তোমার জীবন-রক্ষার্থে তোমার স্বামীকে সেই রমণীর হাতে সমর্পণ করতে সন্মত হ’তে পার? পার কি জুমেলা?”
“অ্যাঁ, – না—ন!—না—না! কখনই না! সহস্রবার না!”
“তবে জুমেলা, তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর নিজে, নিজেরই মুখে পাচ্ছ না? যার প্রাণের পরিবৰ্ত্তে আমাকে তুমি চাও, সে আমাকে ছাড়িয়। তার প্রাণ চাহে না; আর আমার স্ত্রীকে যদি আমি যথার্থ হাঁ ভালবাসি, তবে তার অনভিপ্রেত কাজে আমার হস্তক্ষেপ কর ঠিক হয় না।”
“তবে কি আমার কথার উত্তর না’? তুমি জান, তা’ হ’লে তুমিই তোমার সেই স্ত্রীরই হন্তারক হবে?”
“তথাপি তুমি আমার মত কিছুতেই ফিরাতে পারবে না, জুমেলা।”
“তবে তুমি আমাকে ঘৃণা কর?”
“হাঁ, ভাল রকমে।”
“তবে ভাল রকমে রেবতী ও মরিবে?”
‘মরে —মরিবে।”
“নিশ্চয় মরিবে।”
“তেমনি নিশ্চয়, সে একা মরিবে না।”
“হোঃ—হোঃ—হোঃ [হাস্য] তুমি আমায় বড় ভয় দেখাচ্ছ!”
“হাঁ।”
জুমেলিয়া আবার হাসিল।
সেই অমঙ্গলজনক—পৈশাচিক তীব্র অট্টহাস্য—নির্জ্জলদগগনবক্ষের গম্ভীরবজধ্বনিবৎ। জুমেলিয়া বলিল, “তোমাকে আমি ভয় করি না–করিতে শিখিও নাই।”
দেবেন্দ্র। যদি না শিখিয়া থাক, আজ শিখিবে।
জুমেলিয়া। কেন?
দে। না শিখিলে আমার কাজ সফল হইবে কি প্রকারে?
জু। তোমার কাজ?
দে। হাঁ।
জু। কি কাজ?
দে। তুমি যে কাজ করিতে আমাকে বলিয়াছ।
জু। আমি তোমায় কি কাজ করিতে বলিয়াছি – বল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
দে। তুমি তোমার জন্য পূৰ্ব্বে যে যে যন্ত্রণার উল্লেখ করেছ, সেই সকল যন্ত্রণাই তোমাকে আমি ভোগ করাইব। আমি যে মানুষ, এ কথা আমি এখন যতদুর ভুলে যেতে পারি, ভুলিব; তোমার উপযুক্ত— তোমারই মত হ’তে—পিশাচ হ’তে চেষ্টা করিব। আমি এখন একএকটি ক’রে তোমার মস্তকের সকল কেশ—যতক্ষণ না, তোমারই ওই ষড়যন্ত্রপূর্ণ মস্তক কেশলেশহীন হয়—ততক্ষণ মূলোৎপাটিত করব। তার পর আমার এই ছুরি পুড়িয়ে লাল করব, সেখান তোমার কপালে চেপে ধরব—দুই গালে চেপে ধরব—তা দিয়ে তোমার চক্ষু দুটা উৎপাটিত করব।
জুমেলিয়া হাসিতে গেল—পারিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় পূৰ্ব্ববৎ বলিতে লাগিলেন, “পাছে তুমি নিজের জীবন নিজে বাহির কর, পাছে যদি তোমার কাছে কোন প্রকার বিষা থাকে, আগে তা কেড়ে নেব, তার পর তোমাকে সেই মুণ্ডিতমস্তক, ঝলসিত মুখ অবস্থা না ঘটে, ততক্ষণ তোমার কোন স্বাভাবিক অবস্থা না ঘটে, ততক্ষণ পথে পথে অনাহারে ঘুরিবে।”
জু। [সচীৎকারে] তুমি! তুমি এই সকল করবে?
দে। হাঁ, আমিই সব করব।
জু। [ সচীৎকারে ] তুমি! তমি এই সকল করবে?
জু। তুমি! দেবেন্দ্রবিজয়!
দে। আঃ, ভুলে যাও কেন, জুমেলা, আমি কেন? দেবেন্দ্রবিজয় মরে গেছে, তার দেহে এক পিশাচের অধিষ্ঠান হয়েছে; সেই পিশাচ, যতক্ষণ না তুমি মর, ততক্ষণ তোমাকে নূতন নূতন যন্ত্রণা দেবে; যখন একটু সুস্থ হবে, আবার নূতন যন্ত্রণা।
জু। [ সরোষে ] নিৰ্ব্বোধ! তুমি কি মনে করেছ, আমি এই সকল যন্ত্রণা সহ করবার জন্য তোমার কাছে ঠিক এমনি ভালমানুষটির মত চুপ্‌ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকব?
দে। কি করবে, মরবে? পারবে না। যদি তুমি আত্মহত্যা করবার জন্য কোন বিষ বাহির করিতে যাও, পিস্তলের গুলিতে তোমার হাত চুর্ণ-বিচূর্ণ ক’রে দিব; যদি পালাবার জন্য এক পা নড়বে, এখনই এই গুলিতে তোমার পা ভেঙ্গে দিব।
জুমেলিয়া তিরস্কারব্যঞ্জক কৰ্কশ হাসি হাসিতে লাগিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বজ্রনাদে বলিলেন, “জুমেলা, হাসি নয়—আমি মিথ্য বলি না—শীঘ্র প্রমাণ পাবে।”
“প্রমাণ দেখাও।”
“দেখিবে? তোমার কাণে যে ঐ দুটা দুল আছে, ঐ দুটীর মধ্যেও তুমি কৌশলে বিষ সঞ্চয় ক’রে রেখেছ; তোমার ঐ ফুল দুটির অস্বাভাবিক গড়ন দেখেই তা বুঝতে পারছি—ও দুটি এখনই দূর করাই ভাল।”
বাক্য সমাপ্ত হইতে-না-হইতে দেবেন্দ্রবিজয় উপর্য্যুপরি দুইবার পিস্তলের শব্দ করিলেন, জুমেলিয়ার কর্ণাভরণ দুটা পিস্তলের গুলিতে ভাঙ্গিয়া দুরে গিয়া পড়িল, এবং ঘরটি কিয়ৎকালের নিমিত্ত ধূম্রময় হইয়া উঠিল। ইত্যবসরে দেবেন্দ্রবিজয় পিস্তলটা লুকাইয়া ফেলিলেন।
জুমেলিয়া সভয় চাৎকারে দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গিয়া এক কোণে দাঁড়াইল। যেমন সে হস্তোত্তোলন করিতে যাইবে, দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সাবধান, হাত তুলিয়ে না; এখনি আমি পিস্তলের গুলিতে তোমার হাত ভাঙিয়া দিব। জুমেলা, এ হাস্যোদীপক প্রহসন নয়, পৈশাচিক ঘটনাপূর্ণ বিয়োগান্ত নাটক।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ধরা পড়িল

দুবার উপর্যুপরি পিস্তলের শব্দ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিলেন, তখনই শচীন্দ্র তথায় উপস্থিত হইবে। পাঠক অবগত আছেন, দুইবার পিস্তলের শব্দ তাঁহীদের একটা নির্দিষ্ট সঙ্কেতমাত্র। শচীন্দ্র তখনই অতি নিঃশব্দে আসিয়া জুমেলিয়ার পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দেখিতে পাইলেন; জুমেলিয়া কিছুই জানিতে পারিল না। এখন আর শচীন্দ্রের সে ভিক্ষুকের বেশ নাই, ইতোমধ্যে তৎপরিবর্তে পুলিশের ইউনিফর্ম ধারণ করিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “জুমেলা, তুমি একদিন বলেছিলে না যে, মৃত্যুর পরেও তুমি আমার অনুসরণ করবে? যদি আমি মরিতাম, আমিও তোমার পিছু নিতাম; ভূতের মত অলক্ষ্যে তোমারও পশ্চাতে দাঁড়াতেম; তুমি কিছুই জানতে পারতে না; তার পর তোমার হাত দুটা পিছু-মোড়া করে ধরতেম, তোমার আর নড় বার শক্তি থাকত না—বুঝতে পেরেছ?
জু। না।
দে। এইবার?
তখন শচীন্দ্র জুমেলিয়ার হাত দুখান পিছু-মোড়া করিয়া ধরিল। জুমেলিয়া জোর করিতে লাগিল; চীৎকার করিয়া উঠিল, কিছুতেই শচীন্দ্রের হাত হইতে মুক্তি পাইল না।
জুমেলিয়ার সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের উপযুক্তি কথোপকথনের যে কথাগুলি নিম্নে কৃষ্ণরেখা দ্বারা চিহ্নিত করা হইল, দেবেন্দ্রবিজয় জুমেলিয়াকে না বলিয়া প্রকারান্তরে শচীন্দ্রকেই বলিতেছিলেন। শচীন্দ্র আদেশ পালন করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “জুমেলিয়া, এইবার তুমি অসহায়— পলায়নের কোন উপায় নাই; এইবার আমি তোমার হাতে হাতকড়ী, পায়ে বেড়ী দিব; তার পর তোমারি মন্ত্রণা মত সেই সব যন্ত্রণা তোমাকেই দেওয়া হবে।”

তখনই জুমেলিয়াকে হাতকড়ী ও বেড়ী পরাইয়া দেওয়া হইল। তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে একখানি চেয়ারে বসাইয়া চেয়ারের সহিত লৌহশৃঙ্খলে তাহাকে বন্ধন করিলেন। তখন জুমেলিয়া শচীন্দ্রকে দেখিতে পাইল—এতক্ষণ দেখিতে পায় নাই; বলিল, “পোড়ারমুখ আমার। কই, আমি ত আগে কিছুই জানতে পারি নাই।”
শচীন্দ্র বলিল, “যাকে তুমি পাহারা দিতে বাগানে রেখেছিলে, তাকে যদি না হাত মুখ বেঁধে গাছতলায় আমি ফেলে রেখে আসতেম— জানতে পারতে, আমি এসেছি। জুমেলিয়া, এখন আমাদের দয়ার উপর তোমার পাপপ্রাণ নির্ভর করছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ—জুমেলা, যাকে ভালবাস, এখন তারই দয়ার উপর তোমার জীবন নির্ভর করছে।”
জুমেলিয়া। তবে দেবেন, তুমি তবে আমার সঙ্গে সন্ধি করতে চাও না?
দেবেন্দ্র | সন্ধি? না—কেন করিব?
জু। তুমি রেবতীকে রক্ষা করিবে না?
দে। যদি পারি—করিব।
জু। তবে কেন তুমি তাতে সাধ করিয়া ব্যাঘাত ঘটাইতেছ?
দে। কি প্রকারে?
জু। আমার সহিত সন্ধির কোন বন্দোবস্ত না করিয়া।
দে। তুমি ত বলেছ, তাকে পরিত্রাণ দেবে না।
জু। তখন আমি তোমার হাতে পড়ি নাই।
দে। এ কথা নিশ্চয়—আমি ভুলে গেছ লেম; যাতে তার জ্ঞান হয়, এখন সে ঔষধ আমার হাতে দেবে কি?
জু। দিতে পারি, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে দাও—আমাকে এখান থেকে পালাবার জন্য আটচল্লিশ ঘণ্টা মাত্র সময় দাও—হাঁ, তাহা হইলে আমি দিতে পারি। .
দে। সে আশা বৃথা।
জু। তবে তুমি তোমার স্ত্রীর জীবন রক্ষা করতে অসম্মত?
দে। সে যে রক্ষা পাবে না, এ বিশ্বাস আমার নাই। এবারে তোমার যন্ত্রণা আরম্ভ হবে। [ শচীন্দ্রের প্রতি ] শচী! এখনই এই ছুরি দিয়া জুমেলিয়ার চোখ দুটা উৎপাটন করিয়া ফেল।
জু। [ সচীৎকারে ] বাঁচাও! দয়া কর!
দে। কিসের দয়া?
জু। আমি রেবতীকে বাঁচাতে পারি—বাঁচাব।
দে। বাঁচাও তবে—তাকে।
জু। ছেড়ে দাও আমায়।
দে। সে আশা ক’রো না।
জু। তুমি কি এখন আমার সে প্রস্তাবে সম্মত হবে?
দে। আমি কিছুতেই সম্মত নই।
জু। তবে আমি কখনই তাকে বাঁচাব ন—মরুক সে—চুলোয় যাক সে!
দে। জুমেলা, বাঁচাও তাকে; সে যদি আমাকে তোমার ছেড়ে দিতে বলে, নিশ্চয় তোমাকে আমি মুক্তি দিব; মনে বুঝে দেখ, তোমার ভবিষ্যৎ তার হাতে।
জু। রেবতীর? ভাল, যদি সে স্বীকার করে, তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে? আমি এখনই তাকে বাঁচাব। ছেড়ে দাও আমায়; আমি মিথ্যা বলি না।
দে। না।
জু। তবে কি ক’রে তাকে বাঁচাতে পারি?
দে। কি করলে তার জ্ঞান হবে, আমাকে ব’লে দাও—আমিই সে কাজগুলি করব—তুমি না। যদি তাতে তার জ্ঞান না হয়, তোমার সেই নিজের স্থিরীকৃত যন্ত্রণাগুলি তোমাকেই উপভোগ করতে হবে।
জু। সে যদি বাঁচে, তা’ হ’লে তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?
দে। যদি রেবতী স্বীকার পায়।
জু। যে ঘরে তোমাকে আগে নিয়ে যাই, সেই ঘরে টেবিলের ভিতরে একটি ছোট কাঠের বাক্স আছে, নিয়ে এস—যেমন আছে, তেমনই নিয়ে আসবে; সাবধান, যেন খুলিয়ো না।
তখনই দেবেন্দ্রবিজয় সেই বায়ু লইয়া আসিলেন।
জু। ঐ বাক্সের ভিতর থেকে সতের নম্বরের শিশিট বাহির কর, পাঁচ ফোঁটা ঔষধ রেবতীকে খেতে দাও।
দে। কোন ঔষধে তুমি রেবতীকে এখন অজ্ঞান ক’রে রেখেছ—কত নম্বর?
জু। এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
দে। প্রয়োজন আছে।
জু। নম্বর সাত।
দে। বেশ, যদি এই সতের নম্বরের ঔষধে কিছু ফল না হয়, তোমাকে সাত নম্বরের ঔষধ জোর করিয়া খাওয়াইব।
জু। ফল হবে।

দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে রেবতীর অবসন্ন, তুষারশীতল মস্তক নিজের ক্রোড়ে গ্রহণ করিলেন। তখন তাঁহার মনে যে যন্ত্রণা হইতেছিল, তিনি তেমন যন্ত্রণা ইতিপূৰ্ব্বে কখনও ভোগ করেন নাই। তাঁহার সেই প্রাণের যন্ত্রণার কোন চিহ্ন মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল না। তাহার পর তিনি রেবতীর মুখ-বিবরে বিন্দু বিন্দু করিয়া সেই শিশিমধ্যস্থিত গাঢ় লোহিত বর্ণের তরল ঔষধ ঢালিতে লাগিলেন।
মুহূর্তের পর মুহূৰ্ত্ত কাটিতে লাগিল, গৃহ নিস্তব্ধ—কোন শব্দ নাই।
তাহার পর যখন প্রায় একদণ্ড উত্তীর্ণ হইয়া গেল, সহসা রেবতী চক্ষুরুন্মীলন করিলেন—নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় প্রকোষ্ঠের চতুর্দিকে চাহিতে লাগিলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
একি ইন্দজাল!

চক্ষুরুন্মীলন করিয়া রেবতী যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার বিস্ময়ের সীমা রহিল না।
জুমেলিয়া রেবতীকে ক্লোরোফৰ্ম্ম করিয়া এখানে লইয়া আসে; সে ঘোর কাটিতে-না-কাটিতে সে আবার নিজের অমোঘ ঔষধ প্রয়োগ করে, তাহাতে রেবতী সেই অবধি সম্পূর্ণরূপে সংজ্ঞাহীন। প্রথমে তিনি দেখিলেন, তিনি যে কক্ষে শায়িত আছেন—সে কক্ষ তাহার অপরিচিত—তাহার সম্মুখে দেবেন্দ্রবিজয় দণ্ডায়মান—দেবেন্দ্রবিজয়ের পার্শ্বে ম্লানমুখে শচীন্দ্র এবং কিছুদূরে হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ী দেওয়া লোহশূঙ্খলে আবদ্ধ জুমেলিয়া একখানি চেয়ারে বিনতমস্তকে বসিয়া।
দেবেন্দ্রবিজয় রেবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন আছ?”
রেবতী! ভাল আছি।
দেবেন্দ্র। উঠিতে পরিবে কি?
রে। পারিব। [ দণ্ডায়মান ]
দে। চলিতে পারিবে?
রে। হাঁ, কেবল মাথাটা একটু ভারি বোধ হচ্ছে।

তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় দুই-একটি কথাতে অতি সংক্ষেপে এ পর্য্যন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছে, সকলই রেবতীকে বলিলেন; কেবল জুমেলিয়ার সেই অবৈধ প্রেম-প্রস্তাব সম্বন্ধে কোন কথার উল্লেখ করিলেন না; তজ্জন্য ডাকিনী জুমেলিয়া বারেক সন্তুষ্টনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখপ্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় রেবতীকে বলিলেন, “এখন তোমার হাতে জুমেলার ভবিষ্যতের ভালমন্দ নির্ভর করছে; আমি জুমেলার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, তোমার কথামত আমি কাজ করব; তুমি উহাকে মুক্তি দিতে চাও—দিব, না চাও–না দিব, যা তোমার ইচ্ছা। স্বীকার করি, জুমেলাই তোমাকে মৃত্যুমুখ থেকে ত্রাণ করেছে; কিন্তু সেই জুমেলাই তোমাকে মৃত্যুমুথে তুলে দিয়েছিল; এখন আমি এখান হ’তে বাহিরে যাচ্ছি—এখন এখানে থাকা আমার আবশ্যক করে না; আমার সাক্ষাতে জুমেলা তোমার নিকটে কোন প্রার্থনা জানাতে লজ্জিত হবে; তুমিও কিছুই ভালরূপে মীমাংসা ক’রে উঠতে পারবে না; তবে বাহিরে যাবার আগে তোমাকে একটি কথা ব’লে রাখা প্রয়োজন। সাবধান, তুমি জুমেলিয়াকে স্পর্শ করিয়ো না!—এমন কি নিকটেও যাইয়ো না।”
দেবেন্দ্রবিজয় শচীন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া, তথা হইতে বহির্গত হইয়া বাহির হইতে কবাটে শিকল দিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ও শচীন্দ্র বাহিরে অপেক্ষায় রহিলেন।
পনের মিনিট অতিবাহিত হইল, কোন সংবাদ নাই।

আর দশ মিনিট কাটিল – তথাপি কোন সাড়াশব্দ নাই, একটিমাত্র ভিত্তি ব্যবধানে তাহারা দণ্ডায়মান; কোন শব্দ নাই। তখন দেবেন্দ্রবিজয় অস্থির হইতে লাগিলেন। বাহির হইতে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “অরি আমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিব, যা হয়, ঠিক করিয়া লও।” দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে ঘড়ী বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন। সেইরূপ নিঃশব্দে আরও পাঁচ মিনিট কাটিল।
দেবেন্দ্রবিজয় তখন সশব্দে সেই কক্ষদ্বার উদঘাটন করিলেন। যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহাকে স্তম্ভিত হইতে হইল, তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইতে অনেক বিলম্ব হইল।

যে গৃহমধ্যে তিনি এই কতক্ষণ হস্তপদবদ্ধ জুমেলিয়া এবং রেবতীকে রাখিয়া বাহিরে গিয়াছিলেন, সে কক্ষ শূন্য পড়িয়া আছে।
রেবতী নাই।
জুমেলিয়া নাই।
তাহাদের কোন চিহ্নও নাই।
পাছে ভ্রম হইয়া থাকে, এই সন্দেহে নিদারুণোদ্বেগে দেবেন্দ্রবিজয় উভয় হস্তে উভয় নেত্ৰ মৰ্দ্দন করিতে লাগিলেন। একি স্বপ্ন! জুমেলিয়াকে যে চেয়ারে বন্ধন করা হইয়াছিল, সেই চেয়ারের নিকটে অগ্রসর হইলেন; দেখিলেন, যে শৃঙ্খলে জুমেলিয়া আবদ্ধ ছিল, সেটা চেয়ারের নীচে পড়িয়া রহিয়াছে; হাতকড়ী ও বেড়ী ও সেখানে আছে; তাহা অন্য চাবি দিয়া খুলিয়া ফেলা হইয়াছে í
চেয়ারখানার উপরে এক টুকরা কাগজ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহাতে লেখা ছিল;– .
“কেমন মজা; বাহবা কি বাহব্বা-আবার যে-কে সেই! তুমি বোকারাম গোয়েন্দা। আমি আবার স্বাধীন—রেবতী আবার আমার হাতে পার-ক্ষমতা থাকে তাকে উদ্ধার করিয়ো।
সেই
জুমেলা।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “কিরূপে পলাইল? জুমেলা বাঁধা ছিল। কেবল বাঁধা নয়—তার সম্মুখে রেবতীও ছিল। একি ব্যাপার, শচী? শচী, তুমি যে লোকটাকে বাহিরে বেঁধে রেখে এসেছ, সে ত কোন রকমে এদিকে আসতে পারে নাই?”
শচীন্দ্র সেই সন্ধান লইবার জন্য তখনই যেমন লাফাইয়া গৃহ হইতে বাহির হইতে যাইবেন, অমনি আগুনের একটা সুতীব্র ঝটকা আসিয়া তাহাকে তথায় ফেলিয়া দিল। সেই সঙ্গেই ‘ধ্রূম’ করিয়া একটা পিস্তলের শব্দ হইল। মৃতবৎ শচীন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের পদপার্শ্বে পতিত হইল। এখন দেবেন্দ্রবিজয় কি করিবেন? এ মুহূৰ্ত্ত চিন্তার নহে—কার্য্যের। তখনই পিস্তল বাহির করিলেন, যেদিক্ হইতে আগুনের ঝটুক আসিয়াছিল, সেইদিক্‌ লক্ষ্য করিয়া পিস্তল দাগিলেন। তখনই কোন একটা ভারযুক্ত দ্রব্যের পতন শব্দ এবং মানুষের গেঙানি শুনা গেল—তবে পিস্তলের গুলিটা ব্যর্থ যায় নাই।
তখন দেবেন্দ্রবিজয় দ্বারদেশে নিপতিত শচীন্দ্রকে উল্লঙ্ঘন করিয়া কক্ষের বাহিরে আসিলেন; যেদিক্ হইতে গেঙানি শব্দ আসিতেছিল সেইদিকে দুই-চারিপদ যাইয়াই দেখিতে পাইলেন, একটা লোক মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে; বুঝিলেন, তখনও লোকটা মরে নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শেষ উদ্যম

যখন দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, লোকটা পূৰ্ব্বাপেক্ষ অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়াছে; জিজ্ঞাসিলেন, “কি হে ভদ্রলোক! আমি এখন তোমাকে যা’ যা’ জিজ্ঞাসা করব, ঠিক ঠিক তার উত্তর দেবে কি? যদি না আমার হাত থেকে সহজে নিস্তার পাবে না—তোমার জিহ্বাটা টেনে ছিড়ে ফেলে দিব।”
সেই লোকটা ভয়ে ভয়ে বলিল, “আপনি আমাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান?”
দেবেন্দ্র। জুমেলা কি প্রকারে মুক্তি পাইল?
লোক। আমি তাকে মুক্তি দিয়েছি।
দে। সেখানে আর একটা যে স্ত্রীলোক ছিল, সে কিছু বলে নাই?
লো। আমি আগেই তাকে তার অলক্ষ্যে ক্লোরফৰ্ম্ম ক’রে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসি।
দে! গাড়ী! কোথাকার গাড়ী?
লো। পুৰ্ব্বদিক্কার পথের ধারে আগে একখানা গাড়ী এনে ঠিক করে রেখেছিলেম।
দে। কার আদেশে?
লো। জুমেলিয়ার।
দে! কি জন্য গাড়ী এনে রেখেছিলে?
লো। জুমেলিয়ার মুখে শুনলেম, তার সঙ্গে আপনি কোথা যাবেন বলেছিলেন।
দে। সে গাড়ীতে আর কে আছে?
লো। গিরিধারী নামে আমারই একজন বন্ধু—আমার সেই বন্ধুকেই আপনার সঙ্গী লোকটা নীচে বেঁধে ফেলে রেখেছিল; আমি গিয়ে তাকে উদ্ধার করি; তার পর আপনাদের এখানকার ব্যাপার চুপিসারে এসে দেখি; সুবিধাক্রমে কাজ শেষ করি—তারা এখন সব চ’লে গেছে।
দে। তুমি গেলে না কেন? তুমি যে বড় থেকে গেলে?
লো। আপনাকে খুন করবার জন্য।
দে। আমাকে খুন করিয়া তোমার লাভ?
লো। জুমেলিয়ার লাভ।
দে। তা’তে তোমার কি?
লো। জুমেলিয়ার লাভে আমার লাভ।
দে। গাড়ীখানা কোথায় গেল?
লো। দমদমার দিকে।
দে। দমদমার কোথায়—কোন ঠিকানায়?
লো। ঠিকানা ঠিক জানি না—তবে বেলগাছি ছাড়িয়ে যেতে হবে।
দে। বেলগাছি ছাড়িয়ে কত দূর যেতে হবে?
লো। শুনেছি, বেশি দূর না—দু-চারখানা বাগানের পরেই একটা গেটওয়ালা বাগান আছে, সেই বাগানের ভিতরে।
দে। ও বুঝেছি! হরেকরামের বাগান বুঝি?
লো। হাঁ—হাঁ—ঠিক ঠাওরেছেন।
দে। যদি তা’ না হয়—যদি মিথ্যা ব’লে থাক—তোমায় আমি—
বাধা দিয়া আহত ব্যক্তি বলিল, “আমি মিথ্যাকথা বলি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “জুমেলিয়ার সঙ্গে তোমার আর তোমার বন্ধুর কতদিন পরিচয় হয়েছে?”
“এক সপ্তাহ হ’বে।”
“সে বাগানে আর কেউ আছে?”
“একজন দরওয়ান—তার নাম পাহাড় সিং।”
“জুমেলা আর তোমার বন্ধু গিরিধারী কতক্ষণ গেছে?”
“আমি যখন আপনার সঙ্গীকে গুলি করি, তার একটু আগে।”
“আমাকে খুন করতে তুমি থেকে যাও, কেমন? আমাকে খুন, করবার কারণ কি? জুমেলিয়ার লাভ কি রকম?”
“জুমেলা যাবার সময় ব’লে গেছে, আপনাকে খুন করলে সে আমাকে বিবাহ করবে।”
“তুমি কি তাকে বিশ্বাস কর?”
“আগে করেছিলাম বটে।”
শচীন্দ্রের ক্রমে জ্ঞান হইতে লাগিল; অল্পক্ষণ পরে উঠিয়া বসিল। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, ‘শচী, চলিতে পারিবে?”
শ। পারিব।
দে। জুমেলা এখন কোথায় যাইবে আমি জেনেছি – আমি এখনই তার সন্ধানে চললেম; তুমি এখন এখানে থাক—যতক্ষণ না আমি ফিরে আসি, ততক্ষণ তুমি এইখানেই থাক; সুবিধামত কোন পাহারাওয়ালাকে রাস্তায় পেলে তোমার সাহায্যার্থ তাকে এখানে পাঠিয়ে দিব।
দেবেন্দ্রবিজয় এই বলিয়া ক্ষিপ্ৰপদে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।

অতি অল্পক্ষণে তিনি ছুটিয়া আসিয়া জগুবাবুর বাজারের পথে পড়িলেন, তথায় দুই-একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী তখনও আরোহীর অপেক্ষায় ছিল। দেবেন্দ্রবিজয় লাফাইয়া একখানি- গাড়ীর কোচ বক্সে গিয়া উঠিলেন; ঘোড়ার লাগাম ও চাবুক স্বহস্তে গ্রহণ করিয়া গাড়ী জোরে হাঁকাইয়া দিলেন। গাড়োয়ান তাহার সেই অদৃষ্টপুৰ্ব্ব কাৰ্য্যকলাপ দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল; দেবেন্দ্রবিজয়কে পাগল অনুমানে শঙ্কিত হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিল, “গাড়ী দমদমায় যাবে, বিশেষ দরকার। বাধা দিয়ো না; বাধা দাও—গাড়ী থেকে ফেলে দিব; চুপ ক’রে বসে থাক; যদি দশ টাকা ভাড়া পেতে চাও- কোন কথাটি ক’রো না, চুপ্‌ ক’রে বসে থাক।”
গাড়োয়ান অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া চুপ্‌ করিয়া বসিয়া রহিল। সে দুইদিনে কখন দশ টাকা রোজগার করিতে পারে নাই, এক রাত্রেই দশ টাকা পাইবে শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল।
গাড়ী নক্ষত্ৰবেগে ছুটতে লাগিল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
উদ্যমের শেষ

দেখিতে দেখিতে গাড়ীখানা শ্যামবাজার অতিক্রম করিয়া অতি অল্প সময়ের মধ্যে দমদমায় আসিয়া পড়িল। এখনও সেইরূপ তীরবেগে গাড়ী ছুটিতেছে।
যখন সেই গাড়ী হরেক্‌রামের বাগানের নিকটবৰ্ত্তী হইয়াছে, তখন গাড়ীখানার সম্মুখের একখানি চাকা খুলিয়া গেল-গাড়ী দাঁড়াইল। দেবেন্দ্রবিজয় কি এখন চুপ করিয়া থাকিতে পারেন—লাফাইয়া ভূতলে পড়িলেন; নিৰ্ব্বাক্ গাড়োয়ানের হাতে একখানা দশ টাকার নোট ফেলিয়া দিয়া রুদ্ধশ্বাসে ছুটলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় মরুদ্বেগে ছুটিতে লাগিলেন—ক্ষণকালের মধ্যে হরেক্রামের উদ্যান-সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। উদ্যানের মধ্যে আসিয়া পশ্চিমাভিমুখে চলিলেন, কিয়দর গমন করিয়া একটা দ্বিতল অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন, তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া বামপার্শ্বস্থ সোপানীতিক্রম করিয়া উপরে উঠিলেন। বারান্দার বসিয়া পরম নিশ্চিন্তমনে পাহাড় সিং তাম্রকুটধর্ম পান করিতেছিল—দেবেন্দ্রবিজয় নিঃশব্দে তাহার পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইলেন। পাহাড় সিং হুঁকার যেমন একট লম্বা টান দিতে আরম্ভ করিয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় উভয় হস্তে তাহার গলদেশ টিপিয়া ধরিলেন। সুখটানে বাধা পড়িল—হু কার কলিকা ফেলিয়া পাহাড় সিং গোঁ গোঁ করিতে লাগিল—ক্রমে অজ্ঞান হইয়া পড়িল, চক্ষু উল্টাইয়া গেল। তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাহার গলদেশ ছাড়িয়া দিলেন, তাহারই পরিহিত বস্ত্রে তাহার হস্তপদ বন্ধন করিলেন ও মুখবিবরে খানিকটা কাপড় প্রবেশ করাইয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন; তাহার পর দ্রুতপদে নিম্নে অবতরণ করিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ
শেষ

বৈঠকখানা গৃহে দেবেন্দ্রবিজয় প্রবিষ্ট হইলেন, তথার কেহ নাই। একপার্শ্বে একটা অৰ্দ্ধমলিন শয্যা ছিল, তাহার উপরে ক্লান্তভাবে বসিয়া পড়িলেন। অনেকক্ষণ পরে উদ্যানের বাহিরে একটা সচল গাড়ীর ঘর্ঘর ধ্বনি উঠিল। দেবেন্দ্রবিজয় গবাক্ষ দিয়া জ্যোৎস্নালোকে দেখিলেন, একখানি গাড়ী ফটক দিয়া উদ্যান-মধ্যে আসিল; বুঝিতে পারিলেন, তন্মধ্যে জুমেলিয়া ও তাহার পত্নী আছে, উপরে যে ব্যক্তি বসিয়াছিল, সে সেই গিরিধারী সামন্ত।
গাড়ীখান ক্রমে অট্টালিকার দ্বারসমীপ্লাগত হইয়া দাঁড়াইল—লাফাইয়া গিরিধারী সামন্ত অগ্ৰে ভূতলে অবতরণ করিল।
“পাহাড় সিং! পাহাড় সিং!” জুমেলা চীৎকার করিয়া ডাকিল। পাহাড় সিং উত্তর করিল না। কে উত্তর দিবে?
গিরিধারী সামন্ত বলিলেন, “মরুক্‌ ব্যাটা—হতভাগা পাজী! গেল কোথায়?”
জুমেলিয়া বলিল, “হয় ত ব্যাট সিদ্ধি গাঁজা খেয়ে, বেহুস হয়ে পড়ে আছে—মরুক সে! গিরিধারী, তুমি আমার ভগিনীকে তুলে নিয়ে যাও।”
“ভগিনী! জুমেলিয়ার?” মৃদুগুঞ্জনে ডিটেক্‌টিভ আপনা-আপনি বলিলেন–তাঁহার আপাদমস্তক বিকম্পিত হইল।
গিরিধারী জিজ্ঞাসিল, “ম’রে গেছে না কি?”
ঈষদ্ধান্তে জুমেলিয়া বলিল, “মরেছে? না—এখনও মরে নি; যাও ইহাকে তুলে নিয়ে যাও।”
গিরি। কোথায় নিয়ে রাখব?
জু। বৈঠকখানা ঘরে।
বৈঠকখানার ভিতরে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাদের অপেক্ষায় ছিলেন। গিরিধারী সেই কক্ষেই আসিবে জানিয়া, দ্বারপার্শ্বে লুক্কায়িত রছিলেন। তখনই সংজ্ঞাহীন রেবতীকে লইয়া গিরিধারী তথায় প্রবিষ্ট হইল। তথায় আলো না থাকায় সে দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিতে পাইল না। পশ্চিমপার্শ্বস্থিত অৰ্দ্ধোন্মুক্তবাতায়নপ্রবিষ্ট জ্যোৎস্নালোকে ঘরটি অস্পষ্টভাবে আলোকিত; তৎসাহায্যেই গিরিধারী শয্যাটী দেখিতে পাইল, তদুপরি রেবতীকে রাখিয়া বহির্গমনোদ্যোগ করিল।
এমন সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় নিঃশব্দে তাহাকে আক্রমণ করিলেন; যেরূপে তিনি পাহাড় সিংকে বন্দী করিয়াছিলেন, সেইরূপে গিরিধারীকেও বন্দী করিলেন; কোন শব্দ হইল না; অথচ কাৰ্য্যসিদ্ধ হইল। তাহার মৃতকল্পদেহ পালঙ্কের নিম্নে রাখিয়া দিলেন।
তৎপরেই তিনি রেবতীর নিকটস্থ হইলেন, তাঁহার মুখের নিকট মুখ লইয়া সেই অস্পষ্টীলোকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, রেবতী এখন ক্লোরফৰ্ম্মের দ্বারাই অচেতন আছে মাত্র। আশঙ্কার কোন কারণ নাই। দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুস্বরে বলিলেন, “হতভাগিনি! তোমার দুর্দিন এইবার শেষ হইবে।”
বাহির হইতে জুমেলিয়া ডাকিল, “গিরিধারি! গিরিধারি!”
দেবেন্দ্রবিজয় গিরিধারীর কণ্ঠস্বর অনুকরণ করিয়া বলিল, “আবার কি –কি হয়েছে? চ’লে এস না তুমি।”
জুমেলিয়া বাহির হইতে বলিল, “এখান থেকে ঔষধের বাক্সট আর কাপড়গুলো নিয়ে যাও।”
পূৰ্ব্ববৎ দেবেন্দ্রবিজয়, “রেখে দাও—তোমার কাপড় আর বাক্স, আমি তোমার বোনকে নিয়ে দস্তুরমত একটা আছাড় খেয়েছি।” শুনিতে পাইলেন, জুমেলিয়া তাহার কথা শুনিয়া অত্যন্ত হাসিতেছে; গবাক্ষ দিয়া দেখিলেন, জুমেলিয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল; তাহার হস্তে সেই কিরীচ উন্মুক্ত রহিয়াছে, চন্দ্ৰকরে সেটা বিদ্যুদ্ধত ঝক ঝক করিতেছে।
ক্রমে জুমেলিয়া বৈঠকখানা গৃহের নিকটস্থ হইল; দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিম্নকণ্ঠে ডাকিল, “গিরিধারী!”
তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাহার গুপ্ত লণ্ঠন বাহির করিয়া স্প্রীং টিপিয়া দিলেন; উজ্জল স্বতীব্র আলোকরশ্মিমালা জুমেলিয়ার চক্ষু ধাঁধিয়া তাহার মুখের উপরে পড়িল।
কর্কশকণ্ঠে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “গিরিধারী এখানে নাই; তোমার অপেক্ষায় আমিই আছি, জুমেলা।”
“দে-বে-দ্র-বি-জ-য়!” জুমেলিয়া সবিস্ময়ে বলিল।
“হাঁ, দেবেন্দ্রবিজয়—তোমার যম—তোমার শক্ৰ—তোমার পরম শক্ৰ ৷ এক পা যদি নড়বে, এখনই তোমাকে গুলি করব—এতদিন তুমি আমাকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছিলে; তোমার জন্য কতদিন আমার অনাহারে কেটে গেছে; এমন কি নানাপ্রকার দুর্ঘটনায় আমার মস্তিক্ষও তুমি বিকৃত ক’রে দিয়েছ; আজ তোমার নিস্তার নাই; দেবেন্দ্রের হাতে তোমার কিছুতেই নিস্তার নাই—এক পা অগ্রসর হইলেই গুলি করব।” দেবেন্দ্রবিজয় ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিলেন; তাঁহার চক্ষু দিয়া তখন যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছিল।
জুমেলিয়া ভয় পাইল না; তাহার অখণ্ড প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রাখিয়া স্মিতমুখে বলিতে লাগিল, “মাইরি! গুলি করবে? তুমি! দেবেন্দ্রবিজয়! জুমেলিয়াকে? পার না—তোমার সাধ্য নয়—তোমার হাতে মৃত্যুতেও জুমেলিয়ার কলঙ্ক আছে। দেবেন! তোমার হাতে মরব! হায়! হ’য়ে কেন মরি নাই! মাতৃস্তন্য – কেন আমার বিষ হয় নাই! যাকে ভালবাসি, তার হাতে আমি মরব! কষ্টকর— বড় কষ্টকর—সে মৃত্যু বড় কষ্টকর, দেবেন! দেবেন, এখনও বলছি, তোমাকে আমি ভালবাসি—আগে বাসতাম, এখনও বাসি— – ম’রেও ভুলতে পারব, এমন বোধ হয় না। ভালবাসি বলিয়াই ত আমি আজ না এই বিপদগ্রস্ত; নতুবা এতদিন তোমাকে আমি কোন কালে এ সংসার থেকে বিদায় দিতাম। অনেকবার মনে করেছি— পারি নাই; ঐ মুখ দেখেছি—ভুলে গেছি—সব ভুলে গেছি। আপনাকে ভুলে গেছি, আপনার কর্তব্য ভুলে গেছি, জগৎ-সংসার ভুলে গেছি। শোন দেবেন, যদি তুমি আমার প্রতিদ্বন্দী না হ’তে, তোমার অপেক্ষ সহস্ৰগুণে শ্রেষ্ঠ কোন গোয়েন্দা আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিত, সে কখনই আমার কেশস্পর্শও করতে পারত না। অবলীলাক্রমে আমি তাহাকে নিহত করতেম। এই তুমি—তোমার রূপে—তোমার গুণে যদি না আমি ভুলতেম—তা’ হ’লে তুমি এতদিন কোথায় থাকতে—কি হ’ত তোমার, কে জানে? এতদিন তুমি আবার কোথায় নূতন জন্মগ্রহণুy করতে। তোমাকে ভালবাসিয়াই ত সৰ্ব্বনাশ করেছি—নিজের মৃত্যু— নিজের অমঙ্গল নিজে ডেকেছি। কি করব? মন আমার বশীভূত নয়। আমি মনের দাস। যখন তুমি তোমার গুরু অরিন্দম গোয়েন্দার সাহচৰ্য্য কর, আমার গুরুই বল, স্বামীই বল—ফুলসাহেবকে গ্রেপ্তার কর, তখন হ’তে তোমাকে আমি কি চোখে দেখেছি, তা জানি না। দেবেন, এটা যেন চিরকাল স্মরণ থাকে—যে জুমেলা তোমার পরম শক্ৰ, সেই জুমেলাই তোমার প্রেমাকাজিহ্মণী; যে জুমেলার তুমি পরম শক্ৰ, সেই জুমেলার তুমি প্রাণের রাজা। তোমার হাতে মৰ্বতে, মৃত্যুযন্ত্রণা বড় ভয়ানক হবে; নিজে মরি—দেখ—তোমার সামনে মরি—হাসতে হাসতে মরতে পারব। তুমিও জুমেলার মৃত্যু হাসিমুখে দেখতে থাক, জুমেলাও তোমাকে দেখতে দেখতে হাসিমুখে মরুক।” এই বলিয়া জুমেলিয়া সেই কিরীচ নিজের বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিল। ভলকে ভলকে অজস্ৰ শোণিত নিঃসৃত হইতে লাগিল। বুকের ভিতরে অত্যন্ত যন্ত্রণা হইতে লাগিল, করতলে বুকের সেই ক্ষতস্থান চাপিয়া বাত্যাবিচ্ছিন্ন বল্লরীর ন্যায় জুমেলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে গৃহতলে পড়িয়া গেল। মুখ ও দৃষ্টি সৰ্ব্বাগ্রে মৃত্যুচ্ছায়ান্ধকারমান হইয়া আসিল। তখনও সেরূপ প্রবলবেগে তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ পরিহিত বসন ও গৃহতল প্লাবিত করিয়া শোণিতপাত হইতে লাগিল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন বাতবিকম্পিত, রক্তচন্দনাক্ত রক্তপদ্মবং জুমেলিয়া। সেইখানে পড়িয়া লুটাইতে লাগিল—তখনই তাহার মৃত্যু হইল।
দেবেন্দ্রবিজয়ের পরম শত্রু এইখানে এইরূপে পরাভূত ও নিহত হইল।

সে সময়ে কেহ যদি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখিত, অবশ্যই সে দেখিতে প্লাইত, দেবেন্দ্রবিজয়ের চক্ষু, তখন নিরশ্রু বা শুষ্ক ছিল না। সেই সময়ে তাহার সেই বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষু দুটিতে দুইবিন্দু জল ছলছল করিতেছিল।

সমাপ্ত।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত